• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৫ | জানুয়ারি ২০২২ | গল্প
    Share
  • দুটি গল্পঃ গয়নার বাক্স; খোলা হাওয়ার খোঁজে : দেবেশ মহান্তি
    গয়নার বাক্স | খোলা হাওয়ার খোঁজে

    গয়নার বাক্স



    ঠাৎ লক্ষ্মীলাভ। প্রাচীন একটা গয়নার বাক্স। ভেতরটা সাবেককালের গয়নায় ভর্তি। নতুন ড্রেসিং টেবিলটার ভেতরে ছিল। তৃষা নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। হৃদপিণ্ডটা খুব জোরে দৌড়াতে থাকে। অবিশ্বা, ভয়, লোভ, হাজারো ভাবনার ঘূর্ণি চিন্তাধারায় আবর্তিত হয়। নিজের অবদমিত আকাঙ্ক্ষাগুলো পূর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা মনের কোণে উঁকি দিতে থাকে। সারাদিন কোনরকমে পার করে রাতে তৃষা আর অর্ক আলোচনায় বসে। ফিসফিসিয়ে কথা হয়।

    ‘এটা কিন্ত বিপদ ডেকেও আনতে পারে। চোরাই মাল যে নয় তার কি ঠিক! বরং সে সম্ভাবনাই বেশি। নইলে এটা এখানে এল কিভাবে?’

    ‘কি করবে ভাবছ?’

    ‘যার জিনিস সে নিশ্চয় পুলিশ লাগিয়েছে। পুলিশ যদি খুঁজে খুঁজে এখানে আসে। তারা হয়তো আমাদেরকেই চোর বলল। ওটাকে তার চেয়ে আগেই পুলিশে দেওয়া ভালো। তারাই যা করার করবে।’

    ‘পুলিশকে দিলেও যে তারা তোমাকে চুরির দায়ে ঢোকাবে না বা ওটা নিজেরাই মেরে দেবে না তার কিছু ঠিক আছে! তা ছাড়া আগবাড়িয়ে এত কিছু করার দরকার কি! এত চিন্তার কিছু নেই। আমরা তো আর চুরি করিনি। পুলিশ যদি আসে তো দিয়ে দিলেই হবে।’

    ‘চুরি করিনি সেটা আমরা জানি। পুলিশ তো আর জানবে না। তারা যদি জিজ্ঞেস করে পুলিশে খবর দেননি কেন? কি উওর দেবে তখন?’

    ‘বলব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কি করা উচিত বুঝে উঠতে পারিনি। তাছাড়া পুলিশ যে আসবেই তুমি কি জেনে বসে আছ? তাছাড়া আমাদের কপালটাও তো খুলে যেতে পারে! কথায় আছে হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলতে নেই।’

    ‘পুলিশ যদি নাও আসে, যারা চুরি করেছে তারা কি আর জানবে না কোথায় আছে। ওরা ঠিকই খবর জানবে। অনেক টাকার ব্যাপার। কত বড় চক্র এর সাথে জড়িত কে জানে? ডাকাতি, খুন না জানি কি জড়িয়ে আছে এর সাথে। ওরা হয়তো সুযোগের অপেক্ষায় আছে।’

    ‘তখন বলব আমরা জানি না। তেমন যদি হয় নিয়ে যাবে। রিস্ক তো একটু থাকবেই। তাছাড়া যেরকম ভাবছ তেমন কিছু নাও তো হতে পারে। ওটা এখন আমাদের কাছেই থাক, পরে যা হবে দেখা যাবে।’

    ওদের ডাল-ভাতের জীবনে বিরিয়ানির গন্ধ এসে অভ্যস্ত জীবনটাকে এলোমেলো করে দিয়েছে। না পারে ভালো করে ডাল ভাত খেতে না পারে বিরিয়ানির দিকে হাত বাড়াতে। সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকে। কি যেন আশঙ্কা হয়। অপরাধীর মতো সতর্ক সন্ত্রস্ত হাবভাব। বাড়ি থেকে একসাথে আর বেরোতে পারে না আজকাল। কেউ বাড়িতে এলে তাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অর্ক অফিস থেকে বার বার ফোনে খোঁজ নেয়, ‘সব ঠিক আছে তো?’ রাস্তায় পুলিশ দেখলে অকারণে বুকটা ধক করে ওঠে। বিত্তশালীদের জীবনযাপনের টুকরো ছবি চোখে পড়লে সতৃষ্ণ আগ্রহের সাথে তাকিয়ে থাকে। বড়োই মনোরম মনে হয় সে জীবন। বড়ো আকর্ষণ তার। এতদিন মনে হয় জীবনটা বৃথা গেছে। তৃষার মনে হয় এতদিন কিছুই পায়নি সে। অনেককিছুর প্রয়োজন পড়ে আজকাল। অনেককিছু দেখে মনে হয় ওটা তার চাই। সেটা সে সহজেই পেতে পারে ভেবে সুখ হয়। আজকাল একলা দুপুর বেলায় সে দরজা জানলা বন্ধ করে গয়নাগুলো পরে আয়নার সামনে বসে। নিজেকে ঐতিহাসিক কোন রাজ্যের সম্রাজ্ঞী মনে হয়। একধরনের ফ্যান্টাসিতে মেতে ওঠে। বেশ লাগে।

    অর্ক খালি হাতে ফিরে এসেছে। একটা গয়না বিক্রি করতে গিয়েছিল। একটা এ.সি. দরকার, তৃষার মডিউলার কিচেন চাই, আরো কয়েকটা টুকিটাকি ফার্নিচার না হলে চলছে না। কিছু টাকা চাই।

    ‘খালি হাতে ফিরলে যে বড়ো। এত ভীতু কেন তুমি!’

    ‘তুমি তো বলেই খালাস। সারা রাস্তা ভয়ে ভয়ে ছিলাম। এই বুঝি পকেট কাটলে। মনে হচ্ছিল সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। পুলিশ দেখলে মনে হচ্ছিল এই বুঝি এসে সার্চ করবে। কত দোকানের সামনে ঘুরেছি ঢুকতেই পারিনি। শেষে একটায় ঢুকলুম তো বলে এ জিনিস কোথায় পেয়েছি? কোনরকমে বললুম, বাড়িতে বহুকাল ছিল। ব্যাটা নিলে না তো বটেই, আমার দিকে কেমন যেন তাকিয়েছিল। জহুরির চোখ! কি বুঝলে কে জানে!’

    ‘তোমাকে দিয়ে কিছু হবে না। এত ম্যাদামারা তুমি! জীবনটা আমার শেষ হয়ে গেল তোমার সাথে। সারাজীবনে কি করতে পারলে? কি সুখটা দিতে পারলে? তোমার সাথে শুধু কষ্ট করে করে গেল।‘

    কথায় কথা বাড়ে। ছোট্ট একটা স্ফুলিঙ্গ থেকে বড় অগ্নিকাণ্ড হতে বেশি সময় লাগে না। বড়সড় ঝগড়া বেঁধে গেল। গয়নার বাক্স দুজনের ভেতর ধীরে ধীরে যে বিষ সঞ্চিত করেছিল, তা আজ তাদের একে অপরকে অন্ধ আক্রোশে তীব্র দংশনে দগ্ধ করে দিতে উদ্যত।

    রাতে থমথমে পরিবেশ, দুজনের আগের দিনগুলো মনে পড়ে যাচ্ছিল।

    ‘আরে কাঁদছ কেন? ঝগড়া তো হতেই পারে। কোন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া হয় না বলো! শুনেছি ঝগড়ায় প্রেম বাড়ে। মাঝে মাঝে স্বাদবদলও তো দরকার।’

    ‘সব ওই বাক্সটার দোষ। কেমন যেন হয়ে গেছি আমরা। আগে কি খারাপটা ছিলাম! কতদিন একসাথে কোথাও বেরোনো হয় না! হাসিখুশি অল্পের মধ্যে বেশ ছিলাম। কোথা থেকে এ আপদটা এসে পাগল করে দিল।’

    ‘চল আজই এটাকে ফেলে আসি। সত্যিই আমরা অসুস্থ হয়ে গেছি। এতে ভালো কিছু দেখছি না। এখন গ্লানি থাকতে থাকতেই এর ব্যবস্থা করতে হবে। আজই। সকালে আবার ভূত চাপবে।’

    রাতের অন্ধকারে চোরের মতো চুপিচুপি বেরিয়ে বাক্সটাকে একটা ডোবায় ফেলে দিয়ে এল ওরা।

    এক দিন যায়। দু দিন যায়। পুরোনো সহজ জীবনটকে ফিরে পাওয়া যায় না। মেনে নিতে পারে না। ঝোঁকটা কেটে গেছে। বার বার আক্ষেপ হয়। কেন যে হঠাৎ ফেলে দিতে গেল। কি ক্ষতিটা হচ্ছিল!

    আবার এক রাতে ওরা চোরের মতো সন্তর্পণে বেরিয়ে আসে।

    ‘এইখানটাতেই তো ছুঁড়ে ছিল। ঠিক এই খানটায়। কোথায় গেল। কেউ নিয়ে গেল না তো!’

    গভীর রাতে দুজনে পুকুরের জলে পাগলের মতো খুঁজতে থাকে, একটা গয়নার বাক্স।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণ : রাহুল মজুমদার
  • গয়নার বাক্স | খোলা হাওয়ার খোঁজে
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)