১)
বুধবার সকালে, পোর্টসমাউথ লেডিজ (বর্তমানে নাম বদলে, ‘পোর্টসমাউথ উইমেন’ হলেও, লোকমুখে ‘পোর্টসমাউথ লেডিজ’ নামটাই প্রচলিত।) ফুটবল ক্লাবের ম্যানেজার, ইয়ান ব্র্যাডলি যখন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড চিফ টনি অ্যাডামসের ঘরে ঢুকলেন, তখন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের দুঁদে গোয়েন্দা মাইক ব্রিয়ারলি এবং তাঁর সহকারী অ্যান্ড্রিউ রবার্টসনও সেখানে ইয়ানের জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। ইয়ানকে দৃশ্যতই বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল। টনি অ্যাডামস ইয়ানকে বললেন, “পরিচয় করিয়ে দিই, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের দুই অফিসার মাইক ব্রিয়ারলি আর অ্যান্ড্রিউ রবার্টসনের সঙ্গে, আপনার পরিচয় এবং সমস্যার কথা পোর্টসমাউথ পুলিশ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকে আগেই জানিয়েছে। তবুও যেহেতু, ব্রিয়ারলি এবং রবার্টসন এই তদন্তভার গ্রহণ করেছে, সেহেতু আপনি পোর্টসমাউথ পুলিশ স্টেশনে যা বলেছেন, তা বিস্তারিত ভাবে ওদের বলুন, ওদের কোনও প্রশ্ন করার থাকতে পারে।”
ইয়ান বললেন, “আমি একটা গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার হতে চলেছি। আপনারা জানেন, যে আজ থেকে তিনদিন বাদে আগামী ৫ই ডিসেম্বর পোর্টসমাউথ লেডিজ লন্ডনের ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে, মহিলাদের এফএ কাপের ফাইনালে, ওয়েস্ট হ্যাম লেডিজের মুখোমুখি হবে, আর গতকাল থেকে আমার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়, এ বারের লিগে উনিশ গোল করা এবং এফএ কাপ সেমিফাইনালে অ্যাস্টন ভিলার বিরুদ্ধে জয়সূচক গোল করা স্ট্রাইকার বেটি জেমস উধাও। গতকাল সকালে বেটি অনুশীলনে না আসায় ফোন করে দেখি মোবাইল সুইচড অফ বলছে। একজন পেশাদার ফুটবলার তার ক্লাবকে না জানিয়ে অনুশীলনে অনুপস্থিত থাকতে পারে না, এ দিকে আবার আজ সন্ধ্যায় লিগের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে আমরা সাউদাম্পটনের মুখোমুখি হব। সেই ম্যাচে তো বেটি জেমসকে পাব না ধরে নিয়ে পরিবর্ত স্ট্রাইকার হানা রো’কে তৈরি থাকতে বলেছি। যাইহোক, সে সব তো পরে মাথায় এসেছে, গত কাল আমি প্রথমে পোর্টসমাউথ লেডিজের আর এক ফুটবলার অ্যামেলিয়া কুরির কাছে বেটির অনুপস্থিতির ব্যাপারে জানতে চাই, অ্যামেলিয়া দলে বেটির সবথেকে ঘনিষ্ঠ বান্ধবী, একসময় সে বেটির সঙ্গে ফেয়ারহ্যামে একই অ্যাপার্টমেন্টে থাকত, মাস দুয়েক হল বেটির এক পুরুষ বন্ধু হওয়ায় অ্যামেলিয়া পোর্টসমাউথের সাউথসী অঞ্চলে পারিবারিক ফ্ল্যাটে উঠে আসে, কিন্তু অ্যামেলিয়া বেটির অনুশীলনে অনুপস্থিতির কারণ জানাতে পারেনি, সে বলে উইলিয়ামসকে কেন জিজ্ঞাসা করছি না, উইলিয়ামস জর্জ হচ্ছে বেটির বয়ফ্রেন্ড।” এইসময় মাইক বললেন, “উইলিয়ামস জর্জ তো পোর্টসমাউথের প্রাক্তন ফুটবলার ছিলেন, খুব নামী ফুটবলার না হলেও দীর্ঘ দশ বছর পোর্টসমাউথ দলের হয়ে খেলেছেন, তবে কখনই নিয়মিত ফুটবলার ছিলেন না। তিন বছর আগে, নিজের তিরিশ বছর বয়সেই বাঁ হাঁটুর লিগামেন্টে চোটের কারণে অবসর নেওয়ার পর লেডিজ দলের দায়িত্ব নেন, গত দুই মরশুমে ম্যানেজার হিসেবে লিগ টেবিলের মাঝামাঝি জায়গায় শেষ করেছেন, জর্জের দায়িত্ব নেওয়ার আগে দলের পারফরম্যান্স কিন্তু তলানিতে নেমে গেছিল, এই মরশুমের শুরুতে পোর্টসমাউথ লেডিজ ওকে সরিয়ে আপনাকে দায়িত্ব দেয়। কারণ, ক্লাব কর্তৃপক্ষ মনে করেছিল ট্রফি জিততে গেলে আপনার মতো মহিলা ফুটবলের সফল একজন ম্যানেজারকে দরকার।”
বৌদি মানে, অধীরদার স্ত্রী এইসময় কফির কাপ আর পকোড়া ট্রেতে সাজিয়ে ঘরে ঢুকতে, অধীরদাকে থামতে হল। রোববার সকালে অধীর বাগচীর সোদপুর স্টেশন রোডের বাড়িতে জুটেছি, ডাবলিনের দ্য ইনভেস্টিগেটর পত্রিকায় প্রকাশিত স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের মহা গোয়েন্দা, মাইক ব্রিয়ারলির সাম্প্রতিকতম গোয়েন্দা কাহিনির টানে আর মিসেস বাগচীর হাতের ভালমন্দ রান্নার লোভে, মন্দটা কথার কথা, ওঁর হাতের সব রান্নাই মহা ভালো। আমার মিসেসও এসেছেন, যাকে বলে সস্ত্রীক নিমন্ত্রণ, তবে দুই গিন্নিই দু’চক্ষে এইসব গোয়েন্দা কাহিনি দেখতে পারেন না, ওনারা তাই ওনাদের মতো অন্দরমহলে আড্ডা মারছেন আর মাঝে মাঝে চা এবং টা’র জোগান দিচ্ছেন, আমরা তাতেই বেজায় খুশি। পকোড়াতে একটা কামড় দিয়ে অধীরদা জিজ্ঞাসা করলেন, “কী বুঝলেন অতনুদা?” আমি বললাম, “মাইক ব্রিয়ারলির হোমওয়ার্ক তৈরি, টনি অ্যাডামস ঘটনার দায়িত্ব মাইককে দেওয়ার পরেই, পোর্টসমাউথ পুলিশের ব্রিফ অনুসারে সঙ্গে সঙ্গে কাজ শুরু হয়ে গেছে, মাইক ব্রিয়ারলি আর তার সহকারী রবার্টসনের এ হেন কর্মপদ্ধতির সঙ্গে আমরা পরিচিত।“
২)
অধীরদা হেসে বললেন, “হ্যাঁ এটা বোধহয় সমগ্র মেট্রোপলিটন পুলিশ সার্ভিসেরই (MPS) বিশেষত্ব, যে বাহিনীকে আমরা মেট পুলিশ বা স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড নামেই চিনি। অতনুদা আপনি হয়তো জানেন যে, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড কিন্তু সরকারি ভাবে বৃহত্তর লন্ডনের নিরাপত্তা দেখে, মূল লন্ডনের দায়িত্ব অন্য বাহিনীর, কিন্তু পুরো ব্রিটেন জুড়েই কোনও কঠিন তদন্তের জন্য স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সহায়তা নেওয়া হয়, যেমন এ ক্ষেত্রে পোর্টসমাউথ ক্লাবের প্রেসিডেন্টের অনুরোধ মেনে নিয়ে পোর্টসমাউথ পুলিশ, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড চিফ, ‘টনি অ্যাডামস’-এর সাহায্য চায়।
পোর্টসমাউথকে এমনিতেই ইংল্যান্ডের সবথেকে অপরাধপ্রবণ জায়গাগুলোর মধ্যে গণ্য করা হয়। সদা ব্যতিব্যস্ত পোর্টসমাউথ পুলিশ, বেটি জেমস নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারে প্রাথমিক তদন্ত শুরু করলেও, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের হস্তক্ষেপে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে বলা যায়।
কাউন্টার টেররিজমও স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের আওতাভুক্ত কাজ, রাজ পরিবার এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের নিরাপত্তার দায়িত্বেও থাকে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড, বিদেশে ঘটে যাওয়া অপরাধের ক্ষেত্রেও অনেক সময়ে সংশ্লিষ্ট দেশের পুলিশ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের পরামর্শ চায়। এত বিস্তৃত যে বাহিনীর কাজের পরিধি, তাদের সেরা গোয়েন্দা মাইক ব্রিয়ারলি তো সবসময় এক কদম এগিয়ে তৈরি থাকবেনই। চলুন দেখি, ইয়ান ব্র্যাডলি আর কী বলছেন।”
৩)
ইয়ান, মাইককে বললেন, “আপনি সব খোঁজখবরই নিয়ে নিয়েছেন বুঝতে পারছি, তাই সরাসরি গত কালের ঘটনায় চলে আসছি। আমি উইলিয়ামস জর্জকে বেটির অনুপস্থিতির কারণ জানে কি না জিজ্ঞাসা করি, জর্জ বলে সে কিছুই জানে না, সে নিজেই নাকি বেটি অনুশীলনে আসেনি দেখে ফোন করেছিল, ফোন সুইচড অফ বলছে, অনুশীলন শেষে বেটির অ্যাপার্টমেন্টে যাবে। আগের দিন রাতে ও নাকি বেটির সঙ্গে ছিল না, ওর মায়ের জন্মদিন থাকায়, হেলিং আইল্যান্ডে মায়ের বাড়িতে গেছিল। এটা কথায় কথায় জর্জ সোমবার সকালেই আমাকে বলেছিল, তাই ওকে আমি প্রথমে বেটির অনুশীলনে না আসার কারণ জিজ্ঞাসা করিনি।
প্রসঙ্গত, জর্জকে ক্লাব ম্যানেজারের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিলেও সে এখনও লেডিজ টিমের গোলরক্ষক কোচ, জর্জ নিজেও গোলরক্ষক ছিল এবং গোলরক্ষক কোচ হিসেবে যথেষ্ট ভালো। ক্রীড়াজগতে খেলোয়াড় আর কোচের মধ্যে প্রেম কোনও বিরল ঘটনা নয়। আর বেটি জেমস হল স্ট্রাইকার, জর্জ গোলরক্ষকদের কোচ, সুতরাং স্বার্থের সংঘাতের প্রশ্ন নেই, জর্জের পক্ষে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করে, বেটিকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই, তাই ফুটবল ম্যানেজার হিসেবে আমার তরফ থেকে বা ক্লাবের তরফ থেকে ওদের সম্পর্ক নিয়ে আপত্তির কারণ ঘটেনি। তা ছাড়া বেটি জেমস দলের অপরিহার্য ফুটবলার, বেটির বা অ্যামেলিয়ার মতো ইংল্যান্ডের জাতীয় দলের ফুটবলারদের কারও সহায়তা নিয়ে দলে ঢুকতে হয় না। এই দু’জনকে আমি পোর্টসমাউথ লেডিজের দায়িত্ব নেওয়ার পরে সাউদাম্পটন থেকে নিয়ে আসি। সাউদাম্পটন লেডিজ এই দুই ফুটবলারকে সম্পূর্ণ ভুল পজিশনে খেলাচ্ছিল।
যাইহোক, জর্জের কাছ থেকেও কিছু জানতে না পেরে, আমি তখন বেটি জেমসের বাড়ির ল্যান্ডলেডি মিসেস এমার্সনের ফোন নম্বর ক্লাব রিসেপশনিস্টের থেকে যোগাড় করে তাঁকে ফোন করি, তিনি বলেন, বেটির গাড়ি তাদের কম্পাউন্ডেই আছে, তিনি বেটির দরজায় নক করেন, সাড়া না পেয়ে ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে দেখেন ঘরে কেউ নেই। মিসেস এমার্সন ব্যাপারটাকে তেমন গুরুত্ব দেননি, বলেন বেটি নিশ্চয়ই কোনও বন্ধুর সঙ্গে বেরিয়েছে। পেশাদার ফুটবল ম্যানেজার হিসেবে জানি একজন ফুটবলারের ভরা মরশুমে এ মোটেই স্বাভাবিক আচরণ নয়, আমি সাউদাম্পটনে বেটির বাড়িতে ফোন করি, ওর মা বলেন সেখানে বেটি যায়নি, আগের দিন সন্ধ্যায় ফোনে বেটির সঙ্গে তার সাধারণ কথাবার্তা হয়েছিল। আমি দুপুর অবধি অপেক্ষা করে আবার মিসেস এমার্সন আর বেটির বাড়িতে ফোন করি, কোনও খবর না পেয়ে ক্লাব প্রেসিডেন্টকে জানিয়ে পোর্টসমাউথ পুলিশ স্টেশনে সব জানাই। ওরা পোর্টসমাউথ প্রেসিডেন্টের অনুরোধ মেনে নিয়ে আপনাদের সাহায্য চায় এবং আমাকে বলে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে এসে মেট পুলিশ চিফকে ঘটনা বিস্তারিত জানাতে। তাই সন্ধ্যায় গুরুত্বপূর্ণ মিড উইক লিগ ম্যাচ থাকা সত্ত্বেও আমি নিজে ছুটে এসেছি। আমার ধারণা বেটি যাতে এফএ কাপ ফাইনালে না খেলতে পারে, কেউ তার ব্যবস্থা করেছে।” মাইক বললেন, “আপনি কাকে সন্দেহ করছেন?”
ইয়ান বললেন, “শুধু আন্দাজ করতে পারি, সে ব্যক্তি ফুটবলের সঙ্গে জড়িত। বাকিটা আপনাদের বার করতে হবে।” মাইক বললেন, “ঠিক আছে মি: ব্র্যাডলি, আপনি ফেয়ারহ্যামে বেটির ঠিকানা, মিসেস এমার্সনের ফোন নম্বর আর সাউদাম্পটনে বেটির বাড়ির ঠিকানা এবং ফোন নম্বর লিখে দিয়ে যান, পোর্টসমাউথ লেডিজের ওয়েবসাইট থেকে আমরা বাকি তথ্য সংগ্রহ করে নেব, সন্ধ্যায় আপনাদের ম্যাচ থাকলেও তার আগে অন্তত অ্যামেলিয়া আর জর্জকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চাই, বিকেল নাগাদ আমরা পোর্টসমাউথ ক্লাবে পৌঁছে যাব, ব্যবস্থা করে রাখবেন। আর সন্ধ্যায় সাউদাম্পটনের বিরুদ্ধে আপনার ক্লাবের ম্যাচের দু’টো টিকিট রেখে দেবেন, আমি আর রবার্টসন বহুদিন হল খেলা দেখতে মাঠে যাইনি।”
৪)
আমি বললাম, “অধীরদা, মাইক ব্রিয়ারলি যে শুধু ফুটবল দেখতে মাঠে যাচ্ছেন না, এটা বলে দেওয়াই যায়। পোর্টসমাউথ ক্লাবের কাউকে জেরা করতে হলে, ক্লাবের কনফারেন্স রুমেই করতে পারবেন, তার জন্য খেলা দেখার কী দরকার কে জানে?” অধীরদা বললেন, “সেই একই প্রশ্ন টনি অ্যাডামস আর রবার্টসনও করেছিল, উত্তরে মাইক বলেছেন, বেটি জেমসকে ছাড়া পোর্টসমাউথ লেডিজের এফএ কাপ ফাইনালে কতটা জেতার সম্ভাবনা আছে সেটা দেখার জন্য নাকি এই ম্যাচটা দেখা জরুরি। রবার্টসন যথারীতি বিড়বিড় করে বুড়ো ছুঁচো বলে গালাগালি দিচ্ছিল।
যাইহোক, এখন মাইকের গাড়ি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে ফেয়ারহ্যাম অভিমুখে যাত্রা করেছে, গাড়িতে ঘন্টা দেড়েকের পথ, এখন গাড়ির ড্যাশবোর্ডের ঘড়িতে সকাল এগারোটা বাজে, বেটির বাড়িওয়ালা এমার্সন দম্পতি মাইকদের জন্যে অপেক্ষা করছেন। ফেয়ারহ্যাম থেকেই মাইক আর রবার্টসন চল্লিশ মিনিট ড্রাইভ করে সাউদাম্পটনে বেটির মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যাবে, বেটির বাবা আগেই প্রয়াত হয়েছেন। সেখান থেকে কাজ সেরে, সোজা পোর্টসমাউথ ক্লাবে।
রবার্টসনই গাড়ি ড্রাইভ করছে, পাশে বসা মাইক ব্রিয়ারলির ট্যাবে পোর্টসমাউথ লেডিজের ওয়েবসাইট খোলা রয়েছে। ওদিকে আমাদের দরজা দিয়ে কফির গন্ধ এগিয়ে আসছে, চলুন অতনুদা, কফি আর ধূমপান ব্রেকের পরে আমরা সরাসরি মাইক আর রবার্টসনের গাড়িতে ওদের কথোপকথনের মধ্যে ঢুকে পড়ি।”
রবার্টসন, মাইককে পোর্টসমাউথ ওয়েবসাইটে নিমগ্ন দেখে খোঁচা মারল, “তা বস, ওয়েবসাইটে মণি-মুক্তো কিছু পেলেন?” মাইক যেন কিছুটা আনমনে বললেন, “গভীর সমুদ্রে ঝিনুক পেয়েছি কিছু, তার থেকে মুক্তো খুঁজে নিতে হবে।” রবার্টসন বলল, “বস, ঝিনুকগুলোর সঙ্গে আমার একটু পরিচয় করিয়ে দিলে, একটু দিশা খুঁজে পেতাম আর কী।”
মাইক শুরু করলেন,
“প্রথম ঝিনুক-
ইয়ান ব্র্যাডলি : বয়স পঞ্চান্ন, উচ্চতা ৫’১০”, টাক মাথা, একটু ভারী চেহারা, সক্রিয় মহিলা ফুটবল ম্যানেজারদের মধ্যে সফলতম। কুড়ি বছরের ক্যারিয়ারে সাতবার লিগ, তিনবার চ্যামপিয়ন্স লিগ জিতেছেন, কিন্তু কখনও এফএ কাপ জিততে পারেননি। ওয়েস্ট হ্যাম লেডিজ ছেড়ে এই মরশুমে পোর্টসমাউথের দায়িত্ব নিয়েছেন। ওয়েস্টহ্যামের সঙ্গে আরও একবছর চুক্তি বাকি থাকায়, তারা ইয়ানকে ছাড়তে চায়নি, শেষ পর্যন্ত একটা রিলিজ ক্লজের ফাঁক গলে ইয়ান বেরিয়ে আসেন, ব্যাপারটা অত্যন্ত তিক্ততার মধ্যে শেষ হয়, ঘটনাচক্রে তিনদিন বাদে সামনের রবিবারে এফএ কাপ ফাইনালে সেই ওয়েস্টহ্যামের মুখোমুখি হবে ইয়ানের পোর্টসমাউথ। বলা বাহুল্য এই ম্যাচ জিততে দু’পক্ষই মরীয়া থাকবে। সেটা কি কাপ জেতার সম্মানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না জল আরও দূর গড়িয়েছে?
জর্জ আর বেটির সম্পর্ক নিয়েই বা ইয়ান সাফাই গাইলেন কেন? বেটি আর অ্যামেলিয়ার টিমে অপরিহার্যতা, কায়দা করে বললেন কেন? তারা প্রিয় ছাত্রী এবং নিজে তাদের এই মরশুমে সই করিয়েছেন বলে হতে পারে, কিন্তু বেটি জেমস অন্তর্ধান রহস্যে তা কতটা প্রাসঙ্গিক? এটা আরও একটি সাফাই হতে পারে কি?”
রবার্টসন মনে মনে বিড়বিড় করে উঠল, “উফ! শালা বুড়ো ছুঁচো, সবেতেই খালি সন্দেহ।” মুখে বলল, “বস, ইয়ানকে সন্দেহ করাটা একটু বেশি বাড়াবাড়ি নয় কি? সে কি নিজের পায়ে কুড়ুল মেরে এফএ কাপ জেতার সম্মান হারাতে চাইবে?” মাইক বললেন, “সন্দেহ করাটা গোয়েন্দাগিরির প্রাথমিক শর্ত, আর সন্দেহের বহু রকমফের আছে। মূলে পৌঁছতে গেলে শাখা প্রশাখার খবরও রাখতে হয়।”
একটা সিগারেট অধীরদার দিকে এগিয়ে দিয়ে, আমিও বললাম, “বাড়াবাড়ি নাটক।” অধীরদা সিগারেট ধরিয়ে, কয়েকটা সুখটান দিয়ে বললেন, “সেটা সময় বলবে, তবে অভিজ্ঞতা থেকে জানি, মাইক ব্রিয়ারলির সব নাটুকেপনার পিছনেই একটা জ্যামিতি থাকে, আপাতদৃষ্টিতে সেটা সাধারণের চোখে ধরা পড়ে না, মনে রাখতে হবে, মাইক ব্রিয়ারলি সাধারণ রক্তমাংসের মানুষ হলেও চিন্তাভাবনায় তিনি অসাধারণ। চলুন আবার মাইক আর রবার্টসনের যাত্রাপথের শরিক হতে, ওদের গাড়িতে সওয়ার হই।”
“দ্বিতীয় ঝিনুক-
বেটি জেমস : পোর্টসমাউথ লেডিজের তারকা স্ট্রাইকার। বয়স ২৬, উচ্চতা ৫’৭”, ফুটবলারের থেকে মডেল হলে যেন মানাত, স্বর্ণকেশী।
গত মরশুমে সাউদাম্পটন লেডিজ দলে উইঙ্গার পজিশনে খেলেছিলেন, পুরো মরশুমে মাত্র পাঁচটি গোল করেছিলেন, ইয়ান পোর্টসমাউথের দায়িত্ব নিয়ে বেটি আর অ্যামেলিয়াকে সাউদাম্পটন থেকে নিয়ে আসেন। ইয়ান পোর্টসমাউথ ওয়েবসাইটে একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সাউদাম্পটন বেটিকে ভুল জায়গায় খেলিয়ে নষ্ট করছিল, পোর্টসমাউথে তিনি বেটিকে স্ট্রাইকার করে দিতেই অ্যামেলিয়া-বেটি জুটি মাঠে ফুল ফোটাতে আরম্ভ করে। অ্যামেলিয়ার সঙ্গে দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব, সাউদাম্পটন অ্যাকাডেমি থেকে দু’জনের উঠে আসা। বেটির বেশিরভাগ গোলের পিছনে মিডফিল্ডার অ্যামেলিয়ার ফাইনাল পাস। পোর্টসমাউথ লেডিজে এসে, ক্লাবের ঠিক করে দেওয়া বাড়িতে দু’জনের একত্রে থাকা, মাস দুয়েক আগে বেটি জেমসের সঙ্গে জর্জের লিভ ইন শুরু, অ্যামেলিয়ার বেটির সঙ্গ ছেড়ে অন্যত্র বসবাস। অ্যামেলিয়া কি এটা ভালভাবে নিয়েছে? পারফরম্যান্স গ্রাফ বলছে খেলায় তার প্রভাব পড়েছিল অন্তত প্রথম মাস দেড়েক, ওই সময় ছয় ম্যাচে বেটির গোল মাত্র দুই, তার একটাও অ্যামেলিয়ার অ্যাসিস্ট নয়। গত দু’সপ্তাহে চাকা ঘুরছে। এই সময়ে দুই ম্যাচে, বেটির গোলসংখ্যা তিন, তার দু’টো অ্যামেলিয়ার পাশ থেকে। মেঘ কি কেটে গেছে, না এ ছিল ঝড়ের পূর্বাভাস? বেটি এবং অ্যামেলিয়া সম্বন্ধে পোর্টসমাউথ পুলিশ সূত্রের আর একটি উল্লেখযোগ্য তথ্য হল, দুই বন্ধু ড্রাগসের নেশায় জড়িয়ে পড়ে ২০১৮-১৯ মরশুমের বেশিরভাগ সময় মাঠের বাইরে কাটাতে বাধ্য হয়েছিল।”
রবার্টসন বলল, “বস, বেটি আর অ্যামেলিয়ার সম্পর্কটা বন্ধুত্বর থেকে আরও বেশি কিছু যদি হয়, তবে দৃশ্যপটে জর্জের আবির্ভাব অ্যামেলিয়ার মনে ঈর্ষার সঞ্চার করতে পারে।”
মাইক বললেন, “ভেরি গুড পয়েন্ট রবার্টসন, এই অ্যাঙ্গেলটা তোমার মাথায় না এলে, তোমার স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে অবসর নিয়ে নেওয়া শ্রেয় হত। আমার প্রশ্ন, বেটি আর অ্যামেলিয়ার মধ্যে বন্ধুত্বের অধিক যদি কিছু থাকে, তবে সেটা ইয়ান ব্র্যাডলির অজানা থাকার কথা নয়, তবে তিনি সেটা উল্লেখ করলেন না কেন? কিছু আড়াল করতে চাইলে, তা কেন?”
এই অবধি পড়ার পর দেখলাম অধীরদা মিটিমিটি হাসছেন, তারপর বললেন, “অতনুদা দেখলেন তো, আমি কেন আগে একদিন বলেছিলাম, ‘দ্য ইনভেস্টিগেটর’ পত্রিকাটি রবার্টসনকে প্রাপ্য সম্মানটুকু দেয় না, দেখলেন
রবার্টসন কেমন কাব্যে উপেক্ষিত? একটা সম্ভাব্য পয়েন্ট তুলে ধরার পরও এমনভাবে লিখেছে যেন এটা একটা জলভাত ব্যাপার, রবার্টসনের কোনও কৃতিত্ব নেই।” আমি অধীরদার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করলাম না, গল্পে বাধা পড়ুক তেমন ইচ্ছেই আমার নেই।
“তৃতীয় ঝিনুক-
অ্যামেলিয়া কুরি : বয়স ২৮, উচ্চতা ৫’৮”, অ্যাথলিট ফিগার, ইনিও স্বর্ণকেশী। সাউদাম্পটনে গত বছর স্টপার ব্যাক পজিশনে খেলেছিলেন, পারফরম্যান্স ভালই ছিল, জাতীয় দলেও ওটাই এই মরশুমের আগে অ্যামেলিয়ার পজিশন ছিল। ইয়ান এই মরশুমে অ্যামেলিয়াকে পোর্টসমাউথ লেডিজে সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার পজিশনে নিয়ে এসে, ওর সেরা খেলাটা বার করে এনেছেন। জাতীয় দলের ম্যানেজার স্টিভ মোয়েসেও তাই এখন অ্যামেলিয়াকে সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার খেলাচ্ছেন।
বাকি ক্ষেত্রে তথ্য বেটি জেমসের তথ্যসমূহের সঙ্গে সমান্তরাল। বেটি এবং জর্জের সম্পর্কে ঈর্ষান্বিত হতে পারে, সাময়িক অবনতির পরে বেটির সঙ্গে মিটমাট? না কি আড়ালে অন্য কোনও অঙ্ক?”
“চতুর্থ ঝিনুক-
উইলিয়ামস জর্জ : বয়স ৩৩, উচ্চতা ৬’২”, সুদর্শন, সুঠাম স্বাস্থ্য, পোর্টসমাউথ ক্লাবের প্রাক্তন ফুটবলার, লেডিজ টিমের প্রাক্তন ম্যানেজার, ইয়ান ব্র্যাডলির আগমনে নিজের ক্লাবে ম্যানেজারের চাকরি হারিয়ে এখন শুধু মহিলা দলের গোলরক্ষক কোচ। বেটি জেমসের প্রণয়ী। ইয়ান ব্র্যাডলি এবং পোর্টসমাউথ ক্লাব কর্তৃপক্ষর বিরুদ্ধে রাগ থাকা অস্বাভাবিক নয়। মনে রাখতে হবে, তলানিতে নেমে যাওয়া পোর্টসমাউথ লেডিজের দায়িত্ব নিয়ে জর্জ তাদের লিগ টেবিলের মাঝামাঝি জায়গায় নিয়ে এসেছিল, ক্লাব যা ভেবেই ইয়ান ব্র্যাডলিকে নিয়োগ করুক, এ ক্ষেত্রে জর্জের নিজেকে অবিচারের শিকার মনে করা বিচিত্র নয়। সে কি বেটি জেমসকে লুকিয়ে রেখে, ইয়ানের এফএ কাপ জেতার স্বপ্নে জল ঢেলে দিয়ে প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করছে?
“পঞ্চম ঝিনুক-
ড্যানিয়েল ক্যাডিক : প্রাক্তন পোর্টসমাউথ প্রেসিডন্ট, পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার পর, বর্তমান প্রেসিডেন্ট স্কট হিউজের কাছে নির্বাচনে হেরে ক্ষমতাচ্যুত। ক্যাডিকের পোর্টসমাউথ আন্ডার ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে যোগাযোগ নিয়ে কানাঘুষো শোনা যায়, যদিও পুলিশের খাতায় তার নামে কোনও অভিযোগ নেই, পোর্টসমাউথ পুলিশের মতে, ক্যাডিক গভীর জলের মাছ। সে প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন পোর্টসমাউথ কোনও ট্রফি জিততে পারেনি। হিউজের সময়ে পোর্টসমাউথ যদি মহিলাদের এফএ কাপ জেতে এবং চ্যামপিয়নশিপে খেলা (ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় ডিভিশন বা প্রিমিয়র লিগের নীচের ধাপে থাকা ফুটবল লিগ) পুরুষদের দল যদি প্রিমিয়র লিগে খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে, তবে ক্যাডিকের পরবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতায় ফেরার কোনও আশা নেই। ক্যাডিকের দিক থেকে কোনও অন্তর্ঘাতের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। মনে রাখতে হবে উইলিয়ামস জর্জকে ফুটবল ম্যানেজারের পদ থেকে অপসারণ করেছেন নতুন প্রেসিডেন্ট স্কট হিউজ। ক্যাডিক এবং জর্জের কোনও অশুভ আঁতাত কি বেটির অন্তর্ধানের পিছনে কাজ করছে? গত শনিবার মি: ক্যাডিক সপরিবারে অস্ট্রেলিয়া গেছেন, অতএব তার অ্যালিবাই পাকা এবং
এই মুহূর্তে তাকে সশরীরে জেরার টেবিলে বসানো সম্ভব হবে না।
বুঝলে রবার্টসন, আরও এক বা একাধিক ঝিনুক পর্দার আড়ালে থেকে যেতে পারে। সেটা অকুস্থলে না পৌঁছে বলতে পারছি না।”
রবার্টসন মনে মনে বিড়বিড় করল, “সে শালারা ধনে প্রাণে মারা গেছে, এ একেবারে সাক্ষাৎ শয়তান, পর্দার আড়াল তো থাকবেই না, প্রয়োজনে পাতাল থেকে টেনে অপরাধীকে বার করবে। মুখে একটা হেঁ হেঁ হাসি মিশিয়ে দিয়ে বলল, বস আপনি যখন তদন্তে নেমেছেন, তখন অপরাধীর আর নিস্তার নেই।”
মাইক ব্রিয়ারলি মুখে কিছু বললেন না, তবে বিগলিত হাসি দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, যারপরনাই খুশি হয়েছেন।
যাত্রাপথে মাইকরা শুধু একবার খেতে দাঁড়িয়েছিল, বেলা একটা নাগাদ মাইক আর রবার্টসনের গাড়ি ফেয়ারহ্যামে পৌঁছে গেছে। পোর্টসমাউথের পুলিশের একটা গাড়িও ঘটনাস্থলে দেখা যাচ্ছে, পোর্টসমাউথ পুলিশের পক্ষ থেকে গ্যারি ফার্দিনান্দ উপস্থিত আছেন। তিনি মাইকদের স্বাগত জানিয়ে প্রাথমিক রিপোর্ট দিলেন।
ফেয়ারহ্যামের এই দিকটা খুব একটা ঘন বসতিপূর্ণ জায়গা নয়, এমার্সন দম্পতির বাড়িটি একতলা, কোনও বাউন্ডারি ওয়াল নেই, গ্যারেজ নেই, বাড়ির সামনে পিছনে দু’দিকেই অস্থায়ী ছাউনি করা আছে, সেখানে গাড়ি রাখা যায়, এখানকার সব বাড়িতেই এক ব্যবস্থা, কোনও বাড়িই গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে নেই। বাড়ির সামনে একটা হ্যাচব্যাক ভক্সোগন দাঁড়িয়ে। বাড়ির সামনে পিছন দু’দিক দিয়েই বড়রাস্তায় গিয়ে পড়া যায়, এমার্সনদের বাড়ির পিছন দিয়ে সোজা ৫০০ মিটার আন্দাজ গেলে, ওয়ালিংটন রিভার বিচ। রবার্টসন বলল, “স্যার, উধাও হয়ে যাওয়ার আদর্শ জায়গা বটে।”
৫)
এ দিকে কাকতালীয় ভাবে সোদপুর স্টেশন রোডেও এখন একটা বাজে। তাই গিন্নিদের রাগারাগিতে, অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমাকে আর অধীরদাকে মধ্যাহ্ন ভোজনের বিরতি নিতে হল। তারা বোধহয় দুপুরে কোনও সিরিয়াল দেখবেন, তাই খাওয়া দাওয়ার পাটটা তাড়াতাড়ি চোকালেন। তবে নন্দিতা বৌদি মানে মিসেস বাগচীর হাতের ভেটকির কাঁটা চচ্চড়ি খাওয়ার স্বর্গীয় অনুভূতির বর্ণনা দিয়ে কারও মন ভারাক্রান্ত করে দিতে চাই না। গলদা চিংড়ির মালাইকারি, কচি পাঁঠার ঝোল, নলেন গুড়ের পায়েসের কথা তো না হয় ছেড়েই দিলাম। নেহাত স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ধুরন্ধর গোয়েন্দা প্রবর মাইক ব্রিয়ারলি এবং তার সহকারী অ্যান্ড্রিউ রবার্টসন এত ক্ষণে এমার্সন দম্পতির বাড়ির দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছেন তাই, ওঁদের তো আর দাঁড় করিয়ে রাখতে পারি না, অগত্যা গাত্রোত্থান করলাম, নয়তো একটু গড়িয়ে নিতাম আর কী।
অধীর দা, দ্য ইনভেস্টিগেটরের পাতা খুলে আবার শুরু করলেন,
প্রথমেই এমার্সনদের বাড়িতে না ঢুকে দুই গোয়েন্দা বাড়ির আশেপাশে ফিতে দিয়ে কীসব মাপামাপি আরম্ভ করেছেন, বাড়ির পিছন দিকে দাঁড়ানো একটা টয়োটা গাড়ির চাকার মাপও নিলেন দেখছি, বাড়ির সামনের দিকে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির চাকার মাপ আগেই নিয়ে নিয়েছেন, রবার্টসন ছোট শক্তিশালী ক্যামেরায় ছবিও তুলছে, মাইক আবার ফোন করে ইয়ান ব্র্যাডলিকে কী সব জিজ্ঞাসা করলেন। নিজেদের মধ্যে দু’জনে কিছু আলোচনা করলেন, মাইকের মুখ দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই, তবে রবার্টসনের মুখ দেখে অখুশি মনে হচ্ছে না। এমার্সন দম্পতি মাইকদের অভ্যর্থনা জানাতে বেরিয়ে এসেছেন, তাদের নিয়ে বাড়িতে ঢুকলেন, দেখা যাক তারা কী বলেন।
এমার্সন দম্পতির একতলা কটেজের সামনের দিকে বেটি থাকত, পিছনে বাড়িওয়ালা দম্পতি। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িটাই বেটি জেমসের গাড়ি। পিছন দিকে দাঁড়িয়ে থাকা টয়োটা হ্যাচব্যাক গাড়ির মালিক এমার্সন দম্পতি। মিসেস এমার্সন সরকারি নার্স ছিলেন, অবসর নিয়েছেন, স্থানীয় একটি ক্লিনিকে এখনও আংশিক সময়ে নার্সিং করেন। মি: এমার্সন ব্যাঙ্কের কর্মচারী ছিলেন, অবসর নিয়েছেন, এখন কিছু করেন না। দু’জনেই ষাটোর্ধ্ব হলেও শরীর স্বাস্হ্য ভালো। ওঁদের একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে লন্ডনে।
বাড়িওয়ালা দম্পতি মি: এবং মিসেস এমার্সন জানালেন, বেটি অনুশীলন থাকলে কোনওদিন ব্রেকফাস্ট করে না, ক্লাবে গিয়েই খায়। দুপুরে লাঞ্চও ক্লাবে সারে, একজন পেশাদার ফুটবলারের তো প্র্যাকটিস সেশন, জিম সেশন, সুইমিং সেশন, রিকভারি সেশন সেরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে বিকেল গড়িয়ে যায়।
তাই সকালে তারা বেটির খোঁজ করেননি। বেটির গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেও তাদের কিছু মনে হয়নি, কারণ বেটি কখনও কখনও জর্জের গাড়িতেও অনুশীলনে যেত। যেহেতু তাদের একজন ফুটবলার এবং একজন কোচিং স্টাফ, সেহেতু ক্লাবে তাদের রিপোর্টিং এবং ডিপার্চার টাইম সবসময় মিলত না, যেদিন সেটা একই থাকত, সেদিন ওরা জর্জের গাড়িই ব্যবহার করত।
কাল রাতে ডিনার নেওয়ার সময় বেটি জানায় তার এক বান্ধবী আসবে বলে এখনই ফোন করেছে, তাই দু’জনের বদলে তিন জনের ডিনার দেওয়া যাবে কি না? মিসেস এমার্সন তখন কিছু অতিরিক্ত খাবার দিয়ে দেন, তবে কোন বান্ধবী সেটা মিসেস এমার্সন জিজ্ঞাসা করেননি, তবে ধারণা করেছিলেন অ্যামেলিয়া হবে। বেটির একসময়ের রুমমেট অ্যামেলিয়া এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর, মাঝখানে আসা একেবারে বন্ধ করে দিলেও দশ-বারো দিন আগে আবার একদিন এসেছিল।
বেটি সবসময় নিজের ঘরে খাবার নিয়ে গিয়ে খেত, কাল রাতেও সাড়ে সাতটা নাগাদ তার ঘরে খাবার নিয়ে যায়। এমার্সন দম্পতি তার পরে পরেই বাইরে গাড়ি আসার শব্দ পেয়েছিলেন। বেটি রাতের খাওয়া সারার পর নিজেদের বাসন ধুয়ে রেখে দিত, পরের রাতে সেটা ফেরত দিয়ে অন্য বাসনে খাবার নিত। মিসেস এমার্সন বেটিদের জন্য দু’সেট বাসনের ব্যবস্থা রেখেছিলেন। গতকাল ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে বেটিকে না পেয়ে তিনি বাসন নিয়ে চলে যান। বাসন সব ধুয়ে রাখাই ছিল।
মাইক জিজ্ঞাসা করলেন, সেদিন সন্ধ্যায় তারা জর্জকে দেখেছেন কি না এবং জর্জের গাড়ি দেখেছেন কি না, তাতে মিসেস এমার্সন খুব অবাক হয়ে বললেন, “না দেখিনি, আসলে অত খেয়ালই করিনি, জর্জ তো মাস দুয়েক হল বেটির সঙ্গেই থাকে, আমরা এমনিতেই তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ি, আমার কর্তা ঘুমের ওষুধ খান আর সেদিন দুপুর থেকেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টিও হচ্ছিল, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, আর সামনের দিকে কী হচ্ছে সেটা ঘর থেকে না বেরলে বোঝার কোনও উপায়ও নেই। বেটি খাবার নিয়ে চলে যাওয়ার পরে পরেই যে গাড়ির আওয়াজ পেয়েছিলাম, সেটা জর্জের বলেই ধরে নিয়েছিলাম, কারণ বেটি খাবার নেওয়ার সময় বলেছিল জর্জ তখনও ফেরেনি।
মাইক জিজ্ঞাসা করলেন, “বেটির সঙ্গে অ্যামেলিয়ার সম্পর্কটা কি শুধুমাত্র বন্ধুত্বর ছিল? অ্যামেলিয়া বেটির সঙ্গ ছেড়ে চলেই বা গেল কেন?”
মিসেস এমার্সন বললেন, “পেয়িং গেস্টের ব্যক্তিগত ব্যাপারে অহেতুক কৌতূহল আমাদের থাকা উচিত নয়, তবে আপনার ইঙ্গিতটা আমি ধরতে পেরেছি। হ্যাঁ, আমারও মনে হয়েছে, ওদের মধ্যে একটা প্রেমের সম্পর্ক ছিল, হতে পারে জর্জের আগমনে তাতে ছন্দপতন হয়েছিল এবং দু’জনে আলাদা থাকার সিদ্ধান্তে এসেছিল।”
মাইক বললেন, “আর কিছু জানার নেই, চলুন বেটি জেমসের অ্যাপার্টমেন্টটা দেখা যাক।”
বাড়ির সামনের দিকে বারান্দা দিয়ে উঠে বেটির অ্যাপার্টমেন্টের দরজা দিয়ে ঢুকলে, একটা প্যাসেজ, প্যাসেজের বাঁ দিকে একটা সু ওয়ার্ডোব, মাইক খুলে দেখলেন ছেলেদের দু’জোড়া স্পোর্টস সু, দু’জোড়া অফিসিয়াল সু, মেয়েদের তিন জোড়া স্পোর্টস সু, চার জোড়া ফ্যান্সি ডিজাইনার সু; মাইক, রবার্টসনকে ওয়ার্ডোবের ভিতরের ছবি তুলে রাখতে বললেন। প্যাসেজ পেরিয়ে ছোট ছোট দু’টো ঘর ডাইনিং রুম এবং ড্রইং রুম হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তার পিছনে বেশ বড় শোওয়ার একটা ঘর। শোওয়ার ঘরের ভিতর দিকের দরজা খুললে এমার্সনদের অ্যাপার্টমেন্ট। দরজা ভিতর থেকে বন্ধ, মিসেস এমার্সন জানালেন, এই দরজা দু’দিক থেকেই বন্ধ করা থাকে, এটা খুলতে গেলে, দু’পক্ষেরই সম্মতি দরকার হয়। এই দরজা দিয়েই বেটি খাবার নিয়ে আসে।
প্যাসেজের ডানদিকে টয়লেট এবং কিচেন। কিচেন সামান্যই ব্যবহার করা হয়, এমার্সনরাই পেয়িং গেস্টদের খাবার সরবরাহ করতেন আগেই বলা হয়েছে। কিচেনে থাকার মধ্যে একটা ডিশ ওয়াশার, চা করার ইলেকট্রিক কেটল, কাপ ডিশ, গ্লাস। মাইক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পুরো অ্যাপার্টমেন্টই পরীক্ষা করলেন, আসবাবপত্র বিশেষ কিছু নেই। ডাইনিং রুমে, খাওয়ার টেবিল, চারটে চেয়ার, একটা ফ্রিজ। ড্রইং রুমে একটা সেন্টার টেবিল, দুটো সোফা, দু’টো সাধারণ চেয়ার, দেওয়ালে একটা ল্যান্ডস্কেপ একটা টেলিভিশন।
শোওয়ার ঘরের বিছানা কিছুটা এলোমেলো, দু’টো ওয়াড্রোব, চাবি দেওয়া নেই, মাইক খুলে দেখলেন, একটায় জামাকাপড় বেশ অগোছালো, আর একটায় কিছু সাধারণ জামাকাপড়, ফুটবল জার্সি, প্যান্ট। খাটের এক প্রান্তে একটা ট্র্যাকশুট ঝুলছে। একটা ড্রেসিং টেবিল, টিপটপ পরিষ্কার,
আয়নাটি ঝাঁ চকচকে, সামান্য একটু ধুলো পড়েছে, হয়তো মালকিনের দু’-একদিনের অনুপস্থিতিতে যেটুকু পড়া সম্ভব।
ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসার ছোট টুলের ওপর একটা জার্সি। ড্রেসিং টেবিলে অনেক প্রসাধনী সামগ্রী, বডি স্প্রে, পারফিউম, লিপস্টিক, নেলপলিশ, আইলাইনার দেখে মনে হয়, বেটি সাজতে ভালবাসেন। বাথরুমে উল্লেখযোগ্য বর্ণনার মতো কিছু নেই। সাধারণ বাথরুম যেরকম হয়। তবে বাথরুমের আয়নায় একটু ক্ষণ মুখ দেখতে ইচ্ছে করে, অসম্ভব যত্ন করে পরিষ্কার করা হয়, সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। মাইক বললেন, “চলো রবার্টসন, আর কিছু দেখার নেই। মি: ফার্দিনান্দ, আপনি এই অ্যাপার্টমেন্ট আপাতত সিল করে দিন।”
অধীরদা বললেন, “মাইক ব্রিয়ারলির চোখ দিয়ে বেটি জেমসের অ্যাপার্টমেন্টে কী দেখতে পেলেন অতনুদা? দেখি মাইক ব্রিয়ারলির ভক্তের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা।”
আমি বললাম, “বেটি জেমসের ঘরদোর বেশ অগোছালো, কিন্তু সে সুন্দরী এবং সাজতে ভালবাসে। তাই ড্রেসিং টেবিল এবং বাথরুমের আয়না যত্ন নিয়ে পরিষ্কার করে, নিজের সুন্দর মুখ দেখতে কে না পছন্দ করে? সোমবার বিকেলে প্র্যাকটিস থেকে ফিরে সে ট্র্যাকসুট জার্সি খুলে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলেছে, ট্র্যাকসুট পড়েছে খাটের কোণে, জার্সি পড়েছে ড্রেসিং টেবিলের বসার টুলে। যখনই বেটি জেমস উধাও হয়ে থাকুক না কেন, সে স্বেচ্ছায় কোথাউ যায়নি। কারণ ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে প্রসাধন না করে বেটি জেমস বাড়ি থেকে বেরবে না, আর কোনও সুন্দরী যুবতী কিছুটা অগোছালো হলেও ছেড়ে রাখা জার্সির ওপর বসে প্রসাধন সারবে না, টুলের ওপর ছেড়ে রাখা জার্সি প্রমাণ করে, সোমবার বাড়ি ফেরার পর বেটি ওই ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসেনি।”
অধীরদা ওঁর ফাইভ ফিফ্টি ফাইভের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,মাইক ব্রিয়ারলি, সাউদাম্পটনে বেটির মায়ের বাড়ি যাওয়ার পথে রবার্টসনকে ঠিক এই অনুমানের কথাই বলছিলেন, যে অনুমান ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কম।”
৬)
বেটি জেমসের মা, এলিজাবেথ জেমস সামনের জানুয়ারিতে আটান্ন বছরে পা দেবেন, মেয়ের খোঁজ না পেয়ে প্রচণ্ড দুশ্চিন্তার মধ্যে আছেন, তবু বোঝা যায় এখনও তিনি রীতিমতন সুন্দরী। মি: জেমস মারা গেছেন ২০১৮-এর শুরুতে, তারপর থেকে একাই থাকেন, বেটি জেমস তার একমাত্র কন্যা, সে ঘন ঘন মায়ের কাছে আসলেও আলাদাই থাকে, সাউদাম্পটন লেডিজে খেলার সময়ও বেটি আলাদা অ্যাপার্টমেন্টেই অ্যামেলিয়ার সঙ্গে থাকত, সেই অ্যাপার্টমেন্টের দূরত্ব মিসেস জেমসের বাড়ির থেকে পাঁচ মিনিটের পথ। প্রতিদিনই মা-মেয়ের ফোনে কথা হত, মোবাইল দেখে জানালেন সোমবার সন্ধ্যা সাতটা দশে বেটির সঙ্গে তার শেষ কথা হয়। মা একা থাকে বলে বেটি মিসেস জেমসকে একটা কুকুর রাখার জন্য কিছুদিন হল চাপ দিচ্ছিল, জর্জদের বাড়ির ডোবারম্যানের কয়েকটা বাচ্চা হওয়ার পর বেটির মাথায় ঢোকে যে, একটা বাচ্চা নিয়ে তার মা পুষলে বাড়ির সুরক্ষা বাড়বে। মিসেস জেমসের আবার কুকুর পোষা একদম অপছন্দ, এই নিয়ে মা মেয়ের একটু কথা কাটাকাটি হয়, সেদিন অ্যামেলিয়া বা জর্জের প্রসঙ্গ ওঠেনি। আমি খেতে যাচ্ছি বলে বেটি ফোন কেটে দেয়।
মিসেস জেমস পরিষ্কারই জানালেন, বেটি এবং অ্যামেলিয়া সমকামী, পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট, তাই তারা একসাথে থাকতে পছন্দ করত, এই নিয়ে মিসেস জেমসের কোনও আপত্তি ছিল না, তিনি মেয়ের ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে সম্মান করেন, কিন্তু আর পাঁচটা মায়ের মতই চাইতেন মেয়ে বিয়ে করে নিজস্ব সংসার করুক, তাই মাস দুয়েক আগে বেটি যখন সুদর্শন জর্জের সঙ্গে লিভ ইনের সিদ্ধান্ত নেয়, তখন তিনি বোঝেন তার মেয়ে উভকামী, তিনি খুশিই হয়েছিলেন, নাতি-নাতনির শখ সবারই থাকে। জর্জের সঙ্গে বেটির সম্পর্ক আরও কিছুদিন আগেই শুরু হয়েছিল বলে অনুমান, বেটি বেশ কিছুদিনই জর্জের প্রশংসা করে মায়ের কাছে গল্প করত, যে লক্ষণ তিনি ভালই বুঝতেন। বেটি তাকে এটাও জানিয়েছিল যে জর্জের সঙ্গে লিভ ইনের সিদ্ধান্ত স্বভাবতই অ্যামেলিয়াকে খুশি করতে পারেনি, সে আলাদা হয়ে যায়, তবে প্রাথমিক টেনশন কেটে যাওয়ার পর কিছুদিন হল ওদের সম্পর্ক স্বাভাবিক হচ্ছিল, যতই হোক ওরা ছোটবেলার বন্ধু। মিসেস জেমস বললেন, বেটির অন্তর্ধানের পিছনে কার হাত থাকতে পারে সে নিয়ে তার কোনও ধারণা নেই, তবে বেটি জেমসের মা হিসেবে তিনি মহিলা ফুটবলের পুঙ্খানুপুঙ্খ খবর রাখেন। ইয়ান ব্র্যাডলির ওয়েস্ট হ্যাম ছেড়ে পোর্টসমাউথ লেডিজে যোগদান নিয়ে ব্যাপক তিক্ততা ও উত্তেজনার খবর তিনি জানেন। ইয়ানের সেরা অস্ত্রকে অপহরণ করে তার অধরা এফএ কাপ জয়ে জল ঢেলে দিতে ওয়েস্ট হ্যাম ক্লাব বা তাদের সমর্থকরা কত দূর যেতে চাইবেন তা তিনি বলতে পারবেন না। অ্যামেলিয়া সম্পর্ক স্বাভাবিক করে নেওয়ার ভান করে কোনও প্রতিশোধ নেওয়ার ছক করেছে, সেটা যুক্তির বিচারে একটা সম্ভাবনা হলেও তিনি মন থেকে সেটা বিশ্বাস করতে পারছেন না। মাইক আর রবার্টসন বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসার সময়, মিসেস জেমস জিজ্ঞাসা করলেন, “আমার মেয়ে বেঁচে আছে তো অফিসার?” মাইক বললেন, “ আমি শুধু বলব, সোমবার রাত থেকে বেটির বয়সী কোনও অজ্ঞাতপরিচয় যুবতীর মৃতদেহ পাওয়া যায়নি। আশাকরি শিগগির আপনার প্রশ্নের উত্তর আমরা দিতে পারব।”
৭)
মিসেস জেমসের বাড়ি থেকে বেরিয়ে মাইকদের গাড়ি আধ ঘণ্টা বাদে পোর্টসমাউথ ক্লাবে ঢুকে গেছে, মাইক, ইয়ানকে এমার্সনদের বাড়ির বাইরে থেকে যখন ফোন করেছিল, তখনই অ্যামেলিয়া আর জর্জের গাড়ি সম্বন্ধে খোঁজ খবর নিয়েছিল। রবার্টসনের অ্যামেলিয়ার ফোর্ড ফিয়েস্তা সেডান আর জর্জের ভক্সহল কোরসা সেডান বার করতে বেগ পেতে হল না। প্রয়োজনীয় কাজ সেরে রবার্টসন, মাইককে রিপোর্ট দিল। পোর্টসমাউথ প্রেসিডেন্ট, স্কট হিউজ তার ঘরে মাইকদের সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন, বললেন তিনি ক্লাবের প্রতিটি বিভাগের সমস্ত কর্মচারীদের নির্দেশ দিয়ে দিয়েছেন, যাতে মাইক এবং রবার্টসনকে পূর্ণ সহযোগিতা করা হয়। প্রাক্তন ক্লাব প্রেসিডেন্ট ক্যাডিক সম্বন্ধে বললেন, “ব্যাটা আস্ত ঘুঘু।” এর বেশি কোনও নতুন তথ্য শোনাতে পারলেন না। হিউজের থেকে বিদায় নিয়ে মাইকরা ম্যানেজার্স রুমে চলে এলেন, সেখানে ইয়ান, ওদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন, ঘড়িতে পাঁচটা বাজতে দশ মিনিট, আটটা থেকে সাউদাম্পটনের বিরুদ্ধে লিগের খেলা শুরু হবে, স্বভাবতই ইয়ান ব্যস্ত, এই সময়ে অ্যামেলিয়া আর জর্জকে জেরা করতে দিতে তিনি ইতস্তত করছিলেন, মাইক বললেন, “এই তদন্তে প্রতিটি সেকেন্ড জরুরি, আপনি অ্যামেলিয়াকে আগে পাঠান, আমরা বেশি সময় নেব না।”
অ্যামেলিয়া ঘরে ঢুকে মাইকদের সামনে রাখা চেয়ারে বসল, মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। বলল, “অফিসার্স, বেটিকে ফিরে পাওয়া যাবে তো?” মাইক বললেন, “সেটা নির্ভর করবে, আপনি কতটা সহযোগিতা করবেন, তার ওপর। আপনি কিন্তু সত্য গোপন করেছেন। ইয়ান যখন মঙ্গলবার সকালে বেটির অনুশীলনে না আসার কারণ জিজ্ঞাসা করেন, তখন আপনি একবারও বলেননি যে সোমবার বিকেলে আপনি বেটির সঙ্গে ছিলেন, আপনি বলতেই পারেন, ইয়ান তো সেটা জানতে চায়নি, কিন্তু ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝে আজকেও তো সেটা ইয়ানকে বলেননি!” অ্যামেলিয়া বললেন, “আমি যে সোমবার বিকেলে বেটির সঙ্গে ছিলাম, সেটা কী করে বলছেন?” মাইক বললেন, “এখনও আপনি সময় নষ্ট করছেন, তবু শুনুন, বিকেলে ক্লাব থেকে বেরিয়ে আপনি গাড়ি নিয়ে বেটির বাড়ি যান, গাড়ি রাখার সামনের ছাউনিতে বেটির গাড়ির পাশে আপনার গাড়ি পার্ক করেন, কারণ ক্লাব থেকে গেলে এমার্সনদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে ঢুকতেই সুবিধা, আর আপনি ফেরার সময় পিছনের রাস্তা ধরেছিলেন, সাউথসীতে আপনার অ্যাপার্টমেন্টে ফেরার ওটাই সহজ রাস্তা। ম্যাপ তাই বলছে, আপনার ঠিকানা যে আমরা জেনে নিয়েছি সেটা তো বুঝতেই পারছেন।
আপনার গাড়ি সেডান এবং টায়ার ব্রিজস্টোন, এমার্সনদের গাড়ির সঙ্গে এ গুলো মিলবে না, জর্জের গাড়ির সঙ্গেও নয়। সোমবার দুপুর থেকে ফেয়ারহ্যামে ঝিরিঝিরি বৃষ্টিপাত হচ্ছিল, এমার্সনদের বাড়ি খোলা মাঠের মধ্যে, ওই অঞ্চলের সব বাড়িই তাই। বাড়ির সামনে আর পিছনে দু’টো বাঁধানো ড্রাইভ ওয়ে গিয়ে দু’টো গাড়ি রাখার ছাউনিতে পড়েছে, বৃষ্টি থেকে গাড়ি বাঁচাতে আপনি বেটির গাড়ির পাশে ছাউনির ভিতর গাড়ি রেখেছিলেন, কিন্তু ফেরার সময় পিচ রাস্তায় পড়ার আগে আপনাকে মেঠো পথে গাড়ি নামাতেই হয়েছিল।
কম্পার্টমেন্ট থেকে যতটুকু মাটির রাস্তা পেরিয়ে পিচ রাস্তায় পড়তে হয়েছিল, তাতে আপনার গাড়ির চাকার দাগ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, জোরে বৃষ্টি পড়লে চাকার দাগ মুছে যেতে পারত। সেটা হয়নি। সোমবার রাতের পর ফেয়ারহ্যামে বৃষ্টিই হয়নি। আরও আছে, আপনি এবং বেটি দু’জনেই স্বর্ণকেশী হলেও, বেটির চুল কোঁকড়ানো, আপনার চুল সোজা, বেটির বিছানায় আমি দু’রকমের চুলই পেয়েছি, পরীক্ষা করলেই ধরা পড়ে যাবেন। আপনি আন্দাজ সপ্তাহ দুয়েক আগে বেটির বাড়িতে গেছিলেন, ততদিন আগের চুল বিছানায় থাকা অসম্ভব, বেটির বিছানা কিছুটা অগোছালো, কিন্তু অপরিষ্কার নয়। বালিশ বিছানার ওয়ার পরিষ্কার। নিয়মিত কাচা হয়। সুতরাং,
যত লুকোচুরি করবেন, তত বেটির দ্রুত ফিরে আসার সম্ভাবনা কমতে থাকবে।”
অ্যামেলিয়া বলল, “সব বলছি, বেটি আর আমি বাল্য বান্ধবী। আমাদের পড়াশোনা, ফুটবল সব একসাথে, প্রেমও। আমরা পরস্পরের প্রতি শারীরিক ও মানসিক ভাবে আকৃষ্ট। এই বছর দু’জনে পোর্টসমাউথে সই করার পর, বেটি আস্তে আস্তে উইলিয়ামস জর্জের প্রেমে পড়ে যায়, আমাদের জীবনে প্রথমবার কোনও পুরুষের আগমন।
ব্যাপারটা বেশ কয়েকমাস চলবার পর দু’মাস আগে বেটি, জর্জকে আমাদের ফেয়ারহ্যামের অ্যাপার্টমেন্টে নিয়ে আসে, বলে তিনজনে একসাথে থাকবে, আমি সেটা মানতে পারিনি, সাউথসীতে আমাদের পারিবারিক অ্যাপার্টমেন্টে মা-বাবার কাছে চলে আসি। বেটি আমার মান ভাঙানোর চেষ্টা করলেও আমি অনুশীলনের সময় ওকে এড়িয়ে চলতাম। আমার মাথায় তখন সত্যিই প্রতিশোধের আগুন, আমি বেটিকে দেখানোর জন্য আমার দ্বিগুণ বয়সী ইয়ান ব্র্যাডলির সঙ্গে ফ্লার্ট করা আরম্ভ করি, কারণ একটা পেশাদার ফুটবল দলে ম্যানেজারই সবথেকে ক্ষমতাশালী, তার বান্ধবী হয়ে আমি বেটিকে আমার গুরুত্ব বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। দু’বছর আগে ইয়ানের বউ ক্যানসারে মারা গেছে, এক ছেলে আমেরিকায় সেটল। নিঃসঙ্গ ইয়ানের মনোযোগ আকর্ষণ করতে আমায় বেগ পেতে হয়নি।
পোর্টসমাউথে যোগ দেওয়ার পর, ক্লাব ইয়ানকেও সাউথসীতে ফ্ল্যাট দিয়েছে। আমি ইয়ানের ফ্ল্যাটে গেছি, ইয়ান আমার বাড়িতে এসে আমার মা-বাবার সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলেছে। ইয়ান আমার জীবনে প্রথম পুরুষসঙ্গ, দেখলাম আমি সেই সঙ্গ উপভোগ করেছি। বুঝলাম, আমিও আদতে বেটির মতো উভকামী। আসলে বেটির সঙ্গে থাকার সময় চারিদিকে চোখ তুলে দেখিনি কখনও। হয়তো আমি শুরুতে ব্যাপারটা ফ্লার্ট ভেবেছিলাম, কিন্তু অচিরেই আমি ইয়ানের প্রেমে পড়ে গেলাম, আর প্রেমের সৌন্দর্য এমনই যে বেটিকে ক্ষমা করে দিলাম, বেটিকেও তো ভালবাসি। সপ্তাহ দুয়েক আগে বেটি প্র্যাকটিসে হাল্কা চোট পেয়ে পরের দিন আর প্র্যাকটিসে আসেনি, আমি তাড়াতাড়ি প্র্যাকটিস থেকে ছুটি নিয়ে বেটির অ্যাপার্টমেন্টে চলে যাই, জর্জ তখনও প্র্যাকটিসে। আমাদের আবার বাঁধ ভেঙে যায়। সেদিনের কথা আমি ইয়ানকে লুকোইনি। এমনিতেই বেটির সঙ্গে আমার সম্পর্ক কারও অজানা নয়। আমার একটু আশঙ্কা ছিল, ইয়ানের খারাপ লাগতে পারে বলে, বাস্তবে ইয়ান খুশি হয়েছিল, কারণ বেটি আর আমার সম্পর্কের অবনতি টিমের পারফরম্যান্সের ওপর প্রভাব ফেলছিল, সেটা ইচ্ছাকৃত না হলেও, আমরা ঠিক সুরে বাজছিলাম না। ক্লাব ম্যানেজার হিসেবে ব্যাপারটা ইয়ানকে চিন্তায় রেখেছিল। বেটির জায়গায় কোনও পুরুষ হলে নিশ্চয়ই ইয়ানের ঈর্ষা হত।
মাইক বললেন, “তবে সোমবার বিকেলে বেটির সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার খবর চেপে গেলেন কেন?”
অ্যামেলিয়া হাসল, “সোমবার প্র্যাকটিসে এসে বেটি বলে জর্জ আজ তার মায়ের জন্মদিনের পার্টিতে যাবে, রাতে ফিরবে না, আমি যেন ফেয়ারহ্যামে ওর অ্যাপার্টমেন্টে যাই, একসাথে সময় কাটানো যাবে। এ দিকে ইয়ান বিকেল পাঁচটায় টিম মিটিং ডাকে। আজকের লিগে সাউদাম্পটন ম্যাচকে এফএ কাপ ফাইনালের চূড়ান্ত প্রস্তুতি হিসেবে ধরে নিয়ে এই টেকনিকাল মিটিংয়ের ডাক। আমি আর বেটি একসঙ্গে একান্তে সময় কাটানোর সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইনি, আমি তখন ইয়ানকে বলি, পাঁচটায় আমার ডেন্টিস্টের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে, সুতরাং
মিটিং যেন মঙ্গলবার সকালে রাখে, ম্যাচের আগের দিন এমনিতেই ইয়ান হালকা প্র্যাকটিস করায়, ইয়ান আমার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়। ডেন্টিস্টের সঙ্গে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্টটা সত্যি, কয়েকদিন ধরে দাঁতের ব্যথায় ভুগছিলাম, তবে সেটা ছিল রাত সাড়ে সাতটায়।
আমি বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ ক্লাব থেকে বেরিয়ে পড়ি, বেটি তার আগেই বেরিয়ে যায়, ক্লাব থেকে বেটির অ্যাপার্টমেন্ট গাড়িতে মিনিট পনেরোর পথ, বেটি বলেছিল জর্জ রাতে ফিরবে না, কিন্তু আমি পৌঁছনোর মিনিট দশেক বাদেই জর্জের গাড়ি সেখানে পৌঁছে যায়, জর্জ গাড়ি থেকে নেমে বারান্দা অবধি আসে, তারপর আবার ফিরে গিয়ে গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে যায়, সম্ভবত আমার গাড়ি ওর নজরে পড়ে যায়, জানালা দিয়ে আমাকেও দেখে থাকবে, ড্রইংরুমের জানালা দিয়ে আমি ওকে দেখতে পাচ্ছিলাম। আমরা রেড ওয়াইন পান করছিলাম, বেটি জানালার দিকে পিঠ করে বসায় জর্জকে দেখেনি, বেটির কানে হেডফোন থাকায় গাড়ির আওয়াজও শুনতে পায়নি।
আর যখন জর্জ নিজে থেকেই ফিরে গেল, তখন আমি ওকে জর্জের আগমনের সংবাদ দিয়ে আমাদের একান্ত সন্ধ্যাটি মাটি করতে চাইনি, বেটি তা হলে ঠিক জর্জকে ডাকত।
যাইহোক, বেটির অ্যাপার্টমেন্ট থেকে আমি সাতটা নাগাদ বেরিয়ে ডেন্টিস্টের চেম্বারে যাই, ডেন্টাল চেম্বারের ফোন নম্বর লিখে দিচ্ছি যাতে আমার কথার সত্যতা আপনারা সহজেই যাচাই করতে পারেন। আমি ইয়ানের সামনে নিজেকে মিথ্যাবাদী প্রমাণিত করতে চাইনি বলেই বেটির অ্যাপার্টমেন্টে যাওয়ার কথাটা লুকিয়ে যাই। তবে আমি হলফ করে বলতে পারি সন্ধ্যা সাতটা অবধি বেটি বহাল তবিয়তে ছিল, আপনারা ওকে খুঁজে বার করুন অফিসার্স।” অ্যামেলিয়া একটানা কথা শেষে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
অধীরদা বললেন, “বলেছিলাম না অতনুদা, মাইক ব্রিয়ারলির সব নাটুকেপনার পিছনে একটা জ্যামিতি থাকে। এখন বুঝেছেন তো ইয়ান কেন, অ্যামেলিয়া আর বেটির প্রেমের সম্পর্কর কথা উল্লেখ করেননি আর কেনই বা একপ্রকার সাফাই দেওয়ার মতো করে, বেটি আর জর্জের প্রণয়ের কথা জানানোর ছলে পোর্টসমাউথ লেডিজে বেটি এবং অ্যামেলিয়ার অপরিহার্যতার কথা বলেছিলেন? ইয়ান এ ভাবে নিজের সঙ্গে অ্যামেলিয়ার প্রণয়ের সাফাইও গেয়ে রেখেছেন আর তিনি জানতেন বেটির সঙ্গে অ্যামেলিয়ার সম্পর্কর কথা বললে, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড বেটি অন্তর্ধানে অ্যামেলিয়ার মোটিভের গন্ধ পেতে পারে, তিনি তাই সুকৌশলে নিজের যুবতী প্রেমিকাটিকে আড়াল করতে চেয়েছিলেন। ইয়ান ব্র্যাডলি ঝানু ফুটবল ম্যানেজার হতে পারেন, কিন্তু স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের কর্মপদ্ধতি সম্বন্ধে তার কোনও ধারণা নেই। বয়সে প্রৌঢ় হলেও তিনি মননে প্রেমিক যুবক। সব প্রেমিকই নিজের প্রেমিকাকে ঝড় ঝাপ্টা থেকে আড়াল করার চেষ্টা করে, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।” আমি বললাম, “অধীরদা, অনেক মেয়েই বয়সে অনেক বড় পুরুষদের জীবনসঙ্গী করতে চায়, একজন ফাদার ফিগারের প্রতি আস্থা খুঁজে পায়। অ্যামেলিয়ার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।”
শুনে অধীরদা বললেন, “হুঁ, ওসব বিয়ের আগে হয় বুঝেছেন, বিয়ের পর দাম্পত্যে মেয়েদেরই একমাত্র ফিগার করা যায়, পুরুষেরা নো ফিগার হয়ে যায়। বিয়ের পর অ্যামেলিয়াই সংসার ম্যানেজ করবে, ইয়ানের দৌড় ওই ফুটবল টিম ম্যানেজ করাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে।” অধীরদা সাহসী মানুষ, বেশ জোরে জোরেই কথাগুলো বলছিলেন। আমি সভয়ে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে চারিদিক দেখে আশ্বস্ত হলাম, গিন্নিরা আশেপাশে নেই। অধীরদা তা দেখে একটা ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি হেসে বললেন, “আমাকে বোকা পেয়েছেন? ও আমি আগেই দেখে নিয়েছি, সিরিয়াল দেখতে ব্যস্ত, বুঝলেন না।” আমি, মাথা নাড়লাম, “বুঝতে কিছু আর বাকি নেই।”
মাইক, উইলিয়ামস জর্জকে বললেন, “আমরা জানতে পেরেছি,, আপনি সোমবার বিকালে বেটি জেমসের অ্যাপার্টমেন্টে গেছিলেন, কিন্তু ইয়ানের কাছে সেটা বেমালুম গোপন করে গেলেন কেন? অনুশীলনে বেটিকে অনুপস্থিত দেখে বেটিকে মোবাইলে ফোন করে দেখলেন তার ফোন সুইচড অফ। তখন এমার্সনদের ফোন করলেন না কেন? আগেই জানতেন ওদের ফোন করে কোনও লাভ নেই? জবাব দিতে হবে যে মি: উইলিয়ামস জর্জ।”
জর্জ শুরু করল, “আমাদের বাড়ি পোর্টসমাউথেরই হেলিং আইল্যান্ডে, ইদানীং আমি বেটির সঙ্গে তার ফেয়ারহ্যামের অ্যাপার্টমেন্টে লিভ ইন করছিলাম। একটু আশ্চর্যর হলেও তার আগে পর্যন্ত আমি আমার বাবা মায়ের সঙ্গেই থাকতাম, হতে পারে পোর্টসমাউথেই দীর্ঘ ফুটবল জীবনের জন্য এটা সম্ভব হয়েছে। অ্যাকাডেমি থেকেই আমি পোর্টসমাউথের সঙ্গে যুক্ত, কখনও ক্লাব বদলাইনি। অজ্ঞাত কারণে কোনও মেয়ের সঙ্গে সেরকম গভীর সম্পর্কেও জড়াইনি, হয়তো বেটি জেমসের জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। আমার মা-বাবা ছেলে সঙ্গে থাকায় খুশিই ছিলেন, বরং বেটির সঙ্গে লিভ ইনের ব্যাপারটা মানতে যেন তাদের কষ্ট হচ্ছিল, সোমবার ছিল আমার মায়ের জন্মদিন, বাড়িতে একটা ছোট খাটো পার্টি ছিল, আমি আর বেটিকে যেতে বলিনি। ওকে বলেছিলাম, ক্লাব থেকে মায়ের কাছে চলে যাব, রাতে আর ফিরছি না। সোমবার কাজ সেরে যখন ক্লাব থেকে বেরচ্ছি তখন সাড়ে চারটে বেজে গেছে, মোটামুটি ওই সময়তেই আমি রোজ বেরোই, বেটিকে মায়ের জন্মদিনের পার্টিতে না যেতে বলায় মনটা খুব খচখচ করছিল। বেটি তত ক্ষণে বাড়ির পথে রওনা হয়ে গেছে, ভাবলাম এখন ফোন করে লাভ নেই, একবার ফেয়ারহ্যামে গিয়ে দেখি যদি ওকে রাজি করিয়ে নিয়ে যেতে পারি। আমার মা-বাবাকে তো চিনি, রাগ করবেন না। গাড়ি নিয়ে সোজা ফেয়ারহ্যামে বেটির অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছে যাই। ফেয়ারহ্যামে এই সময় সওয়া চারটে নাগাদ সূর্যাস্ত হয়ে যায়, বাড়ির সামনে বিদ্যুতের আলো থাকলেও আমি গাড়ির ছাউনিতে বেটির গাড়ির পাশে অ্যামেলিয়ার গাড়ি খেয়াল করিনি, ছাউনির আলো নেভানোই থাকে, দরকার হলে জ্বালানো হয়। বাড়ির সামনের আলো যদিও আবছা ভাবে গাড়ির ছাউনিতে পৌঁছোয়।
বারান্দায় উঠতে গিয়ে আমি অ্যামেলিয়াকে জানালা দিয়ে দেখতে পাই, অ্যামেলিয়াও আমাকে দেখে থাকবে, নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। বেটি জানালার দিকে পিঠ করে বসে থাকায় আমাকে দেখতে পায়নি।
আমার ওদের অন্তরঙ্গতা দেখে খুব আনন্দ হয়, আমার কারণে ওদের মধ্যে একটা ফাটল সৃষ্টি হয়েছিল, সেটা আমাকে কষ্ট দিত, আমি আস্তে আস্তে ওখান থেকে সরে আসি, গাড়ি নিয়ে সোজা হেলিং আইল্যান্ডে চলে যাই। আমি আগের সন্ধ্যায় বেটিকে সম্পূর্ণ সুস্থ আর আনন্দে থাকতে দেখে এসেছিলাম, তাই কোনও আশঙ্কা করিনি, এমার্সনদের ফোন করার কারণ দেখিনি। ভেবেছিলাম এটা নিছক অনুশীলনে ফাঁকিবাজি ছাড়া কিছু নয়, ক্লাব থেকে যাতে যোগাযোগ না করতে পারে তাই মোবাইল বন্ধ রেখেছে। পরে ওকে বুঝিয়ে বলব অনুশীলনে ফাঁকি না দিতে। ইয়ানকে সোমবার বিকেলে আমার বেটির বাড়িতে যাওয়ার কথা বলতে গেলে, বেটি আর অ্যামেলিয়া যে মিথ্যা বলে টিম মিটিং ভেস্তে দিয়েছে সেটাও তো বলতে হত, নিজের প্রেমিকাকে কেউ অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলতে চায়?”
মাইক, এবার জর্জকে জুতোর ওয়ার্ড্রোবের ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “প্রতিদিন একই ওয়ার্ড্রোব থেকে যখন জুতো ব্যবহার করেন, তখন বেটির সব জুতো আপনার চেনার কথা। এই ছবির বাইরে বেটির কোনও জুতো আছে?” জর্জ বলল, না তো, যতদূর মনে হচ্ছে নেই। হ্যাঁ, ঘরে পরার এক জোড়া স্লিপার আছে।” মাইক বললেন, “ঠিক আছে, আপনি এবার আসতে পারেন।”
৮)
মাইক, রবার্টসনকে বললেন, “বেটির শোওয়ার ঘরে একজোড়া স্লিপার ছিল, সেটা নিঃসন্দেহে বেটি জেমসের। সু ওয়ার্ড্রোবের পাশে একজোড়া স্লিপার ছিল, সেটা জর্জের, স্লিপার ছেড়ে জুতো পরে বাইরে গেছে। বেটি কি তবে খালি পায়ে বেরিয়ে গেল রবার্টসন? অ্যামেলিয়া আর জর্জের বয়ান ক্রস চেক করতে তোমার কত সময় লাগবে রবার্টসন? তোমার বাহিনী কী ইনফর্মেশন দিচ্ছে?” রবার্টসন বলল, “স্যার অ্যামেলিয়ার বয়ান সব ঠিক আছে, ফেয়ারহ্যাম থেকে অ্যামেলিয়া ডেন্টিস্টের চেম্বারে পৌঁছোয় সওয়া সাতটায়, সেটা এন্ট্রি করা আছে, ফেয়ারহ্যাম থেকে সাউথসীর ওই চেম্বারে পৌঁছতে মিনিট পনেরো লাগে, মনে রাখতে হবে বেটি তার মায়ের সঙ্গে ফোনে সাতটা দশ-পনেরো নাগাদ কথা বলেছে।
সাড়ে সাতটায় ডাক্তার অ্যামেলিয়াকে অ্যাটেন্ড করেন, এক ঘণ্টা বাদে সেখান থেকে বেরিয়ে অ্যামেলিয়া নিজের বাড়িতে ফিরে যায়, পরের দিন সকালে অনুশীলনে যাওয়ার আগে বেরোয়নি, পোর্টসমাউথ পুলিশ রাস্তার সিসিটিভি ফুটেজ চেক করেছে, পোর্টসমাউথে পুলিশ অপরাধ রুখতে অনেক সিসি টিভি ক্যামেরা রাস্তায় লাগিয়ে রেখেছে, অ্যামেলিয়াদের বাড়ির প্রবেশ পথ তার একটার আওতায় পড়ে গেছে, বাড়িটিতে ঢোকা বেরনোর ওই একটাই দরজা। জর্জের অ্যালিবাই মিনিট কুড়ির মধ্যে জানাতে পারব।”
অধীরদা বললেন অতনুদা, “তা হলে আমরাও একটা কফি ব্রেক নিয়ে নিই, আর শুনি মাইক ব্রিয়ারলির সঙ্গে বেটি জেমস অন্তর্ধান রহস্য সমাধানে বেরিয়ে এত ক্ষণে কী সিদ্ধান্তে এলেন?” আমি কফির কাপ শেষ করে সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললাম, “মাইক ব্রিয়ারলির দাবার চাল কিস্তিমাতের আগে অবধি বোঝা যায় না, এই কেসে মোটিভ তো অনেকেরই আছে, অ্যালিবাইও। তুলনায় প্রমাণ বা সূত্র কোথায়? এই রহস্য ভেদ, রবার্টসনের ভাষায় যিনি, ‘সাক্ষাৎ শয়তান’ সেই মাইক ব্রিয়ারলির পক্ষেও অসম্ভব মনে হচ্ছে।
তবে বেটি জেমসের জুতো সংক্রান্ত একটা ইঙ্গিত মাইক দিয়েছেন। বেটি জেমস খালি পায়ে কোথাউ চলে গেল? কিন্তু কেন?
অধীরদা বললেন, “ধরুন বেটি স্বেচ্ছায় অ্যামেলিয়ার সঙ্গে গাড়িতে উঠে চলে গেল, পুলিশকে বিভ্রান্ত করতে নিজের জুতো পরে গেল না, অ্যামেলিয়া এক জোড়া জুতো আগে থেকে গাড়িতে রেখে দিয়েছিল, সেটা পরে বেটি রাস্তায় কোথাউ নেমে গেল, তারপর ক্যাব নিয়ে বা অন্য কোনওভাবে কোথাউ গিয়ে আত্মগোপন করল? বেটি মায়ের সঙ্গে মোবাইলে সওয়া সাতটা নাগাদ শেষ কথা বলেছিল, সেটা বাড়ির বাইরে থেকে বলাও সম্ভব। বেটির মা এই ষড়যন্ত্রের অঙ্গ হতে পারেন, বেটি হয়তো মায়ের কাছেই লুকিয়ে আছে। আমি বলছি না এমনই হয়েছে, কিন্তু অঙ্কের হিসেবে এটা হতে পারে বলে জুতোর ব্যাপারে ব্রিয়ারলির মনে প্রশ্ন এলেও কোনও সিদ্ধান্তে ঝাঁপিয়ে পড়েননি, শুধু বিবেচনার মধ্যে রেখেছেন। বেটি আর অ্যামেলিয়ার এই ষড়যন্ত্রের পিছনে টাকা বড় মোটিভ হতে পারে। সেই টাকা প্রাক্তন পোর্টসমাউথ প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে আসতে পারে, তিনি যে নিজের অ্যালিবাই ঠিক রাখতেই অস্ট্রেলিয়া গিয়ে বসে নেই, সেটা কে বলবে? ওয়েস্ট হ্যাম ক্লাবের সঙ্গে ইয়ান ব্র্যাডলির অত্যন্ত তিক্ত সম্পর্কর কথা ভুললেও চলবে না। একটা ঐতিহ্যশালী ক্লাব হয়তো সরাসরি এমন অপরাধে জড়াবে না, কিন্তু ক্লাব সমর্থকদের কোনও শক্তিশালী সংগঠন এই কাজ করতে পিছপা নাও হতে পারে। মহিলা পেশাদার ফুটবলাররা পুরুষ ফুটবলারদের তুলনায় স্যালারি এবং স্পনসরশিপ থেকে অনেক কম টাকা পান, মোটা অর্থের হাতছানি অনেকেই উপেক্ষা করতে পারেন না। এমনকী ইয়ানের প্রতি অ্যামেলিয়ার প্রেমও টলে যেতে পারে।
মনে রাখবেন মাঠে নেমে ইচ্ছাকৃত বাজে খেললে ক্যামেরা, অভিজ্ঞ ম্যানেজার, ক্লাব সমর্থকদের চোখকে ফাঁকি দেওয়া কঠিন কাজ, ফিফা এবং এফএ’র অ্যান্টি করাপশন ডিপার্টমেন্টও লেডিজ এফএ কাপ ফাইনালের মতো হাই প্রোফাইল ম্যাচে অত্যন্ত সক্রিয় থাকবে। ধরতে পারলে ফুটবল এবং জীবন দু’টোই শেষ।
তার চেয়ে মাঠে না নামা ভালো। চোটের বাহানা দিয়ে না খেলাও সহজ নয়, আধুনিক স্পোর্টস মেডিসিন সেটাও ধরে ফেলবে, তা ছাড়া বেটি যার সঙ্গে এক ছাদের নিচে থাকে, সে অভিজ্ঞ ফুটবলার এবং কোচ, তার চোখকে ফাঁকি দেওয়া যাবে না। অপরাধে পার্টনার বাড়লে টাকার ভাগ কমে, ঝুঁকির ভাগ বাড়ে। কী অতনুদা, আপনি তো বেশ হতাশ হয়ে পড়েছেন মনে হচ্ছে, সুন্দরী বেটি জেমসকে তো নায়িকা বানিয়ে হৃদমাঝারে বসিয়ে ফেলেছিলেন। হতাশ হবেন না, আমি শুধু বেটি জেমসের খালি পায়ে উধাও হওয়ার সম্ভাব্য একটা কারণের কথা বললাম মাত্র। আপনি বেটির প্রতি আপনার অনুরাগ বজায় রাখতেই পারেন। তবে রহস্যের সাগরে যখন জাহাজ ভাসাবেন তখন নিজেকে নিরাসক্ত থাকতে হবে, কে সাধু আর কে অপরাধী সেটা যদি আগে থেকেই ঠিক করে বসে থাকেন তবে জাহাজ কোনওদিন বন্দরে ভেড়াতে পারবেন না, ও জাহাজ ডুববেই। চলুন দেখা যাক রবার্টসন, জর্জের বয়ান যাচাই করে কী বলছে।”
আমি মনে মনে স্বীকার করলাম, এই দুনিয়ায় কেউ যদি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দা চূড়ামণি মাইক ব্রিয়ারলির বুদ্ধির আশেপাশে আসতে পারেন, তিনি হলেন, সোদপুর স্টেশন রোডের বাসিন্দা, ‘অধীর বাগচী’।
রবার্টসন বলল, “বস, জর্জ সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ছটায় স্যোশাল মিডিয়ায় তার মায়ের বার্থডে পার্টির প্রথম ভিডিয়ো পোস্ট করে, তারপর তার মা-বাবাও ফেসবুক, ইনস্ট্রাগ্রামে লাইভ ভিডিয়ো পোস্ট করে, সেখানে বাড়ির পোষ্য একাধিক কুকুরকেও দেখা গেছে, কয়েকজন অতিথিও উপস্থিত ছিল, খাওয়া-দাওয়া, কেক কাটা, ভিডিয়ো পোস্ট এইসব রাত সাড়ে এগারোটা অবধি চলতে থাকে, ভিডিয়ো এবং অন্যান্য পোস্টগুলো জেনুইন, সাইবার ক্রাইম বিভাগ জানিয়েছে, এই সময়ের মধ্যে জর্জ কোথাউ যায়নি এটা হলফ করে বলা যায়, তারপর জর্জের একমাত্র অ্যালিবাই তার মা-বাবা, তারা জানিয়েছেন জর্জ রাতে বাড়িতেই ছিল, এর সত্যতা জানার কোনও উপায় নেই।”
৯)
মাইক বললেন, “চলো মাঠে গিয়ে গ্যালারিতে বসি, খেলা শুরু হতে এখনও পৌনে এক ঘণ্টা বাকি, কিন্তু টিম দু’টো ওয়ার্ম আপ করতে এত ক্ষণে মাঠে নেমে পড়েছে, বদ্ধ ঘরে বসে থাকার থেকে সেটাই ভালো। খোলা হাওয়ায় মাথাটাও যদি খেলে।” পোর্টসমাউথ লেডিজ তাদের সম্মাননীয় দুই অতিথিকে স্বভাবতই ভিআইপি সিট দিয়েছে। পোর্টসমাউথের মেয়েরা ভিআইপি বক্সের একদম সামনেই গা ঘামাচ্ছিল, মাইক ব্রিয়ারলি গভীর একাগ্রতার সেই দিকে তাকিয়েছিলেন, রবার্টসন সেটা দেখে মনে মনে বলল, “শালা খচ্চর, গিলে খেয়ে ফেলবে মনে হচ্ছে, মিসেস লিলিয়ান ব্রিয়ারলি এইখানে থাকলে এত ক্ষণে ব্যাটার চোখ গেলে দিত।” মাইক হঠাৎ স্বগতোক্তি করে উঠলেন, “উফ, তাই তো ভাবছি, কোথায় যেন দেখেছি। রবার্টসন, তুমি কিছু দেখছ না?” রবার্টসন বলল, “অনেক কিছু দেখছি, কিন্তু বস, আপনি কী দেখাতে চাইছেন সেটা বুঝতে পারছি না।”
“পরে বোঝাচ্ছি রবার্টসন, তুমি পার্কিং থেকে গাড়ি বের করে অপেক্ষা করো, ফেয়ারহ্যামে যেতে হবে।
খেলা দেখা পরে একদিন হবে, আমি পোর্টসমাউথ অফিস হয়ে আসছি।”
মাইক গাড়িতে উঠে, পোর্টসমাউথ পুলিশের গ্যারি ফার্দিনান্দকে, এমার্সন দম্পতির বাড়িতে একটা অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে চলে আসতে বললেন। রবার্টসনকে বললেন, জানি তুমি কৌতূহলে ফুটছ, শুধু এইটুকু বলতে পারি বেটি জেমসের খোঁজ পেয়ে গেছি এবং সম্ভবত সে জীবিত। বাকিটা ক্রমশ জানতে পারবে, তোমার গাড়ি তো এমার্সনদের বাড়ির হাতায় ঢুকে পড়েছে।”
মি: এমার্সন দরজা খুলে বললেন, “আসুন অফিসার্স, দুপুরে যখন মি: মাইক ব্রিয়ারলি স্বয়ং আমাদের বাড়িতে পদধূলি দিলেন, তখনই আমরা বুঝে গেছিলাম বাঁচার আশা ক্ষীণ, আপনার কীর্তির কথা কে না জানে, তবু ভেবেছিলাম সেরা স্ট্রাইকারও তো গোল মিস করে, আপনারও ভুল হতে পারে, আপনাকে ফিরতে দেখে বুঝলাম, সে গুড়ে বালি। আমরা বেটির কোনও শারীরিক ক্ষতি করিনি, আমাদের বেসমেন্টের একটা ঘরে ও ঘুমোচ্ছে, স্যালাইনও চলছে, আমি আপনাদের বেটির কাছে নিয়ে যাচ্ছি। ওকে হাসপাতালে পাঠান, বেটি দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবে।
আর ওর মা’কে খবর দিন যে মেয়ে অক্ষত আছে, আমরা তো রইলাম, যা শাস্তি হওয়ার তা হবে, তবে আমাদের মেয়ে সম্পূর্ণ নির্দোষ, সে কিছুই জানে না, পুরো প্ল্যান আমাদের স্বামী স্ত্রী মিলে করা। মাইক, বেটিকে এক ঝলক দেখে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, “চলো হে রবার্টসন, মি: ফার্দিনান্দ এদিকের সব ব্যবস্থা করবেন, এমার্সন দম্পতি আমাদের সঙ্গে যাচ্ছেন। পোর্টসমাউথ পুলিশ স্টেশনে, ওদের মুখে অনেক গল্প শুনতে হবে। সেই সকাল এগারোটায় স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে বেরিয়ে চরকিপাক খাচ্ছি, রাত আটটা বেজে গেল, একজন তারকা ফুটবলারকে খুঁজতেই যদি আট-ন ঘণ্টা কাটিয়ে দিই তবে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড আমাকে বরখাস্ত করতে বেশি সময় নেবে না। একদম টনি অ্যাডামস স্যার পোর্টসমাউথ পুলিশ স্টেশনে ঢুকলে সব খোলসা করছি, তার আগে গাড়িতে যেতে যেতে প্রয়োজনীয় কয়েকটা ফোন সেরে নিই। পোর্টসমাউথ লেডিজের লিগ ম্যাচ শেষে পোস্ট ম্যাচ প্রেস কনফারেন্স সেরে, ইয়ান ব্র্যাডলির পোর্টসমাউথ পুলিশ স্টেশনে ওঁর ক্লাবের প্রেসিডন্ট সাহেবকে নিয়ে পৌঁছতে পৌঁছতে আন্দাজ রাত সাড়ে এগারোটা বাজবে, তারপরেই আমাদের মিটিং শুরু করতে হবে, গোয়েন্দার তো আর ঘর সংসার থাকতে নেই, কী বলো রবার্টসন?”
অধীরদা ফুট কাটলেন, “শুরু হয়ে গেছে আপনার ব্রিয়ারলি সাহেবের ভাষণ, লোকটা বুদ্ধিমান হলেও নাটুকেপনাটা নেওয়া যায় না।” আমি জানি, এ সব অধীরদার কথার কথা, ডাবলিন থেকে আসা ত্রৈমাসিক পত্রিকা, ‘দ্য ইনভেস্টিগেটর্’-এর প্রতিটি কপির জন্য অধীরের অধীর প্রতীক্ষা তো মাইক ব্রিয়ারলির গোয়েন্দা কাহিনির টানেই।
আমি শুধু বললাম, “অধীরদা, এমার্সন দম্পতি যে বলল, তাদের মেয়ে নির্দোষ, মেয়েটা কে বুঝতে পারলাম না তো!” অধীরদা বললেন, “পোর্টসমাউথ পুলিশ স্টেশন চত্বরে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের বড় কর্তা টনি অ্যাডামসের গাড়ি ঢুকে পড়েছে, তাকে ভিতরে নিয়ে গেছেন পোর্টসমাউথ পুলিশ চিফ, রব হোল্ডিং, এসে গেছেন পোর্টসমাউথ ক্লাব প্রেসিডেন্ট স্কট হিউজ, ম্যানেজার ইয়ান ব্র্যাডলি, অ্যামেলিয়া কুরি, উইলিয়ামস জর্জ। বেটির মা আসেননি, তিনি এই মানসিক চাপ নিতে পারবেন না জানিয়েছেন। তাকে পরে সব জানানো হবে। মাইক ব্রিয়ারলি, রবার্টসনকে নিয়ে তৈরি। টনি অ্যাডামস মাইককে নির্দেশ দিলেন শুরু করার জন্য। নাটকের শেষ দৃশ্যের পর্দা উঠছে, চলুন অতনুদা আমরাও রঙ্গমঞ্চে নির্দিষ্ট আসন গ্রহণ করি, দেখতে থাকি এই নাটকের কুশীলবদের ভূমিকা আর একাধারে প্রধান নট এবং পরিচালক মাইক ব্রিয়ারলি, কী ভাবে নাটকের যবনিকা পতনের চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছে যান। তার সংলাপে কান পাতা যাক।”
মাইক, স্বভাবসিদ্ধ নাটকীয় ভঙ্গিতে মাথা ঝুঁকিয়ে সকলকে অভিবাদন জানিয়ে শুরু করলেন, “অনেক রাত হয়ে গেছে, সকলেই ক্লান্ত, তাই সবকিছু আমি সংক্ষেপে বলব। বিস্তারিত লিখিত রিপোর্ট আমি, কাল টনি অ্যাডামস স্যারের কাছে জমা করব।
বেটি জেমস অন্তর্ধান রহস্যের মোটিভ খুঁজতে গিয়ে দেখি জর্জ, অ্যামেলিয়া, ড্যানিয়েল ক্যাডিক এবং পোর্টসমাউথ লেডিজের প্রতিদ্বন্দ্বী এক ক্লাবের জোরালো মোটিভ রয়েছে। জর্জ এবং অ্যামেলিয়া সোমবার বিকেলে বেটির ফেয়ারহ্যামের অ্যাপার্টমেন্টে গিয়েও সে কথা ইয়ানের কাছে লুকিয়ে গিয়ে সেই সন্দেহ আরও জোরালো করে তোলে। সেদিন অ্যামেলিয়া আর জর্জ ছাড়া কারও গাড়ি বেটির অ্যাপার্টমেন্টে যায়নি। অন্য কোনও চাকার দাগ আমরা পাইনি। বেটি একজন শক্ত সামর্থ্য ফুটবলার, তাকে গাড়ি করে অপহরণ করা কী সম্ভব? সে তো বাধা দেবে, চিৎকার করবে, এমার্সনরা একটা দরজার ওপারে সেটা শুনতে পাবেনই। তবে বেটি কি স্বেচ্ছায় জর্জ বা অ্যামেলিয়ার সঙ্গে গেল? গেলে সে খালি পায়ে যাবে কেন? সে সাজতে ভালবাসে, তার প্রমাণ পেয়েছি, স্বেচ্ছায় গেলে তার সাজগোজ করার কথা, পারিপার্শ্বিক প্রমাণ বলছে সেটা সে করেনি। এইসব যুক্তি খণ্ডন করার যুক্তিও দেওয়া যায়। কিন্তু আমরা যখন নিশ্চিত করে অ্যামেলিয়া আর জর্জের বয়ান ক্রস চেক করে
জানতে পারলাম যে সন্ধ্যা সাতটায় অ্যামেলিয়া এবং তার অনেক আগেই জর্জ ফেয়ারহ্যাম ছেড়ে চলে গেছে, তখনই আমাদের সন্দেহের তির এমার্সন দম্পতির দিকে ঘুরে গেল। মিসেস এমার্সন বলেছিলেন বেটি সেই রাতে সাড়ে সাতটার সময় তিনজনের খাবার চায়, কায়দা করে তিনি শুনিয়ে দেন বেটির এক বান্ধবী আসার কথা এবং সেটা অ্যামেলিয়া হতে পারে জানাতেও ভোলেননি। আর একজন তো অবশ্যই জর্জ। অথচ জর্জের সে রাতে ফেরার কথাই নয়, সেটা মিসেস এমার্সনও জানতেন, বেটি তাকে নিশ্চয়ই জর্জের খাবার করতে বারণ করেছিলেন, অ্যামেলিয়ার খাবার চাওয়ার প্রশ্নই নেই, সে সাতটায় ডেন্টিস্টের চেম্বারের উদ্দেশে বেরিয়ে যাবে তা বেটির অজানা নয়। জর্জ আর অ্যামেলিয়ার আসা যাওয়া এমার্সনদের নজর এড়ায়নি, কিন্তু সেটা স্বীকার করলে তারা সাড়ে সাতটার আগে চলে গেছিল সেটাও বলতে হত, সেক্ষেত্রে এই দু’জন অনেকটাই সন্দেহের আওতার বাইরে চলে যেত। তাই এমনভাবে এই দু’জনই সেদিন রাতে এসেছে বুঝিয়ে দিলেন যাতে তাদের ফেরার সময় নিয়ে এমার্সনদের কিছু বলতে না হয়, তারা তো তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েন।
কিন্তু তখনও এমার্সন দম্পতির মোটিভ আমি ধরতে পারিনি, সেটা পারলাম পোর্টসমাউথ লেডিজের ওয়ার্ম আপে।
ওয়ার্ম আপ সেশনে, ভিআইপি বক্সের মুখোমুখি আন্দাজ কুড়ি মিটার দূরত্ব স্প্রিন্ট করে এসে টাচলাইন ছুঁয়ে, ফুটবলাররা আবার ঘুরে গিয়ে হেঁটে স্টার্টিং পয়েন্টে ফিরে যাচ্ছিলেন। তখনই হঠাৎ একজন ফুটবলারের হাঁটা দেখে মনে হল, আরে এই হাঁটা তো আমি চিনি, কোথায় দেখেছি? জার্সির পিঠে ফুটবলারের নামটা দেখে আমার কাছে সব পরিষ্কার হয়ে গেল, সকালেই তো ইয়ান ব্র্যাডলির মুখে নামটা শুনেছি, আর দুপুরে ফেয়ারহ্যামে এমার্সনদের বাড়িতে দেখেছি এই হাঁটা, ডানদিকে কাঁধটা একটু সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে দ্রুত পদচারণা।” এই অবধি বলে মাইক ব্রিয়ারলি থামলেন, যেন ঘরে পিন পতনের নীরবতা উপভোগ করবার জন্যই। টনি অ্যাডামস, মাইক ব্রিয়ারলির এই সবার সাসপেন্স বাড়িয়ে দিয়ে হাততালি কুড়োবার নাটক খুব ভালই জানেন। তিনি মুখ দিয়ে বিরক্তিসূচক শব্দ করে বললেন, “কাম টু দ্য পয়েন্ট ব্রিয়ারলি, ফুটবলারটি কে? তার সঙ্গে এই কেসের কী সম্পর্ক? নো মোর সাসপেন্স, রাত বাড়ার কথা নিজেই তো বলছিলে।”
মাইক সামনে রাখা জলের গ্লাস এক চুমুকে শেষ করে, রুমালে মুখ মুছলেন, ভাব খানা যেন, জল খেতেই থেমেছিলেন। আবার শুরু করলেন, “ফুটবলারটির নাম, ‘হানা রো’। পোর্টসমাউথ লেডিজে বেটি জেমসের পরিবর্ত স্ট্রাইকার, মি: এবং মিসেস এমার্সনের একমাত্র কন্যা, যিনি বেটি জেমস অনুপস্থিত থাকলে দর্শক পরিপূর্ণ ঐতিহাসিক ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে এফএ কাপ ফাইনাল খেলবেন। তোমার মনে আছে রবার্টসন, যখন এমার্সনদের দরজা দিয়ে বেরিয়ে বাড়িটা অ্যান্টি ক্লক ওয়াইজ ঘুরে আমরা বেটির অ্যাপার্টমেন্টের দরজার দিকে যাচ্ছি তখন মি: এমার্সন চাবি হাতে আমাদের সামনে সামনে হাঁটছিলেন। বাবা আর মেয়ের একরকম হাঁটা, শুধু চেহারার বৈশিষ্ট্য নয়, অনেকসময় আমরা হাঁটা, কথা বলার ভঙ্গি, শোওয়ার কায়দা, এ রকম অনেক কিছু বাবা-মায়ের থেকে ইনহেরিট করি। আগেই বলেছি, তখন আমি এমার্সন দম্পতিকে সন্দেহ করতে আরম্ভ করেছি, কিন্তু মোটিভটা ধরতে পারছিলাম না।
পোর্টসমাউথ অফিসে খোঁজ নিয়ে বুঝলাম ক্লাবে কেউ কিন্তু জানে না, হানা রো’র মা-বাবা হলেন এমার্সন দম্পতি। হানা রো তো আর রোনাল্ডো বা মেসি নন, যে তার মা-বাবার খবর কেউ জানবে। বিবাহিত হানার স্বামীর নামই ক্লাবে নথিভুক্ত আছে। পোর্টসমাউথ ক্লাবের নিয়মানুযায়ী, কোনও ক্লাব কর্মচারী তার নিজের বা নিজের কোনও আত্মীয়র বাড়িতে ক্লাবের ফুটবলারদের পেয়িং গেস্ট রাখতে পারেন না। কারণ কোনও ফুটবলার যদি থাকা, খাওয়া এবং নিরাপত্তার মান নিয়ে প্রশ্ন তোলে, তবে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর বিরুদ্ধে ক্লাবকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। এটা করলে একই ক্লাবের দুই কর্মচারীর মধ্যে কর্মক্ষেত্রে তিক্ততা সৃষ্টি হয়, ফুটবলারও তো ক্লাবের বেতনভুক কর্মচারী। ক্লাব শুধুমাত্র মহিলা ফুটবলারদেরই ইচ্ছুক ক্লাব সদস্য সমর্থকদের বাড়িতে পেয়িং গেস্ট রাখে। হোটেলে রাখার থেকে তাতে খরচা কম, সদস্য সমর্থকদেরও কিছু বাড়তি রোজগার হয়। পুরুষ ফুটবলারদের হোটেল বা সপরিবারে আলাদা কটেজে রাখাই রীতি। মহিলা দলের বাজেট তুলনায় কম বলে পেয়িং গেস্ট রাখাই ভরসা। এর কারণ কতটা বাণিজ্যিক, কতটা লিঙ্গ বৈষম্য সেটা ক্রীড়া জগতের কর্ণধাররা বলতে পারবেন। বেটি আর অ্যামেলিয়া এমার্সনদের প্রথম পেয়িং গেস্ট। মি: এমার্সন গত বছরের শেষে কর্মক্ষেত্রে অবসর নেওয়ার পর বাড়তি রোজগারের আশায় পোর্টসমাউথ ক্লাবে পেয়িং গেস্ট রাখতে চেয়ে আবেদন করেন। অবশ্যই হানার সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা লুকিয়ে গেছিলেন। ফুটবল ক্লাব তো আর স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড নয়, যে এটা তদন্ত করে জানবে। এই মরশুমে অ্যামেলিয়া আর বেটি সই করার পর ক্লাব তাদের এমার্সনদের বাড়িতে থাকতে পাঠায়।
ঘটনাচক্রে বেটি জেমস টিমে হানা’র জায়গা কেড়ে নিল। গত দু’বছর হানা রো, ছিল পোর্টসমাউথের প্রধান স্ট্রাইকার, সে পোর্টসমাউথকে লিগ টেবিলের তলা থেকে তুলে, মাঝের সারিতে নিয়ে আসতে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিল। ম্যানেজার বদলের ফলে হানা’র জায়গা হল রিজার্ভ বেঞ্চে।
এই মরশুমে মাত্র তিনটে ম্যাচে সে স্টার্ট করেছে, আর পাঁচটা ম্যাচে পরিবর্ত হিসেবে কিছু ক্ষণ খেলার সুযোগ পেয়েছে। হানার মনে এই নিয়ে ক্ষোভ থাকা অস্বাভাবিক নয়, মা-বাবার সঙ্গে এই নিয়ে আলোচনা হতেই পারে, এমার্সন দম্পতির মাথা খারাপ হয়ে যায় পোর্টসমাউথ লেডিজ এফএ কাপ ফাইনালে ওঠায়। হানা এই ম্যাচ খেলার সুযোগ পাবে না, এই ব্যাপারটা তারা মানতে পারেননি।
তবে বেটিকে অপহরণের ছক সম্ভবত খুব পুরনো নয়, একদম আকস্মিক সিদ্ধান্ত। সোমবার সকালে যখন বেটি জানায় রাতে জর্জ ফিরবে না, তার খাবার দেওয়ার দরকার নেই, তখনই তাদের মাথার পোকা নড়ে ওঠে। জর্জের উপস্হিতিতে এই কাজ করা ছিল অসম্ভব।
একজন অভিজ্ঞ নার্স হিসেবে কাউকে কয়েকদিন ঘুমের ওষুধ ইঞ্জেকশন করে আচ্ছন্ন করে রাখা সাধারণ ব্যাপার।
এফএ কাপ ফাইনালের দিন সকালে বেটিকে বাড়ির বারান্দায় পাওয়া গেছে বলে ক্লাবকে জানিয়ে দিতেন, একদিনে বেটি কিছুতেই সুস্থ হত না। বেটির একটা ড্রাগস নেওয়ার ইতিহাস আছে, খেলার খবর যারা রাখেন তারা সেটা জানেন, এমার্সনরাও জানতেন, সবাই ভাবত বেটি আবার ড্রাগস নেওয়া আরম্ভ করেছে, পুলিশ কিছু ড্রাগ পেডলারকে ধরপাকড় করত। বেটি পরে কিছুই মনে করে বলতে পারত না, এই আচ্ছন্ন সময়ের কোনও স্মৃতি থাকবে না, সেটা পুরোটাই ঘুমের অতল গহ্বরে সমাধিস্থ।
আর বেটি জেমসের খাবারে সম্ভবত সোমবার রাতে কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ মেশানো হয়েছিল, মি: এমার্সন ঘুমের ওষুধ খান, ওষুধ বাড়িতেই মজুত ছিল।
এমার্সনরা খালি তাদের মেয়ের এফএ কাপ ফাইনাল খেলা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন, বেটির শারীরিক ক্ষতি করতে চাননি, তাই স্যালাইনের ব্যবস্থা রেখেছিলেন, আর কী ওষুধপত্র দিয়েছিলেন, কী ওষুধ ইঞ্জেক্ট করেছিলেন সেগুলো তদন্ত সাপেক্ষ। আমি নিশ্চিত ছিলাম বেটি বেঁচে আছে, তাই পোর্টসমাউথ পুলিশের মি: ফার্দিনান্দকে অ্যাম্বুলেন্স আনতে বলেছিলাম। সোমবার রাত থেকে পোর্টসমাউথ বা তার আশেপাশের অঞ্চলে কোনও যুবতীর মৃতদেহ পাওয়া যায়নি। এমার্সনদের হ্যাচব্যাক গাড়িতে কোনও লাশ পাচার করতে হলে তাকে টুকরো করতে হবে, সেটা এমার্সন দম্পতির পক্ষে কঠিন কাজ। যদি সেটা তর্কের খাতিরে সম্ভব ধরে নিই, তবে লাশ ফেলার আদর্শ জায়গা হতে পারত ওয়ালিংটন নদী, কিন্তু গতবছর একজন মহিলা মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি নিয়ে সোজা নদীতে পড়ে যাওয়ার পর থেকে বীচে চব্বিশ ঘণ্টা পুলিশ পাহারা থাকে, বীচে গাড়ি নিয়ে ঢুকলেই তারা চেক করে। সুতরাং নদীতে লাশ ফেলে দেওয়ার সম্ভাবনায় ইতি।
সোমবার সকালে বেটি অনুশীলনে বেরিয়ে যাওয়ার পরে এমার্সন দম্পতি বেটিকে অপহরণের পরিকল্পনা করেন এবং স্যালাইন এবং আনুষঙ্গিক জিনিসের ব্যবস্থা করেন, একজন স্বাস্থ্যকর্মীর পক্ষে সেটা কঠিন কাজ নয়। মনে রাখতে হবে, তিনি এখনও বিশেষজ্ঞ নার্স হিসেবে একটি ক্লিনিকের সঙ্গে যুক্ত।
সেই রাতে বেটিকে নিজেদের বেসমেন্টে আনার পর ওরা সম্ভবত আর বাইরে বেরোননি, বেটিকে পাহারা দিচ্ছিলেন। এমনকি নিজের মেয়ের লিগ ম্যাচ দেখতেও আজ আসেননি। ওরা বলেছেন হানা কিছু জানেন না, সেক্ষেত্রে মেয়েকে খেলা দেখতে না আসার কী অজুহাত দিয়েছেন তা ওরাই জানেন। পোর্টসমাউথ লেডিজের ওয়েবসাইট বলছে, পোর্টসমাউথের নিজস্ব স্টেডিয়ামে লেডিজ টিমের খেলা হয় না, তার জন্য চুক্তি ভিত্তিক একাধিক মাঠ আছে, এফএ কাপ ফাইনালের প্রস্তুতি ম্যাচ হিসেবে সেমিফাইনালের পরই পোর্টসমাউথ প্রেসিডেন্ট এই ম্যাচটি নিজেদের মাঠে খেলতে চেয়ে এফএ’কে অনুরোধ করেছিলেন। লেডিজ দলকে উৎসাহ দিতেই এই আয়োজন, তবু এই বিশেষ ম্যাচ এমার্সনরা দেখতে আসতে পারেননি। তবে এফএ কাপ ফাইনাল দেখতে লন্ডনে যেতেনই, সেইজন্যই আমার ব্যাখ্যা, বেটিকে তারা ফাইনালের দিন সকালে ক্লাবের হাতে তুলে দিয়ে লন্ডন রওনা হতেন। ভুল হলে ওরা শুধরে দেবেন।”
টনি অ্যাডামস বললেন, “আচ্ছা ব্রিয়ারলি, ম্যাচের আগের দিন রাতে বেটিকে ফুড পয়সন করে দিলেই তো ঝামেলা মিটে যেত, ঝুঁকি নিয়ে অপহরণের কী দরকার ছিল বলতে পারো?”
মাইক বললেন, “বেটিকে ওরা পেতেন কোথায়? রবিবার এফএ কাপ ফাইনাল খেলবার জন্য ইয়ান ব্র্যাডলি আজকের লিগ ম্যাচের পর কাল বা পরশু তার টিম নিয়ে লন্ডনে ঘাঁটি গাড়তেন, ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে প্র্যাকটিস সেশন তো ম্যাচের আগে তাদের প্রাপ্য। দেড় ঘণ্টা যেতে দেড় ঘণ্টা আসতে মোট তিন ঘণ্টা যাতায়াতোর ধকল তিনি নেবেন কেন? আর এই ধরনের হাই প্রোফাইল ম্যাচের আগে সব ফুটবলারকে একত্রে টিম হোটেলে রাখাই রীতি। বাড়ি থেকে গিয়ে এই ম্যাচ খেলার প্রশ্নই নেই, এটা গোয়েন্দা নয়, ফুটবল অনুরাগী হিসেবে বললাম। বেটির ল্যান্ড লেডি সেটা জানেন। বেটি যখন রাতে মিসেস এমার্সনের অ্যাপার্টমেন্ট্ তার আর জর্জের খাবার আনতে যেতেন, তখন একটু গল্পগুজবও কি হত না? সুতরাং সোমবার রাতে জর্জের অনুপস্থিতির সুযোগ এমার্সনদের নিতেই হত। অ্যামেলিয়া যদি সেদিন ডেন্টিস্টের কাছে না গিয়ে, বেটি জেমসের সাথে থেকে যেত, তবে এমার্সনদের কোনও পরিকল্পনাই কাজে লাগত না।
হানা’র স্বামীর নাম স্মিথ রো, তার অফিস সাউদাম্পটনে এবং সেখানেই সস্ত্রীক থাকেন। মিসেস এমার্সন বলেছিলেন তার মেয়ের বিয়ে হয়েছে লন্ডনে, সেটা সত্যি, হানা আগে খেলত লন্ডনের ফুলহ্যাম ক্লাবের হয়ে, সেখানেই স্মিথের সঙ্গে তার প্রণয় ও পরিণয়। তিন বছর আগে হানা পোর্টসমাউথ লেডিজে সই করলে, স্মিথ কর্মক্ষেত্রে বদলি নিয়ে সাউদাম্পটনে চলে আসে। পোর্টসমাউথ ক্লাব থেকে হানাদের বাড়ি গাড়িতে যেতে আধ ঘণ্টা লাগার কথা।
হানা এবং স্মিথ কখনও কখনও এমার্সনদের সঙ্গে দেখা করতে এলেও অ্যাপার্টমেন্ট মালিক এবং তার পেয়িং গেস্টদের প্রবেশ পথ এবং কার পার্কিং কটেজের বিপরীত দিকে হওয়ায় বিষয়টা জানাজানি হয়নি, এমার্সন পরিবার তো নিশ্চয়ই সতর্ক থাকতেন।
আর ব্রিটিশরা গোয়েন্দা না হলে, অন্যের বিষয়ে নাক গলায় তেমন বদনাম কেউ দিতে পারবে না। আমি এই রহস্যের সব পয়েন্টগুলোই ছুঁয়ে গেলাম, তবে মি: এবং মিসেস এমার্সনের নিশ্চয়ই কিছু বলার আছে, সেটা আপনারা এখন বলতে পারেন।”
মিসেস এমার্সন বললেন, “সব আমারই দোষ। আমার মেয়ের থেকেও কম বয়সী একটা মেয়ে আমার পেয়িং গেস্ট আর তার সঙ্গে কী আচরণ করে ফেললাম! মি: এমার্সন এই অকাজে রাজি ছিলেন না। হানা ফুটবলার হওয়ার জন্য অনেক আত্মত্যাগ করেছে, বাইরে বাইরে থেকেছে, ছোটবেলায় ফেয়ারহ্যামের অনতিদূরে সাউদাম্পটন লেডিজ অ্যাকাডেমিতে ফুটবল চর্চা শুরু করলেও, জুনিয়র লেভেল থেকেই শহরের বাইরে বাইরে বাড়ি থেকে দূরে থেকেছে, সেসব বিস্তারিত বলে লাভ নেই। হানার বয়স এখন তিরিশ। আর বছর দুয়েকের মধ্যে পারফরম্যান্স গ্রাফ নামতে শুরু করবে, তিরিশের পরেই পেশাদার ফুটবলারের ক্লাব থেকে দীর্ঘ মেয়াদী চুক্তি পেতে অসুবিধা হয়। হানা এখনও পর্যন্ত ইংল্যান্ডের জাতীয় দলের জার্সি পরতে পারেনি, যেটা ওর শিশু বয়স থেকে লালিত স্বপ্ন, আমাদেরও। ছোটবেলা থেকে ও কোনও খেলনার জন্য বায়না করত না, খালি জাতীয় দলের জার্সি কিনে দিলেই খুশি, সে জার্সি হানার গা থেকে খোলাই ছিল দুঃসাধ্য কাজ। পোর্টসমাউথ লেডিজ এফএ কাপ ফাইনালে উঠেছে, মেয়েটা প্রথম দলে থাকবে না, পরিবর্ত হিসেবে মাঠে যে নামতে পারবেই তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। আমাদের মনটা খুব খারাপ হয়েছিল,
কিন্তু তা বলে বেটির অনিষ্ট কামনা করিনি, ফুটবলারের প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবার দিতে কার্পণ্য করিনি।
সোমবার সকালে অনুশীলনে যাওয়ার সময়, বেটি বলে গেল, জর্জ আজ রাতে ফিরবে না, রাতে ওর খাবার দেওয়ার দরকার নেই, মাথায় শয়তান ভর করল, ভাবলাম বেটি যদি কয়েকটা দিন ঘুমিয়ে থাকে, তবে আমাদের মেয়েটা এফএ কাপ ফাইনাল খেলতে পারবে। এত বড় ম্যাচে কখনও খেলেনি হানা, দর্শক ভর্তি ঐতিহাসিক ওয়েম্বলি স্টেডিয়াম, লাইভ টিভি কভারেজ, ইংল্যান্ডের মহিলা ফুটবল দলের ম্যানেজার স্টিভ মোয়েসের শ্যেন দৃষ্টি থাকবে এই ম্যাচের ওপর, আর হানার গোলে যদি এফএ কাপ জিতে নেয় পোর্টসমাউথ লেডিজ! তবে ইংল্যান্ডের জার্সি পরবার অধরা স্বপ্ন ছুঁয়ে ফেলবে মেয়েটা। স্টিভ মোয়েসের ফোন আসা তো তখন সময়ের অপেক্ষা। পরের দিন ডেইলি মেল, দ্য সান, দ্য টাইমস, ডেইলি মিরর প্রভৃতি খবরের প্রথম পাতায় শুধু, একটাই ছবি, একটা নাম, ‘হানা রো’। পোর্টসমাউথের মানুষের মুখে মুখে একটাই নাম, ‘হানা রো’, যাকে স্থানীয় মেয়ে হিসেবে তারা জানতই না, সেই রাতারাতি পোর্টসমাউথের নয়নের মণি। যে ইয়ান ব্র্যাডলি, পোর্টসমাউথ লেডিজ দলের ম্যানেজারের দায়িত্ব নিয়েই হানাকে রিজার্ভ বেঞ্চে নির্বাসিত করেছেন, তিনিই ওর সাউদাম্পটনের ফ্ল্যাটে ছুটছেন নতুন চুক্তিপত্র নিয়ে। রঙিন স্বপ্নে আমি আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম, মি: এমার্সনকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করালাম, বেটি মাত্র কয়েকটা দিন ঘুমিয়ে থাকবে ব্যস।
সেই মতো ব্যবস্থা করে ফেললাম। ঘুমের ওষুধ তো ঘরেই ছিল, মেডিক্যাল পার্সোনাল হওয়ার কিছু অন্যায্য সুযোগও নিয়েছি। পুরো গুছিয়ে বিকেলে বেটি আসার অপেক্ষায় ছিলাম।
বেটি ফিরল, পিছন পিছনই প্রায় অ্যামেলিয়া, প্রমাদ গুনলাম, অ্যামেলিয়া থেকে গেলে সব পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। তারপরেই এল জর্জ, কিন্তু বাড়িতে না ঢুকেই ফিরে গেল। ঘড়ির কাঁটা ঘুরছিল, ক্রমশ অধৈর্য হয়ে পড়ছিলাম, একসময় অ্যামেলিয়াও বেরিয়ে গেল, হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম, আমরা সব লক্ষ রাখছিলাম। বেটি খাবার নিতে এল, সেই খাবারে তো কারুকার্য করে রেখেছি।
এক ঘণ্টা পরে আমরা ডুপ্লিকেট চাবি খুলে বেটির ঘরে ঢুকি, নিশিত হওয়ার জন্য এই সাবধানতা, যদিও জানতাম ঘুমের ওষুধে অনভ্যস্ত বেটি, ঘুমের ওষুধের হেভি ডোজ সহ্য করে অত ক্ষণ জেগে থাকতে পারবে না। দুই অ্যাপার্টমেন্টের মধ্যের দরজা খুলে বেটিকে আমাদের বেসমেন্টে নিয়ে আসি। মি: এমার্সন বেটির অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে গিয়ে মাঝের দরজা বন্ধ করে, সামনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে চাবি বন্ধ করে আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে আসেন। আমরা নিশ্চিন্তে ছিলাম দু’জন বয়স্ক মানুষকে কেউ সন্দেহ করবে না, পুলিশ আমাদের অ্যাপার্টমেন্ট সার্চ করবে না, আমাদের কোনও মোটিভ থাকতে পারে সেটা কেউ ভাবতেই পারবে না। মি: ব্রিয়ারলি আমাদের ভুল প্রমাণিত করলেন।
আমাদের কঠিন শাস্তি হোক, শুধু বেটি জেমস নয়, আমরা কায়দা করে জর্জ আর অ্যামেলিয়ার দিকে সন্দেহের তির ঘুরিয়ে দিতে চেষ্টা করে গেছি, অথচ এরা আমাদের সন্তানতুল্য। তবে হানা কিন্তু সত্যিই কিছু জানে না। মি: এমার্সনও আমার অপরাধের শাস্তিই পাবেন, তাকে আমি একপ্রকার বাধ্য করেছি আমার দুষ্কর্মে সামিল হতে।” মি: এমার্সন, তার মিসেসের পিঠে হাত রাখলেন, মিসেস এমার্সনের এত ক্ষণের সংযম ভেঙে গেল, তিনি দু’হাতে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙে পড়লেন।
অধীরদা বললেন, “চলুন অতনুদা, আমরা মিসেস এমার্সনকে কাঁদার সুযোগ দিই, এমার্সন দম্পতি সত্যিই অনুতপ্ত কি না, তা বিচার করার আমরা কে? তার চেয়ে, এক মুহূর্তের জন্য চোখের জলের ওপর বিশ্বাস অটুট রেখে,
আমরা বরং পোর্টসমাউথ পুলিশ স্টেশনের কার পার্কিংয়ের বাইরের জমায়েতে চোখ রাখি। টনি অ্যাডামস, আগেই বেরিয়ে গেছেন। একটু বাদেই মাইক ব্রিয়ারলি, রবার্টসনের গাড়ি লন্ডনের উদ্দেশে রওনা দেবে, উপস্থিত কুশীলব
সকলেই তাদের কৃতজ্ঞতা এবং বিদায় জানাচ্ছেন।
মাইক ব্রিয়ারলি, পোর্টসমাউথ ক্লাব প্রেসিডেন্টকে বলছেন, দেখুন যদি আপনার ক্লাবের মেডিক্যাল টিম রবিবারের এফএ কাপ ফাইনালের আগে বেটি জেমসকে সুস্থ করে তুলতে পারে। ওদিকে আপনার ক্লাবে দু’-দুটো বিয়ের সানাই বাজতে চলেছে, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকে নিমন্ত্রণ করতে ভুলবেন না, পুলিশের সঙ্গে খাদ্যদ্রব্যের কোনও শত্রুতা নেই, কী বলো হে রবার্টসন।”
অধীরদা, দ্য ইনভেস্টিগেটরের পাতা বন্ধ করে বললেন, “এক কথায় মাইক ব্রিয়ারলিকে কী উপমা দেওয়া যায় বলুন তো অতনুদা?” আমি, কেন জানি না, রবার্টসনের মতই বিড়বিড় করে উঠলাম, “শালা সাক্ষাৎ শয়তান।”