কাগজের দিস্তাখানা পাশে সরিয়ে রেখে প্রুফ রিডার সমরবাবু আঙুলের চাপ দিলেন বেলে –
পিওন এসে দাঁড়াতেই বললেন, "এক কাপ চা নিয়ে এস। ওহঃ, মাথাটা ধরে গেছে একেবারে!"
এতো ভুল বানান মানুষ লিখতে পারে? ঠিক করতে করতে জীবন বেরিয়ে গেল।
নিজের চেম্বার থেকে বেরিয়ে হলে গিয়ে দাঁড়ালেন। সামনে কম্পিউটার মনিটরের দিকে চোখ রেখে সকলেই ভীষণ ব্যস্ত। তিনি ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন একজন তরুণের দিকে।
স্পোর্টস রিপোর্টারকে জিজ্ঞেস করলেন, "কে লিখেছে গল্পটা?"
—কেন স্যার? কোনো ভুল আছে?
—না মানে, বেশ ভালোই। তাই জিজ্ঞেস করছি।
—আমার মেসোমশাই লিখেছেন। আসলে উনি কম্পিউটারটা ভালো জানেন না তো ...তাই হাতে লিখেই মানুস্ক্রিপ্ট পাঠিয়েছেন।
—ভালো, ভালো। খুব ভালো। তবে দু'-একটা বানান ভুল নজরে এল—তাই।
—আসলে উনি কখনো বাংলায় কোনো গল্প এর আগে লেখেননি তো। বরাবর ইংরেজিতেই অভ্যস্ত।
—ও আচ্ছা, আচ্ছা।
সমরবাবু আর দাঁড়ালেন না। তাঁর অনেক কাজ পড়ে আছে।
বাইরে গুমোট গরম, আকাশের মুখটা ভার হয়ে আছে। রিমোট দিয়ে এ.সি.র ঠান্ডা বাড়িয়ে দিলেন। ফেসবুক খুলতেই নজরে এল কেউ একটা গল্পের সাইট-এ সুন্দর একটা গল্প পোস্ট করেছে। আমপানে উড়ে যাওয়া ঘরদোর আর মানুষের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে ছোট অথচ চমৎকার একটি গল্প। মোটামুটি ১৫০০ শব্দের হবেই। কিন্তু এরা গল্পগুলো পত্রিকা অফিস-এ পাঠায় না। এখন ফেসবুক জাতীয় সোশ্যাল সাইটে এত রকম গল্প, কবিতা, ছবি ইত্যাদি পোস্ট করার জায়গা আছে। কেউ আর কষ্ট করে পত্রিকা অফিস-এ পাঠাতে চায় না। তারা নিজেরাই পোস্ট করে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে লাইক আর কমেন্ট পেতে থাকে পাঠকদের —ফলে হাতেনাতে লাইক পাওয়ার নেশায় গল্প সেখানেই পোস্ট করে।
রবিবারের পত্রিকার জন্য গল্প খুঁজতে এখন অনেক পরিশ্রম করতে হয়। ভালো গল্প পাওয়া তো আর মুখের কথা নয়। আগে পত্রিকা অফিস-এ বাঁধাধরা গল্প-লিখিয়ে ছিলেন। অনেক পারিশ্রমিক নিতেন তাঁরা। নামকরা নামকরা সব কাহিনীকার, লেখক, কবি। তাঁদের বেশিরভাগের এত বয়স হয়ে গেছে যে আর তাঁরা লিখতে পারেন না, নয়তো তাঁদের জীবনাবসান হয়েছে। আর এখনকার লেখকদের কোনো কন্সিস্টেন্সিই নেই। তার উপরে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা অনলাইন ম্যাগাজিন, অ্যাপস, ওয়েবসাইট আরও সর্বনাশ করেছে সাহিত্যজগতের। সবাই লেখক হয়ে যাচ্ছে। যা খুশি তাই লিখে চলেছে। না আছে লেখার স্টাইল, না কোনো সুশৃঙ্খল ধারাধরন। কেউ তো প্রুফ রিডিং করে না, ফলে যা খুশি তাই হচ্ছে।
হতাশভাবে আবার হাতে তুলে নিলেন পাণ্ডুলিপিটা। এই গল্প কি রবিবারের পত্রিকায় ছাপা যাবে? সন্দেহ আছে। গল্পটা ঠিক দানা বাঁধেনি সেভাবে। অথচ স্পোর্টস রিপোর্টারকে সে কথা মুখের উপর বলাও যাবে না। তাই বাধ্য হয়ে নিজেই ঠিক করতে বসলেন গল্পটা। নাহলে এত বছরের একটা বিখ্যাত সংবাদপত্রের বদনাম হয়ে যাবে।
রবিবার গল্পটা ছাপা হওয়ার পর চিফ এডিটরের মোবাইলে ফোন এল একজন পরিচিত সাহিত্যিক তথা সাহিত্য সমালোচকের।
—আরে প্রণব, আজকাল এসব কী গল্প ছাপছ ভায়া?
—কেন?
—এ গল্প তোমাদের পত্রিকার কোয়ালিটির সাথে ম্যাচ খাচ্ছে না। গল্পের শেষটা একদম হয়নি। ভীষণ জোলো লাগছে।
—হ্যাঁ, সেটা ঠিক। তবে মানে...
—শোন, যুগের সাথে পাল্টাও নিজেদের। এখনও লোকে তোমাদের পত্রিকা অফিসে গিয়ে গল্প জমা দিয়ে আসবে—সেটা ভাবাই ভুল। আমাদের সময় চলে গেছে। গোঁড়ামি ছেড়ে অন্তত একটা ইমেইল আইডি দাও, তবে ভালো গল্প পাবে।
সাহিত্যিক ভদ্রলোকের কথাটা মনে ধরেছে প্রধান সম্পাদক মশাইয়ের। অন্তত একটা ইমেইল আইডি দিও। পরের সপ্তাহে রবিবারের পত্রিকাতে দিতে হবে।
প্রুফ রিডারকে ডেকে পাঠালেন।
—শোন, সামনের সপ্তাহে আমাদের রবিবারের পত্রিকায় তোমার ইমেইল আইডিটা দিয়ে দিও। নাহলে একটা নতুন আইডি ক্রিয়েট করে নিও।
—কেন স্যার?
—আমাদের ভালো লেখা পেতে হবে সমর। আফটার অল আমরা এর জন্য পে করছি। আমাদের ভালো লেখা চাই। তার জন্য যা করতে হবে, করো।
—স্যার, একটা কথা বলব?
—বলো, শুনছি।
—এক ভদ্রমহিলা একটা স্টোরি রাইটিং অ্যাপসে খুব ভালো লিখছেন। ওনাকে একবার বলে দেখব?
—তার মানে? তুমিও আজকাল ওইসব পড়ো না কি?
—না, না, আমি পড়ি না। আমার মেয়ে পড়ে বলছিল।
—আজকালকার ছেলেমেয়েরাও হয়েছে সেরকম। কেউ খবরের কাগজ, গল্পের বই পড়তেই চায় না। নাহলে কেউ অ্যাপে গল্প পড়ে?
—স্যার, তাহলে যোগাযোগ করি?
সম্পাদক মশাই হতাশভাবে দু’হাত নেড়ে বললেন, “করো। আমি আর কী বলব?”
মন্দিরা মন দিয়ে একটা ওয়েব ডিজাইন করছিল। মোবাইল ফোনে একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন আসতেই ভ্রু কুঁচকে গেল। নির্ঘাত কোন ব্যাঙ্কের ক্রেডিট কার্ড ডিপার্টমেন্ট থেকে। বিরক্ত হয়ে ফোনটা কেটে দিতে যাচ্ছিল হঠাৎ কি মনে হওয়ায় ফোনটা ধরল, “হ্যালো?”
—হ্যালো, আমি সমর চ্যাটার্জি ‘সচেতন মন’ পত্রিকার অফিস থেকে বলছি।
মন্দিরা ধনুকের ছিলার মত টান টান হয়ে বসল। এমন নামকরা নিউজপেপার থেকে তাকে ফোন করছে? কী ব্যাপারে? ভাবনা, উত্তেজনায় সে অনুভব করল তার হার্টবিট অনেকগুণ বেড়ে গেছে।
—‘হৃদয়ের কথা’-র ফেসবুক ওয়ালে আপনার লেখা একটা গল্প পড়লাম। ‘রাজহংসের পাখা’—বেশ ভালো লাগল। তাই বলছিলাম যদি ওই গল্পটার স্বত্ব না বিক্রি করে থাকেন তাহলে ওই ওয়াল থেকে ডিলিট করে আমাদের পাঠিয়ে দিতে পারেন। কিংবা অন্য গল্পও দিতে পারেন যদি সেটা আপনার নিজস্ব ভালো লেখা হয়।
মন্দিরা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে ভাবল। তারপর বলল, “না, ওই গল্পের স্বত্ব বিক্রি না করলেও ফেসবুক ওয়াল থেকে মুছে ফেলা সম্ভব নয়। অনেক পাঠক পড়ে ফেলেছেন, লাইক এবং কমেন্টও করেছেন। নতুন কোন ভালো লেখা এই মুহূর্তে রেডি নেই, তবে চেষ্টা করে দেখতে পারি।“
-খুব বেশিদিন দেরি করবেন না। আগামি মঙ্গলবারের মধ্যে পাঠিয়ে দিন। তবেই সেটা রবিবারের পত্রিকায় প্রকাশ করা সম্ভব হবে। আর বিভিন্ন ধরনের ফেসবুক ওয়ালে কেন এমন গল্প পোস্ট করেন জানি না। ওগুলো ভ্যালুলেশ। তার চেয়ে বরং কোন নামীদামি পত্রিকা অফিসে পাঠান।
—দেখুন, কোন পত্রিকা অফিসে পাঠানো যেতেই পারে, কিন্তু তাদের যা ক্রাইটেরিয়া থাকে সেগুলো ফুলফিল করা মুশকিল।
—কেন? কেন? আমরা তো এখন আর ডাকযোগে বা অফিসে এসে লেখা জমা দেওয়ার কথা বলছি না। এখন তো আমাদের ইমেইল আইডি দেওয়া হচ্ছে।
—সেটা খুব ভালোই করেছেন। আচ্ছা, ঠিক আছে দেখছি মঙ্গলবারের আগেই পাঠানো যায় কি না।
মন্দিরা ফোন ছাড়তেই পাপড়ি জিজ্ঞেস করল, “কার ফোন ছিল গো?”
মন্দিরা জানে পাপড়ি তার প্রতি খুব জেলাস। সারাক্ষণ সে কার সাথে কী কথা বলছে কান খাড়া করে শোনে।
তাই মুচকি হেসে বলল, “সচেতন মন’ পত্রিকার অফিস থেকে সম্পাদক মশাই ফোন করেছিলেন। গল্প চাইছেন।”
মন্দিরার কথাগুলো হজম করতে পাপড়ির কষ্ট হচ্ছিল। তবু মুখে হাসি টেনে এনে বলল, “তুমি তো ভালোই লেখো। তাই নিশ্চয়ই...। আমাদের মিষ্টি খাওয়াচ্ছ তো?”
—দাঁড়াও, আগে তো ছাপা হোক।
—সে হয়ে যাবে। তাহলে খাওয়াচ্ছ তো?
—নিশ্চয়ই।
বাড়ি ফিরে পলাশকে বলতেই সে তো উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ল।
—ওহঃ, আমার বউ সাহিত্যিক হয়ে গেছে! আমি যে কী করি! নামীদামি পত্রিকা অফিস থেকে ফোন আসছে, বাপ রে বাপ!
—আহঃ, কী করছ কি? আশপাশের ফ্ল্যাটের লোকজন শুনতে পাবে যে।
—শুনুক। এমন সাহিত্যিক বউ আছে কারো?
—আহঃ, চুপ করবে? তোমার সাথে আর কথাই বলব না।
—এই না, না। কথা বন্ধ কোরো না। প্লিজ কথা বলো। আচ্ছা, তোমার লেখা গল্পটা কবে ছাপা হবে গো?
—দাঁড়াও আগে তো লিখি।
—এই, শোন না, তোমাকে আজ আর খাবার গরম করতে হবে না। আমি করে দিচ্ছি। তুমি আজ থেকেই গল্পটা লিখতে শুরু করো।
—আঃ কি পাগলামি করছ? সরো তো। আমাকে দেখতে দাও কী তরকারি আছে। হয়ত কিছু বানাতে হতেও পারে।
—এই যে সুমিতদা, শুনছেন? আমাদের অফিসে একজন মস্তবড় রাইটার হয়ে গেল, সে খবর রাখেন?
—কে? কে রাইটার হয়ে গেল, তুমি?
—হুঁ:, কোন খবরই আজকাল রাখছেন না। আমি বলছি মন্দিরার কথা।
—ও তো ফেসবুকে একটু-আধটু লিখত-টিখত জানতাম। তা রাইটার্স বিল্ডিং-এ চাকরি পেল কবে থেকে?
—ইয়ার্কি নয়। সত্যি, সত্যি। ‘সচেতন মন’ পত্রিকার সম্পাদক নিজে ফোন করেছিলেন।
—বল কি?
—ঠিকই বলছি।
—দেখো, দেখো। মাত্র দু’বছর আগে এই অফিসে জয়েন করে আমাদের পিছনে ফেলে কোথায় এগিয়ে যাচ্ছে। আর আমরা দশ বছর ধরে শুধু আঙুল চুষছি।
পাপড়ি ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সবই ভাগ্য সুমিতদা! নাহলে ওর মধ্যে বস এমন কী দেখলেন যে এই দু’বছরে ওর পাঁচ হাজার টাকা মাইনে বেড়ে গেল?”
—কপাল, কপাল, সবই কপাল। তোমার-আমার ভাগ্যে নাই কো ঘি, ঠকঠকালে হবে কী?
তারপরেই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিয়ে পাপড়িকে বলল, “এই, চট করে যেকোন একটা ফাইল দাও। বস আসছেন। আমরা গল্প করছি দেখতে পেলে....।”
সকালবেলা দু’কাপ চা নিয়ে পলাশ এসে মন্দিরার পাশে বসে জিজ্ঞেস করল, “তোমার গল্পটা আর কত বাকি আছে গো?”
—শেষটা কিছুতেই দাঁড়াচ্ছে না, জানো? আসলে মস্তবড় পত্রিকা তো? একটা চাপ কাজ করছে মনের মধ্যে।
—অত চাপ নিও না। বরং আজকে অফিসে না গিয়ে লেখাটা শেষ করে জমা দিয়ে দাও। আজই তো শেষ দিন না?
—হ্যাঁ। সেটাই ভাবছিলাম।
—আজকে কোন ইমপর্টেন্ট কাজ ছিল?
—না, তেমন কিছু না। কালকে দিলেও চলবে....
—তাহলে তুমি গল্পটাই শেষ করো। অফিসে কিছু একটা অজুহাত দিয়ে দাও। এতবড় পত্রিকায় তো সবসময় লেখার সুযোগ আসে না। আমি বাজার থেকে ভালো মাছ এনে দিচ্ছি। সুমনাদিকে বলে যাচ্ছি ভালো করে রান্না করে দেবে। তুমি শুধু আজ লেখার দিকেই মন দাও।
সারা দুপুর গড়িয়ে বিকেলবেলা শেষ হ’ল মন্দিরার গল্প লেখা বা টাইপ করা। ল্যাপটপে অভ্র কীবোর্ড ব্যবহার করে সে অনেকটা বড় গল্প লিখে ফেলেছে। এই প্রথম বাংলা হরফে সে এতবড় গল্প টাইপ করল।
সন্ধ্যাবেলায় সে ইমেইল পাঠাল সমর চ্যাটার্জির দেওয়া আইডিতে। তারপর ফোনে জানিয়ে দিল।
এখন রবিবারের পত্রিকাটা কখন হাতে আসবে তার অপেক্ষা!
আগের দিন রাত থেকে উত্তেজনায় ভালো ঘুম হচ্ছিল না মন্দিরা আর পলাশের।
রবিবার দিন সকালে ঘুম ভাঙতেই পলাশ বাজারে গিয়ে ‘সচেতন মন’ খবরের কাগজটা কিনে আগে খুলে ফেলল তার রবিবাসরীয় পত্রিকা। কিন্তু একি, মন্দিরার গল্প কোথায়? এ তো অন্য লোকের লেখা। সুনীল ভদ্রের ‘আলের পারে’ আর জীবেন ঘোষের ‘নীল নয়না’ –- দু’জনেই নামী লেখক। তাহলে মন্দিরার গল্প কি ছাপবে না ওরা?
পলাশ ভারাক্রান্ত মনে বাড়ি ফিরল। ইন্টারনেট সংস্করণ দেখে আঘাত পেয়েছে মন্দিরাও।
পলাশ বাজারের ব্যাগটা মন্দিরার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে হতাশ গলায় বলল, “তোমার গল্পটা ওরা ছাপেনি।”
—জানি। আমি ইন্টারনেট সংস্করণ দেখেছি।
—লেখা পাঠানোর পরে সমরবাবুর সাথে কি তোমার কোন কথা হয়েছিল?
—না। সেভাবে সুনিশ্চিত করে কিছু বলেন নি। তবে লেখা পাঠানোর আগে তো বেশ কয়েকবার ফোন করেছিলেন। তখন মনে হয়েছিল লেখাটা ওঁদের খুব প্রয়োজন।
—তাহলে তোমার লেখাটা কি ওদের পছন্দ হয়নি? কিন্তু তুমি তো ভালোই লেখো মন্দিরা?
—হয়ত ওরা যেমন চাইছেন তেমন নয়!
মন্দিরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল।
মন্দিরার পাঠানো গল্পে কারেকশানের বিশেষ কিছু ছিল না। অভ্র কীবোর্ড লেআউট ব্যবহার করে টাইপ করা ঝকঝকে একটা গল্প। প্রুফ রিডার সমর চ্যাটার্জি খুব মন দিয়ে পড়ছিলেন গল্পটা। আর মনে মনে তারিফ করছিলেন –- ভদ্রমহিলার লেখার হাতটা চমৎকার। গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে সুন্দর একটা গল্প লিখেছেন। ঠিক তখনই ইন্টারকমে চিফ এডিটর তাঁকে ডেকে পাঠালেন।
—এই নাও সমর দু’জন নামী লেখক আমার রিকোয়েস্টে এই গল্প দুটো পাঠিয়েছেন। সামনের রোববার এগুলো যাতে ছাপা হয় তার ব্যবস্থা করো।
—কিন্তু স্যার ওই ভদ্রমহিলার গল্পটা একদম রেডি আছে। আমি ওঁকে কথা দিয়েছি যে....
—কথা দিয়েছ মানে? ওরকম অনামী লেখিকাকে তুমি কথা দিয়ে ফেললে? জানো, আমাদের পত্রিকায় গল্প-উপন্যাস প্রকাশ করতে গেলে কত নামীদামি লেখককেও কতদিন অপেক্ষা করতে হয়? আগে এই পাণ্ডুলিপি দুটো রেডি করে ফেলো আগামী রবিবার ছাপার জন্য।
—কী হ’ল? তোমাদের মন্দিরাদেবীর লেখা বেরোল কই?
সুমিতদার কথায় পাপড়ি ঠোঁট উল্টে বলল, “যত না লেখে তার থেকে দেখায় বেশি। ফেসবুকে লিখলেই বড় লেখিকা হওয়া যায় না।”
—এবারে রবিবারের পত্রিকাতে দেখছ কাদের লেখা বেরিয়েছে? তাদের কাছে তোমার মন্দিরাদেবী চুনোপুঁটি।
দুজনেই সশব্দে হেসে উঠল।
—যা বলেছেন। সবাই এখন লেখক হয়ে যাচ্ছে। কেউ আর পাঠক হিসেবে থাকবে না।
মন্দিরা ওদের কথাগুলো সবই শুনতে পাচ্ছিল কিন্তু প্রতিবাদ করার উপায় তো নেই। মুখের উপর জবাবটা দেওয়া যেত যদি কোন নামীদামী পত্রিকায় ওর লেখাটা ছাপা হ’ত। শুধু সময়ের অপেক্ষা করতে হবে।
সমর চ্যাটার্জি যে এরকম করবেন, ভাবতে পারেনি মন্দিরা। অত আগ্রহ দেখিয়ে লেখা জমা নিয়ে শেষে ছাপবে না, ভাবতে পারেনি সে। তার লেখাটা কি এতটাই খারাপ হয়েছিল? চোখে জল আসে মন্দিরার।
সাহিত্য সমালোচক ভদ্রলোক এবারেও ফোন করেছেন ‘সচেতন মন’-এর চিফ এডিটরকে।
—তোমাদের রবিবাসরীয় পত্রিকায় দুটো গল্পই পড়লাম। দু’জনেই নামীদামী সাহিত্যিক। ভালো তো লিখবেনই। তবে আগের মত ধার নেই লেখাতে। বয়স হয়েছে তো? অভ্যাসমত লিখে যান এখনও। কিন্তু গতানুগতিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন না। তোমরা কি কোন নতুন লেখকদের এন্ট্রি দিচ্ছ না?
—না, আসলে তেমন কিছু নয়। ভালো লেখক এখন কোথায় বলুন তো?
—কী বলছ প্রণব? আমি বৃদ্ধ মানুষ, সারাদিন মোবাইল ফোনে পড়ি কত ভ্রমণকাহিনী, গল্প, কবিতা। ফেসবুক ওয়াল, অ্যাপস আর অনলাইন ম্যাগাজিনে তো চমৎকার লেখা বেরোচ্ছে। তবু বলছ ভালো লেখকের অভাব? আমি বলছি, নতুন লেখকদের সুযোগ দাও। দেখবে বাংলা সাহিত্যটা আর কোণঠাসা হয়ে পড়বে না। যুগের পরিবর্তনের সাথে চিন্তাভাবনারও বিবর্তন দরকার। নাহলে পিছিয়ে পড়তে হবে যে?
প্রণববাবু ফোনটা ছাড়ার পর কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। তারপর প্রুফ রিডার সমরবাবুকে ইন্টারকমে বললেন, “একবার ওই নতুন লেখিকা ম্যাডামের লেখাটা একটু প্রিন্ট করে নিয়ে এসো তো।”