• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | Satyajit Ray | প্রবন্ধ
    Share
  • তিলুবাবু ও আমাদের কৈশোর : দোলনচাঁপা চক্রবর্তী

    ফার্স্ট ইয়ার থেকে সেকেণ্ড ইয়ারে ওঠার পরীক্ষা শেষ করে দিয়ে কলেজে গরমের ছুটি পড়ছে আজ, বাইশে মে । পয়লা জুলাই আবার ধুলোমাখা ক্লাসরুমে গিয়ে ঢুকব । মাঝের এই দিনগুলোতে দেখাশোনা হবার তেমন সুযোগ নেই বন্ধুদের মধ্যে । সুযোগ নেই, তা হয়তো নয় আসলে কলকাতার এই ঘামেভরা ভ্যাপসা গরম আর কটকটে রোদ, বাইরে বেরোনোর তাগিদটা খানিক ছিনিয়ে নেয় । স্কুল খোলা থাকলে তো ওদিকে ন্যাশনাল লাইব্রেরি, চিড়িয়াখানা থেকে শুরু করে এপাশে নন্দন, ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরি, গোলগম্বুজ -- কিছুই বাদ যায় না । কলকাতায় কি আর আড্ডা দেবার জায়গার অভাব, নাকি হাফ-ডেগুলোতে কলেজ কাট মারার ইচ্ছায় আমাদের কোন কমতি আছে ! দঙ্গল বেঁধে বেরিয়ে পড়ি সব । কিন্তু, ছুটি পড়লেই যে কি হয় ! গরম যেমন জমিয়ে পড়ে, লোডশেডিংও তেমনি আনুপাতিক হারে বাড়তে থাকে । এ তো গাঁ-গঞ্জ নয় যে সারা দুপুরটা পুকুরপাড়ের বাঁশবনে ঘুরে বেড়াব, কিংবা আমগাছের তলায় মাদুর পেতে শুয়ে পড়ব । এ একেবারে শহর কলকাতা । সুতরাং, হয় বাড়ির সামনে দিয়ে বাস-ট্রাকের চিত্কারে শান্তি পাওয়ার উপায় নেই, নয়তো একটু নিরিবিলির দিকে গাছপালা ঢাকা অঞ্চলে ঘরবাড়ি থাকলে মশার উত্পাত ! আমাদের সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতায় গাঁ-ঘরের সঙ্গে মশা-মাছিটাকে বেশ খাপ খাওয়াতে পারলেও, নিজেদের সুখী-সুকোমল শহুরে বাসস্থানের সঙ্গে একেবারেই পারি না । ফলে বিলক্ষণ বোর হতেই হয় একেকসময় । আজ পরীক্ষা শেষ হতে বেরোলাম সবাই একসঙ্গে । তেমন সিরিয়াস মুডে এই পরীক্ষাটা নিইনি কেউ তবু পরীক্ষার গাম্ভীর্য তো একইরকম থাকে । খাতা জমা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে নিতে নিতে একঝলক আলোচনা । কে কি লিখেছে কিম্বা লেখেনি এবং কেন । শুভম, প্রতীশদের পুরো দলটাও বেরিয়েছে । ওদের যেন শুধু অনার্স পেপারগুলো ছাড়া আর কোন কিছুতেই আসক্তি নেই, এমন একটা ভাব ! সবাই একপাশে এসে দাঁড়িয়েছি । কাল থেকে ছুটি শুরু, এত তাড়াতাড়ি বাড়িমুখো হব, নাকি কোথাও যাওয়া যায়, সেটাই ভাবা হচ্ছে । পলাশ বলল, "চল সব প্রজ্ঞানন্দের ঠেকে গিয়ে বসি । হারুর দোকান থেকে চা নিয়ে নেব । বিল হবে শ্রীমান তিয়াসার নামে ।"- বলেই হে: হে: হাসি ! আমরাও হেসে ফেললাম । কোমর পর্যন্ত চুল তিয়াসার নরম-তরম চেহারাকে আরো লাবণ্যবতী করে রাখত । কিন্তু, ওর বাবা-মা এখনই ওর জন্য "এলিজিবল ব্যাচেলর"-এর সন্ধান শুরু করায় রেগে গিয়ে সে ক'দিন আগে ঘাড় অবধি একেবারে কদমছাঁট ছেঁটে কলেজে আসার পর থেকেই পলাশ ওকে শ্রীমান তিয়াসা বলে মস্করা আরম্ভ করেছে ! এখন অবিশ্যি তিয়াসা রাগল না । আমরাও বেরিয়ে পড়লাম । আইডিয়াটা ভাল । কলেজের পিছনে বিশাল মাঠটার অন্য প্রান্তে একটা চায়ের দোকান । দোকানের সামনেই একটা বড় বারান্দাওলা দোতলা বাড়ি, বিশাল একটা নিমগাছের ছায়ায় ঢাকা । বাড়িটা গত এক বছর ধরে তালাবন্ধ পড়ে আছে । কাজেই আমরা এসে তালাবন্ধ গ্রিলের সামনের সিঁড়িতে এবং গাছের নীচটাতে বসে অফ পিরিয়ডগুলোতে আড্ডা দিই । এই আমাদের প্রজ্ঞানন্দের ঠেক ।

    যেকোন পরীক্ষার দিন কেন যেন সেই বিষয়ের ওপর যাবতীয় বইখাতা ভীষণ দামী নোটস সমেত ব্যাগের মধ্যে ঢুকে পড়তে চায় এবং ঢুকে যায়ও । ফলে ব্যাগটার হাল হয় ঢোলের মত ! সেই ঢোলটিকে একপাশে সযত্নে ফেলে দিয়ে হাত-পা ছড়িয়ে বসার পর প্রথম প্রশ্নটা করল তারক । "এবারে বল, ছুটিতে কে কোথায় যাচ্ছিস ?" দেখা গেল প্রায় কেউই কলকাতায় থাকছে না এবারে, দু'একজন ছাড়া । চন্দ্রারা যাবে গোপালপুর, প্রতীশ, শুভমরা ব্যাগ গুছিয়ে রেডি সিমলার জন্য । সিমলায় প্রতীশের এক বন্ধুর মামার বাগানবাড়ি । তিনি যেতে পারবেন না এবার, ওদের খুশি মনেই চাবি দিয়েছেন । -- "আমি একটা এমন জায়গায় যাচ্ছি, যেখানে তোরা কেউ যাচ্ছিস না । চাইলে অবশ্য যেতে পারে কেউ, নেমন্তন্ন ফ্রি ।" চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলল নীরল । নীরল পাণ্ডে । মিষ্টি স্বভাবের অবাঙালি মেয়ে । আদতে ওরা উত্তরপ্রদেশের ব্রাহ্মণ, কিন্তু বহু বছর ধরে এখানে থেকে থেকে বাঙলাটা ভালমত শিখে গেছে ও । বাঙলা পড়তে শিখেছে শুধু নয় গল্প-কবিতা পড়ে, ভাল বাঙলা ফিল্ম দেখে এবং রীতিমত সিরিয়াস আলোচনাও করে । "কোথায় যাবি তুই ?"-- জিজ্ঞেস করলাম ।
    -- "আমি যাচ্ছি তিলুবাবুর বাড়ি খঁংউজতে", হাসল নীরল ।
    -- তিলুবাবুটা আবার কে ?
