• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | Satyajit Ray | সাক্ষাৎকার
    Share
  • পোস্টমাস্টার-এর 'রতন'-এর সঙ্গে কিছুক্ষণ : রাজীব চক্রবর্তী



    রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকীতে সত্যজিৎ রায় গল্পগুচ্ছ -এর তিনটি ছোটোগল্পের চলচ্চিত্রায়ন করেন, `তিনকন্যা' ছবিতে । প্রথমা কন্যা `পোস্টমাস্টার'-এ রতন-এর ভূমিকায় চন্দনা বন্দ্যোপাধ্যায় দর্শককে ছুঁয়ে যান তাঁর স্পর্শী অভিনয়ে । তাঁরই সাথে আলাপচারিতায় `পরবাস'-এর পক্ষ থেকে রাজীব চক্রবর্তী (কলকাতা, জ্যৈষ্ঠ, ১৪০৯) ।

    প্রশ্ন -- সত্যজিৎ রায় পরিচালিত তিনকন্যা ছবিটিতে আপনি পোস্টমাস্টার যে গল্পটি ছিল তাতে রতন-এর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন । ব্যাপারটি কীভাবে ঘটেছিল ? মানে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে পরিচয় কীভাবে হল ?

    না, পরিচয় তো আগে থেকে কিছু ছিল না । আমি একটা নাচের স্কুলে নাচ শিখতাম উনি সেখানে এই চরিত্রের জন্য, মানে অভিনয় করবে যে, নায়িকা খুঁজতে বেরিয়েছিলেন । সেখানে দেখে উনি আমাকে পছন্দ করেছিলেন এবং তারপরে ওনার বাড়িতে আমাকে যেতে বলেছিলেন । আমি ওনার বাড়িতে যাই এবং তারপরে স্ক্রিন টেস্ট ইত্যাদি যে ফরম্যালিটিস আছে সেগুলো স্টুডিওতেই করা হয়েছিল ।

    প্রশ্ন -- উনি কি প্রথম আপনাকে নাচের স্কুলে এসেই দেখেছিলেন ?

    হ্যাঁ, নাচের স্কুলেই প্রথম দেখেছিলেন । আমি দেখছি যে, আমি যে অতটা ভালো নাচ করতাম তা না, আমার বোন কিন্তু আমার থেকে অনেক ভালো নাচত । ও প্রথমদিকে ছিল, আমি রয়েছি পিছনদিকে । আমি দেখছি কি -- নাচ দেখতে গেলে আমার দিকে দেখার কথাটা স্বাভাবিকভাবে মনে হয় না । অন্য অনেক মেয়েই আছে, আমার বোন শুধু নয় । আরও অনেক আছে যারা আমার থেকে ভালো নাচে । সাধারণভাবে মনে হয় নাচ দেখতে গেলে তাদেরটাই দেখবে । কিন্তু আমি দেখছি উনি কোনো দিকে --- আমি তো চিনতেও পারছি না । আমি দেখছি যে খুব লম্বা লোক, মাথাটা প্রায় দরজার কাছে ঠেকেছে আর শুধু চেয়ে আছেন আমার দিকে । আমি ভাবছি কি ব্যাপার ! আমি কি কিছু ভুল করছি ! আমি এদিকে তাকাচ্ছি একবার, ওদিকে তাকাচ্ছি একবার । কিন্তু উনি ঠিক এইরকম স্থির --- আর কিরকম একটা অস্বস্তি লাগে না ? কেউ যদি এরকমভাবে চেয়ে থাকে ! উনি কিন্তু শুধু দেখছেন, দেখছেন, দেখছেন -- নাচটা শেষ হল । ততক্ষণ কোনো কথা বলেননি । তারপর আমাকে ডাকলেন । ডেকে বললেন তুমি কোথায় থাকো ? আমি বললাম কাছেই থাকি । তখন বললেন বাড়িতে কে আছে ? বাবা আছেন ? আমি বললাম হ্যাঁ বাবা আছেন । বললেন বাবাকে একটু ডেকে আনতে পারবে ? বললাম তা পারব । তারপরে তো আমি ডেকে আনতে চলে গেলাম । কাছেই, খুব একটা -- মিনিট পাঁচেক হাঁটা হয়ত । বাড়িতে এসে বলছি যে এরকম একজন লম্বা মতন ভদ্রলোক এসেছেন আর বাবাকে ডাকছেন । খালি আমাকে দেখছেন । কেউ তো বুঝতে পারছে না, বলছে তুমি কি কিছু করেছো ? আমি বললাম না না কিচ্ছু করিনি, আমি তো নাচ করছিলাম । তারপরে তো একজন ভদ্রলোক ডেকে আমাকে এরকম বললেন । তারপরে বাবা এলেন । তখন উনি চলে গেছেন ওনার একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট-কে রেখে । তাকে বলে গেছেন এরকম ব্যাপার । এই ওনার অ্যাড্রেস -- তখন উনি থাকতেন লেক টেম্পল রোডে । তখন তো ওনার মা-ও বেঁচেছিলেন । আমি ওনার মাকেও দেখেছি । তার অল্প পরেই সেই বছরেই কিন্তু ওনার মা মারা গেছেন মানে ওই একই বছরে । ওনাকে দেখালেন আমাকে । আমার সঙ্গে কথা বললেন । উনি সুকুমার রায়ের স্ত্রী আর কি । বাবা আমাকে নিয়ে ওনার বাড়িতে গেল । সত্যজিৎ রায় তখন বললেন যে এই সিনেমাটা করছি । এর একটা চরিত্র রতন-এর চরিত্রে ওকে ভীষণ পছন্দ হয়েছে । আমার চোখের ওপর -- উনি নাকি চোখটা ভীষণ দেখতেন । কেননা যে ধরনের রোল ছিল ডায়লগের থেকেও তো এক্সপ্রেশনটা তো বেশি প্রয়োজন । এখন এক্সপ্রেশনটা তো বেশি ফুটে ওঠে চোখের মধ্যে দিয়ে, না ? সেই জন্যে মূলত আমার চোখটা ভালো লেগেছিল । আর পরে যা শুনেছিলাম উনি একটা ক্যারেকটার যখন চিন্তা করতেন, উনি বোধহয় ছবি আঁকতেন তার এবং সেটার সঙ্গে মিলিয়ে নিতেন যতটা কাছাকাছি -- সেটা হয়তো আমার সঙ্গে বেশি মিলটা পেয়েছিলেন । কিন্তু উনি বলেছিলেন আমি ভয়েস টেস্ট করব । ক্যামেরাতে দেখবো । সেজন্য আবার আমায় টেকনিশিয়ন স্টুডিওতে একদিন যেতে হল । টেস্ট হল, সব ও. কে. হল । তারপরে শ্যুটিং ।

    প্রশ্ন -- রতন চরিত্রটি অভিনয় করবার আগে আপনি কি `পোস্টমাস্টার' গল্পটি পড়েছিলেন ? রতন চরিত্রটি সম্পর্কে আপনার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল ?

    না, প্রথমে যখন উনি আমাকে বললেন এই চরিত্রটা সম্বন্ধে -- বলেছিলেন `পোস্টমাস্টার' গল্পটা পড়ে নিতে । কিন্তু এটা ঠিক সেই বয়সে `পোশ্টমাস্টার' পড়ে বোঝার মতো --- জাস্ট উনি একবার বলেছিলেন এই গল্পটাতে তুমি অভিনয় করছ । কিন্তু গল্পটা আমি পড়লেও সেরকম ভাবে বিশেষ কিছু বুঝিওনি । আর তাছাড়া উনি যেটা করতেন -- গল্প পড়াটা তার সঙ্গে খুব একটা সম্পর্কযুক্ত নয় । না পড়লেও কোনো অসুবিধা হত না । কারণ উনি যেদিন যেটা অভিনয় করার ব্যাপার থাকত সেটা উনি একটু স্ক্রিপ্ট আকারে লিখে দিতেন । সেজন্য টোটাল ব্যাপারটা না বুঝলেও তখনকার মতো সেই সিচুয়েশনটা বুঝে গেলেই ব্যাপারটা আর কী হয়ে গিয়েছিল ।

    প্রশ্ন -- আপনার তখন যা বয়স ছিল ওই সময়ে বিশ্ববন্দিত পরিচালক সত্যজিৎ রায় সম্পর্কে আপনার কী কোনো ধারণা ছিল ?

    না, আমার সেরকম ধারণা ছিল না । তবে শুনেছিলাম `পথের পাঁচালি' উনি করেছেন । `পথের পাঁচালি' দেখেও ছিলাম । এইটুকুই ধারণা । `পথের পাঁচালি', সত্যজিৎ রায় -- এর বাইরে আর কিছু ধারণা ছিল না ।

    প্রশ্ন -- সেই সময় অভিনয় করতে গিয়ে আপনার কী অনুভূতি হয়েছিল ?

    মানে, আমার একটু -- বুঝতেই পারছেন বয়েস তখন খুবই কম । এখন আমাকে যেটা উনি যেভাবে বলে দিতেন আমি অত্যন্ত বাধ্যতার সঙ্গে ঠিক সেইটা ফলো করার চেষ্টা করতাম । এবং উনি যেরকম বলেছেন আমি ঠিক সেটাই করেছি । সেখানে আমার নিজের কতটা ক্ষমতা সেটা ঠিক বোঝার মতন বয়সও তখনো আমার হয়নি । কোনো অসুবিধা হতো না আমার । উনি যেভাবে বলে দিতেন বা বুঝিয়ে দিতেন আর যা করতে বলতেন সেটা করতাম কোনো অসুবিধা হতো না । কারণ প্রথম কথা -- উনি ভীষণ সহজভাবে মিশতেন যেটা বিরাট -- । এরকম একটা সিরিয়াস জিনিষ অভিনয় করছি কিন্তু আমার সঙ্গে ওনার সম্পর্কটা খুব সহজ হয়ে গিয়েছিল । যার জন্য যেটা উনি বুঝিয়ে বলতেন এটা তুমি কর আমি সেটা করতাম । বুঝেছি আমি অনেক পরে ব্যাপারটা ।

    প্রশ্ন -- ওই সময় অভিনয় করতে গিয়ে আপনার আরও যাঁরা কো-অ্যাক্টর ছিলেন তাঁরা আপনার সঙ্গে কেমন ব্যবহার করত ?

    শুধু কো-অ্যাক্টর বললে ভুল হবে, ইউনিটের প্রত্যেকে অত্যন্ত সহযোগিতা করেছে । কারণ একটা ৯-১০ বছরের মেয়ে, প্রথম কথা । আর তখনকার দিনে তো আর এমন ছিল না -- এখন যেমন একজন অভিনয় করতে যায়, সঙ্গে তার বাড়ির বিরাট লোকজন । সঙ্গে তার মা-বাবা সব চলে গেল । আমাদের সময় ঠিক সে ব্যাপারটা ছিল না, মা কোনোদিনই আমার সঙ্গে যায়নি । কখনো কখনো বাবা গেছে, কখনো হয়তো পাড়ার কোনো পরিচিত কাউকে বলা হয়েছে একটু সঙ্গে যাওয়ার জন্য । সেদিক থেকে ধরতে গেলে কিন্তু আমি ইউনিটের লোকেদের কাছে একা । কিন্তু তাদের সঙ্গে তাদের ব্যবহারে মনেই হত না যে আমি বাড়ির বাইরে আছি । আর অনিল চ্যাটার্জী ছিলেন -- আমার সঙ্গে এত চমত্কার ব্যবহার যে আজ উনি মারা গেছেন আমার বলতেও খারাপ লাগছে আর কী । নৃপতি চ্যাটার্জী ছিলেন । উনি বিশু পাগলার রোলটা করেছিলেন । উনিও ভীষণ, মানে -- চমত্কার ব্যবহার ।

    প্রশ্ন -- আপনার ওই বয়সে সে অনুভূতি হয়তো থাকবার কথা নয়, তবুও ছোটো ছেলে বা মেয়েদের নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে সত্যজিৎ রায়ের ভূমিকাকে আপনি কিভাবে দেখেছেন ?

    এখন আমি পরে ওনার অনেক ছবি দেখেছি । সেখানে দেখেছি যে এরকম আমার থেকেও ছোটো কাউকে নিয়ে উনি অভিনয় করিয়েছেন -- যেটা `সোনার কেল্লা'-তে । আমি যখন করেছিলাম তখন আমিও কিন্তু বেশ ছোটোই ছিলাম । কিন্তু সেক্ষেত্রে `সোনার কেল্লা'-র ব্যাপারটার সঙ্গে এটা ঠিক তুলনীয় নয় যদিও কিন্তু তবু আমি বলব যে উনি যেভাবে সাহায্য করতেন, সেখানে বলার কিছু নেই । উনি আর ইউনিটের সবাই -- মনে হত যেন বাড়িতেই আছি ।

    প্রশ্ন -- উনি আপনাকে কীভাবে হ্যাণ্ডল করতেন ?

    উনি আসলে করতেন কি জিনিশটার মধ্যে খুব একটা সহজ পরিবেশ রাখতেন । মানে উনি মোটেই বুঝতে দিতেন না যে জিনিশটা একটা বিরাট কিছু হচ্ছে । আর খুব অল্প অল্প অংশ শ্যুট করা হত একেক দিন । ঠিক যেটুকু অংশ সেটা উনি বারবার আমাকে দেখিযে দিতেন । আমি বলছি, আমার সঙ্গে তুমি পরে বলো -- এইরকমভাবে । এইভাবে রির্হাসাল করিয়ে নিয়ে তারপরে শ্যুটিং করতেন । তারপরে হয়তো কোনোসময় --- এটা তো স্বাভাবিক, ভুল হতেই পারত । হতও হয়ত এক-আধ সময় কিন্তু উনি কক্ষনো বলতেন না যে ওটা ভুল হয়েছে । কারণ ভুল শুনলেই স্বাভাবিক ওইটুকু একটা মেয়ের রিঅ্যাকশন হবে । আমি পারছি না, হয়তো মনে হতে পারে -- মানে মনোবলটাকে নষ্ট করতে কখনো দিতেন না । যার জন্য উনি বলতেন -- ফাইন, বলেই তারপরে আবার বলতেন তুমি এই জায়গাটায় একটু এইরকম করে কর । তাতে আমার কোনোসময়ই মনে হত না যে আমি খারাপ করছি । মনে হত আমি খুব সুন্দর করেছি কিন্তু উনি হয়তো আর একটু ভালো কিছু চাইছেন, আরও পারফেকশন চাইছেন ।

    ওনার সঙ্গে সম্পর্কটা নিজের আত্মীয়ের মতো হয়ে যেত । অনেক ক্ষেত্রে নিজের আত্মীয়ের থেকেও বোধহয় বেশি । কী সহজভাবে মিশে -- আর সবথেকে বাচ্চাদের সঙ্গে মেশাটা কিন্তু খুব মুশকিল । কেননা আমাকে যখন একটা ছোট্ট বাচ্চার সঙ্গে মিশে তার কাছ থেকে অনেক কাজ আদায় করতে বলে -- যেটা আমরা স্কুলে পড়ানোর ক্ষেত্রে নিজেরাই বলি, -- না না সিনিয়র ক্লাস দেবে । ছোটো ক্লাস পারি না, ম্যানেজ করতে পারি না, অসুবিধা হয় । তাদের মুড ইত্যাদি । সেখানে তো তবু পড়ানোর ব্যাপার, ক্লাস ম্যানেজ করার ব্যাপার । এসব জিনিশ তো আরও ক্রিয়েটিভ জিনিশ । সেখানে একটা ছোট্ট বাচ্চার কাছে ঠিক আমি বা চাইছি সেটা আদায় করে নেওয়া -- এটা খুব ডিফিকাল্ট ব্যাপার । সেটা উনি দারুণভাবে জানতেন এবং বাচ্চাদের সাইকোলজিটা আমার মনে হয় উনি খুব ভালো করে বুঝতেন বলেই এটা পারতেন । এগুলো আমি পরেই রিয়েলাইজ করেছি -- তখন তো আর এসব বুঝতাম না কিছু ।

    আর একটা জিনিশ দেখতাম । উনি -- সাধারণত কি হয়, বাঙালিরা বাড়িতে ভাত খায় । এখন হয়তো অনেকে ফ্যাশন-ট্যাশন করে খায় না সে অন্যকথা । কিন্তু আমি যে-সময়ের কথা বলছি সে-সময় একটা ৯-১০ বছরের মেয়ে বাড়িতে ভাতই খায় । উনি আমার যেটা মনে হয়, এগুলো আমি পরে অবশ্য বুঝেছি, কখনো কোনো প্রশ্ন তো ওনাকে আমি করিইনি । করার ব্যাপারও না । উনি কিন্তু আমাকে ভাত খেতে দিতেন না -- ওখানে উনি নিজে যা খেতেন, আমি আর উনি একসঙ্গে খেতাম । কিন্তু ইউনিটের অন্য লোকেরা, অনিল-কাকামণি, ওঁরা কিন্তু ভাত খেতেন বলেই আমি জানি । ওঁরা কিন্তু চলে যেতেন অন্য জায়গায় । আমাকে নিয়ে উনি একট আলাদা ঘরে বসে -- উনি আর আমি একরকম খাবার খেতাম । ফিশফ্রাই, ভালো ভালো খাবার, স্যাণ্ডউইচ, দই । আমার যেটা মনে হয় -- যে উনি আমাকে ভাত-টাত খেতে দিতে চাননি হয়তো বা বাচ্চাটার খেলে-টেলে ঘুম পাবে, একটা লেথার্জি আসবে । এটাই আমার মনে হয়, কারণ । নাহলে উনি তো আমায় জিজ্ঞেস করতে পারতেন -- সবাই চলে গেল, তুমি ভাত খাবে না ? কিন্তু উনি কোনোদিন জিজ্ঞাসাই করেননি আমাকে । কিছু বলতেনই না -- যেমন, চন্দনা কিন্তু আমার সঙ্গে খাবে । তাতে কি মানে হচ্ছে -- যেন এ আর আমি খুব ক্লোজ । খেতে খেতে গল্প করা তার নেচারটা কিরকম বোঝা । যে তুমি এই করতে ভালোবাসো ? গল্পের বই পড়তে, না খেলতে? আমি বলতাম আমি খেলতে ভালোবাসি না, গল্পের বই পড়তে ভালোবাসি । এইভাবেও কিন্তু উনি সেই মানুষটার চরিত্রটাকে এইসব কাজের অবসরে জেনে নিতেন, বুঝে নিতেন । তবেই তো তার সঙ্গে কাজ করা যায়, না ? সে কি বোঝে না-বোঝে বা কতটা তার কোন জিনিশ পছন্দ, কোন জিনিশ অপছন্দ । এটাও উনি বুঝেছিলেন -- তখন থেকেই আমার চোখ একটু খারাপ ছিল । আমি চশমা পরতাম বাড়িতে । কিন্তু শ্যুটিং-এ আমি চশমা নিয়ে যেতাম না । কারণ ওখানে তো আর চশমা পরার ব্যাপার নেই । চশমা পরে তো অভিনয় হবে না । আমি নিয়েও যেতাম না । আমার ওই অত আলো-টালোয় একটু মাথার যন্ত্রণা করত । চোখটা খারাপ তো, ন্যাচারালি আমি অনেক সময় হয়ত মাথায় হাত দিয়ে বসে আছি । উনি আমাকে ঠিক লক্ষ করতেন । আমি কিন্তু দেখেছি উনি খুব লক্ষ করতেন । লক্ষ করে করে আমার মনে হয় সেই মানুষ সম্বন্ধে ধারণাটা আরও পরিষ্কার করতেন । অন্য লোক হলে হয়ত খেয়ালই করত না । মাথায় হাত দিয়ে একটা বাচ্চা বসে আছে তো কি হয়েছে ? আছে থাক, সে তো আর কিছু বলছে না । তোমার কি চোখ খারাপ ? তুমি কি বাড়িতে চশমা পর ? আমি বললাম হ্যাঁ, কোনো অসুবিধে হয়নি, মাথাটা একটু ব্যথা করছে । উনি বললেন তুমি চশমাটা নিয়ে আসবে । যখন শ্যুটিং থাকবে না তখন তুমি চশমাটা পরে থাকবে । এই যে একটা, মানে সূক্ষ্ম অনুভূতি, যে একটা মেয়ে তার ছবিতে অভিনয় করছে তার দিকে লক্ষ রাখা, তার কি অসুবিধে সেটাকে এইরকম নিখুঁতভাবে লক্ষ রেখে তবে না বুঝতে পারা যায় । সেটা কিন্তু অন্য লোকের কাছে এক্সপেক্ট করা যায় না ।

    প্রশ্ন -- এরকম একটা শোনা যায়, হয়ত আংশিক সত্য, বা নাও হতে পারে, যে একটা শট নেওয়ার পরে হঠাৎ উনি বললেন যে এটা আর একবার নিতে হবে । তখন আপনি তো ছোটো, বিস্ময়ে হতবাক হয়ে আপনি বোধহয় জিজ্ঞেস করেছিলেন যে আমার কিছু ভুল হল কী ? তা, আপনার পিঠ চাপড়ে উনি বলেছিলেন না, ভুল অনিলদাদার --

    হ্যাঁ, এরকম একটা ব্যাপার হয়েছিল । আমি তো তখন বুঝতে পারিনি, আমি ভেবেছি বোধহয় আমার কোনো ত্রুটি হয়েছে । কিন্তু সেখানে ভুলটা হয়েছিল অনিলকাকুর । যার জন্য উনি বললেন -- না না তোমার কোনো ভুল হয়নি, অনিলকাকুরই ভুল হয়েছে ।

    প্রশ্ন -- ওই সময় অন্য আরও যাঁরা ছিলেন অ্যাক্টর ছাড়া । যেমন ক্যামেরাম্যান বা মেকাপ-ম্যান তাঁদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক --

    সবার সঙ্গে, সবাই ভীষণ ভালোবাসত । পুরো টিমটাই । প্রত্যেকের ব্যবহার -- মানে, আমরা কিরকম হই যে অনেকসময় রেগে যাই । রেগে গিয়ে হয়তো একটু খানি রাফলি কথা বলি । এগুলো তো আমাদের সাধারণ মানুষের নেচার । আমি ওখানে কখনো ওনাকে আমার ওপর রেগে যেতে বা ইউনিটের কেউই আমার ওপর রাগ করছে এমন দেখিনি । শুধু রাগ নয় মানে কেউ মামণি ছাড়া কথাই বলছে না । এমন সম্পর্কটা করছে তারা যেটার জন্যে হচ্ছে কি যে একটা বাচ্চা কাজ করছে, অতটা পরিশ্রম করছে সেও সেটা বুঝতেই পারছে না । সেও একটু মোহগ্রস্ত হয়ে থাকছে যে -- কি সুন্দর সবার ব্যবহার -- যে যা বলছে তাই শোনে । প্রত্যেকে । উনি হয়তো ইউনিটের কারও সঙ্গে কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলছেন -- সেটা অন্য কথা । কিন্তু আমার সঙ্গে উনি কখনো -- মানে, কোনোদিন রাগতে ওনাকে দেখিইনি । মানে., ভীষণ সুন্দর সফটলি কথা বলতেন । কিন্তু আবার সিরিয়াস । এমন নয় যে খুব হাসিঠাট্টার পরিবেশ তাও কিন্তু নয় । পরিবেশটা -- মানে, ছবিটা হচ্ছে এমন ধরনের এখানে যদি খুব হাল্কা ভাবে চলে সেটা তো ফুটে উঠবে না । এদিকে গম্ভীর অথচ ভীষণ সুন্দর । ঠিক ব্যবহারটা যে কিভাবে প্রকাশ করব বুঝতে পারছি না । এতো সুন্দর ব্যবহার ! এখনো সেটা ভোলোংআ যায় না । তখন আমি কাকিমাকে খুব বেশি -- পরে শুনেছি যে কাকিমা শ্যুটিং-এ -- সোনার কেল্লার সময় কুশল খুব ছোটো ছিল, কাকিমা সঙ্গে যেতেন । আউটডোর শ্যুটিং-এ ওরা সবাই যেতেন । কিন্তু আমি যে-সময়টার কথা বলছি সে-সময় কিন্তু কাকিমা আসতেন স্টুডিওতে । মাঝে মাঝে শ্যুটিং দেখতেন । আউটডোরে যখন গেছি আমি তখন খুব একটা বেশি ওনাকে যেতে দেখিনি । যা কিছু সম্পর্ক আমার সঙ্গে কিন্তু গড়ে উঠেছে বেশি মানিককাকুর । কাকিমাও খুব ভালো । ওনার সঙ্গে যেটুকু পরিচয় হয়েছিল আমার -- পরেও খুবই ভালোই পরিচয় ছিল । খুবই সুন্দর কথাবার্তা । আমি কিন্তু শ্যুটিং-এর সময় খুব একটা ওনাকে পাইনি । পরে শুনেছি উনি অনেকসময় ড্রেস-ট্রেস সব দেখিয়ে দিতেন । অনেকভাবে হেল্প করতেন । তো সেই সময়টায় হয়ত উনি তখনও এত বেশি ইনভলভ্ড হননি । হয়ত বাবু ছোটো ছিল সেটাও একটা কারণ । তারপর আমার তো আর ড্রেসের ব্যাপার কিছু ছিল না । মেকাপেরও ব্যাপার ছিল না । একটা নোংরা শাড়ি কোনোরকমে পরিয়ে দেওয়া । সেগুলো তো স্বাভাবিক ভালোই লাগত না । এমনকি এত নিখুঁত -- যে হাতে একটা লোহা পর্যন্ত -- মানে এসব ধরনের মেয়েরা পরে না ? হাতে তার ওপর আবার একটা সেফটিপিন লাগানো । ঠিক -- প্রত্যেকটা একেবারে নিখুঁত । চুলে তো তেল দিতে বারণ করতেন । তারপরে চুলে একটু পাউডার দিয়ে দিত । চুলের অয়েলি ভাবটা যাতে চলে যেত ।

    প্রশ্ন -- এই সময় অভিনয় করতে গিয়ে সিনেমা, এই মাধ্যমটির প্রতি কী কোনো আগ্রহ জন্মেছিল ?

    আগ্রহ বলতে সিনেমা দেখতে হয়তো তারপর থেকে ভালো লাগত । কেননা একজন অভিনয় করলে হয় কী সিনেমার অনেক খুঁটিনাটি জিনিশের সঙ্গে সে জড়িত হয় -- বুঝুক না-বুঝুক । আমি হয়ত বুঝছি না কিন্তু ছবি তোলা হচ্ছে, তার পরে শট নেওয়া হচ্ছে । শট নম্বর এতো, টেক এইসব কথাগুলোর সঙ্গে, টেকনিক্যাল টার্মগুলোর সঙ্গে পরিচিত হচ্ছি । সেইজন্যে হয়তো সিনেমা বিষয়টার ওপর একটা আকর্ষণ ছিল কিন্তু নিজের কখনও সিনেমা করতে ইচ্ছে করেনি । কিন্তু সিনেমা দেখতে ভালো লাগত ।

    প্রশ্ন -- পরবর্তীকালে অন্য কোনো ছবিতে আপনার আত্মপ্রকাশ ঘটেনি ?

    না, সেরকম সুযোগ এসেছিল অনেক কিন্তু --

    প্রশ্ন -- পুরোপুরি তারপর পড়াশোনা বা ঘরকন্নার কাজেই আপনি --

    হ্যাঁ পড়াশোনা, তারপর চাকরি করলাম আমি । সাতাত্তর-সাল থেকে চাকরি করছি আমি । এইসব দিকে ব্যাস্ত হয়ে গেলাম । কিন্তু সিনেমা দেখতে তখনো ভালো লাগত ।

    প্রশ্ন -- পরে ওনার কোনো ছবিতে বা অন্য কোনো পরিচালক আপনাকে কাজ করতে ডেকেছিলেন ?

    না, অন্য পরিচালক চেয়েছিলেন কিন্তু ওনার ছবিতে আর ডাকেননি । অন্যান্য -- সেইসময় যখন তিনকন্যা রিলিস করেছিল । সেই সময় অনেক অফার এসেছিল । একবার সরে গেলে তারপর তো কেউ আর ডাকবে না, এগুলো করতে গেলে -- কনটিনিউআস প্রোসেস আর কী, পরপর করে যেতে হয় । এখন একজন দেখছে যে সে আর করছেই না । অভিনয়ের সঙ্গে যুক্তই নেই । ডিটাচড হয়ে গেল আর কী ।

    প্রশ্ন -- আজকে এই পরিণত বয়েসে আপনার কখনো কী ইচ্ছে হয় সিনেমা করার ?

    না, সেভাবে আর ইচ্ছে হয় না, কারণ এগুলো আমার মনে হয় যারা করে তারা অনেকদিন ধরে এই বিষয়টার সঙ্গে যুক্ত থাকে । হঠাৎ করে এই বয়সে এসে অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত হওয়া -- সেরকম ইচ্ছে আমার আসেনি । আর আসবে বলে মনেও হয় না ।

    প্রশ্ন -- সিনেমার আউটডোর শ্যুটিং কোথায় হয়েছিল ?

    আউটডোর শ্যুটিং হয়েছিল জগদ্দল বলে একটা জায়গায় । সোনারপুরের কাছে ।

    প্রশ্ন -- সেইখানে কি উনি এসে নিয়ে যেতেন ?

    হ্যাঁ, উনি ওনার গাড়ি পাঠিয়ে দিতেন । গাড়ি এসে আমাকে নিয়ে যেত । সঙ্গে কেউ হয়তো যেত । আউটডোর শ্যুটিং থাকলে আমার মনে আছে বেশ ভোরের দিকেই যেতে হত । মানে সকালে উঠতে বেশ কষ্টই হত । বেশ ভোর । তারপর তো সারাদিন শ্যুটিং করে বিকেলবেলা ফেরা । ঠিক সেই সময়টায় যে খুব ভালো লেগেছে তা কিন্তু বলা যাবে না । কেননা সেটা একটা বাচ্চা মেয়ের ওপর খানিকটা একধরনের চাপ সৃষ্টি হচ্ছে, না ? সে হয়ত তখন ঘুমোতে চাচ্ছে তকে উঠে তখন শ্যুটিং-এ যেতে হচ্ছে । যাবার পরে আমি বারবারই বলছি ওনার ব্যবহারটা এত সুন্দর যে সেটা আজও এতদিন পরে আমি ভুলতে পারিনি ।

    প্রশ্ন -- স্কুলের কোনো পড়াশুনার ডিস্টার্ব--

    পড়াশুনার মানে, তখন একটু-আধটু যে অসুবিধা হয়নি তা বললে ভুল হয় । তবে উনি চেষ্টা করতেন যতটা সম্ভব -- যে আমার স্কুল যেদিন বন্ধ থাকে অথবা ছুটি দেখে শ্যুটিং করা । তবে অল্প কয়েকদিন হয়ত আমাকে এর জন্য অ্যাবসেন্ট হতে হয়েছে । তবে উনি বেশি চেষ্টা করেছেন আমার সুবিধা দেখেই দিন ফেলার । কিন্তু তার জন্যে আমার পরীক্ষার কোনো অসুবিধে হয়নি । স্কুলে উপস্থিতির কিছু অসুবিধে হয়েছিল । সামান্য, সেরকম কিছু নয় ।

    প্রশ্ন -- আপনার পড়াশোনা ?

    আমি ম্যাথ-এ অনার্স নিয়ে পাশ করেছি । তারপরে বিয়ে হওয়ার জন্য ন্যাচারেলি এমএসসি-টা করা হয়নি । জাস্ট ভর্তি হয়েছিলাম কিন্তু ক্লাস করিনি । যোগমায়া দেবী কলেজে পড়েছি । তারপরে ৭৭-সাল থেকে ইউনাইটেড মিশনারি স্কুলে পড়াচ্ছি । এই স্কুলেই আমি পড়তাম, এই স্কুলেই আমি পড়াচ্ছি ।

    প্রশ্ন -- আপনি তো এখন একজন স্কুল-শিক্ষিকা । শিক্ষাদানের অবসরে কোনো ক্রিয়েটিভ কিছু করতে ইচ্ছে করে কী ?

    শিক্ষা দেওয়াটাই তো একটা ক্রিয়েটিভ ব্যাপার বলে আমি মনে করি । আর সেখানে হয় কি শুধু পড়ার সময় যে আমরা পড়াই তা তো নয় পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও অনেক কিছু বিষয়েই আমাদের যুক্ত থাকতে হয় । হয়তো স্কুলে কোনো অনুষ্ঠান হচ্ছে বা স্কুলে কোনো ক্যুইজ হচ্ছে । সেগুলোতে তো কিছু কিছু শিক্ষিকাদের অবদান থাকে । একেবারে যে থাকে না তা তো নয় । তাছাড়া ঠিক আসলে সারাদিন স্কুল করার পর তারপর আর নতুন করে -- মানে এটা বেশ পরিশ্রম-সাপেক্ষ কাজ কিন্তু । আমি ঠিক অন্য কাজের সঙ্গে তুলনা করে বলতে পারব না । কারণ আমি তো অন্য কোনো চাকরি কখনো করিনি । কিন্তু কাজটা যদি ঠিক ফুলটাইম মানে ডিভোশন দিয়ে আমি পড়াতে চাই তাহলে এটা কিন্তু বেশ পরিশ্রম সাপেক্ষ । তা না-করে অনেকে হয়তো বলবেন যে আজকাল যারা টিউশনে ব্যাস্ত আছে তারা কি পড়াচ্ছে না ? কিন্তু আমার মানে হয় ক্লাসে যদি কেউ খুব মনোযোগ দিয়ে পড়াতে চায়, এবং ফুল এফর্টটা যদি সে ক্লাসে দেয় তাহলে কিন্তু তার পক্ষে টিউশন করা একটু মুশকিল আছে কেননা এটা এতই পরিশ্রম-সাপেক্ষ ।

    প্রশ্ন -- যেদিন ছবিটা রিলিজ হল সেদিনের অনুভূতিটা যদি বলেন ?

    সেদিন আমরা যেরকম হয় এখন -- ম্যাটিনি, ইভনিং আর নাইট তিনটে শো থাকে আমরা ইভনিং শোতে গিয়েছিলাম ।

    প্রশ্ন -- বাড়ির সবাইকে নিয়ে ?

    বাড়ির সবাই, মানে, হ্যাঁ বাড়ি থেকে অনেকেই গিয়েছিল । আর আমার কিছু রিলেটিভ মনে আছে তারাও ম্যাটিনি শো-তে গিয়েছিল । যাইহোক আমি তো -- উনি যেতে বলেছিলেন ওপরে । তো যত আর্টিস্ট ছিলেন যারা অভিনয় করেছেন, অপর্ণা সেন ছিলেন, কণিকা মজুমদার ছিলেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন, অনিল চট্টোপাধ্যায় ছিলেন আর সত্যজিৎ রায় তো ছিলেনই, কাকিমা ছিলেন । সত্যজিৎ রায়ের ছেলে বাবু, সে আমার থেকে একটু ছোটো, সেও শ্যুটিং-এর সময় মাঝে মাঝে আসত, সেও সেদিন গিয়েছিল । সেই অনুভূতিটা একটুখানি অন্যরকম । ঠিক প্রকাশ করা একটু মুশকিল -- মানে নিজেকে দেখছি পর্দায় সেটা ঠিক -- মানে অভিনয় করতে বলেছেন, যেটা বলেছেন করলাম । কিন্তু তারপর এইরকমভাবে দেখে যেন তখন নিজেকে মনে হচ্ছে এটা কি আমি, না অন্য কেউ ! মানে আমি এটা কী করে করলাম সেটা আমি নিজেই তখন ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না । তারপরে যেটা খুব প্রবলেম হত আমি তো তখন স্কুল যেতাম আর আমরা তখন বেশিরভাগ সময় হেঁটেই যাতায়াত করতাম । স্কুলে যাওয়ার সময় -- আর এইখানে `ভারতী'-তেই রিলিস করেছে । `ভারতী'-র পেছনেই আমার বাড়ি । এখান থেকে স্কুল যাওয়ার পথে মানে সবাই সেই তাকাচ্ছে, বলছে জোরে জোরে । মানে প্রথমদিকটা খুব আন্‌-ইজি লেগেছিল । তারপরে অবশ্য ব্যাপারটাতে খানিকটা অভ্যস্ত হয়ে গেলাম । সবাই দেখছে -- কীরকম একটা অস্বস্তিকর লাগত প্রথম প্রথম ।

    প্রশ্ন -- বন্ধুরাও বলছে সবাই ।

    বন্ধুরাও বলছে । বন্ধুদের থেকেও বেশি হত রাস্তায় ব্যাপারটা । স্কুলে টিচাররাও অনেকে ডেকে বললেন । বন্ধুরা তখন আবার এত ছোটো তারা ঠিক বোঝেনি । এখনকার মতো তো ছিল না এত । বন্ধুরাও জানত । কিন্তু রাস্তায় চলাটা একটু মুশকিল হয়ে যেত সেই সময় । কোনো জায়গায় কোনো আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে গেলেই এটাই একটা প্রথম পরিচয় হয়ে যেত । সবাই চেয়ে আছে, নিজের একটা ভীষণ আন্‌-ইজি লাগত ।

    প্রশ্ন -- রতন চরিত্রটা তো খুবই ট্রাজিক মানে শেষের দিকটা । সেক্ষেত্রে ওই চরিত্রটা করতে গিয়ে আপনার কোনো অনুভূতি ?

    আমি তো বারবারই বলছি যে টোটাল জিনিশটা যে তখন খুব আমি বুঝে উঠেছি বলে আমি মনে করি না । আমি যেটা বুঝেছি তা পরে । সমস্ত কৃতিত্বটা ওনাকেই দিতে হয় । কেননা উনি যেভাবে আমার কাছে জিনিশটা করতে বলছেন -- মানে সমস্ত জিনিশটা কিন্তু মাথায় রয়েছে ওনার । উনি যেভাবে আমার কাছে চাইছেন কাজটা [সেইভাবে করতে] আমি চেষ্টা করেছি । আমি বরাবরই খুব বাধ্য ছিলাম । স্কুলেতে পড়াশোনার ব্যাপার মানে যেকোনো ব্যাপারে । বাধ্যতা আমার একটা বৈশিষ্ট্য । বিশেষ করে ছোটোবেলায় যেটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল । বাড়িতেও সবার আমি বাধ্য । এখন এই বাধ্যতার জন্যই যেটা উনি আমাকে দেখাচ্ছেন আমি ওটা চেষ্টা করছি -- যতটা যেভাবে উনি বলছেন সেভাবে করার । তো সেটারই এফেক্ট এইটা আর কী । আমার এখনও দেখলে মনে হয় যে এটা আমি কী করে করলাম । এটা আমার কাছে অবাকই লাগে । কিছু কাজ যে কনফিডেন্টলি করা -- যেমন ঘর ঝাঁট দেওয়া ইত্যাদি -- এগুলো মনে হচ্ছে খুব এক্সপার্ট, খুব দক্ষ হাতে করা হচ্ছে । রুটি করার একটা ব্যাপার আছে । রুটিটা বেলার ব্যাপারটা আছে । কিন্তু বেলা রুটিটাকে ঝাড়া, সেগুলো যেন মনে হচ্ছে যে এইসব কাজগুলো মুখস্থ ।

    প্রশ্ন -- সব কিছুই কী উনি শিখিয়ে দিয়েছেন ?

    না, রুটি করাটা উনি বলেছিলেন যে একটু মা'র কাছ থেকে শিখে নেবে । তাছাড়া বাকি তো সব উনিই দেখাচ্ছেন । ঝাঁট দেওয়াটা হয়তো বলছেন উনি যে এইভাবে ঝাঁটটা তুমি দাও -- কিন্তু আমি যখন দেখছি চরিত্রটা তখন আমার মনে হচ্ছে যে মানে কিভাবে আমি ঝাঁটটা পারলাম ! আমাকে এখন তো করতে বললে আমি তো সত্যি পারব না । আমাকে এখন কেউ একটা ঘর ঝাঁট দিতে বললে আমি করব, ঝাঁট দেব কিন্তু সেটা ঝাঁট দেওয়ার মতোন ঠিক হবে না । কিন্তু এরকমভাবে -- সেটা উনিই করিয়ে নিয়েছেন ।

    প্রশ্ন -- ওনার মৃত্যুসংবাদ যখন শুনলেন তখন আপনার অনুভূতি কি হয়েছিল ?

    আসলে তার আগে থেকেই ওনার সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল । সেই সিনেমা হওয়ার পর থেকেই ওনার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল । হয়ত অভিনয় জগতের সঙ্গে যুক্ত নই আমি কিন্তু ওনার বাড়িতে আমি গেছি । এমনকি উনি আমার বিয়েতেও পর্যন্ত এসেছেন । আমার হাসব্যাণ্ডের সঙ্গেও ওনার পরিচয় ছিল । আমার হাসব্যাণ্ড, আমি দুজনে মিলেও বহুবার ওনার বাড়িতে গিয়েছি । সবটাই আমি ওনাকে দেখেছি কিন্তু সুস্থ । তারপরে যখন উনি অসুস্থ হলেন -- তখন উনি তো নার্সিংংএহামে ভর্তি ছিলেন । আমি ফোন করে জিজ্ঞাসা করতাম খোঁজখবর নিতাম । কিন্তু যখন জানলাম খারাপ মানে সত্যি মনে হল নিজের আত্মীয় বোধহয় কেউ । তার থেকেও বোধহয় বেশি মনে হল । আসলে রিলেশন-তো নির্ভর করে তার ওপর -- আমার অনুভূতিটা কি রকম তার ওপর । নিজের বোনও আমার কাছে পর মনে হতে পরে যদি তার সঙ্গে আমার রিলেশনটা সেরকম না হয় । বা তার দিক থেকে আমি যদি কোনো দু:খ পেয়ে থাকি । উনি আমার সঙ্গে এত সুন্দর ব্যবহার করেছেন বরাবর যে নিজের আত্মীয় মারা গেলে যে দু:খটা হয় আমার তো মনে হয় তার থেকেও বেশি হয়েছে । তারপর গিয়েও ছিলাম আমি । নন্দনে বডিটা যেখানে রাখা ছিল ওখানে আগে গেলাম । সৌমিত্র চট্টোপাদ্যায় ছিলেন, অনিল চট্টোপাধ্যায় আরও অনেকে ছিলেন । ওখানে খানিক্ষণ থাকলাম । থেকে-টেকে তারপর বাড়িতে এলাম । কাকিমার সঙ্গে দেখা করলাম । কথা বললাম, তারপর চলে এসেছিলাম । ওনার ছেলের বিয়েতেও কিন্তু ঠিক মনে করে আমায় নেমন্তন্ন করেছিলেন । আমার সঙ্গে সেভাবে, ধরুন -- আমি তো অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত নেই, হয়তো সেভাবে রেগুলার যোগাযোগ তো ছিল না । কিন্তু আমি বলেছি মাঝেমধ্যে আমি যেতাম বা ওনাকে ফোন করতাম, খবর নিতাম । কিন্তু ঠিক এই ধরনের একটা সামাজিক অনুষ্ঠানে উনি খেয়াল করে আমার ফুল ফ্যামিলিকে নেমন্তন্ন করেছিলেন । আমি, আমার হাসব্যাণ্ড, আমার মেয়ে সবাই গিয়েছিলাম । তখনি ওনার শরীরটা খারাপই দেখেছিলাম । তার কিছুদিন পরেই উনি অসুস্থ হয়ে পড়েন । তখন তো ক্যাসেট ট্যাসেট-এর ব্যাপারগুলো -- যে `তিনকন্যা'-র হয়েছে জানতাম না । এমনি অনেক ফিল্মের ক্যাসেট হয় । হিন্দি ফিল্মেরই বেশি হয় জানতাম । তারপরে বাংলা ফিল্মেরও ক্যাসেট হয় কিন্তু `তিনকন্যা'-র যে হয়েছে সে খবরই আমি রাখিনি । উনিই আমাকে বললেন যে তোমার কাছে ক্যাসেটটা আছে ? তখন আমি বললাম না, ক্যাসেট তো আমার কাছে নেই । তখন উনি বললেন যে ঠিক আছে আমি বাবুকে বলে দিচ্ছি ও তোমাকে একটা ক্যাসেট করে দেবে । ছেলেকে বলে ক্যাসেট করিয়ে আমাকে বললেন যে তুমি একদিন এসো ওর কাছে । ওই সব করে দেবে । মানে ক্যাসেটটা আমি ওনার কাছে নিতে গেছি যেদিন তার অল্প কিছুদিন পরেই শুনলাম উনি অসুস্থ হয়ে নার্সিংংএহামে ভর্তি হয়েছেন । তারপরে ক্যাসেটটা নিতে গেলাম, অনেকক্ষণ গল্প করলেন এবং এমন পরিষ্কার ধারণা যে ঠিক তখন আমার বয়সটা কি উনি -- এখন তোমার বয়স হয়তো এইরকম হবে, না ? আমি বললাম, হ্যাঁ । মানে এমন পরিষ্কার ধারণা ঠিক কোন সময়ে ছবি, এখন এতদিন হয়ে গেছে -- ঠিক এর বয়সটা কত, এগজ্যাক্ট বয়সটা বলে দিলেন । খানিক্ষণ গল্প-টল্প করলাম, ক্যাসেটটা নিলাম, চলে এলাম ।



  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments