বাংলা দেশের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং রাশিয়ার লেখক ও সমাজকর্মী ম্যাক্সিম গোর্কি দুজনেই বিশ্ববরেণ্য তাতে সন্দেহ নেই। গোর্কি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের থেকে সাত বছরের ছোট। অন্যদিকে গোর্কির মৃত্যু ১৯৩৬-এ আর রবীন্দ্রনাথের ১৯৪১। নানা দিক থেকে এই দুই মহান লেখকের জীবনচর্যা ও সাহিত্যচর্চার মধ্যে তফাৎ আছে, কিন্তু দুজনেই ছিলেন মানবজীবনের শিল্পী। ১৯৩১-এ P. S. Kogan মস্কো থেকে লেখেন—'In 1930, Rabindranath Tagore paid us a visit and could convince himself how our workers respect and honour the great writer' এবং '...songs of Tagore are resounding in our hearts as a beautiful call for liberation.'
রাশিয়ার সঙ্গে ভারতবর্ষের সম্পর্ক সুপ্রাচীন—পঞ্চদশ শতাব্দীর আফানাসি নিকিতিন-এর কাল থেকে। কিন্তু এই বিস্তারে আমরা যাব না, প্রসঙ্গের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকব।
আমাদের বঙ্গদেশে গোর্কি চেতনা, গোর্কিয়ানার ঢেউ আসতে শুরু করে ১৯০৫ থেকে, ১৯১৭-তে অক্টোবর বিপ্লবের সাফল্য, বলশেভিকবাদের তত্ত্ব ও প্রতিফলন সদর্থক ও নঞর্থক, দুরকমই ১৯০৫-এর পর থেকে ক্রমবিকশিত হতে থাকে।
সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত ইংরেজি দৈনিক বেঙ্গলীতে গোর্কি সাড়ম্বর অভ্যর্থনা পেলেন। ১৭ ফেব্রুয়ারি এই পত্রিকায়—‘ম্যাকসিম গোর্কি—ঔপন্যাসিক, কবি এবং বিপ্লবের অগ্রদূত’ নামে প্রবন্ধ বেরোল। গোর্কির চিঠি Moscow Revolution বিষয়ক বেরোল। রুশ বিপ্লবের খবর মানেই গোর্কির খবর। রাধারমণ মিত্র জানান ১৯১৬-১৭-তে ছাত্রজীবনে গোর্কির কিছু বই রিপন কলেজ লাইব্রে্রি থেকে নিয়ে পড়লেন। পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় ১৯১৭-তে কোন্ডাগ্রামে শিক্ষকতা করার কালে মৈয়মনসিংহ কলেজের এক ইংরেজি অধ্যাপকের কাছ থেকে পেলেন গোর্কির 'থ্রি অফ দেম'। ভূপেন্দ্রকুমার দত্ত ১৯১৮-তে রাজসাহী জেলে গোর্কির নাম প্রথম শোনেন। সরোজ আচার্য বলছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি পাঠ সংকলনে পেলেন ‘চেলকাশ’ গল্পটি, ১৯২০-২২-এ। গোর্কির সাহিত্যধর্মের ঐতিহাসিক শরিকানা এল নজরুলের কবিতায়। যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায় লেখেন ১৯২১-২৪-তে বিপ্লবের নতুন করে গোছগাছের সঙ্গে গোর্কিকেও নানাভাবে বোঝার চেষ্টা চলল। হেমন্ত চট্টোপাধ্যায় সুদীর্ঘ প্রবন্ধে আনলেন লেনিনের মৃত্যুতে গোর্কির শোকজ্ঞাপক প্রবন্ধ কথা, তা অনূদিত হল বাংলায়। ‘বোলশেভিকবাদ’ নামে বইটির বাংলা অনুবাদে ভূমিকা লিখলেন নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত। রাসেলের লেখা থেকেও গোর্কির গুরুত্ব প্রতিভাত হল। নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় ‘ম্যাকসিম গোর্কি’ নামে সুদীর্ঘ প্রবন্ধ লিখলেন ‘কল্লোল’ পত্রিকায়, ঘোষণা করলেন—‘গোর্কি বর্তমান রুশিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ লেখক’। শরৎচন্দ্র বলছেন ‘পথের দাবী’ উপন্যাসের প্রেরণা পেয়েছেন গোর্কির ‘মা’ উপন্যাস থেকে। ‘একদিন যারা মানুষ ছিল’ গল্পটির উল্লেখ করছেন তিনি হিন্দী লেখক ইলাচন্দ্র যোশীকে এক পত্রে। সাপ্তাহিক ‘লাঙল’ পত্রিকায় নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ ‘মা’ উপন্যাসটির ধারাবাহিক অনুবাদ শুরু করলেন ১৯২৫ থেকে। পরের বছরই অনূদিত হল—‘টলষ্টয়ের স্মৃতি’ (পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়) ‘কল্লোল’ পত্রিকায়। ১৯২৫ থেকে ১৯৩৮-এর মধ্যে বাংলাতে চারটি অনুবাদ প্রকাশ পায় ‘মা’ উপন্যাসের, ভারতীয় অন্য ভাষাতেও এর প্রভাব পড়ে। ১৯২৭-এ সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর রাশিয়ায় থাকাকালীন গোর্কির ২টি কবিতাও অনুবাদ করেন যার একটি‘ঝোড়ো পাখির গান’। প্রমথ ভৌমিক জানান—বাঙালি বিপ্লবীদের রূপান্তরে গোর্কির অবদান কম নয়। দীনেশ গুপ্ত ফাঁসিতে যাবার আগে মাকে বলেন—‘কেঁদো না, গোর্কির মা পড়ো, সান্ত্বনা পাবে।’ গোর্কির মৃত্যুতে কলকাতা কফিহাউসে শোকসভা হয় ১১ জুলাই যাতে শোকবাণী পাঠান রবীন্দ্রনাথ। ঢাকা প্রগতি লেখক সঙ্ঘের প্রবক্তা রণেশ কুমার দাশগুপ্ত বলেন—‘ম্যাকসিম গোর্কি তাঁর উপন্যাসে শিল্পের বাঁধ খুলে দিয়েছেন, ভেঙেছেন।’ খগেন্দ্রনাথ মিত্র অনুবাদ করলেন ‘গোর্কির ডায়েরি’ এবং ‘গোর্কির ছোটগল্প’। (১০টি গল্পের সংকলন) ক্রমে ক্রমে আরও অনেক অনেক বই—গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস অনূদিত হতে লাগল।
রবীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের সন্তান। পিতামহ দ্বারকানাথ ব্যবসা ও জমিদারি কাজে সক্রিয়, সাহেবদের নিয়ে য়ুনিয়ন ব্যাঙ্ক স্থাপন, কোম্পানির চাকরি ছেড়ে নীলকুঠি কিনে কুঠি স্থাপন, দুবার বিলাতযাত্রা। তাঁর বদান্যতা, সৌন্দর্যপ্রিয়তা, বিলাসিতা প্রসিদ্ধ। রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ তারুণ্যে ধনৈশ্বর্যের আবিলতার মধ্যে কাটালেও পিতার মৃত্যুর পর য়ুরোপীয় দর্শনে আগ্রহী হন, ধর্ম দর্শনে (নিরীশ্বরবাদ) আগ্রহী হন, ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নেন, সমাজের আদর্শ ও কর্মের সঙ্গে যুক্ত হন। পুরাতন ও নূতনের সন্ধিলগ্নে রবীন্দ্রের জন্ম ও বিকাশ। সাহিত্যের রসগ্রাহিতা, গীতকুশলতা পেয়েছেন। উপনয়নের পর পিতার সঙ্গে হিমালয় যাত্রা। অ্যাকাডেমিক শিক্ষায় বীতশ্রদ্ধা, বিফলতা সত্ত্বেও কবিতা, গান, নাটক, পত্রিকা চালনাতে সক্রিয়তার (ভারতী, বালক, সাধনা) কথা জানা যায়। ‘রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিপুল প্রতিভা এবং ঐশী কবিশক্তির বলে সেই পথেই (রামমোহন, কেশব, বিবেকানন্দ) ভারতবর্ষের নিভৃত-তপোবনের সাধনালব্ধ বাণীকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।’ (সজনীকান্ত দাস) ‘টলস্টয় গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ এই তিন মনীষীর মিল তাঁদের গভীর অধ্যাত্ম বিশ্বাসে।’ ‘গান্ধী ও রবীন্দ্র উভয়েই অধ্যাত্মবিশ্বাসী, জীবনের যাহা কিছু সকলেরই চরমমূল্য দান করিয়াছেন অধ্যাত্ম সত্যের আলোকে। এঁরা তিনজনই হয়ে উঠেছিলেন ‘নগরবিমুখ’ ও নাগরিক সভ্যতার প্রতি বিশ্বাসহীন।’ তবে এ তিনজনের ধ্যান-ধারণায় বৈষম্যও ছিল। রবীন্দ্র প্রবর্তিত শিক্ষা ছিল প্রাচীন তপোবন আদর্শে, প্রকৃতির ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য জ্ঞানের সম্মেলক চর্চায়। (শশিভূষণ দাশগুপ্ত)
কর্মী রবীন্দ্রনাথের নানা পরিচয় আছে। তারুণ্যে রাজনারায়ণ, নবগোপালদের সঙ্গে মিলে সামান্য দেশোদ্ধারের কাজ, জনসাধারণের উপযোগী শিক্ষাপদ্ধতি সম্বন্ধে প্রবন্ধ, ‘ভাণ্ডার’ পত্রিকা কেন্দ্রে রেখে কিছু কর্মপ্রয়াস, কিছু দ্রব্য (মোজা, সাবান, চাটনি, সিরাপ) গ্রাহকদের সস্তায় দেওয়া, শিলাইদহকেন্দ্রিক জমিদারি চালনা সূত্রে রেশম গুটির পরীক্ষা, কুষ্ঠিয়ার ব্যবসা, ব্রহ্মচর্যাশ্রম স্থাপন, প্রকৃতি স্পৃষ্ট শিক্ষানিরীক্ষা, গ্রাম সমস্যা নিরসনে মিতব্যয়িতা, সংঘকর্ম ও সঞ্চয় অভ্যাস, সমবায় ব্যাঙ্ক স্থাপন, গ্রামের অভ্যন্তরে নৈশ বিদ্যালয়, উৎসব উপলক্ষে ভেদাভেদ দূরীকরণ—কয়েকটি দৃষ্টান্ত। ‘আজ আপন পথে ফিরতে হবে, সামনে মিলন স্বর্গ’। শ্রীনিকেতন কর্মসমূহ স্মতর্ব্য। পত্রে নির্দেশ— ‘প্রজাদের বাস্তুবাড়ি ক্ষেতের আইল প্রভৃতি স্থানে আনারস, কলা, খেজুর প্রভৃতি ফলের গাছ লাগাইবার জন্য তাহাদিগকে উৎসাহিত করিও। আনারসের পাতা হইতে খুব মজবুত সূতা বাহির হয়, ফলও বিক্রয় যোগ্য। শিমূল-আঙুর গাছ বেড়া প্রভৃতির কাজে লাগাইয়া তাহার মূল হইতে কিরূপে খাদ্য বাহির করা যাইতে পারে তাহাও প্রজাদিগকে শিখানো আবশ্যক। আলুর চাষ প্রচলিত করিতে পারিলে বিশেষ লাভের হইবে। কাছারিতে যে আমেরিকান ভুট্টার বীজ আছে তাহা পুনর্বার লাগাইবার চেষ্টা করিতে হইবে। কৃষি বিজ্ঞানের উপদেশমত চেষ্টা করিবে।’। (মনোরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়কে লিখিত পত্র) শিলাইদহে কয়েকজন যুবককে পল্লীসংস্কারে উদ্যোগী করেন। কাজ—চিকিৎসাবিজ্ঞান, প্রাথমিক শিক্ষা, কূপ খনন, রাস্তা প্রস্তুত, মেরামতি, জঙ্গল সাফ ও ব্যবচ্ছেদ, ঋণদায় থেকে চাষীদের রক্ষার ব্যবস্থা, সালিশী বিচারে গ্রাম্য বিবাদের নিষ্পত্তি। দুইশত অবৈতনিক নিম্ন প্রাথমিক পাঠশালা, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, পড়া লেখা পাটিগণিত শিক্ষা, মুখে মুখে ইতিহাস ভূগোল স্বাস্থ্য কথা, আকস্মিক বিপদ থেকে রক্ষার উপায়, অগ্নিনির্বাপণ ও বন্যায় সাহায্য ইত্যাদি। (রবীন্দ্র জীবনী, ২য় খণ্ড, পৃ. ৫৩৮)।
গোর্কির বেড়ে ওঠার গল্পটা কিন্তু একেবারেই আলাদা। এক প্রাদেশিক গরীব পরিবার থেকে এসেছিলেন, ছোট্ট বয়সেই জেনে যান জীবন কত নিষ্ঠুর। অনাথ হন ৭ বছর বয়সে, আত্মনির্ভর ৯ বছরে আর দয়াহীন দাদুর পরিবার থেকে পালান ১২ বছরে। ভ্রাম্যমান জীবনে ঘুরেছেন পুরো রাশিয়ায়, নানা পরিবেশে, সাক্ষাৎ হয়েছে নানা ধাঁচের মানুষের সঙ্গে। বাপের মৃত্যুর পর মায়ের পুনর্বিবাহ, যে ভোলগার নাবিক। নিষ্ঠুর দাদু কারণে অকারণে পেটাতেন নাতিকে। স্নেহময়ী দিদা চেষ্টা করতেন তাকে স্নেহাশ্রয় দিতে। পালক পিতার প্রতি গোর্কির ক্রোধ ছিল। মায়ের মৃত্যুর পর নিষ্ঠুর দাদু বলল—লেক্সি তুমি তো আমার গলার হার নও। বেরিয়ে পড়ো দুনিয়ায়। এবার সে পেটের দায়ে নিল নানান কাজ—কখনো জুতোর দোকানে ঠিকে, ভল্গা স্টিমারে ডিশ ধোয়ার কাজ, আর এক জাহাজে রান্না ঘরের ফাইফরমায়েসী, কখনো আইকন নির্মাতার সাহায্যকারী, মেলা মাঠের তাঁবু খাটানোর কাজে জুটে ১৬ বছরের মধ্যেই সে যায় কাজানে। তার মনে হত—সব কিছুই কত ইন্টারেস্টিং আর বিষাদময়। মনে পড়ত দিদিমার অজস্র গল্প। স্টিমারে ছিল স্মুরি—বিপুল চেহারা, তবে বইপড়ুয়া। বলত চারদিকে মানুষজন বোকার দল, উজ্জ্বল হতে হলে বই পড়া চাই, তবেই চিনবে জগৎকে। পড়া হল নানান বই। এক দয়াবতী মহিলা পিয়ানো বাজাতেন, পড়ালেন টুর্গেনেভ, আকাসভ, ট্যুচেভ। ক্রমশ জানার আগ্রহ বাড়তে লাগল। মাত্র ১৫ বছরেই সে চূড়ান্ত হতাশ, কাজ হয়ে উঠল অর্থহীন। গোঁকুর এর লেখা, বালজাকের লেখা (Eugenie Grandet) ভালো লাগে। আর সব গল্প হুল্লোড় আর মাতলামির।
এক সময় মনে হতে লাগল আমি এসেছি এ পৃথিবীতে অস্বীকার করার জন্য। আলাপ, র্যাডিকালদের সঙ্গে। ১৯০৫-এর ব্যর্থ বিপ্লবের পর পালালেন পশ্চিম ইউরোপে, রইলেন ১৯১৩ পর্যন্ত। হব্স এর Leviathan এবং ম্যাকিয়াভেলীর Prince এবং আরও কিছু ধ্রুপদী বই পড়া হল। নানা ধরনের মানুষ, নানা তত্ত্ব, Populists, Tolstoyans, Marxists জানা হল। তবে জানতে হবে জীবন সত্য। নানান কাজ করতে করতে ইচ্ছে হল টলস্টয় দর্শনের পাঠ। হৃৎপিণ্ডে গন্ডগোল তাই সৈন্যদলে যোগ হল না। একটুআধটু লেখা শুরু। The Song of the Ancient Oak কবিতাটি লিখে দেখালেন কোরোলেঙ্কোকে, এমন বেজায় সমালোচনা হল যে পালালেন, পোড়ালেন লেখাটা। নিঝনি ছেড়ে বেসারবিয়া, ওডেসা, টিফলিস ঘোরা হল। কালিয়ুঝনি তার ভবঘুরেমি তারিফ করলেন, লেখা হল—Makar Chudra (১৮৯২) ম্যাক্সিম গোর্কি ছদ্মনামে। ১৮৯৮-তে বেরোল গল্পসংকলন। ‘আমি কেমন করে লিখতে শিখলাম’ রচনায় বলেন দুটো ধাক্কা এল—এই একঘেয়ে জীবনের থেকে মুক্তি চাই, যা অবিশ্বাস্য তা লিখো না। স্বচক্ষে দেখা অমার্জিত মানুষের গল্প লোকের মনে ধরল। বাজপাখির গান, চেলকাশ, মালভা, মাকার চুদ্রা—স্মরণীয় রচনা। চেকভকে পাঠালেন তার লেখা। গড়ে উঠল নিবিড় বন্ধুত্ব। চেকভের মতে এ এক প্রশ্নাতীত প্রতিভা, খাঁটি প্রতিভা। তবে চেকভের ধাঁচ তো আলাদা, তাতে থাকে—Understatement for its effect of wry irony. ১৮৯৯-তে অবিস্মরণীয় গল্প ‘ছাব্বিশজন পুরুষ ও একটি মেয়ে’।
১৯১৩-তে রাজনৈতিক অপরাধীদের মুক্তির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয় লেনিনের দ্বারা যিনি গোর্কির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন, তাঁর বিভ্রান্তি কাটাতে সাহায্য করতেন, তিনি গোর্কিকে রাশিয়ায় ফিরে আসার অনুরোধ করেন, অসংখ্য সর্বহারা তাকে স্বাগত জানাল। ১ম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে গোর্কি ছিলেন ফিনল্যান্ড, শীঘ্রই ফিরলেন পেট্রোগ্রাদে, সাম্রাজ্যবাদীদের গোপন ষড়যন্ত্রের বিরোধিতা করতে থাকেন। একটা নতুন প্রকাশনা, একটা পত্রিকা চালু করলেন যাতে এসব আদর্শগত যুদ্ধ চলল। তাঁর পরিকল্পনায় ছিল দেশ-বিদেশের মহান মানুষদের জীবনী লেখাবেন তরুণদের জন্য; রোলাঁ, ওয়েলস প্রভৃতিকে লিখতে বলেন। বলশেভিক বিপ্লবের পর কিছু বুদ্ধিজীবী ও লেখককে রক্ষা ও নিরাপত্তা দেবার চেষ্টা করেন। ১৯১৮-২১-এর মধ্যে বিপন্ন লেখক ও বুদ্ধিজীবিদের অনাহার থেকে বাঁচানোর কথা জানা যায়। তাঁর শরীর ক্রমশ খারাপ হওয়া সত্ত্বেও কতকগুলি স্মরণীয় প্রকাশের ব্যাপারে তাঁর উদ্যোগ ছিল। সেগুলো হল—A History of the Civil War, A History of Factories, A History of a Young Man of the Nineteenth Century, The Building of the U.S.S.R. আর লেখেন আরও পাঁচটি নাটক। তাঁর আত্মজীবনী মূলক রচনার ২টি খণ্ড। আর্টামানব পরিবার নিয়ে উপন্যাস, ক্লিম সামখিন নামে মহাকাব্যিক উপন্যাস বেরোল। তার অসংখ্য পত্র সংকলিত হতে লাগল। ১৯২৮-এ রাশিয়ায় গিয়ে নানা স্থানে ভ্রমণ এবং বক্তৃতা দেওয়া চলল। সোভিয়েত ইউনিয়নের ৫ম কংগ্রেসের কার্যকরী কমিটিতে তাকে নেওয়া হল, পরীক্ষামূলক ঔষধের একটি প্রতিষ্ঠান গড়লেন, প্রথম সোভিয়েত লেখক কংগ্রেসের সক্রিয়তা, লেখক সঙ্ঘের সভাপতি করা হল। ১৯৩৫-এ বিজ্ঞান অ্যাকাডেমির ডিরেক্টর হলেন, প্যারিসে সংস্কৃতি রক্ষার সম্মেলনে নাম দিলেন, যাতে অবশ্য শরীর খারাপের জন্যে যেতে পারেন নি। ১৯৩৬-এর ১৮ জুন তাঁর মৃত্যু।
Gleb Struve তাঁর বইতে (Russian Literature under Lenin and Stalin 1917-1953) বলেন—লেনিনের সঙ্গে সুদীর্ঘকাল ব্যক্তিগত যোগাযোগ ও বলশেভিক পার্টির সঙ্গে যোগ থাকলেও পার্টির যুদ্ধ ও আনুষঙ্গিক বিষয়ে কিছু কিছু দ্বিমত পোষণ করতেন। বিভ্রান্ত গোর্কি কখনও মেনশেভিকদের পক্ষে কিছু বলেন, ‘বন্দেমাতরম’ কাগজটার গ্রাহক হন। এসব লেনিন পছন্দ করেন নি, কিন্তু গোর্কি যে খাঁটি মানুষ তাতে লেনিনের সন্দেহ ছিল না। রাশিয়ার সৌভাগ্য গোর্কিকে তিনি বিসর্জন দেন নি। ১৯১৮-২১ রুশ সংস্কৃতি ও তার মুখ্য প্রতিভাদের বাঁচাতে ভূমিকা নেন, ‘বিশ্ব সাহিত্য’ নামে একটি প্রকাশনা গড়ে তোলেন। রুশ লেখকদের বিরূপ পরিস্থিতিতে অনুবাদ কর্মে নিযুক্তিতে তার ভূমিকা ছিল। Victor Shaklovsky অবশ্য গোর্কির ভাবনাকে ironic Bolshevianism বলেন। গোর্বাচেভও কিছু নিন্দে করেছেন।
জীবন যাপনের ভিন্নতা এবং কর্মের ভিন্নতা বশতই এই দুই বিশ্ববিখ্যাত মনীষীর চিন্তার ভিন্নতা দেখা গেছে। সমালোচক বলেছেন—‘রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যজীবনে সৌন্দর্য সন্ধানী ও আনন্দবাদী, ব্যক্তিজীবনে ঔপনিবেশিক তত্ত্বাদর্শে ও স্থিতধী সংযমে বিশ্বাসী।’ (অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়) আর এক সমালোচকদের মতে রবীন্দ্রনাথ রোম্যান্টিক সাহিত্যতত্ত্বমুখী, যারা বলেন শিল্পসাহিত্য নির্মাণ নয়, তা একটা দিব্য আবির্ভাবের মতো। (সত্যেন্দ্রনাথ রায়) সাহিত্য যে আনন্দের জন্য, তার আর কোনো উদ্দেশ্য নেই। (সাহিত্য) নানা অভিঘাতে রবীন্দ্রনাথ বলেন—‘মনুষ্যত্ব প্রকাশই সাহিত্যের উদ্দেশ্য।’ (চিঠি) আরো পরে (সাহিত্যের তাৎপর্য) বলেন—‘বাইরের জগৎ লেখকের মনের মধ্যে তাঁর হৃদয়বৃত্তির রসে জারিত হয়ে যে রূপ নেয়, সাহিত্যের জগৎ মানুষের সেই হৃদয়ের জগৎ।’ অন্যদিকে গোর্কির জীবনের গড়ে ওঠার কালে ছিল ভবঘুরে মনোবৃত্তি, অদ্ভুত চরিত্র বা ঘটনা সন্ধান ও রূপদান; আর ছিল বিক্ষুব্ধ পন্থীদের সাহচর্যে বিক্ষুব্ধতা। তিনিও শুরু করেছিলেন রোমান্টিকতায়, পরে রোমান্টিক রিয়ালিজমে। তার পরে সাহিত্য ও লোকশিক্ষার সম্পর্ক গুরুত্ব পায়। ‘বাস্তব’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেন লোকশিক্ষা সাহিত্যের লক্ষ্য নয়। তাছাড়া ‘টলস্টয়ের শিল্পতত্ত্বের প্রবল নৈতিকতা বা ধর্মীয়তা রবীন্দ্রনাথকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল।' ( সত্যেন্দ্রনাথ রায়) বাস্তব চাই, আবার বাস্তবকে চাই না, সত্যকে চাই—এ বিড়ম্বনা রবীন্দ্রনাথে (সত্যেন্দ্র) ‘সাহিত্য প্রয়োজনের ঊর্ধ্বে’ (তথ্য ও সত্য) এবং লোকহিতভিত্তিক বাস্তবতাবাদকে অগ্রাহ্য করেন রবীন্দ্রনাথ। (সত্যেন্দ্র) এবং ‘সাহিত্যের বিষয়টি শ্রেণীগত নয়’ (সাহিত্যবিচার) গোর্কি সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা ও সাহিত্যের শ্রেণীগত বিচার মান্য করেছেন। রবীন্দ্রনাথ বলছেন সাহিত্যের কাজ হৃদয়ের যোগ ঘটানো (সাহিত্যের তাৎপর্য) কিন্তু কোনো সাহিত্য সর্ব ‘শ্রেণী’র হৃদয়ের সামীপ্য পায় না। গোর্কি স্মরণীয় মনীষীদের জীবনকথা লেখাতে চেয়েছেন পরিণত বয়সে। রবীন্দ্রনাথ ও বিশ্ববিদ্যা সংগ্রহের ছোট বইগুলি রচনা করিয়েছিলেন ‘লোকশিক্ষা’ দানের উদ্দেশে; নাম দেন—লোকশিক্ষা গ্রন্থমালা।
অধ্যাপক A. P. Gnatyuk Danilchuk বলেন রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প পড়ে তাদের মনে হয়েছে এইসব গল্প কিছুটা ম্যাক্সিম গোর্কির প্রথম দিকের গল্প মনে করিয়ে দেয়। এই সাদৃশ্য a short of lyricism. দানিলচুক জানান লেনিনের ব্যক্তিগত সংগ্রহে ছিল রবীন্দ্রনাথের ন্যাশনালিজম, হোম অ্যান্ড দি ওয়ার্ল্ড (ঘরে বাইরে)। লুনাচারস্কি এবং ম্যাক্সিম গোর্কির সংগ্রহেও রবীন্দ্র রচনা ছিল। তবে কি কি বই গোর্কির সংগ্রহে ছিল তা বলেন নি। ম্যাক্সিম গোর্কির সক্রিয় সহযোগিতায় বার্লিনে একটি প্রকাশনা থেকে ‘ঘরে বাইরে’ বার হয় (অনুবাদ--Z. Zhuravskaya)। RAPP পর্বে গোর্কির মতো রবীন্দ্রনাথের মূল্যায়নেও অনাগ্রহ আসে। তবে সাধারণ পাঠক সমাজে এ দুজনের লেখার সমাদর ছিল। গোর্কির গ্রেপ্তার ১৯০৫এর দশকে ভারতেও ক্ষোভ এনে দেয়। রবীন্দ্রনাথের প্রিয়ত্ব বেশী মাত্রায় ছিল চেকভের প্রতি। গোর্কির কি কি রচনা তিনি পড়েছিলেন তার তালিকা দিতে পারছি না। তবে তাঁর বেশ কিছু লেখা তিনি পড়েছিলেন। কোনো একটা লেখায় পড়েছি কলকাতা ধর্মতলা অঞ্চলের বিখ্যাত বইয়ের দোকান থ্যাকার অ্যান্ড স্পিংক থেকে রবীন্দ্রনাথ গোর্কির একটি বই কিনেছিলেন। রাশিয়ায় যাওয়া রবীন্দ্রজীবনে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। রাশিয়ার চিঠি বইতে এবং অন্যত্র তিনি রাশিয়া প্রসঙ্গ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। ১৯৩৪-এ রাশিয়াতে প্রথম লেখক কংগ্রেস হয়। এই কংগ্রেসের সভাপতির ভাষণ দেন গোর্কি। রবীন্দ্রনাথ এই কংগ্রেসের সংবাদ পেয়ে অভিনন্দন জানান। রবীন্দ্রনাথ বলেন—তিনি প্রশংসা জানাচ্ছেন গোর্কি, গ্ল্যাডকভ, রোমানভ, লিওনভ প্রভৃতিকে। এদের কিছু লেখা ইংরেজিতে পড়েছেন। (২৬ এপ্রিল, ১৯৩৪) গোর্কির মৃত্যুতে (১৮ জুন, ১৯৩৬) রবীন্দ্রনাথ নিকোলাস রোয়েরিখকে চিঠি দেন। রোয়েরিখ রবীন্দ্রনাথকে শান্তিনিকেতন গ্রন্থাগারের জন্য তাঁর লেখা গোর্কি ও পুশকিন বিষয়ক প্রবন্ধ দুটি পাঠিয়ে দেন। (১১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৭-র চিঠি)।
উপন্যাস বিচারে উৎকর্ষ বা অপকর্ষ বিষয়ে মন্তব্য পাঠকের অ্যাটিচুডের উপর অনেকটাই নির্ভর করে। একই উপন্যাস ভিন্ন ভিন্ন রুচির পাঠকের কাছে নিন্দিত হতে পারে। বিশেষত পরিবর্তনমান যুগের লেখা হলে মতান্তর হতেই পারে। ১৯০৭ থেকে ১৯১৩র মধ্যে গোর্কি ৭টি নাটক, ৪টি উপন্যাস, ২টি স্কেচবই, আত্মজীবনীমূলক রচনার প্রথমটি লেখেন। এই সবকটিতেই তিনি পেসিমিজমকে আটকাতে চেয়েছিলেন, যা সে সময়ের রুশ সাহিত্যের সার্বিক বৈশিষ্ট্য। এইসব বছরে গোর্কি চেয়েছেন to inject into it a note of hope and energy. (Helen Muchnic) The Lower Depths নাটকটি কেবল জীবনকথার টুকরো নয়, তাতে আছে কথা আর কথা, কিন্তু কাজের অভিমুখ। এটা আমরা খেয়াল করি না যে লেনিনের What is to be Done এবং এই নাটকটি রচিত হয় একই বছরে। লেনিন এ রচনায় বলেছিলেন—দিবাস্বপ্ন দেখতেই হবে; তিনি উনিশ শতকী নিহিলিস্ট Pisarev উদ্ধৃত করে এই দিবাস্বপ্নের কথা বলেন। এ নাটকের Luke-এর দিবাস্বপ্নে জাগে দাসত্ব, Satin-এর মধ্যে স্বপ্ন স্বাধীনতা, অন্যদের মধ্যে আসে নানা জীবনের সঙ্গে পরিচয়ের আগ্রহ। গোর্কির সত্য, বাস্তবতা বোধ, হিউম্যানিস্ট--মেটাফিজিকাল নয়। ‘মা’ উপন্যাসটি পড়ে লেনিন বলেছিলেন উপন্যাসটিতে শিল্পগুণের খামতি থাকতে পারে, কিন্তু কালের বিচারে প্রয়োজনীয় বই। ‘ফোমা গর্দেইয়েভ’ (১৮৯৯) উপন্যাসে মুখ্য চরিত্র এক বড়ো একচেটিয়া কারবারি, যার মতে বণিক সমাজই রুশ জীবনের তন্দ্রা কাটাবে। আর আছে ভীরু কতিপয় বুর্জোয়া। ‘নীচতার সামনে একজন সৎ মনোভাবাপন্ন মানুষের সরাসরি ও সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের কাহিনী তিনজনা’ (১৯০০) ‘ক্লিম সামগিনের জীবন’ (১৯২৭-৩৬) বিপ্লবের অব্যবহিত পূর্ব পর্যন্ত রুশ বুদ্ধিজীবীদের সামগ্রিক পরিচয় দানের ইচ্ছে, অসম্পূর্ণ।
রবীন্দ্র উপন্যাসে পরিবার জীবনের ছবি আছে, ব্যাপ্ত সমাজ জীবনের ছবি নেই। যোগাযোগ-এ বণিক পরিবারের ক্রমপরিবর্তন লক্ষ্য থাকলেও এগোন নি। ক্ষেত্র গুপ্ত বলেন—রাজনৈতিক বোধের দিক থেকে ক) রবীন্দ্রনাথ উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদের বিরোধী, তবে উদার প্রশান্ত ভারতের স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসতেন, খ) স্বদেশী প্রচার, বিদেশী দ্রব্য বয়কট সংক্রান্ত কার্যক্রম মেনে নিতে পারেন নি গ) গোপন বিপ্লবী আন্দোলনে ধ্বংসাত্মক ও আত্মনাশী রূপই দেখেছেন। ‘গোরা’ উপন্যাসে চরঘোষপুরে গোরার বিষম অভিজ্ঞতা থাকলেও, সশস্ত্র প্রজা প্রতিরোধ থাকলেও, গল্প শেষ পর্যন্ত পরিবারে স্থিত হয়। ক্ষেত্র গুপ্ত বলেন ‘গোরা’ উপন্যাসে ‘রাজনীতি আছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় এবং মুখ্য চরিত্রের ভাবনা ও কর্ম সবই রাজনীতি কেন্দ্রিক।’ একথায় আমার সায় নেই। বরং হিন্দুধর্ম, ব্রাহ্মধর্ম, শাশ্বত মানবধর্ম সে সবই বড়ো। আনন্দময়ীর মধ্যে প্রকৃত মা এবং মাতৃভূমি আবিষ্কার ‘গোরা’ এবং ‘ধাত্রীদেবতা’য় (তারাশঙ্কর) আছে। কিন্তু সত্যকার ভারতবর্ষ? বরং ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে প্রেম ও রাজনীতির সমন্বয় গুরুত্ব পায়। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন, বয়কট, স্বদেশ বোধ এসব গুরুত্ব পায়। ইতিহাসের সঙ্গে মিলিয়ে তা কেউ কেউ দেখতে চেয়েছেন। হয়তো তাই ইউরোপে ও রাশিয়ায় এ বইটির প্রতি পাঠকের আগ্রহ সর্বাধিক। অধ্যাপক Sergei Serebriany তার প্রবন্ধে দেখান ‘ঘরে বাইরে’ অনুবাদ হয় ১৯২০, ১৯২৩, ১৯২৫-তে। রবীন্দ্র অনুবাদ রাশিয়ান ভাষায় ব্যাপক ১৯২৭-এ, কিন্তু কার্যত থেমে যায় ১৯২৯-এ যখন স্ট্যালিন তাঁর তৃতীয় বিপ্লব শুরু করেন। ১৯৫৫ পর্যন্ত রবীন্দ্র রচনার অনুবাদ কার্যত হয়নি। তবে কোনো সরকারি নিষেধাজ্ঞা ছিল না, জনগ্রন্থাগার থেকে তার বই সরানো হয়নি। রবীন্দ্র সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি বিশের দশকে নানামুখী। মার্ক্সীয় কর্তারা রবীন্দ্রনাথকে reactionary এবং Idealist বলতেন। অ্যাকাডেমিক মহলে অবশ্য তাঁর আলোচনা হয়েছে Oldenburg, Tubiansky ও অন্যান্য স্কলারদের দ্বারা। সাধারণ পাঠক নীরব তারিফ করত বলেই অনূদিত বই (রবীন্দ্র) বিক্রি হত। আর বুদ্ধিজীবীদের একাংশ রবীন্দ্রনাথকে তাচ্ছিল্য করত। (যেমন--Mandelshtam) কেউ শ্লেষের সঙ্গে তার লেখক ও সাংস্কৃতিক সত্তাকে গণ্য করত। যেমন Bogoraz যিনি ১৯২০-তে ইউরোপে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে একবার পরিচিত হন এবং পরে অনেক কটি প্রবন্ধ লেখেন, ভূমিকা লেখেন, অনূদিত রচনার রিভিউ করেন। তথ্যপূর্ণ এইসব লেখায় রবীন্দ্রনাথকে an object of ethnographic research-এর বিষয় মনে করতেন। কিন্তু যারা বিপ্লব, বিশ্বযুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ অতিক্রম করেছেন তাদের কাছে রবীন্দ্রনাথ naive. রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে রুশ emigre চিত্রী নিকোলাস রোয়েরিখ এর পরিচয় ১৯২০-তে, পরিচয় অব্যাহত দীর্ঘকাল। মাঝে মাঝে রোয়েরিখ তাঁর high blown words এবং semi prophetical style-এ রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে লিখতেন। লেনিনের আগ্রহ ছিল যথেষ্ট। ক্রেমলিনে ১৯১৮ থেকেই ৫টি বই দেখা যায়—Personality, Nationalism (২টি ভিন্ন অনুবাদে), The Home and the World (বার্লিনের অনুবাদ) এবং একটি সংকলন (রাশিয়াতে ১৯২৩)-- তবে এসব বই সম্পর্কে তাঁর মতামত জানা যায় না।
রবীন্দ্রনাথ ‘চার অধ্যায়’ নিয়ে হইচই বাধালেও এ-বই য়ুরোপে, রাশিয়ায় পাত্তা পায়নি। ‘ঘরে বাইরে’ ও ‘চার অধ্যায়’-এ রাজনীতি বড়ো ভূমিকা নিলেও রবীন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রভক্তরা এ বই দুটির প্রেম মনোভাব দিয়ে রাজনৈতিকতা চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। শাসকদের কাছে নিরাপদ থাকা।
রবীন্দ্রনাথের রাশিয়া ভ্রমণ এ প্রবন্ধের পক্ষে প্রাসঙ্গিক। একাধিক কারণের মধ্যে প্রথমত বলা যায় সোভিয়েত কর্মযজ্ঞে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে গোর্কি বিতর্কিত হয়েও অধিনায়ক বিশেষ, রবীন্দ্রনাথ ও মতাদর্শসূত্রে সোভিয়েত মহলে বিতর্কিত হলেও বিশ্বখ্যাত কবি ও মনীষী। বার্লিনে ১৯৩০-এ লুনাচারস্কির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ হয়। লুনাচারস্কি রাশিয়া ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানান। ১৯২৫ থেকে ১৯২৮-র মধ্যে অন্তত পাঁচবার রবীন্দ্রনাথের কাছে সে দেশে যাবার আমন্ত্রণ আসে। কিন্তু নানা কারণে ১৯৩০-এর আগে তাঁর যাওয়া হয়নি। সে সময়টা রাশিয়ার ব্যাপক রদবদলের কর্মকাণ্ড চলছে। কে নয়া ব্যবস্থার স্পষ্ট সমর্থক আর কে নয় এ নিয়ে রাজনীতিতে সংস্কৃতিতে বিতর্ক চলছে। রবীন্দ্রনাথ নোবেল প্রাইজ সূত্রে বিশ্বখ্যাত হলেও সোভিয়েত সরকার রবীন্দ্র মতাদর্শ সম্পর্কে বিরূপ ধারণাই পোষণ করতেন। কিন্তু সোভিয়েত ব্যবস্থা দেখে যাবার জন্য বিশ্ববরেণ্য অনেককেই সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ আমন্ত্রণ জানাতেন। অভ্যর্থনার ব্যবস্থা আপাতভাবে সদর্থক মনে হলেও সে সময় সোভিয়েত ভ্রমণ ছিল সম্পূর্ণ রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
এখানে বলা দরকার বিশ্বভারতীর প্রায় সূচনা কাল থেকেই পলাতক রুশ বুদ্ধিজীবীদের কয়েকজন কবির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। প্যারী নিবাসী জনৈক মাদাম দ্য মজিয়ালী নামে রুশ মহিলা শান্তিনিকেতনে আসেন (২ জানুয়ারি, ১৯২২) তিনি কলাভবনে রাশিয়ার ভয়ানক অবস্থা প্রসঙ্গে ভাষণ দেন। তাতে সোভিয়েত নয়া সভ্যতার কথা নেই, অভাব অনটন দুঃখ কষ্টের কথা আছে। দ্বিতীয়ত: অক্সফোর্ডের আইন শাস্ত্রের রুশ অধ্যাপক পি. ভিনোগ্রাদভ কবিকে এক দীর্ঘ পত্রে সোভিয়েত বুদ্ধিজীবীদের অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্টের কথা এবং অর্থ সংগ্রহে কবির সাহায্য ও সহযোগিতার অনুরোধ করেন। এ পত্র ‘শান্তিনিকেতন’ পত্রিকা ‘প্রবাসী’ ‘মডার্ন রিভিউ’তে মুদ্রিত হয়। ভিনোগ্রাদভ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েও ১৯১৩-তে বক্তৃতা দিয়ে গেছেন। তখনই আলাপ কবির সঙ্গে। তৃতীয়ত: পলাতক রুশ বুদ্ধিজীবী বগদানভ যিনি ছিলেন স্পষ্টত জারপন্থী তিনি ১৯২২-এ নভেম্বরের প্রথমদিকে অধ্যাপক হিসেবে শান্তিনিকেতনে যোগ দেন। আর এসেছিলেন অধ্যাপক হিসেবে মি. কলিন্স। এরা বিশ্বভারতীর আদর্শ সম্পর্কে বিরূপ কথা বলে বেড়াতেন। চতুর্থত: ১৯২৬-এ মুসোলিনীর আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথের ইতালী ভ্রমণ এবং মুসোলিনীর ফ্যাসিস্ট শাসন ব্যবস্থার তিনি উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বেড়ান যা ইউরোপে নানা পত্রিকায় ছাপা হয়। রোলাঁ তাঁকে সতর্ক করার চেষ্টা করেন। পঞ্চমত: রবীন্দ্রনাথ নানা লেখায় আপত্তি জানাচ্ছিলেন কবিতার শ্রেণীবিচার, তা বুর্জোয়া কি প্রলেতারিয়েত—এসব নিয়ে। বলশেভিজম যে মঙ্গলজনক নয়, সংস্কৃতি বিচারে যে তা নিন্দনীয় সে সব কথাও নানাভাবে নানা জনকে বলেছেন।
এই পাচঁটি বিষয় মাথায় রেখেই রবীন্দ্রনাথের সম্পূর্ণ রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত রাশিয়া ভ্রমণ বিচার্য বলেই মনে হয়। দেশত্যাগী রুশ স্কলারদের আশ্রয় দান, বিপন্ন রুশ বুদ্ধিজীবীদের জন্য অর্থ সংগ্রহ, ফ্যাসিবাদের প্রশংসা, বলশেভিক সংস্কৃতি চিন্তা বিষয়ে বিরূপতা, সচেতন বলশেভিক কর্তৃপক্ষের পছন্দ হওয়ার কথা নয়। তাই রবীন্দ্রনাথের রাশিয়া ভ্রমণকালে লুনাচারস্কি, গোর্কি অনুপস্থিত (মৈত্রেয়ী দেবীর মতে গোর্কি তখন ইটালীতে) কিন্তু রাশিয়ার বাইরে থাকলেও যোগাযোগ, বার্তা অসম্ভব ছিল না। কোনো বড়ো মাপের কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক কি এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে এ সময়? জানা যায় না। লুনাচারস্কি মারা যান ১৯৩৩-এ। গোর্কি ১৯৩৬-এ, অতএব ৩০-এ এরা জীবিত। লুনাচারস্কি, গোর্কি ব্লক, আন্দ্রেয়েভার সঙ্গে বলশয় ড্রামা থিয়েটার স্থাপন করেন। রবীন্দ্রনাথ মস্কোতে যে নাটক দেখতে যান সেখানেও প্রসঙ্গত এদের কথা নেই। লুনাচারস্কিকে করা হয় সোভিয়েত পিপলস কমিশনার, শিক্ষামন্ত্রী। তিনিই প্রথম সেন্সর প্রথার দায়িত্বে। এসব কারণেও অনুপস্থিতি হতে পারে। স্ট্যালিনের সঙ্গে রোলাঁ, এইচ. জি. ওয়েলস প্রভৃতির সাক্ষাৎ হয়। রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে স্ট্যালিন এবং তার বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ অনাগ্রহী অনুমান হয়। গোর্কির অনাগ্রহও পূর্বোক্ত কারণে।
সোভিয়েত দেশ পরিদর্শনের জন্য ১৯২৫ থেকে ১৯২৮-এর মধ্যে অন্তত পাঁচবার রবীন্দ্রনাথের কাছে অনুরোধ আসে। শেষপর্যন্ত ১৯৩০ সালের ১১ সেপ্টেম্বর কবি কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে মস্কো পৌঁছান। সঙ্গীদের একজন অমিয় চক্রবর্তী আর একজন সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই দুজনের এই ভ্রমণ বিষয়ে কোনো লেখা পড়ার সুযোগ আমার হয়নি। জানি না তাঁরা আদৌ লিখেছিলেন কি না। ‘রাশিয়ার চিঠি’ (শতবার্ষিক সংস্করণ) পড়লে আমরা কোথাও কোনো বড়ো মাপের লেখকের কথা পাই না, ছোট মাপের লেখা, সাহিত্য আন্দোলন এসবের কথাও নেই। গোর্কি বা লুনাচারস্কির কথা কোথাও নেই। ‘রাশিয়াতেও সম্প্রতি নায়কের প্রবল শাসন দেখা গেল।’ কিন্তু গোর্কি রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে কোনো আগ্রহ দেখান নি। রবীন্দ্রনাথ ন বছর পর (১৭/৩/৩৯) অমিয় চক্রবর্তীকে চিঠিতে লিখছেন মস্কোতে তিনি চেকভ-এর প্রতি সমাদর প্রকাশ করে বিব্রত হয়েছিলেন। বস্তুত রাশিয়ায় সাহিত্য সংস্কৃতির সমাদর ও অনাদরের ইতিহাস অবিশ্বাস্য বাস্তব। গোর্কির লেখা, অবস্থান ইত্যাদি নিয়ে একটি শব্দ-ও নেই। জানা যাচ্ছে এই সময় অধ্যাপক Karatygin এবং তার ৪৭জন সহকর্মী মাংস জোগানের গণ্ডগোলে পড়ে নিহত হন। সেই দিনটা ছিল মস্কোতে রবীন্দ্রনাথকে স্বাগত জানানো। (Victor Serge, স্মৃতিকথা পৃ. ২৮৮)
সৌভাগ্যক্রমে আর এক সহযাত্রী সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি ছোট্ট পুস্তিকা (ত্রয়ী) পড়ার সুযোগ হয়েছে। সৌমেন্দ্র রবীন্দ্রভ্রাতা সুধীন্দ্রের পুত্র। ইনি বিশের দশক থেকে কমিউনিস্ট মতবাদে আকৃষ্ট হন। ১৯২৮-এ ষষ্ঠ আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট কংগ্রেসে ভারতীয় প্রতিনিধিরূপে যোগ দিতে মস্কো যান। তারপর ২ বছর পরে রবীন্দ্রনাথের সহযাত্রী।
সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ত্রয়ী’ বইটি এই প্রবন্ধে প্রাসঙ্গিক। এই পুস্তিকায় আছে বারবুস, গোর্কি ও রোলাঁর সঙ্গে তার কথাবার্তার কথা। সৌমেন্দ্র ১০ম বার্ষিক উৎসবের দিন (১৯২৭, ৭ নভেম্বর) মস্কোতে। ঘুরে গেলেন লুনাচারস্কি, নাচ দেখে বৃদ্ধ শক্লৎওয়ালা নেচে উঠলেন। আঁরি বারবুসের সঙ্গে দেখা ও কথা হল। প্রসঙ্গত সৌমেন্দ্র বারবুসকে জানালেন ১৯২৫ সালে গান্ধীবাদের সংকীর্ণ জাতীয়তার পরিপন্থী রবীন্দ্রনাথ। এরা জানতেন তিনি রবীন্দ্রের দৌহিত্র। ১৯৩০-এ পুনরায় দেখা বার্লিনে যখন হিটলারের কালো ছায়া ক্রমশ দীর্ঘতর হচ্ছে। ১৯৩১ ডিসেম্বরে সৌমেন্দ্র ইটালীর ক্যাপ্রিতে—যেখানে অনেকদিন কাটিয়েছেন লেনিন, গোর্কি, লুনাচারস্কি। খোঁজ নিলেন অসুস্থ ম্যাক্সিম গোর্কির, তখন তিনি ক্যাপ্রি ছেড়ে সোরেন্টোতে। নির্দিষ্ট সময়ে গোর্কির বাড়িতে পৌঁছাতে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক রুশ ভাষায় বললেন—‘আপনি টাগোর, না? মস্কোয় আপনাকে দেখেছি।’ খেতে খেতে আলাপ গোর্কি, তার পুত্র, পুত্রবধূ, স্ত্রীর সঙ্গে। তখন তিনি একটা বড়ো উপন্যাস লিখে চলেছেন। প্রসঙ্গত লেনিনের শব পূজা, চিন্তার স্বাধীনতা পদে পদে রুদ্ধ হওয়ার, নতুন ধরনের পেট্রিয়টিজম গজিয়ে ওঠার কথা। তৎকালীন রুশ সাহিত্য নিয়ে সৌমেন্দ্রর মতামত জানতে চান গোর্কি। মজুর সাহিত্য ও বুর্জোয়া সাহিত্যের বিভাজন নিয়েও কথা হয়। শ্রেণীউদ্ভুত সাহিত্যের কথাও। ভারতবর্ষ সম্বন্ধে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করলেন। স্বাধীনতা আন্দোলন ও গান্ধীজীর সম্পর্কে অনেক খোঁজ নেন। লক্ষণীয়, এখানে রবীন্দ্র প্রসঙ্গ নেই। এই নেইটাই লক্ষণীয়।
রোলাঁ রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ও গোর্কি প্রসঙ্গের মধ্যে, সম্ভবত একথা পূর্বে বলেছি। সৌমেন্দ্র ১৯৩৩-২৪ নভেম্বর, অর্থাৎ মস্কো পর্ব (রবীন্দ্র প্রসঙ্গিত) অন্তে কয়েক বছর পর এই সাক্ষাৎ। এখানেও কথা প্রসঙ্গে উঠল বাঙলা দেশে ইংরেজ সরকারের অত্যাচার, গান্ধীবাদ, জাতীয় ব্লকের ধারণা, অহিংসা করা। সৌমেন্দ্র জানান ১৯৩০-এ রবীন্দ্র যখন ইউরোপে আসেন তখন হিংসা অহিংসার সমস্যা নিয়ে দাদু-নাতির কথা হয়। রোলাঁ উত্তরে বলেন—‘রবীন্দ্রনাথ যেটা ধী-শক্তির আলোকে প্রত্যক্ষ করেন, জনসাধারণের অন্তরে প্রবেশ করতে সক্ষম গান্ধীর সহজ-বুদ্ধি (Instinct) তাঁর কাছে সেটা প্রকাশ করে।’ বেশিরভাগ কথাই গান্ধীবাদ নিয়ে। তবে রোলাঁর ঘরে সৌমেন্দ্র লক্ষ্য করেন তিনটি ছবি টাঙানো—গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ আর গোর্কির। রোলাঁর ভারত ডায়েরি বইটির পাতা খুললে দেখতে পাব দিলীপ রায় রোলাঁকে জানাচ্ছেন—ভারতবর্ষে হালের সবচেয়ে মৌলিক লেখক শরৎচন্দ্র। তিনি ভবঘুরে, ঠিক গোর্কির মতো। (১৯ এপ্রিল, ১৯২১) পূর্বোক্ত সৌমেন্দ্র সাক্ষাৎকার (১৯৩৩) প্রসঙ্গে রোলাঁ তাঁর ভারত ডায়েরিতে লেখেন—রাশিয়ার নব্য শাসন সমর্থন করার অনেক ফরাসী বন্ধু হারালেও রাশিয়াতে পেয়েছেন অসংখ্য বন্ধুত্ব—তাদের মধ্যে ছিল গোর্কির বন্ধুত্ব। (নভেম্বর, ১৯৩৩) পুনরায় সৌমেন্দ্রর সঙ্গে কথাবার্তায় উঠল স্তালিনের প্রতি অপছন্দভাব এবং পরম প্রীতিতে গোর্কির কথা।
রোলাঁ রচিত ‘শিল্পীর নবজন্ম’ বইটি থেকে আমরা ভারতবর্ষ বিষয়ক অনেক প্রসঙ্গ পাই। তার মধ্যে ১৯১৯, ২৬ জুন ল্যু মানিতে পত্রিকায় মনের স্বাধীনতার ঘোষণা ইস্তাহারে সহস্রাধিক বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের স্বাক্ষরও আছে, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর (রোলাঁ) ১৯২১, ১৯২৬, ১৯৩০ সাক্ষাৎ হয়। রবীন্দ্র মৃত্যুতে রোলাঁ ঠাকুর পরিবারের বন্ধুদের শোকবার্তা জ্ঞাপন করেন। অন্যদিকে ১৯৩১, ১০মে লেখা ‘গোর্কির প্রতি রোলাঁ’ রচনা থেকে রোলাঁর দৃষ্টিতে এই দুই বন্ধুর ভাবনা ও অংশগ্রহণ সম্পর্কে মূল্যবান মন্তব্য মেলে। রোলাঁর ভাষায় ‘শ্রমিক শ্রেণীর বিবেকের সঙ্গে তিনি (গোর্কি) আজ একাত্ম। সর্বহারা শ্রেণীর তিনি সংস্কৃতির মধ্যমণি।’ এ হল ‘ভ্রাতৃত্বের বন্ধন’। দুঃখের বিষয় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এখানেই পূর্বোক্ত দুইজনের পার্থক্য। মহাজীবনের প্রসঙ্গে রচনা লেখার অনুরোধ আসে গোর্কির কাছ থেকে রোলাঁর কাছেও। রবীন্দ্রনাথও এ প্রবণতা থেকে লোকশিক্ষা গ্রন্থমালা লেখান, অবশ্য বাঙালি বিশেষজ্ঞদের দিয়ে।
রবীন্দ্রনাথের বিপুল রচনাবলী থেকে খুঁজে পেয়েছি গোর্কি প্রসঙ্গের মাত্র চারটি ব্যবহার। (আরও থাকতে পারে। তার মধ্যে একটি সিরিয়াস, অন্যগুলি নয়। রবীন্দ্রনাথ ২৭ সেপ্টেম্বর, ১৯২৪ লিখছেন—গোর্কি রচিত টলস্টয় ‘জীবন চরিত’ রচনাটির কথা। রবীন্দ্রনাথের ধারণা এ হল ‘দোষে গুণে তীক্ষ্ণ রেখায় আঁকা ছবি মাত্র’ যাতে দয়ামায়া ভক্তিশ্রদ্ধা নেই। আর একটি প্রসঙ্গ তুলেছেন। তা হল এ রচনা কতখানি ‘বৈজ্ঞানিক’? এ লেখায় বহুকালের বহুলোকের চিত্ত সংহতির উদাহরণ নেই। (পথে ও পথের প্রান্তে)
ম্যাক্সিম গোর্কির On Literature বইটিতে তিনটি Literary Portraits আছে। চেকভ, টলস্টয়, য়েসেনিনকে নিয়ে। জানানো হচ্ছে এই দীর্ঘ রচনাটি random notes যখন গোর্কি Oleiz তে, টলস্টয় তখন Gasparaতে, সবে অসুস্থতা কাটিয়ে উঠেছেন। এ লেখা টুকরো কাগজে লেখা, হারানো, আবিষ্কৃত, তখন একটি চিঠিও সংযোজিত। সেটাও অসম্পূর্ণ। অতএব ‘বৈজ্ঞানিক’, ‘জীবনচরিত’ রচনার কোনো অভিপ্রায় এখানে নেই। শিল্পী গোর্কি যেভাবে The Disintegration of Personality লেখেন বা প্রথম লেখক কংগ্রেসে ভাষণ দেন (১৭ আগস্ট, ১৯৩৪) সেই ভঙ্গি এখানে নেই। টুকরো টুকরো প্রসঙ্গের, আলাপচারিতার, সিরিয়াস ও মজার, নিজের লেখা পাঠ ও পূর্বসূরীর মতামত গ্রহণ, হাঁটতে হাঁটতে মস্কোর অ্যারিস্টোক্রাটদের কথা বলা, বিজ্ঞান বিষয়ে বলা, ফরাসী ঔপন্যাসিকদের ধরনে মেয়েদের কথা বলা, বসে কিংবা হাঁটার কালে ‘ক্রুয়টাজার সোনাটা’ (টলস্টয় রচিত)-র কথা বলা, ডস্টয়েভস্কির ভাষা ব্যবহার, ঈশ্বর প্রসঙ্গ, প্রাতরাশ, দুপুরের খাওয়ার কালের কথা, বাইবেলের কিছু কথা, বিব্রত করার মতো কথাবার্তা, সেনাপতি কর্নেট-এর বিধবা প্রসঙ্গ, ডাক্তারদের সম্পর্কে মতামত, তাস খেলা, ডিকেন্সের মন্তব্য, নীচের মহল থেকে কিছু অংশ পড়ে মতামত নেওয়া, ভয়ানক স্বপ্ন, মদ্যপান, ঈশ্বর কথা, (তাতে কোরান, নিউ টেস্টামেন্ট) ইত্যাদি। শেষের পত্রটিতে পূর্বসূরী সম্পর্কে মন্তব্য, প্রেরিত চিঠিতে বুদ্ধিজীবী, রাষ্ট্র, জনতা কথা, নানা প্রতিক্রিয়া, গ্যেটে বা বুদ্ধ কথা, চেকভ, রুশ ধর্মপ্রচারক প্রভৃতি। গোর্কির কথায় তার আত্মার মধ্যে চলেছে কুকুরের চিৎকার, চোখের সামনে বিপর্যয়ের স্ফুলিঙ্গ। মানুষ টলস্টয় কথা, তার মৃত্যুতে হৃদয়ে এক ধাক্কা, বেদনায় ও দুঃখে কান্না, চিত্রায়ন, বারে বারে উঠে আসছে বিগত শিল্পীর কথা, টলস্টয়ের চোখে ডস্টয়েভস্কি, কখনও চেকভ, তার কথা বলার ব্যক্তিক চার্ম যা ভাষায় প্রকাশ করা শক্ত, টলস্টয় ভক্ত কথা, গোর্কির গল্পের (২৬জন পুরুষ ও ১টি মেয়ে) মেয়েটি, পথ চলার সময় খরগোস দৌড়ে যায় পায়ের ফাঁকে, hawk এর অপেক্ষা, পাক, নর্মানদের সম্পর্কে ইতিহাস, হিংসা, গিবন, কস্তোমারভ, Les Freres Zemganno পাঠ, গোগলের ‘মৃত আত্মা'। রচনা শেষে টলস্টয়কে দেবতার আসন দেওয়া। ইচ্ছে করে একটু বিস্তৃত করলাম দেখাতে যে এটা মোটেই বৈজ্ঞানিক রচনা নয়, গোছানো নয়, কিন্তু পূর্বসূরী ও উত্তরসূরীর সচল ছবি যার তুলনা নেই। এটাই একটা ধরন—আবেগী শিল্পীর দৃষ্টিতে শিল্পী। গোর্কি প্রায়শই যেতেন টলস্টয়ের কাছে। টলস্টয়ের ধর্মশিক্ষা সম্পর্কে বিচারী মনস্কতা থাকলেও সারাজীবন revered the great artist in him. গোর্কির লেনিনস্মৃতি-ও একই ভঙ্গিতে লেখা। ক্রুপস্কায়া তা পড়ে জানান—তোমার লেখাতে সে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। যে তাকে ভালোবাসত না সেও এমন লিখতে পারত না। লেনিন হয়ে উঠেছে পুরো জীবন্ত। কথাটি পূর্বোক্ত লেখা সম্পর্কেও প্রযোজ্য। রবীন্দ্রনাথ যেকোনো কারণেই হোক লেখাটিতে মন দিতে পারেননি।
এক রুশ সাহিত্য বিশেষজ্ঞদের মতামত তুলে দিই:
এই বিক্ষিপ্ত নোটস-এর থেকে ভালো লেখেননি তিনি, তার দিদিমার চিত্রণের তুল্য। যে কেউ গোর্কি বাস্তবে কেমন তা দেখতে পাবেন, এ হল astute observation এর gift, ইম্প্রেসনিজম এর পরিচয়। যদি তিনি এই টুকরো টুকরো গুলোকে একটা consecutive narrative-এ বিস্তার ও বন্ধন দিতে চাইতেন তাহলে নষ্ট করে ফেলতেন.... তিনি লোকজনকে দেখতেন নিজের মতো করে। তিনি চেকভের মতো তারিফকে কাঠামো কৌশলে চমৎকার করে ফেলতে পারতেন না।
(From Gorky to Pasternak—Helen Muchnic, Pg. 93)
বাদবাকি যে কটি প্রসঙ্গ তা নিতান্তই ক্যাজুয়াল। ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসে আছে ‘লাবণ্য তার ঘরের সোফায় হেলান দিয়ে পায়ের উপর শাল মেলে গোর্কির ‘মা’ বলে গল্পের বই পড়ছে।’ এ বইতে আরও কিছু কিছু কবির নাম আছে, কিন্তু গোর্কির ‘মা’ উপন্যাসের উল্লেখ লাবণ্যের মানসিকতা প্রকাশে কোনো ভূমিকা নেয়নি। অমিতের ভাবোচ্ছ্বাসে ইংরেজি কবিদের কথা, লাবণ্যের কথায় কালিদাস। (র-চ শতবার্ষিক, পৃ. ৭৬৫) ‘মা’ নানা বইয়ের একটি। ‘মা’ নিছক ‘গল্পের বই’ ছিল না, সে সম্পর্কে অল্প বলেছি এ লেখায়। লাবণ্যর মনে যদি অনুরণন তুলত, তাহলে, অমিতের মতো হাস্যকর চরিত্রকে বা শোভনলাল কাউকেই সে পছন্দ করত না। তাঁর শেষ কবিতাতেও ওই বইটির বিন্দুমাত্র অনুষঙ্গ মেলে না। মরণ সাধনার লেখা ‘চার অধ্যায়’-এও এলা, অন্তু, ইন্দ্রনাথ কারোর হাতেই এ উপন্যাস নেই, পেট্রিয়টিজম নিয়ে অনেক কথা আছে নানা প্রবন্ধে, চিঠিতে। না, সেখানেও নেই।
‘পয়লা নম্বর’ গল্পের অদ্বৈতচরণ বিত্তবান, আছে ‘বই-পড়ার নেশা’। সে অনেক কিছু পড়ে—ইবসেন, মেটারলিঙ্ক, ফ্লোবেয়ার, টলস্টয়, টুর্গেনিভ—ও আরও অনেক কিছু। বই পড়ার জগতেও ফ্যাশন আছে। ধনবানের বিদ্যা প্রচারের ক্ষেত্রেও এ ফ্যাশন আজও আছে। এরা, বাছবিচার করতে জানে না, কিংবা চায় না। শুধু চায় কিছু নিয়ে হইচই তাই নিয়েই লাফালাফি। সেটা জামাকাপড় জুতো হতে পারে আবার নব্য সংস্কৃতি হতে পারে। অন্য দলের প্রিয়, জীবন প্রেরণা সঞ্চারী বই/গানও তারা তুলে নিতে পারে—নিজে ওয়াকিবহাল বোঝাতে অথবা শেষোক্ত ধাঁচের বই/গানকে বোঝানোর চেষ্টা করে পাঠককে শ্রোতাকে গুলিয়ে দেবার জন্য। এ গল্পের অদ্বৈত অনুগত কানাইকে বলে রাতের সাহিত্যসভার জন্য সব তৈরি—‘ম্যাক্সিম গোর্কির নতুন গল্পের বই, বের্গসঁর উপর রাসেলের সমালোচনা, মাছের কচুরি, এমনকি, আমড়ার চাটনি পর্যন্ত।’ অদ্বৈতচরণ চটকদারপন্থী বিত্তবান, তার কাছে, তার সভার ভক্তদের কাছে গোর্কি, বের্গসঁ, রাসেল, মাছের কচুরি, আমড়ার চাটনি—সমান মুখরোচক। অদ্বৈতচরণের ব্যক্তিগত জীবনে ‘গোর্কির নতুন গল্পের বই’-এর কোনো অভিঘাত নেই, তার বউ পালায়, পাশের বাড়ির সিতাংশুর পঁচিশটি প্রেমপত্র আবিষ্কৃত হয়, ‘স্ত্রীর পত্র’ গল্পের মৃণাল-এর মতো এ মেয়ে পালায়। কিন্তু কোথায়? সমালোচকরা যে ব্যাখ্যাই দিন, আসলে এ হল বড়লোকের বউ পালানোর গল্প। গোর্কি লিখেছিলেন—‘সংস্কৃতির প্রভুরা, আপনারা কার পক্ষে?’ শেষের কবিতা, পয়লা নম্বর রচনায় গোর্কির উল্লেখ সেই লেখা মনে পড়িয়ে দেয়।
আর একটা উল্লেখ পাচ্ছি। রাণী চন্দ লিখছেন—‘সকালে প্রায় রোজই আমাকে (গুরুদেব) খানিকক্ষণ ইংরেজি পড়ান। আজ কয়েকদিন থেকে পড়ছিলাম ম্যাক্সিম গোর্কির “মাই ইউনিভার্সিটি ডেজ” বইখানা। এই বইখানি হাতের কাছে ছিল, তিনি বললেন ভালোই হল, এখানা আমার পড়া হয় নি, তোকে পড়াতে পড়াতে আমারও পড়া হয়ে যাক।’ (আলাপচারী রবীন্দ্রনাথ—রাণী চন্দ, পৃ. ৩৩) প্রসঙ্গ ১৫ জুন, ১৯৩৫-র। রাণী চন্দ স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেন ১৯৪২-এ, জেলে যান, যে প্রসঙ্গ আছে ‘জেনানা ফাটক’ বইতে। আন্দোলনের ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে গোর্কির কথা জানা স্বাভাবিক। রাণীর জীবনে গোর্কি সাহিত্য কতদূর ধাক্কা দিয়েছিল জানার কৌতূহল মুলতুবি রইল। তবে রবীন্দ্রনাথ আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসটির এই ৩য় খণ্ডটি পড়তে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন এটা কৌতূহলোদ্দীপক। কি ছিল তার মত, জানা যায় না।
বুদ্ধদেব বসু প্রমুখরা বলতে শুরু করেছিলেন, রবিঠাকুরের দিন গেছে। বৃদ্ধ কবি এরকম মন্তব্যে বিব্রত বোধ করতেন। তাই প্রাণপণে আধুনিক বা সাম্প্রতিক থাকার চেষ্টা ছিল। একটা প্রদর্শনমনস্কতা এসে গিয়েছিল। গোর্কি প্রসঙ্গ ব্যবহার তার একটি দৃষ্টান্ত।
সংযোজন:
পূর্বেই বলেছি রবীন্দ্র দৃষ্টিভঙ্গিকে দেখতে হবে রোলাঁ রবীন্দ্র গোর্কি সূত্রে। রোলাঁর মস্কো ডায়েরি সূত্রে জানা যায় ১৯৩৫-এর জুন মাসে রোলাঁ সস্ত্রীক রাশিয়া যান গোর্কির আমন্ত্রণে এবং অতিথি হয়ে (গোর্কির) থাকেন তিন সপ্তাহ। দিনগুলি ছিল সোভিয়েতের এবং রোলাঁর সংকটের কাল। ১৯১৮-তে রোলাঁকে মস্কোর সমাজতান্ত্রিক সমাজবিজ্ঞান একাদেমির সম্মানিত সদস্যপদ দেবার ঘোষণা হয়। রাশিয়া তাঁকে আকর্ষণ করছিল চুম্বকের মতো। রোলাঁ লেনিন ও গান্ধী, মস্কো ও ভারত, ‘আগুন ও জলের’ আপাতবিরোধী মিলন সাধনের চেষ্টা করেন। তবে বারবুসকে বলেন তিনি ফ্যাসিজম এবং কমিউনিস্ট ডিক্টেটরি উভয়েরই বিরোধী। গোর্কি রাশিয়া ফেরার পর থেকে চাইছিলেন রোলাঁর সঙ্গে দেখা করতে। ১৯১৭ থেকে দুজনের অব্যাহত পত্রালাপ। গোর্কির বাড়িতে স্তালিনের সঙ্গে রোলাঁর দেখা। মলোটভ, ভরোশিলভ, কাগানোভিচও ছিলেন। এছাড়া এসেছেন লেখকরা, পুদভকিন ও সঙ্গীতজ্ঞরা। ডায়েরি অনুযায়ী গোর্কি সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়ন—“তিনি স্তালিনপন্থী লেনিনবাদের উদ্দেশ্য ও কর্ম পুরোপুরি বরণ করেছেন, তার মধ্যে এনেছেন উদ্দীপনার এক প্রচণ্ড আবেগ এবং সেই আশাবাদ, যা ঐক্যসঙ্গীত হয়ে উঠেছে কর্মীবাহিনীর এবং গড়ে তোলার বিশাল বিশাল পরিকল্পনার কর্মশালা গুলোর সঙ্গে। ... লেনিন তাঁকে ভালোবাসতেন, নিজে তাঁকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলেন ধ্বংস আর লড়াইয়ের ময়দান থেকে।” (পৃ. ১২০, বাংলা অনুবাদ: অবন্তী সান্যাল) ট্রেনে বসেই গোর্কিকে লিখছেন—‘সোভিয়েতের মাটিতে আমার প্রথম কথাটাই আপনার নাম।’ (পৃ. ১৯৪) ক্রেমলিনে স্ট্যালিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ, যুব ক্রীড়া উৎসবে সম্মানিত অতিথি, উলানোভার নাচ দেখা, ‘ভোক্স’-এ সংবর্ধিত। গান্ধী চর্চা, রবীন্দ্র সাক্ষাৎ ও চর্চা সূত্রেই রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ সাধনায় আগ্রহী হবার কথা বলেছেন শ্রী সান্যাল। (পৃ. ৩২) পাঠক যদি রাশিয়ার চিঠি ও মস্কোর ডায়েরি পড়েন তাহলে এই দুজনের reception-এর ফারাকটা বোঝা যাবে।