• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৫ | জানুয়ারি ২০২২ | গল্প
    Share
  • খোল দো کھول دو : সাদাত হাসান মান্টো
    translated from Urdu to Bengali by শুভময় রায়
    খোল দো | আনন্দী

    খোল দো
    کھول دو
    সাদাত হাসান মাণ্টো


    মূল উর্দু থেকে অনুবাদ: শুভময় রায়




    [উর্দু ভাষার হয়ত-বা সর্বশ্রেষ্ঠ গল্পকার সাদাত হাসান মাণ্টো (১৯১২-৫৫) দেশভাগের কারণ বিশ্লেষণে আগ্রহ দেখাননি, সাধারণ মানুষের জীবনে সে বিধ্বংসী ঘটনাপ্রবাহের পরিণাম কিন্তু তাঁর অনেক ছোট গল্পে সম্পূর্ণ নগ্নরূপে প্রতিফলিত হয়েছে। বাহুল্যবর্জিত গদ্যে মাণ্টো ধরার চেষ্টা করেছেন সমসাময়িক নির্মমতাকে। শব্দ যখন স্মৃতি থেকে হারিয়ে যায় তখনও এই কাহিনিগুলো পাঠকের স্মৃতিতে অম্লান থাকে, তাদের বারবার নাড়া দেয়, বিড়ম্বিত করতে থাকে। তাঁর নিজের ভাষায় ‘ঝড়ে যা কিছু খোয়া গেছে, তা পুনরায় ফিরে পেতে হলে, আমাদের শরীরের ক্ষতবিক্ষত অংশগুলো আবার জুড়তে হলে, আমাদের বিভক্ত সভ্যতার শৈল্পিক উৎকর্ষের যেটুকু অবশিষ্ট আছে, তার পুন‍ঃসঞ্জীবনের প্রয়াস প্রয়োজন।’

    বাস্তবে মাণ্টোর প্রতীকী উচ্চারণে সেই ‘ক্ষতবিক্ষত অংশগুলো’র সবচেয়ে নির্মম দৃষ্টান্ত ছিল পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি মহিলার ধর্ষণ, অপহরণ ও হত্যা। মাণ্টোর ভাষায় সে ঘৃণ্য নারকীয়তার পেছনে আছে ‘আমাদের ভীরুতা’ আর ‘আমাদের বিরোধীদের সীমাহীন লাম্পট্য’। ব্যক্তি পাগল হলে তবু সামলানো যায়, সমষ্টি -- দুই সম্প্রদায়ের মানুষ যৌথভাবে উন্মত্ত আচরণ করলে সামাল দেবে কে?

    অনুবাদের জন্য কিতাবি দুনিয়া, দিল্লি প্রকাশিত ড. খালিদ আশরাফ কর্তৃক নির্বাচিত ও সংকলিত ‘ফসানে মাণ্টো কে’ শীর্ষক গল্প সংগ্রহে মুদ্রিত মূল উর্দু গল্পটি ব্যবহার করেছি।

    —অনুবাদক]



    স্পেশাল ট্রেন অমৃতসর থেকে বেলা দুটোয় ছেড়ে আট ঘণ্টা পর মুঘলপুরা পৌঁছোল। পথে বেশ কিছু যাত্রী খুন হল। আরও অনেকে আহত। আর দু-চারজন এদিক-ওদিক কোথায় যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেল কে জানে!

    সকাল দশটা। শরণার্থী শিবিরের ঠান্ডা মাটিতে শুয়ে সিরাজুদ্দিন চোখ খুলে নিজের চারপাশে চাইতেই দেখল পুরুষ-মহিলা আর বাচ্চাদের বিক্ষুব্ধ সমুদ্র যেন। ভাবনা-চিন্তা করার যেটুকু ক্ষমতা তার ছিল, তাও হারিয়ে সে যেন আরও দুর্বল হয়ে পড়ল। সিরাজুদ্দিন অনেকক্ষণ ঘোলাটে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। একে তো ক্যাম্পের চারদিকে অনবরত শোরগোল চলেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও কিছুই যেন বৃদ্ধ সিরাজুদ্দিনের কানে ঢুকছে না। সে কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। কেউ তাকে দেখলে মনে করত যে সে কোনও গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। কিন্তু তা তো নয়। তার অনুভূতি আর বিচারবুদ্ধি যেন কাজ করছে না। তার সমগ্র অস্তিত্বই যেন শূন্যে ঝুলে রয়েছে।

    ঘোলাটে আসমানের দিকে লক্ষ্যহীন, শূন্য চাউনি নিয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎই যেন সূর্যের সঙ্গে তার দৃষ্টির ধাক্কা লেগে গেল। তীব্র আলোর ঝলকানি তার সত্তার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়তেই সে জেগে উঠল। একের পরে এক ছবি যেন তার মনের আয়নায় ভেসে উঠছে – লুট, আগুন ধরানো, পড়ি-মরি করে দৌড়-স্টেশন-গুলিবৃষ্টি-রাত-সাকিনা... সিরাজুদ্দিন তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে উঠে পাগলের মত তার চারদিকে ক্রমশ ফুঁসলে উঠতে থাকা মানুষের সমুদ্রের মধ্যে দিয়ে পথ করে এগোতে থাকে।

    তিনটে ঘণ্টা ‘সাকিনা! সাকিনা!’ বলে চিৎকার করতে করতে সে শিবিরের চারদিকে তন্ন তন্ন করে খোঁজে। কিন্তু তার একমাত্র জোয়ান মেয়েটির কোনও খোঁজ পাওয়া গেল না। চারদিকে যেন কান-ফাটা আওয়াজ। কেউ নিজের বাচ্চাকে খুঁজছে, কেউ মা, বিবি, অথবা বেটির সন্ধানে বেরিয়েছে। শেষমেশ ক্লান্ত সিরাজুদ্দিন এক জায়গায় বসে পড়ে। সে স্মৃতি খুঁড়ে বার করার চেষ্টা করে কোথায় আর কখন তার আর সাকিনার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। কিন্তু যতবারই মনে করার চেষ্টা করে, ততবারই তার মন সাকিনার মায়ের ক্ষতবিক্ষত লাশের কাছে এসে থমকে দাঁড়ায়। তার সমস্ত নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে এসেছে। সিরাজুদ্দিন আর কিছুই ভাবতে পারে না।

    সাকিনার মা মরে গেছে। সিরাজুদ্দিনের সামনেই তার শেষ নিঃশ্বাস পড়েছিল। কিন্তু সাকিনা কোথায় যার সম্পর্কে তার মা মরতে-মরতে বলেছিল, ‘আমার কথা ভেবো না। সাকিনাকে নিয়ে এখনই এখান থেকে পালিয়ে যাও।’

    সাকিনা তো তার সঙ্গেই ছিল। দুজনে খালি পায়েই পালাচ্ছিল। সাকিনার দোপাট্টা খুলে পড়েছিল। দোপাট্টা তোলার জন্য তার বাবা থামতে চাইলে সাকিনা চিৎকার করে বলেছিল, ‘আব্বাজি! ছোড়িয়ে!’ কিন্তু সিরাজুদ্দিন দোপাট্টা তুলে নিয়েছিল। এই ভাবতে ভাবতে তার নজর পড়ল কোটের খোলা পকেটের ওপর। পকেটে হাত দিতেই এক টুকরো কাপড় বেরিয়ে এল। ...সাকিনার সেই দোপাট্টা... কিন্তু সাকিনা কোথায় গেল?

    সিরাজুদ্দিন তার ক্লান্ত স্মৃতি যতই হাতড়ায়, কোনও সমাধানে পৌঁছোতে পারে না। সে কি সাকিনাকে সঙ্গে করে স্টেশন পর্যন্ত নিয়ে এসেছিল... ? ...? সে কি তার সঙ্গেই গাড়িতে সওয়ার হয়েছিল... ? রাস্তায় যখন গাড়ি থেমেছিল আর দাঙ্গাবাজরা গাড়ির ভেতরে ঢুকে এল, তখন কি সে নিজে বেহুঁশ হয়ে গিয়েছিল? তখনই কি তারা সাকিনাকে নিয়ে চলে যায়?

    যার কোনও উত্তর নেই এমন প্রশ্নের পর প্রশ্ন সিরাজুদ্দিনের মনকে অবশ করে দেয়। তার সহানুভূতির প্রয়োজন ছিল, কিন্তু চারদিকে যে জনসমুদ্র ক্রমশ আরও প্রসারিত হচ্ছে, তারা সকলেই তো সহানুভূতি চাইছে। সিরাজুদ্দিন কাঁদতে চাইল, কিন্তু তার চোখ তাকে মদত দিল না। কে জানে অশ্রু কোথায় সরে পড়েছে! ছদিন পরে যখন তার হুঁশ কিছুটা ফিরে এসেছে তখন সে কয়েকজনের সন্ধান পেল যারা তাকে সাহায্য করার জন্য তৈরি। তারা আটজন নওজোয়ান। তাদের লরি ছিল, বন্দুক ছিল। সিরাজুদ্দিন তাদের জন্য হাজার বার প্রার্থনা করে অবশেষে সাকিনার বর্ণনা দিল, ‘ফর্সা রং, খুব সুন্দরী। আমার মত নয়, ওর মায়ের মত দেখতে। বয়েস সতের হবে। বড় বড় চোখ.....কালো চুল....ডানগালে মোটা একটা তিল....আমার একমাত্র মেয়ে। খুঁজে আনো, খুদা তোমাদের মঙ্গল করবেন।’

    স্বেচ্ছাসেবক সেই যুবকেরা অত্যন্ত আন্তরিকভাবে বৃদ্ধ সিরাজুদ্দিনকে আশ্বস্ত করে বলল যে যদি তার মেয়ে বেঁচে থাকে, তা হলে কয়েক দিনের মধ্যেই তাকে তারা তার বাবার কাছে ফিরিয়ে আনবে।

    সেই আট যুবক চেষ্টার কসুর করেনি। প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে তারা অমৃতসর গেল। বেশ অনেক মহিলা, পুরুষ আর বাচ্চাকে উদ্ধার করে নিরাপদ গন্তব্যে পৌঁছে দিল। দশ দিন পার হয়ে গেলেও তারা সাকিনার দেখা পেল না।

    একদিন তারা যখন হারিয়ে যাওয়া মানুষদের উদ্ধার করে আনার জন্য নিজেদের লরি নিয়ে আবার অমৃতসরে যাচ্ছে, তখন চুহরাটের কাছে রাস্তায় একটা মেয়েকে পথ চলতে দেখতে পেল। লরির আওয়াজ শুনে সে ঘাবড়ে গিয়ে ছুটতে শুরু করল। স্বেচ্ছাসেবকেরা মোটর থামিয়ে সবাই গাড়ি থেকে নেমে তার পিছু নিল। চাষের ক্ষেতে তারা মেয়েটাকে ধরে ফেলল। খুব সুন্দরী ছিল সে। তার ডান গালে একটা মোটা তিল। একটা ছেলে তাকে বলল, ‘ঘাবড়িও না... তোমার নাম সাকিনা?’

    মেয়েটার রং যেন আরও ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সে কোনও উত্তর দিল না। কিন্তু যখন সব ছেলেরাই তাকে ভরসা দিয়ে আশ্বস্ত করল, তখন তার মনের ভয় দূর হল। সে মেনে নিল যে সেই সিরাজুদ্দিনের কন্যা সাকিনা।

    সেই আট স্বেচ্ছাসেবী যুবক নানাভাবে সাকিনার মন ভালো করার চেষ্টা করছিল। তাকে খাবার খাইয়ে, দুধে চুমুক দিইয়ে লরিতে বসিয়ে দিল। যেহেতু দোপাট্টা না থাকাতে মেয়েটি খুব লজ্জা পাচ্ছিল আর বারবার দুবাহু দিয়ে নিজের বুক ঢাকার নিষ্ফল প্রয়াসে ব্যস্ত ছিল, তাই একটি ছেলে নিজের কোট খুলে তাকে দিয়ে দিল।

    বেশ কয়েকদিন চলে গেল। ...সিরাজুদ্দিন সাকিনার কোনও খবর পেল না। সে সারাদিন বিভিন্ন শিবির আর দফতরে চক্কর কাটে। কিন্তু কেউ তার মেয়ের সংবাদ দিতে পারে না। অনেক রাত পর্যন্ত স্বেচ্ছাসেবক যুবকেরা যাতে তার মেয়েকে খুঁজে পায় তার জন্য সে প্রার্থনা করতে থাকে। সেই যারা তাকে আশ্বস্ত করেছিল যে সাকিনা যদি বেঁচে থাকে তা হলে কয়েকদিনের মধ্যেই তারা তাকে খুঁজে বার করবে।

    একদিন সিরাজুদ্দিন শরণার্থী শিবিরে আবার সেই স্বেচ্ছাসেবক যুবকদের দেখতে পেল। তারা তাদের লরিতে বসে ছিল। সিরাজুদ্দিন দৌড়তে দৌড়তে লরির কাছে যখন পৌঁছল, গাড়ি তখন সবে চলতে শুরু করেছে। সে জিগ্যেস করল, ‘বেটা, আমার সাকিনার কোনও খবর পাওয়া গেল?’

    তারা সবাই একসঙ্গে বলে উঠল, ‘পাওয়া যাবে, পাওয়া যাবে।’ লরি ছেড়ে দিল। সিরাজুদ্দিন আরও একবার সেই যুবকদের সাফল্য কামনায় প্রার্থনা করাতে তার মনের ভার যেন একটু হালকা হল।

    সেদিন সন্ধ্যায় সিরাজুদ্দিন শিবিরে যেখানে বসে থাকে তার আশেপাশেই কোথাও যেন গোলমালের আওয়াজ টের পেল। চারটে লোক কিছু একটা জিনিস যেন বয়ে নিয়ে আসছে। সে জিগ্যেস করে জানল যে একটা মেয়েকে রেল লাইনের পাশে বেহুঁশ অবস্থায় পাওয়া গেছে। লোকেরা তাকেই উঠিয়ে নিয়ে এল। সিরাজুদ্দিনও তাদের পেছন পেছন চলতে শুরু করল। যারা মেয়েটিকে বয়ে নিয়ে আসছিল, তারা হাসপাতালের কর্মীদের হেফাজতে তাকে দিয়েই সরে পড়ল। সিরাজুদ্দিন কিছুক্ষণ শিবিরের হাসপাতালের বাইরে কাঠের থামে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর আস্তে আস্তে ভেতরে ঢুকে পড়ল। ঘরে কেউ ছিল না। শুধু একটা স্ট্রেচারের ওপর কারও লাশ পড়ে আছে। সিরাজুদ্দিন অতি সন্তর্পণে পা টিপে টিপে স্ট্রেচারের কাছে পৌঁছোতেই হঠাৎ ঘরের আলো জ্বলে উঠল। সিরাজুদ্দিন লাশের ফ্যাকাশে মুখে জ্বলজ্বল করতে থাকা তিলটি দেখেই চিৎকার করে উঠল, ‘সাকিনা!’

    যে ডাক্তার কামরার আলোটা জ্বালিয়েছিলেন, তিনি সিরাজুদ্দিনকে দেখে বললেন, ‘কেয়া হ্যায়?’

    সিরাজুদ্দিনের গলা থেকে কোনও মতে যেন স্বরটুকু বেরোল, ‘জি আমি, জি আমি ওর বাপ।’

    ডাক্তার স্ট্রেচারে পড়ে থাকা লাশটার দিকে তাকালেন। নাড়ি দেখলেন। তারপরে সিরাজুদ্দিনকে বললেন, ‘খিড়কি খোল দো।’

    সাকিনার মুমূর্ষু শরীরটা যেন সামান্য কেঁপে উঠল। দুর্বল হাতগুলো দিয়ে সে তার ইজেরের দড়ি খুলে ফেলে সালওয়ার নিচে নামিয়ে দিল।

    বুড়ো সিরাজুদ্দিন আনন্দে চিৎকার করে উঠল, ‘বেঁচে আছে! আমার মেয়েটা বেঁচে আছে!’

    ডাক্তারের মাথা থেকে পা পর্যন্ত তখন ঘামে ভিজে উঠেছে।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ শুভময় রায়
  • খোল দো | আনন্দী
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments