• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | Rabindranath Tagore | গ্রম্থ-সমালোচনা
    Share
  • তথ্য থেকে তত্ত্ব : এক মেধাবী উত্তরণ - "রবীন্দ্রনাথের গান দীপের মতো : গানের স্রোতে"; সমীর সেনগুপ্ত : শংকর চট্টোপাধ্যায়

    রবীন্দ্রনাথের গান দীপের মতো : গানের স্রোতে; সমীর সেনগুপ্ত; অনুষ্টুপ, কলকাতা, জানুয়ারি ২০১১, ISBN 978-81-85479-61-5

    রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে আলোচনা বা নিবন্ধ বা গ্রন্থরচনার সূচনা রবীন্দ্রনাথের জীবৎকালেই। তাই বলা যায় রবীন্দ্রসংগীত বিষয়ে প্রথম আলোচক রবীন্দ্রনাথ নিজেই। তার সঙ্গে যুক্ত করা যায় তাঁর অনুজ ধূর্জটিপ্রসাদ ও দিলীপকুমারের নাম। এই দুজনের সঙ্গে আলাপচারিতা বা পত্রবিনিময়ের মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথের গানের একটা সঠিক রূপরেখা আমরা প্রথম পেয়েছিলাম। রবীন্দ্রপ্রয়াণের পর থেকে রবীন্দ্রশতবর্ষের কাল পর্যন্ত রবীন্দ্রসংগীত বিষয়ক গ্রন্থ অপ্রতুল। এই গ্রন্থগুলির মধ্যে শান্তিদেব ঘোষের 'রবীন্দ্রসংগীত' গ্রন্থটিকে পথিকৃৎ বলা যেতে পারে। এটি ছাড়া অন্যান্য যে-সব গ্রন্থ এই সময়সীমার মধ্যে প্রকাশিত হয়েছিল সেগুলি মূলত রবীন্দ্রসংগীত বিষয়ে অ্যাকাডেমিক আলোচনা। রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন পর্যায়ের বা অঙ্গের গান, বিভিন্ন তাল ও ছন্দ বা গানে ব্যবহৃত কিছু রাগরাগিণীর পরিচয়ই ছিল সেই সব গ্রন্থের উপজীব্য। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে যারা রবীন্দ্রগান বিষয়ে নানা গ্রন্থ রচনা করছেন তাঁরা অনেকেই রবীন্দ্রসংগীতের গায়ক বা শিক্ষক নন। এঁরা কেউ কবি বা অধ্যাপক, কেউ বা বুদ্ধিজীবী, কিন্তু সকলেই রবীন্দ্রগানে মগ্ন। এঁদের কাছ থেকে আমরা রবীন্দ্রনাথের গান সম্পর্কে সবচেয়ে মূল্যবান মূল্যায়নগুলি পেয়েছি। এঁরা আমাদের তথ্য দিয়েছেন অনেক, কিন্তু তথ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেন নি। রবীন্দ্রনাথের গানের বাণীর গভীরে অবগাহন করে গীতরূপটির সত্য উদ্ঘাটন করেছেন। কথার সঙ্গে সুরের যে মহৎ মিলন রবীন্দ্রনাথের গানে এই মিলনে বাণীর নির্মাণ সম্পর্কে আমাদের গভীরভাবে অবহিত করেছেন।

    সমীর সেনগুপ্ত রচিত 'রবীন্দ্রনাথের গান দীপের মতো গানের স্রোতে' শীর্ষক এই ক্ষুদ্রকায় গ্রন্থটি শেষোক্ত ধারার ফসল। এ গ্রন্থে অজস্র তথ্য আছে, তত্ত্বও আছে। আছে তথ্য থেকে তত্ত্বে উত্তরণের নানা প্রয়াস, যা পরবর্তী গবেষকদের সহায়ক হতে পারে। কিন্তু তার আগে গ্রন্থটির একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া দরকার। এই গ্রন্থটি আটটি নিবন্ধের সংকলন। এর মধ্যে ছয়টি নিবন্ধ পূর্বেই বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত। বাকি দুটি নিবন্ধ স্বতন্ত্র রচনা। প্রবন্ধগুলির বিষয়ও বহুধাবিস্তৃত। আলোচ্য গ্রন্থের দীর্ঘতম নিবন্ধ 'রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গান'। সমগ্র গ্রন্থটির একতৃতীয়াংশের বেশি স্থান এই নিবন্ধের বিস্তার। তাই উক্ত নিবন্ধই আমাদের প্রথম আলোচ্য।

    আলোচ্য নিবন্ধটি তথ্যবহুল। কিন্তু এই বাহুল্য সত্ত্বেও লেখক এই তথ্যগুলির সাহায্যেই দু'একটি অনুসিদ্ধান্তে আমাদের পৌঁছতে সাহায্য করেছেন। এতেই নিবন্ধটির মূল্য বেড়েছে। তথ্যগুলি আমাদের সাহায্য করে রবীন্দ্রনাথের সংগীতজীবনে কিভাবে বর্ষার গানগুলি (যার মোট সংখ্যা একশ'বারো) যাওয়া আসা করেছে ষোলো বছর বয়স থেকে শুরু করে প্রায় মৃত্যু-প্রাক্কাল পর্যন্ত। রবীন্দ্রনাথের প্রথম বর্ষার গানটি রচিত হয় তার ষোলো বছর বয়সে। বৈষ্ণব পদাবলীর অনুসরণে রচিত পদ 'শাঙন গগনে ঘোর ঘনঘটা' হল তাঁর প্রথম বর্ষার গান। একুশ বছর বয়সে রচিত 'গহন ঘন ছাইল' তাঁর দ্বিতীয় বর্ষার গান। গানটি কালমৃগয়া গীতিনাট্যে ব্যবহৃত এবং সম্ভবতঃ নাটকের প্রয়োজনেই পূর্ববর্তী কোনো হিন্দি খেয়ালাঙ্গ গানের আদর্শে রচিত। সমীর সেনগুপ্ত নানা তথ্যসমাবেশে দেখিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথের প্রথম বর্ষার গানটি তাঁর বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছেও কত জনপ্রিয় ছিল। বোঝা যায় সেইকালে কবিখ্যাতির চেয়েও গীতিকার সুরকার হিসেবে প্রতিষ্ঠার সূচনা হয়েছিল। 'গহন ঘন ছাইল' গানটির পরে দীর্ঘকাল ধরে রবীন্দ্রনাথ কোনো বর্ষার গান রচনা করেন নি। ১৮৮২-র পর ১৮৯৫-এর সেপ্টেম্বর মাসে রচিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের তৃতীয় বর্ষার গান 'ঝর ঝর বরিষে বারিধারা' শিলাইদহে স্টিমারের খোলা ছাদের ওপর বসে অবিরাম ঝড় বৃষ্টিবাদলের আবহে। কিন্তু তৃতীয় এই গানটিকে রবীন্দ্রনাথ রচিত প্রথম স্বকীয় বর্ষাসংগীত বলে গণ্য করা যেতে পারে। এই গানে বৈষ্ণব পদের অনুকরণ নেই। দ্বিতীয় গানটির মতো হিন্দিভাঙা খেয়ালের সুর একমাত্র আধার হয়ে ওঠে নি। আমাদের বিস্ময় জাগে, কেন এই গানের পূর্বজ পাঁচ শতাধিক গানের মধ্যে একটিও বর্ষার গান (সম্ভবত অন্য ঋতুরও) পাই না। দেখা যায় যে ঠিক গীতাঞ্জলি পর্বের আগে বা সমসময়ে রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গানের ঢল নামে। গীতাঞ্জলিতেই আমরা একুশটি বর্ষার গান পাই। এর মধ্যে একটি গানের সুর পাওয়া যায় না। গানটি 'আজ বরষার রূপ হেরি মানবের মাঝে'। এ গানটি রচনার দিন শান্তিনিকেতনে এক মর্মান্তিক ঘটনা উল্লেখ করেছেন সমীর। সেই মৃত্যুই বোধহয় গানটির সুর কেড়ে নিয়ে গেল।

    সাধারণত বর্ষার গানে নানা প্রকার মল্লার বা দেশ রাগের সুর ব্যবহার করা প্রথাসিদ্ধ ছিল। রবীন্দ্রনাথের পূর্বজ সুরকাররা এই ঐতিহ্যকে বহন করে এসেছেন। রবীন্দ্রনাথই সম্ভবত প্রথম এই ঐতিহ্যকে ভেঙেছেন। রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গানে আমরা তাই প্রচুর পরিমাণে ইমন ভৈরবী বেহাগ প্রভৃতি সুরের এবং তারই সঙ্গে সঙ্গে বাউল ও কীর্তন সুরের প্রয়োগ পাই। এই ধারাটিও কিন্তু অচলায়তন ভাঙার একটি পদক্ষেপ। তাঁর ব্যত্যয়ী সুরের প্রথম বর্ষার গান 'আষাঢ় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল' - এটি বর্ষার কোনো রাগে নয়, ইমন কল্যাণের আধারে রচিত। গানটি গীতাঞ্জলি পর্যায়ের রচনা, যখন রবীন্দ্রনাথ সুরযোজনার সনাতন পন্থা ছেড়ে স্বতন্ত্র হয়ে উঠছেন।

    সমীর সেনগুপ্ত তাঁর প্রারম্ভিক নিবন্ধে রবীন্দ্রনাথের গানের মূল বৈশিষ্ট্যটি উন্মোচন করেছেন রাগসংগীতের সঙ্গে তুলনায়। রাগাঙ্গ সম্পূর্ণত প্রকাশ পায় না বলেই একদা রবীন্দ্রনাথের গান শাস্ত্রীয় সংগীতবিদদের কাছে অনাদৃত ছিল। সুরে কবিতাপাঠ বড়ো জোর এই অভিধা জুটতো ওস্তাদমহলে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সৃষ্ট সুরের প্রবল নিজস্বতাকে তার নিজস্ব চারিত্র্যকে আমাদের সামনে রেখেছেন সমীর। রবীন্দ্রনাথের গান যেমনভাবেই পরিবেশিত হোক না কেন, কণ্ঠে বা যন্ত্রে, সুরটিকে রবীন্দ্রসংগীতের সুর বলে তৎক্ষণাৎ সনাক্ত করতে আমাদের অসুবিধা হয় না। এমনকি বিশুদ্ধ রাগরাগিণীতে আধারিত রবীন্দ্রসংগীতের বেলাতেও একথা খাটে। এস্রাজে 'কার বাঁশি নিশিভোরে' গানটি বাজলে কিংবা গিটারে 'মোর বীণা ওঠে কোন সুরে বাজি' তাকে জৌনপুরী বা ভৈরবী কোন বন্দিশ বলে ভুল করবে না। তৎক্ষণাৎ এই সব সুরকে রবীন্দ্রসংগীতের সুর বলে চিহ্নিত করা যায় একমাত্র এই কারণে যে বাণীর সহযোগ ছাড়া সেই সুরের একটি নিজস্ব ঘরানা আছে। রাগরাগিণী তার মধ্যে কতটা জায়গা পেয়েছে কিংবা রচিত সুরটি কোন রাগভাঙা আঘাটায় গিয়ে পড়েছে - এসব ওস্তাদমহলের বিবেচনাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এ গানের সুর তার প্রবল ব্যক্তিত্বে ও নিজস্বতায় একটি স্বশ্রেণী। এই কারণেই তো যা ছিল একদা 'রবিবাবুর গান' আজ তা রবীন্দ্রসংগীত হিসেবে স্বতন্ত্র একটা আসন করে নিয়েছে। তাই এই গানের সুরে কথায় যে প্রবল ব্যক্তিত্ব তাকে প্রকাশ করাই গায়কের প্রাথমিক দায়িত্ব। এই বিষয়ে লেখক নিজেই বলেছেন, "রবীন্দ্রনাথের গানকে রবীন্দ্রনাথ যেভাবে চেয়েছিলেন সেভাবে গাইলেই তার ভিতর দিয়ে গায়কও সবচেয়ে ভালো ফুটে ওঠেন।" কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বেশির ভাগ গায়কই "রবীন্দ্রনাথের গানের জগতটা... এমন করে তুলেছেন যে আজ রবীন্দ্রনাথের নিজের গলার রেকর্ড শুনলে মনে হয়, যাকে রবীন্দ্রসংগীত বলে সেটা যে কেমন করে গাইতে হয় রবীন্দ্রনাথ তা জানতেনই না।"

    সমীর সেনগুপ্ত তাঁর গ্রন্থের একাধিক অধ্যায়ে রবীন্দ্রনাথের গান শোনা এবং উপভোগ করার ব্যাপারটি আলোচনা করেছেন। এই সমস্যাটি পুরোনো এবং এ নিয়ে আলোচনাও বোধহয় অপ্রতুল নয়। গায়ক গান পরিবেশন কালে কতটা কলাবিদ হবেন, আর কতটাই বা কৃৎকুশলী সেটা গায়কের নিজস্ব বোধবুদ্ধি ও উপলব্ধির উপর নির্ভর করে শেষ পর্যন্ত। অপরদিকে যিনি শ্রোতা তাঁর গানের উপভোগ বা রসাস্বাদ নির্ভর করে তিনি কতটা দীক্ষিত তার উপরে। এ বিষয়ে অবশ্য এলিয়ট একটু ভিন্ন কথা বলেছেন। তাঁর কথায় মহৎ শিল্প 'is communicated before it is understood'। কথাটা খুব একটা ফেলে দেওয়ার মতো নয়। একজন শ্রোতা, ধরা যাক, 'মেঘ বলেছে যাব যাব' গানটি শুনছেন। তাঁর হাতে গীতবিতান নেই। গানটির অর্থও তাঁর কাছে তেমন স্পষ্ট নয়। অন্যদিকে বেহাগ রাগ বা যৎ তাল ইত্যাদি টেকনিকালিটির সঙ্গে তাঁর পরিচয় নেই বললেই হয়। তবু গানটি তাঁর ভালো লাগছে। গানটি তাঁর কাছে আদৃত হচ্ছে তার কারণ গানের মধ্যে দিয়ে কিছু একটা communicated হচ্ছে তাঁর কাছে। যিনি গাইছেন তাঁর সামনে খোলা আছে গীতবিতান বা স্বরবিতান স্মৃতি-সহায়ক হিসেবেই। কিন্তু গানের বাণীর অন্তর্লীন ভাবের গভীরে ঢুকে বুঝে উপলব্ধি করে কি তিনি গাইছেন? লেখকের পরামর্শমতো শ্রোতার হাতেও যদি গীতবিতানের ওই পাতাটা খোলা থাকতো তবে কি গানটি শোনামাত্র শ্রোতার অর্থবোধ ঘটতো?

    আসলে গান শোনার ব্যাপারে আমরা দুজাতের শ্রোতা পাই। একদল অনেক অনেক শুনে কান তৈরি করেছেন, মনটাও গ্রহিষ্ণু হয়েছে। অন্যদিকে অদীক্ষিত শ্রোতাও আছেন যাঁর গান শোনার কোনো পূর্বপ্রস্তুতি নেই। এই গায়কের বা শ্রোতার রবীন্দ্রকাব্যসাহিত্য তাঁর বিশ্ববীক্ষা সীমা-অসীম-ভূমা ইত্যাদি সম্পর্কে বিন্দুমাত্র জানা নেই তবু তারা উপভোগ করেছেন। সমীরবাবু দেখিয়েছেন অতীতে অবঙ্গভাষী কিছু সুখ্যাত শিল্পী, যাঁদের রবীন্দ্রনাথের ভাষাকাব্যসাহিত্য ইত্যাদিতে বিন্দুমাত্র অধিকার ছিল না তাঁরা রবীন্দ্রনাথের গানের মর্মের কাছাকাছি প্রবেশ করেছিলেন। আমার মনে হয় যে কোনো শিল্পের উপভোগ বা রসাস্বাদ সম্ভবত একটি অর্জিত গুণ। ছবি বারবার দেখতে দেখতে আর গান বারবার শুনতে শুনতে তার সত্তার গভীরে প্রবেশের দ্বার খোলে আর আমরা তার স্বাদ গ্রহণ করি। যেমনটা হয় বিয়র বা কালো নিশ্চিনি কফি খাওয়ার বেলায়। প্রথমে কটূ, পরে স্বাদ অর্জিত হয়। রবীন্দ্রনাথের গান শুনে লেখকের মাতামহের উক্তিটি অদীক্ষিত শ্রোতার পক্ষে সঠিক। কিন্তু অনেকবার শোনার দীক্ষার পর রুচি অর্জন করলে তাঁরও হয়তো ভালো লাগত। আসলে এই অর্জনই সাহায্য করে বুঝতে যে সুর ও কথার খেলার মধ্যে দিয়ে রচিত হয় এক তৃতীয় ভুবন, এক ভিন্ন সমন্বয় যা বুদ্ধদেব বসুকে বিস্মিত করেছিল।

    লেখক তাঁর গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের গানে লয় নির্ধারণ বিষয়ে আক্ষেপ করেছেন। স্বরলিপিতে কোনো লয়ের নির্দেশ না থাকায় একটা বাস্তব সমস্যা উদ্ভূত হয়েছে সন্দেহ নেই। অন্য কোনো নির্দেশের অভাবে এই সমস্যার সমাধান শেষ পর্যন্ত গায়ক ও প্রশিক্ষকদের বিচারবোধের উপর ছেড়ে দিতে হয়। গুরুশিষ্য পরম্পরায় অধীত লয় অনেক সময় পথনির্দেশ করে। কিন্তু সে আর কতোটুকু। রবীন্দ্রনাথের অধিকাংশ গানই কথা ও সুর মিলিয়ে অভিজ্ঞ প্রশিক্ষক ও গায়কের কাছে একটি নির্দিষ্ট বার্তা পৌঁছে দিতে পারে। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাণীর সঙ্গে সুরের গঠনের মিল না হলে যে সমস্যা তৈরি হয় তার সমাধান শেষ পর্যন্ত গায়কের উপলব্ধি, কণ্ঠসামর্থ্য ও লয়বোধের হাতে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। একটি উদাহরণ দিই। 'দূররজনীর স্বপন লাগে' গানটিতে একটি বিষাদকরুণ পরিস্থিতি আছে। কবি তাঁর নিজের 'কাল' হারিয়েছেন এবং একদিন যে সুরের খেলায় মেতে গান গেয়েছিলেন সেই সব দূরাগত স্মৃতি তাঁকে ভারাক্রান্ত করছে। এই দিক থেকে স্মৃতিভারাতুর বিষণ্ণ ধীর লয়ই এ গানের যোগ্য। অন্যদিকে এই গানের সুরের গঠন অনুপুঙ্খ অনুধাবন করলে দেখা যাবে যে এই সুর ধীর লয়কে অনুমোদন করছে না। আবার গানের শেষ দিকে গানের বাণী বিষাদ কাটিয়ে উঠছে। 'নবীন চোখের চপল আলোয় সে কাল ফিরে' পাওয়ার অন্তিম ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে পূর্বে স্থিরীকৃত ধীর লয় যেন নবীন চাপল্যের দ্রুতি অর্জন করে। তবে কি এ গানে প্রথমার্ধ আর শেষার্ধে দুরকম লয় প্রযোজ্য হবে? রবীন্দ্রগানে এরকম লয়ফেরতার দৃষ্টান্তও তো বিরল নয়।

    রবীন্দ্রনাথের গানে লয় সম্পর্কে অন্যদিকেও একটি সমস্যা প্রকট। যেগুলি আমরা তালছাড়া ঢালা গান বলি সেগুলির পরিবেশনের সময় সঠিক লয় নির্বাচনের দিকে গায়কের কোনো নজর থাকে বলে মনে হয় না। অধিকাংশ গায়ক এই ধরনের গানগুলির কথাকে লম্বা করে যথেচ্ছ টেনে টেনে অতিরিক্ত অলংকার, এক্ষেত্রে টপ্পার জমজমা প্রয়োগ করে গেয়ে থাকেন। এতে গানের কথা ও সুরের সম্পৃক্তি ব্যাহত হয়। তাই অর্থবোধের দিকে প্রয়োজনীয় নজরটা থাকে না, মন পড়ে থাকে কেবল অলংকার প্রয়োগের দিকে। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথেরও আপত্তি ছিল। সুন্দরীকে আরও সুন্দর করে তোলার জন্যে তার গায়ে গাদাগাদা গয়না চাপালে সৌন্দর্যটাই যে মাটি হয়ে যায়।

    সমীর সেনগুপ্তর গ্রন্থে 'কেন রবীন্দ্রনাথের গান' শীর্ষক একটি নাতিদীর্ঘ অথচ মূল্যবান নিবন্ধ আছে। এটি পূর্বপ্রকাশিত কোনো নিবন্ধের পুনর্মুদ্রণ নয়। নিবন্ধটি ছোট হলেও এতে একটি চমকপ্রদ এবং প্রায়-অনালোচিতপূর্ব বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে। এই অতিপ্রসঙ্গিক প্রসঙ্গটি হল রবীন্দ্রনাথের কবিতা আধুনিক কবি বা বুদ্ধিজীবী সমাজ বা আধুনিক কবিতার ভক্তদের কাছে তেমন গ্রহণযোগ্য নয়। বলতে গেলে রবীন্দ্রকবিতাকে তাঁরা বর্জনই করেছেন। অথচ রবীন্দ্রকবিতার প্রতি তাঁদের এই অনীহা রবীন্দ্রসংগীতের প্রতি তাঁদের অনুরাগে কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি। লেখক এর কারণ অনুসন্ধান করতে চেয়েছেন এই নিবন্ধে। তিনি আমাদের জানিয়েছেন পঞ্চাশ দশক পর্যন্ত কবিরা রবীন্দ্রনাথের গান এবং কবিতা উভয়েরই গুণগ্রাহী ছিলেন। তার আগে কল্লোলীয় কবি অচিন্ত্যকুমার ভেবেছিলেন রবীন্দ্রনাথই তাঁদের কবিতার দ্বার রুদ্ধ করে রেখেছেন। এটিকে ব্যতিক্রম বলেই ধরে নেওয়া যায়। কারণ তাঁর সমসাময়িকরা রবীন্দ্রনাথের কাছাকাছিই ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের কবিতার সঙ্গে তাঁদের যতো মানসিক নৈকট্য ছিল, তাঁর গানের সঙ্গে ততো পরিচয় ছিল না। শতবার্ষিকীর কিছু আগে থেকেই আধুনিক কবি মানসিকতা রবীন্দ্রনাথের কবিতার সঙ্গে দূরত্ব অনুভব করতে থাকে, আস্থা কমে এবং শেষ পর্যন্ত তিনজোড়া পায়ের পদাঘাতে পাপোষেই রবীন্দ্রকবিতার যথাস্থান নির্ধারিত হুয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গান সম্পর্কে এই বিরূপতা শতবার্ষিকীর দশক থেকেই অন্তর্হিত হতে থাকে। লেখক জানিয়েছেন কবিতার তুলনায় গানের প্রতি এই পক্ষপাত সুরের কারণেই। যে বাস্তবতা কবিতায় মেলে না সুরে-বাঁধা গানে সে বাস্তবতার প্রত্যাশা থাকে না। লেখকের নিজের কথায় "কথা দিয়ে তৈরি সাহিত্যের দায় আছে বাস্তবের কাছে....। কিন্তু সুরের সে দায় নেই, সুর হল সত্যিকারের বিমূর্ত সামগ্রী।" মনে হয় লেখকের এই ব্যাখ্যায় আমরা একটা কারণ খুঁজে পাই গানের প্রতি পক্ষপাতের। কিন্তু সুরের সহযোগ থেকে বিযুক্ত হলে রবীন্দ্রনাথের গান তো সেই রবীন্দ্রকবিতা যাতে অনুরাগ নেই আধুনিকদের। এখানে আমার একটা কথা মনে হয়। রবীন্দ্রনাথের কবিতার বাগ্‌বৈদগ্ধ্য ও অলংকারবহুল তার দীর্ঘবিন্যাস তাঁর গানে অনেক সুবদ্ধ ও মিতবাক। বাগতিরেকবর্জিত চারতুকী বা দুইতুকী গানের সংযম ও শাসন কবিতার তুলনায় অনেক সংহত। এই দিকটিও হয়তো আধুনিকদের আকর্ষণ করে থাকতে পারে সুরের বিমূর্ততার সঙ্গে সঙ্গে।


  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments