রবীন্দ্রনাথের প্রথম পরিচয় - তিনি একজন বিশ্ববরেণ্য কবি, যদিও রাজনীতি নিয়ে অনেক সময় তিনি মতামত দিয়েছেন। তাছাড়া নোবেল পুরস্কার লাভ কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দেশে ও বিদেশে নানা ধরনের অপপ্রচার, গোষ্ঠীগঠন, ষড়যন্ত্র হয়েছে, কিছু তৎকালীন সংবাদপত্রে বেরিয়েছে, কিছু বা তেমন করে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নি। রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্রে রেখে, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এমন ২/১ টি ষড়যন্ত্রের কথা বলা যাক।
প্রথম ঘটনাটি ১৯১৬ সালের। এ বছরের মে জুন মাসে জাপানে এসে তিনি জাপানী উগ্রজাতীয়তাবাদ নিয়ে বিরূপ বক্তব্য রাখেন। এরপর ১৮ সেপ্টেম্বর কবি আমেরিকায় পৌঁছান। আমেরিকায় তখন গদর পার্টি শক্তি সংগ্রহ করেছে। জার্মানির সঙ্গে ইংলণ্ডের যুদ্ধ শুরু হয়েছে তাই দেশে ও দেশের বাইরে ভারতীয় বিপ্লবীরা উৎসাহিত হয়ে উঠেছে। ইংলণ্ডের শত্রু জার্মানি, অতএব বিপ্লবীদের বন্ধু জার্মানি। কোমাগাটা মারু জাহাজে করে শিখ ও পাঞ্জাবি মুসলমানদের নিয়ে আসা হচ্ছিল হংকং থেকে কানাডা, কিন্তু সেদেশের সরকার যাত্রীদের নামতে বাধা দেয়। ফলে সংঘর্ষ হয়। এর পিছনেও গদর পার্টির হাত। অন্যদিকে প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হলে গদর বিপ্লবীরা ভারতে এসে এক সামরিক অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করে। এ ব্যাপারটার সঙ্গে জড়িত ছিলেন রাসবিহারী বসু, যিনি পরে রবীন্দ্রনাথের আত্মীয় এই পরিচয় দিয়ে ভারত থেকে পালান। সানফ্রানসিস্কো ছিল গদর পার্টির এক ঘাঁটি। এখানে বক্তৃতায় রবীন্দ্রনাথ যা বললেন তা হল - পশ্চিম চলেছে ধ্বংসের দিকে। তখন গদর নেতা রামচন্দ্র সংবাদপত্রে বললেন - রবীন্দ্রনাথ আধ্যাত্মিক কবি, যিনি বিজ্ঞানকে অনুমোদন করেন না। রবীন্দ্রনাথ এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, মোগল সাম্রাজ্য এবং অন্যান্য সমস্ত শাসকদের তুলনায় বৃটিশ শাসনই শ্রেষ্ঠ। রবীন্দ্রনাথ যদি প্রাচীন ভারতের সমর্থক এবং সত্যিই যদি প্রতীচ্য সরকার বিরোধী তবে তিনি বৃটিশের স্যার উপাধি নিলেন কেন। ফলে দেখা যাচ্ছে - জাপান চটল, জাপান বন্ধু গদর সভ্যরা চটল, বৃটিশ শাসনের সমর্থনও গদরপন্থীদের পছন্দ হল না। জাতীয়তাবাদকে ধিক্কার দেওয়াটা গদর সভ্যদের ভালো লাগেনি। রবীন্দ্রনাথ আমেরিকায় ঢোকবার আগেই গদর নেতা রামচন্দ্র Call পত্রিকায় চিঠিতে লিখলেন - রবীন্দ্রনাথের আমেরিকা সফরের উদ্দেশ্য নান্দনিক বিষয়ের বক্তৃতা নয়, তাঁর উদ্দেশ্য হিন্দু বিপ্লবী প্রচারে বাধা দেওয়া। রবীন্দ্রনাথ আমেরিকায় এসে বৃটিশ শাসন ভালো এবং ভারতীয়রা স্বায়ত্তশাসনের উপযুক্ত নয় বলাতে রামচন্দ্র আবার চিঠি লিখলেন, যার কথা একটু আগেই বলেছি। চিঠিতে অভিযোগ ছিল দেশে ব্রিটিশ শাসনে লক্ষ কোটি লোক দুর্ভিক্ষে মরেছে, যুবকবৃন্দ কারাগারে, চারশ জন ফাঁসি গেছে - এসব কি তিনি ভুলে গেছেন। পরের দিন অর্থাৎ ৬ অক্টোবর দিল্লীবাসী গোবিন্দ বিহারী লাল পূর্বোক্ত Call পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের সমালোচনা করে লিখলেন - তারা মনে করেন রবীন্দ্রনাথ দেশের যথার্থ প্রতিনিধি নন, দেশ এখন বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে উদ্দীপ্ত। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু প্রাচীনপন্থী, কিন্তু আমরা শিল্প, যন্ত্র ইত্যাদির প্রসারে আগ্রহী।
ঠিক এই বাদ প্রতিবাদের সময় একটি বাজে ঘটনা ঘটে গেল। ৫ অক্টোবর প্রাচীন অধ্যাপক বিষেন সিং মাট্টু ও তার দুই সঙ্গী উমরাও সিং এবং পর্দম সিংহ সানফ্রান্সিসকোতে রবীন্দ্রনাথকে আমন্ত্রণ জানাতে এলে প্যালেস হোটেলের সামনে এক-হাত কাটা জীবন সিং এবং এইচ সিং হাতেশী তাদের বাধা দেয়, কথা কাটাকাটি, ধাক্কাধাক্কি হয়, অধ্যাপকের মাথার সাদা পাগড়ি মাটিতে পড়ে। জীবন ও হাতেশী গ্রেপ্তার হয়, জানা যায় তারা গদর নেতা পূর্বোক্ত রামচন্দ্রের কর্মচারী। পরের দিন কাগজে কাগজে খবর বেরলো - 'রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে হত্যার ষড়যন্ত্র' এই শিরোনামে। সিয়াটলের একটি কাগজে একথা তো ছিলই, উপরন্তু জানানো হয় - এই কারণেই রবীন্দ্রনাথকে একটা বক্তৃতা বাতিল করতে হয়, তিনি তাড়াতাড়ি সান্তা বারবারা চলে যান। রবীন্দ্রনাথ প্রাণের ভয় পাচ্ছিলেন জাপানে থাকার সময় থেকেই। যাহোক ব্যাপারটা ভিত্তিহীন। রামচন্দ্রও জানায় এটি নিছক গুজব। রবীন্দ্রনাথও তখন এই ষড়যন্ত্র যে অমূলক একথা বিবৃতিতে জানান। তবে প্রধূমিত বহ্নি যে জাগ্রত ছিল তা তো মিথ্যে নয়।
রবীন্দ্রনাথ যখন চীনে গেলেন (১৯২৪) তখন সেখানেও কিছু কাণ্ড ঘটেছিল। এ পর্বে চীনের রাজনীতি সুস্থিত ছিল না। সাংহাইতে সম্বর্ধনায় রবীন্দ্রনাথ যে ভাষণ দিলেন তাতে বললেন চীন ও এশিয়ার প্রতিবেশী জাতিগুলোর সঙ্গে ভারতের মৈত্রীর পথ উন্মোচন করার জন্য তিনি চীনের যুবমনকে আহ্বান করছেন। চীনা শিক্ষিত সম্প্রদায়ের একাংশ ভাবতে চাইল, রবীন্দ্রনাথের এই সফরের প্রকৃত উদ্দেশ্যটা কি? রবীন্দ্রনাথ পরের দিনের বক্তৃতায় তার উত্তর দিলেন। কোনো রাজনৈতিক সুবিধা সংগ্রহের জন্য তিনি আসেন নি, এসেছেন স্বার্থশূন্য প্রেম ও মৈত্রীর জন্য। এ শহরের জাপানী ব্যক্তিত্বদের সভায় রবীন্দ্রনাথ যখন পুনর্বার বললেন - পাশ্চাত্য জাতিসমূহের ধনলোলুপতা ও শক্তিমত্তার আদর্শ যেন পূর্বদেশকে গ্রাস না করে। এ বক্তৃতাতে জাপানীরা চটল, পাশ্চাত্যমনস্ক, বিজ্ঞানমনস্ক চীনা যুবকরাও অসন্তুষ্ট হল। পিকিং- এ রবীন্দ্র বক্তৃতাতেও এই একই সুর ছিল। যুবকরা প্রতিবাদ শুরু করল। রবীন্দ্রনাথ যেখানেই বক্তৃতা দিতে যান চীনা যুবকরা সেখানে হাজির হয়ে ছোটো ছোটো হ্যাণ্ডবিলে রবীন্দ্র বক্তব্যের সমালোচনা লিখে শ্রোতাদের মধ্যে ছড়িয়ে দিত। শুধু পিকিং নয়, নানকিঙ-এ ও এরকম প্রচারপত্র বিলি করা হয়। সঙ্গী এলমহার্স্ট সাংহাইতে লক্ষ্য করেছেন চারটি বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের প্রতি বিরোধিতা আছে। তা হল - রবীন্দ্রনাথ শান্তিবাদী, যন্ত্রবিরোধী, আত্মা সম্পর্কে কথা বলেন এবং কমিউনিস্ট নন। সিন্হুয়া কলেজে যখন রবীন্দ্রনাথ বক্তৃতা দিতে যান তখন সেখানেও একদল ছাত্র বিরোধী ইস্তাহার বিলি করতে শুরু করে। পিকিং- এ ১০ মে বক্তৃতা দিচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। ২য় দিনের বক্তৃতার শেষে রবীন্দ্রনাথ লক্ষ্য করলেন বক্তৃতা ঘরের দেওয়ালে কয়েকটি প্রচারপত্র। সেগুলোর বক্তব্য কি, জানতে চাইলে রবীন্দ্রভক্ত ডঃ হু শি জানান - তরুণরা ৫টি ব্যাপারে বিরোধী বক্তব্য রাখছে। তাহল - ক) যে প্রাচীন সমাজ জনগণকে শোষণ করেছে কবি সেই সভ্যতার দিকে ফিরে যেতে বলছেন। খ) চীনা কৃষি ও শিল্প অনুন্নত ফলে দেশবাসী অসুবিধাগ্রস্ত। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু বস্তুসভ্যতার আধিক্যের জন্য তিরস্কার করছেন। গ) যে 'আত্মিক সভ্যতা'র কথা কবি বলছেন তা কিন্তু মানুষকে (চীনে) যুদ্ধ, লুণ্ঠন, লালসা, নৃশংসতায় নিয়ে গিয়েছে। ঘ) রাষ্ট্রীয় দুর্দশা নিয়ে ভাবনার বিপক্ষে তিনি কথা বলছেন। ঙ) যে আত্মার মুক্তির কথা রবীন্দ্রনাথ বারবার বলছেন তা কিন্তু অকর্মণ্য তত্ত্ব। ২৫ মে হান ঘৌ-র বৌদ্ধদের হলে রবীন্দ্রনাথ যখন বক্তৃতা দিচ্ছেন তখন দর্শকদের মধ্য থেকে চীনা ভাষায় কিছু যুবক চিৎকার করে উঠল - পরাধীন দেশের দাস ফিরে যাও। আমরা দর্শন চাই না, বস্তুবাদ চাই। শ্লোগানের সঙ্গে প্ল্যাকার্ড নাড়ানো চলল। কালিদাস নাগ দ্রুত ছুটে গেলেন, তাঁর ভয় হল এরা হয়ত কবিকে আক্রমণ করতে পারে। ফিরে এসে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন - 'নিছক সম্মান পাবার সৌভাগ্য আমার হয় নি। সেখানেও একদল লোক আছে, তাদের দল খুব ভারি নয় - তারা বললে লোকটি ভারতবর্ষ থেকে এসেছে আমাদের মাথা খারাপ করতে।'
এই বিশের দশকেই রবীন্দ্রনাথ জার্মানী যান, পরেও একাধিকবার গিয়েছেন। এখানে রবীন্দ্রসমাদর বিপুলভাবে হয়েছিল। যুদ্ধশেষের জার্মান মধ্যবিত্ত হতাশ্বাস অবস্থায় রবীন্দ্রনাথকে মুক্তিদূত রূপে গ্রহণ করেছিল। বলা বাহুল্য, সবাই নয়। রবীন্দ্রনাথকে বৃটিশ সাম্রাজ্যের দূত হিসেবে অনেকেই দেখছিলেন। স্পেনের গৃহযুদ্ধকালে, জার্মান নায়ক গোয়েবল্স্ ১৯৩৭-এ নুরেমবার্গ-এ পার্টিসদস্যদের এক সমাবেশে বিশ্ব-উদারনৈতিকতার প্রতি আক্রমণ হানে, কারণ এই উদারনৈতিকরা স্পেন সরকারকে নৈতিক সমর্থন জানাচ্ছিল। যাঁদের মতামত এ সভায় সমালোচিত হয় তাঁদের একজন রবীন্দ্রনাথ। যে সমস্ত দেশ ফ্যাসিস্ত বা আধা ফ্যাসিস্ত হয়ে পড়ছিল সেখানে রবীন্দ্র বক্তৃতা সেন্সর করা হচ্ছিল, তাঁর অনেক রচনা নিষিদ্ধ করা হচ্ছিল। দক্ষিণপন্থী জার্মান পত্রিকা অন্ধ স্বাদেশিকতা বশতঃ ১৯২১-এই বলছিল রবীন্দ্রনাথ একজন defeatist বা একজন traitor।
ফ্যাসিবাদ যখন জার্মানীতে তীব্রতর হয়ে উঠল তখন প্রচার করা হচ্ছিল - রবীন্দ্রনাথ একজন ইহুদি, ওঁর আসল নাম Rabbi Nathan.উনি ওপেনহাইমার নামে বোম্বাইয়ের এক ধনী ইহুদি যুবতীকে বিয়ে করে প্রচুর টাকা পেয়েছেন। মেয়েটির বাবা বাঁশের ব্যবসা করে প্রচুর টাকা করেছে। জার্মানীতে রবীন্দ্রনাথ যে কাউন্ট কাইজারলিং এর আতিথ্য নিলেন এটাও অনেকে সুনজরে দেখে নি।
বুয়েনোস আয়েরস থেকে ফেরার পথে ১৯২৫ এ রবীন্দ্রনাথ ইটালিতে যান। তখন ইটালির সর্বময় কর্তা মুসোলনী, ফ্যাসিস্ট দলের নেতা। তাঁর প্রতাপে সকলেই ত্রস্ত। রবীন্দ্রনাথ জেনোয়া পৌঁছানোর পরই সংস্কৃতজ্ঞ অধ্যাপক ফর্মিকি ও প্যারিস থেকে আসা মিসেস হগমান রবীন্দ্রনাথের দায়িত্ব নিজেদের ওপর তুলে নিলেন। ফর্মিকি রবীন্দ্রনাথের আসার খবর গোপন রাখতে চাইছিলেন। কিন্তু জানাজানি হয়ে যায়। ফর্মিকির অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ ইটালীর উদ্দেশে একটি বাণী তৈরি করেন। রবীন্দ্রবাণীটি সংবাদপত্রে প্রচারিত হয়। জেনোয়া থেকে মিলানে ট্রেন যাত্রায় রবীন্দ্র সঙ্গীদের কৌশল করে অন্য কামরায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ফর্মিকি রবীন্দ্রনাথকে ইটালির রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিষয়ে জানাতে থাকেন। মুসোলিনীর ভক্ত ফর্মিকি জানান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে বিশৃঙ্খল ইটালীকে মুসোলিনী শান্ত ও সুশৃঙ্খল করে তুলেছে। তাই ইটালীয়ানরা ফ্যাসিবাদের প্রতি কৃতজ্ঞ, যে হিংসা ছিল প্রয়োজন তাতে জনগণের আপত্তি নেই। বলা বাহুল্য ইটালীয়ান জনগণের বৃহদংশ এই মতের সমর্থক ছিল না। রবীন্দ্রনাথ চটপট সরকারকে প্রশংসা করে বিবৃতি দেন এবং পরের দিনের প্রতিটি সংবাদপত্রে তা ছাপা হয়ে যায়। ফলে ইটালীয় জনগণ স্তম্ভিত। রোমা রোলাঁ সুইজারল্যাণ্ড থেকে টেলিগ্রাম করে রবীন্দ্রনাথকে প্রকৃত পরিস্থিতির ও প্রতিক্রিয়ার কথা জানান। রবীন্দ্রনাথ ফ্যাসিবাদের স্বরূপ জানিয়ে পাল্টা বিবৃতি দেবেন ঠিক করেন, কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক সে বিবৃতি আর পাঠানো হয় নি। মুসোলিনী রবীন্দ্রনাথকে ইটালীর বরেণ্য ধ্রুপদী শিল্পীদের অনেক ছবির অ্যালবাম উপহার দেন, রবীন্দ্রনাথের অনেক রচনার ইটালীয় ভাষায় অনুবাদের উদ্যোগ নেওয়া হয়। রবীন্দ্রনাথের মানবতার আহ্বান ফর্মিকির পছন্দ হয় নি। আরও গোঁড়া ফ্যাসিস্টদের ভালো লাগার কথা নয়। তাই মিলানে ভাষাতত্ত্বগৃহে তাঁর বক্তৃতার পর ফর্মিকি লেখেন - রবীন্দ্রনাথের চারপাশে যে উৎসাহের আবহ তৈরি হয়েছিল তা 'was replaced by harsh criticism, angry debates and the stirring up of suspicion and hate.' রবীন্দ্রনাথ ক্রোচের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু বারংবার বাধাগ্রস্ত হন। ১৯২৬ এ ইটালি ভ্রমণের সময় রবীন্দ্রনাথ ফ্যাসিবাদের স্বরূপ ও ইটালির রাষ্ট্রযন্ত্রের দাপটের কথা জানতেন না তা নয়। এণ্ড্রুজকে লেখা তাঁর পত্র থেকে তা বোঝা যায়। ফর্মিকিকে লেখা রবীন্দ্রনাথের পত্র সূত্রে জানা যায় - রবীন্দ্রনাথ বলছেন মুসোলিনীর আতিথ্য ও সৌজন্য তিনি যা পেয়েছেন তা প্রচুর ও আন্তরিক। তাঁকে যেটা আকর্ষণ করেছিল তা হল মুসোলিনীর ব্যক্তিত্ব। ইটালির দেশত্যাগী অধ্যাপক সালভাদরির স্ত্রীকে ও ১৯২৬, ৫ জুলাই জানান - মুসোলিনী তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল একজন আর্টিস্ট রূপে, তাঁর ব্যক্তিত্ব ছিল আকর্ষণীয়। তবে তিনি ফ্যাসিবাদকে সমর্থন করেন না। ফিরে এসে এক পত্রিকার প্রতিনিধিকেও জানান, ইটালিতে মুসোলিনীর অসীম ব্যক্তিত্ব দেখে বিস্মিত হয়েছেন। তবে ইটালিতে সাধারণ জনমতকে গলা টিপে মারা হয়েছে। ১৯৩০, ২১ নভেম্বর আমেরিকা সফরকালে রবীন্দ্রনাথ রথীন্দ্রনাথকে একটা চিঠিতে লেখেন মুসোলিনীকে তিনি একটা চিঠি লিখেছেন। চিঠিটা পাঠানোর ব্যাপারে ভাবতে বলেন, কারণ - 'চিরকাল ইটালির সঙ্গে ঝগড়া জাগিয়ে রাখা ঠিক নয়।' সে চিঠি কিছু বিলম্বে পাঠানো হয়। গবেষকরা জানান নানা বিবৃতিতে রবীন্দ্রনাথ মুসোলিনীর 'অকুণ্ঠ প্রশংসা' করেন। তবে ইটালির মানুষকে তিনি কোনদিনই অশ্রদ্ধা প্রকাশ করেন নি। মুসোলিনী রবীন্দ্রনাথের ১৯৩০- এ লেখা চিঠির কোনো উত্তর দিয়েছিলেন কি না জানা নেই। সব মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথের ইটালি সফর ষড়যন্ত্র অধ্যুষিত সন্দেহ নেই।
অনেক পরবর্তীকালে রবীন্দ্র প্রসঙ্গিত একটি ছোট্ট ষড়যন্ত্রের কথা বলে আপাতত ক্ষান্ত হব। কেতকী কুশারী ডাইসন, সকলেই জানেন, রবীন্দ্রনাথের আর্জেন্তিনা সফর বিষয়ে একাধিক বই লিখেছেন, অনেক নতুন কথা জানিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে স্প্যানিশে লেখা অনেক প্রবন্ধ বাংলা অনুবাদ করেছেন। এটাও সবাই জানেন, সান ইসিদ্রো-র 'মিরালরিও' বাড়িতে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর উদ্যোগে রবীন্দ্রনাথের থাকার ব্যবস্থা করা হয়, যে বাড়িতে কয়েকমাস কাটান, অনেক ছবি আঁকেন, অনেক কবিতা লেখেন, বহু ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তাঁর কথাবার্তা হয়। ১৯২৪ এ বসন্তকালে এই বাড়িতে, সংলগ্ন বাগানে কত কথা বলেছেন, কত হেঁটেছেন। স্বভাবতঃই আর্জেন্তিনায় গিয়ে রবীন্দ্রনাথ সংক্রান্ত গবেষণা করতে গিয়ে, একজন যোগ্য গবেষকের মতো মিরালরিওর এই বাড়িটি একবার দেখার আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু আর্জেন্তিনায় ভারতীয় রাষ্ট্রদূত মণি চাড্ডা ১৯৯০ সালে স্টেটসম্যান পত্রিকায় লেখেন এই বাড়িটি বোমায় উড়ে গেছে। কেতকীর In Your Blossoming Flower-Garden বইটির সমালোচনা করে আর্জেন্তিনা দূতাবাস প্রকাশিত (১৯৯২) বইতে, (সেমিনারে দেওয়া ভাষণ) কেতকীর সমালোচনা করে লেখেন, এ বাড়িটি আর নেই, অনেক বছর আগেই এটি ধ্বংস হয়ে গেছে। অধ্যাপিকা মারিও রেনে কুরা, যিনি ওকাম্পো আর্কাইভ্সের তত্ত্বাবধায়িকা, এই কথা সমর্থন করেন বলে জানান। অধ্যাপিকা শ্রীমতী কুরাও কেতকীকে আর্জেন্তিনায় একই কথা বলেন। অর্থাৎ বাড়িটি ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু কেতকী জানতে পারেন চাড্ডা এবং কুরা দুজনেই মিথ্যে কথা বলেছেন। কেতকী জানতে পারেন শ্রীমতী গ্লোরিয়া লাফুয়েন্তে ও তার স্বামী বর্তমানে এই বাড়ির স্বত্ত্বাধিকারী। গ্লোরিয়ার মেয়ে মারিয়ানাকে সঙ্গে নিয়ে কেতকী শেষপর্যন্ত মিরালরিও নামক বাড়িতে পৌঁছান এবং দেখেন - 'মোটের উপর বাড়িটার চেহারা এখনও তেমনি আছে।' কেতকী সারাটা দিন এই বাড়িতে কাটান। কেতকী লক্ষ্য করেছেন - ভিক্তোরিয়ার 'সান ইসিদ্রোর শিখরে রবীন্দ্রনাথ' বইটির স্পেনীয় প্রথম সংস্করণে মিরালরিও বাড়িটির একাধিক ছবি ছিল কিন্তু দ্বিতীয় সংস্করণ (১৯৮৩) থেকেই এই ছবিগুলো সরিয়ে নেওয়া হয়। এও একপ্রকার ষড়যন্ত্র বটে। পাঠকের কৌতূহল হবে - এই শেষোক্ত ষড়যন্ত্রের কারণ কি? কেতকীর সিদ্ধান্ত - 'এই বাড়িটাই আর্জেন্তিনার প্রকৃত রবি-তীর্থ। ......... ভিলা ওকাম্পোর অর্থ সাহায্যের প্রয়োজন আছে, অতএব এই প্রতিযোগী বাড়িটার অস্তিত্বকে চেপে দিতে পারলে তাকে 'ডিমলিশ' অথবা বোমার ঘায়ে 'দেসাপারেসিদো' করে দিতে পারলে পথের কাঁটা দূর হয়।' (চলন্ত নির্মাণ, পৃ. ২৬০)।
শিক্ষিত লোকরাই বেশীমাত্রায় ষড়যন্ত্র করে। কারণ তাদের মাথা অনেক বেশী জটিল। তাদের স্বার্থের খাতা অনেক বড়ো। দেখা যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ষড়যন্ত্রে এ কথাই আর একবার প্রমাণিত।