• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৫ | জানুয়ারি ২০২২ | কবিতা
    Share
  • আরাবল্লীর কাব্য : ইন্দ্রনীল দাশগুপ্ত



    ধুলোর দুহিতারা



    তখন শহরে ছিল একটাই সাপের মত লম্বা রাস্তা -
    আঁধি উঠলে সেটাও থাকত না, আমাদের বাস ঘ্যাঁচ করে দাঁড়িয়ে যেত যমুনার চিকচিকে জল থেকে কয়েক হাত দূরে।
    বাস থেকে মাটিতে নামলে আর উঠতে পারব না জানতাম সবাই
    কিন্তু সে সব নিষেধ উপেক্ষা করে হুড়মুড়িয়ে নেমে পড়ত ধুলোর দুহিতারা
    জলে পা ভেজাবার লোভ সামলাতে না পেরে।
    এগিয়ে যাওয়ার আগে আমরা শেষবারের মত "বিদায়", বলতে গিয়ে দেখতাম
    বালিতে তাদের পায়ের ছাপগুলো দৌড়োচ্ছে আমাদের সঙ্গে
    আর তারা নদীর নীচে ব্রীজের শিকল ধরে ঢেউয়ের মধ্যে
    ডুব দিতে গিয়ে বিষম খেতে খেতে এক কোমর জলে দাঁড়িয়ে পড়ছে।

    বাস চলতে শুরু করত -
    আরাবল্লীর পাশ দিয়ে এঁকে বেঁকে যাওয়া রাস্তাটায়
    আঁধির কুড়িয়ে আনা উন্মত্ত ওড়নাগুলো বাবলার ডাল থেকে সরিয়ে
    আমাদের হৃদয় চলে যেত রিজের দুর্গম গভীর কাঁটাগাছের অরণ্যের ভিতর
    যেখানে ঠান্ডা পুকুরের নীচে গত বছর থেকে শুয়েছিল একটা পরী।
    তার খোলা চোখ দুটো তখন আমাদের নিষ্পলক দেখতে দেখতে সূর্যের সঙ্গে পিছলে নামছে টিলার পিছনে
    হিন্দুরাও হাসপাতালের দিকে... পরিত্যক্ত হনুমানের মন্দিরে ঢুং ঢাং কেন?
    অস্বস্তির সঙ্গে বাজতে শুরু করেছে রাজস্থানী মহিলার হাতের ঘন্টা।

    সন্ধ্যে হল। হরপ্পার প্রাচীন ধংসাবশেষের গলি অতিক্রম করে
    আমরা বাড়িতে ঢুকবার সময় বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিয়েছি কেউ পিছু নিয়েছে কিনা -

    হঠাৎ দরজা খুলে মা আর মামিমা একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল - এই তোদের সঙ্গে ওরা কারা!

    তখন পিছন দিকে না তাকিয়েও জানতাম গলির অন্ধকার দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের দেখছে ধুলোর প্রতিমারা
    যারা তাদের পথে ছেড়ে না আসার জন্য অনেকবার সেধেছিল।


    শববাহী নদীটির পাড়ে


    একদিন আমাদের মন সব তর্কের গোলাপ
    চেয়েছিল ঝরে যাক রূপবান চপ্পলের নীচে
    পরীদের; ফাল্গুনের ক্রূর হাতে জীবনের তুলি
    ছেড়ে দিয়ে দেহের গোধূলি এই প্রলম্বিত ক্রিকেটের পিচে
    হেরে যাক।

    এবং পাহাড় থেকে নুড়ির ধসের মত গড়িয়ে আমরাই
    আরাবল্লীর ঘাটে আলোয় ধাঁধানো এই ধুলো আর ধ্বংসের মাজারে
    নেমে আসি যেখানে ঘাসের কোলে সুবীর্য বাংলার তুলে মুখ
    গালিব করাতেন পান তিনটি লিঙ্গের চেয়ে ভিন্ন কোনও আরক্তিম সুখ -
    সেখানে আবার যেন মৃত্যুকে উপেক্ষা করে পরীদের সঙ্গে জন্মাই

    শববাহী নদীটির পাড়ে -


    আসাদের শহরে সনেট


    গদ্য কবিতার ক্লাসে হাসতে আমাদের ছিল মানা
    - শোনো তোমরা এখানে ফাজলামি না করে, যাও প্লীজ -
    বলে আরাবল্লীর এই নিভে যাওয়া সূর্যের দহ্‌লীজে
    নতুন কাফিলা এসে খুলেছে নতুন শুঁড়িখানা -

    তখন। আমরাও পথে নেমে এসে নিজেরই শহরে
    অচিন গলির এক অজানা ঠিকানা নিয়ে খুঁজে
    বিকেলের ভারে কোনও ভেঙে যাওয়া বিষন্ন গম্বুজে
    উঠে মাস্তানের মত একসঙ্গে হাসতে শুরু করে

    বলেছিলাম - এইখানে একদিন আসাদ এসেছিল
    এই কয়লার চাঁই ভেঙেছিল হাতুড়ির ঘায়ে
    ধার করে টেনে মদ হেরেছিল আসল জুয়ায়
    কিন্তু শহরের সেই উন্মত্ত ফকিরও হেসেছিল -

    কারণ একদিন এই আগুনের নদীটা বদলাবে
    গদ্য কবিতার ক্লাসে, সকলের সঙ্গে বসে যাবে!


    আরাবল্লীর আদিম গীর্জায় দাঁড়িয়ে রেজারেকশান


    বসন্তের বন্ধ কামরায় বাইরে থেকে লাগিয়ে দিয়ে খিল
    যখন এক বেওকুফ চৌকিদার পাহাড় থেকে হারিয়ে গিয়েছিল
    তখন আমাদের চুল না বাঁধা সেই সাধারণ পৃথিবীকে দেখেই পাগল হয়ে যাওয়া মুক্ত পরাগের স্রোতে
    দাঁড়িয়ে কোনও আরাবল্লীর আদিম গীর্জার শেষ রো'তে
    আমরা বলেছিলাম -

    হে পৃথিবী - এই কাঁটার শয্যার ঘুম ভাঙিয়ে দিও না কোনও জাগরণের ভোরে
    ভালোবাসার সমান আমাদের প্রবঞ্চনার যোগ্য এবং প্রবঞ্চিতার ক্ষমার উপযোগী করে
    গড়ে তুলো। আমাদের হাতে ধরা প্রার্থনার মোমবাতিগুলি যখন একদিন নিভে যাবে
    সময়ের হিমবাহে ঢেকে দিও সবাইকে সাদা চাদরের অভাবে।

    তারপর যদি আমরা প্রতিশ্রুত কোনওদিন আরেকবার শব থেকে উঠি
    প্রতিটি দেহের কোষ অবিকল সংগঠিত হলে, প্রতিটি বাতাসের অণু, আমাদের একত্রিত মুঠি
    তখন বসন্তের স্নিগ্ধ কামরায় আবার যেন হই অবরুদ্ধ, আর তালা যেন হয় চাবিহারা -
    এই আদিম পৃথিবীকে যেন আবার তাদের বুক দিয়ে ঢেকে দেয় আমাদের যৌবনের কাঁটার লতারা।


    হোলি


    সুখ ছিল না দুঃখ, আজ বুঝতে পারা ভার
    কাঁটার লতাগুলি ঠেলে জাগরণের দ্বার
    ঢুলতে ঢুলতে ঢুকেছিল - ওঠো মির্জা, ভীতু!
    শহরের সর্বাঙ্গ জুড়ে এই পরাগের ঋতু

    কাল সকালে মিলিয়ে যাবে, তখন ফিরে আবার
    তাকিয়ে যদি দেখো, দেখবে সাঁতরে গেছি লাভার
    নদী, পদধ্বনির শব পেরিয়ে গেছি কত -
    আঁচড়ে তোমার নীরোম বুকে গভীর করে ক্ষত

    আমরা যাব মিলিয়ে সেই কুয়োর পাতাললোকে
    বহুযুগের ওপারে কোন অপানৃতার চোখে -
    তখন তুমি বুঝবে তোমার সঙ্গে কেন আছে
    বসন্ত, যে আসত শুধু বে-শরমের কাছে।



    সুখ ছিল না দুঃখ, আজ বোঝা কঠিন তার
    কাঁটার লতাগুলি ঠেলত জাগরণের দ্বার
    ঝাঁকিয়ে তুলে দিয়ে বলত - ওঠো মির্জা, ভীতু!
    ঘুমের সময় নেই, শহরে বে-শরমীর ঋতু।


    পঁচাত্তর বা সাতাত্তরের ক্লাস


    যমুনার দুই কংক্রিটের পাড় ভেঙে যাওয়ার পর মনে হত আমাদেরই চোখের ভুল
    কেননা ইঁটের শবের উপর সাবধানে পা ফেলে, হাতে চটি,
    স্পষ্ট দেখা যেত হাঁটছে শিমলিপুরের পুল -

    আমাদের সেই ছেলেবেলায় প্রায়ই ক্ষেপে গিয়ে বাতাস, নদী, বন,
    আর পৃথিবীর সীমান্ত থেকে ছুটে আসা আকাশবাড়ির বত্রিশজন বউ
    তাদের কয়লায় চলা ট্রেনের মত অন্ধকার চুল দিয়ে ঢেকে ফেলত আমাদের পাড়া, ব্রিটিশদের তৈরী বাড়ি -
    (কিম্বা বাড়ি তাদের বলা উচিত নয় কারণ কনুইতে কনুই গলিয়ে দাঁড়ানো সেই হলুদ চূনের বাক্সগুলো
    নিজেদের হয়ত ভাবত এক ধরণের আরব সাগরের ধৌ
    অচিন কোনও নাবিকের সঙ্গে দিকশূন্যতায় যারা দিয়েছে পাড়ি -
    নীল কাঠ আর কাঁচের জানলাগুলো তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটতে গিয়ে হয়ে যাচ্ছে ক্লান্ত)

    মুষলধার বৃষ্টিতে শহরের যত বেঁকেচুরে এগোনো ফাটল
    রোশনারা নামের একটি রাজকন্যার চূর্ণকুন্তল মুখ আড়াল করে থামত।
    প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে তার অগ্রসরমান ধ্বংসের পরিখাগুলি জানত
    লোমে আর অবেলার আলোয় ঢাকা তাদের পুরোনো শরীর, পাচ্ছে কোনও নতুন মানুষের নাম।

    আমরা দৌড়োতে শুরু করতাম -
    আমাদের ময়লা ও ছেঁড়া কাপড় চোপড় সব ত্যাগ করে আমরা শিমলিপুরের বালক ও বণিতারা
    চুল দিয়ে মুখ ঢেকে কাহারদের ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে লজ্জাকে ছুটে হারাতাম রেসে

    এক ঝাঁক জলের কণার সঙ্গে হো হো করে হেসে
    আমাদের উড়িয়ে নিয়ে যেত -
    সেই পঁচাত্তর বা সাতাত্তর সালের সবজান্তা হাওয়া, যে দেখেছিল
    বন্যায় আমাদের বক্তৃতা, আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের ইতিহাসের মূক ও বধির চলচ্চিত্রের রীলও -
    বক্সি রোড ধরে সাঁতরে চলেছে সম্বলপুরার স্লুইসগেটের দিকে,
    বালকরাম হাসপাতালের টিলা থেকে গুঁড়ি মেরে নেমে এসেছে কচ্ছপের মত পুলিশের জিপ
    পোস্ট অফিসের গোল দ্বীপ
    বোঁ বোঁ করে ঘুরে শিমলিপুরের সেকেণ্ড মার্কেট থেকে ভাসতে শুরু করেছে,
    পার্ক থেকে হাজার হাজার পাথরের নুড়ি -

    আর আমরা? - রদ্দির বস্তা ছিঁড়ে বেরিয়ে আসা গর-লেফাফা, তামাদি সব চিঠি,
    কেউ ভাঙা টাইপরাইটার, তো কেউ তানপুরার হাত ধরে বেরিয়ে আসা তবলা, কেউ হাতুড়ি
    সম্বলপুরার ব্যারাজের উপর আমরা সবাই মিলিত হয়ে একসঙ্গে যখন হি হি করে কাঁপতাম শীতে
    দূর নভস্তলে তখন চটি হাতে হাঁটছে ভাঙা ইঁটে
    বকের মত সাবধানে পা ফেলে ফেলে, খ্যাপা সেই শিমলিপুরের পুল
    আকাশপাড়ার ড্রেনপাইপ বেয়ে নামতে শুরু করেছে অন্ধকারের চুল
    ডক্টর বাজাজের ডায়াবেটিসের রুগীরা বানের ভাঙা বাঁধ দেখবে বলে ভুল করে চলেছে উলটো দিকের পথে
    ভিজে ঢোল হয়ে যাওয়া গ্রেনেড পকেটে নিয়ে মোটরসাইকেল ঠেলছে ধরমবীর গুজ্জরের গ্যাং,
    এক গলা জল তোলপাড়
    করে একটা নিরুদ্দিষ্ট ডিটিসির বাস খুঁজছে তার ভেসে যাওয়া ড্রাইভার

    কেউ আমাদের চিনে ফেলার আগে আমরা লাফ দিয়ে ব্যারাজ থেকে নেমে পড়তাম হাঁটু অবধি ডোবা বালির চরে
    যেখানে পায়ের পাতার উপর দিয়ে সরত একের পর এক হেরে যাওয়া অভিমানী গব্বরের
    মত আকাশের দিকে চেয়ে থাকা জল-অপ্সরাদের অম্লান চোখ।
    আমরা ফেরার পথে মনে মনে আউড়ে যেতাম - শীগ্‌গীরই হবে দেখা আবার, দেখা হবে ...


    কিন্তু আমাদের দেখা হয়নি কোনওদিন তারপর - শুধু প্রচণ্ড হাওয়ায় পরচুলের মত উড়িয়ে দিয়ে চুল, আমাদের খড় আর মাটির অবয়বে -
    আমাদের নগ্ন মুখে আর রং উঠে যাওয়া দেহে হাত বুলিয়ে চিনে নিয়েছিল অপ্সরা আর অপ্সরীরা দ্রুত,
    যাতে একদিন আমাদের গা থেকে মোজা আর ব্যাণ্ডেজ খসিয়ে, পা থেকে খুলে দিয়ে টিকিট লাগানো সুতো
    তারা আমাদের এক এক করে জমা করতে পারে স্লুইস গেটের নীচে পিলারের আশে পাশে -
    যেন বহুদিন পরে ফিরে এসেছে সবাই পঁচাত্তর বা সাতাত্তরের ক্লাসে!

    বাতাস, নদী, বন, আকাশবাড়ির অনেকগুলি চুলখোলা তাম্বূলরসিকা ঝি, গালে হাত দিয়ে সেদিন বলতে পারে -
    কারা ফিরে এল? কোন বাড়ির ছেলে বা মেয়ে? কোন গুজ্জর? কোন কাহার?

    সেদিন চোখের বিচূর্ণ মণি যদি উষ্ণ থাকে আরো কিছুক্ষণ
    আমাদের আবার দেখা না হওয়ার আক্ষেপই ফুটিয়ে তুলবে সেই জলের দর্পন
    আর আরাবল্লীর পাহাড় কাঁপিয়ে শোনা যাবে শিমলিপুরের পাশ দিয়ে চলেছে অসম্ভব লম্বা এবং ভারী
    মৃত অভিলাষের প্রতিবিম্ব দিয়ে ঠাসা একটি দীর্ঘশ্বাসের রেলগাড়ি।




    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments