• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৫ | জানুয়ারি ২০২২ | গল্প
    Share
  • কাঠবিড়ালি ও কৃষ্ণ : পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়







    —কাঠবিড়ালি দিদি লো, কাপড় কেচে দিবি লো?

    —দেব না লো দেবই না।

    পুকুরকে মাসি বলে ডাকে কাঠবিড়ালি, তাই ‘লো’ তার বলতে লজ্জা করে। কিন্তু ওটা বলার ঝোঁক। অনুপ্রাস। বলতেই হবে। সত্যিই সে দেবে না কেচে কাপড় তা কি আর হয়? তবু তালে তাল মেলাতে এমন অনেক কিছুই বলতে হয়। বলতে ভালো লাগে দু-জনেরই।

    সামনের দুটি লম্বা দাঁত বের করে—না, ঠিক বের করে নয়—ও দুটো তো বেরিয়েই আছে হরদম—কাঠবিড়ালি হাসত হো-হো করে।

    এখন মাসি আর তেমন মজা করে বলে না কথাটা। ছন্দের শাঁসটা কালের পোকায় খেয়ে গেছে। বেরিয়ে আছে শুধু তার কেজো বিচি। নিছকই যা না বললে নয় মাসি বলে শুধু সেটুকুই। মজাও আর হয় না তেমন। ঐ বলাটুকুই সার। কৃষ্ণচূড়ার ডালে বসে থাকে কাঠবিড়ালি। কৃষ্ণও পা ঝুলিয়ে বসে। রোজ। আজও আছে। তবু হাওয়াটা কেমন যেন এলোমেলো আজকাল। পুকুরমাসির পৌষের ভোরবেলার লেপটা—জলের ওপর সেই ঘন কুহেলিকা— সেটার তুলো যেন পাতলা হয়ে গেছে, তার তলায় মাসির দু-চোখ পেঁজা তুলোর মতন মেঘ দেখছে না, দেখছে যেন—মেঘের মতন সেই লেপের তুলো। জলসায় যেমন সব আয়োজন ঠিক করেও গুরুজির পানে জর্দা দিতে ভুল হয়ে যাওয়ার মতন সামান্য ভুলেও তাল কেটে যায়; এখানেও তাই। কী যেন নেই। আসর জমছে না। বাঁচাটা আনন্দের হচ্ছে না। মাঝে মাঝেই মনে হচ্ছে—কাঠবিড়ালির, মাসির, কৃষ্ণের—তিন জনেরই—দূর, দূর, কিচ্ছু ভাল্লাগে না।

    কৃষ্ণের অলৌকিক চশমার পাওয়ার ক্ষয়িষ্ণু হয়েছে। দূরদৃষ্টি নেই বললেই চলে। কাঠবিড়ালি বলে। কেননা কৃষ্ণ এখনো ভাবে, যদি আসে রমণীরা স্নান করতে বা স্নানের নামে জলকেলি, তাদের শাড়ি-কাপড় লুকিয়ে দেওয়ার খেলাটা আবার খেলবে।

    বসে বসে কতদিন এই আশায় কেটে যাচ্ছে। কেউ আসছে না।

    কৃষ্ণ বলে, কেন আসে না ও ভগিনী আমার—ও কাঠবিড়ালি তুমি বুঝি জানো? —যদি আমি তোমার ভাগ্নি হই তো এর উত্তর জানি না। আর যদি বুন হই তো জানি।

    —আহা আমি তো তোমায় ভগিনী বলে ডেকেছি কাঠবিড়ালি।

    —ও কথা আমার মাথার অ্যান্টেনার ওপর দিয়ে যায়।

    —যাঃ, তুমি কুবাক্য বলছ। অসত্য উচ্চারণ করছ।

    কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে কাঠবিড়ালি হঠাৎ বলল, এই, জানো দাদা, এক কবি না ‘অশ্বত্থ গাছ’ লিখতে গিয়ে ভুল করে লিখে ফেলেছিল ‘অসত্য গাছ’। পরে দেখল, অসত্য গাছ বলে কিছু হয় না বটে—শব্দটাই ভুল, কিন্তু তার কবিতা বেঁকে বসেছে—ঐ শব্দটা নাকি কিছুতেই ছাড়বে না।

    কাঠবিড়ালি কয়েক মুহূর্ত অন্যমনস্ক হয়ে রইল। তারপরে বলল, বুন বলে ডাকলে তোমার মান যায়; তাই না ভগবান?

    কৃষ্ণ বলল, ভগবান আমায় বললে?

    —না তো কি আমার বাবাকে বললাম!

    —কিন্তু আমি তো ভগবান-টগবান নই ভগিনী।

    কাঠবিড়ালিকে হতাশ দেখালো। বলল, নাঃ, সত্যের যুগ খতম দেখছি। এক শূকরছানাকে সেদিন শুয়োরের বাচ্চা বলে ডেকেছিলাম। সে আমাকে এমন কটূ একটা গাল দিল আমার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল।

    —কাঠবিড়ালি ছিঃ! এই তোমার মুখের ভাষা?

    —বা রে, আমার মুখ খারাপ কোথায় দেখলে তুমি দাদা, এ তো সেই শুয়োরের বা –

    —আবার!

    আচ্ছা ঠিক আছে। তা কী যেন জিজ্ঞেস করছিলে দাদা? লোকজনের স্নানের কথা? তা একসময় শুধু স্নানই নয়। আমার পুকুরমাসির ছিল দারুণ জৌলুস। মাসির কাছেই আসত বোধন। প্রতিবার পুজোর ঠিক আগে-আগে।

    এই কথা বলেই কাঠবিড়ালি গলা ছেড়ে গাইতে লাগল –

    শিয়াল গেল খালকে
    শুগ্নি গেল ডালকে
    আইসো বুধন ঘরকে।

    তারপর কাঠবিড়ালি আবার শুরু করল, শেয়াল-শকুন নাহয় যে যার বাসায় গেল। পুজোর সময়টা প্রবাসে কে-ই বা থাকে দাদা! তাই গানে বলছে, বোধনও এবার ঘরে আসুক।

    গানটা আরো একবার গেয়ে সরু কোমর দুলিয়ে কাঠবড়ালি একটু নেচেও নিল। ফুর্তি পেতে আপ্রাণ চেষ্টা করে গেল। কিন্তু জমল না। তবু কাঠবিড়ালি হেসে বলল, বোধনকে আদর করে মা-কাকিমারা ডাকত বুধন। আশ্বিনে জিহুড় ষষ্ঠী। সারাদিন উপোস মেয়েদের। রাত জেগে তারপর ঘরেই ছাঁকা হবে চপ, পকোড়ি, দুধপুয়া, পাপচি। একটা পাকা তাল চাই। বছরের ফল। গোটা বছর অপেক্ষার পরে—সেই যে বোশেখ-জষ্টির দাবদাহে গ্রাম পুড়েছে—গাছের ছায়াগুলি হয়ে গেছে দুপুরের চেয়ে নিচু; কোনো মানুষ সেদিন একটু দাঁড়িয়ে অপেক্ষাও করতে রাজি নয়— দৈবাৎ যে ঘুমিয়ে গেছে গাছহীন পথের পাশে দুরতিক্রম্য ক্লান্তি নিয়ে—তার চোখে রোদ আড়াল করে তাকে দুদণ্ড ঘুমোতে দিতে; তীক্ষ্ণ গলাকাটা রোদ্দুরে খাঁ-খাঁ করেছে নামোকুলির দুর্গামন্দিরের কাছটা। তারপর একদিন, অবশেষে, ঝমঝম বৃষ্টি; থুপথুপানি ফলের গাছগুলো, সেই শ্রাবণ-ভাদরেও যারা ছিল নেহাতই চারাগাছ—কালীপুজোর আগে আগে কী দ্রুত ছেলাবেলাটা উতরে গেল তাদের; গোল গোল খাঁজকাটা ফল ধরল; সেই ফলে, কালীপুজোর আগের দিন বিকেল বেলা, কিশোরী মেয়েরা চালগুঁড়ো-গোলা জলে প্রতিটি মন্দিরের চাতালে, প্রাচীরে লিখে এল নিজের নিজের নাম; নিজের সঙ্গে জড়ানো বান্ধবীর নাম; এঁকে এল কিছু লতাগুল্ম। কিন্তু নয়নাদি-র রচিত বেতস লতাটি প্রতিবার হয়ে যেত কালসর্প!

    এই কথা বলে কাঠবিড়ালি একদম নিশ্চুপ হয়ে গেল। গেল তো গেলই। রা-টি পর্যন্ত নেই। কৃষ্ণ অপেক্ষা করে থাকে। আকাশে ধকধক করে জ্বলছে কী একটা আলো। তার রং বদলে যাচ্ছে। নানারকম হচ্ছে। অথবা দেখার ভুলও হতে পারে। গ্রাম নিঝুম হয়ে আসছে। মাথাটিও যেন বেদখল হয়ে যাচ্ছে। নীল নীল কুয়াশা গায়ে এসে লাগতে দেহ শিউরে উঠল। কৃষ্ণ জানে তার কাছে অলৌকিক বলে কিছু যদি থাকে, সে শুধু অলৌকিক অক্ষমতা। সে এই কৃষ্ণচূড়ার মোটা ডালটিতে বসে আছে তো আছেই অনাদি-অনন্তকাল যাবৎ। ঐ আকাশেই একদিন হয়ে গেছে নক্ষত্রে নক্ষত্রে মহারণ। সহস্র সূর্যের মতো আলোর বিস্ফোরণ। তারপর অনিঃশেষিত অন্ধ তমিস্রার যুগ। সে আর ফুরোয় না। কৃষ্ণেরও সময় কাটতে চায় না। কোথায় ছিল তখন কাঠবিড়ালি? ওঃ, তাকে ছাড়া কী দুঃসহ ভারাক্রান্ত ছিল সেই কালখণ্ডটি। এই পুষ্করিণী তখনো ছিল যতদূর মনে পড়ে। কিন্তু তা কী করে সম্ভব? অথচ মনে হয়, সে ছিল মূক। তার জল ছিল অন্ধকার। নিজের ছায়া দেখতে গিয়ে হতাশায় মৃদু শিরশ্চালন করতে করতে কৃষ্ণ পড়েছে বসে। কত সহস্র বছর হবে এইসব ঘটনার ঘটে যাওয়া? তারপর এল কাঠবিড়ালির সঙ্গে সদাপ্রসন্নতার দিন যাপন। দৃষ্টির মুক্তি। আকাশ পানে চেয়ে চোখ জুড়িয়ে যাওয়া। ‘এতটা সময় তুমি শুধু বসে বসেই কাটিয়ে দিলে দাদা?’—এই ভর্ৎসনায় কতদিন পরে—হয়তো জীবনে প্রথমবার হা-হা করে কৃষ্ণ উঠল হেসে। কাঠবিড়ালি অবশ্য বলে, না, দাদার এইসব ভাবনাগুলি উৎকট। তারা দু’জনই আসলে রয়েছে একজন কারুর স্বপ্নে। সে-স্বপ্নে বহু কিছু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু আছে। আবার হরেক স্বপ্নের মতোই তা যুক্তি পারম্পর্যহীনও বটে। তবু কৃষ্ণের মনে হয় কাঠবিড়ালির এই সন্দর্ভটি যেন বড়ো বেশি নিষ্ঠুর। কথাটি ভেবেই অমনি কৃষ্ণের কালঘাম ছুটছে। তার অস্তিত্ব—তার ও কাঠবিড়ালির, কাঠবিড়ালি ও নয়না নান্মী পাগলিনীর মধুর জটিল সম্পর্কের স্বতঃপ্রণোদিত বন্দোবস্ত সবই কি তবে স্বপ্ন-ঘটিত! যে-মানুষ এই অসাধারণ স্বপ্নটির মালিক সে ঘুম ভেঙে অতি প্রভাতে, একদিন, এই সমস্ত কিছু হারিয়ে কাঠকয়লা ও নুন-তেলের হিসেব কষতে বসবে?

    কাঠবিড়ালিকে বুকে জড়িয়ে ধরে কৃষ্ণ কাঁদছে। এমন যেন না হয় কাঠবিড়ালি। আমাকে বাঁচাও।

    যেন কাঠবিড়ালির হাতেই সব কিছু। কাঠবিড়ালিই ঈশ্বর।

    কাঠবিড়ালি হঠাৎ নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আগের প্রসঙ্গ ধরল।

    কাঠবিড়ালি বিড়বিড় করে বলতে লাগল, কালসর্প! ঘাড়টা আবার একটু বাঁকিয়ে বলল, ওরে বাবা, কালসর্প! তারপর নিজেকেই জিজ্ঞাসা করলো, আচ্ছা আগামীকাল-সর্প না গতকাল-সর্প?

    কৃষ্ণ বুঝল কাঠবিড়ালি এমনই আপন মনে বকতে থাকবে কিছুক্ষণ। পরে ঠিক হয়ে যাবে আবার। কিন্তু ভাবের এই খেলাটা যখনি শুরু হয় এমন একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটতে থাকে যার ব্যাখ্যা কৃষ্ণ কিছুই খুঁজে পায় না। কাঠবিড়ালির ভাবের অন্তর্গত দৃশ্যাবলী সে নিজেই দেখতে পায়। তখন সে বড়ো অপদস্থও হয়। নিয়ন্ত্রণের সুতোটা থাকে কাঠবিড়ালির হাতে আর কৃষ্ণের কিছুই করার থাকে না। এখন যেমন চারিদিক ধোঁয়ায় ধোঁয়াক্কার। একটা ভাঙাচোরা রথ। তার একটা চাকা কাদায় বন্দী। সামনেই এক আহত মুমূর্ষু ব্যক্তি যার মৃত্যু আসন্ন। লোকটির মাথা কোলের ওপর রেখে বসে আছে কাঠবিড়ালির নয়নাদি। পরনে সাদা থান। ভিজে চুল এলো করা। কৃষ্ণের কেন জানি মনে হলো এই দৃশ্যটি অসঙ্গত। কারণ কৃষ্ণ কাঠবিড়ালির নয়নাদিকে এ পর্যন্ত দেখেইনি। আবার এই শোকাবহও অদৃশ্যপূর্ব। তাহলে নয়নার কথা কিংবা এখানে তার অনুপস্থিতির কথাই বা কৃষ্ণের মনে এল কেন? রমণীর মুখ দারুণ চিন্তাক্লিষ্ট। কতদিন যে খায়নি তার ঠিক নেই। মৃত ব্যক্তিটির খোলা চোখ সরাসরি আকাশে স্থাপিত। এই লোকটিকেও কৃষ্ণের বেশ পরিচিত বলে মনে হলো। তার মধ্যেই একবার তার মনে কাঠবিড়ালির কথাও এসে গেল। কাঠবিড়ালি কোথাও নেই, কিন্তু হঠাৎ এক মধুর বেয়াদপি এসে কৃষ্ণের কানে কানে বলে গেল, দাদা, এই সেই কালসর্প আর এই তার ছোবলখানি। তুমি এখন বুদ্ধিমান হতে চেয়ো না তোমার পায়ে ধরি দাদা। তুমি বরং এইবেলা মরে যাও লোকটির মতো।

    কৃষ্ণ ভয় পেয়ে বলল, মরে যাব কীরকম?

    কাঠবিড়ালি বলল, আহা, ভাবের ভিতর একটু মরতেও পারবে না তুমি?

    কৃষ্ণ কী করবে কিছুই বুঝতে পারল না। সে দেখল নানা পাখির প্রত্যাবর্তন নিয়ে আস্তে আস্তে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। তার মধ্যে একদল বালিহাঁসের একটি উড়ন্ত মালাও রয়েছে। কিন্তু কৃষ্ণের চোখে তাদের কারুরই আর বাসায় ফেরা আর হলো না। নিশ্চল শূন্যে পাখির মালাটি লম্বমান হয়ে রয়ে গেল। কৃষ্ণের কাছে চিরদিনের জন্য অনিকেতরূপেই থেকে গেল ঘরে ফিরতে উন্মুখ পাখিরা। অথচ অন্য সকল জীবন্ত লোকে দেখল, পাখির মালাটি আর আকাশে নেই। ফিরে গেছে যথাস্থানে। কৃষ্ণ বুঝল ভাঙা রথের মালিক মৃত লোকটির এই দশা হয়েছে বর্তমান দর্শনের।

    কে যেন ডুকরে উঠছিল, কৃষ্ণা, কৃষ্ণা! যাজ্ঞসেনী, যাজ্ঞসেনী! নয়নাদি রা দিল না। চোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা খসে পড়ল মুক্তোবিন্দু। কৃষ্ণের একবার মনে হলো কোলের ওপর লোকটার মৃত্যু একবার পাশ ফিরল।

    তখন আবার সেই চপলমতি শিশুর মতন কণ্ঠটি শোনা গেল—যাকে কৃষ্ণ কাঠবিড়ালির গলা বলে চেনে; সেই গলা বলল, কালজয়ী হওয়া কি ভালো দাদা! দেখলে তো কেমন নাকানিচোবানি খেয়ে এলে।

    কৃষ্ণ বলল, হ্যাঁ, তাই তো দেখলাম ভগিনী। সে কী নিদারুণ ক্লেশ! কী বিষম যন্ত্রণা!

    —তবে আমার একটু ভুলই হয়ে গেল গো দাদা। তার জন্যে তুমি আমায় ক্ষমা কোরো।

    —কেন?

    —বা রে, কাল আবার অন্য কেউ নাকি! তুমিই তো একাধারে প্রবৃদ্ধ কাল, আবার এই সেদিনের ছোকরাও। তোমার আরম্ভও নেই, শেষও নেই। তুমি অনাদি-অনন্ত। একথা আমি ভুলে গেলাম কী করে!

    —আমি এতকিছু নাকি? কই, জানতাম না তো। আগে তো কেউ কিছু বলেইনি আমায়।

    কাঠবিড়ালি বলল, বলেছে বৈকি। এখনো বলে। সত্যি তুমি এখনো জানো না, তুমি ভগবান?

    কৃষ্ণ বলল, ধ্যুৎ, আমি ভগবান কেন হতে যাব?

    তা-লে নিজেই বলো তুমি কে? তুমি এখানে, এই কৃষ্ণচূড়ার ডালে এলে কী করে? তোমার মা-বাবা কে? তাঁরা কোথায়?

    কৃষ্ণ হাত তুলে বলল, ও ভগিনী থামো, থামো, একসঙ্গে এত প্রশ্ন করলে প্রশ্বাস আটকে যাবে যে!

    কাঠবিড়ালি বলল, বেশ, আগে যে পর্যন্ত বললাম তার উত্তর করো।

    কৃষ্ণ কিছুক্ষণ চুপ থেকে চিন্তিত ভাবে বলল, উঁহু, কিছুই যে স্মরণে আসছে না। আমি তোমাকে জন্ম থেকেই এই বৃক্ষের ওপর দেখছি। তারও আগে থেকেই কি এখানেই তুমি আছ?

    —কী জানি!

    —আচ্ছা, তোমার স্মৃতি বোঝার অন্য রাস্তা আছে। তোমার অর্জুনকে মনে আছে? কৃষ্ণ চুপ করে আছে দেখে কাঠবিড়ালি তাকে ঝাঁকুনি দেবার চেষ্টা করে বলল, অর্জুন, অর্জুন, তোমার প্রিয় সখা। যুদ্ধে যার রথ চালিয়ে টো-টো করে ঘুরে বেড়ালে তুমি।

    কৃষ্ণ বিহ্বল হয়ে বলল, যুদ্ধ?

    কাঠবিড়ালিও অসহিষ্ণু হয়ে বলল, মহাভারতের সেই মহারণ—মনে পড়ছে না? কৃষ্ণ জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, উঁহু।

    কাঠবিড়ালি আরো অধীর হয়ে উঠল—এই তো এক্ষুণি নয়নাদি-র কোলে মাথা রেখে যে লোকটি মরে গেল—যার প্রয়াণ ছিল তোমারও মৃত্যুর আদল—তাকে চিনলে?

    কৃষ্ণ তার কর্ণমূলটি চুলকে বলল, সত্যি বলছি ভগিনী আমি জানি না।

    কাঠবিড়ালি ভারি অবাক হয়ে গেল কৃষ্ণের আচরণে।

    একটু থেমে সে বলল, উঁহু, আমারই ভুল। বাইরে তুমি যাই হও অবচেতন তোমার ভগবত্তায় টইটম্বুর। রথ-ভাঙা মৃত ব্যক্তিটির নামে তুমি কান ছুঁলে কেন হঠাৎ? সেই ব্যক্তি তো কর্ণ!

    কৃষ্ণ বলল, কিন্তু ভগবত্তা শব্দটি আমায় ভাবিত করছে।

    —কেন, ভগবত্তার কি সারবত্তা নেই? আমি একবার খুব বাজে এক গেলাস শরবতে চুপিচুপি চুমুক দিয়ে এসেছিলাম। না স্বাদ না মিষ্টি তাতে। সেই শরবতেরও একেবারে সারবত্তা ছিল না—শরবত্তাই ছিল না বলা যায়।

    —আবার কেন অর্থহীন কথা বলছ ভগিনী। শুধু বলছ না, করছ-ও। নয়নাদিকে কোন যুক্তিতে তুমি ওভাবে যুদ্ধ ও মৃত্যুর মাঝে এনে ফেললে? তিনি না নরম কোমল এক নারী! তা ছাড়া আমি তাকে কোনোদিন দেখলামই না অথচ ভাবের ঘোরে দিব্য সনাক্ত করে পারলাম। এসব কী?

    কাঠবিড়ালি কৃষ্ণের কথার মৃদু প্রতিধ্বনি তুলে বলল, এসব কী? এসব কী? তারপর কৈফিয়ত দেওয়ার মতো করে বিড়বিড় করে বলতে লাগল, আমি একটি অকিঞ্চিৎকর জীব। আমি প্রেমের কী বুঝি! মৃত্যুর আমি কী জানি! আমি শুধু তৎকালে আমার অন্তঃস্থিত নয়নাদিকে বললাম, দিদি, তুমি আমি হবে?—না, না, বললাম যে, আমি তুমি হব?

    —আহা, এ যে গণিতের চেয়েও দুর্বোধ্য হয়ে গেল।

    কাঠবিড়ালি বিরক্ত হয়ে বলল, আমি তার কী জানি! নয়নাদিই তো জট পাকাল তারপর। আমার কথা শুনে সে আবার তার অন্তঃস্থিত পাঞ্চালীকে বলল, তুমি আমি হবে?—ইত্যাদি।

    —ওরে বাবা, এই ভাবের বহু পৈঠা যে গো! আর কতদূর গভীর?

    কাঠবিড়ালি বলল, এই হয়ে এসেছে। বেশি নেই। তা পাঞ্চালীর হৃদয় খুঁড়তে দেখা গেল, সুদীর্ঘ পাগলের মতো এক প্রেম রয়েছে তার নিজেরই অজ্ঞাত হয়ে। সেই প্রণয় ঐ হতভাগা মৃত লোকটির জন্যে। তা সেই নিঃসঙ্গ প্রেমেরও দায় অনেক। একগাদা অপোগণ্ডের মতো তার রয়েছে লালিত-পালিত অশ্রুগুলি। যে মানুষ মরে গেছে সে কিছুরই গতি দেখতে পাচ্ছে না। তার দেখা পাখিরা শূন্যে থমকে থেকে গেছে। অথচ সেই পাখিরাই অন্যের জলজ্যান্ত দর্শনে নীড়ে ফিরে গেছে। অশ্রুর মুক্তোগুলিও যে মুহূর্তে লোকটির বুকের ওপর পড়ছে ঠিক সেই মুহূর্তেই লোকটির দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সময় ছিনিয়ে নিল গতি। সমস্ত অশ্রুধারাতেই কিছ-না-কিছু পক্ষপাত থাকে। তার মধ্যে যেখানে প্রেমের পক্ষপাত অধিক তার মাধুর্যও বেশি। ভাঙা রথের সেই অবসন্ন যোদ্ধা মৃত্যুর ভিতর দেখল, তার জন্য আপাত নীরব এক নারীর অশ্রুগুলি, সেইসব বিহঙ্গের মতোই চলমানতা হারিয়েছে চক্ষু থেকে ঠিক টপকে আসার পরেই। সেই অশ্রুরা আর প্রণয়েরও প্রকাশ নয়। তাদের ভিতর এখন শুধু হিমশীতল নিরপেক্ষতা। মৃত্যুর মধ্য থেকে চাইলেও সে এর বেশি দেখতে পেল না কিছুই।

    কাঠবিড়ালি খানিক চুপ করে থাকল। সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। অসংখ্য তারায় ঝকঝক করছে শরতের আকাশ। দূর কোনায় সামান্য কালো মেঘ। তার বিস্তার কত দূর হবে কেউ জানে না।

    কৃষ্ণ অবসন্নের মতো বলল, না কাঠবিড়ালি, আর ভালো লাগে না নিগূঢ় তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করতে।

    —আবার কাঠবিড়ালি? বুন হই না?

    —ভারি ভারি কথা তুলে এমন করে বিরক্ত করলে তোমার দাদা হওয়া আর হবে না! একটু আগে নিজেই তো ভাবছিলে আমার আমার উপনেত্র অক্ষম হয়ে গেছে। হ্যাঁ, সত্যই হয়েছে। জেনে রেখো। বয়েই গেছে আমার ভগবান হবার বোঝা বইতে।

    কাঠবিড়ালি ভীষণ খুশি হয়ে বলল, এর’ম করেই কথা বলো না কেন? কেন গুমোর করে কঠিন কঠিন শব্দ বানাও?

    কৃষ্ণ বলল, মোটেও আমি শব্দ বানাই না তোমার মতো।

    কাঠবিড়ালি বলল, বাব্বা, কী ঝগড়াই না করতে পারো। কিন্তু বেশ লাগছে শুনতে।

    কৃষ্ণ ছদ্মরাগ করে বলল, ও, আমি পরিহাসের পাত্র? তুমি আমার সঙ্গে হাস্য-বিনোদ করতে চাও?

    —আচ্ছা করব না, হলো? মনে মনে বলল, ভগবানেরও এতো গোঁসা! জানতাম না বাপু।

    কৃষ্ণ হেসে ফেলল, আমি কিন্তু—ঈশ্বর হই আর না হই—মন পড়তে পারি।

    কাঠবিড়ালিও হেসে ফেলল, তার মানে তোমার চোখের এক্স-রে এখনো ঠিক আছে। এফোঁড়-ওফোঁড় হচ্ছে।

    কৃষ্ণ বলল, স্নানের বিষয়ে কী বলছিলে তুমি? সেই কথায় কথায় ফিরে যাও না গো!

    —না। আগে বুন বলে ডাকো, তবে।

    —ভগিনী।

    —না, বুন।

    —তোমার মতো কেন বলব আমি?

    —বলোই না একটিবার।

    —বুন।

    —আঃ, কী ভালো লাগল তোমার মুখে বুন শুনতে!

    —এবার আগের কথায় ফেরো।

    —এই যে গেলাম বলে। তোমার সঙ্গে কথা বলতেই তো চাই সারা দিন সারা রাত। এবার যে-কথা তুমি শুনতে চাইছিলে... তা স্নান পর্বে কেমন একটা ঘোলাটে বিকেল নেমে এসেছে। খুব দুর্দিন স্নানের। কোথায় পাবে তুমি আর—সকালে নাইতে আসা, হবু সন্ধ্যায় গা ধুতে—এমন নারীদের! পুরুষরাও এমনকি ঘরে তুলেছে স্নানকে। আগে স্নানের কাছে মাথা নত করত সবাই। ডুব দিতে গিয়ে। এখন মাথায় তুলেছে তাকেই। মাথার ওপর ফোয়ারা। ক্ষীণাঙ্গী ঝরনার মতন। কলঘর। বাথরুম। যাদের এসবের বালাই নেই তারা কলের জল বয়ে আনছে বাইরে থেকে। ভগীরথ। মা গঙ্গাকে পথ দেখিয়ে ঘরে তুলছে।

    কৃষ্ণ বলল, স্নান কি তবে এখানে একেবারেই অসূর্যম্পশ্যা?

    —তা যা বলেছ দাদা! একেবারে খাঁটি কথা। তা মানেটা যদি একটু—

    —অর্থাৎ স্নান কি সূর্যের মুখই দেখতে পায় না নাকি?

    —তাই কি পায়? আচ্ছা, সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর—তাপ্পর?

    —কলি। কিন্তু জোর করে ছন্দ মেলাবার কী আছে?

    —তা দাদা, আমার মাঝে-মাঝে ছন্দ পায়। বেগ ধরে রাখতে পারি না।

    কৃষ্ণ নাক কুঁচকে বলল, ছিঃ!

    —তারপর শোনই না। কলির আগে দ্বাপর যুগ। তারপর দাপট যুগ।

    —দাপট যুগ আবার কোনটি?

    —কেন, কলি। কলিতে তো যুগেরই দাপট। অন্য যুগে, যুগ যদি দাপট দেখাতে গেছে অমনি দাপটও তাকে যুগ দেখিয়ে ছেড়েছে।

    —কী আবোলতাবোল বকছ তুমি ভগিনী? কিছুই তো বোধগম্য হচ্ছে না।

    —কিন্তু এখন তার বিপরীত। শেয়াল গেছে না হয় খালকে। শুগ্নি গেছে ডালকে। এবার বোধন কোথায় যাবে? পুজোর আগে-আগেটা কীরকম যে খাঁ-খাঁ করে আজকাল! আহ্বান যেন নেই-ই। শুধু ঘটা করে বিসর্জন। বোধনের জন্য দুঃখ হয়, জানো দাদা। প্রতিবার সে পুকুরমাসির ঘাটের ওপর গভীর রাত থেকে অপেক্ষায় বসে থাকে। এই সবাই এল বলে! এই এল! ভোরের একটা সময় সব তারা মুছে যায়। মিশকালো আকাশ। বোধন ফিরে যায়। ভাবে, এ বছর হল না তো কী! সামনে বছর আবার সেই আগের মতন হবে।

    —তুমি কাঁদছ, ভগিনী?

    কাঠবিড়ালি অপ্রস্তুত হয়ে বলল, একদম মিছে কথা বলবে না বলে দিচ্ছি।

    —এই তো তোমার অশ্রুকণা। আমার অঙ্গুলিতে লেগে রয়েছে।

    কাঠবিড়ালি স্বাভাবিক হয়ে বলল, দূর, ওটা তো শিশির।

    —শিশির হলে শীতল হতো না?

    —বাব্বা, ওইটুকুনি উষ্ণতাও মাপতে পারো!

    —শুধু ঐ অবধিই। আর তো কিছু পারি না রে বুন।

    কাঠবিড়ালি চোখ বুজে বলল, বুন? আহা! আহা!

    কৃষ্ণ বলে চলল, অবশ্য তাতে আমি দুঃখী নই। তোমাকে বুঝলেই আমার হয়ে গেল। আমার আর কিচ্ছু চায় না।

    খানিক থেমে আবার কৃষ্ণ বলল, আচ্ছা আমি যদি তুমি হয়ে যাই? আমাকে আমার কী প্রয়োজন?

    কাঠবিড়ালি দারুণ ভাবিত হয়ে রুদ্ধ কণ্ঠে বলতে লাগল, আমাকে আমার কী প্রয়োজন! আমাকে আমার— ইত্যাদি। তারপর হঠাৎ কেঁদে ফেলে বলল, ভগবান গো, এ তুমি কী জাদু ছড়িয়ে দিলে কথাটার মধ্যে? কথাটার অর্থ আমি বুঝতে পারছি কি পারছি না তাই তো বুঝতে পারছি না।

    কাঠবিড়ালির শরীর থরথর কাঁপতে লাগল।

    কৃষ্ণ তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আলতো করে মাথায় হাত বুলোতে লাগল।

    খানিক পরে কাঠবিড়ালি শান্ত হয়ে এল।

    কৃষ্ণ ধীরে ধীরে বলতে লাগল, মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে কী জানো?

    কাঠবিড়ালি আবদার করে বলল, আগে যেমন ডাকলে তেমনি করেই ডাকো না আমাকে।

    কৃষ্ণ তার কথা না শুনেই বলে চলল, ইচ্ছে করে সব কিছু ত্যাগ করে পালাই। কিন্তু তুমি, জলের দিকে হেলে পড়া এই কৃষ্ণচূড়া, একাকী রমণী এই জলাশয়, কাউকে ছাড়তে পারি না। কী যে মায়া!

    —কী কপাল তোমার ভগবান। আবার মায়ার ফাঁদে তুমি?

    —কী জানি গো বুন, আমার এমনকি কোনো কোনো দিন ঘরে ফিরতেও ইচ্ছে হয় খুব।

    —আহা, তাই তো কালীমন্দির, তার আলো এড়িয়ে একটু ঢালাই রাস্তা আর খানিক অলিগলি পেরিয়ে, নামোপাড়ায় ব্যাঙ্কের মোড় পেরিয়ে—যেখানে দিনের বেলা বাইরের লোকের মহাব্যস্ততার মাঝে গ্রামের মানুষগুলি নিরুদ্দেশ হয়ে থাকে সন্ধ্যার আগে পর্যন্ত—তারপর শিবনাথদের পোড়ো বাড়ি ছাড়িয়ে ওদিকটায় কোথায় যে যেতে চাইছিলে একদিন!

    কৃষ্ণকে ভারি চিন্তিত দেখাল, হ্যাঁ, কোথায় যেন ইচ্ছে হয়েছিল যেতে। ভেবেছিলাম ওদিকেই যেন আমার ঘরবাড়ি। কিন্তু যেতে পারলাম কই?

    কৃষ্ণকে চিন্তিত দেখে তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গ পালটে ফেলল কাঠবিড়ালি, এই জানো দাদা, এই গাঁয়েরই একটি মেয়ে কিছুদিন আগে জার্সি গাই না কোন বিদেশে চাকরি করতে গেছে?

    কৃষ্ণের ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞাসাচিহ্ন হয়ে গেল। বলল, জার্সি গাভী নয়। নিউ জার্সি। কাঠবিড়ালি বলল, ও-ই হলো। আগে ছিল উলটো। মেয়েরা অন্তরালবর্তিনী না কী যেন বলে, কিন্তু তাদের স্নানটি, গ্রামে, ছিল একেবারে হাটখোলা। এখন তারা বহু দূর দেশে চলে যাচ্ছে। আর সেই পুরনো স্নানকে করেছে—ইয়ে— কৃষ্ণ বলল, পর্দানশিন।

    কাঠবিড়ালি বলল, পর্দার রশি! বাঃ, নতুন শব্দ। তোমার কাছে থাকতে থাকতে কত কিছু যে জানা হয়ে যায়।

    কৃষ্ণ ওর কথায় কর্ণপাত না করে বলল, সমস্যা বড়ই ভগিনী। নারীরা চারদেওয়ালের ভিতর স্নান করবেন সেটা তো ভালোই। কিন্তু তাতে যে জলাশয়রা বড়ো একা হয়ে যায়। জরার কবলে পড়ে যায় তাড়াতাড়ি।

    কাঠবিড়ালি বলল, জ্বরের কবলে পড়লে তবু রক্ষে আছে। কিন্তু জরার খপ্পরে পড়েছ কী বুড়ো হয়ে মরেছ আর কি! তাছাড়া স্নান শুধু গা ধোয়া নয়। তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ—বিষ্ণু।

    কৃষ্ণের ভ্রূ সপ্তর্ষিমণ্ডল হয়ে গেল, কে?

    কাঠবিড়ালি তাড়াতাড়ি বলল, তুমি—তুমি! তুমি নারীদের স্নানের সঙ্গে জড়িত ছিলে না এককালে? তাদের কাপড়চোপড় চুরি করে পালিয়ে যেতে না? সে কথাই বলছিলাম। তোমারই আরেক নাম তো বিষ্ণু। আমি একদিন টেবিলে একটা কবিতার বইয়ের ওপর কাঠবাদাম খেতে খেতে পষ্ট পড়তে পারলাম সেই বইয়ের মর্ম—স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ; এমনকি তোমার পোশাকি নামটা পর্যন্ত। বিষ্ণু। সে যাকগে। পুকুরকে ঘিরে স্নান ছাড়াও আরো কত কিছু যে গাঁয়ে-গাঁয়ে। একটা লোকের শরীরে যদি দিনে দিনে গত্তি লাগতে থাকে আর পাশাপাশি তার হৃদয় কমে যায়, তারপর একদিন বিরাট স্বাস্থ্যবান হয়ে যদি দেখে সে হৃদয়হীন হয়ে গেছে! এই মৌতোড় গাঁয়েও কতকটা সেইরকমই। আনাড়ি হাতের রুটির বেলতে যাওয়ার মতন শুধু বেড়েই চলেছে। এই মাসির মতন আরো অনেক দুখিনী পুকুর আছে গ্রাম জুড়ে। তাদেরও এই দশা। হৃদয়হীন স্বাস্থ্য। পুকুরহীন গ্রাম।

    কৃষ্ণ ব্যথিত হয়ে বলল, কিন্তু কেন এমন হচ্ছে গো?

    কাঠবিড়ালি বলল, কারখানা হচ্ছে কিসের যেন। নতুন নতুন লোক দেখা যাচ্ছে। মাপজোক। বাড়ছে স্থানীয় লোকেদের দাবি-সনদ। আন্দোলন। একটি দল করছে এই সমস্ত কিছু। তারাই নিয়ন্ত্রক। কিছুকাল আগেও অন্য একটি মহাশক্তিশালী দল ছিল ক্ষমতায়। দিনুর দল। সেই দলে দারুণ দলতন্ত্র। দল যা বলবে তাই। আবার দিনু দলকে যা বলবে তাই। তার ওপরে কথা নেই। তৎকালে সে-ই দলের মুখ। দীনবন্ধু ঠাকুর। সময়কে ধরে রাখতে চেয়েছিল মুঠোভরে। বজ্রমুষ্টি। মুঠো খুলতেই দেখা গেল, কিস্যু নেই। ধুলো। ঝরাপাতা, ছিন্নমূল। দিনু ঠাকুরের বদলে নতুন দলের তরুণ মুখ এখন। কিন্তু জরার চোখ আর ভীমরতি-ধরা মাথাদের কাছে সব তালগোল পাকিয়ে গেছে। তারা ভাবছে, কোথায় নতুন? সেই দিনুই তো। এ তারই প্রত্যাবর্তিত যৌবন। উঁচু গলা আর দারিদ্র্যকে পোষ মানাচ্ছে। প্রয়োজন। সবই আগের মতন। কারখানার সঙ্গেই এসে গেছে কল। আসতেই হবে। কল-কারখানা যে। জলের কল। ঘরে ঘরে। কারখানার মাথাদের মৌতোড়-গ্রামবাসীবৃন্দের চাপের কাছে নতি স্বীকার করতেই হল। কল দিতে হবে। মাথা নত না করে কি উপায় আছে! সেই লড়াকু উঠতি তরুণ মুখ আছে যে।

    কৃষ্ণ বলল, তুমি একটু আগে ঠিকই বললে, পুষ্করিণীর সঙ্গে তো মানুষের শুধু জলের সম্পর্ক নয়—

    কাঠবিড়ালি ফোড়ন কেটে বলল, জলের অন্য নাম যেমন জীবন, তেমনি জীবনের আরেক নাম জল। যে জীবন শুধু বাঁচা নয়। তার সঙ্গে হাজারো রকম কাণ্ডকারখানা। দেখলে, আমি কী করব? ঘুরে ফিরে সেই কারখানা। ঐ কারখানাই যত কাণ্ডের মূল। কৃষ্ণ বলল, ওরে বাবা! মূল, কাণ্ড, কারখানা—কথার যেন খই ফুটছে।

    কাঠবিড়ালি বলল, বোধনের কথা তো শুনলেই। তারপর আছে প্রসূতি মায়ের একুশিয়া। সন্তান যখন একুশ দিনের হবে, মা-র সেদিন প্রথম স্নান। প্রতিবেশিনীদের সঙ্গে নিয়ে মা আসবে ষষ্ঠী বটতলায়।

    কৃষ্ণ তার এককালের চক্র-ধরা আঙুলটি পুবের কোনার দিকে বাড়িয়ে বলল, ও-ই তো দেখা যাচ্ছে ষষ্ঠী বটতলা। বেহুলা পুকুরের পাড়ে।

    কাঠবিড়ালি বলল, হ্যাঁ। ওখানেই। ওর জলেই স্নান। বেহুলা-মাসি তো এই মাসিরই বুন হয়। স্বচ্ছ পবিত্র হয়ে মা আতপ চাল, ফলমূল, কাজললতা, আর প্রজ্জ্বলিত শিখা দিয়ে সন্তানের ভবিষ্যৎ নিবেদন করবে ষষ্ঠী-মা-কে। মা, তোমারই সন্তান। তোমার হাতেই রইল। দেখো।

    কৃষ্ণ বলল, কাজললতাটি কেন?

    কাঠবিড়ালি বলল, ওই দিয়ে শিশুকাল বোঝাচ্ছে। লম্ফের কালি জমিয়ে, সামান্য সরষের তেল মিশিয়ে ধরে রাখে ওটিতে। তাই দিয়ে কাজল পরায় মা তার অপত্যকে। আসলে তো তা নয়। স্নেহের সঞ্চয়।

    কৃষ্ণ বলল, বুঝেছি। ঐ একুশিয়াও একরকমের বোধন। আগামীর।

    কাঠবিড়ালি বলল, সে তুমি যা-ই বলো না কেন দাদা, কিন্তু তার দশাও ঐ বোধনেরই মতো।

    তারপর কাঠবিড়ালি কিছুটা উদাস হয়ে বলল, কত বাচ্চার মা এইভাবে কত যুগ ধরে ষষ্ঠী-বটতলায় এল—তারপর সেই শিশুরাই কালে কালে পিছিয়ে পিছিয়ে ছাই রঙের এক-একটা অতীত হয়ে গেল; তারপরও আরো পশ্চাদপসরণ করে অন্ধকার পিচ্ছিল একটা দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে, বহু পুরানো অচিন ফেরিঅলার অস্ফুট ডাকের মতো তার সেই থাকাটুকুও ‘ছিল’ হয়ে গেল; ‘নেই বলেই খাচ্ছ, থাকলে কোথায় পেতে?’—একটা মৃত শরীর কীট-কৃমিদের ভক্ষ্য হচ্ছে—সেই তার জীবন অবশিষ্ট থাকাতে কিন্তু এমনটা হতে পারছে না—ঠিক যেন এই হেঁয়ালির ঢঙে রিনিঝিনি হয়ে বেঁচে থাকে তাদের না-থাকাগুলি… কাঠিবিড়ালি স্তব্ধ হয়ে গেল। অন্ধকার কালচে আকাশে একটা গান যেন থমকে আছে। গানের বাণী আর এগোচ্ছেই না। গানটা কাঠবিড়ালি আগে কোনোদিন শোনেনি। যত দূর সে শুনতে পেয়েছে ততটা অব্দি গানের কথাগুলি তার বেশ লেগেছে— এবং কথাগুলি তার মুখস্থও; গানটা তারপরও আছে—নইলে যে খাপছাড়া হয়ে যায়! কিন্তু এর পরবর্তী থেকে সে আর সুরের ওঠাপড়া ধরতে পারছে না বা গানের বাণীও আন্দাজ করতে পারছে না গানটা পূর্বশ্রুত না হওয়ায়। কাঠবিড়ালির একবার কৃষ্ণকে বলতে ইচ্ছে করল, দেখো তো দাদা, গানটা ওভাবে থমকে গেল কিসে! কিন্তু কথাটা মুখ থেকে বেরোল না কিছুতেই। কাঠবিড়ালির বুকে মৃদু কম্পন উঠল। যদি এমন হয়—দাদার কান দিয়ে গোটা গানটি প্রবাহিত হয়ে গেছে অনেক আগেই, এবং গানের পরবর্তী বাণীও দাদা বেশ শুনতে পেয়েছে—একমাত্র কাঠবিড়ালির কাছে এসেই গানটি হঠাৎ প্রতিহত হয়ে গেছে! সঙ্গে সঙ্গে তার—মৃতের চোখে বালিহাঁসদের আকাশে আপাত থমকে যাওয়ার কথাই প্রথম এবং বেশি করে মনে পড়ল। কাঠবিড়ালির বড়ো ভয় করতে লাগল।

    সে ঐ প্রসঙ্গে গেলই না আর। আকাশ থেকে মুখ ফিরিয়ে বলল, ঐ যে বললাম ‘না-থাকাটি’ রইল বেঁচে, কিন্তু ওগো দাদা আমার, না-থাকা কি সত্যিই থাকে? অথচ মানুষের সমর্থন, থাকার মতো না-থাকার প্রতিও আছে খুব।... ষষ্ঠী-বটগাছের নিচের দিকের পাতাগুলো পুরু সবুজে আচ্ছন্ন। আবার একেবারে মগডালের কিছু পাতা এখনো পাতলা ফিনফিনে সবুজ। কচি। এদের কারুরই যেন কিছুই বদলায়নি। বদলায় না। তারা তো নিবেদিতই হয়ে আছে ষষ্ঠী-মায়ের কাছে। অনন্ত জীবনে তাদের নিজেদের ঝরিয়ে-দেওয়া নৈবেদ্যের ক্লান্তি নেই।

    কৃষ্ণ হতাশভাবে বলল, মানুষেরও অনন্ত জীবন। একক কারুকে দেখলে বুঝবে না। একজন ব্যক্তির জরা ও মৃত্যু তো থাকবেই, কিন্তু শুধু মানুষ হিসেবে মানুষ কিন্তু এ-পর্যন্ত অজর-অমর।

    কাঠবিড়ালি বলল, একজনকে চিনি যে আজও সেই পুরনো দিনের মৌতোড়েই বেঁচে আছে।

    —কে?

    —কেন তুমি নিজে বুঝতে পারছ না? কত তো বলেছি তার কথা। রোজই বলছি।

    —নয়নাদি?

    —হুঁ। সবাই বলে সে এক খেপি।

    —আর তুমি কী বলো?

    —নয়নাদি-ও বলি, খেপিও বলি। যখন যা ইচ্ছে বলি। সবেতেই সে রা দেয়। তবে অন্য কারুর মতন অন্য কিছু ভেবে খেপি বলি ভেবো না। বলি, ভরা গ্রীষ্মে টইটই করে ঘুরে বেড়াও গোটা গ্রাম, শাড়ির আঁচল মাটিতে লুটিয়ে থাকে, যত রাজ্যের আবর্জনাকে নেমন্তন্ন করে টেনে আনে, একটু কেন গড়িয়ে নিতে পারো না? নয়নাদি বলে, আমার যে একেবারে ঘুম আসে না বুন। রাতেও না যে। বলি, আমি তোমার কাণ্ড জানি না ভেবেছো! গভীর রাতে পুকু্রমাসির ঘাটে গিয়ে একা-একা বসে থাকো। কিন্তু জানো দাদা, ঘাটে বসে না, সে এক অন্য মানুষ। নয়নাদর ভাইঝি নয়নাদিকে মাঝে-মাঝে বকাঝকা করত। নয়নাদি রা-টি কাটে না। চুপ করে শোনে। আর কারো কথায় কর্ণপাত করে না নয়নাদি। ভীষণ জেদি। জেহাদিই বলতে পারো। ভাইঝি ওকে মা-র মতনই ভালোবাসে। বিকেলে চুল বেঁধে দিত জোর করে। পরিষ্কার কাপড় পরিয়ে দিত। ক্রিম মাখিয়ে। নয়নাদি ভীষণ ভালো ছিল পড়াশুনোয়। ভাইঝি তাকে দিয়ে জোর করে অঙ্ক দেখিয়ে নেয়। নয়নাদি তখন স্বাভাবিক মানুষ। বলে যে, সব কি আর মনে আছে তার? সেই কবে পড়েছে নয়নাদি। মৌতোড় মানদা সুন্দরী উচ্চতর মাধ্যমিক স্কুল। গ্রামেই। আগে হেডস্যারের যে অফিস ঘর সেটা এখন অন্য জায়গায় চলে গেছে। পুব থেকে উঠে উত্তরে। পুরনো ঘর খালি পড়ে আছে। কখনো খেয়াল হলে নয়নাদি সেই কক্ষের ভাঙা জানলা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখে। দেখতেই থাকে। ফিরতে ইচ্ছে করে না। সেই মস্ত টেবিল। কেন জানি সরায়নি কেউ। তেমনি আছে। বোর্ডে চক দিয়ে লেখা নোটিশ। একানব্বই সালের ফেব্রুয়ারি মাসের তারিখ। নয়নাদির সেবার মাধ্যমিক। বুকটা কেমন হু-হু করে ওঠে। মন বসে না কোথাও। কিন্তু সব দিন কি পিসিকে পেত সেই কিশোরী? আর আজ সেই মেয়ে নিজেই বহুদূরে। নিউ জার্সি।

    কৃষ্ণ বলল, আমি কেন গো দেখিনি তোমার সেই নয়নাদিকে?

    —দেখবে কী করে! সে যখন ঘাটে আসে, তুমি তখন গভীর ঘুমে বেহুঁশ।

    —ঠিক আছে, আজ রাত জেগে থাকব।

    —পারবেই না।

    —কেন?

    —কী জানি বাবা, কী যে দৈবযোগ!

    —একদিন মনে করো তোমার নয়নাদি ঘাটে এসে বসেছেন। কচি অলাবুর শাঁসের মতো কোমল জ্যোৎস্না ভরে গেছে চারিদিক।

    লেবুর তো শাঁস নেই! কোয়া।

    অলাবু। লাউ। তারপর শোনোই না, থমকে গেছে রাত, নিভে গেছে কালীমন্দিরের আলো –

    —আহা, পার্টি-আপিসেও তো আলো আছে।

    —সেটাও নিভিয়েই দাও না মনে মনে। তা দেখলাম, তিনি আমার কাছে এলেন। হাত রাখলেন আমার মাথায়। বললেন, আমিই সেই মানবী যার স্বপ্নে তোমরা দু-জন—তুমি ও কাঠবিড়ালি—পালিত-পোষিত। তিনি আরো বললেন, আমি সেই আমাকে দেখব কী করে! যার স্বপ্ন তাকে কি দেখা যায়! তিনি এখন স্বপ্নের বাইরে বেরিয়ে এসেছেন। এটাও অবশ্য আরেকটা স্বপ্নই—কারণ তিনি নিজে প্রকৃতই স্বপ্নের বাইরে বেরোলে কাঠকয়লার হিসেব তাকে তাড়া করবে—তাতে আমাকে ও তোমাকে তিনি যে আমানত হিসেবে জমা রেখেছেন সেটি সমূলে খোয়া যাবে। তবে সেই বিকল্প স্বপ্নেও তিনি দারুণ স্বচ্ছতায় দেখা দিলেন। সে যে কী নয়নাভিরাম দৃশ্য কাঠবিড়ালি!

    কাঠবিড়ালি সেই কথায় কর্ণপাত না করে হঠাৎ বলে বসল, নয়না+আত্মারাম। এই কৃষ্ণচূড়ারই বাকল কুঁদে লিখে রেখেছিল একটা ছেলে। অনেক কাল আগে। দীর্ঘদিন ছিলও সেই বৃক্ষলিপি।

    কৃষ্ণ বলল, এই তো। শিলালিপি। বৃক্ষলিপি। তুমিও মস্ত শব্দভাণ্ডারী। জানি, কুবাক্য তুমি ইচ্ছে করে বলো।

    কাঠবিড়ালি বলতেই লাগল, তার মধ্যে আত্মারাম নামটিকে আমি দাঁতে কেটে কেটে, অনেক দিনের চেষ্টায়—খাঁচাছাড়া অবিশ্যি করিনি, তাতে নিজেরই ক্ষতি—কিন্তু গাছ-ছাড়া করেছি বলতে গেলে একেবারে এক কথায়। রয়ে গেছে শুধু নয়না। আজও আছে।

    —এ কিন্তু তোমার ভারি অন্যায় ভগিনী। ওরা হয়তো দু-জন দু-জনকে চেয়েছিল। কৃষ্ণ বলল কাঠবিড়ালির ওপর একটু যেন ক্ষুণ্ণ হয়েই।

    কাঠবিড়ালি বলল, আত্মারাম মস্ত মানুষ হয়েছিল পরে। চোখ ঝলসানো চাকরি। বিয়ে হলো নয়নাদির সঙ্গেই। চলে গেল বোম্বে। ওফ, কত বড়ো জায়গা যে সেটা আন্দাজ করতে পারি না। তারপর গলা নরম করে বলল, হ্যাঁ গো দাদা, ওখানে কাঠবিড়ালি আছে?

    কৃষ্ণ বলল, উমম্‌, থাকা অসম্ভব নয়।

    —ও তার মানে না-ও থাকতে পারে। না, দরকার নেই তবে গিয়ে। হয়ত গাছও নেই। কাঠবিড়ালি খুব খুঁতখুঁত করতে লাগল, নাঃ। নয়নাদি বলেছিল বটে। জানলার ধারে দাঁড়িয়ে সে দেখত, দূরে দূরে গায়ে-গা দিয়ে পর পর সাজানো দেশলাই-বাক্সের মতন বিরাট বিরাট বাড়ি। আকাশ নেই। রং-চটা রোদ্দুর। সেই দেখা ছিল তার চৈত্রমাসের মাঝামাঝি। নিমফুলের গন্ধ তখন নয়নাদির গ্রামের হাওয়ায়। সাগর থেকে আসা লোনা হাওয়া নয়। একেবারে মিষ্টি। আর একটি পরিত্যক্ত উঠোন… যে তালাটি লাগিয়ে তারা শেষবারের মতো চলে গেল—সেই যে পুরু করে সিঁদুর পরা জেঠিমা, তার ব্যাটারা, ব্যাটার বউয়েরা, নাতি-নাতনি আর পক্ষাঘাতগ্রস্ত তার বৃদ্ধ স্বামী—সন্ধিপ্রসাদ জেঠু—কত কাল ধরে সেই তালা আর-সব ছোঁয়া বাঁচিয়ে সুদূর অতীতের এক ভোরবেলায় সেই তাদের স্পর্শের স্মৃতিটুকু দাঁতে দাঁত চেপে ধরে আছে… ঝরাপাতার হলুদ চেটে নিচ্ছে পাকা তালশাঁসের মতো টুসটুসে বিকেলের রোদ, খানিক পরেই এই রোদ নিজেও আবছা অন্ধকারের স্পর্শে পচে গিয়ে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে যাবে… একটা কোকিল শেষ বিকেলে ডাকছে এ-ডাল থেকে ও-ডাল সুরের আরতি নিয়ে—কিংবা সুরের আর্তিই বলা যায়… এমন কত যে হাবিজাবি ভাবত সেই রমণী। থাকা তার হলো না বোম্বেতে। এমনকি স্বামীর সঙ্গেও। চিরদিনের মতন।

    কাঠবিড়ালি চুপ করে থাকল। কৃষ্ণেরও মুখে কথা নেই। ক্রমশ আরো বোবা হয়ে আসছে গ্রাম। কালীমন্দিরের আলো সারারাত জ্বলেই থাকে। পার্টি অফিসের হলুদ বাল্ব নিভে গেল হঠাৎ। কাঠবিড়ালি মনে মনে ভাবল, এখনো সেই তাদের—নতুন পার্টির আমলে পুরনো পার্টির লোকেদের বাতি দেবার লোক আছে! মাথার ওপর দিয়ে একটা চামকিকে উড়ে গেল। ফরফর।

    কৃষ্ণই হঠাৎ বলে উঠল, ঐ নয়নাদিকে তোমার ভালো লাগে, বলো?

    কাঠবিড়ালি একবার মুখ তুলে চেয়েই সঙ্গে সঙ্গে নামিয়ে নিল।

    কৃষ্ণের হালকা হাসি শোনা গেল।

    কাঠবিড়ালি বসে ভাবতে লাগল, আমার এই না-বলা কথা তুমি যদি শুনতে পাচ্ছ পাও দাদা, পাও। শোনা অব্দি তুমি বুঝি ভাবছ, এক নারীকে ভালো লাগার কথা বলতে অন্য নারীর সামাজিক লজ্জা কী—কেননা নয়নাদির মতো আমি নিজেও নারী? কিন্তু কেউ না জানুক আমি তো জানি—দরজায় ঝোলানো গৃহসজ্জার পলকা ফাঁপা কাচের নলগুলি যেমন মৃদুমন্দ হাওয়ার কাতুকুতু মেখে পরস্পরের গায়ে ঢলাঢলি করতে গিয়ে অস্ফুট অপরিণত টুংটাং শব্দে হেসে ওঠে, আর একটুখানি মনোযোগ দাবি করে অতিথি-অভ্যাগতের—আবার বেশিরভাগ সময় সেই দাবিই যেমন তাদের আনমনা উপেক্ষার কাছে সহজেই পড়ে এলিয়ে—নয়নাদির মুখোমুখি হলে আমার অস্তিত্বের অস্থি-মাংস তেমনি করেই মিলিয়ে যায় বেমালুম; নারীত্ব—এমনকি কাঠবিড়ালিত্বটাকেও তখন স্রেফ ভুলে যাই; হয়ে যাই, বিনি পয়সার মাল—বিনি সুতোর মালার মতন—হাওয়ায় দুলতে থাকা টুংটাং শব্দের মতন বিনি অস্তিত্বের ওরাংওটাং। তখন যেন আমি নয়নাদিকেই শুধু দেখছি, দেখছি—কিন্তু কে দেখছি বা কে দেখছে জানি না, কার রক্ত খাচ্ছে ছিন্নমস্তা জানে না—এই সর্বগ্রাসী—সর্বনাশীও বলা যায়—খিদেই হয়ে ওঠে আমার সারাৎসার, অন্তত তখনকার কিছু মুহূর্তের জন্য।

    এবার দু-জনই অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে।

    হঠাৎ কে যেন কিছুটা কান্না হাওয়া-যোগে কৃষ্ণের বাঁশির ভিতর পাঠিয়ে দেয়।

    স্বাভাবিক অবস্থাটা কেটে যায়—যে অবস্থায় রোজ থাকতে থাকতে একরকমের যান্ত্রিকতার সৃষ্টি হয়, সেটা। জ্বর এসে কিছুদিন পরে আরোগ্য পাওয়া আনন্দের মতো নতুন একটা পরিস্থিতির উদ্ভব হয়।

    কৃষ্ণ বহুক্ষণ ধরে বাঁশি বাজায়। জগৎটা সেই সময় অনেকাংশে হারিয়ে গেল। বেড়ে গেল নীল নীল কুয়াশার শোভাযাত্রা। চাল-কয়লার হিসেব-করা বিষয়ী লোকটি—সেই যে তাদের স্বপ্নের মালিক—কাঠবিড়ালি ও কৃষ্ণ যার স্বপ্নের ভিতর আছে—নাকি সে নিজেই নেই, বরং সে-ই ওদের স্বপ্নের অন্তর্গত—এই দোলাচল যার বর্তমান পরিস্থিতি—সে পর্যন্ত এখন সুরের মূর্চ্ছনায় তার সমস্ত অদেয় সমর্পণ নিয়ে ঝুরোঝুরো হয়ে ঝরে পড়ছে নিজেরই স্বপ্নের ভরকেন্দ্রে—যদি আদৌ স্বপ্নটি তার হয় কাঠবিড়ালি বা কৃষ্ণের না হয়ে।

    অনেকক্ষণ পরে কাঠবিড়ালি অব্যক্ত এক ব্যথা টের পেল।

    কাঠবিড়ালি বলল, আমি আজ তোমার সঙ্গে বেশি করে গল্পে ডুবে আছি বলে মাসির আমাকে সরাসরি বলতে খারাপ লাগছে। মাসির এবার সব কাপড়-চোপড়গুলি ফিরিয়ে দেওয়ার সময় হলো।

    কৃষ্ণ বলল, রোজই তো দেখি, ফিরিয়ে দিচ্ছেন গাদা গাদা বস্ত্র। সেসব কাদের বলো দেখি!

    —মাসি ভাবে অবগাহনের স্মৃতি সে ফিরিয়ে দিচ্ছে গ্রামবাসীদের। তার জিম্মায় রাখা প্যান্ট, রুমাল, শাড়ি যা কিছু পুরনো জীর্ণ যেটি যেমন অবস্থায় পায় প্রত্যর্পণ করে নিয়মিত। আমি সেসব কেচেকুচে ধোপদুরস্ত করে মাসির এই বাঁধানো ঘাটে মেলে রাখি। কিছু শুকোয় এই কৃষ্ণচূড়ার ডালে ও তার পাড়া-প্রতিবেশী গাছেদের শাখায়। সন্ধে বেলা এই-ই তো আমার কাজ, দেখো না তুমি ঘুমিয়ে পড়ার আগে অব্দি? এসব, সবাই, যারা একদিন সাড়ম্বরে স্নান করত—জলকেলি আর পার্বণ করে থাকত সারা বছর এই পুষ্করিণীতে, এবং ধরেই নিয়েছে হারিয়ে গেছে ওগুলি, ফিরে পাবে না আর কদাপি—হারানো বলেই প্রবলভাবে গণ্য যেগুলি—তাদেরই বস্ত্র প্রতিটি।

    কাঠবিড়ালি এইসময় গলা তুলে পুকুরকে বলল, ও মাসি আগে তুমি কেমন ছিলে ভগবানকে জানিয়েছ গো?

    উত্তর এল কিছু দেরিতে।

    ভগবানের কি কিছু অজানা আছে গো মা?

    —না, তবু তুমি বলো নিজের মুখে।

    —নিজের মুখে কী বলব মাগো, ডোবা ছিলাম একটা।

    কাঠবিড়ালি কৃষ্ণকে বলল, এমন ডোবা ছিল মাসি, মাথা ডোবানোই ছিল দায়। সেই ঘোলাজলেই—হ্যাঁ, মাছ ধরতও বটে কিন্তু চানও করত গাঁয়ের আদ্ধেক জনতা।

    মুহূর্তের বিরতি নিয়ে কাঠবিড়ালি আবার বলল, সে-ই তারা প্রথম ক্ষমতায়। দিনুর দল। দোর্দণ্ড প্রতাপ। কিংবা তার চেয়েও বেশি। বলা যায়—

    কাঠবিড়ালি সঠিক শব্দ খুঁজে পাচ্ছে না দেখে কৃষ্ণ বলল, জ্বলদর্চি। প্রজ্জ্বলিত শিখা। আহা, বিপন্ন বোধ করার তো কিছু নেই। প্রতিটি কথাই তো আমিই বলছি। তোমার মুখ দিয়ে।

    কাঠবিড়ালি বলল, তবে আটকে যাচ্ছি যে?

    কৃষ্ণ বলল, সে তুমি চেষ্টা করছ না বলে।

    আমিই যদি জোর লাগাব হাঁইসা বলে তবে তুমি আর কল্লে কী? কিছু মনে কোরো না দাদা, বেশি ফুটুনি ভালো নয়। ওদের সময়ে অবতার নিয়ে আর দু-চার গণ্ডা ওদের নিন্দে-মন্দ করেই একবার দেখতে পারতে। পার্টি আপিসে তৎক্ষণাৎ ডেকে তোমারও বিচার হতো। চাই কি, দু-এক ঘা পুরস্কারও লাভ করতে পারতে।

    কৃষ্ণ বলল, যাঃ, তাই আবার হয় নাকি? অবতারদের কত্তো ক্ষমতা!

    বলেই কৃষ্ণ হা-হা করে হেসে উঠল।

    দেখলে আমি অবতার হতে চাইলেও তুমি হতে দিতে চাও না।

    হাসির পরে কৃষ্ণের চোখ ভরে গেল জলে।

    চোখ মুছে বলল, না বুন আমি এমনি বললাম। সত্যি আমি একটা স্মৃতিভ্রষ্ট লোক।

    কৃষ্ণের মুখ-চোখ অসহায়ের মতো দেখালো। কাঠবিড়ালির তবু খটকা গেল না।

    কাঠবিড়ালি বলল, সবাই জানে, যখন যা ঘটে সেসব তুমি আগেই সাজিয়ে রাখো। তবু আমার কেন জানি মনে হয়, সেইসময় ওদের বিরুদ্ধে তুমি কেরদানি দেখাতে গেলে ঐ পার্টি-আপিসে ওদের হাতে তোমার ধোপদুরস্ত হওয়ার কাণ্ডটি বাদ দেওয়ার ক্ষমতা তোমারও থাকত না। এককালে এক ব্যাধের হাতে প্রাণ দিয়ে তুমি সেবারের মতো তোমার ইহলীলা সংবরণ করেছিলে। তা সেই ব্যাধ তো শুধু ব্যাধ নয়—বেচারা বৃদ্ধ হলেও তোমার বাধ্য কম ছিল না। শর বিদ্ধ তাকে নিরুপায় হয়েই করতে হয়েছিল। তোমার কথাতেই চালিত হয়েছিল সে বেচারা। চাই কি এ যুগে দিনুই হতে পারত সেই ব্যাধ। কিন্তু সে তোমার কথার আগে শুনত না তার পার্টির কথা, বুঝেছ! তোমার গুমোর দেখানোর পরিণাম বেশি কিছু না হলেও অন্তত ক্ষুদিরামকাকুর মতো হওয়া আশ্চর্যের ছিল না।

    —তিনি আবার কে? তোমার মতোই কোনো কাঠবিড়ালি নাকি?

    —কেন, নয়নাদিকে-ও তো দিদি বলি, সে-ও কি কাঠবিড়ালিনী?

    —কৃষ্ণ বলল, ‘কাঠবিড়ালিনী’ বলে কোনো শব্দই হয় না।

    —তবে কী হয়? কাষ্ঠমার্জারিণী? তোমার তো গ্রাম্ভারী কথা খুব পছন্দ। কিন্তু গ্রামের লোক অমন ভারী ভারী কথা বলতে কক্ষনো পারে না।

    কৃষ্ণ চিন্তিত হয়ে বলল, কিন্তু ওটাও তো একটা—

    কাঠবিড়ালি প্রায় চোখ পাকিয়ে বলল, সরস্বতী-মা তোমার কে হয় গো?

    —তোমার কে হন?

    —আমার না-দেখা সুন্দরী মা।

    —আমারও।

    —তুমি খুব চালাক, না!

    কৃষ্ণ অভিমান করে বলল, বা রে, কতকাল ধরে আমি এই জলের দিকে হেলে পড়া কৃষ্ণচূড়ার ডালেই বসে আছি। আমি কি সকলের খবর জানি নাকি! কিন্তু এসব কথা তুমি হঠাৎ জিজ্ঞেস করছই বা কেন?

    সরস্বতী-মা-কে পেলে আমি নিজেই তাঁকে শুধাতাম, পুরুষ কাঠবিড়ালি কাঠবিড়াল নয় কেন? আর তাই যদি না হবে তবে মেয়ে কাঠবিড়ালির কাঠবিড়ালিনী হওয়াকে তুমি আটকাতে পারো না।

    কৃষ্ণ জোরে হেসে বলল, ও এই! এই জন্যে? এতদূর ঘুরিয়েও নাক দেখাতে পারো তুমি! আচ্ছা, ভুল হয়েছে। ক্ষুদিরাম নামের কারো কথা বলছিলে না তুমি?

    —বলছিলামই তো। তুমিই তো হাওয়া বদলে দিলে। ক্ষুদিরামকাকু ভদ্রলোক। চাকরিও করত। তাকে কী একটা ঝামেলায় ডেকে পাঠানো হয়েছিল পার্টি-আপিসে। বোধ হয় কিছু বিরোধিতা-টিরোধিতা করেছিল ওদের। সন্ধে বেলাতেই ডাকা হত। দূরের গাছতলায় বসে আছে উৎকণ্ঠিত অনেক লোকজন। তার বউ। পাঁচ বছরের মেয়েও। মা কাঁদছে। শিশুটি অবুঝ। সে ঘটনাক্রম কিংবা আসন্ন পরিণাম কিছুই বুঝতে পারছে না। সকলের চেয়ে সে-ই স্থির। শান্ত। মায়ের চোখ মুছিয়ে দিচ্ছে বারে বারে। উদ্বিগ্ন লোকগুলি প্রকাশিত নয়। তবে আছে। অন্ধকারে লুকিয়ে-চুরিয়ে। হয়ত আর না-ও ফিরতে পারে মানুষটা।

    কৃষ্ণ আঁতকে উঠে বলল, কী বললে, না-ও ফিরতে পারে? ফিরবে না কী রকম? পার্টি অফিস তো গাঁয়ের মধ্যেই। এই বৃক্ষশাখা থেকেই যে দেখতে পাই সেই ভবনের বাইরে বিদ্যুতের আলো। কীরকম ঘোলাটে। তার থেকে দু-একটি কৈশিক রেখা—একেবারে চুলের মতোই সূক্ষ্ম—এসে পড়েছে তোমার নাসাগ্রে, এতই কাছে সেটি।

    —সে তো নাহয় হলো, তা বলে যমপুরী কারুর পাশের বাড়ি হলে সে কক্ষনো মরবে না নাকি? সেটা কথা নয়। ক্ষুদিরামকাকু বেরিয়ে এল খোঁড়াতে খোঁড়াতে। এসেই মেয়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে বুকের মধ্যে পিষে ফেলে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগল। ভুলে গেল, তার প্যাণ্ট-জামা খুলে নেওয়া হয়েছে। পরানো হয়েছে একটা কাচ্ছা। ঊরুর কাছে টর্চ ফেলতে বলল সে তার বউকে। চার-পাঁচটা বাঘা-বাঘা তেঁতুলেবিছের মতন কালশিটে-পড়া দাগ।

    —‘এমন করে মানুষকে কেউ মারে!’—অন্ধকারই যেন স্বর হয়ে স্ফুট হলো।

    —‘যতদূর মনে হয় মেরেছে কিরিচের বাঁটে।’ ক্ষুদিরামকাকুর লাঞ্ছিত গলা বলল খানিক শান্ত হওয়ার পরে। চেনা লোকই মারে। দেখতে পাওয়া যায় না। আলো নিভিয়ে দেওয়া হয় আগেই। মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করতে পারে না অনেকে। ভয়ে কাঁপে। অসুস্থ হয়ে যায়। হাতে-পায়ে ধরে। কিরিচ সব সময় মুখ ফিরিয়ে লেজের আঘাত দেবে তার ঠিক কী? কামড়েও তো দিতে পারে। ক্ষুদিরামদের বিরাট একান্নবর্তী উঠোন। ঘর-ভরা পায়রা। গোটা দিন, সারা রাত পায়রার ছানারা গুমরে-গুমরে কাঁদে। ক্ষুদিরামকাকুর সেই মেয়ের মনে হয় কী একটা না-বলা কষ্ট যেন সততই থাকে ওদের। সেই রাত ক্ষুদিরামকাকু মেয়েকে জড়িয়ে ধরেই শুলো। মেয়ের মনে হল, তার বাবার বুকেও পায়রার ছানারা আছে।

    একটু থেমে কাঠবিড়ালি বলল, তাই বলছিলাম, অবতার নিয়েও তোমার রক্ষে হতো না। তুমি কার যেন একশোটা দোষ দিব্যি হাসতে হাসতে মার্জনা করে দিয়েছিলে। ওরা অতটা মার্জিত নয়। মার্জনা ওরা দু-চক্ষে দেখতে পারত না। আবর্জনার চেয়েও ঘৃণ্য ভাবত ওটাকে। কোথাও একটু মার্জনা জমতেও দিত না। তার আগেই—

    কৃষ্ণ বিরক্ত হয়ে বলল, আঃ! মারধোর অস্ত্র-আয়ুধ ছাড়া তোমার কি এই ভর সন্ধে বেলা কোনো কথা নেই?

    কাঠবিড়ালি অভিমানিনী হয়ে বলল, বা রে আমি কী করব। পুকুরমাসির জন্মটাই হয়েছিল সেই ক্রান্তিকালে।

    কৃষ্ণের মুখ এই সময় হঠাৎ হয়ে গেল বিকৃত। চোখ কুঞ্চিত। নাকটা উঠে যেতে চাইল কপালে। হাতের তালু দুটো দু-দিক থেকে জানলার পাল্লার মতো নাককে আড়াল করার জন্যে উদ্যত।

    ঐ অবস্থাতেই কৃষ্ণ বলল, লেজে ধূলি ওড়াচ্ছ কেন? হজ্ঞী আসছে যে।

    কাঠবিড়ালি কৃষ্ণের মুখ-চোখের অবস্থা দেখে হি-হি করে হেসে উঠে বলল, হাঁচি? ও বাবা, হাসির সংস্কেতো ঠাকুর্দা হজ্ঞী নাকি? এতো বড়ো বংশপঞ্জি হাঁচির! তা দাদা, এখন তোমার দৈব সিকনির সমুদ্দুর ঝরতে শুরু করলে তাকে মন্থন করার সাধ্যি কারুর বাপের নেই। এই সামান্য কাঠবিড়ালির লেজের ধুলো তো কোনো কাজেই লাগবে না।

    কৃষ্ণ অসন্তুষ্ট হয়ে বলল, আবার তরলমতি?

    কাঠবিড়ালি বলল, বা রে, প্রসঙ্গটাই যে জোলো, আমি কি করব?

    কৃষ্ণ বলল, তোমাকে নিয়ে আর পারি না আমি।

    পাতলা ফিনফিনে হাওয়া বইছে। বসন্ত। চৈত্রের মাঝামাঝি। এদিকের মস্ত সিঁড়ি-বাঁধানো ঘাটটি বাদেও ওরকম ঘাট আরও আছে দু-দিকে দুটি। মাসির ছেলে-মেয়ে। কাঠবিড়ালি বলে। সবাইকেই ছুঁয়ে থাকতে চায় মাসি। কিন্তু বছরের ক’টা দিনই বা সেই বাৎসল্যসুখ মাসি পায়! বছরের বেশিরভাগ সময়ই জল নেমে থাকে নিচে। ঘাটের নাগাল পায় না। মাসির ছেলে-মেয়েরা আর আগের মতন দুগ্ধপোষ্য শিশু নেই। বিরাশি সালে তাদের প্রতিষ্ঠা হয়। অনেক কাল তারা ছিল যাকে বলে লব্ধপ্রতিষ্ঠিত। তারপর তারাও বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। নতুন ঘাটের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। মাসি তো আরোই জরতি। মাসি এখন ওদেরই মুখাপেক্ষী। কিন্তু হাত বাড়িয়েও ঘাট দুটির হাত ধরতে পারে না মাসি। কাঠবিড়ালি বলল, মাসি, ভগাবান তোমার এত কাছে। সে কিছুই করছে না তোমার। রাগ হয় না?

    —হয় না মা, হয় না। কেন যে হয় না! নিজের প্রতিই অনুযোগ মাসির।

    মাসি কোনোভাবেই কারুর ওপর ক্ষুব্ধ হতে পারে না। তার নিজেরই সতত যেন অপরাধীর ভাব।

    পরে কাঠবিড়ালি বুঝেছে ব্যাপারটা। মাসি গুছিয়ে কথা বলতে পারে না। মিতভাষিণীও বটে। কিন্তু এক সমুদ্দুর মমতা মাসির অন্তরে। কৃষ্ণের সেই সত্তা যে আর নেই মাসি যথেষ্ট অনুভব করেছে সেটা। এবং বিস্মৃত এক শুরু থেকে এই অব্দি কোনো দৈবক্রম ঘটেওনি এখানে। এই তরুণটি দিব্যকান্তি হলেও সে যে ভগবান এ নিয়ে এক প্রকার সংশয়ও মাসির দৈনন্দিন ভাবনার ঘরে মাঝে-মাঝে ভ্রমরগুঞ্জন করে বেড়ায়। তখন মাসির বড় ভয় হয়। এমন সব কথা ভাবাও যে পাপ! তবু, ছেলেটির সময় কাটে না; মোটা ডালে শুয়ে সারাদিন এপাশ-ওপাশ করে, অনেক কাল এই অবস্থা দেখে দেখে একটা বিবশ সংবেদনে সারাদিন মাসি মুহ্যমান হয়ে থাকে। কৃষ্ণ বাঁশিও বাজায় আজকাল কম। কাঠবিড়ালি মাঝে-মাঝে পীড়াপীড়ি করে। সুর ধরতে ধরতেই কিন্তু কৃষ্ণের দু-চোখ জড়িয়ে আসে ঘুমে। কাঠবিড়ালি আর বিরক্ত করে না তাকে। বসে থাকে নিশ্চুপ। আজ তবু অনেকখানি হলো। এবং এক সময় চটকা ভেঙে কৃষ্ণ বলে উঠল, এবার রাখি?

    কাঠবিড়ালি অন্যমনস্কভাবে বলল, আচ্ছা। তারপর আবার শুরু করল সেই প্রসঙ্গ—উনিশ-শো বিরাশি সাল। সবে ইলেকট্রিকের আলো এসেছে মৌতোড় গ্রামে। তা-ও ইলেকট্রিক সবাই নিতে পারেনি। দু-একটা বাড়িতে শুধু। হলুদ বাতির দিন ছিল সেসব! আবার দীনু ঠাকুর। তাকে বাদ দিয়ে ঐ সময়ের কোনো কথা বলা যায় না। তার ইচ্ছে হলো এখানে একটি ইন্দ্রপ্রস্থ বানানোর। কিন্তু শুধু প্রস্থে বাড়বে না দীন-দুখিনী পুকুরমাসি। দৈর্ঘ্যেও। টাকা বরাদ্দ করালো সে। তারও তো গ্রাম রে বাবা! সে-ও এই মৌতোড়েরই লোক। শয়ে শয়ে লাগল মানুষ। বাউরি-বামুন সবাই।

    কৃষ্ণ বলল, দ্বিজরাও শ্রমের অংশভাগী হলো! বাঃ, সুলক্ষণ।

    কাঠবিড়ালি বলল, ঠিকই, কোনো দ্বিজাতি-তত্ত্ব ছিল না প্রথম প্রথম। সবাই এক সেদিন। তবে নগদ মজুরি নেই। তার বদলে কন্ট্রোলের চাল আর গম। তাই সই। মোটকথা পুকুরটাকে গড়তেই হবে। নিজেদেরই স্বার্থে। সমস্ত চেষ্টাকে জলে দিতে হবে। হ্যাঁ, জলেই তো। গভীর কালো জল। মাঝখানটা হবে একটু বেশি গভীর। চৌবাচ্চা-মতো। সেখানে থাকবে শ্যাওলা-মাখা বিরাট এক মৎস্য অবতার। বোশেখ মাস। দিনের বেলা রোদ জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে মারে। তাই রাত জেগে কাজ। অভ্র মেশানো মাটি। জ্যোৎস্নায় চিকচিক করছে। জমছে চারদিকে। ঘুরছে ছায়ারা। অসংখ্য। বামুনের, বাউরির ছায়া। দূরত্ব নেই, বাঁচিয়ে চলা নেই। ছায়ার ওপর ছায়া। মিলেমিশে যাওয়া। একাত্ম হয়ে যাওয়া। জমা হচ্ছে ধন। মাটি। পুকুরের চারটি পাড় হচ্ছে উঁচু। এর চেয়ে স্থায়ী আর কী? ছেলের ছেলে—তার ছেলের আমলকেও দেখে নেবে। তারই মধ্যে বিদ্বেষের বিষ একদিন। রক্ত। রাজনীতি। দু-পক্ষকেই হাতে রাখা। এটুকু তো করতেই হবে দিনুকে। সামনে তখন তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন। এ সবের পরও মাসি হয়ে উঠল লাবণ্যময়ী। দুদিকের পাড়ে নারকোল গাছ। একদিকে কৃষ্ণচূড়া। বাকি আরেকটায় বহু ইউক্যালিপটাস।

    থেমে গেল কাঠবিড়ালি। কী যেন একটা কথা শেষ না করেই।

    আবার বাঁশি হাতে নিয়েছে কৃষ্ণ। আজও তন্ময় হয়ে বাজালে গোটা পৃথিবীকে কাঁদিয়ে ছাড়ে। অবিশ্যি এই মৌতোড় গ্রামটিই কাঠবিড়ালির পৃথিবী। নইলে আর কোথায় গেছে সে?

    কাঠবিড়ালি আস্তে-আস্তে বলল, কোন রাগ দাদা?

    কৃষ্ণ উত্তর দিল না। আগামী দীর্ঘ রাতের তন্ত্রী নড়ে উঠছে মনকেমন-করা সুরের মূর্ছনায়।

    একটু পরেই যথারীতি কৃষ্ণের চোখ জড়িয়ে এল ঘুমে।

    আরো খানিক বাদে নিঃশব্দে নেমে গেল কাঠবিড়ালি। রাত বাড়ছে। মাসির তুলে রাখা কাপড়গুলি কেচে দিতে হবে।

    তারপরও আরো কাজ। জ্যোৎস্নায় শুকোতে দিতে হবে সমস্ত। মুখপুড়িটা আজও ভাবে, আবার একদিন এই গ্রামের, বিয়ে হয়ে সংসারের আবর্তে হারিয়ে যাওয়া নারীদের নিয়ে কলকল্লোলিত হবে তার ঘাটগুলির ভবিতব্য। কিন্তু দিনে দিনে শ্যাওলার চর্বি জমে কীরকম থলথলে হয়ে যাচ্ছে মাসি!

    কাঠবিড়ালি যেন কিঞ্চিৎ বিরক্তি নিয়েই আজকাল মাঝে-মাঝে কৃষ্ণকে বলে, মাসিকে তুমি বোঝাও দাদা। এই কাপড় কাচার আর কোনো অর্থই নেই। এইসব বস্ত্র—আশি ও নব্বই দশকের সমস্ত স্মৃতি আজ জীর্ণ শুধু নয়। অর্থহীন। অপ্রাসঙ্গিকও।

    কৃষ্ণ কিছুই বলে না। চুপ করে বসে ভাবে শুধু।

    আকাশের দিকে চেয়ে থাকতে গিয়ে কাঠবিড়ালির কাপড়-কাচা হাতের গতি কমে কমে যায়। অনন্ত এক শূন্যতা চোখ জুড়ে দৃশ্যমান, বুক জুড়ে বিদ্যমান। কিন্তু শূন্য কি সত্যি সত্যি শূন্য নাকি? আকাশের মতন এমন অদ্ভুত শূন্যতা আর কি কোথাও আছে যাকে ছুঁয়ে আসতে ইচ্ছে হয়! কাঠবিড়ালির মন বারে-বারে কাজের সংসার আর সংসারের কাজ থেকে শুকনো বাকলের মতো খসে পড়ে উড়ে উড়ে চলে যাচ্ছে ঐ অগাধ উন্মার্গের দিকে। অথবা আনমনা সেই মার্গ, সে নিজেই যার ওপর নতজানু হয়ে আছে। কিছু নেই এখন আর। নিজের দেহের কথা পর্যন্ত কাঠবিড়ালি ভুলে গেল। কিন্তু দেহই যদি নেই, তাহলে তো—নাঃ, যুক্তি-পরম্পরা এখন অর্থহীন—নিঃসীম অন্ধকারে-ঘেরা তারই অন্তঃস্থিত স্বৈরাচারী একজন যেন কাঠবিড়ালির এই অবাধ অন্ধত্বের কাছে দ্রষ্টব্য শ্রোতব্য করে তুলছে সেই তার স্বেচ্ছাচারের অনুকূল যা কিছু দেখা, যত কিছু শোনা। কাঠবিড়ালি ক্রমশ যেন জ্ঞান হারাচ্ছে। তার সমস্ত সংজ্ঞা আর সংবেদন বহু দূর অব্দি তার ঋজু সাহসী রক্ষক হয়ে অবশেষে আহত অবসন্ন হয়ে থেমে গেছে। কিন্তু আশ্চর্য, মাঝে মাঝে চিড়িক-চিড়িক বিদ্যুৎ চমকানির মতো একটি চেতনার রেখা এলিয়ে পড়ছে না কিছুতেই। নয়নাদি— নয়নাদি! কাঠবিড়ালি জানে, নয়নাদির প্রতি ভালোবাসাই তার এই সব সঙ্গিন মুহূর্তগুলির সঙ্গিনী। এত রাত হয়ে গেল, নয়নাদি এখনো তুমি কেন এলে না মুখোমুখি ঘাটটিতে? কত কাল তুমি কাঁদো না নয়নাদি। চুপ করে গেছ। একদম চুপ। কাঠবিড়ালির ইচ্ছে করছে, বাসস্ট্যান্ডের কাছে ঢিপির মতন যে উঁচু জায়গাটিতে বসে—যার একদম শীর্ষে লম্বা সরলরৈখিক এক ইউক্যালিপটাস—যেখানে ফোঁটা ফোঁটা পড়েছিল নয়নাদির অশ্রু—সেই মাটির গন্ধ নিতে, জিভের আগায় ছুঁতে সেই মাটিকে, চেখে দেখতে। ...আঃ, দিনু ঠাকুরের কাছে চিরদিন না-জানাই রয়ে গেল, একজনের—একজন নয়—দুই নারীর—নয়নাদির সঙ্গে সেদিন ছিল তার সেই ভাইঝি-ও, ক্ষুদিরামকাকুর সেদিনের সেই পাঁচ বছরের মেয়ে, তখন রীতিমতো তরুণী—এমন দু-জন তারা, যাদের এক প্রিয়জন দিনুরই আঙুলের ইশারায় তার দলের হাতে নিগৃহীত হয়ে ভুলে যায়নি সেদিনই সবটুকু, কিংবা এতটুকুও; বাকি আর যে-ক’দিন বেঁচে ছিল প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছবার আগেই মরে যাওয়ার আগে, জ্বলেপুড়ে অনেকটা মরা তার হয়ে গিয়েছিল তারও আগে—সেই তাদের আজকের অশ্রু দিনুর অতি দুই নিকট-আত্মীয়ার মতোই তার শেষজীবনের অসহায়তাকে—হাজার হোক মানুষ তো, মানবিক পূর্ণতা দিয়েই—সমস্ত কিছুর উর্ধ্বে ওঠা মানবীর আবহমান কালের মাতৃত্বে ভরা পরিপূর্ণতা দিয়ে, যেন-বা দগদগে ও জ্যান্ত দহন-চিহ্নের ওপর গুঁড়ো-গুঁড়ো ঝুরো-ঝুরো তুষার ঝরিয়ে চোখ-বোজা আরামে তাকে বেঁচে থাকার সহায়তা ও সমর্থন দিতে চাইল। ...বসেছিল দিনু, পতুর দোকানে দুপুরের অসময়ে অসঙ্গত এক গেলাস চা নিয়ে। সামনে তেতে ওঠা পিচের রাস্তা। শালিকদের হুটোপাটি। গরমের মধ্যেই। একটা শালিকের ডানা ভেঙে গেল। ডানাটা প্রসারিত হয়ে শিথিল হয়ে গেল। শালিকটা আর হয়তো উঠবেই না। এ কী আত্মঘাতী খেলা! এমন সময় এল রোগা পিংপিঙে প্রতিশোধকামী লোকটা। বহু পুরনো এক হেনস্থার শোধ নিতে। দিনুর বুকের কাছে পাজ্ঞাবিটা মুঠো করে ধরে সপাটে মারল একটি চড়। পড়ে গেল দিনু। ডানাভাঙা শালিকটার কাছেই। চোখের কাছে একগোছা ধুলো-মাখা দীর্ঘ সাদা চুল ঝুলে পড়েছে। চশমাটা সম্পূর্ণ ভাঙেনি। একটি কাঁচে বাঁকাচোরা ‘দ’-এর মতো ফাটল। তার ভিতর দিয়ে দিনু দেখতে পেল, বজ্র এসে থমকে গেছে তালগাছের মাথায়। উপস্থিত সবার মুখেই একটা-না-একটা কাটা দাগ। ঘাতক লোকটা শুধু যেন শেষ নিঃশ্বাসটা হাতে রেখে বাকি সবটুকু খরচ করার ইচ্ছেয় জোরে জোরে হাঁপাচ্ছে। দল নেই দিনুর। সংগঠন নেই। সবাই গেছে অন্য দলে। অস্তগামী সূর্য সে। নরম ক্ষমাশীল আলোর দূত সে। উঠল ধীরে ধীরে। কেউ এগিয়ে এল না। পাজ্ঞাবিটা ছিঁড়ে গেছে অনেকটাই। বুকটা হাটখোলা। ঠোঁট কেটে গেছে। নিস্পৃহভাবে উঠে দাঁড়াল দিনু। যেন সেই সময় সেই সাম্প্রতিকেই সে বসে আছে। অনুগামী, অনুরাগী, এবং সন্ত্রস্ত অগুনতি মানুষের দ্বারা পরিবৃত হয়ে। ভক্তি, তোষামোদ। কাণায় কাণায় পূর্ণ। মাঝ-মাঝে এসবে আতিশয্যও এসে যাচ্ছে। চোখ বুজে পান করছে দিনু অমৃতপ্রতিম সেই মদিরা। কিন্তু মুখাবরণের কোনো রেখা কাঁপছে না। দীর্ঘ-কুঞ্চিত কিছুই হচ্ছে না। আজ শুধু সেই মুখোশ নেই। মুখটাই সারাৎসার। উইঢিপির মাথায় যেন শুরু হয়েছে বৃষ্টি। বৃহৎ ক্ষয় কে রুখবে! শুধু দিনুর নয়। একটি যুগ, একটি সর্বাত্মক প্রতিষ্ঠানের। এই বিধ্বংসের দিনু স্বেচ্ছাসেবক। তাই এইসব ছোটো-ছোটো লাঞ্ছনা ও নিগ্রহের তেমন বৃহৎ কোনো তাৎপর্য তার কাছে নেই। পিংপিঙে লোকটা হয়ত ভাবছে, দিনু একটা গণ্ডার। অপমানবোধ নেই, অন্তর্দহন নেই। যার এসব নেই তাকে নিগ্রহ করেও সুখ নেই। এই তার দুঃখ। ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে দিনু বলল, আমাকে আর মারিস না, অবনী। আমি একেবারে বুড়ো হয়ে পড়েছি। নিজেই তো এবার মরে যাব।... সেই সেদিনই আসছিল নয়নাদির ভাইঝি। বাস এসে পড়ল দৃশ্যটার মুখোমুখি। কাকতালীয়? কাঠবিড়ালির অমনি ঝপ করে একটা কথা মনে পড়ে গেল। অলক্ষ্যে গোপনে এইটুকু ঘটানো এই নিরীহ ভগবানটির কীর্তি? কী জানি বাবা। তার অনেক গোপনীয়তা। গোপিনীদের ব্যাপারে যেমন কিছুই শোনা যায় না দাদার নিজের মুখে। গোপিনীয়তা নিয়েই যখন এমন গোপনীয়তা, অন্য ব্যাপারে তখন নিশ্চয় আরোই শোচনীয়তা! ইস, আবার কত কিছু উল্টো-পালটা মেলাতে ইচ্ছে করছে! আটলান্টিকের মতো অতলান্ত বেহুঁশ অবস্থাতেও এমন মজার্য বিষয়—আহা, মহার্ঘ বললেই বা ক্ষতি কী! কাঠবিড়ালির নিজেরই হাসি পাচ্ছে।...তা ফিরেই, সেই ঢিপির কাছে মেয়ের গিয়ে পিসিকে জড়িয়ে ধরা। পিসি কাঁদছে। মহূর্ত পরে পিসিই ভাইঝিকে বলছে, তুই কাঁদবি না মা? ওই আকাশের দিকে তাকিয়ে বাবাকে বল, বাবা দেখো, আমি সেই লোকটার জন্যেই কাঁদছি।...

    ঘোরের মধ্যেই যেমন-তেমন করে কাচা হয়ে গেল কাপড়চোপড়গুলি। আজ ছিল অনেক। চাঁদ এসে গেছে মাথার ওপরে। কাঠবিড়ালি দ্রুত ফিরে এল গাছে। কৃষ্ণ ঘুমিয়ে পড়েছে ডালের ওপর। পা দুটি শূন্যে ঝুলে আছে।

    দাদা, ও দাদা—

    এক ডাকেই কৃষ্ণ ধড়মড় করে উঠে বসল। চারিদিক নিঝুম।

    কাঠবিড়ালি বলল, বাড়ি যাবে না?

    কৃষ্ণকে কেমন যেন আচ্ছন্ন দেখাল, অ্যাঁ! বাড়ি? যাব তো।

    উঠল বটে, কিন্তু কিছুই মনে পড়ছে না কৃষ্ণের কোন বাড়ি যাবে। কার ঘরে।

    তবু চলল। পাড়ের ওপর এককালের মাছ-পাহারা দেওয়া ঘরটির কাছে এল এগিয়ে। চালের ওপর টিন আঁচড়াচ্ছে পাখিদের তীক্ষ্ণ নখ। এত রাতে? কৃষ্ণ পায়ের বুড়ো আঙুলের সাহায্যে উঁচু হয়ে ঘরটির মাথায় দৃষ্টি বোলালো। ফাঁকা। দিনের রোদ্দুরে টিন বেড়ে ওঠে গরম হয়ে। গভীর রাতের ঠান্ডায় আবার কমে যায়। প্রসারণ, সংকোচন। তার জন্যেও ওরকম আওয়াজ হয়।

    তারপরও বাধা। কর্কশ কুঞ্চিত হাসির শব্দ। নতুন নয় শব্দটা, কৃষ্ণের চেনা শব্দ। শব্দ সৃষ্টিকারীদেরও দেখা যাচ্ছে জ্যোৎস্না ভালোভাবে প্রস্ফূটিত হওয়ায়। একপাল শেয়াল। বলির রক্ত খেতে এসেছে মন্দিরে। শেয়ালগুলি দারুণ অবিমৃশ্যকারী। কাঠবিড়ালির শুকোতে দেওয়া বস্ত্রগুলি নিয়ে টানাটানি করছে প্রবলভাবে। জীর্ণ কাপড় ছিঁড়ে যাচ্ছে ফরফর। বস্ত্র বিদীর্ণ হওয়ার শব্দকে মনে হচ্ছে বক্র হাসি।

    কৃষ্ণ একবার মৃদু স্বরে ডাক দিলো—জম্বুক! জম্বুক!

    সহসা নতুন নামে শিবাবৃন্দ সম্মানিত ও সম্মোহিত বোধ করল সাময়িকভাবে। কিন্তু ক্রীড়া পরিত্যাগ করল না।

    পুষ্করিণী-মাসির স্মৃতি-সম্ভারের এই দশা! দৈবাৎ কাঠবিড়ালির চোখে পড়েনি এই দৃশ্য। কৃষ্ণকে দারুণ অসহায় দেখাল সেই মুহূর্তে।

    পাড় থেকে কৃষ্ণ নেমে এল। লোকালয়ের মধ্যে গোলাকৃতি মাঠ। এখানে হাট বসে। মঙ্গল, শুক্র। কাছেই বিখ্যাত কালীমন্দির। আলো জ্বলছে। তার পিছনেই অন্ধকার গলি। কৃষ্ণের মনে হল ওইদিকেই তার ঘর। সেদিনও নিজেরই অজান্তে ওখানেই ঢুকে এসেছিল।

    কালীমন্দিরের কাছে আসতেই এক নারী। সাদা থান আলেয়ার মতন প্রকট। হাঁড়িকাঠের ঠিক কাছেই। গাছ থেকে নামা অব্দি কৃষ্ণ আরো লাজুক হয়ে গেছে। কেন জানি তার ভয়-ভয়ও লাগতে শুরু হয়েছে। নারীটিকে দেখে সে থতমত খেয়ে গেল। বলে ফেলল, আমার বাড়ি কোন দিকে বলতে পারেন?

    নারীটি প্রথমে কিছু বলল না। কৃষ্ণের বুক দুরুদুরু। পর মূহূর্তে সেই মহাশ্বতা থান কাপড়খানাই যেন বলে উঠল, কে এসেছিস, আমার মেয়ে? তারপর একটু কাছে এসে বলল, মেয়ে না তো! ছেলে। একই হলো। আচ্ছা আয়।

    কৃষ্ণ বলল, কোথায়?

    —বা রে স্তন্যপান করবি না আমার?

    —কিন্তু আমি তো—

    —না, না, কতক্ষণ খাসনি যে। খিদে পায়নি?

    দ্রুত পা ফেলে এগিয়ে আসতে লাগল সেই রমণী। আলো পিছন দিকে। মুখটা দেখা গেল না। কিন্তু ভয়ের কারণে মনে হলো করালবদনী।

    কৃষ্ণ দেখল উপায় নেই। দৌড় দৌড় দৌড়।

    ময়ূর পাখা খসে পড়ল। মোহন চুড়ো খুলে গেল। এটাই সবচেয়ে অস্বস্তির। কত যত্নে বেঁধে দিয়েছিল মা। মা-কে এবার কোথায় পায় কৃষ্ণ? কে যে মা তাই যে তার মনে নেই!

    কৃষ্ণ চলে এল কৃষ্ণচূড়ার কাছেই। হাঁপাচ্ছে। কাঠবিড়ালি তখনো ঘুমোয়নি।

    কৃষ্ণ একটু দম নিয়ে বলল, যা পাগলিনীর পালায় পড়েছিলাম ভগিনী। একটু হলেই যেতাম বুঝি।

    কাঠবিড়ালি হি-হি করে হাসতে লাগল।

    কৃষ্ণ বলল, হাসছ যে?

    কাঠবিড়ালি বলল, ও-ই তো নয়নাদি। তারপর হঠাৎ সে চিন্তিত হয়ে এবং তৎক্ষণাৎ নিজেই একটা সিদ্ধান্ত খাড়া করে অমনি বলল, আসলে তুমি তো দারুণ দেখতে—দৈব কান্তি তোমার, নয়নাদি তোমায় দেখে ভেবেছে, ও যা বলতে চায়—যার এক কণা কিছুই বুঝতে পারে না কেউ—গ্রামের প্রতি তার যত অনঙ্গ মায়া-মমতার অণু-পরমাণু— সেসব হঠাৎ এমন এক অনিন্দ্য তরুণের রূপে প্রকাশিত হয়েছে; নয়নাদি তো আসলে মা—সে তার এই দুর্বোধ্য প্রকাশ থেকেই বাৎসল্য-সুখ পেতে চায়। হয়তো তাই তোমায় দেখে আবেগ উথলে উঠেছে সেই আবাগির। এটা কিন্তু শুধু মিল দিতে বলা নয়, আগেই বলে দিচ্ছি। অলঙ্কার দিয়ে কথাটাকে ঝিলমিল করানোও নয়। আবাগি মানে আমি খুব ভালো করেই জানি। ভাগ্যহীনা। একটু দম ফেলে কাঠবিড়ালি বলল, তা’লে দেখলে আমার নয়নাদিকে?

    কৃষ্ণ বলল, আসলে মুখটা ঠিক—

    কাঠবিড়ালি বলল, জানতাম। আচ্ছা ঘুমকে আজ হারিয়ে দাও দিকি। দেখি, রাগি হয়ে তাকাও। তোমার ঐশী চোখে আজ ঘুম আছে কি না দেখি?

    কাঠবিড়ালি কৃষ্ণের বিস্ফারিত চোখে উঁকি মেরে দেখল। হতাশ হয়ে তারপর বলল, নাঃ। শুধুই দেখলাম দু-পাশাড়ি কৃষ্ণচূড়ার বনবীথির ভিতর দিয়ে একটা ছায়াচ্ছন্ন রাস্তা কোথায় যেন চলে গেছে।

    কৃষ্ণ বলল, আমার কেন জানি মনে হয়, ওটা মানুষের সবচেয়ে দুর্বল জায়গাটিতে পৌঁছে যাওয়ার রাস্তা। ঐ রাস্তা ধরে তুমি কোথাও যেতে চাও?

    —কোথায় যাব?

    —কেন, তোমার নয়নাদির কাছে।

    —নয়নাদির কাছে যাব আবার কী। সে তো কাছেই থাকে। জানো দাদা, সুর পালটে গেল কাঠবিড়ালির, কালী মায়ের মন্দিরে না, রোজই একটা না একটা বলি হয়। নয়নাদি তার ধপধপে কাপড়ে রোজ রাতে বলির রক্ত মুছে দেয়। তারপর কাপড়টা মাসির কাছে কাচতে আসে। মাসির কাছে এলে সব হিংসাই জোলো হয়ে যায়। জলবৎ তরল। কাপড় ছেড়ে আবার একটা পরিচ্ছন্ন থান পরে নয়নাদি। তখন সে অন্য মানুষ। এক রাশ ভিজে চুল পিঠে। মুখটা শান্ত। রোজই তো দেখি। তুমি ঘুমোও, আমি তার কাছে বসে থাকি গিয়ে। অর্ধেক রাত অব্দি।

    কৃষ্ণ বলল, কাছাকাছি থেকেও ভালোবাসায় পৌঁছনো বড়ই কিন্তু কঠিন, ভগিনী।

    কাঠবিড়ালি বলল, দাঁড়াও তবে, কৃষ্ণচূড়ার সেই রাস্তাটা তবে ভালো করে আরেক বার দেখি। কাছ থেকে দেখতে হবে এবারে।

    কৃষ্ণ হাত দুটি জড়ো করে বুকের ওপর রাখল। কাঠবিড়ালি চড়ে বসল তাতে।

    একটু পরে দেখা গেল, কৃষ্ণের দেখা আলেয়ার সেই শিখাটা হাওয়াতে ভাসতে ভাসতে ঘাটের দিকে আসছে। অমনি কৃষ্ণের হাই উঠতে লাগল।

    সন্ধ্যা থেকে বকবক করে, ভালোবাসার রাস্তা দেখতে গিয়ে কাঠবিড়ালি কৃষ্ণের কোলের ওপর ঘুমিয়ে পড়েছে আগেই।

    কাঠবিড়ালির ছোটো ছোটো নিঃশ্বাস পড়ছে। ঐটুকু দেহের হিসেবে সেগুলিকে দীর্ঘশ্বাসই বলা যায়।



    অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments