প্রাগ স্টেশনে যখন নামলাম তখন দুপুর সোয়া তিনটে। ট্রেন ধরেছিলাম ভিয়েনা থেকে বেলা এগারোটায়। চার ঘন্টার রাস্তা বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে কেটে গেছে। ম্যাপ দেখে বুঝলাম হোটেলে পৌঁছতে বাস বা ট্রামে বেশ ঝামেলা আছে, কারণ পুরনো শহরের অনেক জায়গাতে বাস বা ট্রাম ঢোকা নিষেধ, এই নিয়মটা ইউরোপের বেশ কিছু জায়গায় রয়েছে, পথটা অনেক ঘুরে এবং নেমে আবার বেশ খানিকটা হাঁটতে হবে। চাকুরিজীবী মানুষের দেশের বাইরে বেড়াতে যাওয়ার এক বিড়ম্বনা হল এই যে পদে পদে টাকাপয়সার খরচ মাথায় রাখতে হয়। আমরা যেহেতু তিনজন, মানে আমি, আমার স্ত্রী এবং কন্যা, হিসেব করে দেখা গেল, তিনজনের পাবলিক ট্রান্সপোর্টের ভাড়ার থেকে অল্প বেশি দিয়ে একটা ট্যাক্সি নেওয়া যেতে পারে। একটু খরচ হলো কিন্তু বেশ আরামে চট করে হোটেল পৌঁছে গেলাম। হোটেলটা একটি পুরনো বাড়ি থেকে বানানো, নাম হোটেল সেন্ট জর্জ, একটা পুরনো দিনের আমেজ একটু-আধটু পাওয়া যাচ্ছে ঘরগুলো আর সাবেকী আসবাব থেকে। সবথেকে বড় কথা দ্রষ্টব্যস্থানগুলো একদম কাছে, বিখ্যাত চার্লস ব্রিজ শুধু দুই মিনিট দূর।
সময়টা শীতকাল, টপ করে সন্ধ্যে নেমে গেল। হাত মুখ ধুয়ে বেরনো হলো আশপাশটা দেখা আর রাতের খাওয়ার জন্য। তারিখ ৩০ ডিসেম্বর, তাপমাত্রা শূন্যর নীচে, কিন্তু চতুর্দিক লোকে লোকারণ্য, সবাই ছুটি কাটাতে এসেছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। চার্লস ব্রিজের থেকে অপূর্ব দেখাচ্ছে শহরটাকে। নদীর উপর প্রাগ ক্যাসলের প্রতিচ্ছবি ভুলবার নয়।
চেক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী প্রাগ (স্থানীয় নাম প্রাহা)। আশ্চর্য ভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কোনো ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিল। এর অসাধারণ স্থাপত্য বিভিন্ন যুগের লম্বা ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয়। চার দশকের কমিউনিজম বাণিজ্যিকীকরণকে খানিকটা ঠেকিয়ে রেখেছিল। ইউরোপে আর কোন শহর নেই যার ঐতিহাসিক স্থাপত্য এমন সুন্দর ভাবে মিশে গেছে তার প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে। শহরের মাঝ দিয়ে দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে বয়ে গেছে ভ্লতাভা (Vltava) নদী। শহরের দুই দিক জোড়া লাগাতে নদীর উপর আছে আঠেরোটা ব্রিজ। পর পর ব্রিজগুলি বড়ই নয়নাভিরাম। শহরের প্রধানত পাঁচটা ভাগ – নদীর পশ্চিম দিকে ক্যাসল ডিস্ট্রিক্ট আর লোয়ার টাউন, পুব দিকে ওল্ড টাউন, জিউইশ কোয়ার্টার আর নিউ টাউন। লোয়ার টাউন আর ওল্ড টাউনের মাঝখানে চার্লস ব্রিজ। ভ্রমণকারীদের মোটামুটি এই জায়গাগুলিতেই আগ্রহ বেশি থাকে।
পরের দিন হোটেলে প্রাতঃরাশ সেরে বেরোলাম। চার্লস ব্রিজের উপর দিয়ে হন্টন, গন্তব্য ক্যাসল ডিস্ট্রিক্ট। ব্রিজ পেরিয়ে একটুখানি চড়াই, তবে বিশেষ কিছু নয়। মাঝপথে আবদার, স্টারবাক্স থেকে কফি। গেটে পৌঁছতে প্রায় মিনিট চল্লিশেক লাগল। তারপর বেশ বড়সড় লাইন। বিভিন্ন দ্রষ্টব্য থেকে, একটা দুটো তিনটে বা সবকটা, নিজেদের যেটুকু দেখার ইচ্ছে সেইটুকুর জন্য টিকিট কাটার বন্দোবস্ত আছে। দুটো জায়গা বিশেষ করে মনে দাগ কেটে আছে।
ঘোরাঘুরি করে বেশ খিদে পেয়েছে। ইউরোপে নভেম্বরের শেষ থেকে শুরু হয়ে যায় ক্রিসমাস মার্কেট। এখানেও রয়েছে, মেলার মত পরিবেশ, কত রকমের ভাষা শোনা যাচ্ছে চারদিকে, বিক্রি হচ্ছে খেলনা, ঘর সাজাবার জিনিস, খাবার দোকান ইত্যাদি। একটা দোকানে বিভিন্ন কড়াইতে বিভিন্ন খাবার গরম হচ্ছে, যেটা যেটা পছন্দ সেইগুলো বলে দিলেই সব একটা পাত্রে তুলে ওজন করে দাম দিতে হবে। আমরা নিলাম নানা রকম মাংস এবং হালুস্কি (halusky) বলে একটা রান্না, যা হল সেদ্ধ আলু , বাঁধাকপি ছোট ছোট করে কেটে ময়দা, চীজ আর ডিম দিয়ে হাল্কা করে ভাজা, এটা আসলে স্লোভাক খাবার। বেশ উপাদেয়, পেট ভরে যায়, স্বল্প দাম, ফাস্ট ফুড হিসেবে উত্তম। ব্যাসিলিকার পিছন দিকে জ্লাটা উলিকা (ইংরেজিতে Gold Alley), এখানে থাকত শহরের আল্কেমিস্টরা, ক্ষুদ্র বাড়িগুলো দুর্গের দেওয়ালের মধ্যে বানানো। রাস্তার শেষে পাহাড়ের উপর থেকে প্রাগ শহর দেখায় খুব সুন্দর।
১লা জানুয়ারি, ২০১৭। আজ যাব ওয়েন্সেলাস স্কোয়ার। মিনিট পনেরোতেই পৌঁছে গেলাম। এটা আমাদের এম জি রোড, ব্রিগেড রোডের মতো জায়গা, বড় বড় দোকান, রেস্তোরাঁ। তার মধ্যে দেখি একটা চার তলা জুতোর দোকান – আমাদের সবার চেনা বাটা। খানিকক্ষণ এখানে থেকে শহরটা একটু এক্সপ্লোর করার জন্য হাঁটা লাগালাম, আর এক রাস্তা ধরে পৌঁছে গেলাম নদীর ধারে।
যেতে যেতে রাস্তায় পড়ল একটা রেস্টুরেন্ট, নাম কাভারনা স্লাভিয়া। এখানে আড্ডা দিতেন অনেক সাহিত্যিক, শিল্পী এবং গুণীজন। তার মধ্যে একজন ভাক্লাভ হাভেল, ১৯৮৯-এর ভেলভেট রেভলিউশন-এর আন্যতম রূপকার, পরবর্তী কালে প্রেসিডেন্ট। এইসব দৃশ্য উপভোগ করতে করতে আবার এসে গেলাম ওল্ড টাউন। সাহিত্যপ্রেমীদের কাছে প্রাগ এক বিশেষ আকর্ষণ যার জন্য তিনি হলেন, দি ট্রায়াল এবং মেটামরফসিস রচয়িতা বিশ্ববরেণ্য ফ্রাঞ্জ কাফকা। ওল্ড টাউনে দেখতে পেলাম তাঁর জন্মস্থল, বাড়িটার গায়ে লাগানো আছে ধাতু দিয়ে তৈরি কাফকার প্রতিকৃতি। সেখান থেকে কাছেই জোসেফভ বা জিউইশ কোয়ার্টার, এই পাড়াটা একটু মন কেমন করা, ইংরেজিতে বললে মেলাঙ্কলিক। উল্লেখ্য যে কাফকা ছিলেন ইহুদি ধর্মাবলম্বী।
কাফে লুভ্র থেকে বেরোতে বেরোতে প্রায় বিকেল হয়ে গেল, তার পর এই পাড়াতেই উইন্ডো শপিং, খুচখাচ কেনাকাটা করতে করতে নেমে এল সন্ধ্যে।
এই লেখার শিরোনাম সম্পর্কে কিছু কথা। খ্রিস্টপূর্ব নবম শতাব্দীতে বর্তমান চেক প্রজাতন্ত্রের উত্তর ভাগে বসতি স্থাপন করে কেল্ট উৎসোদ্ভুত লোকেরা। তাদের নাম ছিল বোইই (Boii), এর থেকেই এই এলাকার নাম হয় বোহেমিয়া, যার মধ্যস্থলে রয়েছে প্রাগ। বোহেমিয়ান কথাটা পরবর্তী কালে যে অর্থে ব্যবহার করা হয় – ছন্নছাড়া, রীতিবিরুদ্ধ ইত্যাদি, তা শুরু হয় আনেক পরে উনবিংশ শতাব্দীতে। সেই থেকে শুরু করে লম্বা ইতিহাস, পঞ্চদশ শতাব্দীতে বোহেমিয়া চলে গেল অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের অধীনে, তার পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, কমিউনিসম এবং তার উৎখাত – যার পরিণতি দেশ ভাগ হয়ে তৈরি হোল দুই নতুন দেশ, চেক এবং স্লোভাকিয়া। একটা দরকারি তথ্য - চেক প্রজাতন্ত্র যদিও শেঙ্গেন ভিসার আওতায় পড়ে কিন্তু এদেশে ইউরো চলে না, এখানকার মুদ্রার নাম কোরুনা। ১ কোরুনা ভারতীয় প্রায় ৩ টাকার সমান।
৩রা জানুয়ারি, গন্তব্য স্ট্রাহোভ মনাস্টেরি। যেতে হবে আবার সেই চার্লস ব্রিজ পেরিয়ে। এইখানে প্রাগ ক্যাসল থেকেও যাওয়া যায়, কিন্তু তার জন্য হাতে অনেক সময় নিয়ে বেরোতে হয়। এবার চার্লস ব্রিজের কথা একটু বলি। হাওড়া ব্রিজ যেমন কলকাতার, আইফেল টাওয়ার প্যারিসের, সেই রকম চার্লস ব্রিজ হল প্রাগের প্রতীক। বহুদিন যাবত এইটা ভ্লতাভা নদী পেরনোর জন্য ছিল একমাত্র সেতু। ব্রিজের উপর রয়েছে অনেকগুলি বারোক (baroque) মূর্তি। ব্রিজের উপরে আগে বসত বাজার, এমনকি কখনো দেওয়া হতো ফাঁসি। দুই দিকে আছে দুটো টাওয়ার, যাবার পথে আমরা উঠলাম একটাতে, সে এক অপরূপ দৃশ্য।
আজ ঠিক করা হল যে রাতে হোটেলেই খাব। হোটেলটা ওল্ড টাউন স্কোয়ারের খুব কাছে একটা নিরিবিলি গলিতে। মেনু থেকে সিলেক্ট করে যে ছেলেটিকে অর্ডার দিলাম, সে অতি রূপবান পুরুষ, ইংরেজিতে বললে হ্যান্ডসাম। তিনি রোজ সকালে ব্রেকফাস্টের সময় থাকেন, এখন দেখলাম খুব হিমসিম খাচ্ছেন, প্রশ্ন করতে বললেন, আর বলবেন না, আজ অন্যরা ছুটিতে, আমি একাধারে রিসেপশানিস্ট, ওয়েটার এবং কুক। একটু দেরি করে খাবার আসলেও, অতি সুস্বাদু। বলে রাখি যে চেক বিয়ার পৃথিবীবিখ্যাত এবং এখানে জলের দামের থেকেও সস্তা।
৪ঠা জানুয়ারি, আজ শেষ দিন। হাতে অবশ্য সময় আছে। সকাল বেলা প্রাতঃরাশ সেরে চেকআউট করে নিলাম, মালগুলো রেখে দেওয়া হল হোটেলেই। কাছেপিঠেই থাকব। একটা জিনিস দেখা বাকি, কাফকা মনুমেন্ট।
দুপুর বেলা ক্রিসমাস মার্কেটের স্টলের থেকে মধ্যাহ্নভোজ সারার সময় মনটা খারাপ লাগতে লাগল। পাঁচ দিন একটা শহরকে - যে অসামান্য শিল্প, সাহিত্য, স্থাপত্য, সঙ্গীত, ইতিহাসের ঐতিহ্য বহন করে চলেছে – অনুভব করার জন্য বড় কম। কত কিছুই তো দেখা হল না - ন্যাশানাল গ্যালারি, মিউজিয়ম, শহরের কাছে রয়েছে সুন্দর সব পার্ক এবং অনেক দুর্গ, তার মধ্যে কয়েকটিতে ইদানিং কালে শুট করা হয়েছে হিন্দি ছবি রকস্টার। এ ছাড়া চেক দেশের অন্যান্য জায়গা দেখা হয়নি, যেমন ফিল্ম উৎসবের জন্য বিখ্যাত কারলভি ভ্যারি। সুযোগ হলে আবার আসব এই আশা নিয়ে রওয়ানা হলাম এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে, বিকেল সাড়ে পাঁচটায় ফ্লাইট।