১.১. ছবি, সে কি স্বপ্ন, সত্য না প্রতিফল-মাত্র? ছবি কি উদ্দেশ্য ও উদ্দিষ্টের ছায়া-মাত্র - যার অবস্থান, দৈর্ঘ্য ও বহিরাকার নির্ভর করছে আলোর স্রোতের নিরিখে? সে কোথায়, কতটা, কোন দিকে ঘনাতে পারল তার উপর? যখন নিষ্প্রাণ নির্বিকার বিচরণভূমি নিজেই একজন ছায়াকার - "হাসি মুখ সেজে ... স্ফটিক সে নির্বিকার"[১] তখন সেই ছায়াটির কিছুমাত্র যায় না খোওয়া; বাঁচিয়ে-সরিয়ে কিছু হয় না রাখা রোমন্থনের নিরিখে, সবটাই দেওয়া হয় ফিরিয়ে। কত রূপ রঙ্গ রস হয় অঙ্কিত আকাশের নির্বিকার পটে ও দিনশেষে কালভেদে হারিয়েও যায় তারা, মোছা হয়ে যায় সব শেলেটে; ইতিমধ্যে নিয়ম মাফিক সূর্য ওঠে সূর্য ডোবে, স্বনিয়মে চলে চাঁদ - কৌতুক, কৌশল সব থাকে বাদ। ফলত বিধেয়-বাক্যে শুধু থেকে যায় শূন্যতা; ছায়ার ছায়াগুলি, ছায়াদের ফিরে না আসার হাহাকার।
১.২. একাকী ও দিশাহীন উদ্দেশ্যখানি এমনই একটি শুক্ল সন্ধ্যাবেলায় স্থির করে, আরশি'র সাথে ছায়া-ছায়া খেলা হবে ভাল। আরশিকে রেখে সাক্ষী সে দিল নিজের ছায়াখানি কবিকে, নিজেকে সরিয়ে নিল শেষে। মনে হল, অধরা থেকে গিয়ে খেলা হল বোধ করি শেষ নায়িকার। বসন্তের গীতিরঙে উন্মত্ত নিমিষ দিল মনকে বিক্ষিপ্ত ক'রে, ক'রে আত্মভোলা। বিধেয় করেছে ঠিক ছায়া নেবে "খেলা-ছলে" "হেলাভরে হেসে" - ভেবেছিল কখনও পরে তারও এক ছায়া এঁকে ফিরিয়ে দেবে বুঝি "তোমারি উদ্দেশে"। কিন্তু হল বিপরীত; উদ্দেশ্যের সেই ছায়া প্রথমে ভিতরে এসে হল প্রতিধ্বনি, পেল প্রাণ অফুরান শুধু গানে গানে, নিজেকে দিল সে ধরা কবির ভুবনে।(জুবানে???) তাহলে দেখা যায় এ-গান তো সেই গীত নয় যার সুরলয়তালে রয়েছে মাত্র হাত উদ্দেশ্যেরই; এই গান, বস্তুতঃ "তোমার সে দান। / যদিবা দেখিতে তারে / পারিতে না চিনিবারে ... / আমার পরাণ পেয়ে / সে আজি তোমারো চেয়ে / বহুগুণে বেশি"।[২]
১.৩. তবে ছায়া তুমি কার? যে তাকে দিয়েছে সুরের মহিমা? যে তোমার খেয়াল দিল ক'রে ত্যাগ? যে ভুলেছে মর্ত্য, মেজে(??), শুক্ল সন্ধ্যাকাল, বসন্তের সৌরভ? যে ভুলেছে আকরণ, বাক্য-বিভেদ? এ কি সেই যে পাখীর গানে গানে নিজের বাণীকে করেছে প্রোথিত প্রতিভাষিত[৩] - প্রতিটি নিমেষে যে গেয়ে ওঠে অনিমেষ গান? চিহ্ন হতে চিহ্নহীন রাতের সাগরপারে তরঙ্গের গর্জনে সে শোনে বুঝি "নিঃশব্দের মন্ত্রস্বর"! নিজের অস্তিত্ব ও ছায়াকেও মুছে ফেলে করেছে স্মরণ তাকে, বরণ করেছে - "নিজেরে আড়াল করি' / বর্ণে গন্ধে ভরি' / প্রেমের দিয়েছে পরিচয় / ফুলেরে করিয়া বাণীময়।"[৪]
২.১. কেন এ আড়াল রয়ে যায় তবু মনে? কেন এ শঙ্কাবোধ -
"কেন এ কম্পিত প্রেম, অয়ি ভীরু, এনেছ সংসারে,
ব্যর্থ করি' রাখিবে কি তারে।"[৫]
নিজেকে আড়াল করে রাখে যক্ষরাজ। সুরঙ্গমা-সুরঞ্জনা খুঁজে মরে আমাকেই জানি। নিজেকে আড়াল করে গল্পচ্ছলে রাখে বৃহন্নলা। এ যেন নিজেকে দিয়েছে বাঁধা সংশয়ের বন্দীপত্রে তার, যার বাহিরের থেকে বাজে অন্তরের তীব্র পরাজয়। সে কি মাত্র এইজন্য যে ছায়াদের হতে নেই নিতে নেই নাম, কোনও গোত্র, পরিচয়? আর তাই -
"হায় সে যে পায় নাই আপন নিশ্চিত পরিচয়,
বন্দী তারে রেখেছে সংশয়"[৬]
এভাবেই "মুক্তিবন্ধনের সীমানায়" ('বিচিত্রিতা' পৃ. ৫৭) সংশয়ে সংশয়ে দিন যায় চলে।
২.২. তাহলে একে সে-ই যার আমি ছবি আঁকি মনে মনে? এ কি সেই "যে এখনো আসে নাই মোর পথে, / কখনো যে আসিবে না আমার জগতে, / তার ছবি আঁকিয়াছি মনে, -"[৭] কখনও মনে হয় এসব এমনই ছায়া যারা বহু আগে দুয়ারে ক'রে করাঘাত "চলে গেছে একেবারে, / ফাল্গুন মধ্যাহ্নবেলা শিরীষ ছায়ায় চুপি চুপি / তারা ছায়ারূপে / আসে যায় হিল্লোলিত শ্যাম দুর্ব্বাদলে"।[৮] অতীতে ফিরে গিয়ে নায়িকা দেখছেন সব দ্বার হয়ে গেছে "রুদ্ধ তোমার পশ্চাতে"[৯], যখন বসন্তের উৎসবের রাত্রিশেষে সব বাতি গেছে নিভে, সেতারের তার যখন মুখরতা ত্যাগ ক'রে নির্বাক নিশ্চিত চুপ - "শুষ্কমালা, ভস্মশেষ দগ্ধ গন্ধধূপ"। সামনের খোলা আকাশে, উদাস বর্ণহীন রাতে দিনে শুধু স্মৃতি শেষ, মত্ততার কলরব রুদ্ধ শেষ - শুধু "ভাষাহারা অশ্রুহারা অজ্ঞাত কাঁদন"।[১০] এ যেন বক্ষকপাটের বেড়ায় "আত্মদানের রুদ্ধবাণী"[১১] মরছে ঘুরে ঘুরে; মনে হচ্ছে ছায়াটিই বুঝি আসল মানুষ, মূল যে সে নয় ("আপনি যেন আর কেহ সে, এই লাগে তার মনে)[১২] - ফলে সে তার আপনার ভাষায় কথা বলাও ভুলে যায় আপন জনের সাথে। শুধুমাত্র ইসারার উপভাষা চলেছে বিধির সাথে, বিশ্বের সাথে চলেছে নীরব আলাপচারিতা।[১৩]
২.৩. বিধেয়ের সাথে উদ্দেশ্যের এই বার্তা, এই আলাপের পিছনে রয়েছে শুধু একগুচ্ছ সংশয়, দুর্ভাবনা। অবলুপ্ত উদ্দেশ্যপদ শুধু ক্রিয়াশীল, কেন কে বা জানে - "লুকানো নহো, তবু লুকানো থাকো"[১৪] বহুযুগে বহুবার হয়েছে দেখা, তবু "তোমারে আমি কখনো চিনিনাকো" - কারণ তোমার আবরণে থাকে ঢাকা সব বেদনাই, তোমার কথা বলে মৌন মুখ - যার অর্থ খুঁজে মরে কবি; আধেক হয় চেনা, রয়ে যায় আধেক অজানা:
"মৌন তব কী কথা বলে বুঝি,
অর্থ তারি বেড়াই মনে খুঁজি'।
চলিয়া যাও তখন মনে বাজে
চিনি না আমি, তোমারে চিনি না যে।।"[১৫]
২.৪. ভয়ে মরে বিধেয়া বধূটি - "নিভৃতে দর্পণে / দেখে আপনার মুখ।/ শুধায়ে(??শুধায়) সভয়ে / হবো কি মনের মতো, পাবো কি হৃদয়ে"[১৬]। স্থান কোনও সে-কথাই ভেবে থেকে "আগন্তুক অজানার ... উদ্দেশে নিজেরে সঁপে আগামিক??? প্রেমে" সে। এই আত্মবিসর্জনে মাঠ, রাঙা ধূলি, শীত, বাতাসের শ্বাস, শিহরণ - সবারই রয়েছে এক সম্মিলিত চক্রান্ত - অজানিতের হাতছানি:
"... শিহরণে ঘাসে,
কী কথা কহিল তোর কানে। ...
সৃষ্টির প্রথম স্মৃতি হোতে
সহসা আদিম স্পন্দ??? সঞ্চরিল তোর রক্তস্রোতে"।[১৭]
যখন জেগেছে প্রেম, শিহরণ লাভের জমানো কড়ি পড়ে থাকে পদতলে, "ভাবনা কোথায় চলে ধেয়ে"; "সাম্প্রতের??? আবরণ মন হ'তে" দ্রুত খসে "বিরাট কালের মাঝে ... ওঙ্কারধ্বনি"[১৮] ওঠে গুঞ্জরি। তখন শুধু চারিদিকে শব্দহীনতার স্বর'ই বাজে, গেয়ে চলে অনিদ্র কোকিল, যার "একরাতে আজ এই জীবনের শেষ কথাটি চাই"[১৯] - কারণ "বদ্ধ বাণীর অস্ফুটতার" রহস্য-ভেদ করা তার চাই। তাকে বলতে হবে প্রেমের কথা "সবার চেয়ে গভীর যাহা নিবিড় ভাষায় সেই কথাটি", যার রক্তরঙীন ছায়া থাকে ঘিরে "তোমার চারিপাশে / ইঙ্গিতে আভাসে / ... দোলা দিয়ে বিনা ভাষায় আলাপ করে কানে কানে, / নাই কোনো যার মানে"[২০] - এ যেন এক "যুগলছায়ার স্বপ্ন খেলা"। যদিচ ছায়া, প্রতিচ্ছবি মনে - তবু মনে হয়
"প্রাণের যে-প্রশান্ত পূর্ণতা, লভি তাই
যখন তোমার কাছে যাই,"[২১]
৩.১. আমার 'বিচিত্রিতা' পাঠের প্রয়াসের সঙ্গে এই বিরল কাব্যগ্রন্থটির নবতম সংস্করণের (জানুয়ারি ২০১১; বিশ্বভারতী-প্রতিক্ষণ প্রকাশন) ভূমিকার একটি সাবধানবাণীর সম্বন্ধ রয়েছে, যেখানে সম্পাদক শ্রী আশিস পাঠক মন্তব্য করছেন: "দেখা যাচ্ছে, অধিকাংশ কবিতা ১৯৩২-এর জানুয়ারি থেকে মার্চ-এর মধ্যে লেখা, একটি জুলাইয়ে। ..... অর্থাৎ বিচিত্রিতা-র অধিকাংশ কবিতা খুব কম সময়ের মধ্যে পরপর লেখা। তবু এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলির মধ্যে ভাবের কোনও সাক্ষ্য নেই।" (পৃ. জ) অবশ্য একই সঙ্গে তিনি বলছেন: "বিষয়ে একটি ঐক্য-প্রবণতা অবশ্য আছে, অধিকাংশ কবিতাই নারী-বিষয়ক"। (পৃ. ঐ) আবার ক'রে কাব্যগ্রন্থটি একাধিক বার আদ্যোপান্ত প'ড়ে আমার কিন্তু মনে হয়েছে - সূক্ষ্মভাবে হলেও - এই কবিতাগুলির মধ্যে কোথাও যেন একটা আন্তর্বয়ান বা ইন্টারটেক্সটুয়ালিটি রয়েছে। আর এই অর্বাচীন প্রতিক্রিয়ায় সেই বয়ানটিকেই ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার - এ হল সেই সময় যখন কবি রবীন্দ্রনাথ চিত্রশিল্পী রবীন্দ্রনাথ রূপেও বেশ জোরালো উপস্থিতি রেখেছেন আন্তর্জাতিক স্তরে এবং এই সময়ে পৌঁছতে পৌঁছতে অঁর রঙে ও তুলিতে বেশ কিছু প্রতিকৃতিও ভাবছায়া আমরা দেখতে পারছি।
৩.২. আশ্চর্যের কিছু নেই যে শিল্প-সর্জনে ও শিল্প-আন্দোলনের ভূমিকা নির্মাণে তখন উনি যে পরিমাণ সময় ব্যয় করেছেন যে ঠিক তখনই তাঁর ভিতরে ইচ্ছা জাগবে অন্য শিল্পীদের আঁকা চিত্র ও বিচিত্রের বিষয়ে উনি কিছু লিখিত ও ভাষিত প্রতিক্রিয়া রচনা করবেন। পরবর্তী সময়ে বিশেষ ক'রে ১৯৩৬-এ এসে দেখতে পারছি উনি যে শুধু নিজের শিল্প-ভাষা ও বিষয় নিয়েই কথা বলছেন তা নয়, উনি নিজেরই আঁকা মুখাবয়ব, অন্ধকার, প্রকৃতি ও বিভিন্ন জান্তব প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে কয়েক পংক্তি ক'রে ভাষায় (এবং তৎসঙ্গে ইংরাজি অনুবাদেও) অবিস্মরণীয় কিছু পংক্তিকে কাব্যধর্মে দীক্ষিত করে ছবির পাশাপাশি রাখছেন, বিশেষ ক'রে 'চিত্রলিপি/১' সংকলনে যার চূড়ান্ত প্রকাশে হয়তো আরও ক'বছর লেগে গেছে। মোদ্দা কথা হল, এ সেই সময় যখন মূর্ত ভাষা ও অমূর্ত ভাব তার সম্পর্ক কিংবা রঙ-রেখার প্রকাশভঙ্গী ও বাচনের প্রতিফলের মধ্যে দিয়ে কবি ও শিল্পী রবীন্দ্রনাথ বচন-বাচনের ভাষা এবং দর্শন-অঙ্কনের ভঙ্গীর একটা বিরল যুগলবন্দী রচনা করছেন। পরবর্তী কালে এক সময়ে শিল্পী রবীন্দ্রনাথ বলছেন ভাষার প্রতি অবিশ্বাসের কথা; বলছেন যা শব্দবর্ণের মধ্যে দিয়ে বলে ওঠা অঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি, সেই ভাবই উনি প্রকাশে আনতে পেরেছিলেন ছবির ভাষায়।
৩.৩. এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই যে 'বিচিত্রিতা'-র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল রবীন্দ্রনাথ কৃত একটি দুর্লভ 'ভাষান্তর' - দর্শনের পৃথিবী থেকে বচনের দুনিয়ায় ভাব যে-ভাবে অনূদিত হয়ে এসেছে তার অনেক উদাহরণ অদ্যাবধি পাওয়া কঠিন। কবিতা এসেছে আগে, তারপর তারই প্রতিক্রিয়ায় ছবি - এমন উদাহরণ বাংলায় ও অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় আজ অনেক পাওয়া যাবে। কিন্তু ছবির বিবৃতিকে বাণীতে এঁকে ফেলার মতন 'আন্তর্সেমিওটিক অনুবাদ' (inter-semiotic translation) যে-কোনও ভাষা-সংস্কৃতিতেই আজও বিরল। অন্য বহু নব্যক্ষেত্রের মত এই ভূমিকাতেও এই মনচাষা অদ্ভুত ফসল ফলাতে পেরেছেন বলে আমার বিশ্বাস। যে সমালোচক বন্ধুরা এই কবিতাগুলিকে ছবিগুলি থেকে আলাদা ক'রে তাদের কাব্যগুণাগুণ ও ছন্দপক্কতার চুলচেরা বিচারে মনে করবেন ওজনে কম শুদ্ধ কবিতার রবীন্দ্রনাথের তুলনায়, আমার মনে হয় তাঁরা এই বিশাল মাপের সৃজনমানুষটির সৃষ্টির বোধ ও বোধের এই অস্পষ্ট অনুচ্চার পৃথিবীতে ঢুকতেই পারেন নি।
৩.৪. সত্যি বলতে, শব্দ থেকে শব্দে গতায়াতের একটা সূক্ষ্ম সূত্রাবলী আছে - যার দখল সবার থাকে না, তবে সেইসব দ্বিভাষী মানুষদের থাকে যাঁদের শব্দবোধ সুতীব্র ও সুগভীর। একটি বর্ণবন্ধকে কেমন ক'রে ভিন্ন সংস্কৃতির জিহ্বায় ও শ্বাসে-প্রকরণে আরেকটি একই রকম জিহ্বাকর্ষক বর্ণ-বিন্যাসে বাঁধা সম্ভব তার বেশ কিছু উদাহরণ কিছু কিছু কাব্যানুবাদে পাওয়া যায় যেখানে অলঙ্কারগুলির প্রতিও নজর দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এক ধরণের অনুপ্রাসের বদলে অন্য ধরণের অনুপ্রাস - সিলেব্ল সাজানোর বেলায় একটা তুলনীয়তা আনার চেষ্টা করা, বিভাষাতেও - এমনটা দেখা যায় বিখ্যাত কিছু কাব্যানুবাদে। তেমনি একই ভাবরাজি ভিন্ন ভিন্ন শিল্পরচনা-পদ্ধতি বিভিন্ন রূপ-সৌকর্য নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে, বিরল হলেও তার উদাহরণ এমনকি শিল্পী রবীন্দ্রনাথের আঁকাতেও পাওয়া যায়, এমনটা হালের একটি বক্তৃতায়[২২] অধ্যাপক রমণ শিবকুমার দেখিয়েছেন - যা আমার কাছেও বেশ নতুন তথ্য বলে মনে হয়েছে। মোদ্দা কথা, সম্ভাবনার পৃথিবীতে এসব ধরণের অনুবাদ অবশ্যই কঠিন, কিন্তু সম্ভব। তবে শিল্প ও কাব্য - এই দুই জটিল পৃথিবীতে অত্যন্ত সহজ বিচরণ থাকলে তবেই চিত্রের শব্দরূপে উত্তরণের এমন উদাহরণ প্রস্তুতি করা সম্ভব। পরবর্তী পর্যায়ে এমনই কিছু অনুবাদের প্রয়াস নিয়ে আরেকটু বিস্তারে যেতে চাইবো।
৪.১. রবীন্দ্রনাথ নিজে ছাড়া আর যে-কজন শিল্পীকে আমরা 'বিচিত্রিতা'-য় পাচ্ছি - যাঁদের মধ্যে রয়েছেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু, ক্ষিতীন্দ্রনাথ মজুমদার, গৌরী দেবী (ভঞ্জ), নিশিকান্ত রায়চৌধুরী, প্রতিমা দেবী, মনীষী দে, রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সুনয়নী দেবী ও সুরেন কর প্রমুখ, তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগ শিল্পীর মাত্র একটি ক'রে ছবিই অনূদিত হয়েছে - যাঁর মধ্যে ব্যতিক্রম নন্দলাল বসু (তিনটি), রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী (দুটি), সুরেন্দ্রনাথ কর (চারটি), এবং গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আটটি ছবির কাব্যানুবাদ। কবির নিজের ছবিও সংখ্যায় সাতটি রয়েছে। তুলনীয়তার সূক্ষ্ম প্রকরণে সম্ভবতঃ এই শেষোক্ত পাঁচজন শিল্পীর ভূমিকা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়বে কারণ স্পষ্টতঃই এই পর্যায়ে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে গগন ঠাকুর, নন্দলাল, সুরেন কর, রমেন্দ্রনাথ ও নিজের ছবিই কবিকে বহুবার ক'রে জাগিয়ে তুলতে পেরেছে অথবা চ্যালেঞ্জ করতে পেরেছে বর্ণকুশ পর্বত লঙ্ঘন করতে। দেখা যাক, অশ্বমেধের ঘোড়ার রশিকে কবি কেমন স্পর্ধায় কতটা অবলীলায় ধরে ফেলছেন।
৪.২. শুরু করা যাক গগনেন্দ্রনাথের ছবি ও কবি রবীন্দ্রনাথের কবিতা 'কালো ঘোড়া' দিয়ে যা আখর-কবিতা সমেত ৩২টি কবিতার এই সংকলনে এসেছে ২৪তম পাঠ হয়ে, তিরিশটি পংক্তিতে তিনটি অনুচ্ছেদে সাজানো ১১২-শব্দের একটি কাব্যানুবাদ রূপে। শুধু ছবিটি দেখলে একথা স্পষ্ট যে আমরা দেখছি অমাবস-পুচ্ছময় সবলশরীর একটি কৃষ্ণাশ্ব যা উঠে চলেছে সিঁড়ি বেয়ে ক্রমশ ঊর্ধমান, বল্গাহীন ধেয়ে চলা শূন্যপথ দিয়ে, আকাশে - গভীরে যেখানে অন্ধকার চারিপার্শ্বে ছেয়েছে আলোক-চেরা পথ, যার উপর আছে ছায়া, হ্রেষাধ্বনি বাজাবে এমন। আরও আছে অন্য কিছু মানুষের ছায়া, সে-কি উপবিষ্ট, বাদ্যরত অথবা পঠনে যোজিত? রুদ্র খরতর পদতলে কম্পিত ভগ্নপথ, আলোকবর্ষা। অশ্বে উপবিষ্টা নারী দীর্ঘকায়া কালাগ্নির শিখা-বিশেষ - যেন দুহাতে ঢাকা তার চোখ বস্ত্র দিয়ে যা তার ব্যথার মূর্চ্ছনাকেও দিয়েছে ঢেকে। হ্রেষারবে উঠছে জেগে আঁধার চিরে আলো, প্রতিধ্বনি পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘময়। পশ্চাতে ও পশ্চপটে(???) যেখানে আঁধার, সেখানেও মিশকালো অন্ধকারে উড়ন্ত অশরীরি কিছু দেহ খণ্ডকায়।
৪.৩. এমন একটি ছবিকে কবি রবীন্দ্রনাথ কীভাবে দেখালেন কবিতার ভাষায়? একথা খুঁটিয়ে না দেখলে রহস্যের মতই মনে হয়। 'কালো ঘোড়া'-র পাঠককে খুঁজে দেখলে মনে হয় - এ এক এমন কালো ঘোড়ার কথা যার পায়ের গতিতে রয়েছে অধীরতা অস্থিরতা - "অসাধ্যের সাধনা" যার গতি মোহন মুক্তি পেয়েছে হঠাৎ নৈরাশ্যের আঘাত থেকে অকস্মাৎ দ্বার মুক্ত পেয়ে রাতে। বল্গাহারা কালো অশ্ব যেন কালো চিন্তামেঘের দলের মতই এক আত্মঘাতী ঝঞ্ঝার মতনও চলেছে, যার উদ্দেশ্য হল "বিস্মৃতির চির-বিলুপ্তির মধ্যে ... নিরঙ্কিত পথ ধেয়ে" চলতে থাকা ও নিয়ে যাওয়া ব্যর্থতাকে দুরাশাকে অন্ধ রাত্রির পরপারে যেখানে "অন্তিম শূন্যের মাঝে" কৃষ্টিহীনতার "নিশ্চল নির্বাক" পৃথিবীতে চলে যাওয়া যায়। এই অশ্ব যাকে পিঠে ক'রে নিয়ে এলো তিনি "ব্যথায় মূর্চ্ছিত মোর প্রিয়া" - যাঁকে নিয়ে যেতে চাইছে বিস্মরণের বিলোপ-লোকে যেখানে কবির মনে হচ্ছে "যাক্ ধেয়ে", মনে হচ্ছে "নিয়ে যাক" ভাষার বাহিরে কোনও পৃথিবীতে। কারণ, কবি জানেন বাণীর সীমাপারেই আসবে বিরহের আগুনে পোড়া, বহুবিধ শব্দরাজির বর্ষা পেরোতে পারলে তবেই আসবে অগ্নিস্নানে রৌদ্রস্নাত আশ্বিনের আলোক, এমন নির্মল মেঘ যাতে থাকবে না বৃষ্টির কণা; শোক থাকবে বিস্মরণ, ব্যর্থতা, বিরহের - কিন্তু তাও হবে নির্বাক দীপ্তিময়। এভাবেই "অন্ধ অভিলাষের" ঘটবে বাণীমোচন। এই যে ব্যক্তিগত প্রেম-বিরহ থেকে নৈর্ব্যক্তিকতার দিকে ধেয়ে চলা এই যে বাক্-এর পৃথিবী থেকে বৈবস্বতের বর্ণময় বিশ্বের দিকে চলে যাওয়া - এ যেন এই বিপুল নিরীক্ষারই একটা মূর্ত রূপ। আমার মনে হয় শিল্পী-কবি রবীন্দ্রনাথের এই দিকটিকে নিয়ে আরও গবেষণার সুযোগ রয়েছে।
সন্দর্ভ :
[১] 'আরশি' কবিতা থেকে উদ্ধৃত; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯৩৩ ও ২০১১ প্রতিক্ষণ-বিশ্বভারতী সংস্করণ থেকে গৃহীত) পৃ. ১২।
[২] ঐ; পৃ. ১৩।
[৩] "তোমার পাখীর গানে
পাঠাও সে অলক্ষ্যের পানে
প্রতিভাষণের বাণী,
বলো তারে, হে অজানা, জানি আমি জানি,
তুমি ধন্য, তুমি প্রিয়তম -
নিমেষে নিমেষে তুমি চিরন্তন মম।" (ঐ; 'দান' কবিতা থেকে পৃ. ১৫)
[৪] ঐ, পৃ. ১৪।
[৫] ঐ, 'ভীরু' কবিতা থেকে, পৃ. ৩৬।
[৬] ঐ, পৃ. ৩৬।
[৭] 'অনাগতা' থেকে, বিচিত্রিতা, পৃ. ৪৮।
[৮] ঐ, পৃ. ৪৮।
[৯] 'দ্বারে' কবিতা থেকে, পৃ. ৫৫।
[১০] ঐ, পৃ. ৫৬।
[১১] 'বেসুর' কবিতা থেকে, পৃ. ৪১।
[১২] ঐ, পৃ. ৪১।
[১৩] 'বিচিত্রিতা'র আখর-কবিতা নন্দলাল বসুকে উৎসর্গ-কবিতা 'আশীর্বাদ'।
[১৪] 'অচেনা' থেকে, বিচিত্রিতা, পৃ. ৪।
[১৫] ঐ, পৃ. ৪।
[১৬] 'বধূ' কবিতা থেকে, বিচিত্রিতা, পৃ. ৩।
[১৭] 'পসারিণী', পৃ. ৫।
[১৮] ঐ, পৃ. ৬।
[১৯] 'হার' কবিতা থেকে, বিচিত্রিতা, পৃ. ১৬।
[২০] 'মরীচিকা', পৃ. ১৮।
[২১] 'শ্যামলা' থেকে, পৃ. ২১।
[২২] স্মিথসোনিয়ান ইন্সটিটিউশান, ওয়াশিংটনে প্রদত্ত বক্তৃতায়, ২৯শে মে, ২০১১-য়।
পরবাস, ২২-শে শ্রাবণ, ২০১১