সাত নম্বর ওয়ার্ডের তমালদা পুলিশ সার্জেন্ট, ছয় ফুটিয়া, দশাসই চেহারা। কিন্তু সেকেন্ড ইয়ারে স্বরচিত কবিতা প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হয়েছিলেন। সেই থেকে সাত নম্বরে তিনিই রুচির মাপকাঠি। বিজয়গড়ে প্রথম যখন মেয়েরা ম্যাক্সি পরা শুরু করল তখনই তমালদার ভুরু কুঁচকে গেছিল, তারপর তারা যখন তার ওপরে একটা ওড়না বা গামছা ফেলে দোকান বাজার যেতে লাগল তখন তমালদার মনে হল এর একটা শেষ দেখা দরকার। প্রতিবাদ স্বরূপ একদিন তমালদা বৌদির ম্যাক্সি পরে বাজার সারলেন। সে এক হই হই ব্যাপার। সেদিনটা বৌদি দাঁতে দাঁত চেপে কাটালেন। পরের দিন থেকে মেয়ের শর্টস আর টি-শার্ট পরা শুরু করলেন। বয়স্ক প্রতিবেশীনির প্রশ্নের উত্তরে মিষ্টি হেসে বললেন, ‘ওর আসলে ম্যাক্সি খুব অপছন্দ।’
তমালদার আত্মীয়স্বজনরা বাড়ির অনুষ্ঠানে ডাকা বন্ধ করে দিল। তমালদাকে খুঁজতে পাড়ার ছেলে ছোকরারা ঘন ঘন যাতায়াত করতে থাকল। মাস খানেক পরে ঘরের ভিতরে কী কথা হল জানি না, একদিন বৌদি আবার ম্যাক্সি পরা ধরলেন, তমালদা সুবলের চায়ের দোকানে এসে বললেন, ‘বুঝলি, ম্যাক্সিটা খারাপ, কিন্তু মিনিটা আরও খারাপ।’
আমরাও একটা মিনি ট্রেক-এ জোর ধাক্কা খেয়েছিলাম।
সে-বার যাওয়ার কথা আমাদের কোহিমার হর্নবিল উৎসবে। আমার ছোকরা বন্ধুদের মনে হল এ নেহাত আলুনি হবে, সুতরাং এর সঙ্গে একটা মিনি ট্রেক জুড়ে নেয়া যাক। আমার অগ্রপশ্চাৎ ভাবার ক্ষমতা চিরকালই কম। তাই রাজি হয়ে গেলাম। আড্ডা দিতে দিতে পৌঁছে গেলাম ডিমাপুর। তারপর এক প্রাণান্তকর মোটরযাত্রা শেষে আমরা এসে গেলাম কিসুমা গ্রামের মোড়লের বাড়ির দোরগোড়ায়। এনার গরীবখানায় আজ আমাদের রাত্রিযাপন। তাঁর ড্রয়িং রুমে বসে কে খেতে খেতে ফায়ার প্লেসের ওপরে রাখা ছবি দেখিয়ে তিনি সবিনয়ে জানালেন তিনি ছিলেন স্বয়ং ফিজোর দোস্ত। দেখেছি গ্রামেও ওনার খুব মান্যিগণ্যি। মোড়লের বাড়ির এক চিলতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখা যায় খানিকটা দূরে টেবিল টপ-এর মতো একটা ঘাসজমি, তারপর একটা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে রাস্তা উঠে গেছে। ওই পথেই আমরা যাব জোকু উপত্যকা। গ্রামের ছেলেপুলেরা একদিনেই যাওয়া আসা করে। আমরা যাব আসব তিনদিনে। আমাদের একজন মালবাহক দরকার। সে মোড়লমশাই ঠিক করে দেবেন। কিন্তু বার বার আমাদের জিজ্ঞেস করা হল কেন খামোখা যাব ওখানে। কিছুই তো নেই ওখানে। আর আমাদের বারবার সাবধান করা হল ওখানে যম ঠান্ডা। যাঁরা পদযাত্রা করেন না তাঁদের আমরা কাউকেই কখনো বোঝাতে পারিনি কেন যাব। আর ঠান্ডা? হুঁ হুঁ বাবা, আমরা ধৌলাগিরি, মানাসলু কাঞ্চনজঙ্ঘার বেসক্যাম্প পাড়ি দিয়েছি, আমাদের ঠান্ডার কী ভয়?
খানাপিনার ব্যবস্থা চমৎকার। কথা আছে পরদিন আমরা রওনা হব ছোট হাজরির পর, বেলা গড়াতে থাকল, কিন্তু মালবাহকদের দেখা নেই। মোড়লমশাই আশ্বাস দিচ্ছেন এসে যাবে। অবশেষে তাঁরা এলেন দুপুর বেলা। হাসিমুখে জানালেন পথ তো মোটে ঘন্টা দুয়েকের। মোড়লের গাড়ি আমাদের টেবিল টপ-টা পর্যন্ত পৌঁছে দিল। দেখলাম একটা জল নেমে আসার রেখা। সেটাই ওপরে ওঠার পথ। আধঘন্টা মতো সেই সংকুল পথে উঠে যাওয়া। একটু পিছল রাস্তা। কিন্তু রাস্তার দুপাশে পাথরগুলো ঢেকে আছে বিছুটি গাছে। টাল সামলাতে গিয়ে সেদিকে হাত বাড়ালেই সপাং করে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছে, সার্কাসে বাচ্ছারা ভুল করলে যেমন রিং মাস্টারের চাবুক পড়ে।
তারপর অবশ্য ঘন মূলত বাঁশের এক জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ভালো রাস্তা পাওয়া গেল। কিন্তু ভারতের এই পুব কোনায় সন্ধ্যা নামে খুব তাড়াতাড়ি। সন্ধের পর শিবির পাতা ঝামেলা। তাই দলের খরগোশরা একটা বাঁকের পর দ্রুত মিলিয়ে গেল। কচ্ছপ গতির আমার; যখন শেষ চূড়াতে উঠে দেখতে পেলাম সামনে সবুজ উপত্যকায় তাঁবু পাতার কাজ চলছে নিশ্চিন্ত হলাম। কিন্তু কিছু কোপ তখনও বাকি। নীচে নেমে এসে বুঝলাম ওপর থেকে যেটাকে একটা নিরবচ্ছিন্ন সবুজ কার্পেট মনে হয়েছিল তার মধ্যে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে বেশ কিছু জলের ধারা। তাদের পার হওয়া খুব সহজ নয়, আর যেটাকে কোমল ঘাসজমি মনে হচ্ছিল সেটা আসলে একটা ঘন কঞ্চির বন— শক্ত, কাঁটাময়, কর্কশ। তার মধ্যে পা ফেলে ফেলে এগুনো বেশ দুষ্কর। তারপর মোকাম যখন প্রায় নাগালে এসে গেছে দেখা গেল প্রায় পরিখার মতো করে তাকে ঘিরে রেখেছে এক জলের ধারা। অন্ধকারের মধ্যে হেডটর্চ জ্বেলেও রক্ষা পাওয়া গেল না। ফচ্যাং করে পা ডুবে গেল কাদায় আর বুঝলাম ছুরির মতো হিমশীতল সেই জল।
সকালে উঠে দেখলাম জুতো তখনও ভেজা। চটি পরে ঘোরাঘুরি করতে গিয়ে কাঁটার খোঁচা খেলাম বিস্তর। কিলোমিটার দুই গেলে এই উপত্যকার অন্য ঢাল। কিন্তু পা জড়িয়ে ধরছে এই কঞ্চির বন। হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে সবাই কঞ্চি বাঁশের থেকে কত বেশি দড়। ঠিক করা হল মন ভালো করার লুচি-পায়েস তৈরি করে খাওয়া হবে। সময়ও কাটবে। তারপর খাওয়াদাওয়া করে জিনিসপত্র বেঁধেছেদে নেওয়া হল। যাতে মালবাহকরা এসে গেলেই চটপট এখান থেকে বেরিয়ে পড়া যায়। বেলা আড়াইটে নাগাদ বোঝা গেল তাদের আসার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। বিষণ্ণ মনে সেই মোট নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নিয়ে ফিরতে শুরু করলাম আমরা। একে বোঝা অনেকগুণ বেড়ে গেছে তাই দেরি হয়েছে বেরুতে। ফলে আবার সেই পথে ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এল। শেষ আধঘন্টা আবার সেই বিছুটির বনের মধ্যে দিয়ে কসরত করে নামতে হল। টেবিলটপে পৌঁছনোর পর দেখা গেল সেই রাতে কেউই আর নাগা সমাজের মুখদর্শন করতে চায় না। সিদ্ধান্ত হল ওখানেই তাঁবু পেতে আরেক রাত কাটিয়ে দেব। রসদ যা আছে পরের দিন সকাল অবধি চলে যাবে।
পাহাড়ের এই ঢালে ঠান্ডা অনেক মনোরম, জ্বালানির অভাব নেই, ফুর্তি করে কাটল সেই রাত। পরদিন সকালের চা হচ্ছে যখন মোড়লমশাই নিজে গাড়ি নিয়ে এসে হাজির হয়ে দুঃখপ্রকাশ করলেন আগের দিনের লোক না পাওয়া নিয়ে। একটি ছেলের বাড়িতে কোনো এক সংকট হয়েছিল। অন্যজন একা যেতে চায়নি। আমরা তাঁকে কে খাওয়ালাম। একটা সন্ধি স্থাপিত হল। তবে তিনি যখন আবার বলছিলেন যে জোকু দেখে আমরা নিশ্চয় হতাশ হয়েছি আমরা বললাম এমন অপরূপ উপত্যকা আমরা কম-ই দেখেছি। আ রে বাবা, গেরিলা যুদ্ধ আমরাও কি একেবারেই জানি না!
মেলার শহরটা একটা পাহাড়ে অনেকখানি জায়গা জুড়ে ধাপে ধাপে সাজানো। নীচের দিকে একটা মঞ্চ করা থাকে। তার সামনে অনেকটা খোলা জায়গা। তার কিনারা ঘেঁষে দর্শকদের বসার জায়গা। এই উঠোনে সারাদিন ধরে নানা নাগা ট্রাইবরা তাদের বিশেষ পোশাকে সজ্জিত হয়ে এসে নাচগান বা খেলাধুলোর আসর বসায়। এছাড়া বিভিন্ন ধাপে আছে তাদের নিজেদের ধাঁচে তৈরি করা সব কুটির। তাতে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের পোশাক পরা তরুণ তরুণীরা ঝলমল করছে। সেখানেও আলাদা ছোটো ছোটো আসর বসছে, অনেকগুলো কুটিরের সামনে ধোঁয়া ওঠা খাবার দোকান। মূলত প্রবল এক মাংসাশী আয়োজন। তবে কাঁচা বাঁশের মধ্যে পোড়ানো মাছ, সামান্য সাঁতলানো গুগলি, শামুক, সাপ— এসবও পাওয়া যাচ্ছে। নিরামিষাশীরা মনে হয় নাগাল্যান্ডে অনশনে থাকেন।
আমরা মঞ্চের সামনে বসে বসে নানা উপজাতির নানান কিসিমের নাচ দেখতে দেখতে সামান্য ক্লান্তি বোধ করলেই ওপরের কোনো একটা খাবার জায়গায় হাজির হচ্ছি। কখনো সাদরে আমাদের দিকে বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে শূলপক্ব মাংস, কোথাও আমাদের শেখানো হচ্ছে ঠিক কীরকম ফরাসি চুমু খাবার কায়দায় সাঁতলানো ঝিনুকের মধ্যে থেকে সুরুৎ করে শাঁস টেনে নিতে হয়। সেদিন আমরা টের পেলাম কোনো পানীয় ছাড়াই শুধু খাবার খেয়েও মাতাল হওয়া যায়।
মাতালের প্রসঙ্গে বলি উত্তর-পূর্বের এই রাজ্যগুলোয় খ্রিস্টধর্মের প্রাধান্য বলে সরকারিভাবে সেগুলেতে মদ নিষিদ্ধ। আমরা খেয়ে খেয়ে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়লাম তখন ঠিক করলাম একটু কোহিমা ঘুরে আসা যাক। সেখানে শুনেছি রক মিউজিকের আসর বসে এই সময়। সারা ভারত থেকে রক পাগলরা ভিড় জমায়। শহরে ঢুকবার কিছু আগে আমরা দেখলাম দূর পাহাড়ের গায়ে ঝিলমিল করছে কোহিমা শহরের আলো। কালো পাহাড়ের থেকে নেমে এসেছে অলৌকিক এক নক্ষত্রবীথি। কিন্তু তার ছবি তুলতে গিয়ে দেখা গেল রাস্তার পাশে প্রায় দেড় মানুষ উঁচু এক লোহার জালের বেড়া খুব অসুবিধা করছে। পাশেই এক দোতলা বাড়ি। তার দরজা ঠকঠকিয়ে আমরা জিজ্ঞেস করলাম তাঁদের ছাদ থেকে আমরা ছবি তুলতে পারি কিনা। তাঁরা সাদরে আমাদের ভেতরে নিয়ে গেলেন। দোতলার লিভিংরুমের মধ্যে দিয়ে ছাদে যাওয়ার পথ। সেখানে কার্পেটের ওপরে সটান উপুড় হয়ে হয়ে শুয়ে এক বিশালদেহী পুরুষ। ছবি তুলে বাড়ির লোকেদের ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা যখন প্রায় আধঘন্টা বাদে বেরোলাম। তখনও তিনি পূর্ববৎ ঢেঁকি অবতার, নিথর এবং নিশ্চল। আমরা যখন আলোচনা করছি যে এই যোগনিদ্রা কিছুতেই কোনো প্রণোদনাহীন হতে পারে না, আমাদের সারথি ঘ্যাঁচ করে একটা দোকানের সামনে গাড়ি থামিয়ে দিলেন। সেখানে তাকের ওপরে সাজানো থরে থরে স্বচ্ছ জলের বোতল। কিন্তু সেই দোকান আপাদমস্তক লোহার জালে ঢাকা। তার সামনে ছোট্ট এক আয়তাকার ফোকর। সেখান দিয়ে টাকা বাড়িয়ে দিলেই দোকানির হাতে জাদুবলে আবির্ভূত হচ্ছে রাম, ভদকা, হুইস্কি। রহস্যভেদের আনন্দ নিয়ে আমরা হাজির হলাম রক মিউজিকের উদ্দাম উঠোনে যেখানে বসেছে রহস্যভেদীদের প্রাণের ফোয়ারার তুমুল এক জলসা।