নোবেল পুরস্কার পাবার পর রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠেছিলেন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব। ইংরেজি ভাষায় তাঁর জীবনী রচনার কাজ শুরু হয়েছিল ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকেই। সে-সব জীবনী ইংরেজি-ভাষী লেখকেরা লিখেছিলেন, আবার বাঙালি লেখকেরা এবং অ-বাঙালি ভারতীয় লেখকেরাও লিখেছিলেন। সে-সব জীবনীর পরিচয় অনেক গবেষকই পেয়েছেন এবং সে-সম্পর্কে লিখেছেন। কিন্তু ইংরেজি ছাড়া অপর ইউরোপীয় ভাষাগুলিতে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে জীবনী রচনা কারা করেছিলেন সেই ব্যাপারে আমাদের ধারণা খুব বেশি নেই। কাজেই যখন আমরা হাতে পেয়ে যাই চেকভাষায় রচিত একটি রবীন্দ্রজীবনীগ্রন্থ তখন আমাদের স্বভাবতই জানতে ইচ্ছে করে সেই বই এবং বই-এর লেখক সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক তথ্যসমূহ।
বইটির লেখক হলেন ডক্টর ভিনসেন্স লেসনি (Dr. Vincenc Lesny, 1882-1953). বইটির ইংরেজি অনুবাদের নাম ‘রবীন্দ্রনাথ টেগোর হিজ্ পার্সোনালিটি অ্যান্ড ওয়ার্ক’ (Rabindranath Tagore his personality and work). বইটি লেখা হয়েছিল চেকোস্লোভাকিয়াতে বসে ১৯৩১ থেকে ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে। লেখা শেষ হয়েছিল ১৯৩৬ এর শেষে বা ১৯৩৭ এর একেবারে গোড়ায়। চেক ভাষায় লিখিত বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে। এই সংবাদ জানিয়েছেন সমীর সেনগুপ্ত তাঁর ‘রবীন্দ্রসূত্রে বিদেশিরা’ গ্রন্থে। (সাহিত্য সংসদ, ১৪১৭ বঙ্গাব্দ, ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দ, পৃষ্ঠা ৮৭৮)। কিন্তু লেসনির বইটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে। অনুবাদ করেছিলেন গাই ম্যাককীভার ফিলিপ্স (Guy McKeever Phillips)। বইটি প্রকাশিত হয়েছিল জর্জ অ্যালেন অ্যান্ড আনউইন লিমিটেড, লন্ডন থেকে। এই অনুবাদটির প্রাক্কথন (ফোরওয়ার্ড) লিখেছিলেন সি. এফ. অ্যান্ড্রুজ। বইটিতে কী আছে তার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দেবার আগে অধ্যাপক ভি. লেসনি সম্পর্কে কিছু জানা প্রয়োজন।
ভিনসেন্স লেসনি ছিলেন প্রাহা বা প্রাগ্-এর চেক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত ভাষার এবং প্রাচ্য-বিদ্যার অধ্যাপক। ভারততত্ত্ববিদ্রূপে তাঁর খ্যাতি ছিল। রবীন্দ্রনাথকে দেখবার আগে থেকেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন রবীন্দ্রনাথের লেখার অনুরাগী। রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পাবার পরে যে বিদেশিরা রবীন্দ্রনাথের রচনা কিছুটা পাঠ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে অধ্যাপক লেসনি অন্যতম। রবীন্দ্রসাহিত্য পাঠে তিনি মুগ্ধ হন এবং ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দেই রবীন্দ্রনাথের কিছু কবিতা এবং গদ্যের চেক ভাষায় অনুবাদ করে তার একটি সংকলন প্রকাশ করেন। সংকলনটির নাম ‘উকেজি পোয়েজি অ্যা প্রোজি’ (Ukazy Poesie A Prosy)। এই সংকলনটির নাম পেয়েছি আন্তর্জালে কিন্তু চোখে দেখা সম্ভব হয়নি এবং জানতে পারিনি রবীন্দ্রনাথের কোন্ কোন্ কবিতা এবং গদ্য অনুবাদ করেছিলেন লেসনি। তাঁর এই অনুবাদের প্রয়াস থেকেই চেক ভাষায় রবীন্দ্রচর্চার সূত্রপাত হয়।
অধ্যাপক লেসনি বিশ্ববিখ্যাত প্রাচ্যতত্ত্ববিদ্, অস্ট্রিয়ার অধিবাসী মরিস উইন্টারনিৎস (Moritz Winternitz 1863-1937)-এর সূত্রেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত হন। প্রসঙ্গত উইন্টারনিৎস সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলে নেওয়া যায়। অধ্যাপক উইন্টারনিৎস ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হবার পরে অক্সফোর্ড-এ গিয়ে অধ্যাপক ম্যাক্সমুলারের সহযোগীরূপে কাজ করেন। তাঁরা দুজনে মিলে ঋগ্বেদের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রস্তুত করেছিলেন। উইন্টারনিৎস প্রাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারততত্ত্ব পড়াতে শুরু করেন ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে। সংস্কৃত ভাষায় তিনি সুপণ্ডিত ছিলেন । প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ভারতীয় সাহিত্যে ছিলেন বিশেষজ্ঞ।
প্রাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেসনির সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘনিষ্ঠ হয়। লেসনি ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে থেকে প্রাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।
উইন্টারনিৎস-এর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পত্র-বিনিময় ছিল। চাক্ষুষ পরিচয় ঘটে রবীন্দ্রনাথের চেকোস্লোভাকিয়া ভ্রমণকালে। প্রথম মহাযুদ্ধের পর পূর্বের অস্ট্রো-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্যের কয়েকটি অঞ্চলের সমন্বয়ে নতুন রাষ্ট্র চেকোস্লোভাকিয়ার জন্ম হয় ২৮ অক্টোবর ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে। এই নতুন প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক ড. টোমাস মাসারিক (Dr. Tomas Masaryk)। তাঁর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কিছুটা পূর্বপরিচয় ছিল। নতুন চেক প্রজাতন্ত্রে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বতন্ত্র চেক বিশ্ববিদ্যালয়। আগে থেকেই সেখানে ছিল জার্মানদের প্রতিষ্ঠিত স্টেট ইউনিভার্সিটি। এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই রবীন্দ্রনাথকে বক্তৃতার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। চেকোস্লোভাকিয়ার সরকার এই সফরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। রবীন্দ্রনাথ তখন ইউরোপ ভ্রমণ করছিলেন, ভিয়েনা থেকে তিনি গিয়েছিলেন প্রাগ-এ। রবীন্দ্রনাথ প্রাগ-এ পৌঁছেছিলেন ১৮ জুন ১৯২১-এ। সেখানেই প্রথম তাঁর সঙ্গে লেসনির পরিচয় হয়। উইন্টারনিৎস সেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। উইন্টারনিৎস ছিলেন স্টেট ইউনিভার্সিটির এবং লেসনি ছিলেন চেক ইউনিভার্সিটির প্রতিনিধি। সম্ভবত সেখানেই রবীন্দ্রনাথ উইন্টারনিৎস এবং লেসনি দুজনকেই বিশ্বভারতীতে অধ্যাপনা করবার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তাঁরা দুজনেই গ্রহণ করেছিলেন সেই আমন্ত্রণ। উইন্টারনিৎস শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে। তিনি সেখানে ছিলেন ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত। লেসনি এসেছিলেন তাঁর আগেই। তাঁর আসার নির্দিষ্ট তারিখ কোথাও পাওয়া যায়নি। কিন্তু ‘শান্তিনিকেতন’ পত্রিকায় ১৩৩০ বঙ্গাব্দের বৈশাখ সংখ্যায় (এপ্রিল - মে ১৯২৩) যা লেখা হয়েছিল তা এখানে উদ্ধৃত করছি— “... অধ্যাপক লেস্নি এক বৎসরকাল আশ্রম বাস করিয়া বিশ্বভারতীর ছাত্রদের গ্রীক ভাষা ও শব্দতত্ত্ব সম্বন্ধে শিক্ষাদান করিয়াছেন। তিনি এখন আমাদের নিকট হইতে বিদায় লইয়া য়ুরোপ যাত্রা করিতেছেন। কলাভবনে তাঁহাকে বিদায় দিবার জন্য একটি সভা করা হয়। তাহার অমায়িক চরিত্রে, নিষ্ঠায় এবং পাণ্ডিত্যে আশ্রমবাসী সকলেই মুগ্ধ হইয়াছেন। তিনি যতদিন এখানে ছিলেন একটু একটু করিয়া বাংলা ভাষাও শিক্ষা করিয়াছেন। ইনি পূজনীয় গুরুদেবের ‘লিপিকা’র চেক ভাষায় অনুবাদ করিতে মনস্থ করিয়াছেন। ...”
এই সংবাদের ভিত্তিতে বলা যায় যে, লেসনি ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের গ্রীষ্মকালে শান্তিনিকেতনে এসে বিশ্বভারতীতে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হয় কলাভবনে বিশ্বভারতী সম্মেলনীর দশম বিশেষ অধিবেশনে, রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ এপ্রিল তারিখে।
অধ্যাপক লেসনি শান্তিনিকেতনে জার্মান ভাষা শেখাতেন। শান্তিনিকেতনে আসবার আগেই অধ্যাপক উইন্টারনিৎস-এর কাছে সংস্কৃত শিখেছিলেন তিনি। শান্তিনিকেতনে এসে খুব দ্রুত লেসনি বাংলাও শিখেছিলেন এবং রবীন্দ্রনাথ নিজে তাঁকে বাংলা শিক্ষায় সহায়তা করতেন। শান্তিনিকেতনে থাকাকালীন তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা এবং নাটক চেক ভাষায় অনুবাদ করতে শুরু করেন। কোন্ কোন্ রবীন্দ্ররচনা লেসনি চেক ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন তার নির্দিষ্ট তালিকা আমাদের কাছে নেই। তবে তিনি ‘লিপিকা’ চেকভাষায় অনুবাদ করেছিলেন বলে জানা যায়। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি সরাসরি বাংলা থেকে চেকভাষায় অনুবাদ করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে আবার চেকোস্লোভাকিয়ার প্রাগ শহরে গিয়েছিলেন। সেখানে পুনশ্চ তাঁর সঙ্গে লেসনির দেখা হয়। রবীন্দ্রনাথ ফিরে আসবার পর লেসনি অতিথি অধ্যাপকরূপে ১৯২৮ খ্রীষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে আবার শান্তিনিকেতনে আসেন। অতিথি অধ্যাপকরূপে তিন-চার মাস তিনি শান্তিনিকেতনে ছিলেন। এই সময় তিনি কোনো পারিশ্রমিক গ্রহণ করেননি। আবারও ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ এপ্রিল তাঁর বিদায়সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে উপস্থিত থেকে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীর প্রতীক-চিহ্ন খোদাই করা একটি সোনার আংটি তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন। শান্তিনিকেতনে এই প্রথা ছিল। আরও কোনো কোনো অধ্যাপকের বিদায়কালে সোনার আংটি দেওয়া হয়েছিল।
লেসনির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পত্রালাপ ১৯৩৮-৩৯ পর্যন্তই বজায় ছিল। ইউরোপে যে রাষ্ট্রীয় সংকট দেখা দিয়েছিল ১৯৩৭–৩৮ খ্রিস্টাব্দে তার ফলে জার্মানি, পোল্যান্ড এবং হাঙ্গেরি চেকোস্লোভাকিয়ার উপর অধিকার বিস্তার করতে প্রবলভাবে সচেষ্ট হয়েছিল। কিছু কিছু অংশ অধিকারও করেছিল। রবীন্দ্রনাথ সেইসময়ে দু:খ এবং সহানুভূতি জানিয়ে লেসনিকে চিঠি লিখেছিলেন।
শান্তিনিকেতন থেকে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে স্বদেশে ফিরে গিয়ে লেসনি আবার চেকোস্লোভাকিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছিলেন এবং উচ্চপদে আসীন হয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে অমিয় চক্রবর্তীর পরিচয় আগেই ছিল; ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে আবার তাঁদের চেকোস্লোভাকিয়াতে সাক্ষাৎ হয়। তাঁদের মধ্যে শান্তিনিকেতন নিয়ে আলোচনা হয়েছিল এবং লেসনি আরও একবার শান্তিনিকেতনে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। অমিয় চক্রবর্তী ২২ জুলাই ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথকে অনুরোধ জানিয়েছেন যেন তিনি এ-বিষয়ে চেক শিক্ষামন্ত্রীকে চিঠি দেন এবং লেসনিকেও আমন্ত্রণ জানান। রবীন্দ্রনাথকে লিখিত অমিয় চক্রবর্তীর পত্রসমূহের সংকলক নরেশ গুহ জানিয়েছেন যে, রবীন্দ্রনাথ সেই মর্মে চিঠি লিখেওছিলেন কিন্তু বিভিন্ন কারণে লেসনির আর শান্তিনিকেতনে আসা হয়নি।(‘কবির চিঠি কবিকে’, সম্পাদনা নরেশ গুহ, প্যাপিরাস, ১৯৯৫, পৃষ্ঠা ১৪৭)
অধ্যাপক ভিনসেন্স্ লেসনি রবীন্দ্রনাথের যে জীবনীটি চেক ভাষায় লিখেছিলেন তার ইংরেজি অনুবাদ (গাই ম্যাককীভার ফিলিপস্ কৃত) আমাদের হাতে এসেছে। জর্জ অ্যালেন অ্যান্ড আনউইন লিমিটেড, লণ্ডন থেকে ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত এই অনুবাদগ্রন্থটি সামনে রেখে আমরা বইটির সংক্ষিপ্ত পরিচিতি উপস্থিত করছি।
সেই পরিচয় দেবার আগে উল্লেখযোগ্য এই তথ্য যে, লেসনির চেক ভাষায় লেখা যে মূল গ্রন্থটি ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল তার প্রথমে লেসনিকে পাঠানো রবীন্দ্রনাথের বাংলাভাষায় লেখা একটি চিঠি রবীন্দ্রনাথের বাংলা হস্তলিপিতে মুদ্রিত হয়েছিল। বই-এর প্রকাশনার করণ-কৌশলে ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে এরকম একটি ব্যাপার ঘটিয়ে তোলা লেসনির রবীন্দ্র-অনুরাগের এক হৃদয়স্পর্শী স্বাক্ষর। সেই চিঠি এখানে উদ্ধৃত হল —
“... প্রিয় আচার্য লেজ্নি, শান্তিনিকেতনে একদিন তোমার সঙ্গে আমাদের মিলন হয়েছিল সে আমি সৌভাগ্য বলে মনে করি। নানা জাতির বিদ্যাসম্মিলনের মধ্য দিয়ে পরস্পরের হৃদয়ের যোগস্থাপন শান্তিনিকেতনের উদ্দেশ্য। সেই উদ্দেশ্য সাধনে তোমার সহায়তা ও সৌহৃদ্য আমরা মূল্যবান বলে মনে করি। অল্পকালের মধ্যে বাংলা ভাষার অন্তরে প্রবেশ করে আমার রচনার উপরে তুমি যে রকম অধিকার লাভ করেছ, সে আমার কাছে আশ্চর্য বোধ হয়। এমন ধারণা এবং বিচারের শক্তি আর কোনো বিদেশীর মধ্যে আমি দেখিনি। আমার লেখার সঙ্গে তোমাদের দেশের পাঠকদের যে পরিচয়সাধনে প্রবৃত্ত হয়েছ সে জন্যে তুমি আমার কৃতজ্ঞতা গ্রহণ করো। ...
ইতি ৫ই অগষ্ট ১৯৩৬
স্নেহানুগত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর”
(উদ্ধৃত: কবির চিঠি কবিকে; পূর্বোক্ত, পৃ: ১৬৩)
আরও একটি সূত্র থেকে আমরা জানতে পারি যে ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের জীবন ও সাহিত্য সম্পর্কে লেসনির বইটি লেখার কাজ চলছিল। অমিয় চক্রবর্তী শান্তিনিকেতন থেকেই লেসনির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। তিনি ১৯৩৬-এ ইউরোপে থাকার সময় একটি কন্ফারেন্স-এ যোগ দেবার জন্য প্রাগ-এ এসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে লেসনির সাক্ষাৎ হয়। লেসনির নির্মীয়মাণ বইটির কথাও ওঠে। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে লেখা চিঠিতে অমিয় চক্রবর্তীর যা জানিয়েছিলেন তা এখানে উদ্ধৃত হল।—
“July 23[1936]
Tempelkof Aerodrome
Berlinশ্রীচরণকমলেষু,
আজ সকালে প্রাগ থেকে এসেছি — আমাদের Conference হয়ে গেল। Lesny-র বই প্রায় শেষ হয়েছে—আপনার কাব্য এবং গদ্যরচনা সম্বন্ধে বোধ হয় এর চেয়ে ভালো বই এ অবধি বেরোয়নি। পাঁচ বছর একান্ত পরিশ্রম করে এবং মূল রচনা পড়ে উনি এই বই লিখেচেন। ওঁর বই ছাপা আরম্ভ হবে দুমাস পরে—তার মধ্যে যদি ‘পত্রপুট’, ‘বীথিকা’ এবং ‘চণ্ডালিকা’ উনি পান তাহলে উনি বিশেষ কৃতজ্ঞ হবেন—আর সমস্ত বইই উনি পেয়েচেন, আমিও কিছু দিয়েচি। আমার ‘পত্রপুট’, ‘বীথিকা’ অন্যকে দিয়েচি, দেশে গিয়ে নূতন বই পাব। যদি অনিলবাবুকে বলে দেন Lesny-কে ঐ তিনটে বই পাঠাতে তাহলে বড়ো উপকার হয়।আমার ভক্তিপূর্ণ প্রণাম গ্রহণ করুন।
প্রণত
অমিয়”
(কবির চিঠি কবিকে, সম্পাদনা নরেশ গুহ, প্যাপিরাস, ১৯৯৫, পৃষ্ঠা ১৬৩)
অমিয় চক্রবর্তীর এই চিঠি থেকেই আমরা জানতে পারি যে, ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুলাই এই চিঠি লেখার সময় ‘পাঁচ বছর একান্ত পরিশ্রম করে’ বইটি লিখেছেন অধ্যাপক লেসনি। আরও জানা যায়—‘বই ছাপা আরম্ভ হবে দুমাস পরে’। কাজেই লেখার সময়, বই প্রকাশের বছর এবং রবীন্দ্রনাথের চিঠির তারিখ সবই মিলে যাচ্ছে। সহজেই অনুমান করা যায় গ্রন্থটি মুদ্রিত করবার আগে রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে শুভেচ্ছাবার্তা জাতীয় কিছু চেয়েছিলেন লেখক এবং রবীন্দ্রনাথও পূরণ করেছিলেন সেই প্রার্থনা।
এবার আমরা লেসনির বইটির প্রসঙ্গে আসি। প্রথমেই আছে সি. এফ. অ্যান্ড্রুজ-এর লেখা একটি প্রাক্কথন (Foreword)। তারপরে আছে লেসনির লেখা একটি ভূমিকা। সেই ভূমিকায় কৃতজ্ঞতা স্বীকারের অংশটিই প্রধান। তারপরে আছে উপসংহারসহ আটটি অধ্যায়। সবশেষে আছে নির্ঘণ্ট। অধ্যায়গুলির নাম ইংরেজি ভাষাতেই উদ্ধৃত হল। —
1. INTELLECTUAL AND LITERARY TENDENCIES BEFORE RABINDRANATH TAGORE
2. YOUTH
3. MATURITY
4. LOFTIER THEMES
Devotion to Public Works
5. FAME AND WORLD-WIDE RECOGNITION
6. RESTLESSNESS
The Idea of Visvabharati
7. THE AUTUMN OF LIFE
8. CONCLUSION
Index
অধ্যাপক লেসনি তাঁর নিজের ভূমিকাটিতে প্রথমেই বলে নিয়েছেন যে, রবীন্দ্রনাথের জীবন ও সৃষ্টিকর্মের কাল–পরিসর রূপে তিনি ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের শেষ পর্যন্ত সময়–পর্বকে আলোচনার অন্তর্ভুক্ত করতে পেরেছেন। অত:পর তিনি তাঁর গবেষণা–কর্মের সহায়ক গ্রন্থ, পত্রিকা ও ব্যক্তিবর্গের নাম উল্লেখ করেছেন সযত্নে। সেই সব উল্লেখের তালিকা এখানে প্রদত্ত হল। বোঝা যাবে কতটা শ্রম তিনি স্বীকার করেছিলেন তাঁর প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে চেক ভাষা–ভাষী মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য।
পত্রিকা
. শান্তিনিকেতন পত্রিকা
. বিশ্বভারতী কোয়ার্টারলি
. মডার্ন রিভিউ
গ্রন্থ
. গোল্ডেন বুক অব্ টেগোর - সত্তর বর্ষ পূর্তি উপলক্ষ্যে প্রকাশিত রবীন্দ্র-স্মারক গ্রন্থ – ১৯৩১
. ওয়েস্টার্ন ইনফ্লুয়েন্স ইন বেঙ্গলি – প্রিয়রঞ্জন সেন – লিটারেচার (ইউনিভার্সিটি অব্ ক্যালকাটা, ১৯৩২)
. দ্য ফিলসফি অব্ রবীন্দ্রনাথ টেগোর – এস. রাধাকৃষ্ণন (ম্যাকমিলান অ্যান্ড কম্পানি, লন্ডন, ১৯১৮)
. লা পেনসি দ রবীন্দ্রনাথ তাগোর
(La pensee de Rabindranath Tagore) – Sushil Chandra Mitter (প্যারিস, ১৯৩০)
. বেঙ্গলি ড্রামা, ইটস্ ওরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট – পি. গুহঠাকুরতা (লন্ডন, ১৯৩০)
অত:পর অধ্যাপক লেসনি জানিয়েছেন যে, রবীন্দ্রনাথের নিজের লেখা থেকে তিনি বহুল পরিমাণে সহায়তা পেয়েছেন। বিশেষভাবে নাম করেছেন ‘গীতাঞ্জলি'র। একটি তথ্য উল্লেখযোগ্য। প্রাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওরিয়েন্টাল ইন্স্টিটিউট-এর বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক ১৯৩৫–৩৬-এ ছিলেন ডক্টর অমূল্যচন্দ্র সেন। এই গ্রন্থরচনায় সাহায্য করবার জন্য তাঁকে লেখক কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। অত:পর প্রাক্কথন লিখে দেবার জন্য সি. এফ. অ্যান্ড্রুজ এবং অনুবাদ করে দেবার জন্য মিস্টার জি. ম্যাককীভার ফিলিপ্সকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন লেসনি। ভূমিকার শেষ কয়েকটি ছত্রে লেসনি যে-ভাষায় রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন তা তাঁর ভাষাতেই (ইংরেজি অনুবাদে) উদ্ধৃত হল। —
“To write this book has been grateful task for me. In writing it, I have been fascinated both by the inspiration in which Tagore’s literary work is rich and by the charm of his personality, which is equally evident in his pure humanity and in his philosophy. Tagore has sung for his sons and grandsons of his country, not merely for his own generation, and he leaves them both a rich heritage. Today the evening hours of his life are striking, but it is to be hoped that it will yet be long before the evening of his life becomes night.”
অধ্যাপক লেসনির লেখা বইটির অনুসরণে দেখা যায় প্রথম অধ্যায়ে তিনি রবীন্দ্রনাথের জন্মের আগে বাংলার সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের চালচিত্র তুলে ধরেছেন। পলাশির যুদ্ধ এবং ঔপনিবেশিক শাসনের সূত্রপাতের প্রসঙ্গটি অল্প কথায় সেরে তিনি সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিবর্তনের প্রতিই দিয়েছেন গুরুত্ব। রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুর, সতীদাহ প্রথা রদ সংক্রান্ত প্রয়াস, ব্রাহ্মধর্মের সূচনাপর্ব মোটের উপর বিস্তৃতভাবে বিবৃত। সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের জীবনী রচনা করবেন বলেই ব্রাহ্মধর্মের প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে একটু বেশি। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা, কেশবচন্দ্র সেন, ব্রাহ্মসমাজের বিভাজনের উল্লেখ আছে।
ধর্মীয় সংস্কারের দিকটির আলোচনায় অধ্যাপক লেসনির আগ্রহ দেখা যায়। তিনি দয়ানন্দ সরস্বতী, রামকৃষ্ণদেব, রামকৃষ্ণের কালী-অর্চনা, বিবেকানন্দ ও তাঁর শিকাগো-বক্তৃতার কথাও উল্লেখ করেছেন। ঈষৎ বিস্ময়কর যে, বিদ্যাসাগরের সমাজ-সংস্কারের প্রসঙ্গ নেই তাঁর লেখায়। বাংলার হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক নিয়েও কিছু মন্তব্য আছে—তা ইতিবাচক।
বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতির কথা বলতে গিয়ে লেখক কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে চৈতন্যদেব এবং বৈষ্ণবীয় গীতিকবিতার উল্লেখ করেছেন। যাত্রা নিয়ে সুপরিসর আলোচনা আছে। উনিশ শতকের ইংরেজি শিক্ষার প্রসার, ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ, উইলিয়ম কেরির লিখন-চর্চার কথা বলেছেন। এইখানে বাংলা গদ্যের প্রথম সার্থক শিল্পী বলে লেসনি সম্মান জানিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখারও সশ্রদ্ধ উল্লেখ আছে। অধ্যায়ের শেষে কয়েক ছত্রে রবীন্দ্রপ্রসঙ্গের সূত্রপাত ঘটিয়েছেন লেসনি। তিনি বলেছেন যে, চিত্তলোকে এবং লেখায় ইউরোপীয় চিন্তনধারার মিশ্রণকে রবীন্দ্রনাথ এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেননি।
গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায়ের নাম ‘ইয়ুথ’ বা তরুণ বয়স। এই অধ্যায়ের উপাদান প্রধানত সংগৃহীত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি’ থেকে। সেই ছেলেবেলা, ভৃত্যদের শাসন, প্রাসাদোপম বাড়িটির বিভিন্ন কোন, সিঁড়ি এবং অন্ধকার বারান্দা ইত্যাদি বর্ণিত। বাল্যের বিদ্যালয়, স্কুল ছেড়ে বাড়ির বিদ্যাভ্যাস, নববধূ কাদম্বরীর আগমন, উপনয়ন ও গায়ত্রীমন্ত্র, কবিতা লেখার সূত্রপাত ইত্যাদির পর পিতার সঙ্গে হিমালয় ভ্রমণের প্রসঙ্গটি যথোচিত গুরুত্বের সঙ্গে বিবৃত।
এই ‘ইয়ুথ’ অধ্যায়টি শেষ হয়েছে ১৮৮৫-তে—কাদম্বরীর মৃত্যুর ঘটনার উল্লেখে। মধ্যবর্তী পর্বে খুব সংক্ষেপে রবীন্দ্রনাথের ইউরোপ-ভ্রমণের বিবরণ দিয়েছেন লেখক।
অধ্যাপক লেসনির লিখন-প্রক্রিয়ায় রবীন্দ্রনাথের জীবনের ঘটনাবলির চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যসৃষ্টির উপর। প্রতি মুহূর্তেই লেসনি আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি লিখছেন একজন অ–সাধারণ ভাষা–শিল্পীর জীবনকথা। তাই রবীন্দ্রনাথের তরুণ বয়সের লেখা কবিতাবলি এবং সেই সূত্রে বিহারীলাল চক্রবর্তীর প্রসঙ্গ এসেছে। ‘সন্ধ্যাসঙ্গীত’, ‘প্রভাতসঙ্গীত’, ‘ভানুসিংহের পদাবলী’র আলোচনা আছে। রোমান্টিক কল্পনার দিক থেকে আছে শেলির সঙ্গে সাদৃশ্যের প্রসঙ্গ। অধ্যাপক লেসনি রবীন্দ্রকবিতার ছন্দের কারিগরিও কিছুটা ব্যাখ্যা করবার চেষ্টা করেছেন।
এই পর্বের রবীন্দ্ররচনাগুলি অধ্যাপক লেসনি যথেষ্ট মনোযোগ সহকারে পাঠ করেছিলেন। ‘ভগ্নহৃদয়’, ‘বাল্মিকী প্রতিভা’, ‘কালমৃগয়া’ প্রভৃতি গীতিনাট্যগুলি উল্লেখিত হয়েছে। সুন্দরভাবে অধ্যাপক লেসনি বর্ণনা করেছেন তরুণ রবীন্দ্রনাথকে বঙ্কিমচন্দ্রের স্নেহমিশ্রিত সম্মানদানের ঘটনা। রবীন্দ্রনাথের প্রথম পর্বের গদ্য-লিখনগুলির সংক্ষিপ্ত উল্লেখ শেষে ‘বউঠাকুরানীর হাট’ উপন্যাসটির দীর্ঘ আলোচনা করেছেন লেসনি। বোঝা যায়, উপন্যাসটি তাঁর খুবই ভালো লেগেছিল।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীতচর্চার সংক্ষিপ্ত উল্লেখ আছে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রসঙ্গ থাকলেও রবীন্দ্রনাথের তরুণ-চিত্তের পরিণতি বিধানে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের যথার্থ ভূমিকাটি উঠে আসেনি। তবে ‘বালক’ পত্রিকার গুরুত্ব বুঝিয়ে দিয়েছেন লেখক। যদিও নেই জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর নাম—উল্লেখ আছে ‘সিস্টার–ইন–ল’ অভিধায়। খুব সংক্ষেপে আছে রবীন্দ্রনাথের বিবাহ প্রসঙ্গ। যেহেতু ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে এসে এই অধ্যায়টি সমাপ্ত হয়েছে, অধ্যাপক লেসনি ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার ইতিবৃত্তও একটু ছুঁয়ে গেছেন।
তৃতীয় অধ্যায় ‘ম্যাচিওরিটি’ বা ‘পরিণতি পর্ব’ ১৮৮৫ থেকে শুরু করে ১৯০১-এ এসে শেষ হয়েছে। এই অধ্যায়ের প্রায় সবটুকুই এই পর্বে রচিত রবীন্দ্রসাহিত্য বিশ্লেষণে নিবেদিত। ‘নিবেদিত’ শব্দটিই এখানে যথাযথ কারণ অধ্যাপক লেসনি রবীন্দ্রসাহিত্য সম্পর্কে যে বিশ্লেষণ এখানে করেছেন তা অত্যন্ত সশ্রদ্ধ। ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে’ কবিতাটির প্রসঙ্গ দিয়ে তিনি শুরু করেছেন তাঁর আলোচনা। তারপর তিনি চলে এসেছেন রবীন্দ্রনাথের গীতিনাট্য ও নাটকের বিবরণে। ‘মায়ার খেলা’র সংক্ষিপ্ত আলোচনা সেরে তিনি বিস্তৃতভাবে তুলে ধরেছেন ‘রাজা ও রাণী’ নাটকটি। অধ্যাপক লেসনি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নাটক, উপন্যাস, ও ছোটোগল্পগুলির আখ্যান অংশের ঘটনাগুলি বিবৃত করেছেন কারণ চেক্ ভাষাভাষী পাঠকেরা বাংলায় সেগুলি পড়বেন এমন সম্ভাবনা প্রায় নেই। ইংরেজিতেও তাঁরা খুব স্বচ্ছন্দ নন। রবীন্দ্রসাহিত্যের আখ্যানবস্তু এবং ভাববস্তুকে এভাবেই তিনি তাঁর দেশের পাঠকদের গোচরে আনতে চেয়েছিলেন। সেজন্য ‘রাজা ও রাণী’ নাটকের গল্প এবং তারপর ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসের আখ্যানভাগও বিবৃত করেছেন লেসনি। তারপর ‘রাজর্ষি’ উপন্যাস থেকে গৃহীত ‘বিসর্জন’ নাটকের আলোচনায় তিনি চলে গেছেন। ‘বিসর্জন’ সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য—
ক্রমে তিনি ‘মানসী’র কবিতা এবং ‘য়ুরোপ যাত্রীর ডায়েরি’ সম্পর্কেও কিছু কথা বলেছেন।“Thus this Drama, which deals with the moral foundations of human actions, has an elevating conclusion: the idea conquers even though it is at the cost of a human life. This is undoubtedly one of the poet’s best plays.”
নাটক সম্পর্কেই অধ্যাপক লেসনি সমধিক আগ্রহী বলে মনে হয়। ‘চিত্রাঙ্গদা’ নিয়ে তাঁর মুগ্ধতা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে। দীর্ঘ কয়েক পৃষ্ঠা আলোচনা তিনি করেছেন এই গীতিনাট্য নিয়ে।
রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্প সম্পর্কেও লেসনিকে বিশেষ উৎসাহিত দেখা যায়। বাংলার গ্রামাঞ্চলের সজীব প্রাকৃতিক পরিবেশ, চরিত্রগুলির সমুজ্জ্বল চিত্রণ এবং মানুষের মনের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ—এই সবই তাঁর কাছে বিশেষভাবে আকর্ষক বলে মনে হয়েছিল। ‘ঘাটের কথা’, ‘নষ্টনীড়’, এবং ‘সুভা’; সেই সঙ্গে ‘মধ্যবর্তিনী’ গল্পের বিশ্লেষণ তিনি অত্যন্ত প্রশংসার সঙ্গে লিপিবদ্ধ করেছেন।
‘সোনার তরী’, ‘চিত্রা’, ‘চৈতালি’ - সংকলনগুলির কবিতা নিয়ে কিছু কথার পর লেসনি আবার উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছেন ‘বিদায় অভিশাপ’, ‘গান্ধারীর আবেদন’, ‘নরকবাস’, এবং ‘কর্ণকুন্তী সংবাদ’ নাট্যকবিতাগুলির বিবরণে। এই রচনাগুলি যে সাধারণ কবিতা নয়, আবার সাধারণ নাটকও নয়, সেই অভিনবত্বের দিকটি অধ্যাপক লেসনি যথার্থভাবেই উপলব্ধি করেছিলেন। আবার ‘মালিনী’ নাটকের মানবধর্মের আদর্শ এবং প্লটের ঘনত্ব, সেই সঙ্গে পরিণামী নাটকীয়তা সবই তাঁকে মুগ্ধ করেছিল।
‘সাহিত্য’ সম্পর্কে অধ্যাপক লেসনির অর্ন্তদৃষ্টি যে যথেষ্ট গভীর ছিল তা বোঝা যায় যখন তিনি রবীন্দ্রনাথের অভিনব ধরনের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ নিয়ে যথাযথ মন্তব্য করেছেন। বইটি হল ‘পঞ্চভূতের ডায়েরি’। পঞ্চভূত এবং পঞ্চভূতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চরিত্রগুলিকে তিনি চমৎকার ব্যাখ্যা করেছেন। এবং যথার্থভাবেই মন্তব্য করেছেন যে, এই বইটি হল— “Very remarkable criticism of Indian life.”
‘কণিকা’র ছোটো ছোটো কবিতাগুলির সৌন্দর্য তুলে ধরবার পর অধ্যাপক লেসনি এসেছেন ‘ক্ষণিকা’র কবিতাগুলির প্রসঙ্গে। এই কবিতাগুলির সুরের সঙ্গে সহজ কথা চলিত ভাষার মিশ্রণ অপরিহার্য ছিল – এই সত্যটি তিনি যেভাবে অনুভব করেছিলেন তা সেই সময়ে অনেকেই ঠিক মতো ধরতে পারেননি। ‘কল্পনা’ সংকলনটির সম্পর্কে কিছু আলোচনার পর এই অধ্যায়টি সমাপ্ত করেছেন অধ্যাপক লেসনি।
সেই সময় অনেকেরই, বাঙালি আলোচকদেরও অভ্যাস ছিল রবীন্দ্রসাহিত্য আলোচনা-প্রসঙ্গে পাশ্চাত্য সাহিত্যকদের তুলনা টেনে নিয়ে আসা। কিন্তু লেসনি সে ধরনের চেষ্টা বিশেষ করেননি। রোমান্টিকতা বিষয়ে বলতে গিয়ে আগে একবার শেলির নাম ছাড়া আর একবার মাত্র রবীন্দ্রনাথের গল্পের প্রসঙ্গে তিনি কিপলিং-এর কথা বলেছেন। আর একবার বলেছেন যে--দান্তের কাছে যেমন ছিলেন ভার্জিল, রবীন্দ্রনাথের কাছে তেমনই ছিলেন কালিদাস।
চতুর্থ অধ্যায়ের নাম ‘উচ্চভাবনামূলক বিষয়’—‘লফ্টিয়ার থিম্স’। এই অধ্যায়ের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ‘কথা ও কাহিনী’ থেকে ‘ডাকঘর’ পর্যন্ত রচনাবলী। রবীন্দ্রনাথের জীবনের কোনো কোনো ঘটনাও স্থান পেয়েছে। যেমন মৃণালিনী দেবীর মৃত্যু। এই পর্বের কবিতায় ভগবদ্ভক্তির দিকটি যেমন লেসনি দেখিয়েছেন তেমনই তাঁর উপন্যাসে সমাজচিত্র যেভাবে ফুটে উঠেছে সে সম্পর্কেও তাঁকে ইতিবাচক আলোচনা করতে দেখা যায়। এখানে একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল ‘চোখের বালি’র চেয়ে ‘নৌকাডুবি’ উপন্যাসটিকে অধ্যাপক লেসনি অধিকতর সুসংগঠিত (more firmly constructed) বলে মনে করেছেন। তাঁর মতে, ভাবনার দিক থেকেও ‘নৌকাডুবি’, ‘চোখের বালি’র চেয়ে ভালো। মনে হয়, পাশ্চাত্য দেশে বিধবা নারীর জীবনের বঞ্চনার দিকটি সেভাবে বড়ো হয়ে ওঠে না বলে বিনোদিনী চরিত্রের প্রাণধর্ম তিনি ঠিকমতো অনুভব করতে পারেননি। তুলনায় রমেশের দায়িত্ববোধ, কমলার স্বামীনিষ্ঠা এবং হেমনলিনীর প্রেম তাঁর কাছে উচ্চতর নৈতিকতার (ethical) দৃষ্টান্ত বলে মনে হয়েছিল।
এই অধ্যায়ে লেসনির প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা বেড়ে যায়, যখন আমরা দেখি রবীন্দ্রনাথের শব্দতত্ত্ব বইটি সম্পর্কে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করেছেন তিনি। বাংলা ভাষার খুঁটিনাটি নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা তাঁকে মুগ্ধ করেছিল, কারণ নিজে বাংলা শিখতে গিয়ে তিনি অনেক প্রশ্নেরই মুখোমুখি হয়েছিলেন। রবীন্দ্রসাহিত্যের আলোচনা করতে গিয়ে অনেকেই ‘শব্দতত্ত্ব’ বইটির কথা বিস্মৃত হন।
ঋতুনাট্য ‘শারদোৎসব’; ‘রাজা’, ‘গীতাঞ্জলি’, ‘গোরা’—প্রতিটির সম্পর্কেই তিনি আলোচনা করেছেন। তবে ‘গোরা’ উপন্যাসটিকে সেই সময়ের একজন ভারতীয় বাঙালি যেভাবে অনুভব করতে পারেন সেভাবে অনুভব করা স্বাভাবিকভাবেই তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। ‘গীতাঞ্জলি’র উচ্চ প্রশংসা করলেও খুব নতুন কথা তিনি বলেননি। কেবল এই ক্ষেত্রেই রবীন্দ্রনাথের ভক্তিভাবনার সঙ্গে তিনি দুজন চেক ভাষাভাষী কবির উল্লেখ করেছেন যাঁরা আধ্যাত্মিক কবিতার রচয়িতা। ‘ডাকঘর’ নাটকটির প্রসঙ্গ দিয়েই শেষ হয়েছে এই অধ্যায়। ‘গীতাঞ্জলি’ প্রসঙ্গে তিনি উল্লখে করেছেন একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধে যাবার পথে চেক সৈনিকেরা অনেকেই ‘গীতাঞ্জলি’র কবিতা নিতেন সঙ্গে। আমাদের মনে পড়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত কবি উইলফ্রেড আওয়েন-এর পকেটে পাওয়া গিয়েছিল ‘গীতাঞ্জলি’র একটি গান—
‘যাবার আগে এই কথাটি বলে যেন যাই - যা দেখেছি যা পেয়েছি তুলনা তার নাই।’সাহিত্য-আলোচনার পাশাপাশি লেসনি অবশ্য ভোলেননি যে, এই পর্বেই বঙ্গভঙ্গ–প্রতিরোধ আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের যোগদান এবং সেই সূত্রে তাঁর রাজনৈতিক চিন্তা এবং স্বাদেশিকতা–বোধের গভীরতার দিকটি। রবীন্দ্রনাথের স্বদেশপ্রেমের গানগুলির তিনি বিশেষ প্রশংসা করেছেন।
পঞ্চম অধ্যায়ের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি হল রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি। অধ্যায়টির নাম – ‘খ্যাতি এবং বিশ্ব-পরিচিতি’। অধ্যাপক লেসনি ‘গীতাঞ্জলি’র অনুবাদ এবং অনুদিত ‘গীতাঞ্জলি’র কবিতাগুলি সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলেছেন এবং কীভাবে রথেনস্টাইন, ইয়েটস্ এবং স্টার্জ মুর-এর সহায়তায় ‘গীতাঞ্জলি’ সংকলনটি নোবেল-সম্মান অর্জন করল সে-বিষয়ে অতি সংক্ষিপ্ত দুটি পৃষ্ঠা লিখেছেন। অধ্যাপক লেসনির রবীন্দ্রজীবনী রচনার ধরনটি সম্পর্কে আমরা এতক্ষণে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। তিনি রবীন্দ্রনাথের জীবনের তথ্য সম্পর্কে খুব বেশি আগ্রহ দেখাননি। যেটুকু না দিলে নয় সেটুকুই ব্যক্ত করেছেন সংক্ষেপে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের রচনার বিস্তৃত বিবরণ তিনি দিয়েছেন। এই অধ্যায়ে দেখতে পাই ‘চতুরঙ্গ’ এবং ‘ঘরে বাইরে’ নিয়ে অনেকটাই আলোচনা করেছেন তিনি। তুলনামূলকভাবে কবিতার চেয়ে নাটক এবং উপন্যাসের আলোচনাতেই তাঁকে বেশি উৎসাহী দেখা যায়। অধ্যাপক লেসনি ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথকে নাইটহুড সম্মান দেবার প্রসঙ্গটি দু–তিন লাইনে জানিয়ে দিয়েছেন। সেই তুলনায় এই অধ্যায়ে শিক্ষক রবীন্দ্রনাথের পরিচয় উঠে এসেছে অনেকটাই বেশি।
আমাদের মনে রাখতে হবে লেসনির বইটির নামে ‘বায়োগ্রাফি’ বা ‘লাইফ’ শব্দগুলি নেই। তার পরিবর্তে আছে ‘পার্সোনালিটি’ এবং ‘ওয়ার্ক’ শব্দদুটি। রবীন্দ্রজীবনের তথ্য নয় রবীন্দ্রব্যক্তিত্বের স্বরূপ তুলে ধরাই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল। সেই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকেও তিনি অনেকটাই বিস্তৃতভাবে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন।
এই গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের নোবেল-সম্মানের প্রসঙ্গে অধ্যাপক লেসনি ব্যয় করেছেন মাত্র দেড় পৃষ্ঠা; রবীন্দ্রনাথের স্যার উপাধি প্রাপ্তির ঘটনাটি বলবার জন্য নিয়েছেন মাত্র চারটি ছত্র। কিন্তু জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় রবীন্দ্রনাথের উপাধি ত্যাগের ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন প্রায় পাঁচ পৃষ্ঠা জুড়ে। এ-বিষয়ে তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড চেম্স্ফোর্ডকে যে-চিঠি রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন সেটি সম্পূর্ণ উদ্ধৃত হয়েছে এই গ্রন্থে। যদি অধ্যাপক লেসনি চেক না হয়ে ব্রিটিশ হতেন তাহলে সম্ভবত এতটা লিখতেন না।
এই অধ্যায়ে রবীন্দ্রনাথের জাপান ভ্রমণের প্রসঙ্গ আছে। ‘লিপিকা’র রচনাগুলি সম্পর্কে কিছু আলোচনা আছে। সেই সঙ্গে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ–আইনস্টাইন সাক্ষাৎকার এবং ‘মানুষের ধর্ম’ প্রসঙ্গেও তিনি কিছু কথা বলেছেন। যদিও এই অধ্যায়টির কাল পরিসরের ব্যাপ্তি ১৯২০ পর্যন্ত। ‘লিপিকা’র প্রকাশকাল ১৯২২। কিন্তু ‘লিপিকা’র কিছু কিছু লেখা প্রকাশিত হয়েছিল আগেই। আইনস্টাইন-এর সঙ্গে সাক্ষাৎকার দশ বছর পরের ঘটনা হলেও এই প্রসঙ্গটি তিনি এখানেই নিয়ে এসেছেন এবং পরে আর বিষয়টিকে তোলেননি।
ষষ্ঠ অধ্যায়টির নাম ‘অস্থিরতা’ (Restlessness)। নামের সঙ্গেই উল্লিখিত আছে ‘দি আইডিয়া অব্ বিশ্বভারতী’ বাক্যটি। শান্তিনিকেতনের আশ্রমকে এবং শান্তিনিকেতনের বিদ্যায়তনটিকে বিশ্বভারতীর ব্যাপ্তি দেবার আকাঙ্ক্ষা এই সময়েই রবীন্দ্রনাথের মনকে চঞ্চল করে তুলেছিল—এমনই লিখেছেন অধ্যাপক লেসনি। বিশ্বভারতীর ভাবাদর্শ প্রসঙ্গে মোটামুটি বিস্তৃতভাবেই তিনি আলোচনা করেছেন। অত:পর সাহিত্যের আলোচনায় প্রবেশ করে তিনি তাঁর মুগ্ধতা ব্যক্ত করেছেন আবার। এইপর্বে ‘মুক্তধারা’ এবং ঋতুকেন্দ্রিক নাটক ও গীতিনাট্যগুলি তাঁর মন হরণ করেছিল। ‘শারদোৎসব’, ‘বর্ষামঙ্গল’, ‘ফাল্গুনী’, ‘শেষ বর্ষণ’ এবং ‘নটরাজ’ তাঁর আলোচনায় অনেকখানি জায়গা জুড়েছে। ‘রক্তকরবী’ প্রসঙ্গও এসেছে কিন্তু লক্ষ করা যায় ‘রক্তকরবী’র প্রতীকত্ব ব্যাখ্যার তুলনায় প্রত্যক্ষ প্রকৃতিকেন্দ্রিক নাটক ও গীতিনাট্যগুলিকেই যেন তিনি বেশি পছন্দ করেছেন। ‘রক্তকরবী’ প্রসঙ্গে তিনি মেটারলিঙ্ক-এর নাম করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে যে ভ্রমণ করেছিলেন সে প্রসঙ্গ সংক্ষেপে সেরে ‘পূরবী’র কবিতাগুলি নিয়ে বেশ কিছুটা আলোচনা করেছেন অধ্যাপক লেসনি। পুনর্বার ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের ইউরোপ ভ্রমণের বিবরণ তিনি সংক্ষেপে দিয়েছেন। কিন্তু তার মধ্যেই একটু বেশি করে বিশ্লেষণ করেছেন রবীন্দ্রনাথের ইতালি ভ্রমণ এবং মুসোলিনির সঙ্গে সাক্ষাতের ঘটনাটি। স্পষ্টভাবেই তিনি বলেছেন—রবীন্দ্রনাথ শেষপর্যন্ত বুঝেছিলেন যে তাঁর পক্ষে এটা ছিল ‘বিপজ্জনক ফাঁদ’ (dangerous trap)। কিন্তু অভ্যাসমতোই অধ্যাপক লেসনি চলে এসেছেন তাঁর প্রিয় উপন্যাসের প্রাঙ্গণে। ‘শেষের কবিতা’ নিয়ে আছে প্রশস্ত আলোচনা, এমনকী উদ্ধৃতিও। তারপরেই ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসটি নিয়ে কিছুটা আলোচনা করেছেন তিনি।
এই পর্বে রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিদেশভ্রমণ প্রসঙ্গে তিনি কিছু মন্তব্য করেছেন। ‘মানুষের ধর্ম’ নিয়েও কিছু কথা আছে কিন্তু একইরকম গুরুত্ব দিয়ে রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি - পরিবেশ – ভাবনা এবং ‘বনবাণী’ সংকলনটিকে তুলে ধরেছেন তিনি। খুব সংক্ষেপে হলেও এই অধ্যায়ে শান্তিনিকেতনের সংগীতচর্চা এবং চিত্রকলাচর্চা সম্পর্কে কিছু কথা বলেছেন অধ্যাপক লেসনি।
বইটির শেষ পরিচ্ছেদের নাম ‘জীবনের হেমন্তবেলা’। এই অধ্যায়ে দ্রুত এই পর্বের কয়েকটি লেখা সম্পর্কে মন্তব্য করে গেছেন লেখক। ‘পুনশ্চ’ প্রসঙ্গে গদ্যছন্দের কথা বলেছেন। ‘তাসের দেশ’ নাটকটিকে ব্যাখ্যা করেছেন অতি সংক্ষেপে। কিন্তু ‘দুই বোন’ এবং ‘মালঞ্চ’ উপন্যাস দুটি সম্পর্কে এখানেও তাঁকে যথেষ্ট সপ্রশংস দেখা যায়। ‘চার অধ্যায়’ উপন্যাসটি অবশ্য তাঁকে তেমন আকর্ষণ করেনি। অন্য অধ্যায়গুলির তুলনায় ১৯৩১ থেকে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি তিনি এখানে একটু বেশি বিশ্লেষণ করেছেন। বিশেষ করে গান্ধীজি এবং রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক ব্যাখ্যায় তাঁকে আগ্রহী দেখা যায়। এই সপ্তম অধ্যায়ে যেন খানিকটা তাড়াহুড়ো করে অনেক কথা বলতে চেষ্টা করেছেন অধ্যাপক লেসনি। ‘শেষসপ্তক’ এবং ‘পত্রপুট’ কবিতা-সংকলনের কথা যেমন বলেছেন তেমনই ‘সে’ বইটি সম্পর্কেও দিতে চেয়েছেন নিজের ব্যাখ্যা। কিন্তু মাত্র কয়েকটি ছত্রে ‘সে’ রচনাটির বৈশিষ্ট্য ঠিকমতো বোঝানো যায়নি। এই শেষ অধ্যায়ে অধ্যাপক লেসনি খানিকটা হঠাৎ করেই পরিসমাপ্তি টেনেছেন কেবল এইটুকু বলে যে, রবীন্দ্রনাথ এই সময়ে সাম্রাজ্যবাদ এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে মানবতাবাদের স্বরকে ভাষা দিয়েছিলেন তাঁর রচনায়।
গ্রন্থের উপসংহার বা শেষ সিদ্ধান্ত রূপে যে দুটি পৃষ্ঠা সংযোজন করেছেন অধ্যাপক লেসনি সেখানে থেকে বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকটি ছত্র উদ্ধৃত করতে চাই। এখান থেকে বোঝা যাবে ১৯৩৭-এ যখন তিনি লেখাটি শেষ করছেন তখন রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তাঁর সামগ্রিক ধারণা কেমন ছিল—
১. “He has enriched Bengali Literature immeasurably indeed, it is he who first raised it to its present high rank. ” —বাংলা সাহিত্যকে যেভাবে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন, প্রকৃতপক্ষেই, তার পরিমাপ করা যায় না। তিনিই প্রথম বাংলা সাহিত্যকে বর্তমান উচ্চতায় তুলে দিয়েছেন। ২. “Tagore has in truth been a revealer of new paths and a teacher of men.” — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সত্যসত্যই খুলে দিয়েছেন নতুন পথ এবং তিনি মানুষের শিক্ষক। ৩. “From insight into the beauty of nature he arrived at a feeling of confidence in the destiny of mankind, from a conviction of the nobility of man’s mission in the world he derives a wise philosophy, which culminates in his unhesitatingly positive attitude towards life and in his later conception of the divine nature of mankind.” — প্রকৃতির সৌন্দর্য সম্পর্কে গভীর অন্তর্দৃষ্টি থেকে তিনি মানবজাতির ভবিতব্য সম্পর্কে এক আত্মবিশ্বাসী উপলব্ধিতে উপনীত হয়েছেন, বিশ্বজগতে মানুষের কর্তব্যের মহত্ত্ব সম্পর্কে দৃঢ় বিশ্বাস থেকে নিষ্কাশন করে নিয়েছেন এক প্রাজ্ঞদর্শন, যা শিখরীভূত হয়েছে জীবনের প্রতি দ্বিধাহীন ইতিবাচক মানসিকতায় এবং মানুষের দিব্য স্বভাব সম্পর্কে তাঁর পরবর্তী ধারণায়।লেসনি লিখেছেন যে, রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতই এক আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব এবং প্রাচ্য ও প্রতীচ্যকে যেভাবে তিনি কাছাকাছি এনেছেন তা আর কোনো ভারতীয় পারেননি।
এ-ছাড়াও লেসনি লিখেছেন—কোনদিক থেকে ভারত রবীন্দ্রনাথের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে তা নির্ধারণ করা সহজ নয়। অসামান্য ভাষা-শিল্পের স্রষ্টা, অথবা সমুজ্জ্বল মানবতা এবং বৈশ্বিক ঐক্যের প্রবক্তা—দুদিক থেকেই তিনি গভীরভাবে গ্রহণযোগ্য।
আজ আমাদের মনে হয় —এই দুই–এর মধ্যে কোনো বিভাজনরেখা টেনে রাখা অনুচিত। সেই সঙ্গে এ–ও মনে হয়, মানবতা ও বিশ্ব-ঐক্য তথা বিশ্বশান্তি বিষয়ে যেসব বাণী তিনি তাঁর গদ্যভাষণে বিতরণ করেছেন তার চেয়ে ভাষা-শিল্পী রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতা, গান, নাটক, কথাসাহিত্য এবং চিত্রকলায় সেই একই অনুভব ও উপলব্ধিকে যেভাবে রূপবান করে তুলেছেন তারই অভিঘাত হবে বেশি। উপদেশ শুনিয়ে মানবজাতিকে মহত্ত্বের দিকে চালিত করা যায় না। তার প্রমাণ আজকের তথাকথিত সভ্যতায় দৃষ্ট হয় সর্বত্র। লেসনি এইসব কথা লেখার পরের বছরেই শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। মহৎ শিল্পের এবং মহৎ আবিষ্কারের সংস্পর্শেই ব্যক্তিমানুষের মন ক্রমে নির্মল হয়। সেই সব ব্যক্তিই মানবজাতির সান্ত্বনা এবং শুদ্ধতার পথে যাত্রার সংগ্রামের অগ্রদূত।
লেসনির এই বই কিন্তু ভালো লাগেনি রবীন্দ্রনাথের। এ-বিষয়ে ইংরেজি অনুবাদটি প্রকাশিত হবার পরেই তিনি শান্তিনিকেতন থেকে সি. এফ. অ্যান্ড্রুজ-কে একটি চিঠি লিখেছিলেন। কৃষ্ণা দত্ত এবং অ্যান্ড্রু রবিনসন সংকলিত ‘সিলেক্টেড লেটার্স (১৯৯৭)’ এ এই পত্রটি সংকলিত হয়েছে যার বাংলা অনুবাদ করেছেন সমীর সেনগুপ্ত—
“শান্তিনিকেতন ৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৮
প্রিয় চার্লি, আমার সম্বন্ধে লেখা লেস্নির বইটি ভালো হয়নি — বইটা ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে ইংলন্ড থেকে প্রকাশিত না হলেই ভালো হত। বইটা ভুলে ভর্তি—সেটা নাহয় ছেড়েই দিলাম, কিন্তু আমার রচনার সংক্ষিপ্তসার বলে যেটা দিয়েছে সেটা খুবই অসম্পূর্ণ, আর এটায় আমার লেখার মূল্য যেন সস্তা হয়ে গেছে। ...”
(‘রবীন্দ্রসূত্রে বিদেশিরা’, সাহিত্য সংসদ, ২০১১, পৃ. ৮৭৯)
রবীন্দ্রনাথ অবশ্য নিজের কোনো জীবনীকেই উৎকৃষ্ট বলে মনে করতেন না। এই বইটির আগে তাঁকে নিয়ে যে সব বিদেশি জীবনীগ্রন্থ লিখেছেন তার কোনোটির প্রতি কোনো শংসাবাক্য উচ্চারণ করেননি তিনি। লেসনির বইটি কোথায় ‘ভুলে ভর্তি’ তা আমরা খুঁজে পাইনি। লেসনির আলোচনায় তাঁর লেখার মূল্য কোথায় ‘সস্তা’ হয়েছে তাও নির্ণয় করা দুরূহ। অন্তত আমাদের তা মনে হয়নি। রবীন্দ্রনাথের লেখাকে অধ্যাপক লেসনি খুবই মূল্য দিয়েছেন বলে মনে হয়েছে। তবে নিজের অপছন্দের কথা তিনি লেসনিকে জানাতেও যাননি। পূর্বোক্ত পত্রটির পাঁচ সপ্তাহ পরেই লেস্নিকে তিনি একটি চিঠি লিখেছিলেন। সেই চিঠিতে চেকোশ্লোভাকিয়ার রাজনৈতিক সংকট সম্পর্কে তাঁর দুর্ভাবনা এবং চেকোশ্লোভাকিয়ার অধিবাসীদের প্রতি তাঁর সমবেদনাই প্রকাশ পেয়েছে।
গ্রন্থটির প্রাক্কথনে সি. এফ. অ্যান্ড্রুজ অবশ্যই লেসনি রচিত এই জীবনীগ্রন্থের যথেষ্ট প্রশংসা করেছেন। অ্যান্ড্রুজ-এর লেখাটি পরিমিত এবং সুচিন্তিত। অযথা উচ্ছ্বাস প্রকাশ না করে অ্যান্ড্রুজ সমস্ত রচনাটির যথোপযুক্ত চালচিত্র আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। প্রথমে তিনি অধ্যাপক লেসনির পাণ্ডিত্যের পরিচয় দিয়েছেন; তারপরে জানিয়েছেন কীভাবে লেসনি শান্তিনিকেতনে এলেন এবং অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে দ্রুত শিখে নিলেন বাংলা ভাষা। অ্যান্ড্রুজ খুব স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে, যদি লেসনি বাংলা না শিখতেন, রবীন্দ্রনাথের লেখাগুলি মূল বাংলায় না পড়তেন, তাহলে রবীন্দ্রনাথের মানসিকতার দিকটি ধরতে পারতেন না। শান্তিনিকেতনের আশ্রমে বসবাস করবার ফলেও তাঁর পক্ষে রবীন্দ্রনাথের জীবন ও ভাবনাকে বুঝে নেওয়া সহজ হয়েছিল। অ্যান্ড্রুজ বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন লেসনির রবীন্দ্র-অনুরাগের কথা। সেই সঙ্গে বইটি যে যথেষ্ট পরিমাণে তথ্যনিষ্ঠ এবং বিশ্লেষাত্মক—সে-কথাও বলেছেন অ্যান্ড্রুজ। এখানে আমরা উদ্ধৃত করে দিচ্ছি অ্যান্ড্রুজ-এর নিজের ভাষা এবং ভাষ্য—
“His deep devotion to Tagore is evident in every page, and this volume forms a remarkable tribute of affection from a writer of another race and another country; for he has written not only with his mind, but with his heart. Enthusiasm for his subject is evident, and yet the book is no less objective and critical on that account.”
এই অংশটির বঙ্গানুবাদ দিয়ে আমরা এই নিবন্ধ শেষ করব: —
“প্রতিটি পৃষ্ঠাতেই রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর সুগভীর ভক্তি প্রকাশিত, সে-জন্য এই গ্রন্থটি একজন বিদেশি এবং ভিন্ন জাতি-সম্প্রদায়ের লেখকের উল্লেখযোগ্য প্রীতি ও ভালোবাসার অর্ঘ্য হয়ে ওঠে; তিনি কেবল তাঁর মন দিয়েই লেখেননি, লিখেছেন তাঁর হৃদয় দিয়ে। বিষয়টির প্রতি তাঁর আগ্রহ স্বপ্রকাশ, তা সত্ত্বেও বইটি কম তথ্যনিষ্ঠ নয় এবং ভক্তি থাকলেও বইটি কম বিশ্লেষণাত্মকও নয়”।
(অনুবাদ লেখকের)
অধ্যাপক ভিনসেন্স লেসনির এই রবীন্দ্র জীবনীগ্রন্থ চেকোশ্লোভাকিয়ার এক বিশিষ্ট এবং বিদগ্ধ, সুপণ্ডিত অধ্যাপকের রবীন্দ্রনুরাগের পরিচয় তুলে ধরে। রবীন্দ্রনাথের বৈশ্বিক সংযোগ এবং তাঁর আন্তর্জাতিক পরিচিতির দিকটিও সপ্রমাণ করে। রবীন্দ্রনাথ নামক মানুষটির ব্যক্তিত্বের ব্যাপ্তি আমরা নতুন করে অনুভব করি।
অধ্যাপক ভি. লেসনির বইটি আন্তর্জালে পাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের গবেষক তন্ময় সিংহমহাপাত্র এই দুষ্পাপ্র্য বইটি দেখার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তাঁকে ধন্যবাদ জানাই।