• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | Rabindranath Tagore | প্রবন্ধ
    Share
  • তোমায় নতুন করে পাব বলে : শম্পা ভট্টাচার্য


    আমার কলেজ গ্রন্থাগারে দেওয়ালে ঝোলানো সাদা চুল দাড়িওয়ালা, আলখাল্লা পরা রবীন্দ্রনাথের ছবির দিকে তাকিয়ে গ্রন্থাগারিক বলছিলেন - 'আচ্ছা, রবীন্দ্রনাথের তো আরও নানা বয়সের ছবি আছে - কত বছর ধরে ঐ একই ছবি দেওয়ালে টাঙানো; এ বছর কবির জন্মদিনে তা পালটালে হয় না?' ওঁর কথায় আমি চিন্তায় পড়লাম। ভেবে দেখলাম, সত্যিই তো! ফুটপাতে ছবির পসরায়, দেওয়াল ক্যালেণ্ডারে, গানের স্কুলে, পাড়ার পার্কে, রবীন্দ্র স্মরণ অনুষ্ঠানে, জাতীয় গ্রন্থাগারে বসানো অবয়বে সর্বত্র রবীন্দ্রনাথের একই ভঙ্গি, একই রূপ। এমনকি চটের ব্যাগ, ফাইল, টি-শার্ট আর পাঞ্জাবীতে কিংবা শান্তিনিকেতনী ঝোলায় আর বইয়ের প্রচ্ছদে প্রাজ্ঞ, ঋষিকল্প রবীন্দ্রনাথের সেই একই ছবি। বাইশ বছর আগে পারিবারিক ঐতিহ্য মেনে উত্তরাধিকার সূত্রে শ্বশুরগৃহের যেসব মূল্যবান সম্পত্তি আমার হস্তগত হয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম আবক্ষ সাদা দাড়ি সমন্বিত বৃদ্ধ রবি ঠাকুরের একটি বিশালাকৃতি ছবি। অতীতে ২৫শে বৈশাখে বরাবর এই ছবিকে কেন্দ্র করে শুরু হত পূর্ববঙ্গ থেকে উৎখাত হয়ে আসা একটি উদ্বাস্তু পরিবারের কবিপ্রণামের ঘরোয়া আসর। মনে পড়ে আরও একটি কথা। কয়েক বছর আগে আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলাম রবীন্দ্র জন্ম উৎসবের একটি অনুষ্ঠানে। শ্লোগানের সুরে, তালে, ছন্দে, লয়ে ঝোড়ো গর্জনে সর্বহারা রবীন্দ্রনাথ, দীন দুঃখী রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে সপ্রশংস হুহুঙ্কার শুনতে শুনতে আমি তখন দিশেহারা - ভেবে পাইনে 'কী বলে করিব নিবেদন' — ঠিক সেই সময়ে আমাকে আশ্বস্ত করল মঞ্চে ফুলমালা ধূপ চন্দন শোভিত সৌম্য, বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথের ছবি। হ্যাঁ, আবার উচ্চারণ করি 'আশ্বস্ত বোধ করেছিলুম'। বাঙালির sentiment বোধহয় ঐ সাদা চুল, দাড়িওয়ালা বৃদ্ধের ছবির মাঝে এক ধরনের ভরসা আর নির্ভরতা খুঁজে পায়। উপরে উল্লিখিত ঘটনাটি সামান্য, ব্যক্তিগত। তবে বিশ্বযুদ্ধোত্তর য়ুরোপে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নৈরাজ্যে জর্জরিত, আত্মকলহে টুকরো ক্ষতবিক্ষত উঠতি যুবসমাজ রাজনীতি কলুষিত আবহাওয়ার মধ্যে মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা, বিশ্বাস ও আনুগত্য ফিরে পেতে রবীন্দ্রনাথের ঋষিকল্প চেহারা, বাণী ও সাহিত্যের উপর ভরসা করেছিলেন। ঐ দাড়িওয়ালা বৃদ্ধের রূপের ও বেশবাসের জনপ্রিয়তার অন্তরালে আত্মসংশয়ী বাঙালির আপন শিকড় আর গোত্রকে খুঁজে পাওয়ার ব্যাকুল আকাঙ্খা ভিতরে ভিতরে ক্রিয়া করে চলেছে কিনা তা ভেবে দেখার বিষয়।

    পঞ্চাশতম বর্ষে পদার্পণ উপলক্ষে শান্তিনিকেতনে অনুষ্ঠিত জন্মদিনের অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন — 'আজ আমার জন্মদিনে তোমরা যে উৎসব করছ তার মধ্যে যদি সেই কথাটি থাকে, তোমরা যদি আমাকে আপন করে পেয়ে থাক, তাহলেই এই উৎসব সার্থক। তোমাদের জীবনের সঙ্গে আমার জীবন যদি বিশেষ ভাবে মিলে থাকে, আমাদের পরস্পরের মধ্যে যদি কোনও গভীরতর সম্বন্ধ স্থাপিত হয়ে থাকে তবে যথার্থভাবে এই উৎসবের প্রয়োজন আছে। তার মূল্য আছে।' (জন্মোৎসব, দ্রষ্টব্য, ভারতী, ভাদ্র ১৩১৭ পৃ. ৩৯৪-৩৯৯) সত্যিই কি রবীন্দ্রজীবনের সঙ্গে আধুনিক বাঙালিজীবন গভীর ভাবে মিলে গেছে? পরস্পরের মধ্যে স্থাপিত হয়েছে কি কোনো গভীরতর সম্পর্ক? আঁতিপাঁতি বিশ্লেষণ করে কি বাঙালি একবার দেখবে না- ভাববে না- জানতেও চাইবে না! রবীন্দ্রনাথের কাছে তাঁর প্রত্যেক জন্মদিন ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। তা ছিল তাঁর আত্মউপলব্ধি, আত্মপর্যালোচনা এবং আত্মপরিক্রমার দিন। ১৯১১ সালে জন্মদিনের দু' দিন পর প্রিয়ম্বদা দেবীকে কবি একটি চিঠিতে লিখলেন — 'আমার মনে হচ্ছে এই উৎসবে আমি মঙ্গল লাভ করেছি। ঈশ্বর আমার একটি নূতন জীবনের সূচনায় এই আনন্দ আয়োজন ঘটিয়েছেন। তিনি আমাকে এমন একটি জায়গায় নিয়ে যাচ্ছেন যেখানে পরিচয় বা পারিবারিক সম্বন্ধের দ্বারাই মানুষ আত্মীয় হয় না, যেখানে আত্মার পক্ষে আত্মীয়তাই সহজ ধর্ম - সেইজন্যে কত অজানাকে কত সহজেই আপন করে লাভ করেছি।' (রবীন্দ্রভবনে রক্ষিত প্রতিলিপি) পারিবারিক গভীর সীমানা ছাড়িয়ে কবির জন্মদিনের উৎসব আর দুবছর পর থেকে ব্যাপ্ত হয়ে পড়বে দেশ থেকে বিদেশে। কেননা নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পর পরিবার, সমাজ, দেশ পার হয়ে শুরু হবে কবির বিশ্বনাগরিক হয়ে ওঠার পালা। ঝড় ঝঞ্ঝা বর্ষণ মুখরিত ৫২তম জন্মদিনে কবি শিলাইদহ থেকে জগদানন্দ রায়কে চিঠি লিখলেন — 'এই ঝড়ে জীবনের নতুন পর্যায় বুঝি সূচনা হল — জীবনের শেষ ফল ফলাবার জন্যে একবার নতুন সবুজে সাজতে হবে।' পরের বছর ২৪শে বৈশাখ কবির মনে হল পরিচয় তার আর ফুরোবে না, পরিচয় হল অফুরান। ১৩২৮ বঙ্গাব্দের ২৫শে বৈশাখ রবীন্দ্রনাথ ৬০ বৎসর পূর্ণ করে ৬১ বৎসর বয়সে পদার্পণ করলেন। কবি এদিন প্রবাসে জেনিভাতে, বিশ্বযুদ্ধোত্তর রাজনীতির উত্তপ্ত আঁচ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারছিলেন না আবার শতধা বিভক্ত বঙ্গীয় রাজনীতিও তাঁর পিছু ছাড়ছিল না। তাই জন্মদিনে অ্যাণ্ড্রুজকে চিঠিতে লিখেছেন — 'Politics are so wholly against my nature and yet belonging to an unfortunate Country, born to an abnormal situation we fail to avoid their outbursts.' বিদেশে বসে কবি জন্মদিনের মস্ত উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন জার্মান ভাষায় লেখা প্রায় ৪০০ মূল্যবান বই। ১৯২১ সালের ৭ই মে জেনিভা থেকে ইন্দিরা দেবীকে যে চিঠি লিখেছেন তাতে বলেছেন - 'য়ুরোপের মহাদেশে আমার ঘর যে এমন করে বাঁধা হয়ে গেছে তা আমি এখানে আসবার আগে কল্পনা করতে পারিনি।' আধুনিককালে রবীন্দ্র স্মরণ অনুষ্ঠানে বিশ্বমানবিকতাবোধে উদ্বুদ্ধ হওয়া কবির ঐ মানসিক যাত্রাপথ আবার খুঁজে নিতে চেষ্টা করা যায় না কখনও। ষাট বছর পূর্তি উপলক্ষে তিনি স্পষ্টই বললেন - 'সংসারের মধ্যে মানুষের দুটি জন্ম। একটি হচ্ছে নিজের দেশের মধ্যে, আরেকটি সকল দেশে। এই দুটি জন্মের সামঞ্জস্যেই মানুষের সার্থকতা। নিজের হৃদয়ে দেশের সঙ্গে বিশ্বের মিলন সাধন করাতে পারলে তবেই হৃদয়ের মুক্তি।' তাঁর মতো এমন করে যদি আমরা হৃদয়ের মুক্তি খুঁজে নিতাম তবে দেশে দেশে জাতিতে জাতিতে সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে এত ভেদ এত রক্তপাত আর হানাহানি হয়তো ঘটত না।

    তবু বাঙালির সারস্বত নির্ভরতার প্রধান ভরসা রবীন্দ্রনাথ। চারপাশের জীবনের কালিমা আর যন্ত্রণা মুছে যায় তাঁর কবিতায়। তাঁর রচিত সাহিত্য, তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী, শ্রীনিকেতন, তাঁর শিক্ষাদর্শ সমাজভাবনা কোনও কিছুই বাতিল হয়ে যায়নি আমাদের জীবনে। বরং আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে আমাদের জীবনচর্যার পরতে পরতে জড়িয়ে মিশে যাচ্ছে সুখে ও দুঃখে। উৎসবে, অনুষ্ঠানে, জনারণ্যে, বিজনে তাঁর গান আমাদের প্রাণের ভাষা, নির্জনতার সঙ্গী।

    ১৩৩১ বঙ্গাব্দের ২৫শে বৈশাখ কবি ৬৩ বছর পূর্ণ করে ৬৪ বছরে পদার্পণ করলেন। এ দিন তিনি বিদেশে - চীনে। পিকিং (বর্তমান বেজিং) এর Crescent Moon Society এই দিনটিকে রবীন্দ্র দিবস নাম দিয়ে কবির জন্মদিন পালনের আয়োজন করল। সেদিন চীনা ভাষায় রবীন্দ্রনাথের নতুন নামকরণ হল চু-চেন্-টান্ যার অর্থ ভারতের মেঘমন্দ্রিত প্রভাত। জন্মদিনের ঐ অনুষ্ঠানের কথা মনে রেখে কবি মৃত্যুর কয়েক মাস আগে লিখেছিলেন —

    একদা গিয়েছি চিনদেশে অচেনা তাহারা
    ললাটে দিয়েছে চিহ্ন তুমি আমাদের চেনা বলে।
    ধরিনু চিনের নাম পরিনু চিনের বেশবাস,
    একথা বুঝিনু মনে যেখানে বন্ধু পাই
                             সেখানেই নবজন্ম ঘটে।
    (জন্মদিনে - ৩ সংখ্যক কবিতা, উদয়ন, ২১শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৪১)

    ১৩৩২ বঙ্গাব্দ, ২৯শে বৈশাখ - জন্মদিনের চার দিন পরে কবি ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণীকে চিঠিতে লিখলেন — 'আবার আমি ফেলে দিয়েছি আমার বই, আমার কাজ, আবার আমার মন পলাতক। সমস্ত দিন কিছুই করিনে কেবল সামনে চেয়ে আছি - দেখি পূর্ণতা সেই শূন্যে।' (চিঠিপত্র-৫, পৃ. ১৩) দেশে বিদেশে মহা সমারোহে অনুষ্ঠিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের ৭০তম জন্ম উৎসব। অবশ্য তাঁর ৬৭তম জন্মদিনে বিশেষ আকর্ষণ ছিল কবির তুলাদান। কবির দেহের ওজনের সমপরিমাণ বই বিশ্বভারতী থেকে অন্যান্য পাবলিক লাইব্রেরী ও প্রতিষ্ঠানের দানের জন্য রাখা হল। আর তাঁর ৭০তম জন্মদিনটিতে সারা ভারতবর্ষ উৎসবে মেতে ওঠে। বরাবরের মতো এই উৎসব নিয়ে 'শনিবারের চিঠি' কবিকে তীব্র কটাক্ষ করতে ছাড়ে নি। ঐ দিন শান্তিনিকেতনে তাঁর জন্মদিনে কবি বললেন — 'আমাকে অনেকে অনেক রকম করে বলে থাকেন, বর্ণনা করে থাকেন, তত্ত্বজ্ঞানী বলেন, কেহ বা স্কুল মাস্টারের পদে বসান, কেবল ছোটদের নয়, বড়দেরও শিক্ষা দেওয়ার ভার দেন। আমি তা এড়িয়ে এসেচি। আমি বরাবর সকলকে বলি - আমাকে ভুল যেন না বুঝেন। আমি কোনরূপ কাউকে চালনা করতে অধিকারী নই। আমি বলতে এসেছি বলে যাব, বাঁশী দিয়েছেন বাজিয়ে যাব, আমার কাজ - প্রদোষের কথা ও প্রভাতের কথা বলা।'

    ১৯৩৮ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে চলেছে সর্বত্র। হিটলার ও মুসোলিনীর অমানবিক অত্যাচারে কবি মর্মাহত। আর তাই জন্মদিনে ক্ষোভে, দুঃখে, অভিমানে নিজেকে ধিক্কৃত করে নববর্ষে অমিয় চক্রবর্তীকে চিঠিতে লিখছেন — 'এই বিশ্বব্যাপী আশঙ্কার মধ্যে আমরা আছি ক্লীব নিষ্ক্রিয়ভাবে দৈবের দিকে তাকিয়ে—এমন অপমান আর কিছু হতে পারে না — মনুষ্যত্বের এই দারুণ ধিক্কারের মধ্যে আমি পড়লুম আজ ৭৮ বছরের জন্ম বৎসরে।' (চিঠিপত্র-১১, পৃ. ২১৪-১৫, পঃ সঃ ১৬) এই বছর কবি চৈত্র মাসের শেষে গ্রীষ্মের অবকাশ কাটাতে গেলেন কালিম্পং-এ। সেখানে খুব ধূমধাম করে তাঁর জন্মদিন পালিত হল। কবির কণ্ঠে 'জন্মদিন' কবিতাটি কালিম্পং থেকে টেলিফোনে কলকাতায় ব্রডকাস্টিং সেণ্টারে পাঠিয়ে তা কলকাতা, দিল্লী, বোম্বাই, লক্ষ্ণৌ, লাহোর এবং পেশোয়ারে একই সময়ে বেতার স্টেশন মারফৎ রিলে করা হল। বিশ্বব্যাপী ধ্বংসের লীলায় তিনি যেমন তীব্র অস্বস্তি আর যন্ত্রণার শিকার হয়েছেন যার প্রতিফলন আছে ঐ কবিতায় তেমনি তার পাশাপাশি ঐ কবিতায় তিনি উচ্চারণ করলেন — 'আজ আসিয়াছে কাছে / জন্মদিন মৃত্যুদিন, একাসনে দোঁহে বসিয়াছে / দুই আলো মুখোমুখি মিলেছে জীবন প্রান্তে মম / রজনীর চন্দ্র আর প্রত্যুষের শুকতারা সম/ একমন্ত্রে দোঁহে অভ্যর্থনা'। মৃত্যুর পদধ্বনি হয়ত শুনতে পাচ্ছেন তখন।

    ১৯৪১ সালের ৮ই মে রবীন্দ্রজীবনের শেষতম জন্মদিন। বিগত কয়েক বছরের মতো এই দিনে সারা পৃথিবীর রবীন্দ্র অনুগামীর দল যথাযথ মর্যাদায় জন্মদিবসের উৎসব পালন করল। পারস্য, রাশিয়া, চীন, জাপান প্রভৃতি দেশ থেকে আসে অভিনন্দন বার্তা। এত প্রশংসা, স্তব, স্তুতির মধ্যেও কবি যেন কোথাও নির্বিকারভাবে তাঁর পূর্বজীবনের স্মৃতিচিত্রখানি উল্‌টে পাল্‌টে দেখে নিয়ে লিখেছিলেন —

    জন্মের প্রথম গ্রন্থে নিয়ে আসে অলিখিত পাতা,
    দিনে দিনে পূর্ণ হয় বাণীতে
    আপনার পরিচয় গাঁথা হয়ে চলে,
    দিনশেষে পরিস্ফুট হয়ে উঠে ছবি,
    নিজেরে চিনিতে পারে
         রূপকার নিজের স্বাক্ষরে;
    তারপরে মুছে ফেলে বর্ণ আর রেখা তার
                   উদাসীন চিত্রকর কালো কালি দিয়ে।'

    নিজের ঘরে আবদ্ধ থেকে স্তুতি ও নিন্দায় স্ফীত হওয়ার মানুষ কোনোকালে ছিলেন না কবি। অতিপ্রাকৃত সৃজনক্ষমতা ও কর্মপ্রতিভায় ভরপুর এই মানুষটি নিজের কর্মকাণ্ডের প্রতি চিরকাল বেশি মনোযোগী ছিলেন। বাঙালির সামনে আজ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের থেকে বড় কোনও আদর্শ বা দর্শন কি আছে — যার জন্য এক কথায় পথে নামা যায়? অথচ পঁচিশে বৈশাখ বা বাইশে শ্রাবণে আপামর জনসাধারণ যখন মালাচন্দন ধুপধুনো রবীন্দ্র অর্চনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে তখন স্বততঃ মনের মধ্যে একটা খোঁজ জেগে ওঠে যে রবীন্দ্রপ্রিয়, রবীন্দ্রবিরোধী আর রবীন্দ্রনিরপেক্ষ জ্ঞানী গুণীর দল রবীন্দ্রসাহিত্যকে সমকালের অনুষঙ্গে গ্রথিত করতে পারলেন কিনা। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন এ সব জনসভার অনেক অংশই আনুষ্ঠানিক, প্রায় তা কাঠখড়ে তৈরি। একদিন তার আবাহন, পরদিন তা বিস্মৃতির জলে বিসর্জন দেবার যোগ্য। কিন্তু মানুষের কাছে কবির প্রীতি পাবার আকাঙ্খা কোনোকালে মেটে নি। তাই যে আত্মীয়তায় আত্মপরের বিচ্ছেদ, দূর নিকটের ব্যবধান তুচ্ছ হয়ে যায় সেই আত্মীয়তার বরণমালাখানি কখনও দূরে ঠেলে দেননি, কালের ব্যবধান ডিঙিয়ে, ঘুচিয়ে আধুনিক বাঙালি যখন এই জনগণমন অধিনায়কের কাছে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করতে চায় তখন সেটাকে ক্লিশে, অভ্যাসের আবর্জনা বলে বিদ্রুপ করা সঙ্গত নয়। কবির জীবন সাধনা ঘিরে আমাদের অজস্র জিজ্ঞাসা, অন্তহীন কৌতূহল। এখনও অনেক মানুষ মনে করেন - রবিঠাকুর আছেন হৃদয় জুড়ে - না হলে এই জীবন বইব কেমন করে? অর্থনীতির সত্তরোর্ধ এক প্রবীণ অধ্যাপককে আমি চিনি, যিনি গান গাইতে না পারলেও 'গীতবিতান' তাঁর কণ্ঠস্থ। আছেন এমন অনেক মানুষ রবীন্দ্র রচনাবলী উলটে পালটে যোগাড় করেন বেঁচে থাকার রসদ - পরাজয়ের সান্ত্বনাবাক্য।

    রবীন্দ্রনাথ তো শুধু বিদ্বজ্জনের সামগ্রী নন। আমজনতাও রবীন্দ্রসংগীত গাইতে পারেন, কবিতা পড়েন, গল্প উপন্যাস পড়ে তর্কাতর্কি করেন রীতিমত। তাদের পরিচয় মেলে না, তাঁরা স্বভাবত নীরব। পথে ঘাটে, হাটে বাজারে, ট্রেনে, বাসে, প্রান্তিক মানুষের কথায়, পথ চলতি মন্তব্যে রবীন্দ্র সাহিত্য সম্পর্কে মূল্যবান উক্তি শুনলে বোঝা যায় রবীন্দ্র চর্চার শিকড় বাঙালির জীবনে সুগভীর প্রোথিত। সর্বসাধারণের রসাস্বাদন ক্ষমতা বড় কম নয় বলেই রামায়ণ মহাভারত জনসাধারণের মধ্য দিয়ে বহমানতা রক্ষা করে যাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের অস্তিত্ব আমাদের আনন্দ ও গৌরবের বিষয়। তিনি যে আমাদের মাঝে ছিলেন তা নিয়ে উৎসব করতে আমরা ভালবাসি, রবীন্দ্রনাথের কবিতার ছত্রছায়ায় আজও অনেক বাঙালি কাব্য সাধনা শুরু করেন। অনুগত প্রজার মনোবৃত্তি নিয়ে রবীন্দ্রচর্চা করা উচিত নয়। মননে, ভাবনায় তিনি আমাদের থেকে বড় হতে পারেন তবু তাঁর সাহিত্য পড়লে বোঝা যায় তিনি আমাদের বন্ধু, নিকটজন। তাঁর সৃষ্টি আমাদের সঙ্গে কথা বলে। তাঁর সঙ্গে অনায়াসেই মনে মনে সংলাপ বা তর্ক করতে পারি। একটা গভীর নৈকট্য আর আত্মীয়তাবোধে আমরা তাঁর সঙ্গে বাঁধা পড়ে আছি। জীবৎকালে জন্মদিনের ভাষণে মানুষের কাছে বারবার আত্মার আত্মীয়তাটুকু প্রার্থনা করেছিলেন কবি। আজও বেঁচে আছে রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় কীর্তি এবং বেঁচে আছি আমরা। যা প্রয়োজন তা হল এই দুইয়ের মাঝে সুদৃঢ় বন্ধন। এই সম্পর্ক তো কবি গড়তে চেয়েছিলেন। ভুলি কেমন করে যে ঔপনিবেশিক ইংরেজ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া কবি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠা করেছেন। যে উত্তরাধিকার নতুনের জন্ম দেয় তা জীবিতের উত্তরাধিকার। রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা সাহিত্য আরও ব্যাপ্ত আর আন্তর্জাতিক হয়ে উঠেছে। তাঁর উত্তরাধিকার বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে উপহার দিয়েছে সৃজনের প্রতিভা সমৃদ্ধ নতুন সাহিত্যিক। এখানেই রবীন্দ্রনাথ পুরাতন হয়েও চিরন্তন। সেই চিরন্তনতার কাছে মাথা নত করি।

    তথ্যসূত্র :
    পঁচিশে বৈশাখ -- অনুত্তম ভট্টাচার্য (এবং মুশায়েরা, দ্বিতীয় সংস্করণ, এপ্রিল ২০১১)


  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments