• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৫ | জানুয়ারি ২০২২ | গ্রম্থ-সমালোচনা
    Share
  • স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল ট্র্যাজেডির নায়ক : রঞ্জন ভট্টাচার্য

    অসমাপ্ত আত্মজীবনী— শেখ মুজিবুর রহমান ; দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা, প্রচ্ছদ -- সমর মজুমদার; প্রথম প্রকাশ-- জুন ২০১২; ISBN: 978 984 506 059 2

    ট্র্যাজেডির অভিঘাত ব্যক্তিগত সীমানা ছাড়িয়ে কখনও কখনও সমষ্টির ট্র্যাজেডি হয়ে ওঠে। যদিও সেই ট্র্যাজেডির গোপন অন্তঃপুরে ব্যক্তির ভূমিকাই একচ্ছত্র। ব্যক্তিগত লোভ, লালসা, স্বার্থপরতার শানিত ছুরিতে খুন হয় জাতির স্বপ্ন। রচিত হয় জাতীয় ট্র্যাজেডির তীব্র সংকট। শতাব্দীর সেরা দুই বাঙালি -- নেতাজি আর বঙ্গবন্ধুর জীবনের ইতিহাস এই বাস্তব সত্যের জ্বলন্ত দলিল। ব্যক্তিগত সংকীর্ণ স্বার্থে প্রথম জনের কৃতিত্বকে জাতীয় ইতিহাসের পাতায় খাটো করার চক্রান্ত আজও সচল আর দ্বিতীয় জনকে সপরিবারে গোপন ষড়যন্ত্রের নৃশংস বুলেটে ঝাঁঝরা হতে হয়েছিল ১৯৭৫-এর পনেরই আগস্ট। যে দেশ বা জাতির জন্য জীবনের সবটা তাঁরা বাজি রেখেছিলেন সেই দেশ বা জাতির ভেতর থেকেই তাঁদের বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হল। একজনকে দেশের ইতিহাসে যোগ্য মর্যাদা দেওয়া হল না। অপরজনকে খুনই হতে হল দেশের মানুষের অস্ত্রে।

    নেতাজি ও বঙ্গবন্ধুকে এক বন্ধনীতে রেখে তুলনামূলক আলোচনায় ইতিমধ্যেই বহু শব্দ খরচ করা হয়েছে বা ভবিষ্যতেও হবে। আসলে দুই ব্যক্তিত্বই সবদিক থেকে বাঙালি মানসিকতার আদর্শ উদাহরণ। তাই প্রতিতুলনা অবশ্যম্ভাবী। যদিও স্বাধীনতাপূর্ব যুগের বনেদি পরিবারের রাজনৈতিক ঘরানার রমরমা ঐতিহ্যের বিপরীত জগৎ থেকেই মুজিবুর রহমানের রাজনীতির অঙ্গনে আবির্ভাব। তাঁর নিজস্বতাকে কোনোরকম অবজ্ঞা না করেই বলা যায় যে নেতাজির রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে আবির্ভাবের আয়োজন আগে থেকেই অনেকটা তৈরি হয়েই ছিল পারিবারিক ঐতিহ্য, বিলেতি শিক্ষা, সর্বোপরি দাদা শরৎচন্দ্র বসুর রাজনৈতিক পরিচিতির মধ্যে দিয়ে। মুজিবের এসব কিছুই ছিল না। গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ার একদা বর্ধিষ্ণু, সম্পন্ন শেখ পরিবারে ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ মুজিব যখন জন্মাচ্ছেন তখন শেখ-বংশের পড়তি দশা। রানি রাসমণির সঙ্গে ব্যবসায়িক সশস্ত্র দ্বন্দ্বে হেরে গিয়ে শেখ পরিবার কয়েক দশক আগেই প্রায় সর্বহারা। স্থানীয় ভাবে সম্মান থাকলেও আর্থিক অবস্থা ভালো না। বাবা গোপালগঞ্জ আদালতের সেরেস্তাদার শেখ লুৎফর রহমান ধীরে ধীরে চেষ্টা করছেন অবস্থা পরিবর্তনের। গ্রামীণ প্রতিবেশীদের কাছে তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধেয়। কিন্তু রাজনৈতিক আবহ এই পরিবারের ঠিকুজি-কুলজিতে কস্মিনকালেও ছিল না। এই প্রেক্ষাপট থেকে মুজিবুর রহমান রাজনীতির জগতে প্রবেশ করছেন এবং হয়ে উঠছেন বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব। অর্থাৎ তাঁর অর্ধসমাপ্ত, আকস্মিকভাবে থামিয়ে দেওয়া জীবনের প্রতিটি অর্জনের পেছনে রয়েছে সম্পূর্ণরূপে তাঁর নিজস্ব প্রচেষ্টা। এখানেই শুধু নেতাজি না, স্বাধীনতাপূর্ব বা স্বাধীনতা পরবর্তী ভাঙা বাংলার রাজনীতির কুশীলবদের থেকে মুজিবুর রহমান স্বতন্ত্র ভূমিখণ্ডের অধিকারী। হয়তো তাঁর রাজনৈতিক চরিত্র হয়ে ওঠার ব্যক্তিগত পরিপ্রেক্ষিতের সঙ্গে মিল খোঁজা সম্ভব কয়েক যুগ পরবর্তী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে।

    || ২ ||

    মিল-অমিলের পর্বে দাঁড়ি টেনে মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক যাত্রাপথের বর্ণাঢ্য ইতিহাসকে শিরোনামে চিহ্নিত করতে চাইলে কেবল একটি বাক্যই সঠিক বলে মনে হয় -- "Man is the destiny." একালের শিকড়হীন সংকীর্ণ স্বার্থপর রাজনীতির কুরুক্ষেত্রে 'মানুষ' শব্দটির গুরুত্ব ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। এখন মানুষ, দেশ বা জাতির জন্য রাজনীতি ডোডো পাখির মত বিলুপ্ত। এই পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের আদ্যন্ত বর্তমান প্রেক্ষিতে আদর্শস্বরূপ। অবশ্যই মানা না-মানা রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের নিজস্ব সিদ্ধান্ত।

    মানুষের জন্য রাজনীতি করার এই মানসিকতা মুজিবুরের মধ্যে গড়ে উঠেছিল প্রথাগত রাজনীতিতে যোগ দেবার বহু আগে, বোধহয় ব্রতচারী ও অনুশীলন সমিতির হয়ে কাজ করার মাধ্যমে। যদিও নিজের আত্মজীবনীতে ব্রতচারী বিষয়ে তিনি একটি লাইনই লিখেছেন, 'খেলাধুলা করতাম, গান গাইতাম এবং খুব ভাল ব্রতচারী করতে পারতাম'। (পৃ: ৮) কিন্তু ব্রতচারীর আদর্শ যে তাঁর মনে গেঁথে গিয়েছিল তা তাঁর জীবনভর মানুষের পাশে থাকার স্বার্থহীন আগ্রহ থেকে বুঝে নেওয়া যায়। অনুশীলন সমিতির যোগাযোগের সূত্রেই মুজিব জড়িয়ে পড়েছিলেন স্বদেশী আন্দোলনে। তখন তাঁর ষোল বছর বয়স। আসলে সময়ের দাবীতেই তিনি স্বদেশী আন্দোলনে যুক্ত হতে বাধ্য হন। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি লিখছেন, 'স্বদেশী আন্দোলন তখন মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জের ঘরে ঘরে।' (পৃ: ৯) স্বাধীনতা আনতে হবে এই আবেগ পনেরো ষোলো বছরের কিশোরদের অমোঘ নিয়তি। বঙ্গবন্ধুও তাঁর থেকে দূরে থাকতে পারেননি। সেই সময় গোপালগঞ্জে সুভাষপন্থীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এই সূত্রে তিনিও নেতাজির ভক্ত হয়ে পড়েন। দুই বাঙালি আইকন বাঁধা পড়লেন মনের বন্ধনে। সাল ১৯৩৬। নেতাজি তখন বছর চল্লিশের প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্ব আর মুজিব ষোলো -- রাজনীতির শিক্ষানবিশ।

    ১৯৩৭, মুজিব প্রথমে বেরিবেরি এবং পরে গ্লুকোমা সারিয়ে আবার পড়াশোনা শুরু করছেন। সেই সময় তাঁর গৃহশিক্ষক হয়ে এলেন কাজী আবদুল হামিদ এম এসসি। হামিদ সাহেব 'মুসলিম সেবা সমিতি' গঠন করে গরীব ছেলেদের সাহায্য করতেন। সতেরো বছরের মুজিব এই প্রতিষ্ঠানের দ্বিতীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠলেন। বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে দল তৈরি করে বাড়ি বাড়ি ঘুরে সাহায্য জোগাড় করে তার অর্থে গরীব ছাত্রদের বইখাতা কিনে দিচ্ছেন। মানুষের হৃদয়ের সম্রাট এভাবেই দীক্ষিত হচ্ছেন মানবধর্মে। ১৯৩৯ সালে তিনি যখন কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হলেন এবং সচেতনভাবেই জড়িয়ে পড়ছেন প্রথাগত রাজনীতিতে তখন কৈশোরের এই দীক্ষা তাঁকে পৌঁছে দিচ্ছে দুঃস্থ মানুষের পাশে।

    ১৯৪৩, বাংলার আকাশে দুর্ভিক্ষের কালো মেঘ। অবধারিতভাবে মুজিব পীড়িত মানুষের বন্ধু হয়ে উঠছেন। "আমিও লেখাপড়া ছেড়ে দুর্ভিক্ষ পীড়িতদের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়লাম। অনেকগুলি লঙ্গরখানা খুললাম। দিনে একবার করে খাবার দিতাম।' ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ: ১৮)

    মুজিব পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতায় মুসলিম লীগের রাজনীতির শরিক হয়েছেন। সক্রিয়ভাবে সমর্থন, প্রচার ও আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন পাকিস্তানের সমর্থনে। কিন্তু মানসিকভাবে তিনি সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অংশ কোনদিনই হতে পারেননি। ছেচল্লিশের দাঙ্গায় তিনি পাশে দাঁড়াচ্ছেন হিন্দু মুসলমান উভয়েরই। "আমরা ছিলাম স্বেচ্ছাসেবক। শিয়ালদহ ও হাওড়া স্টেশনে হিন্দু ও মুসলমানদের ক্যাম্প করা হয়েছিল -- যাতে বাইরে থেকে কেউ এসেই হিন্দু ও মুসলমান মহল্লায় না যায়। কারণ মুসলমানরা হিন্দুদের মহল্লায় এবং হিন্দুরা মুসলমান মহল্লায় গেলে আর রক্ষা নেই।" (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ: ৬৮) আগস্টে কলকাতা দাঙ্গার মাস তিনেক পর শুরু হল নোয়াখালি ও বিহারের দাঙ্গা। কলকাতাবাসী মুজিবকে দলের পক্ষ থেকে পাঠান হল বিহারে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে। আসানসোলে শরণার্থী শিবির স্থাপন করে বিহারের দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত বহু মানুষকে রক্ষা করার জন্য উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছিলেন শেখ মুজিব।

    তিনি বাংলার সংখ্যালঘু রাজনীতির শরিক হিসেবে বা মুসলিম লীগের দলীয় রণকৌশলের সমর্থক হিসেবে পাকিস্তানের দাবিকে সমর্থন করেছেন, ১৯৪৬-এর ১৬ই আগস্ট পাকিস্তানের দাবিতে 'ডাইরেক্ট অ্যাকশন'-এর পক্ষে প্রচারও করেছেন, কিন্তু দাঙ্গাকে মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারেননি। নিজের অসমাপ্ত আত্মজীবনীর বিভিন্ন অংশে ঐতিহাসিক সত্যকে অকপটে স্বীকার করার মধ্যে দিয়ে তাঁর ধর্ম- বা জাতিনিরপেক্ষ মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। কলকাতার দাঙ্গা সম্পর্কে তিনি লিখছেন, "প্রথম দিন ১৬ই আগস্ট মুসলমানরা ভীষণভাবে মার খেয়েছে। পরের দুই দিন মুসলমানরা হিন্দুদের ভীষণভাবে মেরেছে।" আসলে মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ মুজিবের পক্ষে সাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠা কোনমতেই সম্ভব ছিল না। জেলের মধ্যে অসুস্থ মৃত্যুপথযাত্রী সমাজসেবী চন্দ্র ঘোষকে তিনি বলেছেন, ".... আমি মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখি। রাজনীতিতে আমার কাছে হিন্দু ও খ্রিস্টান বলে কিছু নেই। সকলেই মানুষ। (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ: ১৯১) তাই পাকিস্তান গঠিত হবার পর দলীয় ফোরামে বা প্রকাশ্যে ধর্ম নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রের বিরোধিতা করেছেন এবং ১৯৭৩-এ স্বাধীন বাংলাদেশের নেতৃত্ব কাঁধে তুলে নেবার পরই ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান প্রণয়ন করেছেন।

    শুধু দু'-একটা ঐতিহাসিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই নয়, মানুষের সঙ্গে মুজিবুর রহমানের সম্পর্ক ছিল নিত্য দিনের। মানুষ তাঁর প্যাশন, বোধহয় ইতিবাচক ইনফ্যাচুয়েশনও। ১৯৫২ সালে চিনে যুব সম্মেলনে গিয়ে তিনি দ্রষ্টব্য স্থানগুলির পাশাপাশি পরিচিত হতে চাইছেন নবজাতক সমাজতান্ত্রিক চিনের মানুষের জীবন যাত্রার সঙ্গে। তাঁর আগ্রহে একমাত্র তাঁকেই অতিথি হিসেবে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল একটি চৈনিক পরিবারে।

    মানুষের প্রতি এই ভালোবাসা ও দায়বদ্ধতার মধ্যে দিয়েই তিনি পূর্ব-পাকিস্তান এবং পরে স্বাধীন বাংলাদেশের অবিসংবাদি নেতা হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। পাকিস্তান তৈরি হবার পর তাঁকে বার বার আটক থাকতে হয়েছে। যে পাকিস্তানের দাবিতে তিনি লড়াই করেছেন সেই স্বপ্নের পাকিস্তানই তাঁকে বারো বছর জেলে বন্দী থাকতে বাধ্য করেছে। কিন্তু তাঁকে গ্রেফতার করার সময় প্রত্যেকবারই হাজার হাজার মানুষের প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়েছে প্রশাসনকে। ১৯৬৮ সালে 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা'য় শেখ মুজিবকে আটক করা হলেও ১৯৬৯ সালের ২৮-এ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সরকার প্রবল গণআন্দোলনের চাপে তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। প্রশাসন বুঝতে পেরেছিল তাঁকে মুক্তি না দিলে বিক্ষুব্ধ জনতা জেল ভেঙে তাঁকে মুক্ত করবেই। মুক্ত শেখ মুজিবকে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে সম্বর্ধনা দেবার সময় ছাত্র নেতা তোফায়েল আহমেদ তাঁকে 'বঙ্গবন্ধু' বলে ঘোষণা করে দেন। ১৯৩৯-এ যে যাত্রা শুরু হয়েছিল তার একটি মহোত্তম উত্তরণ সমাপ্ত হল 'বঙ্গবন্ধু', এই নাম ভূষণে। মানুষের নেতা মুজিবুর রহমান হয়ে উঠলেন জাতির পিতা। সুদূর পাকিস্তানে বন্দি থেকেও তিনি নেতৃত্ব দিলেন মুক্তিযুদ্ধের। নেতার অনুপস্থিতিতে সফল বিপ্লব, সারা পৃথিবীর মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। ১৯৭১-এর ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে দশ লক্ষ মানুষের সামনে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক বক্তৃতা, স্বাধীনতা আন্দোলনের আহ্বান, "এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম..." হ্যামিলনের বাঁশির মতো নাড়িয়ে দিয়েছিল বাঙালির হৃদয়। মাত্র ১৮ মিনিটের বক্তব্য বাঙালিকে সশস্ত্র সংগ্রামে দীক্ষিত করেছিল। দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, মানুষের প্রতি ভালোবাসা এবং মানুষের নাড়ি বোঝার ঐশ্বরিক ক্ষমতার গুনেই শেখ মুজিব এই মহাকাব্য রচনা করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

    || ৩ ||

    মানুষের প্রতি সুগভীর ভালোবাসা ও বিশ্বাসের জোরেই টুঙ্গীপাড়ার নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। বিশ্বের মানচিত্রে খোদাই করতে পেরেছিলেন একটি নতুন দেশের নাম। কিন্তু মানুষের প্রতি সেই সুতীব্র বিশ্বাসের মধ্যেই ছিল ট্র্যাজেডির বীজ। তিনি ভাবতেই পারেননি তাঁর প্রিয় দেশবাসীর মধ্যেই লুকিয়ে থাকতে পারে ঘাতক। ব্রুটাসের দল। পাকিস্তানপন্থী মৌলবাদ ও মুসলিম লীগ শাসনে সুবিধাভোগী পরিবারগুলির সক্রিয়তা তাঁর অজানা ছিল না। তবুও দেশবাসীর প্রতি সন্দেহাতীত বিশ্বাসে ব্যক্তিগত সুরক্ষার কোন ব্যবস্থাই তিনি রাখেননি। আসলে সুরক্ষার বর্মে আবদ্ধ করে সাধারণ মানুষের থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখার কথা তাঁর পক্ষে ভাবা সম্ভবই ছিল না। সেই ছিদ্রপথেই ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্ট ৩২ নং ধানমন্ডির বাড়িতে মধ্যরাতে প্রবেশ করল স্বার্থপর ষড়যন্ত্রী ঘাতকের দল। নৃশংসভাবে হত্যা করল বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের বহুজনকে।

    ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টের প্রশ্নের উত্তরে শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন যে তাঁর বড় গুণ হল তিনি তাঁর দেশবাসীকে ভালোবাসেন আর তাঁর দোষ হল তিনি তাঁদের বড় বেশি ভালোবাসেন -- "I love them too much." নিজের জীবন দিয়ে বঙ্গবন্ধু তার দাম দিয়েছেন। কিন্তু তাঁকে প্রাণে মারতে পারলেও ষড়যন্ত্রীদের উদ্দেশ্য সফল হয়নি। জীবিত মুজিবের থেকেও আরও শক্তিশালী মৃত মুজিব। কোটি বাঙালির হৃদয়ে স্থাপিত তাঁর চিরস্থায়ী আসন --যত কাল রবে পদ্মা যমুনা/ গৌরী মেঘনা বহমান/ ততক্ষণ রবে কীর্তি তোমার/শেখ মুজিবুর রহমান।

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments