• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | Satyajit Ray | প্রবন্ধ
    Share
  • ভাষার বাঁধন ভেঙে : অনুবাদে সত্যজিৎ : গোপা মজুমদার


    উপেন্দ্রকিশোর সম্পাদিত সন্দেশ


    সুকুমার সম্পাদিত সন্দেশ


    লীলা মজুমদার, নলিনী দাশ ও সত্যজিৎ সম্পাদিত সন্দেশ

    ১৯৬১ সালে বাঙালি-জীবনে এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছিল। সত্যজিৎ রায় তাঁর বাপ-ঠাকুর্দার আমলের পত্রিকা 'সন্দেশ'-কে নতুন করে শুরু করেছিলেন। তার আগে আমার নিজের বাবা-কাকার কাছে শুনেছিলাম বটে যে ছেলেবেলায় তাঁরা খুব 'সন্দেশ' পড়তেন, সে নাকি আর পাওয়া যায় না। শুনে হাসি পেত। সন্দেশ -- আবার কেউ পড়ে নাকি, সে তো খায়! রহস্য উদ্ধার হল যেদিন উঁচু তাক থেকে দুটো বাঁধানো বই পেড়ে এনে আমার পুতুলের বাড়ির দেয়াল বানাবার চেষ্টা করতেই বাবা দেখতে পেলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে হাঁ হাঁ করে উঠলেন -- "আহা, ওগুলো না ওগুলো না। ওকি খেলার জিনিস নাকি? ও তো পুরোনো বাঁধানো সন্দেশ!" হায় রে, এই শুকনো, ছাপানো কাগজগুলো হল বাবাদের এত সাধের সন্দেশ? অবাক হয়ে গেলাম।

    যে-সময়ের কথা তখন আমি পড়তেই শিখিনি। কিন্তু তার কয়েক বছর পরেই দেখলাম শুধু বাবা-কাকাই নয়, দাদা-দিদিরাও ভীষণ উত্তেজিত হয়ে বলাবলি করছে যে সন্দেশ নাকি আবার শুরু হয়েছে। যিনি শুরু করেছেন তিনি আমার অতি পরিচিত "টুনটুনির বই"-এর নাতি, এবং "আবোল তাবোল"-এর ছেলে। তাঁর নাম সত্যজিৎ রায়। বলা বাহুল্য, ততদিনে আমি পড়তেও শিখেছি, স্কুলেও যাচ্ছি।

    নতুন সন্দেশে কত কি যে থাকত! গল্প-কবিতা-ছড়া-ধাঁধাঁ-প্রবন্ধ -- রকমারি ছবি। কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখি? ত্রক্রমে একটা জিনিস পরিষ্কার হয়ে গেল। সব লেখাই খুব ভালো লাগে। কিন্তু যে গল্পগুলো সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে, সেগুলোর নিচে দেখি একটাই নাম : সত্যজিৎ রায়।

    কলকাতায় বাঙালি ছেলেমেয়েরা কি করত জানি না। কিন্তু আমি থাকতাম দিল্লীতে, ফলে আমার ক্লাসে বাঙালি মেয়েদের সংখ্যা ছিল কম। যে ক'জন ছিল, তারা প্রায় সকলেই 'সন্দেশ' পড়ত। "বংকুবাবুর বন্ধু" গল্পটা পড়বার পর রাত্রিবেলা সবাই সোত্সাহে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে গোলাপী আলো খুঁজতাম। বলা তো যায় না, অন্য গ্রহের প্রাণী যদি হঠাৎ এই দিল্লী শহরেই নেমে পড়ে?

    গোলাপী আলো দেখা গেল না, তবে ১৯৬৫ সালে একটা আলোড়নকারী ব্যাপার ঘটল। ততদিনে প্রোফেসর শঙ্কুর সঙ্গে সকলের পরিচয় হয়েছে। এবার সন্দেশে দেখা দিল ফেলুদা ও তোপসে ("ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি")। ব্যাস, ক্লাসে বাঙালি মেয়েদের মধ্যে ফিসফিস দ্বিগুণ বেড়ে গেল। তোপসে বলেছে রাজেনবাবুকে কে যেন শাসিয়ে চিঠি দিয়েছে। ফেলুদা কি ধরতে পারবে তাকে?

    শেষকালে অবাঙালি মেয়েরা শুধু কৌতূহলী নয়, বেজায় বিরক্ত হয়ে পড়ল। ইয়ে কেয়া ফেলুদা-ফেলুদা করতে রহতে হো? ইয়ে কৌন হ্যায়? বাধ্য হয়ে ফেলুদার গল্প হিন্দি-ইংরেজি মিশিয়ে তাদের শোনাতে হল। শুনে তাদেরও চোখ গোল। ফির কেয়া হুয়া? রুদ্ধশ্বাস প্রশ্ন। আরে, কেমন করে জানব? সন্দেশের পরের সংখ্যা এলে তবে না বলতে পারব!

    তখন কি আর জানি যে অনুবাদের ব্যাপারে সেই আমার হাতেখড়ি? ধীরে ধীরে সবাই বড় হয়ে গেলাম অবাঙালি বন্ধুরা বহু গল্প শুনে-টুনে তারপর কোথায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেল। ততদিনে ফেলুদা-তোপ্সেও সন্দেশের পাতা ছেড়ে 'দেশ' পত্রিকায় দেখা দিচ্ছে। তারও কয়েক বছর পরে তারা আবার সিনেমার পর্দায় উঠে এল, দু-দুবার ('সোনার কেল্লা' এবং 'জয় বাবা ফেলুনাথ')। কতকটা সেই কারণেই অবাঙালি মহলে কিঞ্চিৎ ব্যাপকভাবে সত্যজিতের লেখা নিয়ে আগ্রহ দেখা দিল - শুধু ভারতে নয়, বিদেশেও।


    নঞধশঠংয-এর ভিন্ন সংস্করণ ঝত্ররুঠভধ


    ১৯৮৩ সালে প্রথম ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়। লীলা রায় অনুবাদ করেন 'ফটিকচাঁদ', এবং ক্যাথলিন ও'কনেল করেন শঙ্কুর কিছু গল্প। বইয়ের নাম Bravo! Professor Shonku। ১৯৮৭ সালে সত্যজিৎ রায় নিজেই কিছু ছোটোগল্প ও শঙ্কুর গল্প অনুবাদ করলেন। Stories নাম দিয়ে এই সংকলন প্রকাশ করলেন U.K.-র Secker & Warburg.

    বইগুলো দেখে পরম আহ্লাদ হল। আহা, এমন অনুবাদ আগে পাওয়া গেলে ছোটোবেলায় আমাকে আর মুখে-মুখে গল্প শোনাতে হত না। এইরকম ভাবতে ভাবতেই একেবারে আকস্মিকভাবে আমি আবার অনুবাদের ব্যাপারে জড়িয়ে পড়লাম। দিল্লীতে "নমস্তে" নমে একটি পত্রিকার জন্য ইতিমধ্যে কয়েকটি বাংলা গল্পের অনুবাদ করেছিলাম। সেই পত্রিকার সম্পাদিকা - মনীষা মুকুন্দন - হঠাৎ একদিন বললেন -- "সত্যজিৎ রায়ের কোন গল্প কর না কেন?"

    সর্বনাশ, বলে কি -- বন্ধুদের গল্প শোনানো এক জিনিস, আর অনূদিত গল্প ছেপে বের হওয়া সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। তাছাড়া, সত্যজিতের অনুমতি নেবে কে? আমি? ওরে বাবা!

    মনীষা কিন্তু ছাড়লেন না। বললেন অনুমতি নেবার ভার তাঁর নিজের, আমাকে শুধু একটা গল্প বেছে অনুবাদ করে দিতে হবে। এদিকে রয়েছে রাশি রাশি গল্প, মাত্র একটা বাছা মোটেই সহজ ব্যাপার নয়। শেষে অনেক ভেবেচিন্তে করে ফেললাম "লুই ম্যাজিসিয়ান"। মনীষা সেটা লেখককে পাঠিয়ে দিলেন। তাঁর মনে আশা আমার মনে ভয়।

    বেশিদিন অপেক্ষা করতে হল না। উত্তর এল মাত্র দুটি শব্দে -- Go ahead. । গল্পটা ছেপে বের হওয়ার পর আকাশে ভাসলাম। যাকে পারলাম ডেকে দেখালাম। শেষে বন্ধুবান্ধবরা আমাকে দূর থেকে আসতে দেখলেই বলতে শুরু করল -- Yes, yes, we have already seen it, thank you! অত উত্তেজনা, কারণ তখন আমার ধারণা যে ওই একবারই অমন সৌভাগ্য হয়েছে, আর কখনো হবে না।

