রবীন্দ্রনাথের গান ও অন্যান্য; সুভাষ চৌধুরী; বইমেলা ২০১৩; প্রতিভাস পৃষ্ঠা: ISBN:
সংগীতশাস্ত্রে বলে গীতবাদ্যনৃত্য নিয়েই সংগীত। গীত নৃত্য ও বাদ্যের নানা প্রকারভেদ আছে। আলোচ্য গ্রন্থটিতে যে গীত সম্পর্কে আলোচনা প্রধান সেটি বাণী সহযোগে গীত গান যাকে ভাষান্তরে আমরা বলি কাব্যসংগীত। আর ভারতীয় কাব্যসংগীতের মধ্যে নিঃসন্দেহেই শ্রেষ্ঠ হল রবীন্দ্রসংগীত। এই সংগীতের নানা দিক, নানা সমস্যা, নানা পরিবর্তন নিয়েই বইটি গড়ে উঠেছে। কিন্তু আলোচনা সব সময়ে যে রবীন্দ্রসংগীতেই সীমাবদ্ধ থেকেছে তা নয়। অন্যান্য ধারার গান, বিশেষ করে কয়েকজন গায়ক সম্পর্কে সুভাষ চৌধুরী এই গ্রন্থে আলোচনা করেছেন। বাদ্য বিষয়েও আলোচনা আছে। তালবাদ্য প্রকরণ বিষয়ে অনেক প্রসঙ্গ এ গ্রন্থে আলোচিত হয়েছে যা মূলত রবীন্দ্রসংগীতের সঙ্গেই সম্পৃক্ত। নৃত্যের বিষয়ে একটি ছোটো নিবন্ধ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু সব ছাপিয়ে এ গ্রন্থের কেন্দ্রীয় আলোচ্য হল রবীন্দ্রনাথের গান।
আলোচ্য গ্রন্থে লেখক বিষয়গুলিকে পাঁচটি পর্বে গ্রথিত করেছেন। প্রথম পর্বটি রবীন্দ্রনাথের গানের আলোচনার সঙ্গে সঙ্গে শান্তিনিকেতনে তাঁর ছাত্রাবস্থার স্মৃতিবিজড়িত অনেক ঘটনা আমাদের কাছে উপস্থিত করে। দ্বিতীয় পর্বে রবীন্দ্রসংগীত সম্পৃক্ত বিষয়ের সঙ্গে অন্যান্য বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তৃতীয় পর্বটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই পর্বে দুটি অতি মূল্যবান সাক্ষাৎকার সংযোজিত হয়েছে। চতুর্থ পর্বে রবীন্দ্রসংগীত ভাবনার পাশাপাশি রবীন্দ্রোত্তর কালের দুই অনন্য গীতিকার ও সুরকারের কথা। পঞ্চম ও শেষ পর্বে নৃত্যবিষয়ে একটি নিবন্ধ মুদ্রিত। এই গ্রন্থের প্রায় সব রচনাই পূর্বপ্রকাশিত। এই লেখাগুলির মধ্যে অনেক গ্রন্থসমালোচনা গ্রন্থকারের, এমন কি গ্রন্থের নামোল্লেখ ছাড়াই প্রকাশিত হয়েছে।
এই গ্রন্থে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হল রবীন্দ্রসংগীত বিষয়ে লেখকের স্বচ্ছ দৃষ্টি, নির্মোহ বিশ্লেষণ এবং আদি থেকে অন্ত যুক্তিগ্রাহ্য অবেক্ষণ। এর ফলে নিবন্ধগুলির অন্তর্গত মূল্য অপরিসীম হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের গানকে ঘিরে যত মিথ তৈরি হয়েছে বা হচ্ছে তা তিনি নির্মম হাতে ভেঙে দিয়ে ঘোষণা করেন 'র'বার যেটা সেটাই রবে'। নিজের প্রতিষ্ঠান বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ সম্পর্কে তাঁর দুয়েকটি বিরূপ মন্তব্য এই নির্মোহতার একটি প্রমাণ।
অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের জ্যেষ্ঠ পুত্র সুভাষ চৌধুরীকে তাঁর বাবা ১৯৫৩ সালে শান্তিনিকেতনে গান শেখা ও চর্চার জন্যে সংগীতভবনে পাঠান। আজ থেকে ষাট বছর আগে এ সিদ্ধান্ত বৈপ্লবিক ছিল বলা যায়। কারণ রবীন্দ্রসংগীতের তখনকার পরিস্থিতি যা ছিল তাতে ভবিষ্যৎ প্রতিষ্ঠার কোনো আশ্বাস ছিল না। সুভাষ চৌধুরী তাঁর শান্তিনিকেতনের স্মৃতিচারণ দিয়েই বইটির সূচনা করেছেন। তাঁর শান্তিনিকেতনে সংগীতশিক্ষা করতে আসা একদিকে যেমন তাঁর পরিবারের রুচিঋদ্ধ প্রেক্ষিতটি বুঝিয়ে দেয়, তেমনি শুদ্ধ সংগীতের প্রতি তাঁদের আগ্রহেরও পরিচয় দেয়। সুভাষ চৌধুরী সে যুগে সংগীতভবনের শিক্ষাদান পদ্ধতি ও নানা আনুষঙ্গিক বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। সে যুগের আচার্যদের পরিচয়ও এই প্রসঙ্গে পাওয়া যায়। তিনি যাঁদের কথা লিখেছেন তাঁরা হলেন বীরেন্দ্রনাথ পালিত, বিদ্যাধর ভেংকটেশ ওয়াঝলওয়ার, শৈলজারঞ্জন মজুমদার, শান্তিদেব ঘোষ, অশেষচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতি গুণীজন। শৈলজারঞ্জন মজুমদার ও শান্তিদেব ঘোষের পারস্পরিক অপছন্দ তিনি অস্বস্তির সঙ্গে তখনই লক্ষ্য করেছেন। তিনি লিখেছেন "সাংগীতিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও যাঁরা শিল্পী হিসাবে জনপ্রিয় হয়েছেন তাঁরাই পেয়েছেন সব কিছু। এঁদের মুখোশ দেখেছি - মুখ দেখার সৌভাগ্যও হয়েছে।" শান্তিনিকেতনের সংগীতশিক্ষা শেষ করেছিলেন তিনি। সে যুগে শান্তিনিকেতনে নানা অনুষ্ঠানের যে পরিচয় তিনি দিয়েছেন তার থেকে বোঝা যায় তখন কী অপরিসীম আনন্দময়তার পরিবেশ ছিল।
শান্তিনিকেতন পর্বের পরবর্তী কালেই তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগে স্বরলিপি দপ্তরে। এইখান থেকেই তাঁর সাংগীতিক জীবনের পরিসর আরও বাড়ে। সংগীতজগতের সুখ্যাত অখ্যাত নানা স্তরের অসংখ্য মানুষের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। পরে তাঁর নিজস্ব সংগীত প্রতিষ্ঠান 'ইন্দিরা' প্রতিষ্ঠিত হয়। 'ইন্দিরা'র প্রাণপুরুষ রূপে নানা উল্লেখযোগ্য সাংগীতিক প্রকল্প গ্রহণ করেন। গান শেখানোর পাশাপাশি আজীবন সেই সব প্রকল্পগুলিকে রূপায়িত করতে থাকেন। এই সূত্রে সংগীতজগতের গভীরে তাঁর অনুপ্রবেশ ঘটে। নানা প্রবাদপ্রতিম শিল্পী, আচার্য ও প্রশিক্ষকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। তাঁদের সংস্পর্শে এসেই বোধহয় এই জগতের মুখ ও মুখোষ সম্পর্কে তাঁর পূর্বতন বোধোদয় আরও পোক্ত হয়। তিনি যে সব উল্লেখযোগ্য কাজের সঙ্গে যুক্ত হন তার মধ্যে কয়েকটি তাঁর লেখায় উল্লেখিত হয়েছে। জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের বিখ্যাত গ্রন্থ তহজীব-এ-মৌসিকীর অনুলিখনের কাজ করার সময় জ্ঞানপ্রকাশের বিদগ্ধ সংগীত মনীষার পরিচয় পান। ঊষা উত্থুপের রবীন্দ্রসংগীত রেকর্ড করার দায়িত্ব পান তিনি। তাঁকে গান শেখানোর কালে তাঁর গভীর নিষ্ঠার পরিচয় পেয়ে বিস্মিত হন। ভি. বালসারার মতো অনন্য সংগীতজ্ঞের বিনয়ের পরিচয় পেয়ে আপ্লুত হন তিনি। আবার সারাজীবনে খ্যাতনামা জনপ্রিয়দের পরশ্রীকাতরতা মিথ্যাচার ও অজ্ঞতার পরিচয় পেয়ে ব্যথিত হন। এ সবের উল্লেখও আছে তাঁর গ্রন্থে। নিজের যে প্রকল্পটি সম্পর্কে তাঁর গ্রন্থে কোনো উল্লেখ নেই সেটি হল প্রকাশনা। 'ইন্দিরা'র প্রকাশনায় যে বহুমূল্যবান গ্রন্থগুলি প্রকাশিত হয় তার জন্যে সংগীতজগৎ তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে।
বইটির দ্বিতীয় অধ্যায়ের শিরোনাম 'আপন গান'। এই অধ্যায়ে রবীন্দ্রনাথের নানা গান সৃষ্টির মুহূর্তগুলি তুলে ধরা হয়েছে। এই কাজে তিনি রবীন্দ্রনাথের নানা ভক্ত ও সহচরদের স্মৃতিচারণা খুব সুন্দরভাবে ব্যবহার করেছেন। নানা উপলক্ষ্যে রচিত রবীন্দ্রগানের নেপথ্যের পরিচয়ও দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে অবশ্য নতুন কোনো তথ্য সংযোজিত হয়নি, পূর্বপরিজ্ঞাত তথ্যেরই পুনঃসমাবেশ ঘটিয়েছেন।
পরবর্তী অধ্যায়টির কিছু ঐতিহাসিক মূল্য আছে। এই অধ্যায়ে সুভাষ চৌধুরী আলোচনা করেছেন রবীন্দ্রসংগীতের প্রাচীন ও আধুনিক শিক্ষাপদ্ধতি নিয়ে। নানা তথ্যের সমাবেশে দেখিয়েছেন কেমন করে শান্তিনিকেতনের গানের পাঠক্রম বিবর্তিত হতে হতে শেষ পর্যন্ত সংগীতভবনের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ পাঠক্রমে পরিণত হল। তার বিবর্তনের ইতিহাস আমাদের সকলের কাছে মূল্যবান। পরিশেষে মৃদু অভিযোগের সুর তুলে জানিয়েছেন যে সংগীতভবনের আধুনিক পাঠক্রমের ঝোঁক রবীন্দ্রসংগীতের তাত্ত্বিক বা ঔপপত্তিক দিকেই। ক্রিয়াসিদ্ধির দিকে নয়। এ পাঠক্রম শিল্পী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে - এমন আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন। কিন্তু স্বীকারও করেছেন পাঠক্রমের বদলের সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন ঘটেছে। বাংলা গানের সামগ্রিক সাংগীতিক পটভূমিতে রবীন্দ্রসংগীতের সঠিক অবস্থানের জায়গাটির মূল্যায়নের পথে পাঠক্রমটি দিকনির্দেশক।
'রবীন্দ্রসংগীত যন্ত্রানুষঙ্গ' অধ্যায়টি এ গ্রন্থের উল্লেখযোগ্য একটি আলোচনা। সাম্প্রতিক কালে রবীন্দ্রসংগীতে যন্ত্রের ব্যবহার নিয়ে যে চিন্তাহীন নৈরাজ্য চলেছে তারই প্রেক্ষিতে সুভাষ চৌধুরীর আলোচনায় কিছু যুক্তিগ্রাহ্য দিকনির্দেশ আছে। য়ুরোপীয় কম্পোজারদের রচনায় যেমন সহযোগী যন্ত্র ও লয় নিয়ে নির্দেশ থাকে রবীন্দ্রসংগীত স্বরলিপিতে বা প্রশিক্ষণে কোথাও তেমন নির্দেশ আমরা পাই না। এই কারণে রবীন্দ্রপ্রয়াণের পর নানা প্রশ্ন ওঠে। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ওঠে সহযোগী যন্ত্র হিসেবে হারমোনিয়মের ব্যবহার নিয়ে। সে বিতর্ক এখনও চলছে। কিছু আচার্যের মতে হারমোনিয়ম অস্পৃশ্য এবং সর্বদা বর্জনীয়। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং জানিয়েছেন তিনি নিজেও এই "কল-টেপা" যন্ত্রের গোলামি করেন নি। কিন্তু এই যন্ত্রের সহযোগ তাঁর জীবনে যে অনেকবার ঘটেছিল - সুভাষ চৌধুরী সেই তথ্যগুলি আমাদের সামনে রেখেছেন। সুভাষ চৌধুরী জানাচ্ছেন "... ১৯৩১ সালে রবীন্দ্রনাথের সপ্ততিবর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে যে উৎসবানুষ্ঠান হয়েছিল, সেখানে দিনেন্দ্রনাথ এবং ইন্দিরা দেবীর ওপর সংগীতানুষ্ঠানের পরিচালনার দায়িত্ব ছিল। অংশগ্রহণ করেছিলেন শান্তিনিকেতন ও তার বাইরের অনেক শিল্পী। অনুষ্ঠান চলাকালীন ঢালাও হারমোনিয়ম ব্যবহারের কথা জানা যায় এবং রবীন্দ্রনাথ সমস্ত অনুষ্ঠানেই উপস্থিত ছিলেন - কিন্তু হারমোনিয়ম ব্যবহার বিষয়ে যে কোনো বিরূপ মন্তব্য তৎকালে অথবা পরবর্তীকালে করেছেন বলে জানা যায় না।" (পৃষ্ঠা ৫৮) আজ রবীন্দ্রসংগীতের বিপুল প্রচার প্রসার এবং জনপ্রিয়তা। বৃহত্তর রবীন্দ্রসংগীত সমাজে আজ হারমোনিয়মের অনুষঙ্গ প্রশ্নহীনভাবে গৃহীত। সুভাষ চৌধুরীর মতে এই পরিবর্তিত পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রসংগীতে যন্ত্রানুষঙ্গ নিয়ে আবশ্যিক হল নতুন ভাবনা। হারমোনিয়ম তাঁর কাছে ব্রাত্য নয়। রবীন্দ্রনাথের গানে সব যন্ত্রকেই তিনি সহযোগী যন্ত্রের স্বীকৃতি দিয়েছেন। কিন্তু বলেছেন যে গীতরূপকে ক্ষুন্ন ও গৌণ করে যে যন্ত্রানুষঙ্গ তা পরিহার করা দরকার। ভারতীয় সংগীতের পরম্পরাকে দূরে বিসর্জন দিয়ে যে যন্ত্রানুষঙ্গ তা সুভাষ চৌধুরীর অনুমোদন পায়নি, যদিও তাঁর প্রগতিশীল মনন সর্বদা নতুন পরীক্ষানিরীক্ষার পক্ষপাতী ছিল। সাম্প্রতিক কালে রবীন্দ্রনাথের গানে যে সব প্রিলিউড ইন্টারলিউড বা ফিলার ব্যবহার করা হয় তাতে দেখা যায় মূলগানের সুরের বা ভাবের সঙ্গে ওই সব প্রিলিউড ইত্যাদির স্বরসমষ্টি বা ভাবের কোনো মিলই নেই। রবীন্দ্রনাথ নিজে যে সব গান গেয়েছেন রেকর্ডে সেখানে কোনো যন্ত্রের সহযোগিতা নেই। যন্ত্রের আভরণ ছাড়া সেই সব বিনা সাজে সেজে-ওঠা গানগুলিই তো শ্রেষ্ঠ রবীন্দ্রসংগীতের নিদর্শন।
পরবর্তী অধ্যায়ের শিরোনাম 'পরীক্ষানিরীক্ষা সমালোচনা দরকার'। অধ্যায়টি সংক্ষিপ্ত আকারে, কিন্তু বক্তব্যে নয়। এই একই বক্তব্য অবশ্য পূর্ববর্তী কোনো কোনো নিবন্ধে উপস্থিত করেছেন। তাঁর মতে রবীন্দ্রনাথের গান 'সর্বজনের, সর্বকালের, সর্বযুগের'। তাই এ গান গাইবার অধিকার সকলেরই আছে। হয়তো সঠিকভাবে গাওয়া হচ্ছে না, একটু হেরফের হচ্ছে। এ নিয়ে স্পর্শকাতরতা পরিহার করতে বলেছেন লেখক। বলেছেন একই স্বরলিপি অনুসরণ করেও পাঁচজনের গান পাঁচরকম শোনাতেই পারে। কারণ ব্যক্তিত্ব যে আলাদা। রবীন্দ্রসংগীত গাইবার "ঢং" বস্তুটি নিতান্ত ব্যক্তিগত। তাই কাঠামো ঠিক রেখে গাইলেও গান-উপস্থাপনার ঢং-এর বদল অনিবার্য। তাই লেখক রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা আলোচনা-সমালোচনাকে স্বাগত জানিয়েছেন। কারণ এই সব প্রক্রিয়ার দ্বারাই তো মহৎ সৃষ্টির সম্পর্কে আমাদের সচেতনতা বাড়ে এবং চর্চার মধ্যে দিয়ে সৃষ্টিকেই বাঁচিয়ে রাখার প্রয়াস করে।
'রবীন্দ্রনাথের গানে অলংকরণ প্রয়োগ ও মূল্যায়ন' শীর্ষক আলোচনায় সুভাষ চৌধুরী উদাহরণ-সহযোগে আমাদের দেখিয়েছেন অলংকরণগুলি গানের ভাব প্রকাশের জন্যে কতটা অপরিহার্য। একই নিবন্ধে তিনি কবিতার অর্থবোধের জন্য সঠিক যতির ব্যবহার ভাবপ্রকাশের জন্য কতটা সহায়ক হতে পারে--তারও দিকনির্দেশ করেন। কেবল তালের আবর্তনের শেষে যতিপাতই শিল্পীদের স্বভাবজাত হয়ে গেছে। এমন অনেক উদাহরণ দেওয়া যায় যেখানে শিল্পীর শ্বাসগ্রহণ ও যতিপাতের ধরনটি তাল ও ছন্দের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এর ফলে গানের অর্থবোধ বিঘ্নিত হয় এবং ভাবরূপের ক্ষতি করে। অপরপক্ষে অলংকার প্রয়োগের বাহুল্য গীতরূপকে ভ্রষ্ট ও অসংলগ্ন করে। এর দৃষ্টান্তও কম নয়। এই সঙ্গে লেখকের তালাধ্যায় অংশের কিছু সমস্যা আলোচনা করা যেতে পারে। লেখক আমাদের দেখিয়েছেন অনেক গানের সঠিক ছন্দ স্বরলিপিতে রক্ষিত হয় নি। একটি উদাহরণও দিয়েছেন 'প্রেমে প্রাণে গানে গন্ধে' গানটিতে ত্রিমাত্রিক ঝোঁক প্রায় সারা গানটি জুড়েই। কিন্তু এ গানের স্বরলিপি করা হয়েছে নবতালে অর্থাৎ ৩/২/২/২ ছন্দে। এটিকে প্রথাগত নবতালে বদ্ধ না করে ত্রিমাত্রিক ছন্দে লিপিবদ্ধ করলেই রবীন্দ্রনাথের প্রতি সুবিচার করা হত। রবীন্দ্রনাথ তো নিজেই করেন তাঁর 'যে