যেন পুষ্পবৃষ্টি, যেন আকাশ থেকে দেবতারা বর দিলেন! এই যে ১৯৬৯ সালে সত্যজিৎ রায় ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ নামে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করলেন তার দিকে তাকিয়ে এখন এর বেশি আর কিছুই বলার নেই। একথা তো অতি অবান্তর যে সত্যজিৎ রায় একটি মহৎ ছবি তৈরি করেছেন। কেননা সত্যজিৎ রায় সাধারণত সেরকমই তৈরি করতেন পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে, এটা তাঁর অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। এমনও নয় যে তার কারুকৃতিত্ব অসামান্য বলেই আমরা মজেছিলাম। তিনি এমন কথা বলতেন, এমন ভাবে বলতেন যে তা জনচিত্ত হরণ করত। যেমন ভগীরথ গঙ্গাকে টেনে এনেছিলেন, তেমনভাবেই চলচ্চিত্র ভাষাকে বাঙালিদের মধ্যে সত্যজিৎ রায় প্রসারিত করেছিলেন। একথা সহজ সত্য। কিন্তু ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ আমাদের সমস্ত হিসেব নিকেশের বাইরে। আজ পর্যন্ত বাঙালি শিশুদের জন্য আর কেউ এমন এত সদয় হননি।
বাঙালি শিশুদের খুশী করার জন্য আমরা যে ছবিগুলিকে দেখেছি তা সাধারণত হিতোপদেশ অথবা দুষ্টু ছেলেকে ভালো করার উপায়। এগুলো গুরুমশায়গিরি। এমনকি ঋত্বিক ঘটকের ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ প্রসঙ্গেও মনে হয় যে তাতে ঋত্বিক যতটা অন্যমনস্কভাবে সমাজচেতনা নিয়ে চিন্তা করেছেন ততটা বোধহয় শিশুরা করে না। শিশুরা একটা বড় বাড়ি দেখে অবাক হয়। ঋত্বিক ঘটক সঠিকভাবেই তার লো অ্যাঙ্গেল ক্যামেরা ব্যবহার করেছেন। কিন্তু শিশুরা বড়দের মতো দেশ বিভাগের কারণ বা মানুষের দুর্গতি দেখে চিন্তান্বিত হয় না। ‘তেলের শিশি ভাঙল ব’লে / খুকুর পরে রাগ করো / তোমরা যে সব বুড়ো খোকা / ভারত ভেঙে ভাগ করো! / তার বেলা?’ এটা শিশু বলে না। শিশুর হয়ে যারা কথা বলার তারা বলে। যেমন ‘খোকা মাকে শুধায় ডেকে-- / “এলেম আমি কোথা থেকে, / কোন্খানে তুই কুড়িয়ে পেলি আমারে।‘ এটা শিশু কোনোদিন মাকে জিগ্যেস করেনি। মার মনে হয়েছে শিশু এরকম একটা জিজ্ঞাসা করতে পারে। আর সেটা আমাদের ভাল লেগেছে কিন্তু তা সম্পূর্ণ যুক্তিহীন আনন্দ নয়। যেটা অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুকুমার রায় এবং ঘটনাক্রমে চলচ্চিত্রে সত্যজিৎ রায়ের এই ছবিটিতে আছে। সত্যজিৎ রায় ‘সোনার কেল্লা’ করেছেন বা অন্যান্য ছবি করতে পারেন কিন্তু সেগুলো দেখবেন কিশোরদের জন্য। এই একমাত্র ছবি তাঁর ঠাকুরদাদার প্রতি প্রণতি জানিয়ে তিনি করেছেন। সত্যিই যদি আজ স্বর্গের অবিনশ্বর অতিথিশালায় সমস্ত রায় পরিবারের পুনর্মিলন হয়, তাহলে এই ছবিটি দিয়েই সত্যজিৎ রায় তার পিতামহকে প্রণাম করবেন।
ছবিটিতে যা আছে তাকে রূপকথা বলা যায় না। রূপকথার ধারণায় আমরা সায় দিয়ে ফেলি তা নাহলে দেখবেন এই ছবিটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ যাকে ‘গ্রাম্য সাহিত্য’ বলেছিলেন এ তাই। কোনক্রমেই রূপকথা নয়। রূপকথায় যেমন অলীক কর্মকাণ্ড হয় সবসময় কিন্তু গুপী গাইন বাঘা বাইন-এ তেমন কিন্তু অলীক হয় না। তার রাজা কিন্তু ‘চেঁচাইছিলি কেনে?’ এই ধরনের গ্রাম্য কথাবার্তা বলেন। এই রাজাকে আমরা অনেকসময় চিনি। গুপী এবং বাঘা এই যে দুজন গ্রাম্য মানুষ এদেরও আমরা চিনি। এদের আলাপ পরিসরকে আমরা বুঝতে পারি। এরা যে ফর্সা রাজকন্যাকে বিয়ে করতে চায় তাই দেখে আমরা বুঝি যে এটি আমাদের আটপৌরে চৌহদ্দির গল্প। এবং সত্যজিৎ রায়ের কাছ থেকে বোঝার যে এই গ্রাম্য সাহিত্যটিকে তিনি আসতে আসতে কি করে বিশ্বাসের জগতে নিয়ে গেলেন। আমার মনে হয় আমরা সত্যজিৎ রায়ের কাছ থেকে অনেক কিছুই জানতে পারি। এই ছবি থেকে যা শিখতে পারি তা হল কত কম বাজেটে একটা অত্যুৎকৃষ্ট ছবি তৈরি করা যায়। ‘পথের পাঁচালী’ এ প্রমাণ রেখেছিল। কিন্তু তবুও ‘পথের পাঁচালী’ একজন প্রামাণ্য সাহিত্যিকের লেখা। অধিকন্তু ‘পথের পাঁচালী’ থেকে চিত্রনাট্য করার সময় সত্যজিৎ রায় একটা ছাঁচ পেয়েছিলেন। এবং ‘পথের পাঁচালী’র যে সাফল্য সেটা কিন্তু সর্বসাধারণের জন্য। আর ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ যাদের জন্য করা হচ্ছে তাদের অনেকেরই ন-দশ বছরের নীচে বয়েস। তারা এত জটিলতা খুঁটিয়ে দেখে না। তারাও কিন্তু শেষে রং ব্যবহারটাকে মেনে নিয়েছিল কেননা একজন রাজকন্যা তাকে দুভাগে ভাগ করা যায় না। এটা তাদেরও মনে হয়েছিল যাঃ এ কখনও হয়! এই যে অবিশ্বাস্যকেও বিশ্বাস্য করে তোলার ক্ষমতা সেটা সত্যজিৎ কিভাবেই না করেছিলেন! আজকে দেখি থরে থরে সৌন্দর্য এই সিনেমায়।
আমি শুধু এই ছবির গানের কথাই বলছি না। যদি গানের কথা ভাবেন তাহলে দেখবেন যে এই গানগুলো এমনভাবে করা আছে যেগুলো ঠিক ওস্তাদি গায়কের মত নয়। যে গানগুলো গুপী গায় সেগুলো কিন্তু অঙ্গভঙ্গি করে গাইতে হয়। বাচ্চারা এই অঙ্গভঙ্গীটাকে খুব পছন্দ করে। যেমন ‘থেমে থাক’ বলার সঙ্গে সঙ্গে যে ধরনের শরীরের ভঙ্গি করতে হয়। গানগুলোকে যেভাবে ভেঙে করা হয়েছে — এই গানগুলো শুধু গাওয়ার বদলে ছবিগুলো আমাদের সামনে ভাসতে থাকে। অর্থাৎ গুপী বাঘার অঙ্গভঙ্গির সঙ্গে সঙ্গে গানগুলোর চরণ নির্দিষ্ট হয়। গানগুলোর তাল নির্দিষ্ট হয়। তা শিশুরা খুব অনুভব করে। শিশুরা, যতই প্রতিভাবান হোক না কেন, তারা ওস্তাদি গানের কারুকাজ বোঝে না। সেটা তাদের বাপ-ঠাকুরদার বোঝার কথা। ফলে ঐ যে রাজসভায় অত ওস্তাদী গানের কারুকাজ যা দেখে গুপীবাঘা অবাক হয়ে যায়, এবং তারপরে তারা যখন ‘মোরা বাংলাদেশের থেকে এলাম’ বলে অতি সরল একটি গান করে তখন সকলেই মুগ্ধ হয়ে যায়। আর শিশুরা ভাবে এটি তাদেরই জয় হল। কেননা তারা তো এই সরল গানই চেয়েছিল, যে গান তারা করতে পারবে। যে গান তারা করতে পারে না তার দিকে তারা থতমত খেয়ে তাকায় ও ভাবে বড়রা এটা বোধহয় অদ্ভুত কিছু একটা করছে। এটা আমাদের নয়। তারা এই প্রথম দেখল যে তাদের মতো কিছু হচ্ছে।
যেমন বিখ্যাত ভূতের নাচ। সাড়ে ছয় মিনিটের। আজকে যারা ছবি করেন এই জায়গাটা সবচেয়ে বেশি শিক্ষনীয়। তার কারণ আজকে অ্যানিমেশন এসে গেছে। 2D অ্যানিমেশন, 3D অ্যানিমেশন এবং এই অ্যানিমেশনের জন্য কত বিপুল পয়সা লাগে। হলিউডের ছবি বা ইউরোপের ছবিতে যখন অ্যানিমেশন প্রয়োগ করা হয় সেই অ্যানিমেশনে পয়সার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু মনে রাখতে হবে সত্যজিৎ রায় সামান্য রংটুকু চেয়েও প্রযোজকের কাছ থেকে পাচ্ছিলেন না। এবং এখানেই তাঁর প্রতিভা যেমনভাবে সত্যিকারের গৃহিণীর প্রতিভা সামান্য তেল, নুন দিয়ে অমৃত ব্যঞ্জন রান্না করার। যে তিনি সাড়ে ছয় মিনিটে একেবারে হস্তনির্মিত কতগুলো এফেক্টের মাধ্যমে ভূতের নাচ করান। সেই ভূতের নাচে আপনারা সমাজ চেতনা দেখতে চান অর্থাৎ সেই পৌরাণিক যুগের চতুর্বর্গীয় রূপ। বা সাহেবদের সময় বাঙালির সমাজচিত্র ইত্যাদি সবই দেখতে পারেন। আবার বাচ্চারা তাদের মতো করে ভূতকেও দেখতে পারে। এই ভূতকে বাচ্চারা ভয় পায় না। এই ভূত বীভৎস নন। এর দাঁত দুটো একটু বড়, কিন্তু এই ভূতকে বাচ্চারা অনেকসময় নিজেদের আত্মীয় ভাবে। বাচ্চারা কিন্তু এমন ভূতই চায় যে ভূত তাদের খুব স্তম্ভিত করবে না, খুব হতবাক করবে না। এই ভূত বেশ মজার ভূত। ‘ভূতের রাজা দিল বর’ বলে যে বর ভূতের রাজা দেন, তাতে বাচ্চারা ভারী খুশি। তারা চিরদিন খেতে চেয়েছে, কিন্তু
তাদের দাদু-দিদা বা মা-ঠাকুমা তাদের পেট খারাপ হবে বলে আটকে রখেছে। এখন গুপী-বাঘা হাততালি দেওয়া মাত্র যত খাবার এল গুপী বাঘা তো খেলই, তার সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ-লক্ষ, কোটি কোটি বাঙালি শিশু প্রাণ ভরে খেয়ে নিল। বাস্তবে না হোক সিনেমার পর্দায়। আমি অজস্র শিশুকে জিগ্যেস করে দেখেছি যে তারা 'সত্যজিৎ রায় কে? কত বড় পরিচালক?' এসব না জেনে রবি ঘোষ এবং তপেন চ্যাটার্জিকে প্রাণের করে নিয়েছে। কেননা তারা বুঝেছে যে গল্পটা তাদেরই। গল্পটা বড়রা দাবী করছে কিন্তু আসলে গোপনে ষড়যন্ত্র করে সত্যজিৎ রায় তাদের জন্য বানিয়ে ফেলেছেন।
আজকে এই ছবির পঞ্চাশ বছর। আজকে যখন দেখি বাংলা ছবি কিছুতেই জনপ্রিয় হয় না। সবসময়ই মনে হয় পরীক্ষার পরের সময়টা, মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকের পরে, দলে দলে লোক ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ দেখার জন্য ভিড় করেছে। কি আছে ছবিটায় বুঝতে পারি না। কিন্তু সন্তোষ দত্তের মতো ওরকম রাজা। বাঘার ওরকম হাত নাড়ানো এবং গুপীর ওরকম গান আর ওরকম সাদামাটা বাঙালি। যারা রাজস্থানে গিয়েও জয় করে আনতে পারে। এই যে বাঙালির সর্বজনীনতা এটা যে সত্যজিৎ রায় কী প্রতিভায় তৈরি করেছিলেন, যারা মনে করেন পয়সা দিয়ে সিনেমা হয় তাদের সব্বাইকে বোকা বানিয়ে, প্রায় ছোটোরা যেমন করে বড়দের অনেকসময় ফাঁদে ফ্যালে তেমন করে হঠাৎ এই ছ ফুট চার ইঞ্চি উচ্চতার মানুষটি সমস্ত বাঙালি জাতিকে ফাঁদে জড়িয়ে মুগ্ধ করে রাখলেন। এই ছবির পঞ্চাশ বছর উপলক্ষ্যে তাঁকে প্রণাম।