    -- সে কী রে ? তিলুবাবু তো আসলে তোদেরই লোক আর তোরাই চিনিস না ?
    -- আমাদের লোক মানে ? কি হেঁয়ালি হচ্ছে ? ঠিক করে বল না ? রেগেই গেল শুভম ।
    -- প্রফেসর শঙ্কু ! হিহি হাসি নীরলের । "প্রফেসর শঙ্কু গিরিডিতে থাকেন জান না ?"

    এতক্ষণে বোঝা গেল মামলাটা ! সত্যজিৎ রায়ের অনবদ্য সৃষ্টি বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী প্রফেসর শঙ্কু, যাঁর ডাক নাম ছিল তিলু ।

    -- তুই যাবি শঙ্কুর বাড়ি খঁংউজতে ? ওটা তো একটা চরিত্র রে, কাল্পনিক, তার আবার বাড়ি আছে নাকি ?-- বোঝাতে চাইল চন্দ্রা ।
    -- তাহলে তো আমাদের সণ্ডার্সকে খঁংউজতে লণ্ডন যাওয়া উচিত ! আসলে ও যাচ্ছে গিরিডিতে ঘুরতে, কারুর কাছ থেকে শুনে ঝেড়ে দিল শঙ্কুর নামটা । মিচকে হাসল পলাশ । বুঝলাম যে এটা ও ইচ্ছে করেই বলল নীরলকে চটানোর জন্য । বাঙলা জানে না বা কিছু পড়ে না বললে কেন যেন নীরলের খুব আঁংএত লাগে, যদিও লাগার তো কথা নয় । যাইহোক, পলাশের ঢিলটা ঠিক জায়গায় পড়ল এবং, শুরু হয়ে গেল পলাশ-নীরল-চন্দ্রা-প্রতীশ-শুভমদের অনবদ্য ঝগড়া ! প্রত্যেকেই চেষ্টা করবে যাতে সে যে সবচেয়ে বেশি পড়েছে, এবং অন্যরা যে কিচ্ছু পড়েনি -- সেইটা প্রমাণ করতে । তবু এর মধ্যে দুটো দল হয়ে যাবে বরাবরের মত, একদিকে মেয়েরা, অন্যদিকে ছেলেরা । পলাশও উল্টোদিকে চলে যাবে, কারণ তিয়াসা চায়ের দাম দিয়ে দিয়েছে ! ওদের ঝগড়া শেষ হতে এখনো অনেক দেরি । আজকেই ছুটি পড়ে যাচ্ছে, আবার প্রায় দেড়-মাস বাদে ঝগড়া করতে পারবে । এই ঝগড়ার স্বাদ প্রায় মা'য়ের হাতের তৈরি খাবার কিংবা শঙ্কু সিরিজের মতই, ধরলে আর শেষ না করে ছাড়া যায় না । কাজেই ওরা এখন ঝগড়া করুক, আমরা বরং শঙ্কু ওরফে তিলুবাবু সম্বন্ধে কি কি তথ্য ওরা জানে, সেটা আর একবার ঝালিয়ে নিই ।


    ১৯৬১ সালে সন্দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হল ব্যোমযাত্রীর ডায়েরী । ডায়েরীর মাধ্যমে নিজের লেখনীতেই প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটল স্কটিশচার্চ কলেজের পদার্থবিজ্ঞানের লাজুক, মুখচোরা অধ্যাপক ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কুর । শঙ্কু একজন নির্ভেজাল বৈজ্ঞানিক এবং আবিষ্কারক । সেইসঙ্গে তিনি সৎ এবং প্রকৃত দেশপ্রেমীও । তাই খাঁটি বাঙালি হয়েও শহর কলকাতার জটিল জীবনযাত্রা এবং তার চাকচিক্যকে উপেক্ষা করে সাধনাস্থল হিসাবে বেছে নিয়েছেন গিরিডিকে । উশ্রী নদীর মনোরম জল-হাওয়াকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠা ছবির মত সুন্দর শহর গিরিডিতেই তৈরি করেছেন একান্ত নিভৃত গবেষণাগার যেখানে বন্ধুতুল্য ভৃত্য প্রহ্লাদ, এবং সবসময়ের সঙ্গী বিড়াল নিউটন ছাড়া কারুর প্রবেশাধিকার নেই । পরে অবশ্য বিশেষ ব্যক্তিবর্গ ঢুকেছেন তাঁর গবেষণাগারে, যেমন -- চীনদেশের জাদুকর চি-চিং ( প্রফেসর শঙ্কু ও চি-চিং ), ঝাঁঝাঁর অদ্ভুত বালক অমূল্যকুমার বসু ওরফে খোকা ( প্রফেসর শঙ্কু ও খোকা ), প্রমুখ ।

    প্রোফেসরের কাছের কয়েকজন ব্যক্তির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ না করলে শঙ্কুকাহিনী অসম্পূর্ণ থেকে যায় । প্রথম জায়গাটি অবশ্যই প্রাপ্য শঙ্কুর একমাত্র প্রতিবেশী অবিনাশচন্দ্র মজুমদারের । ইনি নি:সংংএকাচে, নির্দ্বিধায় শঙ্কুর কাছে আসেন এবং এই যাতায়াত হয় তাঁর নিজস্ব সময় অনুসারেই ! বৈজ্ঞানিক হিসাবে আলাদা কোন সম্ভ্রম শঙ্কু কখনো আদায় করে নিতে পারেননি তাঁর কাছে ! শঙ্কুর নিজের কথায়, "অবিনাশবাবুর মত অবৈজ্ঞানিক ব্যক্তি জগতে আর দ্বিতীয় আছে কিনা সন্দেহ । ভদ্রলোকের জন্ম হওয়া উচিত ছিল প্রস্তরযুগে । বিংশ শতাব্দীতে তিনি একেবারেই বেমানান । আমার সাফল্যে ঔদাসীন্য এবং ব্যর্থতায় টিটকিরি -- এ দুটো জিনিষ ছাড়া ওঁর কাছে কখনো কিছু পেয়েছি বলে মনে পড়ে না ।" তথাপি অবিনাশবাবু আমাদের বিরক্তি উদ্রেক করেন না । কারণ তিনি মোটামুটি সহজ-সরল, ভোজনরসিক মানুষ । তিনি নিজে বলেন, "আমি তো মশাই অনেকদিন থেকেই নিরামিষ ধরার কথা ভাবছি" ( প্রোফেসর শঙ্কু ও রক্তমত্স্য রহস্য ), অথচ আমরা শঙ্কুর জবানবন্দি থেকে জানতে পারি যে ব্যাপারটা আসলে মোটেই তা নয়, "এই শেষের কথাটা অবিশ্যি ডাহা মিথ্যে, কারণ, আর কিছু না হোক -- অন্তত: ইলিশমাছ ভাজার গন্ধ পেলে যে অবিনাশবাবু আর নিউটনের মধ্যে কোন তফাৎ থাকে না সেটা আমি নিজের চোখে বহুবার দেখেছি" ! তাই বলে কি অবিনাশবাবু আমাদের কাছে মিথ্যাবাদী হয়ে যান ? না, কখনোই নয় । কারণ, অমন একটু-আধটু বাড়িয়ে তো আমরা সকলেই বলে থাকি, বিশেষত যদি আলোচনাটা ইলিশমাছ সংক্রান্ত হয় ! সেটা অবিনাশবাবু নিজেও স্বীকার করেন, "মাছ ছাড়া মানুষে কি করে বাঁচে জানি না ।" তাঁকে সেইরকমই কিছু গড়পড়তা বাঙালির পর্যায়ে ফেলা যায় যাঁরা কখনো নিজের বাড়ির চৌহদ্দির বাইরে বেরিয়ে পৃথিবীকে দেখেননি । তিনি নিজেই জানেন যে তিনি কখনো সমুদ্র দেখতে যাওয়ার তাগিদ মনের ভেতর থেকে তেমনভাবে অনুভব করেননি । এতে আমরা অবিনাশবাবুকে ঘরকুনো ভেবে নিতেই পারতাম । কিন্তু, তিনি যখন বলেন, "পুরীটা পর্যন্ত যাব যাব করে যাওয়া হল না । আসলে কি জানেন -- সমুদ্রের মাছটা আবার আমার ঠিক রোচে না, আর ওইসব জায়গায় শুনিচি খালি ওই খেতে হয়," তখন আর তাঁকে একেবারে পাশের বাড়ির মানুষ না-ভেবে উপায় থাকে না । অবিনাশবাবুর মধ্যে যে একটা ভ্রমণপিয়াসী মন লুকিয়ে ছিল, সেটাও আমরা জেনে যাই । কারণ তিনি শঙ্কুর গোপালপুর যাওয়ার প্ল্যান শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নিজের মনের কথাটা বলেই ফেলেন, "ঝুলে পড়ব নাকি আপনার সঙ্গে ? ষাটের উপর বয়েস হল -- সমুদ্র দেখলুম না, মরুভূমি দেখলুম না, খাণ্ডলি পাহাড় ছাড়া পাহাড় দেখলুম না -- শেষটায় মরবার সময় আপশোষ করতে হবে নাকি ?" এমন ভাবনা মনে এলে তো আর চুপ করে বসে থাকা যায় না । কাজেই এবারের যাত্রায় ( প্রোফেসর শঙ্কু ও রক্তমত্স্য রহস্য ) তিনি প্রফেসরের সঙ্গী যদিও খঁংউতখঁংউতে লোক বলে হোটেলে ওঠাটা কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না, এবং সেজন্য স্থানীয় বাঙালি পরিবারের বাড়িতে পেয়িংগেস্ট হিসাবেই থাকেন । এই অভিযানে এসে সাবমেরিনে চড়ে সমুদ্রগর্ভে ঢঁংউ মারার সুযোগও তাঁর হয়ে যায়, যদিও প্রোফেসরকে রাজি করাতে তাঁকে বিস্তর যুক্তি খরচ করতে হয়েছিল । আমাদের লাভ এইটুকুই হয় যে, যে-যুক্তি দিয়ে তিনি প্রোফেসরকে কাত করেন এবং এই সাবমেরিনে চড়ার পিছনে তাঁর মনের ভিতর যে কারণটা কাজ করছিল, সেসব আমরা জানতে পারি । সেগুলো যে শুধু বেশ মজার, তাইই না, খানিক অভূতপূর্বও বটে : "আপনি বৈজ্ঞানিক হতে পারেন -- কিন্তু আপনি মাছ সম্বন্ধে কি জানেন ? আমি তো তবু মাছ-খোর--ভালবেসে মাছ খাই । আর আপনি তো প্র্যাকটিক্যালি মাছ খানই না !" তিনি এখানেই থামেননি, সমুদ্রগর্ভে যাওয়ার দরকারটাও প্রোফেসরকে বুঝিয়েই ছেড়েছেন, "লোককে অন্তত: বলতে পারব যে 'ফরেনে' গেছি -- তা সে মাছের দেশ না মানুষের দেশ সেটা বলার কি দরকার ?" এমন জোরালো যুক্তি কি প্রোফেসর উপেক্ষা করতে পারেন ? শঙ্কুর অ্যাডভেঞ্চারে সঙ্গী হওয়া অবিনাশবাবুর এই শুরু । এরপর তিনি শঙ্কুর সঙ্গে আফ্রিকা মহাদেশে গেছেন ( প্রোফেসর শঙ্কু ও গোরিলা ) আফ্রিকা যে সমুদ্রগর্ভের তুলনায় অনেক বেশি বিপদসঙ্কুল হতে পারে, তার আভাস দিতে গিয়ে প্রোফেসরকে "অবৈজ্ঞানিকের রাজা" অবিনাশবাবুর কাছ থেকে বেশ কিছু উপরি পাওনা পেতে হল, -- "আমার কুষ্ঠিতে আছে আমার আয়ু সেভেনটি-এইট । বাঘ-সিংহ আমার ধারে কাছেও আসবে না !" যদিও অবিনাশবাবু যখন জিজ্ঞাসা করেন, "গোরিলা জিনিষটা তো আমরা কলকাতার জু-গার্ডেনে দেখিচি, তাই না ?", প্রোফেসর বুঝতে পারেন যে, ভদ্রলোকের জন্তজানোয়ার সম্বন্ধে জ্ঞান খুবই কম । স্বপ্নদ্বীপে শঙ্কুর সঙ্গী হয়ে গিয়ে প্রায় পঞ্চাশ বছর পর আবার তাঁকে খাতা-কলম হাতে তুলে নিতে হয়েছে । আটজন বৈজ্ঞানিককে সেখানে তিনি দেখছেন, যাঁদের কেউই স্বাভাবিক ব্যবহার করছেন না, এবং এর কারণ অনুধাবন করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব । সূদূর প্রশান্ত মহাসাগরে ১৩৬ ইস্ট লঙ্গিচিউড এবং ১৬ নর্থ ল্যাটিচিউডে পৌঁছে সম্পূর্ণ অপরিচিত সব দৃশ্য পরিবেষ্টিত হয়ে, বহুদিনের চেনা মানুষকে যদি অদ্ভূত আচরণ করতে দেখতে হয়, তাহলে বিজ্ঞান না-জানা সাধারণ মানুষের যা অবস্থা হওয়া উচিত, অবিনাশবাবুর অবস্থাও সেইরকমই হয়েছে । তাঁর লেখনীতে আমরা সেই বর্ণনাই পেয়েছি । কাহিনীর শেষে এজন্য তিনি প্রোফেসরকে তিরস্কার করতেও ছাড়েননি, "রাত জেগে বই পড়ে মাথাটাকে জ্ঞানের ডিপো করে তো জীবনটাকে খোয়াতে বসেছিলেন । যা অবস্থা হয়েছিল আপনার, তাকে তো ছিবড়ে ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না " ! এইরকম ভাবে প্রোফেসরকে সম্বোধন করতে একমাত্র আমাদের অবিনাশবাবুই পারেন । তিনিই পারেন এরপরও প্রোফেসরের সঙ্গী হয়ে তিব্বত অভিযানে যেতে ( একশৃঙ্গ অভিযান ) যদিও তিব্বতের ভূগোল সম্বন্ধে তাঁর অসাধারণ জ্ঞান, "মানস সরোবর তো কাশ্মীরে বলে জানতুম !" অবিনাশবাবু বিজ্ঞানে উত্সাহী নন, তিনি ভূগোল-ইতিহাস সমন্ধেও বিশেষ খোঁজখবর রাখেন না এমনকী প্রোফেসরের "সাহেব বন্ধুদের" সঙ্গে ইংরিজিতে কথা বাক্যালাপ করার ঝক্কি থেকে বাঁচতে অবিনাশবাবু সপাটে বলেন, "আপনি চৌষট্টিটা ভাষা জানতে পারেন, আমার বাংলা বৈ আর সম্বল নেই । সকাল সন্ধ্যায় গুড মর্ণিং গুড ইভনিংটা বলতে পারি, এমনকী ওনাদের কেউ খাদে পড়ে গেলে গুড বাইটাও মুখ থেকে বেরিয়ে যেতে পারে -- তার বেশি আর কিছু পাবেন না ।" তিনি খবরের কাগজ নিয়মিত পড়েন, কিন্তু , সাধারণ জ্ঞান অত্যন্ত কম বলে তিনি শিম্পাঞ্জীকে গোরিলা বলে ভুল করেন । একজন বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী তাঁর প্রতিবেশী, এই তথ্যটিকেও তিনি ততখানি গুরুত্ব দেন না । কিন্তু, তা-সত্ত্বেও, শুধুমাত্র তাঁর সরল হৃদয়ের কথা জানেন বলেই প্রোফেসর মানুষটিকে অপছন্দ করেন না এবং অবিনাশবাবুকে গল্পের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পার্শ্বচরিত্র হিসাবে মেনে নিতে আমাদেরও অসুবিধা হয় না । কারণ আমরা জানি যে, এর বেশি গভীরভাবে কোন বিষয়কে অনুধাবন করা, অবিনাশবাবুর পক্ষে সম্ভব নয় । তিনি প্রোফেসরকে প্রতিবেশির মর্যাদা দেন, এবং তাঁর জন্ম-তারিখটিও ঠিকঠাক মনে রেখে তাঁকে অভিনন্দন জানাতে আসেন -- "মেনি হ্যাপি ডেজ অফ দ্য রিটার্ন !" শঙ্কুর নিজের কথায়, "ভদ্রলোকের হাবভাব এতই আন্তরিকতাপূর্ণ ছিল যে আমি আর ইংরিজিটা সংশোধন করলাম না" ( ড্রেক্সেল আইল্যাণ্ডের ঘটনা ) । সুতরাং, একথা জোর দিয়ে বলা যায় যে প্রতিবেশী হিসাবে অবিনাশবাবুর মত "অবৈজ্ঞানিক" চরিত্রটি না থাকলে শঙ্কুকাহিনী অতখানি সম্পূর্ণ হয়ে উঠতে পারত না ।


    ব্রিটিশ ভূতত্ত্ববিদ জেরেমি সণ্ডার্স এবং জার্মান বিজ্ঞানী উইলহেলম ক্রোল । প্রথমে সণ্ডার্সের কথা বলে নিই । পুণা শহরে জন্মসূত্রে তিনি ভারতীয় । সণ্ডার্সের জবানিতে ভারতের সঙ্গে তাঁর আত্মিক বন্ধনের কথা আমরা জানতে পারি, "আমি অবিশ্যি সাত বছর বয়সে বাবা-মা'র সঙ্গে ইংলণ্ডে চলে আসি, কিন্তু সেই সাত বছরের স্মৃতি, আর ভারতবর্ষ ও ভারতবাসীর উপর টান আমার এখনো অম্লান রয়েছে ।" নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত সণ্ডার্সের একটি জীবতত্ত্ব বিষয়ক প্রবন্ধের সূত্রে তাঁর সঙ্গে প্রোফেসর শঙ্কুর আলাপ । এই আলাপের কিছু পরেই সণ্ডার্সের যকৃতে ক্যান্সার ধরা পড়ে । একজন সাধারণ বিজ্ঞানী হিসাবে শঙ্কুর কোন ক্ষমতা ছিল না প্রিয় বন্ধুকে বাঁচানোর যদি তাঁর হাতে মিরাকিউরল না থাকত । হার্টব্লক হয়ে পিতা শ্রী ত্রিপুরেশ্বর শঙ্কুর মৃত্যু হওয়ার কিছুদিন পরে টিকড়ীবাবার দেওয়া সন্ধান অনুযায়ী কসৌলির এক জঙ্গল থেকে সর্বগুণসম্পন্ন স্বর্ণপর্ণীর গাছ এনে তার পাতা থেকে শঙ্কু এক সর্বরোগহারী ওষুধ তৈরি করেন, যার নাম রাখা হয় মিরাকিউরল । এই ওষুধেরই দশটি বড়ি শঙ্কু তাঁর বন্ধুপত্নীকে পাঠিয়েছিলেন এবং তাই সণ্ডার্সকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনে । এরপর সণ্ডার্স ভারতে আসেন তাঁর পত্রবন্ধু এবং জীবনদাতার সঙ্গে মুখোমুখি আলাপ করার উদ্দেশ্যে । এই ঘটনাই সমবয়সী এই দুই বিজ্ঞানীর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়ে এক সামান্য আলাপকে প্রগাঢ় বন্ধুত্বে পরিণত করে । এই মিরাকিউরলের প্রচারকে কেন্দ্র করেই প্রফেসর শঙ্কুর প্রথম ইউরোপ যাত্রা । এরপর দু'জনে একসঙ্গে বহু অভিযানে অংশগ্রহণ করেছেন । একশৃঙ্গ অভিযান-এ সণ্ডার্সের পুরনো বন্ধু ক্রোলের সঙ্গে আলাপ হয় শঙ্কুর । ক্রোলের চেহারাটি সণ্ডার্সের একেবারে বিপরীত । সণ্ডার্সের, "সুগঠিত সুপুরুষ চেহারা, বুদ্ধিতীপ্ত হাল্কা নীল চোখ, প্রশস্ত ললাট " অপরদিকে "ক্রোলের নিজের হাইট সাড়ে পাঁচ ফুটের বেশি না । টেকো মাথার দুপাশে সোনালী চুল কানের উপর এসে পড়েছে । বেশ গাঁট্টাগোট্টা চেহারা । তবে আদৌ হিংস্র নয় ।" শুধু, "লোকটা মাঝে মাঝে বেজায় অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে, তিনবার নাম ধরে ডাকলে তবে জবাব দেয় ।" এছাড়া শঙ্কুকে লেখা সণ্ডার্সের চিঠি থেকে জানা গেছে যে, "জাদুবিদ্যা, উইচক্র্যাফট ইত্যাদি সম্পর্কে ক্রোলের মূল্যবান গবেষণা আছে ... সে পাহাড়েও চড়তে পারে খুব ভাল", যদিও ক্রোলের সঙ্গে মুখোমুখি সাক্ষাতে শঙ্কুর একবারও মনে হয়নি যে "সে পাঁচবার ম্যাটারহর্নের চূড়োয় উঠেছে ।" তাছাড়া এই বৈজ্ঞানিকের অন্য একটি বিশেষ গুণ হল যে তিনি খুব ভাল বাঁশি বাজাতে পারেন । তিব্বতের এক গুম্ফা থেকে সংগ্রহ করা মানুষের পায়ের হাড় দিয়ে তৈরি একটি বাঁশিতে জার্মান লোকসঙ্গীতের সুর তাঁকে বাজাতে শোনা গেছে অন্য একটি অভিযানে ( প্রোফেসর শঙ্কুর সুবর্ণ সুযোগ )। সণ্ডার্স এবং শঙ্কুর মধ্যে অন্যতম সেতু হল বিড়াল । শঙ্কু নিউটনকে এতটাই ভালোবাসেন যে তার আয়ু দীর্ঘায়িত করতে তিনি একটি ওষুধ আবিষ্কার করেন, যার নাম রাখেন মার্জারিন এবং এই মার্জারিনের জোরেই চব্বিশ পেরিয়েও নিউটন দিব্যি সক্রিয় । অন্যদিকে সণ্ডার্সেরও পোষা বিড়াল রয়েছে, তার নাম মুস্তাফা । নিউটনের যদিও বিদেশ ভ্রমণ হয়নি, মুস্তাফা কিন্তু এই তিনবন্ধুর স্পেন অভিযানে তাঁদের সঙ্গী ছিল । এই দু'জন ছাড়াও বৈজ্ঞানিক জগতে প্রোফেসর শঙ্কুর প্রচুর সুহৃদ এবং বন্ধু, যথা, বিজ্ঞানী সামারভিল, যাঁর সাহায্যে শঙ্কু একবার প্রাণে বাঁচেন ( শঙ্কুর শনির দশা ), জাপানি বৈজ্ঞানিক হিদেচি সুমা, যাঁর তৈরি জেটচালিত সমুদ্রযান 'সুমাক্রাফট'-এ চড়েই শঙ্কুর মানরো দ্বীপে অভিযান ( মানরো দ্বীপের রহস্য ) এবং পরবর্তীকালে মাত্র তিনশো বছরে মানুষের থেকে অনেক বেশি বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি ঘটিয়ে ফেলা এক বিশেষ প্রাণীর উদ্দেশ্যে অভিযান ( ডন খ্রিস্টোবালিডর ভবিষ্যত্বাণী ) প্রমুখ ।


    শুধু যে গবেষণা-সূত্রেই বিশ্বভ্রমণ করেছেন তিনি, তা নয়, বহু রহস্যও সমাধান করেছেন । জীবনে বহুবার এমন কিছু লোকের সংস্পর্শেও এসেছেন প্রোফেসর যাঁদের মধ্যে অনেকেই পেশাগত শত্রুতার কারণে তাঁকে প্রাণে মারতে চেয়েছে, যেমন -- প্রোফেসর হামবোল্ট ( আশ্চর্য প্রাণী ) । কিন্তু, প্রত্যেকবারই মাথা ঠাণ্ডা রেখে বুদ্ধি খাটিয়ে, নয়তো কোন বন্ধুর সাহায্যে প্রাণ বাঁচিয়ে গিরিডিতে ফিরতে পেরেছেন তিনি । এমনই একজন সুহৃদ নকুড়বাবু । নকুড়বাবুর কথা উল্লেখ করতেই হয়, কারণ, নকুড়বাবুর এক অদ্ভূত ক্ষমতা বিদেশে প্রোফেসরকে এমনভাবে সাহায্য করেছে, যা অন্য কারোর পক্ষে সম্ভব হত না । নকুড়বাবুর সঙ্গে আমাদের প্রথম আলাপ প্রোফেসরের গিরিডির বাড়িতে । নিজের মাকড়দার বাড়িতে এক ঝড়-বৃষ্টির দুপুরে 'বল লাইটনিং'-এর প্রভাবে হিপ্নোটিজম, টেলিপ্যাথি, ক্লেয়ারভয়েন্স ইত্যাদি ক্ষমতা তাঁর করায়ত্ত হয় । ক্লেয়ারভয়েন্স বা অলোকদৃষ্টি থাকার দরুণ নকুড়বাবু আগে থেকেই শঙ্কুর সম্ভাব্য বিপদ সম্বন্ধে অবগত হতে পারেন, "পৃথিবীর সব জায়গা থেকেই আপনার ডাক পড়ে, আর আপনাকে সেসব ডাকে সাড়াও দিতে হয় । কিন্তু সাও পাউলোর ব্যাপারটাতে গেলে আপনাকে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে অনুরোধ করি " ( নকুড়বাবু ও এল ডোরাডো ) । শুধু শঙ্কুর বিপদ সম্বন্ধে তাঁকে সাবধান করে দেওয়াই নয়, তাঁর পক্ষে সেই বিপদকে কাটানোর জন্য নিজের বিশেষ ক্ষমতাকে ব্যবহার করে যা কিছু করা সম্ভব, সেই সবকিছুই তিনি করেন । সলোমন ব্লুমগার্টেন শঙ্কুর অত্যন্ত মূল্যবান তিনটি ওষুধের ফর্মুলা চুরি করেছেন, এ ঘটনা নকুড়বাবুর জানা হয়ে গেলে, তিনি ব্লুমগাটেনের সঙ্গে চুক্তি করেন যে তিনি ব্লুমগার্টেনকে এল ডোরাডো দেখাবেন, এবং তার পরিবর্তে শঙ্কুর ওষুধের ফর্মুলা তাঁর চাই । লোভী ব্লুমগার্টেন সেই প্রস্তাব মেনে নিলে তাকে সম্মোহিত করে ব্রাজিলের ঘোর জঙ্গলের ভিতর সোনার শহর এল ডোরাডো দেখিয়ে দেন নকুড়বাবু, এবং ঘন্টা ছ'য়েক পরে এই অঞ্চলে উল্কাপাত হতে চলেছে এই ছবিটি নিজের অলোকদৃষ্টিতে উপলব্ধি করলেও ব্লুমগার্টেনকে কাল্পনিক সোনার খোঁজে সেই গহন জঙ্গলে ঢুকতে নিরস্ত করেন না তিনি এর কারণ হিসাবে তিনি শঙ্কুকে বলেছেন, "আপনার মত এমন একজন লোক, যাঁর সঙ্গ পেয়ে আজ আমি তিনশো টাকা দামের একটি বিলিতি ওষুধ কিনে নিয়ে যেতে পারছি আমার ঠাকুমার জন্য, তাঁর শত্রুর কি আর শেষ রাখতে পারি আমি ?" এমন নির্মলহৃদয় চরিত্র সাহিত্যের পাতায় বেশ কিছু থাকলেও, আমাদের বর্তমান সমাজে খুবই বিরল । সেই জন্য এই সহজ সরল মানুষটি খুব সহজেই আমাদের মন জয় করে নিতে পারেন ।


    এবারে খোদ তিলুবাবু ওরফে প্রোফেসর শঙ্কুর কিছু বিশেষ পরিচয় দেওয়া যাক । তাঁর পুরো নাম ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু । গিরিডির স্কুল থেকে মাত্র বারো বছর বয়সে ম্যাট্রিক পাশ করে তিনি কলকাতায় যান কলেজে পড়ার উদ্দেশ্যে । চোদ্দ বছর বয়সে আই.এস.সি. এবং ষোল বছরে ফিজিক্স-কেমিস্ট্রিতে ভাল অনার্স নিয়ে বি.এস.সি. পাশ করেন । বিশ বছর বয়সে কলকাতার স্কটিশচার্চ কলেজে পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসাবে কাজে যোগ দেন । কাজকর্ম চলছিল ভাল, এর মধ্যেই তাঁর পিতা, শ্রী ত্রিপুরেশ্বর শঙ্কু অসুস্থ হয়ে পড়েন । তাঁর হয়েছিল হার্টব্লক রোগ যাতে হঠাৎ হঠাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায় । তিনি আয়ুর্বেদিক ছিলেন, "লোকে বলত ধন্বন্তরি" । একবার টিকড়ীবাবার শিষ্যরা তাঁকে নিয়ে আসে শঙ্কুর পিতার কাছে শ্বাসকষ্টের চিকিত্সার জন্য । তিনি যখন টিকড়ীবাবার জন্য ওষুধ তৈরি করছেন, সেই সময় সাধু তাঁকে স্বর্ণপর্ণীর সন্ধান বলে দেন, এবং এও বলেন যে হার্টব্লক রোগ এই গাছের পাতাতেই সারবে । কিন্তু, তখন আর হাতে এত সময় ছিল না তাঁর পিতার যাতে করে সূদূর কসৌলিতে গিয়ে এই গাছের সন্ধান করা যায় । শঙ্কুর কলেজে চাকরি পাওয়ার চার বছর পর, এক দূর্গাপূজায় ঐ রোগেই তাঁর পিতার মৃত্যু হয় । পিতার মৃত্যুর পর কালকা থেকে ছেচল্লিশ কিলোমিটার দূরে সাড়ে ছ'হাজার ফুট উঁচুতে ছোট্ট শহর কসৌলিতে গিয়ে চামুণ্ডার মন্দিরের পিছনের এক জঙ্গল থেকে স্বর্ণপর্ণীর গাছ খঁংউজে নিয়ে আসেন শঙ্কু । এই গাছের পাতা থেকেই তৈরি হয় মিরাকিউরল বড়ি । এরপর তিনি একে একে তৈরি করেন "অ্যানাইহিলিন পিস্তল,.. যা শত্রুকে নিহত না করে নিশ্চিহ্ন করে এয়ারকণ্ডিশনিং পিল -- যা জিভের তলায় রাখলে শরীর শীতকালে গরম আর গরমকালে ঠাণ্ডা রাখে লুপ্তস্মৃতি ফিরিয়ে আনার জন্য রিমেমব্রেন ঘুমের অব্যর্থ বড়ি সমনোলিন অতি সস্তায় উজ্জ্বল আলো দেবার জন্য লুমিনিম্যাক্স অচেনা ভাষা ইংরেজিতে অনুবাদ করার জন্য লিঙ্গুয়াগ্রাফ পাখিকে শিক্ষা দেবার জন্য অর্নিথন ।" এছাড়াও নার্ভিগার, অমনিস্কোপ, স্নাফগান, ম্যাঙ্গোরেঞ্জ, ক্যামেরাপিড ইত্যাদি তো আছেই । গবেষণা এবং আবিষ্কার ছাড়া বিভিন্ন রহস্যময় অভিযানে অংশ নিয়েও বহুবার বিশ্বভ্রমণ করেছেন শঙ্কু । আবিষ্কারক হিসাবে টমাস আলভা এডিসনের পরেই তাঁর স্থান পাঁচটি মহাদেশেই স্বীকৃত । এহেন মানুষটির চেহারা নিয়ে একটা আগ্রহ তো আমাদের জাগতেই পারে । তাঁর নিজের ভাষায় তাঁর চেহারার যা বর্ণনা পাই, তা মোটামুটি এই রকম, "শোবার ঘরে ঢুকতেই একটা বিদঘুটে চেহারার লোকের সামনে পড়তে হল । চমকে গিয়ে চিত্কার করেই বুঝতে পারলাম যে, ওটা আসলে আয়না, এবং লোকটা আর কেউ নয় -- আমারই ছায়া " ( ব্যোমযাত্রীর ডায়েরী ) ! যদিও ছবিতে দেখে আমাদের প্রোফেসরের চেহারাটা একেবারে বৈজ্ঞানিকসুলভ না-হলেও ঠিক ততটা খারাপও লাগে না -- "মাথায় চুল নেই বললেই চলে, তবে দাড়ি-গোঁফ আছে, আর চোখে একজোড়া সোনার চশমা । প্রশস্ত ললাট, চোখে তীক্ষণ বুদ্ধির সঙ্গে মেশানো একটা শান্ত সংযত ভাব " ( আশ্চর্য প্রাণী ) । সব মিলিয়ে প্রোফেসরকে কলেজ কিংবা ইউনিভার্সিটির অতি মনোযোগী কোন প্রোফেসর বা গবেষক বলে অনায়াসেই মেনে নেওয়া যায় । নীরলের মত আরো যাঁরা প্রোফেসর শঙ্কুর সঙ্গে চাক্ষুষ দেখা করার ইচ্ছা পোষণ করেন, তাঁদের জানিয়ে রাখি যে, বর্তমানে প্রোফেসরের গিরিডির বাড়ি খালি ! কারণ, তিনি প্রায় বছর পনেরো ধরে নিরুদ্দেশ । লোকমুখে শোনা যায় যে তিনি একটা ভীষণ এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে প্রাণ হারান । এও হতে পারে যে তিনি ভারতবর্ষেরই কোন নিরিবিলি অঞ্চলে লোকচক্ষুর আড়ালে গবেষণায় নিমগ্ন । মোটমাট এখন গিরিডিতে গেলেও যে তাঁর দেখা পাওয়া যাবে না, সেটা সত্যি ।


    কল্পবিজ্ঞানের সঙ্গে রহস্য এবং অ্যাডভেঞ্চারের সুন্দর মিশেলে প্রোফেসর শঙ্কু সত্যজিত্‌-এর অনবদ্য সৃষ্টি । শঙ্কুকাহিনী সম্বন্ধে বেসিক কিছু তথ্য যা দেওয়ার ছিল, দিয়ে দিয়েছি । গল্পগুলো তো আর বলে দেব না, তার জন্য পড়তে হবে । আর কি তথ্য দেওয়া যেতে পারে, সেটাই ভাবছি এখনো নীরলদের ঝগড়া পুরোদমে চলছে ! উফ, এরা পারেও বটে ! ওদের কিচিরমিচির শুনতে শুনতে আমারই মাথা ঝিমঝিম করছে, অথচ ওদের কিছুই হচ্ছে না ! সুতরাং থামাবার গরজ আমারই । কাজেই ঝগড়ারত শালিকদের উদ্দেশ্যে একটা প্রশ্ন ছঁংউড়লাম --
    -- এই যে পড়ুয়ার দল, মোট ক'টা শঙ্কুকাহিনী আছে বলতো ?
    -- ১৯৬১ থেকে ১৯৯২, এই একত্রিশ বছরে মোট চল্লিশটা প্রকাশিত হয়েছে , নীরলের স্মার্ট উত্তর ।
    -- তার মধ্যে আটত্রিশটা সম্পূর্ণ এবং দু'টো অসম্পূর্ণ । -- এবারে শুভম ।
    -- আর যেহেতু এগুলো স্বয়ং শঙ্কুর লেখনী থেকে আমরা পাই, সুতরাং এদের একটাকেও গল্প না বলে ডায়েরী বলাই যায় ! পলাশের ইচ্ছে ভবিষ্যতে সত্যজিতের মত গল্পলেখক হবে কেন সত্যজিতের মতই লিখতে হবে, অন্যরকম কেন নয় -- সেটা জিজ্ঞেস করেছ কি মরেছ ! একেবারে পাগলা "ফ্যান" !
    -- এই বছরই বইমেলাতে শঙ্কুসমগ্র বেরিয়েছে । সবগুলো গল্প আছে ওতে, এমনকী কিছু ছবিও নাকি আছে, যেগুলো আগে কোথাও বেরোয়নি । নীরল বলল পলাশের দিকে তাকিয়ে । ভাবখানা এই, আর ঠাট্টা করবি আমায় নিয়ে ?
    -- কে বার করেছে রে ? জিজ্ঞেস করেই চন্দ্রা বুঝেছে, খুব বেফাঁস প্রশ্ন করে ফেলেছে । কিন্তু, আর উপায় নেই, ফল ভুগতেই হবে !
    -- এটা একটা গাধা, কোন জগতে থাকিস বলতো ? আনন্দ পাবলিশার্স বার করেছে । -অদ্ভূত মুখ করে বলল পলাশ ।

    ঈশশ ! শুনে ফেললেন তো আপনারা ! যদি ভেবে থাকেন যে এরপরে আমাদের ঝগড়াঝাঁটিটা থামবে, খুব ভুল ভেবেছেন । চন্দ্রা কি তাকে গাধা বলাটা মেনে নেবে ? কক্ষনো না । কিন্তু আপনাদেরও আর আমাদের এই দঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে বসে থাকাটা একেবারেই ঠিক হচ্ছে না পাঠক ! আবার কখন কি শুনে ফেলবেন আপনারা ! তার চেয়ে বরং এবার আমরা উঠি । যাওয়ার আগে শুধু জানিয়ে দিয়ে যাই যে একটা ব্যাপারে আমরা সকলে একমত সেটা হল যে, শঙ্কুসমগ্র'র দামটা যদি আর একটু কম হত, তাহলে এই দূর্মুল্যের বাজারে আরো অনেক বাবা-মা' নির্দ্বিধায় বইটি তাঁদের সন্তানের হাতে তুলে দিতে পারতেন ।
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments