• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | Shakti Chattopadhyay | গ্রম্থ-সমালোচনা
    Share
  • 'এক উন্মত্ত দরবেশের কথা', সমীর সেনগুপ্তর দু'টি বইয়ের সমালোচনা : কালীকৃষ্ণ গুহ

    মনুষ্যচরিত্র নানারকম। কবিচরিত্রও স্বভাবতই তাই। জীবনানন্দ দাশ এই শহরেই বসবাস করে গিয়েছিলেন নিজের জন্য একটি অন্তরাল রচনা করে। বিশ্বপ্রকৃতি ও অন্তর্লোকের সঙ্গে তিনি বোঝাপড়া করেছিলেন সেই অন্তরাল থেকে। শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাঁর প্রতিদিনের বেঁচে-থাকাকে একটি উৎসবে পরিণত করেছিলেন। এই শহর টের পেত তাঁর বেঁচে-থাকার কোলাহল। প্রথম জীবনে অন্তরালের একটি সময় অবশ্য তিনি যাপন করেছিলেন চাইবাসা নামের একটি লুকোনো তৎকালীন বিহারের গ্রাম-শহরে, আর এই নিভৃতযাপন থেকে অর্জন করে নিয়েছিলেন একজন কবির নক্ষত্রলোক। এই বৈপরীত্যের মাঝখানে ছিল রবীন্দ্রনাথের অবস্থান—সংসার আর বৈরাগ্য, অন্তরাল ও প্রকাশ্যতা, সৃষ্টি ও ধ্যান, গ্রহণ ও বর্জন, নির্জনবাস ও বিশ্বভ্রমণ, বহির্বিশ্ব ও অন্তর্লোক, কাজ ও বিশ্রাম—সব কিছু একাকার করে নিয়েছিলেন তাঁর মহাজীবনে। কবির জীবন কীরকম হবে, তার কোনো উত্তর নেই। অধিকাংশ সাধারণ মানুষের মতোই হয় অধিকাংশ কবির জীবন, স্বভাবতই। নীরবতা ও কোলাহলের, অন্তর্লোক ও বহির্বিশ্বের, কর্ম ও বিশ্রামের যে মধ্যপথ, তাই গ্রহণ করেন অধিকাংশ কবি। যাঁরা তা করেন না তাঁরা ব্যতিক্রম রচনা করেন। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ব্যতিক্রমী জীবনের কথা আর তাঁর কবিতার কথা বলার একটা পরিসর রচনা করে দিয়েছেন তাঁর বন্ধু ও ভক্তপাঠক সমীর সেনগুপ্ত। আজ কবি শক্তিআমার বন্ধু শক্তি নামের দুখানি বই হাতে নিয়ে সামান্য কিছু কথা বলার থাকবে আমাদের।

    || ২ ||

    আমার বন্ধু শক্তি; সমীর সেনগুপ্ত, পরম্পরা, কলকাতা, বইমেলা ২০১১, ISBN 978-93-80869-12-4

    শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জীবনযাপনের সাক্ষী এ শহরে অনেকেই এখনো জীবিত আছেন—তাঁদের অনেকেই তাঁদের বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন—তবে তাঁকে তাঁর জীবনযাপনের ও কবিতার সমগ্রতায় দেখার যোগ্যতম মানুষ অবশ্যই সমীর সেনগুপ্ত। তাই শক্তির সম্পর্কে প্রায় যে-কোনো প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে তাঁর কাছে যেতে হবে, তাঁকে না পেলে এই বইদুটিকেই প্রধান সম্বল করে এগোতে হবে, অনন্যোপায়।

    আমার বন্ধু শক্তি-তে লেখকের প্রাথমিক স্বগতোক্তিটি সর্বাগ্রে পড়ে নিতে হয়: 'ধরে নিয়েছিলাম শক্তি থাকবে চিরকাল, মানুষকে চিরদিন ভালোবাসবে, পশুপাখিকে ভালোবাসবে, গাছপালাকে ভালোবাসবে। হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দেবে, ওর বিরোধ সব শুধু ওর নিজের সঙ্গে, ও পালাতে চায় শুধুমাত্র নিজের কাছ থেকে—নিজে ছাড়া আর সকলেই ওর বন্ধু। সমস্ত মানুষের সঙ্গে এত ঘনিষ্ঠতা, অথচ ভিতরে ভিতরে এত সুদূর, এমন মানুষ আর দেখব না। সামাজিকতার সম্পর্ক পার হয়ে, বাক্‌ ও অর্থের হানাহানি শেষ হবার পর একটা জায়গায় শক্তির মতো নিঃসঙ্গ কেউ ছিল না, অমন অনুপস্থিত মানুষ আর কখনো দেখিনি।' অনবদ্য এই একজনের শুরুর কথা। এমন মুগ্ধতার প্রজ্ঞাবান কথা কদাচিৎ উচ্চারিত হয়। মানুষ, গাছপালা আর পশুপাখির প্রতি ভালোবাসা নিয়েই ছিল অস্থির ও পলায়নপর জীবন শক্তির। এই জীবনভূমিতে দাঁড়িয়েই তিনি বেদনাহত দর্শক, তিনি কবি। হয়তো একজন অনুপস্থিত মানুষ। মনে পড়বে, শক্তি ব্যবহার করেছিলেন 'সুপুরি বড়ো অনুপস্থিত গাছ'এর মতো অত্যাশ্চর্য বাক্যবন্ধ। প্রায় ৩৮ বছর ধরে নিরন্তর মেলামেশা করেও শক্তি অপরিচিত তথা অনুপস্থিত থেকে গেছেন লেখকের কাছে। এমনই একজন রহস্যময় অনাবিষ্কৃত মানুষ ছিলেন তিনি, যিনি নিজেই জানতেন না পরের মুহূর্তটিতেই তিনি কীসের সাড়া পাবেন, কোন পথ ধরবেন, কোথায় গিয়ে পৌঁছবেন। আমরাও জানি যে, 'সমাজের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের সভায় শক্তি যতটা স্বচ্ছন্দ, কালীঘাট ব্রিজের তলায় চুল্লু আর বাদুড়ের রোস্ট ঘিরে বসা ডোমদের আড্ডাতেও সে ততটাই নিঃসংকোচ।' লেখক একে একে শক্তির অরণ্যভ্রমণ, গ্রামভ্রমণ, শহরভ্রমণ, প্রেম-বিবাহ, সংসার পাতা, সংসার ছেড়ে পালানো, গানগাওয়া-সহ সমস্ত বেঁচে-থাকার বিবরণ উপস্থিত করেছেন সহমর্মিতার চূড়ান্তে পৌঁছে। শক্তির গান শোনেনি, এমন কোনো সমসাময়িক কেউ হয়তো ছিল না। লেখকের মতে শক্তির গান ছিল সাধকের গান, যেমন ছিল রামপ্রসাদের গান। "হৃদয়ে তোমার দয়া যেন পাই" গানটা একবার শক্তির গলায় শুনে লেখকের মনে হয়েছিল, 'শুনতে শুনতে বুঝতে পারি শক্তি কত বড়ো বিশ্বাসী ছিল: আমার মতো পাথুরে নাস্তিকের বুকেও জাগিয়ে তুলতে পেরেছিল অমৃতের আকুতি, যে আমি স্বপ্নে ছাড়া অমৃতের অস্তিত্বে বিশ্বাসই করতে অক্ষম।' অন্য একটি প্রবন্ধে লেখক জানাচ্ছেন, 'অজস্র আগাছা চিনত শক্তি, নাম জানত।' শক্তির লেখায় উল্লিখিত গাছগাছড়ার একটি তালিকা বানিয়েছিলেন তাঁর উদ্ভিদবিজ্ঞানী বন্ধু ড. শম্ভুলাল বসাক। সেই তালিকায় নাকি তিনশোর বেশি নাম ছিল। কথাটা আমাদের অবিশ্বাস্য লাগে, যদিও জানি কথাটা অবিশ্বাস্য নয়।

    লেখক শক্তির এক কবিতা লেখার দুপুরে উপস্থিত ছিলেন কলকাতার বাইরের কোনো এক মফস্বল শহরে। এ বিষয়ে লেখকের বর্ণনা, 'একদিন এক দুপুরে চারপাঁচটি কবিতা লিখল শক্তি। তার মধ্যে একটি হল 'অবনী, বাড়ি আছো?' আর একটি 'আমি স্বেচ্ছাচারী'। ঘরের মধ্যে আমি আর শক্তি, বাইরে দাউদাউ করা দ্বিপ্রহর। মনে আছে লেখা শেষ করে এক হাতে গেলাসে মহুয়া, চিত্রাপাথর থেকে ভোরবেলা সংগ্রহ করে আনা, আর হাতে সদ্যরচিত পাণ্ডুলিপি, উন্মত্ত দরবেশের মতোই শক্তি পদদাপ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে—ঈষৎ স্খলিত কণ্ঠে সেই টাটকা কবিতা পড়তে পড়তে।' শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মতো কবিকে ওই 'উন্মত্ত দরবেশে'র ভূমিকায় সদ্যরচিত কবিতাপাঠরত অবস্থায় দেখতে পাওয়ার সৌভাগ্য লেখকের ঘটেছিল তা জীবন জুড়ে উদ্‌যাপিত হওয়ার মতোই। আর, ভাবা যায়, ভোরবেলার প্রথম কাজ ছিল বাস্তবের দৈনন্দিনের অমৃত সংগ্রহ করা!

    শক্তিসান্নিধ্যে লেখকের রামকিঙ্করের আস্তানায় রাত্রিযাপনের রোমহর্ষক বর্ণনাটি কোনো পাঠকই কোনোদিন ভুলতে পারবেন না। (লেখাটির ভাস্বতী ঘোষ-কৃত ইংরেজি অনুবাদ 'পরবাস'-এ পাওয়া যাবে—সম্পাদক।) প্রচুর দেশি অমৃত তথা গরল পানের পর বেঁহুশ অবস্থা থেকে শেষরাত্রে সহসা চোখ মেলে লেখক দেখেছিলেন নগ্ন রামকিঙ্কর তাঁর এক অর্ধসমাপ্ত ভাস্কর্যের দিকে লণ্ঠনের আলোতে একদৃষ্টে তাকিয়ে বসে আছেন। লেখকের ভাষায়, 'ডান হাতের মুঠোয় ভাতের গ্রাসের আকারের একটা মাটির তাল। টুলে বসে, স্তব্ধ হয়ে কাজটির দিকে তাকিয়ে আছেন রামকিঙ্কর, স্থির। লক্ষ লক্ষ মশা ছেঁকে ধরেছে, তিনি টের পাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে না। তাঁর চোখে একটা অদ্ভুত ভাবলেশহীন দৃষ্টি, রামকৃষ্ণদেব যাকে বলেছিলেন যোগীর দৃষ্টি।' ঘুরতে ঘুরতে নবীনদাস বাউলের আখড়াতে গিয়ে পড়তেন শক্তি, কখনো কেঁদুলির পথে, কখনো অকারণেও। বোঝা যায়, এইসব সহজিয়া সাধক-স্রষ্টাদের মধ্যে শক্তি তাঁর স্বাভাবিক স্থান খুঁজে পেতেন তাঁর অধীত নাগরিক প্রজ্ঞা ও পঠনপাঠন সত্ত্বেও। গীতা মেঘদূত কুমারসম্ভব বা রিল্‌কের অনুবাদক বাউলমেলায় শুয়ে রাত কাটাচ্ছেন, এমনটা হওয়াতেই যেন জীবনের এক সামগ্রিকতায় পৌঁছনো! শক্তি পেরেছিলেন এই সামগ্রিকতার পথে এগিয়ে যেতে বহু দূর, যে-যাত্রার মূল্য হয়তো অকালমৃত্যু। বিরাট জীবনীশক্তি ছিল বলেই শক্তি হয়তো তাঁর অকালমৃত্যু অনেকটা পেছিয়ে দিতে পেরেছিলেন—১৯৩৩-এর জাতক হয়ে ১৯৯৫ পর্যন্ত—৬২ বছর ৪ মাস বয়স পর্যন্ত। তাঁর ছিল এক অতিজীবিতের বাঁচা, যে বাঁচায় কোনো সাবধানতার বা সংযমের স্থান নেই।

    || ৩ ||

    কবি শক্তি; সমীর সেনগুপ্ত, পত্রলেখা, কলকাতা, ২০১১।

    এবার সমীরের কবি শক্তি বইটি নিয়ে দুয়েকটা কথা বলতে চাইব, যদিও এই বই নিয়ে অজস্র কথাই বলার থাকে। শক্তির কবিতা নিয়ে অনেক লেখা লিখেছেন সমীর যেহেতু তিনি শক্তির জীবন ও কবিতার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিলেন বলা যায়। তিনি শক্তির জীবনীকার এবং এই সূত্রে, একজন শক্তি-গবেষকও বটে—শক্তির অগ্রন্থিত কবিতার সংগ্রাহক ও সম্পাদক। ফলে লেখার তাঁর অনেক কিছুই ছিল—জরুরি লেখা সবই। সেইসব লেখা থেকে ১৬টি নিবন্ধ নিয়ে এই গ্রন্থ, যার সঙ্গে পরিশিষ্ট হিসেবে যুক্ত হয়েছে অতি মূল্যবান সযত্নরচিত পূর্ণাঙ্গ জীবনপঞ্জি ও গ্রন্থপঞ্জি।

    প্রতিটি নিবন্ধই সুচিন্তিত। প্রথম নিবন্ধটিতেই লেখক তুলেছেন কবিতাজগতে শক্তির প্রবেশের প্রসঙ্গটি, প্রত্যাশিতভাবেই। এবং বলতেই হবে, কবি হিসেবে শক্তির প্রবেশ ছিল 'জরাসন্ধ'র মতো একটি অত্যাশ্চর্য কবিতা নিয়ে—তাঁর দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রকাশিত কবিতা, যার শিহরন এখনো অনুভব করার মতো। "আমাকে তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে নে": এই গদ্য পংক্তিটি দিয়ে যে-কবিতার শুরু তার মধ্যে দিয়ে উচ্চারিত হয়েছে এক দার্শনিক ও আস্তিত্বিক প্রশ্ন, যা মায়ের উদ্দেশে স্থাপিত। কোন্‌ মা, তা অবশ্য নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। গর্ভধারিণী মা নাকি বিশ্বপ্রকৃতি! এই জিজ্ঞাসা এড়ানো যায় না। ফলে কবিতাটি বিস্তার পেতে পেতে এগোয়। বলে, "আমার যা-কিছু আছে তার অন্ধকার নিয়ে নাইতে নামলে সমুদ্র স'রে যাবে শীতল স'রে যাবে মৃত্যু স'রে যাবে।... অন্ধকার আছি, অন্ধকার থাকবো, বা অন্ধকার হবো।" বিহ্বল বাংলা কবিতার পাঠক তাঁকে মুহূর্তেই বরণ করে নিয়েছিল। (কবির স্বকন্ঠে আবৃত্তি 'পরবাস'-এ পাওয়া যাবে—সম্পাদক।)

    সমীর একজন গবেষকের মতোই দেখিয়েছেন যে প্রথম বইয়ের ৭৬টি কবিতার মধ্যে অধিকাংশ কবিতাতেই—৫১টিতে- কোনো-না-কোনোভাবে মৃত্যুর প্রসঙ্গ আছে। তিনি জানাচ্ছেন, 'মৃত্যুর কথা শক্তির কবিতার একটি প্রধান চিন্তা, সারা জীবন ধরে শক্তি মৃত্যুর কথা বলে গেছে।' ঠিকই। মৃত্যুর কথা তারাই বেশি বলে যারা বেশি আত্মপ্রেমী, অভিমানী, অমরতাকাঙ্ক্ষী, দুঃখকাতর। শক্তির কবিতায় দুঃখবোধ সম্পর্কেও লেখকের একটি অবলোকন পাই যা শুনে নিতে হবে। তাঁর প্রেম একই সঙ্গে শারীরিক ও অশরীরী, অকথ্য ও অনির্বচনীয়—অনিবার্যভাবে পাপোন্মুখ, অনিবার্যভাবে অমৃতাভিলাষী। তিনি আমাদের বুঝতে দেন যে দুঃখ সুখের বিপরীত শব্দ নয়, দুঃখেই মানুষের প্রধান প্রয়োজন। মানবস্বভাব যেহেতু স্বাভাবিকভাবে বিশুদ্ধ নয়, দুর্বারভাবে পাপোন্মুখ, তাই দুঃখের চেতনা তার কাছে নিতান্ত প্রয়োজনীয়। দুঃখবোধই তার শোধনাগার, পার্গেটরি, যার ভিতর দিয়ে সে দুঃখকে অতিক্রম করে যাবে না, দুঃখকে অস্তিত্বের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে শিখবে।' এই অবলোকনটিকে আমরা একটি তত্ত্ব হিসেবে গ্রহণ করতে পারি—শক্তির কবিতার সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে অথবা না জড়িয়ে। তবে আমরাও মনে করি শক্তি ছিলেন একজন ভয়াবহ রকম আত্মপ্রেমী বা অহংবোধে ব্যাকুল মানুষ, ব্যথিত সে অহংবোধ। বলা যায় তিনি ছিলেন একজন ব্যথাপথের পথিক। তাঁর কবিতার পাতালে বা কেন্দ্রে তাঁর আস্তিত্বিক আসনখানি দেখতে পাওয়া যেত। কিন্তু লেখকের পূর্ব-উল্লিখিত মন্তব্যের সঙ্গে যখন মিলিয়ে নিতে হয় লেখকের এই সিদ্ধান্ত যে 'সমকালীন কবিদের মধ্যে শক্তির কবিতা সবচেয়ে আধ্যাত্মিক, সবচেয়ে নিরাসক্ত', তখন কিছু ধন্দ লাগতে পারে। 'আধ্যাত্মিকতা' জিনিসটা কী সে-বিষয়ে আমাদের ধারণা কিছু অস্পষ্ট। অন্তহীন স্থানকালের মধ্যে মনঃস্থাপন করাও আধ্যাত্মিকতা হতে পারে যেখানে ঈশ্বরের কোনো ভূমিকা নেই। সে অর্থে প্রায় সব কবিই কিছুটা আধ্যাত্মিক—অন্তত সেইসব কবি যাদের কবিতা জনসেবার কাজে নিয়োজিত নয় বা প্রতিফলিত অর্থের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। শক্তিকে হয়তো সর্বতোভাবেই আধ্যাত্মিক বলা যায়। কিন্তু শক্তিকে কী অর্থে নিরাসক্ত বলা যাবে তা নিয়েই কথা। যদি কেউ দুঃখাভিভূত হন, অহংব্যাকুলতায় কাতর হন তাহলে কি তাঁকে নিরাসক্ত বলা যাবে? আমাদের বিনীত ধারণা দুঃখানুভূতি বা বেদনাবোধ ছাড়া কোনো সার্থক অনুভূতিতে পৌঁছনো যায় না যা অনূদিত হয়ে কবিতা হয়ে ওঠে। আমরা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, যেমন সমীর বলেছেন, শক্তিকে দুঃখবেদনায় আক্রান্ত এক রূপদর্শী হিসেবেই দেখেছি, ঠিক নিরাসক্ত শীতলতায় পাইনি। কথাটা হয়তো অনেক বিশ্লেষণের দাবি রাখে। কথাটা পাঠকের সামনে রাখা থাক আপাতত।

    লেখকের আরও অনেক মূল্যবান অবলোকন ছড়িয়ে আছে বইটিতে। রয়েছে শক্তির ছন্দ ও ভাষা ব্যবহারের বৈচিত্র্য ও ব্যাপকতা নিয়ে অনেক মূল্যবান কথা। সংস্কৃত শব্দ, রাবীন্দ্রিক শব্দ, সাধু ক্রিয়াপদ, ধ্রুপদী বিন্যাস সবই শক্তি ফিরিয়ে আনলেন বাংলা কবিতায়। আধুনিক বাংলা কবিতার তাত্ত্বিকদের উত্তরীয় খুলে নেবার সাহস ও ক্ষমতা তাঁর ছিল। শক্তি বলেছিলেন, 'আমি অপরিমেয় ইতর ও গ্রাম্য ভাষাকে সরাসরি সমাজে ব্যবহারে আগ্রহী।' বিদ্বান ও সাবধানী পাঠকসমাজকে ধাক্কা দিয়েছিলেন তিনি, যা এসে লেগেছিল মূল্যবোধে। এরকম ধাক্কা তাঁর কৃত্তিবাসী সহযাত্রীরা অনেকেই দিয়েছিলেন অবশ্য। ছন্দের ব্যবহারে শক্তি ছিলেন বলা যায় জন্মসিদ্ধ। কত যে শব্দ-ছন্দ-মিলের খেলা দেখিয়ে আশ্চর্য ধ্বনি রচনা করেছেন তিনি! তবে মনে রাখতে হবে মাত্রাবৃত্ত ছন্দে শক্তির অনেক পূর্বসুরি—তিরিশ ও চল্লিশের দশকের কবিরা এবং সমকালীন কবিরা—অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তশঙ্খ ঘোষ বিশেষ করে—খুবই চমকপ্রদ কাজ করে গেছেন। অর্থাৎ এক্ষেত্রে শক্তিকে সর্বোচ্চ স্থান দেবার প্রস্তাবটিকে আলোচনার ঊর্ধ্বে রাখা যাবে না। আসলে শক্তি সমস্ত রকম ছন্দেই অত্যন্ত সার্থক কবিতা রচনা করেছেন অক্লেশে এবং প্রচুর পরিমাণে। প্রাচুর্যও তো প্রতিভারই লক্ষণ! জীবিতকালে প্রকাশিত ওঁর বইতে কবিতার সংখ্যা ২১৭৬। পরেও বহু কবিতা সংগৃহীত ও গ্রন্থভুক্ত হয়েছে। (এখনো পর্যন্ত অপ্রকাশিত একটি কবিতা 'পরবাস'-এ পাওয়া যাবে—সম্পাদক।)

    লেখক একটি চমকপ্রদ মন্তব্য করেছেন শক্তির কবিতার মৌলিকতা বিষয়ে: 'শক্তির কবিতার মূল বস্তু শৈব আস্তিকতা, যেমন জীবনানন্দের মূল বস্তু বৌদ্ধ নাস্তিকতা। শৈব দর্শনের যে প্রধান তিনটি দিক—বেঁচে থাকার আনন্দ, পার্থিব জগতের সীমাবদ্ধ তুচ্ছতার প্রতি সকরুণ ভালোবাসা, এবং সেই সঙ্গে অব্যক্ত বিরাটের প্রতি অনুরাগ—শক্তির কবিতায় কিভাবে অনুস্যুত হয়ে আছে তাকে পরতে পরতে খুলে দেখাবার জন্য পৃথক পরিসরের প্রয়োজন।' শৈব জীবনদৃষ্টি বিষয়ে আমাদের স্পষ্ট ধারণা ছিল না। লেখকের প্ররোচনায় এ বিষয়ে ভেবে দেখতে পারব যদিও রাস্তাঘাটে ঘুরে আর ছড়ানো গল্পগুলি শুনে বুঝতে পারি, 'শিব খেলাধুলায় মত্ত গাঁজাভাঙে পরিতৃপ্ত...কারণ শিবের মূল কথা ভালোবাসা ও আনন্দ।' শক্তির মোহে জীবন কাটিয়ে এসে সমীর সেনগুপ্ত তাঁকে শিবের আসনে বসাতে চেয়েছেন। তাঁকে জীবনানন্দের মুখোমুখি দাঁড় করাতে চাইছেন—সমানে সমানে। এইসব বোঝাপড়ার কাজ ভবিষ্যতের জন্য রাখা থাকবে, যেমন আমরা সকলেই জানি।

    একটি নিবন্ধে প্রাসঙ্গিকভাবেই লেখক বলেছেন, 'শেষ বিচারে ধ্বনিই তো কবিতার প্রাণ, অর্থ তো নয়।' এই প্রসঙ্গে বলা যায় যে আমাদের আলংকারিকরা 'ধ্বনিরাত্মা কাব্যস্য' বলার পরেও আরও এগিয়েছেন, বলেছেন শেষ কথা হল রস। রস কী? তার উত্তরে তাঁরা বলেছেন, রস অলৌকিক, তার ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। আসলে, মনে রাখা দরকার অর্থহীন ধ্বনি কোনো ধ্বনিই নয় আর শুধুমাত্র অর্থের প্রকাশ ঘটানো কবিতার কাজ নয়। অর্থ ও ধ্বনি এবং চিন্তা বা ভাবও 'রস' সৃষ্টি করে। প্রশ্নটি তাত্ত্বিক, তাই গুরুত্বপূর্ণ। মনে পড়ে শক্তির দিব্যোন্মাদ উচ্চারণ, "অলৌকিকের কাছে সকল আকুতি ঝরে যায়।"

    আমাদের বলার শেষ কথা হল আলোচিত বইদুটির কোনো বিকল্প নেই। মানুষ ও কবি হিসেবে শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে জানতে হলে এই বইদুটি হাতে তুলে নিতে হবে। লেখকের মতে 'তাঁর মতো বিচিত্রদ্যুতিবিচ্ছুরিত ব্যক্তিত্ব কদাচিৎ মনুষ্যসমাজে আবির্ভূত হন।' এই কথাটিকে যদি কেউ অতিশয়োক্তি হিসেবে নিতে চান, তিনি তা নিতে পারেন, তবে তাঁকে জেনে রাখতে হবে কোনো কোনো প্রসঙ্গ অতিশয়োক্তিকে সানন্দে আত্মসাৎ করে।

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments