• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৫ | জানুয়ারি ২০২২ | কবিতা
    Share
  • অনুবাদে লোরকার কবিতা: নিউ ইয়র্কে কবি : ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা
    translated from English to Bengali by স্বপন ভট্টাচার্য



    Poeta en Nueva York (Poet in New York) লোরকার আমেরিকা ও কিউবা সফরকালীন (জুন ১৯২৯ - মার্চ ১৯৩০) লেখা কবিতাগুচ্ছ। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরাজি সাহিত্য পড়বেন--বাসনা এমন কিন্তু নিজেই বলেছেন সফর শেষ হয়েছে প্রায় আধ্যাত্মিক আত্মদর্শনে যার বর্ণনা এই পর্যায়ের রচনাগুলিতে। পড়তে গিয়ে মনে হয় সফরকে spiritual--আধ্যাত্মিক বলছেন তিনি নেহাতই রূপকার্থে। যে আমেরিকায় তিনি গিয়েছিলেন তাকে ঘামে রক্তে দেখে নেবার অবকাশ পেয়েছিলেন। দেখতে পেয়েছিলেন প্রাচুর্য ও শ্রমের বৈপরীত্য, দেখতে পেয়েছিলেন অসাম্য, দেখেছিলেন স্বপ্নপীড়িত এবং স্বপ্নতাড়িত তরুণসমাজ এবং দেখেছিলেন ট্যাবুমুক্ত যৌনবিশ্বাসের প্রতি সহমর্মিতা যা তখন স্পেনে ক্রমশ লাঞ্ছনার মুখে পড়ে যাচ্ছিল। নিউইয়র্কে কবি সংকলনরূপে প্রথম প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুর পরে ১৯৪০’এ।

    নিউ ইয়র্কে ভোর লোরকার জীবদ্দশায় ছাপাই হয়নি। এর দুটি অপর শিরোনাম যা কবি নিজেই পরে বর্জন করেছিলেন তা হল যথাক্রমে Oberro parado – বেকার শ্রমিক এবং Amanecer--ঊষা।

    নিদ্রাহীন শহর (রচনাকাল অক্টোবর, ১৯২৯) প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৩২-এ। প্রথম শিরোনাম ছিল Vigilla--প্রহরা, যা নিজেই বাতিল করেছিলেন।

    গাভী মৃত্যু প্রকাশিত হয় মাদ্রিদ থেকে প্রকাশিত Revisita de Occidente জার্নালে ১৯৩১-এর জানুয়ারিতে।



    নিউ ইয়র্কে ভোর

    নিউ ইয়র্কে ভোর
    চারটে জলার স্তম্ভে ভর করে
    এবং বাসি জলে স্নান সারা পায়রাদের ডানায় ঝড় তুলে
    ভোর নেমে আসছে নিউ ইয়র্কে।

    নিউ ইয়র্কে ভোর নামছে
    ফায়ারপ্লেসের অতিকায় চিমনিতে আর্তনাদ তুলে
    ছাদকে স্কন্ধ দেওয়া লোহার কাঠামোর ফাঁকে ফাঁকে
    ব্যথাকে ভুলিয়ে রাখা জড়িবুটি মলমের খোঁজে।

    ভোর নেমে আসছে অথচ কেউ তা দাঁতেও কাটছে না
    কেননা সকাল নেই এ শহরে, প্রত্যাশা বলেও কিছু নেই
    কখনও কখনও মুদ্রার ভয়ংকর ঝংকার
    ড্রিলের মত সেঁধিয়ে যায় পরিত্যক্ত শিশুদের হাঁ করা মাথায়।

    ভোরবেলা যারা বেরিয়েছে কাজের সন্ধানে তারা হাড়ে হাড়ে জানে
    প্রেম বা স্বর্গ জন্ম নেবে না এইখানে, অতএব মরতেও পারে নি যারা, তারা
    এও জানে, সংখ্যা ও আইনের এঁদোজলে ডুবে যেতে যেতে
    দিন কেটে যাবে নির্মম ক্রীড়া আর ফলহীন শ্রমের মায়ায়।

    সে আলো লুকিয়েছে শিকল ও শব্দের ছায়ায়
    শিকড়বিহীন এক অমোঘকে বেপরোয়া ভর্ৎসনা করে
    এবং মানুষ, তীরে ভেড়া জলযান থেকে নিদ্রাহীন অনর্গল, যেন
    ডুবন্ত জাহাজের খোল থেকে জীবিত ফিরেছে কোনমতে, বিনা রক্তপাতে।

    La aurora (Dawn)






    নিদ্রাহীন শহর
    (ব্রুকলিন ব্রিজে রাত্রি)

    আকাশে তাকাও সকলেই, কেউ যেন ঘুমোতে না পারে
    ঘুম নয়, ঘুম নয়, কেউ যেন ঘুমোতে না পারে।
    চাঁদের বাসিন্দারা ঘ্রাণে বুঝে নেয় কোন কোন বৃত্তে ঘর বাঁধা যাবে।
    জ্যান্ত ইগুয়ানার দল মাংস খুবলে খাবে মানুষের
    রাতচরা যারা স্বপ্ন দেখতে ভুলে গেছে, আর
    ভাঙা মন পলাতক মানুষের দল মোড়ে মোড়ে জটলা বসাবে
    তারাদের ভর্ৎসনা তুচ্ছ করে এক অনুপম কুমীর, কিঞ্চিৎ জিরিয়ে নিচ্ছে আজ।

    ঘুম নয়। এখানে ঘুমোবে না কেউ
    ঘুমহীন চোখ এলায়িত এই পৃথিবীতে।
    দূরের গোরস্থান থেকে একটা শব
    অনুযোগ করে আসছে তিন বছর ধরে
    কেননা পতিত নিসর্গে তার হাঁটু ডুবে যাচ্ছে ক্রমাগত; তদুপরি
    আজ সকালেই মাটিচাপা পড়বার আগে একটি বালক কাঁদছিল
    সেটা চাপা দিতে অবশেষে কুকুর লেলাতে হয়েছিল।

    জীবন স্বপ্ন নয় তত। দেখ, দেখতে থাকো, আমাদের অবরোহণ দেখ
    দেখ নামতে নামতে আমরা কাদা ও মাটির পথ্যে নৈশাহার সেরে নিচ্ছি
    অথবা হয়ত উঠছি, মরা ডালিয়ার অর্কেস্ট্রা শুনতে শুনতে আরোহণ আমাদের
    বরফস্তূপের কিনারায়। কিন্তু এখানে কোন অবলুপ্তি নেই, স্বপ্ন নেই;
    কাঁচা মাংস শুধু। আছে আশ্লেষ চুম্বন, ঠোঁটের ভিতরে থাকা ঠোঁটে
    শিরা আর ধমনীর জট ।
    এবং তারাও আছে যারা নিজেরা আহত বলে সতত আঘাত করে থাকে
    এবং তারাও, যারা মরে যেতে পারে ভেবে মৃত্যুকে কাঁধে বয়ে জীবন কাটায়।

    একদিন শুঁড়িখানাগুলো ঘোড়াশালে পরিণত হবে
    আর প্রতিটি গাভীর চোখে গোপনে লুকিয়ে থাকা হলুদ আকাশ
    হিংস্র পিঁপড়ের দল খুঁটে খুঁটে বার করে নেবে।
    অন্য কোনদিন
    আমরা দেখতে পাব স্টাফ করে রাখা প্রজাপতি পুনরায় উড়ে যেতে পারে
    তথাপি ধূসর স্পঞ্জ আর স্থাণু জাহাজের পটভূমিকায় চলতেই হবে আমাদের
    তখনো দেখব আমাদের অঙ্গুরীয় থেকে ঠিকরে পড়ছে আলো
    আর আমাদের জিভ থেকে অনর্গল উদ্‌গীরিত হচ্ছে যাবতীয় সুগন্ধা গোলাপ।

    দেখ, যদি দেখতে পাও, দেখে নাও
    মেঘভাঙা বাদল আর থাবার আঁচড় দেখে শনাক্ত হবে যে বালক,
    সেতু আবিষ্কারের গল্প শোনা নেই তার তাই কেঁদেই চলেছে
    অথবা সেই মৃতদেহ খুলি আর একপাটি জুতো ছাড়া যার কিছু পড়ে থাকলো না
    তাদের খাড়া কর সরীসৃপ আর ইগুয়ানাদের সামনে প্রতীক্ষাপ্রাচীরের গায়ে,
    যেখানে ভালুকের শ্বদন্ত প্রহর গুনছে,
    যেখানে শিশুর মমি বাড়িয়ে রেখেছে ততোধিক ছোট মমি হাত
    ক্রুর নীল শীত সেইখানে, উটের গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়।

    ওই যে আকাশ, সেখানেও ঘুমোয় নি কেউ
    দেখো, সেখানেও ঘুমোয় না কেউ যেন আজ।
    তবু যদি দেখ ঘুমে কারো চোখ বুজে এলো
    বাচ্চারা শোনো, চাবকাতে হবে, চাবকে জাগাতে হবে তাকে।
    পটভূমি হোক সারি সারি বিনিদ্র চোখ
    আর বিষিয়ে যাওয়া তিক্ত ক্ষতস্থান।
    এলায়িত এই পৃথিবীতে কেউ যেন ঘুমোতে না পারে
    কেউ নয়। এ তো আমি আগেই বলেছি
    কেউ যেন ঘুমোয় না রাতে।
    কিন্তু অন্ধকার হলে, যদি কারো কপালে শ্যাওলা জন্ম নিতে পারে
    গুপ্ত কুঠুরির দ্বার তার জন্য খোলো, চাঁদও আসুক সেই পথে
    বিষে ভরে আছে মেকি পানপাত্র আর মঞ্চের করোটি কপাল।

    Ciudad sin sueno (Sleepless City)
    (Nocturno del Brooklyn Bridge) (Brooklyn Bridge Nocturne)


    গাভী
    লুই লাকাসার প্রতি

    আহত ও ভূমিগত গাভীর শয়ান
    তার শিংয়ের ওপর চড়ে বসেছে নদী ও উদ্ভিদ
    রক্তস্নাত মুখবেড়ি আকাশের শরীরে হেলান।

    ধীরে অসংবৃতে পুরু হয়ে জমে যাচ্ছে লালা
    সে বাঁধনে মধুকর বেঁধে নিল চাক
    ঝিম মারা সকালকে সচকিত করে দিল শ্বেত আর্তনাদ।

    গোশালার ঢিমে আলো ক্ষরিত মধুর মত
    অপর গাভীর দল, জীবিত বা মৃত
    অর্ধনিমীলত চোখে সমূহ সাড়ায় দেয় ডাক।

    এইবার, মাটিতে প্রোথিত শিকড়কে কাছে ডেকে নাও
    যে শিশুটি এখনও জানে ছুরি অর্থ পেন্সিল চিকণ
    তাকেও বলে দাও গাভীটি এবার উপাদেয় মাংস হতে পারে।

    তাদের মাথার উপর ঠিকরে উঠুক আলো
    বিবর্ণ জুগুলার শিরা
    চারখানা চেরা ক্ষুর থর থর হাওয়ায় হাওয়ায়।

    চাঁদকে শুনিয়ে বলো
    পীতাভ পাথর এই রাত্রিকেও ডেকে ডেকে বলো
    ছাই দিয়ে গড়া গাভী ছাই হয়ে উড়ে চলে যায়।
    প্রস্তর-আকাশে কিছু ফাটল মিলেছে তাই
    এই অবসরে গাভী সেখানে গিয়েছে চলে
    যেখানে মাতালরা দ্বিপ্রহরে মৃত্যু রাখে আহার্যতালিকায়।

    Vaca (Cow)




    মৃত্যু


    কতই না চেষ্টা সবার!
    ঘোড়ার প্রবল চেষ্টা কুকুর হবার!
    কুকুরের চেষ্টা পাখি দোয়েল হবার!
    দোয়েলের বাসনায় মৌমাছিজীবন!
    মৌমাছি প্রাণপণে শেষ পর্যন্ত ঘোড়াই হয়ে উঠতে চায়!
    এবং সেই ঘোড়া
    গোলাপের কাঁটায় বিদ্ধ হয়ে
    ওষ্ঠাধরে একখানা বিবর্ণ গোলাপ ফোটায়!
    এবং গোলাপ
    আপতিত আলো আর কান্না
    সুচারু মিশ্রণে রসে অক্ষসন্ধি মিষ্ট হয় তার!
    এবং সেই রসভাণ্ড
    রাতপাহারায় জেগে সে কেবল কাস্তের ধার দেখতে পায়!
    এবং কাস্তে
    খাঁচা থেকে বার করা চাঁদ, নগ্ন
    মাংসের চিরন্তন ব্রীড়া টেনে বার করতে চায়!
    আর এই আমি, ছাদের কিনারায়
    এক প্রোজ্জ্বল দেবদূতের সাথে দেখা হবে বলে নিজেকেই দেবতা বানাই।
    কিন্তু ধনুকসদৃশ এই সমাধিখিলান
    অতি অনায়াস কত সুচারু বিশাল,
    কতটা নিপুণভাবে চোখের আড়ালে সরে গেছে!

    Muerte (Death)



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ উইকিপেডিয়া থেকে
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments