‘ইতিহাস’—এই শব্দের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় অথর্ববেদে, যার সময়কাল ধরা হয় মোটামুটি ১০০০-৯০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। আবার, আজ থেকে ২৫০০ বছর আগেই যে ভারতের মানুষ লিখতে শিখেছিল, অশোকের লেখ তার অকাট্য প্রমাণ। (যদিও একথা ঠিক যে তৃতীয় শতাব্দীর আগে লিখিত পাণ্ডুলিপি ভারতে পাওয়া যায়নি।) অথচ, ভারতকে তার প্রথম লিখিত ইতিহাস বই পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল ১১৫০ খ্রিস্টাব্দ (কারো কারো মতে ১১৪৮ খ্রিস্টাব্দ) পর্যন্ত—ব্যাপারটা খানিক অসম্ভব রকমের নয়? ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগুলির যেসব প্রাচীনতম নিদর্শন পাওয়া যায়, তার মধ্যে প্রত্ন-ভারতীয় আর্যভাষা বা বৈদিক সংস্কৃত ভাষায় লেখা ঋগ্বেদ অন্যতম। প্রাচীন ভারতের সমাজ সংস্কৃতি, আর্যদের আগমন ও বিস্তার, ভারতে বসবাসকারী মানুষদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ—এসবের মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়া যায় ঋগ্বেদ থেকে। হ্যাঁ, একথা ঠিক যে প্রাচীন ভারত ইতিহাসের উপাদান খুব বেশি পাওয়া যায় না ঋগ্বেদে, কিন্তু প্রাচীন সাহিত্য হিসেবে ঋগ্বেদ বা অন্যান্য বেদের গুরুত্ব শুধু ভারত নয়, বিশ্বের ইতিহাসেও কোনোভাবেই হেলাফেলার নয়। এখন, ঋগ্বেদের মূল অংশের রচনা হয়েছিল ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, কারো কারো মতে তা ১৯০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ বা তারও আগে। এখন ঐতিহাসিকদের মধ্যে সালতারিখ নিয়ে মতপার্থক্য মেনে নিয়েও যদি মোটামুটি ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ ধরি, তবে কলহনের রাজতরঙ্গিণীর মধ্যে সময়ের পার্থক্য দাঁড়ায় ২৬৫০ বছর! (ভাবা যায়?) ভারতের মতো এক দেশ, জন্ম থেকেই বিদ্যাচর্চা যার সংস্কৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত, তাকেই কিনা প্রথম ইতিহাস বইয়ের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল এতগুলো বছর!
এখন, এইখান থেকে প্রশ্ন দাঁড়ায় প্রাচীন ভারতের সঙ্গে কতখানি যোগসূত্র আমরা বজায় রাখতে পেরেছি? ‘ঔপনিবেশিক প্রভাব’ বা Colonial Influence তো আমাদের সংস্কৃতি, লেখাপড়া বা চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে এক বাস্তবিক সত্য। আধুনিক যুগে প্রথম ভারতের ইতিহাস লিখেছিলেন যে ব্রিটিশ ঐতিহাসিকেরা তাঁদের সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব কারোর অজানা নয়। এমনকি স্যার উইলিয়াম জোন্স, যাঁর এশিয়াটিক সোসাইটি নিঃসন্দেহে ভারতের ইতিহাসচর্চায় এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল,—তিনি পর্যন্ত, যখন বেশ কিছু ইংরেজ ও ফরাসি দার্শনিকেরা হিন্দুশাস্ত্রে বিবৃত দর্শনের ওপর ভিত্তি করে একে ওল্ড টেস্টামেন্টের পূর্ববর্তী এবং উন্নততর বলে মতপ্রকাশ করতে শুরু করলেন, তখন ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি লিখলেন, কিছু বুদ্ধিমান ও ধর্মপরায়ণ মানুষ মোজেস প্রচারিত বিবরণের প্রামাণ্যতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করছেন। বাইবেলের সৃষ্টিতত্ত্বের প্রথম এগারো অধ্যায় হয় সত্য, নয়তো আমাদের জাতীয় ধর্মের সবটাই অসত্য! আবার, ম্যাক্স মূলার—প্রাচ্যবিদ্যা চর্চায় যার সত্যিই অশেষ অবদান, তিনিও কিনা তাঁর Sacred Books of the East নামের বিশাল বই সম্পর্কে স্ত্রীকে লিখেছিলেন, এই গ্রন্থ ও বেদের অনুবাদ ভারতের ভাগ্যকে প্রভাবিত করবে। এই গ্রন্থগুলিতেই রয়েছে হিন্দু ধর্ম ও সভ্যতার শিকড়। সেই শিকড় উপড়ে ফেলার জন্যই এইসব গ্রন্থ প্রকাশ করার প্রয়োজন ছিল। এইভাবে সেযুগে ভারত ইতিহাসচর্চার বিষয়টি জড়িয়ে গিয়েছিল খ্রিস্টান ধর্মের নিরাপত্তা ও তার সন্তোষবিধানের সঙ্গে। জেমস মিল বা ভিনসেন্ট স্মিথের সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি কারোর অজানা নয়, কিন্তু যেসব পণ্ডিতেরা ভারতের ইতিহাসকে এক নতুন স্বর দিয়েছিলেন, একে বিশ্বের সামনে এমনকি ভারতবাসীর সামনেও নতুনভাবে তুলে ধরেছিলেন, তাদের মধ্যেও ভারতীয় সভ্যতা নিয়ে এক দ্বিধা, কিংবা বলতে গেলে কোথাও না কোথাও যে এক নিরপেক্ষতার অভাব ছিল না তা নয়! এই ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভারতীয় ইতিহাসচর্চাকে বেরোতে সময় লেগেছিল বেশ কিছু বছর।
এরপর যখন জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ইতিহাসচর্চা শুরু হল, তখন গিয়ে প্রাচীন ভারত নিয়ে ধারণা পরিবর্তিত হল অনেকখানি। কাশীপ্রসাদ জয়সয়াল তাঁর Hindu Polity (১৯২৪) বইতে দেখালেন, ভারতে কেবল স্বৈরাচারী শাসন ছিল—ঔপনিবেশিক ঐতিহাসিকদের এই মত মিথ্যা। বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের পাশাপাশি ঋগ্বেদের কাল থেকেই ভারতে প্রজাতান্ত্রিক শাসনের আদর্শও বর্তমান ছিল। হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী, রমেশচন্দ্র মজুমদারের গবেষণা মৌর্য ও গুপ্ত যুগ সম্পর্কে এক নতুন দিগন্ত খুলে দিল। কে এ নীলকান্ত শাস্ত্রী দক্ষিণ-ভারতকে এক নতুন আলোয় তুলে ধরলেন তাঁর বইগুলিতে। ভারতের অতীত যে কত সমৃদ্ধ—জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকদের কাজ তা বিশ্বের কাছে তুলে ধরলেও, নিরপেক্ষ ইতিহাসচর্চার কষ্টিপাথরে যাচাই করলে এঁদের অনেকের রচনায় ভারতের অতীত ঐতিহ্যকে অতিরিক্ত গৌরবময় করে দেখানোর প্রবণতা-ই কিন্তু চোখে পড়ে।
এখন প্রশ্ন দাঁড়ায়, প্রাচীন ভারতের যত সাহিত্যিক উপাদান পাওয়া গেছে, তার সংখ্যা নেহাত কম নয়। তো এসব উপাদানের মধ্যে ইতিহাস-বোধ বা ইতিহাস সচেতনতা কতখানি? কারণ একে শুধুই তো আর ‘সাম্রাজ্যবাদী বনাম জাতীয়তাবাদী’-র বাইনারিতে দেখলে হবে না।
‘ইতিহাস’ শব্দটি ইতি, হ, আস এই তিনটি পদের সমন্বয়ে তৈরি। এর আক্ষরিক অর্থ দাঁড়ায়—‘এইরূপই ছিল’। লক্ষণীয় যে, ইংরেজি ‘হিস্ট্রি’ শব্দটি এসেছে গ্রিক ‘হিস্টোরিয়া’ থেকে, যার মূল অর্থ অনুসন্ধান, গবেষণা। এই দিক থেকে দেখতে গেলে, সুদূর অতীতে ভারতবাসী যে ‘ইতিহাস’ শব্দটির সৃষ্টি করেছিলেন, ব্যুৎপত্তিগত অর্থের দিকে দিয়ে তা এই আধুনিক কালে, যখন ইতিহাসচর্চার দিগন্ত বিভিন্ন দিশায় প্রসারিত হচ্ছে, তখনও সমানভাবে সফল।
যাইহোক, প্রাচীন ভারতে বিদ্যাচর্চায় ‘ইতিহাস’ কিন্তু এক বিশেষ স্থান নিয়ে আছে। কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে রাজাকে ইতিহাস শ্রবণের জন্য প্রতিদিনের একটা সময় নির্দিষ্ট রাখতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। এমনকি, কোন কোন জায়গায় ইতিহাসকে পঞ্চম বেদের স্থান দেওয়া হয়েছে। এখন দেখার, ‘ইতিহাস’কে তাঁরা কীভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন? —
“ধর্মার্থকামমোক্ষাণামুপদেশসমন্বিতম্।তাঁদের চোখে ‘ইতিহাস’ ছিল এমন এক শাস্ত্র, যা অতীতের ইতিবৃত্ত বর্ণনার পাশাপাশি ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষের প্রেরণাও জাগাবে পাঠকের মনে। অর্থাৎ, অতীতের ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা বা বিচার-বিশ্লেষণের ওপর যত না জোর দেওয়া হয়েছে, তার চেয়ে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে মানুষের বৌদ্ধিক, মানসিক এমনকি সামাজিক, রাজনৈতিক উন্নতির ওপর। এককথায়, ‘Better Self’-কে জাগিয়ে তোলার প্রচেষ্টাই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে, তা সে ব্যক্তি মানুষের হোক বা রাষ্ট্রের। ‘এইরূপই ছিল’—না বলে বেশি করে বলা হয়েছে ‘এইরূপই হওয়া উচিত’-এর কথা। যেমন—মনুসংহিতার সপ্তম অধ্যায়ের নাম ‘রাজধর্ম’, যার প্রথম শ্লোকে বলা হয়েছে “রাজা যেরূপ আচরণ বা কর্তব্যপালন করবেন, যেরূপে রাজার সৃষ্টি হয়েছে এবং যেভাবে তাঁর উত্তম সিদ্ধিলাভ হয়, সেই সমস্ত রাজধর্ম আমি (মনু) বর্ণনা করব।” অর্থাৎ, ভবিষ্যতের রাজা কী কী করলে ভালো হয়, সেবিষয়ে আলোচনা করতে তাঁরা রাজি আছেন। কিন্তু তাঁদের অতীতের বা বর্তমানের রাজারা বাস্তবিকই কেমন ছিলেন, কী কী কাজ করেছিলেন—সেবিষয়ে আলোচনার আগ্রহ, অন্তত সরাসরিভাবে প্রকাশ করতে তাঁরা রাজি হননি। এখন, আমরা যখন প্রথম স্কুলে ভর্তি হই, তখন ইতিহাসের সংজ্ঞা পড়ি, অতীতের কাহিনীই হল ইতিহাস। কিন্তু কয়েক ক্লাস ওপরে উঠলে এই সংজ্ঞাটাই আপডেটেড হয়ে হয়, ইতিহাস হল এমন এক বিদ্যা যা অতীতকে জেনে, তার আলোকে বর্তমানকে বুঝে, সেই শিক্ষার ভিত্তিতে ভবিষ্যতকে উন্নতরূপে গড়ে তোলে। ইতিহাসের আধুনিক সংজ্ঞাতেও সেই উন্নতরূপে গড়ে তোলার কথা! তবে, প্রাচীন ভারতবাসী যখন ‘এইরূপই হওয়া উচিত’ নিয়ে বেশি মাথা ঘামান, তখন তাঁকে ইতিহাস না লেখার জন্য কতখানিই বা কাঠগোড়ায় তোলা যায়?
পূর্ববৃত্তং কথাযুক্তমিতিহাসং প্রচক্ষতে।।”
যাইহোক, ভারতের ইতিহাসবোধকে বুঝতে আমরা আবার যদি সেই ঋগ্বেদের যুগে ফিরে যাই, তবে দেখতে পাব ভারতে ইতিহাস-ঐতিহ্যের সূচনা ঘটেছিল এই ঋগ্বেদের সময় থেকেই, গাথা, নারাশংসী, আখ্যান এবং পুরাণের মধ্য দিয়ে। সেযুগে এগুলো সবই ছিল মৌখিক। সূত, মাগধ, চারণ ও ঘটনাপঞ্জীর লেখকগণ ছিলেন এর রচয়িতা, তাঁরাই এগুলোকে জনসমাবেশে আবৃত্তি করতেন। এভাবেই এই ইতিহাস-ঐতিহ্য প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে প্রবাহিত হয়েছিল। কিন্তু গুপ্তযুগে যখন পুরাণগুলো সংকলিত হল, তখন সূত ও মাগধদের মতো পেশাদার ও দক্ষ ব্যক্তিরা একাজে গুরুত্ব পেলেন না। একাজ সম্পাদন করল ব্রাহ্মণেরা। সূত গৌণ হয়ে প্রধান হয়ে উঠলেন রাজার সভাকবি। সামাজিক অবনমন ঘটল সূত ও মাগধদের। সমসাময়িক আইন গ্রন্থগুলিতে তাদের ভিন্ন জাতির মধ্যে সম্পাদিত মিশ্র বিবাহের সন্তান ও সমাজের নিম্নস্তরের মানুষ হিসেবে উল্লেখ করা হল তাদের। এসবের ফলে প্রচলিত প্রাচীন ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা যে অনেকটাই ক্ষুণ্ণ হল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
কিন্তু তবুও পুরাণ থেকে কিছু কম ইতিহাসের উপাদান পাওয়া যায় না। পুরাণ সংখ্যায় আঠারোটি। কিন্তু ইতিহাসের উপাদান রূপে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য হল—বিষ্ণুপুরাণ, বায়ুপুরাণ, মৎস্যপুরাণ, ব্রহ্মপুরাণ এবং ভবিষ্যপুরাণ। পুরাণে শিশুনাগ, নন্দ, মৌর্য, শুঙ্গ, কান্ব, সাতবাহন, গুপ্ত-র মতো রাজবংশ ও যবন, শক, আভীর, তুষার-র মতো জাতির কথা জানতে পারা যায়। সাতবাহন রাজাদের বংশতালিকা ও তাদের রাজত্বকাল সম্পর্কে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ও বিশ্বাসযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় ‘মৎস্যপুরাণে’। আবার এই বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নের মুখেও পড়ে যখন মৎস্যপুরাণেরই বিভিন্ন পাণ্ডুলিপিতে এই তালিকা ভিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়। যাইহোক, প্রাচীন ভারতের সমাজ-সংস্কৃতি এবং রাজনীতিকে জানতে পুরাণের সাহায্য যে অপরিহার্য তা প্রায় সকলেই স্বীকার করেন।
বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্যের ভূমিকা ইতিহাসে আরো বেশি মূল্যবান। পালিভাষায় লেখা সুত্তপিটকের অন্তর্গত ‘খুদ্দনিকায়’-র দশম গ্রন্থ এবং প্রাচীন নবাঙ্গ বিভাগের অন্যতম অঙ্গ হল জাতক, যাতে গৌতম বুদ্ধের পূর্বজন্মের কাহিনী রয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম থেকে দ্বিতীয় শতকের মধ্যবর্তী সময়ের ইতিহাসের উপাদান হিসেবে ‘জাতক’-গুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ষোড়শ মহাজনপদের যুগের (খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ থেকে চতুর্থ শতক) ইতিহাস লিখতে বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্যগুলি অনেকটাই নির্ভরযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। শুধু জাতক নয়, বিনয়-পিটক, দীঘ-নিকায়, মজ্ঝিম-নিকায়, অঙ্গুত্তর-নিকায় ও সুত্তনিপাত এযুগের নির্ভরযোগ্য উপাদান। সিংহলী ইতিবৃত্ত দীপবংশ ও মহাবংশ, ত্রিপিটকের ভাষ্যকার বুদ্ধঘোষের ভাষ্যগ্রন্থগুলির সমষ্টি অত্থকথা (অর্থকথা), গ্রিক রাজা মিনান্দার ও বৌদ্ধ ভিক্ষু নাগসেনের মধ্যে প্রশ্নোত্তর মিলিন্দপঞ্হো, প্রাকৃত ও সংস্কৃতের মিলনে নির্মিত গাথাভাষায় লিখিত অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা, ললিতবিস্তর, মহাবস্তু প্রভৃতি থেকে শুধু যে বুদ্ধের জীবন ও বাণী পাওয়া যায় তা নয়, তখনকার আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক দিকটিও বেশ স্পষ্টভাবেই ফুটে ওঠে। জৈন গ্রন্থের মধ্যে কল্পসূত্র, ভগবতীসূত্র, পরিশিষ্টপার্বণ প্রভৃতিতে ষোড়শ মহাজনপদ এবং মৌর্যযুগ সম্পর্কে অনেক মূল্যবান তথ্য পাওয়া যায়। শুধু তাই নয়, জৈনধর্মের ইতিহাস, প্রাচীন বর্ণব্যবস্থা, নগর ও গ্রামের জনবসতি, সমুদ্র-বাণিজ্য প্রভৃতির ব্যাপারেও বেশ একটা ধারণা পাওয়া যায়।
সেযুগে আইনকানুন নিয়ে বেশ কিছু বই লেখা হয়েছিল, এগুলোকে ধর্মসূত্র বা স্মৃতিশাস্ত্র বলা হয়। ভাষাতত্ত্ব, জ্যোতিষ, রাষ্ট্রনীতির ওপর লেখা গ্রন্থগুলিও অতি মূল্যবান। কাব্য, নাটক, কথাসাহিত্যের মধ্যে থেকেও সেযুগের সমাজ-সংস্কৃতির একটুকরো আভাস পাওয়া যায়। জীবনীমূলক সাহিত্যের সংখ্যাও কম নয়, ইতিহাস রচনায় তা বেশ কাজেও আসে, কিন্তু পৃষ্ঠপোষক রাজার মন জুগিয়ে চলার আতিশয্যে রচনার নিরপেক্ষতা, ফলে তার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বাসযোগ্যতাও, যায় কমে। অবশ্য এ সমস্যা প্রাচীন বিশ্বের সর্বত্রই কম-বেশি ছিল; প্রাচীন-ই বা বলছি কেন, আজকের দিনেও তো শাসকের মন জুগিয়ে চলার কম চেষ্টা হয় না!
এসমস্ত বিষয়ের ওপর লেখা বইগুলোর নাম আমরা কম-বেশি সকলেই জানি, পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, মনুসংহিতা, কালিদাসের কাব্য ও নাটক, গুণাঢ্যের বৃহৎকথা, শূদ্রকের মৃচ্ছকটিক, কথাসরিৎসাগর, বানভট্টের হর্ষচরিত, বাক্পতিরাজের গৌড়বহো, সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত—এসবের নাম আমাদের স্কুল কলেজে মোটামুটি ভালোই শেখানো হয়। হয়তো একটু কম হলেও তামিল মহাকাব্য মনিমেকলৈ, শিলপ্পদিকরম আর শঙ্গম সাহিত্যের নামও আমরা শুনি, জানি যে এগুলো থেকে দক্ষিণ-ভারতের প্রাচীন ইতিহাস জানা যায়। কিন্তু শুধু নামটুকুই, এসব সাহিত্যকে পড়া, আরো ভালো করে বললে—ইতিহাসচর্চার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে যে পড়া, তা আমাদের শেখানো হয় না। এই বইগুলোতে ইতিহাসের কী কী উপাদান পাওয়া যায় তা আমরা কিছুটা পড়ি, কিন্তু নিজেরাই নিরপেক্ষ দৃষ্টি নিয়ে কীভাবে ওর মধ্যে ইতিহাসের উপাদান খুঁজব—তা আমরা শিখি না। আর এইখানেই ব্যর্থ হয়—আমাদের সঙ্গে অতীতের সংযোগ, দেশীয় সাহিত্যের থেকে বেশি করে নির্ভর করতে হয় বিদেশি সাহিত্যের ওপর।
ভারত ইতিহাসের দেশীয় সাহিত্যিক উপাদানগুলির মধ্যে বাকি রয়েছে আর একটিই বিষয়, যার নাম স্থানীয় ইতিবৃত্ত বা আঞ্চলিক ইতিহাস। নেপাল, সিন্ধু, কাশ্মীর ও গুজরাট—মূলত এই চারটি অঞ্চল থেকে পাওয়া গিয়েছে এইরকমের ইতিবৃত্ত। এই ইতিবৃত্তগুলির মধ্যে যেটি সবচেয়ে উজ্জ্বল—সেটিই ‘ভারতের প্রথম ইতিহাস বই’—কলহনের রাজতরঙ্গিণী। কলহন ইতিহাস রচয়িতার প্রধান আদর্শকে ঘোষণা করেছেন--“শ্লাঘাঃ স এব গুণবান্ রাগদ্বেষবহিষ্কৃতা। ভূতার্থকথনে যস্য স্থেয়স্যেব সরস্বতী।।” (সেই গুণবানই শ্লাঘ্য, ভূতার্থকথনে যাঁর বাণী (সরস্বতী) স্থেয় অর্থাৎ বিচারকের মতো রাগদ্বেষ বর্জিত হয়)। নিরপেক্ষ ইতিহাস রচনার তাগিদে তিনি কাশ্মীরের ইতিহাস সম্পর্কিত গ্রন্থগুলিকে খুঁটিয়ে পড়েছেন, লেখমালা, রাজপ্রশস্তি, সনদ ও ভূমিদানের বিবরণাদি থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। এরপর কারো চাপের কাছে নতিস্বীকার না করে লিখেছেন সমকালের তথ্যপূর্ণ, বিচিত্র ও জটিল রাষ্ট্রীয় ইতিহাস এবং নৃপতিদের ইতিবৃত্ত। যদিও রচনার প্রথম অংশ তথ্যের অভাবে কিছুটা দুর্বল, কিন্তু সপ্তম শতাব্দীর পরবর্তী থেকে তথ্য, যুক্তি ও প্রমাণে তাঁর রচনা সমৃদ্ধ। কলহনের অনুপ্রেরণায় জোনরাজ, শ্রীবর, প্রাজ্যভট্ট, শূক প্রভৃতি কবিরা কাশ্মীরের ইতিবৃত্ত রচনা করেন। চৌলুক্যরাজদের পৃষ্ঠপোষকতায় গুজরাটে অনেকগুলি ইতিবৃত্ত রচিত হয়েছিল, সোমেশ্বরের রাসমালা, কীর্তিকৌমুদী তার মধ্যে অন্যতম। নেপালেও কয়েকখানি বংশাবলী লেখা হয়েছিল। যদিও এর মধ্যে কোন রচনাই প্রতিভায় বা গুণে কলহনের রচনাকে ছাপিয়ে যেতে পারেনি।
ভারতীয় ইতিহাসচর্চার ইতিহাসে কলহন এবং তাঁর নিরপেক্ষ, যুক্তিবাদী ও সত্যনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গির গুরুত্ব কোনভাবেই খাটো করার মতো নয়। কলহনের রচনা ও তার চিন্তাভাবনার গুরুত্ব নিঃসন্দেহে অনেক বেশি। কিন্তু প্রাচীন সাহিত্যের ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিচার করার ক্ষেত্রে আমাদের যতখানি কাজ করা উচিত ছিল, ততখানি যে আমরা এখনও করতে পারিনি—সেটাও নিশ্চিত। এটা মোটেই নয় যে কেউ এসব নিয়ে কাজ করেননি, বা কিছুই হয়নি। সেই জাতীয়তাবাদী ইতিহাসচর্চার যুগ থেকে আরম্ভ করে আজ পর্যন্ত নিরপেক্ষ ও নিরলস ভাবে বহু গবেষক পরিশ্রম করেছেন, খুঁজে বের করেছেন এসব সাহিত্যের মধ্য থেকে ইতিহাসের অমূল্য উপাদান। আসলে, ইতিহাস নিয়ে যাঁরা গভীরভাবে পাঠ ও চর্চা করেন তাদের কাছে প্রাচীন দেশীয় সাহিত্যের মূল্য অজানা নয়। কিন্তু এই ছোট্ট কমিউনিটিকে বাদ দিলে সাধারণ নাগরিকরা হোক, হাইস্কুলের ছাত্রছাত্রী হোক বা সরকারি চাকরির পরীক্ষার্থী—আমাদের সকলের কাছে ভারতের প্রথম ইতিহাস বই রাজতরঙ্গিণী। হ্যাঁ, প্রাচীন কিছু বইয়ের নামও আমাদের মুখস্থ আছে পাখিপড়ার মতো। কিন্তু অর্থশাস্ত্র হোক বা দীঘ-নিকায়—ইতিহাস পাঠকের নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে পড়বার বা বিচার করবার কোনো সুযোগ প্রচলিত এই শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের দেয় না। এই আলোচনার আরেকটি দিকও রয়েছে—ইতিহাসের জনক বলা হয় যে হেরোডোটাসকে, তাঁর বইতে আজগুবি গল্প, পক্ষপাতিত্ব, চাঞ্চল্যকর বিষয়ের অযথা এবং অসত্য অবতারণা কিছু কম নেই। কিন্তু তাঁর কাজকে যেমন তাঁর সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করে তা থেকে ইতিহাসের উপাদান গ্রহণ করা হয়েছে, তেমনি মৌর্যযুগের ইতিহাসের ক্ষেত্রে যে অর্থশাস্ত্র গ্রন্থের এত বড় ভূমিকা, তাকে আমরা শুধুই স্মৃতিশাস্ত্র হিসেবে না দেখে ইতিহাসের মর্যাদা দেব না কেন?
গভীর ও সঠিকভাবে ইতিহাসচর্চার প্রশ্নটি তো অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, তার পাশাপাশি প্রতিদিনের জীবনে যেভাবে কিছু মানুষ বা দল নিজেদের উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য প্রাচীন ভারত বা মধ্যযুগের ভারত নিয়ে অসত্য এবং অসম্ভব সব দাবি করেন, আর প্রথাগতভাবে শিক্ষিত বেশ কিছু মানুষ তা মেনেও নেন, আর যাঁরা মানেন না তাঁরা সঠিক যুক্তি বা উত্তর দিতে ব্যর্থ হন—তখনই বোঝা যায় নিজেদের অতীত উত্তরাধিকারকে যথার্থ ও নিরপেক্ষভাবে জানবার প্রয়োজনীয়তা কোথায়! অতীতের সব ভালো বা সব মন্দ—এই দুটোর কোনোটাই আর ঠিক বলে মনে হয় না, যখন অতীতের উপাদানগুলি থেকে আমরা নিজেরাই অতীতকে দেখতে পাই। আর তখনই ভারতের প্রথম ইতিহাস ভারতের প্রথম যুগের সব বইয়ের মধ্যেই প্রকাশ পায়।