    কিন্তু ঈশ্বর কৃপা করলেন। তখন মাত্র দু-তিন বছর আগে Penguin India দিল্লীতে অফিস খুলেছে। সেখানকার Chief Editor - ডেভিড ডাভিদার - ভাগ্যক্রমে "লুই ম্যাজিসিয়ান" গল্পটা দেখে ফেললেন। তার আগের বছরই চিত্রিতা ব্যানার্জীর করা চারটি ফেলুদার গল্পের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে, তাই সত্যজিতের লেখার সঙ্গে ডেভিড পরিচিত ছিলেন। আমার কাছে টেলিফোনে ভেসে এল ছোট্ট একটা প্রশ্ন -- সত্যজিৎ রায়ের আরো কিছু ছোটগল্পের অনুবাদ করতে আমি কি ইচ্ছুক? অ্যা! আমি পুনরায় বাক্যহারা। ইচ্ছুক? ওরে, সে যে স্বপ্নাতীত ব্যাপার।

    স্বপ্ন সফল হতে আড়াই বছর লাগল। যতদিনে কুড়িটি ছোটগল্পের সংকলন (20 Stories) দিনের আলো দেখতে পেল, ততদিনে লেখক আর ইহলোকে নেই। কিন্তু সেই ক'বছরে সত্যজিতের কাছে আমি যা কিছু শিখলাম, তা আমার চিরকালের পাথেয় হয়ে থাকল। আগেই শুনেছিলাম যে নতুন ও অনভিজ্ঞ লোকেদের নিয়ে কাজ করার ব্যাপারে সত্যজিৎ রায় সিদ্ধহস্ত। কথাটা কতখানি সত্যি, এবার বুঝলাম। ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে হল না ঠিকই, কিন্তু আমাকে চাক্ষুষ না-দেখেও লেখক কি করে যেন বুঝে গেলেন যে এত বড় একটা কাজের ভার পেয়ে আমি যত আনন্দিত, আতংকিত তারচেয়ে অনেক বেশি। তাই প্রথমেই ভয় ভাঙিয়ে দিলেন। অবাক হয়ে দেখলাম যে যিনি ইচ্ছে করলে আমার লেখা প্রতিটি শব্দে ভুল ধরতে পারতেন, তিনি কত সহজে আমাকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে ফেললেন। কোথাও অসুবিধে হলে চিঠিতে জানাতাম। তত্ক্ষণাৎ সমস্যার সমাধান করে দিতেন। কিন্তু তাছাড়া কখনো প্রশ্ন করতেন না যে আমি কি লিখছি, কতখানি ও কিভাবে লিখছি।


    সত্যজিতের অনুবাদে সুকুমার


    নিজে অনুবাদ করতেন বলেই নিশ্চয় সমস্যাগুলো এত ভালো বুঝতেন। সবচেয়ে বড় কথা, মূল লেখার প্রতিটি শব্দ যদি অনুবাদে ধরা নাও পড়ে, তাহলে যে মহাভারত অশুদ্ধ হয় না - এই সার সত্য আমি ওঁর কাছেই শিখেছিলাম। নিছক শব্দকে উনি গুরুত্ব দিতেন না, দেওয়া উচিত নয় বলেই। গুরুত্ব পেত শব্দের অর্থ। সেই অর্থকে বজায় রাখতে অনেক সময়ে শব্দ পালটে দিতে হত।

    একটা উদাহরণ দিলে এ-ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে। "খগম" গল্প সত্যজিৎ রায় নিজেই অনুবাদ করেছিলেন। গল্পটা প্রায় সকলেরই পড়া, তাই সোজা চলে যাচ্ছি সেই দৃশ্যে যেখানে ধূর্জটিবাবুর শারীরিক পরিবর্তন শুরু হয়েছে। তিনি অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলছেন। "সাপ" ও "শাপ" - এই দুটি শব্দের বানানের মধ্যে পার্থক্য জানতে চাইলেন। এখানে ইংরেজিতে দন্ত্য-স এবং তালব্য-শ-এর মধ্যে প্রভেদ বোঝানো অসম্ভব। তাই সত্যজিৎ পুরো ব্যাপারটাই এড়িয়ে গেছেন। "আচ্ছা, স-স-স-সাপ কি দন্ত্য স?" -- এই প্রশ্ন না করে ধূর্জটিবাবু বলেছেন, s-s-s-snake spelt with one 's'?

    এছাড়াও একটা ছড়ার উল্লেখ আছে। বাংলায় সেটা হল -- "সাপের ভাষা, সাপের শিস, ফিস্‌ ফিস ফিস্‌।" ইংরেজিতে সেটা হয়ে গেছে, Snakes speak when snakes hiss. I know this, I know this. Snakes kill when snakes kiss. I know this, I know this. এখানে অনুপ্রাসের ব্যবহার ঠিকই বজায় আছে, তবে শব্দগুলো হুবহু আর নেই।


    20 Stories -এর পরে আমাকে ভার দেওয়া হ'ল ফেলুদার বাকি একত্রিশটি গল্প অনুবাদ করার। গল্পগুলো ভালো করে পড়ে দেখলাম তাদের তিনটে ভাগে বিভক্ত করা যায় -- (১) মোটামুটি সহজ (২) বেশ কঠিন, এবং (৩) একেবারে অসম্ভব। শেষ ভাগে পড়ল চারটে গল্প : রয়েল বেঙ্গল রহস্য, ছিন্নমস্তার অভিশাপ, ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা ও গোঁসাইপুর সরগরম। প্রতিটি গল্পে দেখলাম কেবলই শব্দের খেলা, ধাঁধাঁ ও হেঁয়ালি। আমার সাধ্য কি যে সে সব অনুবাদ করি?


    কিন্তু ধীরে ধীরে একটা চিন্তা মাথায় এল। ভাবলাম, লেখক জীবিত থাকলে কি করতেন? এইভাবে হাল ছেড়ে দিতেন কি? কক্ষনো না। অনুবাদের খাতিরে বহু শব্দ পালটে দিতেন নিশ্চয়ই। কিন্তু কি ভাবে? আরো কিছু ভাবনা-চিন্তার পর তারও একটা ব্যবস্থা হল। দেখলাম যে কয়েকটা শব্দ পালটালেই হবে না, বেশ খানিকটা অংশ নতুন করে লিখতে হবে। অবশ্য সেটা করতে গিয়ে মূল গল্পের কোনরকম ক্ষতি করা চলবে না। এখন কথা হল, আমি তো আর লেখক না। লেখকের অনুমতি ছাড়া এত অদল-বদল করবার অধিকার অনুবাদকের আছে কি?

     


    এই প্রশ্নের উত্তর একজনই দিতে পারতেন। তিনি হলেন সত্যজিতের স্ত্রী। বিজয়া রায়কে জিজ্ঞেস করতেই অনুমতি দিয়ে দিলেন। অনুবাদের ব্যাপারে স্বামীর মতামত জানতেন বলেই দ্বিধা করলেন না। The Royal Bengal Mystery and Other Feluda Stories নামে চারটি "একেবারে অসম্ভব" গল্পই একত্রে প্রকাশিত হল ১৯৯৭ সালে। বই বেরিয়ে যাবার পর বহুদিন ভয়ে-ভয়ে ছিলাম। লেখকের স্ত্রী না-হয় অত্যন্ত স্নেহময়ী, ভুল-চুক হয়ে থাকলে ক্ষমা করে দেবেন। কিন্তু অন্যান্য পাঠকরা? ফেলুদার পরম ভক্ত যারা? সামান্যতম ভুলও কি তারা ক্ষমা করবে? কিন্তু না, দেখলাম তারাও সদয় হল। অন্তত এতদিনেও যখন "এসব কি লিখেছেন, যা-তা?" বলে কেউ তেড়ে আসেননি, তখন মনে হয় পরীক্ষায় পাস করেছি।

     


    ফেলুদার পঁয়ত্রিশটি গল্পই অনূদিত হয়েছে। হয়েছে অনেক ছোট গল্প, এবং কিছু শঙ্কুর গল্পও (সুরভি বন্দ্যোপাধ্যায়ের করা The Incredible Adventures of Professor Shonku )। সত্যজিৎ রায়ের লেখা পৌঁছে গেছে অবাঙালি মহলে, ফেলুদা এবং শঙ্কুর ভক্তের সংখ্যা বেড়েছে অনেক। সেটা নি:সন্দেহে পরম আনন্দের কথা। কিন্তু মাঝে মাঝে একটা ব্যাপারে খানিক অনুশোচনাও হয়, যখন দেখি যে ইংরেজি অনুবাদ সাগ্রহে পড়ছে কে? বাঙালি পাঠক। এই ব্যাপারটা যদি শুধু প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে সীমিত থাকত, তাহলে কিছু বলার ছিল না। প্রবাসে বিশেষ করে বিদেশে থেকে সবসময়ে বাংলা শেখা সম্ভব হয় না। কিন্তু কলকাতায়? সেখানে ছেলেমেয়েরা বাংলা ছেড়ে ইংরেজি পড়বে কেন? তারা শুধু ইংলিশ-মিডিয়ম স্কুলে পড়ে বলে? বাংলা পড়ার অভ্যেস নেই (যদিও স্কুলে বাংলা পড়ানো হয়), কিন্তু ইংলিশ দিব্যি গড়গড় করে পড়ে ফেলা যায় বলে? সত্যজিৎ রায় একবার একটা ইনটারভিউতে বলেছিলেন -- "একটা জিনিস লক্ষ করেছি। লোরেটো-র মেয়েরা বাংলা পড়ছে শুধু ফেলুদা পড়ার জন্য।" ("সানন্দা", তারিখ সম্ভবত জুলাই ১৯৮৬) এখন কিন্তু সেটা আর হচ্ছে না কারণ এখন ইংরেজি অনুবাদ সহজলভ্য। আগে যেটা ছিল না। তাই বাংলা পড়ার তাগিদটাই আর নেই। এটা খুবই দু:খের ব্যাপার।

     


    অনুশোচনার কথা বললাম, এবার অনুপ্রেরণার কথা দিয়ে শেষ করি। একবার একজন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন -- এই যে আমি সত্যজিৎ রায়ের লেখা এত এত অনুবাদ করি, তো আমার অনুপ্রেরণা কি? শুধুই কি লেখকের অসাধারণ প্রতিভা ও গগনচুম্বী খ্যাতি? না। সেটা যে একটা বিশাল কারণ সেকথা নিশ্চয়ই আমি অস্বীকার করতে পারি না। কিন্তু সেটাই একমাত্র কারণ নয়। আসলে, এখানে মূল প্রশ্ন হচ্ছে, অনুবাদ আদৌ করি কেন? এতে তো নাম-ডাক বা টাকা-পয়সা -- কোনটাই জোটে না। তাহলে?

    এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে ফিরে যেতে হয় সেই ছোটবেলায়, যখন স্কুলের বন্ধুদের গল্প শোনাতাম। যারা শুনতো তারা কোন প্রশ্ন করত না। কিন্তু একবার একটি অবাঙালি মেয়ে (সে আমার শ্রোতাদের মধ্যে ছিল না) কোন এক সম্পূর্ণ অজ্ঞাত কারণে বাঙালিদের ওপরে ভারি চটে গিয়ে বলেছিল -- "এক রবীন্দরনাথ কো ছোড়কে তুম্যহারে পাস ঔর হ্যায় হি কৌন?" বলামাত্র বাঙালি ছাত্রীবৃন্দ রে রে করে ওঠায় সে বেচারি পালাতে পথ পায়নি। কিন্তু তখনই একটা ব্যাপারে খটকা লেগেছিল। কেবল একগাদা লেখকের নাম আউড়ে গেলেই কি যথেষ্ট হল? লোকের নাম তো বানিয়ে বানিয়েও বলা যায়। সেই লেখকদের লেখা মেয়েটির সামনে ধরতে পারলে তবেই সে না বুঝতে পারত বাঙালি সাহিত্যিকদের নিয়ে বংগালিদের কেন এত গর্ব?

    তার চেহারা মনে আছে, নাম সঠিক মনে নেই। এখন সে কোথায় আছে ভগবান জানেন। কিন্তু আজ যদি মেয়েটিকে সামনে পেতাম, তো শুধু সত্যজিৎ রায় কেন, এযাবৎ যত বাংলা লেখার অনুবাদ হয়েছে, সবগুলো তার সামনে ধরে বলতাম, "হ্যায় হি কৌন ----- হো? ইয়ে দেখো, ইয়ে হ্যায়। ঔর ইয়ে। ঔর ইয়ে, ঔর ইয়ে ভি ... ।"

    সেই অবাঙালি কিশোরীটিই আমার অনুপ্রেরণা। সেই-ই আমার চ্যালেঞ্জ। আজ আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞ।
    ণ্ণৈঢত্ঠযচ্‌ংরু ঁণ্ণত্ষ্‌ ১৫, ২০০১
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)