রবীন্দ্রনাথ মৈত্রেয়ী দেবীকে চন্দননগর হাউসবোট ‘পদ্মা’ থেকে লিখছেন—‘শান্তিনিকেতনে একবার নববর্ষার সমারোহ যদি দেখতে যাও তাহলে মন্দ হয় না। এখানে গঙ্গার দুই তীরে খুব ঘন হয়ে বর্ষা নেমেছে। লাগ্চে ভালো। কিন্তু শান্তিনিকেতনের অবারিত প্রান্তরে বর্ষার আসর যেরকম জমে এমন আর কোথাও না।’ (স্বর্গের কাছাকাছি - মৈত্রেয়ী দেবী, পৃ. ২১৩) অন্যত্র মৈত্রেয়ী বলেন—‘যদিও শান্তিনিকেতনের প্রান্তরে বর্ষাই তাঁর প্রিয় ঋতু—মাঠের উপর দিয়ে ভৈরব হরষে যখন সে আসে কবি হর্ষিত হন। কিন্তু পাহাড়ের ঝিরিঝিরি স্যাঁতসেঁতে বৃষ্টি, শীত শীত ভাব বড় একঘেয়ে হয়ে উঠত।’ (পূর্বোক্ত, পৃ. ২৬২) মাঝে মাঝে বীরভূমের বাইরে গেলে, বিশেষতঃ বর্ষার প্রাক্কালে, বলতেন ফিরে উপভোগে আপ্লুত হবেন বর্ষা সমীরণে। বৈচিত্র্য পিয়াসী কবি সাড়া দিতেন ঋতুরঙ্গের বৈচিত্র্যে। ‘ঝরঝর ঝরে জল, বিজুলি হানে,/ পবন মাতিছে বনে পাগল গানে।/ আমার পরাণপুটে কোন্খানে ব্যথা ফুটে/ কার কথা জেগে উঠে হৃদয় কোণে।।’ স্বরচিত ব্রজবুলিতে শুনি বর্ষা বন্দনা—‘ঘন ঘন রিম্ঝিম্ রিম্ঝিম্ রিম্ঝিম্ বরখত নীরদপুঞ্জ।/ শাল-পিয়ালে তাল-তমালে নিবিড়তিমিরময় কুঞ্জ।’ বর্ষা দেয় বিরহ, একাকীত্ব—‘মেঘের পরে মেঘ জমেছে, আঁধার করে আসে।/ আমায় কেন বসিয়ে রাখ একা দ্বারের পাশে।।/ ...তুমি যদি না দেখা দাও, কর আমায় হেলা,/ কেমন করে কাটে আমার এমন বাদল-বেলা।’ / এবং ‘আষাঢ়সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল, গেল রে দিন বয়ে।/ বাঁধন-হারা বৃষ্টিধারা ঝরছে রয়ে রয়ে।।’ বৃষ্টির ঘনঘটা স্রষ্টাকে উদ্বুদ্ধ করে চিত্ররচনায়—মেঘের জটা উড়িয়ে দিয়ে নৃত্য, অন্তরে আজ কি কলরোল, ‘দ্বারে দ্বারে ভাঙল আগল—/হৃদয় মাঝে জাগল পাগল আজি ভাদরে।’ শ্রাবণকে কবি দুর্দমবীর সম্বোধনে জড়ের যত বাধা উন্মূলনে ভূমিকা নিতে বলেছেন। নিছক বর্ণনা ছাপিয়ে এবার বর্ষাকে তার রূপকে মানুষের মাঝে দেখতে চান। একদিকে হৃদয় নাচে ময়ূরের মতো, অন্যাদিকে এক যুদ্ধজয়ের উদ্দীপনা, ‘প্রমত্তদানব’ দলন। বর্ষার শান্তিদাত্রী রূপ আর একাকীত্বে বেদনা আসছে সময়ের টানে। কবি-মন মেঘের সঙ্গী হয়ে উড়ে চলতে চায় দিগন্তের পানে। ‘শ্রাবণের গান’ কবিকন্ঠে শেষ হবার নয়। বর্ষণ জাগিয়ে তোলে বাণী, মনে পড়ে চোখের জলে ভেসে যাওয়া দিনের ছায়া ‘শ্রাবণ গগনতলে।’ কখনও কখনও টুকরো অভিঘাত অতিক্রম করে কবি কাহিনী বয়নে রাখালের উদ্যোগ, অভিভাবকের নিষেধ (ওগো আজ তোরা যাসনে গো তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে) তুলে আনেন।
‘ছিন্ন পত্রাবলী’র পাতা ওল্টালে, প্রকৃতিপ্রেমিক কবির উদ্দীপনার নানাত্ব চোখে না পড়ে পারে না। (এ লেখায় শুধু বর্ষা প্রকৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছি) যেমন—‘তার পরে বিদ্যুৎবজ্র ঝড় বৃষ্টি সমস্ত একসঙ্গে এসে পড়ে খুব একটা তুর্কিনাচন নাচতে আরম্ভ করে দিলে। বাঁশ গাছগুলো হাউ হাউ শব্দে একবার পূর্বে একবার পশ্চিমে লুটিয়ে লুটিয়ে পড়তে লাগল, ঝড় যেন সোঁ সোঁ করে সাপুড়েদের মতো বাঁশি বাজাতে লাগল।’ (এ বইতে পাব চলিষ্ণু চিত্র, ধ্বনি প্রকাশ, উপলব্ধির বিচিত্রতা) অনুরূপ আর এক ছবি বোলপুরে—‘ধুলোয় আকাশ আচ্ছন্ন হয়ে গেল এবং বাগানের যত শুকনো পাতা একত্র হয়ে লাটিমের মতো বাগান-ময় ঘুরে ঘুরে নেচে নেচে বেড়াতে লাগল—যেন অরণ্যের যত প্রেতাত্মাগুলো হঠাৎ জেগে উঠে ভুতুড়ে নাচন নাচতে আরম্ভ করে দিলে।’ ভয়ানক বৃষ্টি বাদল কাটলে পৃথিবীর তৃণ-আবরণে চিকচিকে টসটসে সবুজ দেখে কবির চোখ জুড়োচ্ছে, জল ভারাক্রান্ত মেঘ এবং বর্ষার সুস্নিগ্ধ ছায়া জাগাচ্ছে ভাবের গতি। ‘মেঘদূত’ মনে পড়া স্বাভাবিক—‘কাল আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে বর্ষার নব রাজ্যাভিষেক বেশ রীতিমত আড়ম্বরের সঙ্গে সম্পন্ন হয়ে গেছে।’ রোমান্টিক কবির আক্ষেপ—‘এমন সুন্দর দিন রাত্রিগুলি আমার জীবন থেকে প্রতিদিন চলে যাচ্ছে—এর সমস্তটা গ্রহণ করতে পারছিনে।’ শিলাইদহে ডাঙায় সন্ধ্যা প্রাক্কালে বেড়াতে বেড়াতে অনুভব করেন—‘আমার মন ছেয়ে যেন নতুন পাতা গজিয়ে উঠছে—আমি নতুন প্রাণ এবং বলে পরিপূর্ণ হয়ে উঠছি।’
এইসব অনুভবের পরিচয় আমরা পাব রবীন্দ্রের এই পর্বের ছোটগল্পেও। সাজাদপুরে একদা লক্ষ্য করলেন ‘রাগী মেঘ’ যা ফুলে ফুলে উঠছে ‘প্রকাণ্ড হিংস্র দৈত্যের রোষস্ফীত গোঁফ জোড়াটার মতো।’ রোমান্টিকতার দুটি লক্ষণ—অতৃপ্তি ও অলৌকিকত্বের পরিচয় এখানে। স্মৃতির সবিনয় দ্বারোদ্ঘাটন যদি প্রশ্রয় পায় তাহলে বলি ১৯৬৩তে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্পগুচ্ছ পড়ানোর কথা। ২টি উল্লেখ মাত্র করব। ‘পোস্টমাস্টার’ গল্প শেষে পোস্টমাস্টার যখন বদলির আনন্দে ফিরে চললেন তখন রতনের অব্যক্ত বেদনা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ শুধু বললেন—‘বর্ষাবিস্ফারিত নদী ধরণীর উচ্ছলিত অশ্রুরাশির মতো চারি দিকে ছলছল করিতে লাগিল,’—এই suggestiveness অতুলনীয়। ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’ গল্পে উদাসীন রাইচরণ আঁচল ভরে কদম্বফুল তুলছে, তখন একবার ঝপ করে শব্দ হল, তারপর বর্ষার ‘পদ্মা পূর্ববৎ ছল্ছল্ খল্খল্ করিয়া ছুটিয়া চলিতে লাগিল, যেন সে কিছুই জানে না, ...।’ আনোয়ার পাশা বলেছিলেন—‘প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই বর্ষার সঙ্গে দুঃখ বেদনার যোগ লক্ষ করা যায় গল্পগুলির মধ্যে।’ ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পে আছে অন্তহীন বর্ষণের কথা, তারপরই তার অসুখ, সে প্রতিক্রিয়ায় চাকরি ইস্তফা, রতনের সঙ্গে চিরবিচ্ছেদ। ‘জীবিত ও মৃত’ ‘গল্পটি বর্ষার সুরে বাঁধা’। ‘ছুটি’ গল্পে ফটিক যেদিন শহর জীবনে অতিষ্ঠ হয়ে নিরুদ্দেশ সেদিন ‘রাত্রি হইতে মুষলধারে শ্রাবণের বৃষ্টি পড়িতেছে’ এবং সন্ধ্যায় পুলিস যখন ধরে আনল ‘তখনো ঝুপ ঝুপ করিয়া অবিরাম বৃষ্টি পড়িতেছে।’ বর্ষার একচ্ছত্র আধিপত্য ‘শাস্তি’ গল্পেও। ‘মেঘ ও রৌদ্র’ বর্ষাঋতুর আলোছায়ার গল্প। (রবীন্দ্র ছোটগল্প সমীক্ষা ১ম খণ্ড, পৃ. ১৫৯ - ১৬২) একটা গল্প পাঠের অবিস্মরণীয় স্মৃতি আজ ৫৭ বছর পরেও মনে আছে। সেটি—‘অতিথি’ যার শেষাংশে আছে—‘আকাশে নববর্ষার মেঘ উঠিল’, এবং ‘গৃহপ্রত্যাগত পার্বতীর মতো দ্রুতগামিনী জলধারা’ কলহাস্য করে এল, তারপর মেঘের ও নদী জলের ক্রমান্বয় গতিবৃদ্ধি। নারায়ণবাবু দেখিয়েছিলেন বর্ষা ও পরিপার্শ্বের গতিবৃদ্ধির সঙ্গে ক্রিয়াপদের বিবর্তন। বর্ষার মেঘান্ধকার রাত্রেই আসক্তিবিহীন তারাপদর চলে যাওয়া।
রবীন্দ্রনাথের বর্ষা বিষয়ক কবিতা, কিংবা বর্ষা চিহ্নিত কবিতা অনেক আছে। সেগুলি নিয়ে স্বতন্ত্র লেখা অবশ্য করা চলে। ঋতু অভিঘাত রবীন্দ্রসাহিত্যে অতুলন বৈচিত্র্যে উপস্থিত। পাঠক প্রযুক্তি সাহায্যে সহজেই এ বিষয়ের সান্নিধ্য পেতে পারবেন, তাই উল্লেখ করলাম না।
রবীন্দ্রনাথ চাইতেন যে-ঋতুবৈচিত্র্য তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে উদ্দীপনা দিচ্ছে সেটা ছড়িয়ে যাক দিকে দিগন্তরে। ‘বর্ষামঙ্গল’ এই অভিপ্রায়েই আয়োজিত। প্রশান্ত পাল এক বর্ষা-উৎসবের কথা বলেন, যদিও বলেন ‘তারিখ জানা যায় নি।’ তবে সেটা ১৯০৭-এ। উদ্যোক্তা ক্ষিতিমোহন ও অন্যান্য শিক্ষকগণ। প্রেরণা রবীন্দ্রের। ক্ষিতিমোহন লেখেন—‘মনে আছে একদিন বর্ষার সন্ধ্যা। কয়েকজন গুরুদেবের চারিদিক ঘিরিয়া বসিয়া আছি। …. গুরুদেব বলিলেন—“যদি আমরা প্রকৃতির প্রত্যেকটি ঋতুকে অন্তরের মধ্যে উপলব্ধি করিতে পারি তবেই আমাদের চিত্তের সব দৈন্য দূর হয়, অন্তরাত্মা ঐশ্বর্যময় হইয়া উঠে।” .... আমরা মনে মনে স্থির করিলাম এই বর্ষাতেই একটি বর্ষা-উৎসব করিতে হইবে।’ .... তখন দিনেন্দ্রনাথ, অজিত চক্রবর্তী, বিধুশেখর প্রভৃতি সকলে মিলিয়া একটা বর্ষা উৎসবের আয়োজন করা গেল। বর্ষার জন্য বৈদিক পর্জন্য দেবতার বেদি সাজানো হইল, ভালো ভালো পর্জন্যস্তুতি উচ্চারিত হইল, তারপর রামায়ণ হইতে বর্ষার বর্ণনা, কালিদাস প্রভৃতি কবিগণের বর্ষাবর্ণনা পড়া হইল, বৈষ্ণব কবিগণের বর্ষার গান, ইংরাজী হইতেও কিছু কিছু বর্ষার কবিতা পাঠ এবং সর্বশেষে গুরুদেবের কাব্য হইতে বর্ষার ভালো ভালো কবিতা পঠিত হইল। দিনুবাবু সদলবলে ‘অচ্ছা বদ তবসং গীর্ভিরাভিঃ’ এই বৈদিক বর্ষা সংগীতটি সুর সহ গান করিলেন। .... গুরুদেব দূর হইতেই এই সব খবর শুনিয়া খুব খুশি হইলেন।’ প্রশান্তবাবু এটাও বলেন এ সময় রবীন্দ্র গানে প্রকৃতির ভূমিকা তেমন ব্যাপক নয়, বর্ষার গানও লক্ষণীয়ভাবে কম। (তখনও ‘ঐ আসে ঐ অতি’, ‘নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে, হৃদয় আমার নাচে রে' আজিকে প্রভৃতি কবিতায় সুরযোজনা হয়নি)। [রবিজীবনী খণ্ড ৬, পৃ. ২৩-২৪)। প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন বর্ষামঙ্গল হয় জোড়াসাঁকোয় (১৩২৮), আলফ্রেড থিয়েটরে (১৩২৯), শান্তিনিকেতনে (১৩২৯) ঐ (১৩৩২), ঐ (১৩৩৬)।
‘বর্ষামঙ্গল’ উপলক্ষে কয়েকটি গান সমসময়ে রচিত হয়। যথা—এই সকালবেলায় বাদল আঁধার, আজ বর্ষা রাতের শেষে, আজ বাদল ছোঁওয়া লেগে, আজ নবীন মেঘের সুর লেগেছে, ভোর হল যেই শ্রাবণ শর্বরী, আসা যাওয়ার মাঝখানে, একলা বসে একে একে অন্যমনে, শ্রাবণ মেঘের আধেক দুয়ার (আগেরগুলি শান্তিনিকেতনে, এটি কলকাতায়), জলে ডোবা চিকন শ্যামল, কান পেতে রই (আত্রাই নদী বক্ষে) পূর্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায় জানান—‘গুরুদেবের মৃত্যুর আগে কখনও কখনও বর্ষামঙ্গল আর বৃক্ষরোপণ অনুষ্ঠিত হচ্ছিল একই দিনে।’ পত্রিকা সংবাদ—‘গত রবিবার (৩১ শ্রাবণ) শান্তিনিকেতন আশ্রমে বর্ষামঙ্গল উৎসব সম্পন্ন হইয়া গিয়াছে। আশ্রমের সিংহভবনে বর্ষামঙ্গলের গান হইয়াছিল। এই উপলক্ষে কবীন্দ্র রবীন্দ্রনাথ স্বহস্তে বৃক্ষরোপণ করেন। আশ্রম বালিকাদের হাতে অর্ঘ্য, পুরোভাগে ক্ষিতিমোহন, দিনেন্দ্র, বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ, সুসজ্জিত চন্দ্রাতপতল। সেবার ‘বলাই’ গল্পপাঠ, অবনীন্দ্রের বর্ষামঙ্গল কিয়দ প্রবন্ধ পাঠ। ১৯৩৩, ৮ জুলাই বর্ষামঙ্গল ও বৃক্ষরোপণে রবীন্দ্রনাথের আবৃত্তি, হাতি সিং-এর ভাবনৃত্য, কবিকর্তৃক সংগীতগুলি আবৃত্তি, উৎসবপূর্ব রাত্রে উদয়শঙ্করের উপস্থিতি।
‘শেষবর্ষণ’ কোনো অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে বিন্যস্ত। সেখানে নটরাজ বলছে, ‘কবি বলেন, বর্ষাকে না জানলে শরৎকে চেনা যায় না’। রাজার কথার উত্তরে নটরাজ বলে ‘বর্ষা প্রথমতঃ আসে বাইরের আকাশে। অন্তরের আকাশে তাকে গান গেয়ে ডেকে আনতে হয়।’ একথা রবীন্দ্রনাথ পূর্বে বলেছেন, এখানের গানগুলিও পূর্বে সৃষ্ট। ‘এস নীপবনে ছায়াবীথিতলে’, ‘ঝরে ঝর ঝর ভাদর বাদর’, ‘কোথা যে উধাও হল মোর প্রাণ উদাসী’, ‘আজ শ্রাবণের পূর্ণিমাতে’, ‘বজ্র মানিক দিয়ে গাঁথা’, ‘ধরণীর গগনের মিলনের ছন্দে’, ‘ঐ আসে ঐ অতি ভৈরব হরষে’ প্রভৃতি গানের সঙ্গে যুক্ত শরতের কয়েকটি গানও।
‘নটরাজ’ পালাগানে আছে ঋতুনৃত্য ও ঋতুগান। যেমন—কালবৈশাখী (কবিতা), নমো, নমো করুণাঘন (গান), আষাঢ় (কবিতা), বর্ষামঙ্গল (কবিতা), শ্রাবণবিদায় (গান), প্রভৃতি।
এবার ২২ শ্রাবণ, রবীন্দ্রপ্রয়াণ দিবস কথা। সে-ও বৃষ্টিঝরা শ্রাবণের এক শোক-অধ্যায়। শেষপর্যন্ত অপারেশনের জন্যই ৯ শ্রাবণ শুক্রবার ২৫ জুলাই রবীন্দ্রনাথ শেষযাত্রা করেন কলকাতার দিকে। বিশেষ সেলুনগাড়ি জুড়ে দেওয়া হয় পাকুড় প্যাসেঞ্জারের সঙ্গে। আনা হল জোড়াসাঁকো বাড়িতে। রবীন্দ্রনাথ নিজে, ডাক্তার নীলরতন সরকার, কবিরাজ বিমলানন্দ তর্কতীর্থ ছিলেন অপারেশনের বিপক্ষে, কিন্তু ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়, ডাক্তার ললিতমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, ডাক্তার ইন্দুভূষণ বসু, ছিলেন অপারেশনের পক্ষে। শেষপর্যন্ত অপারেশনপন্থীরা (এই ‘সুপ্রা পিউবিক সিস্টোস্টমি’ অপারেশন) জয়ী। শান্তিনিকেতন ত্যাগের কালে আশ্রমবাসীরা পায়ে হাত দিয়ে প্রণামের সুযোগ পান নি। স্টেশনগামী বাস চলতে শুরু করার পর গান (আমাদের শান্তিনিকেতন) শোনা গেল। বাস থেকে স্টেশনে বিশেষ সেলুনগাড়িতে, যা যুক্ত হয় পাকুড় প্যাসেঞ্জারে সকাল আটটায়, পৌঁছায় ২-৪০ মিনিটে, ১৪ নম্বর প্ল্যাটফর্মে, গাড়িতে জোড়াসাঁকো ৩-১৫ মিনিটে। ৩০ জুলাই অপারেশনের দিন, ১১টায় বারান্দায় অপারেশন টেবিলে। ২৫ মিনিটের অপারেশন, কিন্তু বিকেলের দিকে মাঝে মাঝে—জ্বালা করছে, ব্যথা করছে। ৩১ জুলাই তাই, ১ অগাষ্ট যন্ত্রণাসূচক শব্দ ও হিক্কা, ২রা আচ্ছন্নতা, মাঝে মাঝে কাশি। ৩রা অবস্থার অবনতি, ওষুধে বিরক্তি, দুপুর থেকে আচ্ছন্নতা। এবার কিডনি অকেজো। জেঁকে বসল ইউরোমিয়া, অপারেশনের সেলাই খুলে দিলেন ললিতবাবু। বিধান ও ললিতের হতাশা। ৭ আগস্ট, ২২শে শ্রাবণ ৭টায় রামানন্দবাবুর উপাসনা, বিধুশেখরের মন্ত্রপাঠ, অমিতা ঠাকুর কর্তৃক মুখে জল, নাড়ি ধরে ডাঃ জ্যোতিষ রায়, মালা জপ তান য়ুন শানের। বেলা ৯টায় অক্সিজেন দেওয়া শুরু। বিধান ও ললিতের পুনঃপর্যবেক্ষণ। খুলে দেওয়া হল অক্সিজেন নল, উষ্ণতা ও হৃদস্পন্দন স্তব্ধ, দুপুর ১২টা ১০মিনিটে।
বাইরে জনসমুদ্র, জনতার অধৈর্যপনা। অন্যদিকে গুরুদেবের দেহ স্নাত, সাদা বেনারসী জোড়, গরদের পাঞ্জাবি, পাটকরা চাদর, কপালে চন্দন, গলায় গোড়ে মালা, দুপাশে রাশি রাশি শ্বেতকমল, রজনীগন্ধা। শেষযাত্রার পালঙ্ক, নকশা এঁকে মিস্ত্রি দিয়ে তৈরি করান নন্দলাল। বেলা সাড়ে ৩টে পর্যন্ত জনতার শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন। এর পর শোকযাত্রা। দোতলার সিঁড়ির রেলিং ভেঙে পড়ে, সিঁড়ির ছাদও ভাঙার উপক্রম, লোহার গেট ভেঙে গেছে। নৌকোর মতো ভাসতে ভাসতে শবাধার চলে রাজপথে। আকাশবাণীতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের যাত্রা বিবরণ, আবৃত্তি, নজরুলের স্বরচিত কবিতা-গান (ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে), এন্ডরুজের রেকর্ড করা ভাষণ, প্রধান ধর্মযাজকের শোক নিবেদন। সমকালীন কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত লেখেন—‘মরণের হাতে লীলাকমল তুমি,/ চলেছ আজ, জনস্রোতের তরঙ্গে তরঙ্গে,/ সদ্য ছেঁড়া সহস্রদল পদ্মের মতোই ভেসে/ শোকের বার দরিয়ায়।’
কলেজ স্ট্রিট, কর্নওয়ালিস হয়ে নিমতলা শ্মশানঘাটে বিকেল ৫:৪০। ‘ঘোর বৃষ্টি জোর নামল ঝমঝম, আর সেই বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে চলে গেলো একদল শান্ত নিঃশব্দ গম্ভীর মন্থর চিনে, প্রত্যেকের মাথা নিচু, প্রত্যেকের হাতে ফুল, প্রত্যেকের খালি পা।’ অসুস্থতাবশতঃ রথীন্দ্রকে ফিরিয়ে আনা হয়, মুখাগ্নি করেন সুবীরেন্দ্রনাথ। ‘রাত্রি ৯টা নাগাদ নেমে এসেছে ধরিত্রীমাতার অশ্রুস্বরূপ বৃষ্টিধারা।’ ৮ আগষ্ট সন্ধ্যায় চিতাভস্ম আনা হয় শান্তিনিকেতনে। চীনভবন বাঁয়ে রেখে রান্নাঘর পেরিয়ে আশ্রমের ভিতর দিয়ে সোজা পথ উত্তরায়ণে, পুরো পথের দুধারে আশ্রমের ছাত্র ছাত্রী শিক্ষক। সচল যাত্রায় পুরোভাগে সুরেনদা, বুকের কাছে দু হাতে ধরা কাঁসার কলসীটি। (দুঃখের বিষয়, গুরুদেব ও তার পিতৃদেব দুজনের ভস্মাধার কলস দুটি উত্তরায়ণ প্রদর্শকক্ষে নেই, জোড়াসাঁকো বাড়ির শেষ পালঙ্কটিও লোপাট। হায় ভবিতব্য!)
পুনশ্চ: কুন্ঠিত নিবেদন
শান্তিনিকেতনে চাকরিকালে বর্ষার জন্য ঢোলা পাজামা, পাঞ্জাবী ও বড়ো ছাতা করেছিলাম। বর্ষার সকালে বেরিয়ে পড়তাম পদব্রজে ক্লাসের উদ্দেশে আর ফার্স্ট পিরিয়ডে যথাসময়ে পৌঁছে যেতাম ‘গিন্নি’ গল্পের মাস্টারমশাইয়ের মতো। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন—‘আমাদের অন্তরের সন্ধ্যাকাশেও এই শ্রাবণ অত্যন্ত ঘন হয়ে নেমেছে .... সেখানে কেবল গানের আসর জমাতে, কেবল লীলার আয়োজন করতে তার আগমন।’ (শ্রাবণ সন্ধ্যা)। ছাত্রছাত্রীরা পাঠ্য ছেড়ে অপাঠ্যের দাবী জানাত, গল্প বলতে হত কখনো, গান বা আবৃত্তিও হত সতর্কতায়। সারাটা দিনের অতিবাহনে নেমে আসত বর্ষার মৃত্তিকাস্পর্শী সৌরভ। ঘনঘোর বর্ষায় কলকাতা ছেড়ে শান্তিনিকেতনে আসতে আসতে ট্রেনে মনে জাগত সিক্ত বিষাদ। শান্তিনিকেতনে বর্ষার অন্যতম মাধুর্য সেখানে বৃষ্টির জল জমে না, বন্দীত্ব আনে না পথপ্রিয় মানুষের। এতো বছর পরেও শ্রাবণ অপরাহ্নে মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনকে —
‘এখন ও বৃষ্টির দিনে মনে পড়ে তাকেআমার ছিন্নভিন্ন জীবনে পাংশু সাধারণ্য অতিক্রম করতে পারলেই তাঁকে, রবীন্দ্রনাথকে আবিষ্কার করি আর জেগে থাকার সমিধ খুঁজে পাই।
প্রাদেশিক শ্যামলিমা যেই পাংশু সাধারণ্যে ঢাকে
অমনই সে আসে....’ (সুধীন্দ্রনাথ)