‘অসময়’ উপন্যাসটিতে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে শচিপতির ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। সে দেখেছিল তাদের পুরনো বাড়ির দক্ষিনের ফাঁকা বাঁধানো উঠোনে সংকীর্তন বসেছে। দাউ দাউ করে জ্বলছে হ্যাজাক বাতি। সবাই মিলে কীর্তন গাইছে আর মাঝখানে দাঁড়িয়ে হেলেদুলে ছোট্ট শচিপতি নাচতে নাচতে গাইতে শুরু করেছে। খানিক পরে অন্ধকার হয়ে এল, মাথার ওপরে ঘুটঘুটে আকাশ, অনেক তারা থমথম করছে। আর তার পায়ের তলায় বাবা মা কাকা কাকি বোন সবাই মিলে অদ্ভুত এক নীচু স্বরে গাইছে : ‘বল হরি, হরিবোল, বল হরি, হরিবোল’। মৃদু হয়ে আসছে সেই হরিবোলের স্বর আর শচিপতির মনে হচ্ছিল শ্মশানের কাছাকাছি এসে সবাই যেন বড় ক্লান্ত হয়ে গেছে। এই অংশটুকুই আমাদের অতর্কিতে ফেলে দেয় অস্তিত্বের এমন এক ভাঙনে যেখানে আলো নিভে আসছে, থেমে যাচ্ছে কোলাহল। কথা পাল্টে যাচ্ছে শব্দহীন আত্মকথনে, প্রকৃতিই হাতে তুলে নিচ্ছে সুখ ও দুঃখের পর্দা সরিয়ে দেবার, দেনাপাওনা পরিস্কার করে দেবার ভার। কোনটা আলো আর কোনটা অন্ধকার, কোনটা চর আর কোনটা জল তা তো স্থির হয়ে থাকে না, বদলে যায় এক লহমায়। মানুষ জেনে যায় নিয়তি তার আশেপাশে ঘুরছে, যে কোন সময় আঁচড়ে দেবে। শচিপতির মেজকাকি তো বলেই ফেলেছিল, “আমায় এবার যেতে দে। শেষ বয়সে ভগবানের সঙ্গে আমার ঝগড়াটুকু সেরে নেব”। সে ঝগড়া কি শেষ করা যায়? পুরনো বাড়ির গাছ গজানো মাটির তলায় সব ঝগড়া চাপা পড়ে যায়।
দুহাত মেলে গাছগাছালি ছড়িয়ে এক বাড়ি। প্রকৃতির দাক্ষিণ্য ও নিস্পৃহতা, হেমন্তের কুয়াশা আর দুরে ট্রেন ছেড়ে যাবার হুইসেল। সে বাড়ির গাঁথনিতে মায়া, যুক্তিহীন বাঁধন আর ভালবাসার স্মৃতিবিস্মৃতি। একদিন সেই বাড়িতে নদীর দিকের খোলা জানলা দিয়ে কোজাগরীর বাঁধভাঙা আলো ঘরে চামর দুলিয়েছিল। জ্বলেছিল জন্মসুখী প্রদীপ। মায়ের লক্ষ্মীপুজোর শাড়ির কোরা গন্ধে এসেছিল নবজাতক। বাড়ির কত্তা বলেছিল, অনেক আনন্দ অনেক সুধা থেকে কেউ ওকে কেড়ে এনেছে বলে শিশুটি কাঁদছে। পরে আর কাঁদবে না (সুধাময়)। পরে সুধাময় দেখেছিল সেই বাড়ির অন্য চেহারা, “ফাঁকা ধু-ধু মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে, নির্জন নিস্তব্ধ, গায়ে শ্যাওলা, সুপুরি আর নারকেল গাছের ঝাঁকড়া মাথা অন্ধকারে আড়াল দিয়ে”। নদীর দিকে মুখ করা লম্বা টানা বারান্দার উত্তর কোণ খানিকটা বন্যার জলে ধসে গিয়েছিল, সেই সঙ্গে সুধাময়ের বাবা। ঘোলা জলের তোড়ে ভেসে যাওয়া দেহ গিয়ে আটকে জিল জামরুল গাছেরগায়ে। অবিনের মায়ের মৃত্যুও তো এইরকম। “কিছু ভিজে চুল মার গলায়, গালে, কপালে আটকে আছে। দৃশ্যটি বড় আশ্চর্যরকম শান্ত, স্তব্ধ ও নিবিড়। অনাবিল জ্যোৎস্না মাথার ওপর, চারপাশ নিঃশব্দ ও নির্জন; রাশি রাশি জোনাকি উড়ছে ঝোপের মধ্যে আর আমার মা পুরু পুরু শ্যাওলার তলায় ডুবে শুয়ে আছে, যেন এতকাল মা যে শয্যায় শুয়ে এসেছে সেটা মার নিজের মনের মতন হয় নি” (অসময়)। প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বড় করে তৈরি বাড়ি জনহীন শব্দহীন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সেখানেই অভ্যাসবশে দিনের কাজ করে চলে একা এক নারী। হেমন্তের সন্ধ্যায় কুয়াশা আর ঠান্ডা নেমে আসে অযত্নের বাগান অন্ধকার করা বড় বড় গাছের মাথা বেয়ে নিচের দিকে। কলোনীর পাশেই রেল লাইন ধরে টানা হুইসল বাজিয়ে চলে যায় গোমো আর নাগপুরের ট্রেন। শব্দহীন এক চরাচরে বিমল করের মেয়ে কোলে হাতদুটো ফেলে বসে থাকে খড়, হিম আর শুকনো পাতার দিকে চোখ মেলে। ‘অসময়’ উপন্যাসের মোহিনীকে দেখে যেমন জ্যাঠামশায় ভাবছিলেন “আমার মাঝেমাঝে মনে হত, সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে মানু যেন সংসারের শতরকম ছোটবড় কাজ কোলে নিয়ে বসে সারাদিন ধরে একটি মালা গাঁথে। এখন দেখি মানু যেন কোল বিছিয়ে বসে অন্যমনস্কভাবে মালাটি গাঁথছে বটে, কিন্তু তার সুখ আনন্দ আর তেমন করে চোখেমুখে ফুটে উঠছে না। তার কেন এমন হল আমি জানি না, বুঝতে পারি না। মানু কি হঠাৎ একদিন এই মালা গাঁথা থামিয়ে কোল থেকে সব ফেলে দেবে?”
তবুও তো কেউ জাগে। প্যাঁচা নয় মানুষই, উষ্ণ না হলেও নিভন্ত অনুরাগে। সে বলে না কিছুই। যতটুকু বলে তা হাওয়ার সঙ্গে ফিসফিস করে সরে যায়। সে কাঁদে না। একটু কেঁপে ওঠে শুধু; শরীর নুয়ে পড়ে, পা হাত শীর্ণ হয়। থেকে যায় ভুল রাস্তায় অনেক দুর চলে আসার দিশেহারা ভাব। জন্মদাগের মতো তার কপালে লেখা থাকে সুখহীন এই দিনলিপি — বার্গম্যানের ছবির মতো, গ্রীক ট্র্যাজেডির কোরাসের মতো। বিমল করের পাতায় পাতায় সেই শব্দহীন শূন্যতার নিঃশ্বাস। মহাকাল সেখানে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। The time of the prologue is eternity. সমস্ত সকাল হারানো দিনের গল্প বলে যায় কেউ। বিকেলে অসম্ভব বিষন্নতা। সে বিকাল হেমন্তের, জীবনের।
ভালবাসা? “ভালবাসা যে জানে সে ভ্রমরের মতন। ভালবাসা জানলে ভ্রমরের মতন অসুখ করে, ভগবান ভ্রমরের মতন অসুখ দেয় যে অসুখে রক্তের লালটুকু মরে যায়” (খড়কুটো)। বুলাকে দেখে মোহিনী ভেবেছিল, “কী লাভ? তোর এখনও এই ভালবাসা বাঁচিয়ে রেখে কী লাভ হবে? তুই মিথ্যে বসে আছিস। মিথ্যে মায়া জমিয়ে রেখেছিস”। নন্দ মরে গেলে আঙুরলতা চেঁচামেচি করল না, মাথা ঠুকতে শুরু করল না। সে বিমল করের মেয়ে। “না আঙুর মরবে না। চোখ তুলে বিশুর দিকে চাইল ও। তারপর আকাশের দিকে। এ-পাশ, ও-পাশ। চিতা এবং গঙ্গার দিকেও। যেন এই সংসারের আকাশ, মাটি, মানুষ, জন- সব তার চেনা হয়ে গেল। আর সে মরবে না, কাঁদবে না” (আঙুরলতা )।
শচীপতিকে একজন বলেছিল, “মানুষের জীবন হল দড়িতে বাঁধা আর্তজীবের মতন, পাহাড়ের চুড়ো থেকে ঝুলছে। যে-কোন সময়ে সেটা ছিঁড়ে যেতে পারে। তোমার করবার কিছু নেই। চেষ্টা করো, কোথাও যদি পা রাখার মতন জায়গা পাও, তাতে দড়িটা দুলবে কম, টান পড়বে আরও কম”। সেই রাখার মতন একটুখানি জায়গাই খুঁজে চলেছে বিমল করের চরিত্রেরা। কেউ পেল, কারও দড়ি ছিঁড়ে গেল। ভ্রমর ভেবেছিল সে ফিরে আসবে। “যেন তার অসুখ সত্যিই বাইবেলের লাজার এর মতন, মৃত্যুতে যার শেষ নেই, সত্যিই ভগবানের মহিমার জন্য এই অসুখ”। আবার ভ্রমর এও বলেছিল, “আমাদের খুব কাছে কোন ভাল জিনিষই থাকে না, না? ভগবানও কত দুরে”। অমল তাকে বলেছিল “তোমাদের যীশু কিন্তু আর আসে নি”। সে বুঝেছিল ভ্রমরকে যার হাতে তুলে দিয়ে এসেছে তাকে সে চেনে না। সে অতি নির্মম, নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন, তার দয়ামায়া মমতা নেই, ভালবাসা নেই।
,p> মানুষ যখন চুপ হয়ে যায় তখনই শোনা যায় প্রকৃতিই কথা। যা বলা যায় না তার দিকে টেনে নেয় কান। কথার পিছনের অনেক কথা, যা চাপা পড়ে থেকেছিল। “স্তব্ধ নিঃসার হয়ে আমরা বসে থাকলাম। চাঁদের আলো কদম গাছের ছায়াটিকে বেদীর সামনে শুইয়ে রেখেছে। করবীঝোপে বাতাস যেন ডুব দিয়ে সাঁতার কেটে যাচ্ছিল, শব্দ হচ্ছিল পাতার। আমরা আমাদের ছায়ার নকশা থেকে চোখ তুলে কখন যে শূন্য দৃষ্টি রেখেছি, কেউ জানি না”। “আমি নীরব হলে কদম গাছ তার ছায়া আরও দীর্ঘ করল। বড়দির বুকে সেই ছায়া দেখলাম। কয়েকটি খড়কুটো এল দমকা বাতাসে। দশরথ ধোপাদের বস্তিতে গানের সুর থেমে গেছে। একটি রাত্রিগামী ট্রেন সাঁকোর ও-প্রান্তে দাঁড়িয়ে হুইসল দিচ্ছে পথের জন্য। ধ্বনিটা ক্ষীণ হয়ে এখানে ভেসে আসছিল” (জননী)। কাশীর সাদা পাথরে বাঁধানো মার বেদীর ওপর পাঁচ সন্তান সেই শব্দ আর নৈঃশব্দের মধ্যে বসে অনুভব করে তাদের মায়ের সৎকার যেন এইমাত্র সমাধ হল। ভেঙে পড়া মানুষকে বুঝতে গেলে একটু কাছে যেতে হয় — তার বসার ভঙ্গী, হাতের পাতা, চুলের জট, চোখ। বার্গম্যানের ছবিতে যেমন ক্লোজ আপ আসে, বিমল করের নারীরা সে রকমই ক্লোজ আপে আসে। ধ্বংসস্তুপের সেই শেষ প্রতিমা। ‘জননী’ গল্পে বড়দির বসার ভঙ্গী, চাঁদের আলো গড়িয়ে যাওয়া চুল, হাতের দুগাছি সরু সোনার চুড়ির চিকচিক। ‘আঙুরলতা’ গল্পে ঝট করে সেজে ওঠে আঙুর — তার লাল রঙের ছেঁড়াছেঁড়া শাড়ি, সাটিনের পুরনো বডিজ, আলতা, টিপ আর কাজল। ‘অসময়’ উপন্যাসে অন্তিম সকালে ঘুম থেকে জেগে উঠে মোহিনী — “গলার হারটা খোঁপার সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল। আস্তে করে জটটা ছাড়ালাম। জামার টিপকল আলগা, নিজের বুকে দুদন্ড হাত দিয়ে শুয়ে থাকলাম। বুকে হাত রাখলেই সেই ধকধক কাঁপুনিটা আমার হাতে লাগে”।তাহলে কি বিমল কর শুধুই এক ভাঙনের গান? অপরের সুখের দায়ভার নেবার মত বিপজ্জনক কিছু নেই। ভালবাসার মত ভঙ্গুর কিছু নেই। তার সময় অসময় জ্ঞানও নেই। তবুও তাই নিয়েই, অপরের সুখের দায়ভার নিয়েই বাঁচে বিমল করের মেয়েরা। সহস্র নেতির মধ্যেই সেই ফুল নিয়ে খেলবার, ভালবাসা নিয়ে বাঁচবার সাধ; মরা আর বাঁচা মিলে যায় সেখানেই। বিমল কর আমাদের সেই দিকেই যেন একটু ঝাঁকানি দিয়েই টেনে নিয়ে যান। একটা ভালবাসার আলো যা শিবানীর ধুয়ে যাওয়া চিতার থেকে বেশ দুরে বসে থাকা ভুবনকে আলাদা করে দিয়েছিল। “চাঁদের আলোয় ভুবনকে কেমন যেন দেখাচ্ছিল। তার চারপাশে নিবিড় ও নীলাভ, স্তব্ধ, মগ্ন যে চরাচর তা ক্রমশই যেন ব্যাপ্ত ও বিস্তৃত হয়ে এক অলৌকিক বিষন্ন ভুবন সৃষ্টি করছিল। এ যেন আমাদের ভুবন নয়। অথচ আমাদেরই ভুবন” (আমরা তিন প্রেমিক ও ভুবন)। মানুষ ভুবন বারবারই মিশে যায় অন্য কোন ভুবনের মধ্যে। বিমল কর সেই আমাদেরই ভুবন অথচ ভুবন নয় — বিষন্ন, বিপজ্জনক। আবার কখনো কখনো অলৌকিকও।