কাঁদনে হিয়া কাঁদিছে' গানটিতে। তালে বদ্ধ অনেক গান অত্যধিক অলংকার প্রয়োগে কেমন করে যে 'ঢালা' গানের রূপ পায় তা কেউ জানে না। এ প্রসঙ্গে দুটি গানের উল্লেখ করা যায়। 'ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা' আর 'আহা তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা'। গান দুটি যথাক্রমে ঝম্পক ও দাদরা তালে নিবদ্ধ হয়ে স্বরবিতানে প্রকাশিত। এবং তা গাওয়া হলে কোথাও গান দুটির ভাবের হানি ঘটছে বলা যায় না। অথচ তাল বাদ দিয়ে টপ্পার দীর্ঘ অলংকরণ প্রয়োগ করে গানদুটি গাওয়া হয়ে থাকে। এর ফলে গানদুটির বাণীর সংলগ্নতা ব্যাহত হয়। যে সব শিল্পীরা এই ধরনে গান দুটি পরিবেশন করেন তাঁরা জানান যে শ্রদ্ধেয় আচার্যের কাছেই তাঁদের তালিম। অথচ শ্রদ্ধেয় আচার্যরা এই রূপবদল নিয়ে আমাদের কিছুই জানান না বা পরিবর্তিত রূপের স্বরলিপিও প্রকাশ করেন না। তাই দেখা যাচ্ছে যে অতি-অলংকার প্রয়োগের আতিশয্যে তাল পরিহার করা যাচ্ছে আর সেই সঙ্গে অর্থবোধেও বিপর্যয় ঘটে। তালে অদক্ষ অথচ টপ্পার অলংকরণে পটু শিল্পীরাই এই ধরনের পরিবর্তিত গানগুলির প্রধান প্রবক্তা।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের গান সম্পর্কে অনেক কথাই বলেছেন। সেই উক্তিগুলি যে সবসময় স্ববিরোধমুক্ত একথা বলা যাবে না। সুভাষ চৌধুরী তাঁর 'রবীন্দ্রনাথের গান: এই সময়' নিবন্ধে রবীন্দ্রনাথের দুটি উক্তি ব্যবহার করেছেন। প্রথম উক্তিটির সারাংশ এই যে গান নানা কন্ঠবাহিত হয়ে প্রকাশিত বলেই গানে কিছু-না-কিছু রূপান্তর ঘটতে পারে, যা কাব্য সাহিত্য বা চিত্রকলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। আর দ্বিতীয় উক্তিটিতে বলা হয়েছে যে তাঁর গান কথা ও সুরের মিলিত শক্তিতে গড়ে উঠেছে, সে কারো কাছে ঋণী নয়। তাই সগর্বেই বলছেন রবীন্দ্রনাথ "তোমার গান রইল, এ আর কাল অপহরণ করতে পারবে না"। তাঁর এই দুটি উক্তিই আপাত স্ববিরোধিতা সত্ত্বেও ঠিক। রবীন্দ্রসংগীত কালজয়ী হয়েছে এবং হবে। আর এটাও সত্য নানা অদীক্ষিত শিক্ষাহীন কন্ঠে পরিবেশিত হতে হতে রবীন্দ্রসংগীতের রূপান্তর ঘটছে, বিবর্তন নয়। এই রূপান্তরের আর্থসামাজিক কারণও নির্দেশ করেছেন সুভাষ চৌধুরী। বিগত অর্ধ শতক জুড়ে ব্যাপক প্রচার ও প্রসারের মূলে আছে রবীন্দ্রসংগীতের পণ্য হয়ে ওঠা। সুভাষ চৌধুরী বেতার ও দূরদর্শনের উদাহরণ দিয়েছেন। বেতারে রবীন্দ্রসংগীত প্রচারের সময় কমেছে অনেক। কিন্তু তার পাশাপাশি আমরা দেখছি দূরদর্শনের অসংখ্য চ্যানেলে রবীন্দ্রনাথের গান অনেক বেশি জায়গা পাচ্ছে। লেখক জানিয়েছেন দূরদর্শনে এই বৃদ্ধির কারণ আর্থিক। পাদপ্রদীপের আলোয় আলোকিত হবার আশায় অসংখ্য শিল্পী অর্থবিনিয়োগ করে গান গাইবার সুযোগ পাচ্ছেন চ্যানেলে চ্যানেলে। অর্থই যখন মাপকাঠি যোগ্যতা নিরূপণে, তখন শিল্পীর ক্রিয়াসিদ্ধি নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। স্বভাবতই গানের মান নিম্নমুখী হয়। টিভির চ্যানেলগুলি, ক্যাসেট বা সিডি কোম্পানি কেবলমাত্র আর্থিক লাভের কারণেই এই খেলায় মেতেছেন। বর্তমান প্রতিবেদকের মনে হয় কেবল গণমাধ্যম দোষী এমনটা নয়। যশপ্রার্থী তরুণ শিল্পীদের রুচি সংস্কৃতি গানের প্রতি ভালোবাসা, নিজেদের আত্মসম্মানজ্ঞান ইত্যাদির প্রশ্নও স্বাভাবিকভাবে এসে পড়ে। আবার এটাও সমান্তরালভাবে দেখা যাচ্ছে যে কেউ কেউ হয়তো সচেতনভাবেই রবীন্দ্রনাথের গানের উন্নতিসাধন করতে চাইছেন নানাভাবে। এই সব অবক্ষয় সত্ত্বেও মনে হয় রবীন্দ্রনাথের গান নিজের জোরেই তার নিজস্বতা নিয়ে বেঁচে থাকবে। তার বহিরঙ্গে চাকচিক্য সাধনের নির্বোধ ঔদ্ধত্য যতই দেখানো হোক না কেন, রবীন্দ্রনাথের গান তার নিজস্ব স্বরূপেই প্রতিষ্ঠিত থাকবে কিছু শিল্পী প্রশিক্ষক শিক্ষার্থী ও রসবেত্তা শ্রোতার ভাবজগতের সমসাময়িক রবীন্দ্রসংগীত জগতের নানা পতনস্খলনের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করেই। কবি নিজেই বলেছেন, 'র'বার যেটা সেটাই রবে'।
পংকজকুমার মল্লিক একটা সময়ে সমকালের শ্রেষ্ঠ শিল্পী বলে বিবেচিত হতেন। রবীন্দ্রসংগীত ও রবীন্দ্রসংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল এই গায়ক রেকর্ডে সিনেমা ও রেডিওতে বহু রবীন্দ্রনাথের গান ব্যবহার করে তৎকালে রবীন্দ্রসংগীতকে প্রসারিত করেছিলেন। সুভাষ চৌধুরী জানিয়েছেন যে পংকজকুমার মল্লিক এমন অনেক গান রেকর্ডে গেয়েছেন যার স্বরলিপি তখন পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি। প্রকাশিত হবার পর দেখা গেল তাঁর গায়নের থেকে স্বরলিপি যথেষ্ট আলাদা। তাঁর গায়কীতে কিছু ম্যানারিজম ছিল। সুরের বিকৃতি, উচ্চারণে অনাবশ্যক ঝোঁক ইত্যাদি বিষয়ে পংকজ অবহিত ছিলেন বলে মনে হয় না। কিন্তু তিনি এমন একজন শিল্পী ছিলেন যাঁর কণ্ঠের মাধ্যমেই শ্রোতারা রবীন্দ্রনাথের গানের স্বাদ পেয়েছিলেন। আর একটা ব্যাপার এই যে তিনি গায়নে ভুল করলে তা স্বীকার করার সৎসাহস দেখিয়েছিলেন। (পৃষ্ঠা ৮৬)
বাংলা গানের বৃত্তের বাইরে একজন শিল্পীকে নিয়ে আলোচনা করেছেন সুভাষ চৌধুরী। শ্রী শচীনদাস মতিলালের নানা জৈবনিক ও সংগীতক্ষেত্রে তাঁর কৃতির কথা জানা যায়। ঠুংরির ক্ষেত্রে শ্রী মতিলালের বিপুল সংগ্রহ ছিল। ঠুংরির টেকনিক্যাল দিকটিতে জোর কমিয়ে তার "এক্স্প্রেশনাল সাইডের" উপর জোর দিয়ে তিনি নিজস্ব শৈলী গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর বিখ্যাত ঠুংরি "ন মানুঙ্গি" (খাম্বাজ ত্রিতাল) একদা মনোহরণ করেছিল শ্রোতার। সুরসাগর হিমাংশু দত্ত সম্পর্কেও আলোচনা আছে এ গ্রন্থে। তবে সুরসাগরের সংগীতপ্রতিভার যে বিপুল ব্যাপ্তি, তার প্রতি কয়েকটি ছোট বাক্য যথেষ্ট হয় না। তাঁর সম্পর্কে দীর্ঘতর আলোচনার দরকার ছিল। কিন্তু আসলে গ্রন্থসমালোচনা হিসাবেই সুরসাগর এসেছেন এ গ্রন্থে। কিন্তু ঠিক কোন গ্রন্থটি সমালোচিত হচ্ছে তার হদিশ নেই। সুরসাগর ছাড়াও নচিকেতা ঘোষের সুরকৃতির পরিচয় দিয়েছেন। এ লেখাকেও অসম্পূর্ণ মনে হয়। কারণ, এ লেখাও তো এক গ্রন্থ-সমালোচনা, যদিও গ্রন্থটির কোনো হদিশ নেই।
সুরকার সুকুমার রায়ের মূল্যায়ন করেছেন সুভাষ চৌধুরী। সুকুমার রায় সম্পর্কে বলতে গেলে তাঁর বংশপরিচয়ের কথা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। গানের পারিবারিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা সুকুমার রায় তাঁর নাটক, গান, কবিতার জন্য আমাদের কাছে কিংবদন্তী হয়ে আছেন। তাঁর আবোলতাবোলের কবিতা পড়ে বা মুখস্থ করেই তো আমরা শৈশব থেকে কৈশোরে উত্তীর্ণ হয়েছিলাম। কিন্তু সুরকার হিসেবে তাঁর সাফল্য যে কিছুমাত্র কম ছিল না সুভাষ চৌধুরী সেটাই প্রতিপন্ন করেছেন এই গ্রন্থে। বিভিন্ন নাটকে তাঁর চৌত্রিশটি গান পাওয়া যায়। সব গানগুলির সুর রক্ষিত হয় নি। নাটকে তাঁর গানের প্রয়োগ সম্পর্কে সুভাষ চৌধুরী আমাদের জানান যে গানগুলির সুর রক্ষিত হয় নি; গানগুলির সুরাবয়ব মাত্র চারটি স্বরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। সুর তাল লয় ছন্দ ও ভাবের যে অনন্য সমন্বয় এই নাটকের গানে পাওয়া যায় তার উদাহরণ-সহ পরিচয় এই নিবন্ধে পাওয়া যায়। নাটকের বাইরেও সুকুমার রায় গানের সুর দিয়েছেন। এরকম দুটি গানের স্বরলিপি এ গ্রন্থে মুদ্রিত হয়েছে। আরও একটি স্বরলিপি সংযোজিত হয়েছে এই গ্রন্থে। গানটি হল "গান জুড়েছেন গ্রীষ্মকালে ভীষ্মলোচন শর্মা"। সুরকার স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। সুভাষ চৌধুরী জানাচ্ছেন যে গানটি ১৯৩৫-এ রবীন্দ্রনাথের সুরেই শান্তিনিকেতনে গাওয়া হয়।
'মুক্তির গান' শীর্ষক নিবন্ধে এক গ্রন্থসমালোচনার সূত্রে লেখক স্বদেশী গানের ইতিবৃত্ত উপস্থিত করেছেন। মুক্তির গান আর দেশাত্মবোধক স্বদেশী গান ঠিক সমার্থক নয়। মুক্তির গানের পরিসর অনেক বড়। কেবল দেশমাতৃকার নানা রোমান্টিক মিথকে সরিয়ে রেখে মুক্তির গান তার অভিযাত্রা শুরু করে। অতীত গৌরবের জয়গানে মুখর স্বদেশী যা নেই, সেই রাজনীতি সমাজনীতি অর্থনীতিও মুক্তির গানে স্থান পেয়ে সমকালীন বাস্তবতাকে ছোঁয়। উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকেই বাংলা কবিতায় ও গানে স্বাদেশিকতার প্রথম আবির্ভাব পরিলক্ষিত হয়। হিন্দুমেলার কাল থেকে স্বাধীনতা প্রাপ্তির কাল পর্যন্ত দেশাত্মবোধক গানের বিস্তার। তবে প্রথম মুক্তির গানের সম্মান সুভাষ চৌধুরী সঙ্গতভাবেই দিয়েছেন রামনিধি গুপ্ত রচিত "নানান দেশের নানান ভাষা" গানটিকে। এ-গানটিতেই প্রথম মাতৃভাষার জয়গান শোনা যায়। তাই জাতীয়তার উন্মেষে গানটিকে পথিকৃৎ বলেই ধরা যায়। এর পরের উল্লেখযোগ্য স্বদেশী বা জাতীয় গান হল 'বন্দেমাতরম্'। সত্যেন্দ্রনাথ রচিত 'মিলে সবে ভারতসন্তান' প্রায় সম সময়েরই রচনা। লেখক জাতীয় মেলার কাল থেকে স্বদেশী গান রচনার যে ঢেউ উঠেছিল তার পরিচয় দিয়েছেন--অসংখ্য রচয়িতার গানের নমুনা উদ্ধৃত করেছেন। এই সব উল্লেখ থেকে দেশাত্মবোধক গানের বিবর্তনের একটি ছবি স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। রামনিধি গুপ্ত থেকে জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র পর্যন্ত স্বদেশাত্মক গানের ক্রমবিবর্তন গভীর পর্যবেক্ষণে লিপিবদ্ধ করেছেন। আলপনা রায় সংকলিত ও সম্পাদিত 'রবীন্দ্রনাথের স্বদেশি গান' গ্রন্থটির সমালোচনাও আলোচ্য গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত। সুভাষ চৌধুরী গ্রন্থটির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন, যা প্রাপ্য। স্বদেশী গানের সঙ্গে ধর্ম ঈশ্বর ও নীতিবোধ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে ছিল। রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ পর্যায়ের গানেই প্রথম দেখা গেল স্বদেশাত্মক গানের মানবিক মুখ। স্বদেশপ্রেম সেক্যুলার সংকীর্ণতা থেকে মানবতার উচ্চে অধিষ্ঠিত হল অনেকাংশে। তবু বলা যায় রবীন্দ্রনাথের স্বদেশপ্রেমের গান মাতৃবন্দনা, অতীত গৌরবগাথা ইত্যাদি থেকে ষোলোআনা মুক্ত ছিল না।
স্বদেশপ্রেমের গান ঔপনিবেশিক ভারতে মুক্তির গান হিসেবেও আখ্যা পেত। রবীন্দ্রপরবর্তী গীতিকার ও সুরকাররা মাতৃবন্দনার ভুল স্বর্গ থেকে মাটিতে দুপা রাখলেন। রবীন্দ্রনাথের পরে সবচেয়ে রাবীন্দ্রিক সুরকার ও গীতিকার জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রকে নিয়ে একটি স্বতন্ত্র অধ্যায় রচনা করেছেন সুভাষ চৌধুরী। জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের জীবনপঞ্জি এবং তাঁর হয়ে ওঠার কিছু মূল্যবান তথ্যও সংকলিত হয়েছে এই গ্রন্থে। জানা যায় যে পারিবারিক পরিবেশ থেকেই দেশজ ও শাস্ত্রীয় সংগীতের ভিত তৈরি হয় জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের। তিনি রবীন্দ্রসংগীতে শিক্ষাগ্রহণ করার সুযোগ পেয়েছিলেন ইন্দিরা দেবী সরলা দেবী দিনেন্দ্রনাথ শৈলজারঞ্জন মজুমদার অনাদিকুমার দস্তিদার ও শান্তিদেব ঘোষ প্রমুখের কাছে। তাঁর পাশ্চাত্য সংগীতে দীক্ষার পিছনে ছিলেন বিষ্ণু দে, নীরদচন্দ্র চৌধুরী ও চঞ্চলকুমার চট্টোপাধ্যায়। রাগসংগীত লোকসংগীত ও পাশ্চাত্য এই ত্রিধারায় শিক্ষিত জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র যে তার সৃষ্টিতে অতুল শক্তিমত্তা ও মৌলিকতার পরিচয় দেবেন এ আর আশ্চর্য কি। তিনি কবি। তাঁর এই পরিচয়টি একদা জনপ্রিয় হয়েছিল শম্ভু মিত্রের কণ্ঠে তাঁর কবিতা 'মধুবংশীর গলি'র রূপায়ণে। তাঁর নবজীবনের গান লিরিক সুরে বাংলা গানের একটি জীবনদায়ী বাঁক সৃষ্টি করেছিল। তাঁর 'এসো মুক্ত করো অন্ধকারের এই দ্বার' — গানটিকে সব গণসংগীতের পিতৃপ্রতিম বলা যায়। এছাড়া তাঁর 'রামলীলা' সর্বভারতীয় স্বীকৃতি পায়। বিষ্ণু দে'র 'স্মৃতিসত্তাভবিষ্যৎ'কে সুরে বসিয়ে সার্থক করা নিঃসন্দেহেই জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের এক বিশাল কীর্তি। জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র তাঁর সৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথের মতোই ঐতিহ্যকে আত্মসাৎ করেই অতিক্রম করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের গীতাদর্শ তাঁর সৃষ্টিতে ক্রিয়াবান থাকার জন্যেই তাকে কেউ কেউ রাবীন্দ্রিক সুরকার বলেন।
'রবীন্দ্রনাথের গান ও অন্যান্য' গ্রন্থের দ্বিতীয় পর্বের প্রথমেই যে অধ্যায় তার নাম ইন্দিরা দেবীর গানের খাতা। এই খাতাটি একটি সোনার খনি। রবীন্দ্রনাথের অনেক গান বিষয়ে এটি তথ্যের বিপুল আকর। বিশেষ করে এই খাতাটি থেকে ভাঙাগানের বিচিত্র সংবাদ পাওয়া যায়। পাওয়া যায় মূল গানগুলির সম্পূর্ণ টেক্স্ট। এই খাতায় ইন্দিরা দেবী সংগৃহীত তিনশো একচল্লিশটি গান আছে। রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের ভাঙাগানের উৎস নির্দেশ করা আছে এই খাতায়। কেবল ব্রহ্মসংগীত নয়, তৎকালে প্রচলিত টপ্পা গান নয়, 'ও মা কালী মুণ্ডমালী'র মতো শ্যামাসংগীতও তাঁর সংগ্রহে স্থান পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতবর্ষেও যে আমরা তাঁর গীতসুধা পিপাসিত চিত্তে পান করতে পারছি, তার মূলে এঁরাই। সরলা দেবী, ইন্দিরা দেবী বা দিনেন্দ্রনাথের এই সংগ্রহস্পৃহা না থাকলে রবীন্দ্রনাথের গান যথাযথভাবে সংরক্ষিত হত না। এই সব পূর্বসূরীর অবদান মনে রাখা আমাদের পক্ষে আবশ্যিক। ইন্দিরা দেবীর গানের খাতার বিবরণ পড়ে সেই কথাই বারবার মনে হয়েছে।
বইটিতে সুভাষ চৌধুরী কয়েকটি গ্রন্থের সমালোচনা করেছেন। এর মধ্যে একটির কথা আগেই বলেছি। এই গ্রন্থসমালোচনাগুলি ছাড়া এই গ্রন্থের সর্বাপেক্ষা উল্লেখ্য হল সুভাষ চৌধুরী গৃহীত দুটি সাক্ষাৎকার এবং আর একটি নিবন্ধ যার আলোচ্য বিষয় সত্যজিৎ রায়ের সংগীতভাবনা। এই দুটি সাক্ষাৎকার এবং সত্যজিৎ-বিষয়ক লেখাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, রবীন্দ্রসংগীত অনুসন্ধিৎসুদের কাছে এ এক পরমপ্রাপ্তি।
প্রথম সাক্ষাৎকারটি সাহানা দেবীর। সংগীতজগতে প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব সাহানা দেবীর পরিচয় দেওয়া বাহুল্যমাত্র। প্রখ্যাত ব্রাহ্মনেতা কালীনারায়ণ গুপ্ত তাঁর পিতামহ। মাতামহ ভুবনমোহন দাশ, চিত্তরঞ্জন দাশের পিতা। মাসি অমলা দাশ সে যুগের প্রখ্যাত গায়িকা। ভ্রাতা অতুলপ্রসাদ সংগীত রচয়িতা। খুব ছেলেবেলা থেকেই তাঁর সংগীতপ্রতিভার স্ফুরণ ঘটেছিল। তাঁর বিবাহিত জীবন সুখের হয়নি। কিন্তু পণ্ডিচেরিতে তিনি তাঁর প্রেমিকের সঙ্গে মিলিত হতে পেরেছিলেন — এই তথ্য সুভাষ চৌধুরী এই গ্রন্থে সমাবিষ্ট করেছেন। (পৃষ্ঠা ২৬৪) মাতুল চিত্তরঞ্জন দাশের বাড়িতেই তাঁর বেড়ে ওঠা। সেইসূত্রে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। গায়িকা হিসাবে রবীন্দ্রনাথের স্বীকৃতি পেয়েছিলেন তিনি। সব ছেড়ে একদা পণ্ডিচেরির নিভৃত বাস মেনে নেন। তাঁর এই সাক্ষাৎকারটি থেকে জানা যায় তাঁর রক্ষণশীল পরিবেশের কথা। গানের সঙ্গে সঙ্গে নাচেও তাঁর আগ্রহ ছিল। নানা বাধাবিপত্তিতে নাচের প্রতিভা স্ফুরিত হতে পারে নি। তাঁর জীবনের নানা ঘটনার কথা আমাদের জানিয়েছেন। একবার দিনেন্দ্রনাথের টেলিফোনে চৌদ্দটি গান শিখেছিলেন। জোড়াসাঁকোয় দিনেন্দ্রনাথ আর ভবানীপুরে সাহানা। জোড়াসাঁকো যাবার জন্য কোনো গাড়ি না পাওয়ায় গান শেখার এই বিকল্প ব্যবস্থা। রবীন্দ্রনাথ গানের সুর অহরহ ভুলে যেতেন। তাই নিয়ে অনুযোগ করেছেন কবির কাছে। রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন, যাকে তিনি প্রথম শেখান সেইটিই সঠিক সুর। সাহানা দেবীর নিজের কথায় "অনেক সময় দেখেছি, উনি ভুলে যেতেন, দিন্দা কাছে থাকলে উনি একটু থেমে দিন্দার দিকে তাকাতেন, আর দিন্দা তখ্খুনি সুরটা ধরে দিতেন।" প্রবাসে থাকলেও বাংলা গান বা রবীন্দ্রসংগীত শোনায় তাঁর ফাঁক পড়েনি। তাঁর অনুজ শিল্পীদের মধ্যে সুচিত্রা মিত্র এবং সুবিনয় রায়ের গান তাঁর পছন্দ বলে জানিয়েছেন। পরিবর্তমান সংগীত পরিবেশের মধ্যে সেই পুরানো কালের গানের প্রাণনিষ্ঠা পেতেন না। স্বয়ং রচয়িতার কাছে গান শেখা আর রচয়িতার প্রয়াণের পর তাঁর শিষ্য প্রশিষ্যদের কাছে গান শেখা— এ দুটির চরিত্র পৃথক হবেই। এই পরিবর্তনকে সহজ যুক্তিতে মেনে নিয়েছিলেন সাহানা দেবী। অতীতচারী হাহুতাশ তাঁর মধ্যে কমই ছিল। তাঁরই স্মৃতি থেকে রবীন্দ্রনাথের তিনটি গান স্বরলিপি করে স্বরবিতানে অন্তর্ভুক্ত হয়। গান তিনটি হল: দিন ফুরালো হে সংসারী, খেলার সাথি বিদায়দ্বার খোলো, এবং বুঝি ওই সুদূরে। আমাদের সৌভাগ্য তাঁরই আনুকূল্যে গান তিনটি সংরক্ষিত হতে পেরেছিল। অতুলপ্রসাদের গানের স্বরলিপিগ্রন্থও তাঁর অবদান। এ গানের স্বরলিপিগুলি তিনি ও দিলীপকুমার রায় যৌথভাবে করেন। সুভাষ চৌধুরী সাক্ষাৎকারের মধ্যে দিয়ে সাহানা দেবীর সংগীতচিন্তার এক ব্যাপক পরিচয় দিতে পেরেছেন। তাঁর এই কৃতিত্ব অভিনন্দনীয়।
এবারে এই গ্রন্থের শেষ প্রতিবেদনটি দুটি বিষয়ে। একটি বিষয় হল সত্যজিৎ রায়ের সংগীতভাবনা। অপরটি সত্যজিৎ রায়ের একটি সাক্ষাৎকার। এই দুটি বিষয়ই সম্পৃক্ত হয়ে আছে সত্যজিৎ রায়ের একটি পূর্বপ্রকাশিত নিবন্ধেঃ 'রবীন্দ্রসংগীতে ভাববার কথা'। এই প্রবন্ধে বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্র পরিচালক ও সংগীত পরিচালক এবং জনপ্রিয় লেখক সত্যজিৎ রায় যে সব নতুন চিন্তার দিগন্ত উন্মোচন করেছেন সুভাষ চৌধুরী তার সঙ্গে একমত হলেও অনেক বিষয়ে সহমত হতে পারেন নি। সেই নিয়েই সুভাষ চৌধুরীর নিবন্ধটি গড়ে উঠেছে। সত্যজিতের প্রবন্ধে আলোচিত নানা প্রসঙ্গ সাক্ষাৎকারেও সুভাষ চৌধুরী তুলেছেন। এর একটাই কারণ, প্রবন্ধটিতে সত্যজিৎ যে মতামত ব্যক্ত করেছেন তার যাথার্থ দ্বিতীয়বার নিরূপণ করা। সত্যজিৎ রায় তাঁর সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে রাগরাগিণী রবীন্দ্রনাথের গানে খুবই অপ্রতিভ দেখায়। রাগের স্বর ব্যবহৃত হয়েছে, কিন্তু শ্রুতি নেই। তাঁর এই মত মানা যায় না কারণ রাগসৃষ্টি তো রবীন্দ্রনাথের অভিপ্রায় ছিল না। সব মহৎ শিল্পীর মতো তিনি ঐতিহ্যকে আত্মসাৎ করে তাকে অতিক্রম করেই নতুন সৃষ্টির পথে এগোতে চেয়েছিলেন। কথা ও সুরের মিলিত যে configuration তাতে রাগ সপ্রতিভ হলেই অসুবিধা। সত্যজিৎ রায় অভিযোগ করেছেন "এই যে বকুল পারুল চাঁপা টগর চামেলির সম্ভার, এই যে শরতের আলো, ফাল্গুনের রং, বরষার গুরুগুরু, বসন্তের হাওয়ার হিল্লোল বা মনের দোলায় দেয় দোল, এই যে মনের দোলায় দেয় দোল, এই যে মনের বীণার সুরের পরশ, হৃদয়ের তন্ত্রীতে বেদনার ঝংকার - এই যে দূরে যাওয়া কাছে আসা, আধো চাওয়া আধো হাসা - এও কি 'কেসে পনিঘট যাঁউ' আর 'পিয়া পিয়া পাপিয়া' আর 'ভরু ভরু অঙ্গ আঁখিয়া'র মতো ফরমুলা নয়; cliche নয় - আজকের দিনে ঠুংরি গানের কথার মতোই যা প্রায় অর্থহীন?" স্বীকার করে নেওয়া ভালো যে রবীন্দ্রনাথের গানে অনেক দুর্বল লিরিক হয়তো আছে। কিন্তু সত্যজিৎ রায় যে উদাহরণ আহরণ করেছেন তার বাইরে তাকাতে পারেন নি কেন এ প্রশ্ন থেকে যায়। এ প্রশ্নের একটা সহজ উত্তর এই যে রবীন্দ্রসংগীতের সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের সামগ্রিক পরিচয় ছিল না হয়তো। সামগ্রিক পরিচয় অর্জন করার সময় ও অধ্যাবসায় স্বাভাবিক কারণেই তাঁর কম ছিল। রবীন্দ্রনাথের গানে লোকায়ত সুর দেওয়ার ব্যাপারে তাঁর পর্যবেক্ষণ ছিল: "সুর লোকসংগীতের, কিন্তু ভাষা ভদ্র মার্জিত, প্রশ্ন ওঠে - এ সংগীতের স্থান কোথায়?" সুভাষ চৌধুরী এর উত্তরে ধূর্জটিপ্রসাদের লেখা থেকে প্রাসঙ্গিকভাবে উদ্ধার করেছেন "এ ধরনের মিশ্রণের একটা নতুন প্রকৃতি আছে, সেটা হল জীবনের প্রকৃতি, সুর নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, সাহিত্যে ভাঙন ধরছে, আর্টে কিছু হচ্ছে না, এ্যাকাডেমিক হয়ে যাচ্ছে - সে সময় জমি থেকে মাটি থেকে একটা নতুন জীবন বইতে থাকে"। রবীন্দ্রনাথ রাগসংগীত বা লোকসংগীত স্রষ্টা ছিলেন না। নিজের গানে সংরক্ষণ করেছিলেন সেই সুর আর ভাব। সত্যজিৎ রায় গানের সঙ্গে এস্রাজ, বেহালা বা হারমোনিয়ম সঙ্গতের বিরোধী। তাঁর মতে এতে tautology-র সৃষ্টি হয়। কিন্তু এই tautology তো আবহমান কাল ধরে সব রকমের ভারতীয় সংগীতে প্রচল আছে। যে সঙ্গত গলাকে এবং সর্বোপরি কণ্ঠস্বরের দুর্বলতাকে ঢেকে দেওয়ায় ব্যবহৃত তাকে অবশ্যই পরিহার করা উচিত। কোনোরকম সঙ্গত ছাড়াই রবীন্দ্রনাথের খালি গলায় গাওয়া রেকর্ডগুলিই আদর্শ —এ কথা স্বীকার করেছেন সত্যজিৎ। যন্ত্রানুষঙ্গ ব্যবহারের দিক থেকে সত্যজিৎ ও সুভাষ চৌধুরী একমত। রবীন্দ্রনাথের গানে সবরকমের যন্ত্র ব্যবহার্য। কেবল তবলা বা খোলের বদলে পিয়ানো বা তদনুরূপ কোনো যন্ত্রে ছন্দ রক্ষা করাই ভালো। কারণ তবলা বাদনের অতিরেক গানকে ক্ষুণ্ণ করে। এই সব নানা নতুন চিন্তায় রবীন্দ্রগানের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে চেয়েছেন সত্যজিৎ। কিন্তু যেটা বারবার তাঁর লেখায় বা সাক্ষাৎকারে প্রতীয়মান হয় সেটা হল এই যে রবীন্দ্রনাথের গানের আদি, মধ্য ও অন্ত পর্বের বিবর্তন সম্পর্কে তাঁর সম্যক পরিচয় ছিল না। সুভাষ চৌধুরীর 'সত্যজিতের রবীন্দ্রসংগীতভাবনা' শীর্ষক নিবন্ধ থেকে একটি উদ্ধৃতি দিয়েই শেষ করি: "... তিনি বলেন, 'এটাও লক্ষণীয় যে গানেই তাঁর একমাত্র সৃষ্টি যার পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে কাব্য উপন্যাসের তুলনায় বিবর্তনের মাত্রাটা এতে অনেক কম।' এই বাক্যটিতে এসে হঠাৎ একটিতে (যদ্দৃষ্ট) ধাক্কা খেতে হয়। সামগ্রিকভাবে রবীন্দ্রনাথের সমগ্র সৃষ্টির সঙ্গে পরিচয় থাকলে একথা কেমন করে মেনে নেওয়া যাবে?"