সুমির এমনি সব কিছু ভালো, মা বাবার কথা শোনে, ভাইকে বেশি কাঁদায় না, যা দেওয়া হয় তাই খেয়ে নেয় কিন্তু সে বড্ড ঘুমোতে ভালোবাসে। সুযোগ পেলেই সে চট করে একটু ঘুমিয়ে নেয়। সকাল বেলা তাকে ঘুম থেকে তুলতে মা-বাবার কালঘাম ছুটে যায়। ক্লাসে ঘুমোতে পারে না টিচাররা বকাবকি করেন বলে কিন্তু বাড়িতে থাকলে তো কথাই নেই। ভাত খেয়ে দুপুরে এক চোট ঘুম তারপর মা টেনে তুলে পড়তে বসালে বই নিয়ে পড়তে পড়তে আবার ঘুম। মা, বাবা দিদা মাসি সবাই বলেন, “কী মারাত্মক ঘুম রে তোর সুমি! আর এতটুকু সময়ও লাগে না। সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়তে পারিস।” কাকু তো বলেন, “ইস তোর মতন যদি ঘুমোতে পারতাম রে! আমার তো বিছানায় শোওয়ার পরও কতক্ষণ ঘুমই আসে না। এটা-সেটা ভাবতে থাকি।”
তাই শুনে সুমি ফিক ফিক করে হাসে। সে তো ঘুমোতে পারলে আর কিছু চায় না।
গরমের ছুটিটা সুমির খুব পছন্দের সময়। পড়ারও বিশেষ চাপ থাকে না তাই মনের আনন্দে যতক্ষণ খুশি ঘুমিয়ে নেওয়া যায়। ছুটি বলে ঘুম থকে দেরি করে উঠলেও মা কিছু বলেন না।
তা এইরকম গরমের ছুটির এক দুপুর বেলা সুমি গল্পের বইটাকে বালিশের পাশে রেখে সবে চোখটা বুজেছে এমন সময় শুনতে পেল কে একজন ডাকছে, “সুমি, এই সুমি?”
সুমি ঘোর অনিচ্ছা নিয়ে চোখ খুলতে দেখল পায়েল দাঁড়িয়ে রয়েছে। পায়েল ওদের ওপরের ফ্ল্যাটে থাকে। ওরা একই ক্লাসে পড়ে। ছোটবেলা থেকেই ওদের খুব বন্ধুত্ব। তাও কাঁচা ঘুমটা ভাঙাবার জন্যে সুমি পায়েলের ওপর মোটেই খুশি হল না, একটু রেগেই বলল, “কী হয়েছে?”
“খুব মুশকিল হয়েছে। আমাদের যেতে হবে। অরাত্রিকার ভাইকে একটা দুষ্টু ড্র্যাগন তুলে নিয়ে গেছে। তাকে বাঁচাতে হবে আমাদের!”
সুমি রেগেমেগে বলল, “কেউ ধরে নিয়ে গেছে তো পুলিশে খবর দিক। ওরাই তো হারিয়ে যাওয়া শিশুদের খুঁজে নিয়ে আসে।”
পায়েল মাথা নেড়ে বলল, “এটা সেই রকম নয়। অরাত্রিকার মা-বাবা ওর ভাইকে ওর কাছে রেখে বেরিয়েছেন আর সেই ফাঁকে দুষ্টূ ড্র্যাগনটা এসে ওকে তুলে নিয়ে গেছে। ওর মা-বাবা ফিরে আসার আগে আমাদের ওকে খুঁজে নিয়ে আসতে হবে।”
ভর দুপুরে এ সব আবার কী জ্বালাতন রে বাবা! সুমি জিগ্যেস করল, “কিন্তু কোথায় নিয়ে গেছে সেটা কি জানা আছে?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ। ড্র্যাগন নিজেই বলেছে তার জন্যে এক গাদা মিষ্টি খাবার নিয়ে গেলে তবে সে অর্ককে ছাড়বে! অরাত্রিকা নিজের বাড়ি থেকে সব মিষ্টি নিয়েছে, আমিও তাই। তোর এখানে যা আছে সব নিয়ে চল বেরিয়ে পড়ি।”
সুমি আর কী করবে উঠে ফ্রিজে যা ছিল সব নিয়ে এল। মা দরজা বন্ধ করে ঘুমোচ্ছেন তাই কিছু বলা গেল না। ততক্ষণে অরাত্রিকা আর পায়েল এসে পড়েছে। সব মিষ্টি আর চকোলেট ইত্যাদি একটা বড়ো পিজবোর্ডের বাক্সে রাখা হয়েছে। সেটা এত ভারী যে পালা করে দুজন দুদিক থেকে সেটাকে ধরে ধরে বইতে হচ্ছে।
ওদের কমপ্লেক্স থেকে বেরোতেই কোথা থেকে একটা সবুজ রঙের লাল-ঠোঁট টিয়া পাখি এসে হাজির। অরাত্রিকা ফিসফিস করে বলল, “ওর নাম কিকি। ড্র্যাগন বলেছে ওই আমাদের রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে যাবে।”
কিকি বলল, “এই তো তোমরা তো তৈরি দেখছি। ঠিক আছে চলো রওনা হই। অনেকটা পথ। তবে একটা কথা তোমাদের আগে থেকেই বলে রাখা ভালো। পথে কিন্তু ঘুমোনো চলবে না। যদি কেউ ঘুমিয়ে পড়ে তাহলে পথ দ্বিগুণ হয়ে যাবে! পরে বোলো না যে মনে করিয়ে দিইনি!”
তাই শুনে সুমির তো মাথায় হাত! কতদূর যেতে হবে তার ঠিক নেই আবার ঘুমিয়ে পড়াও চলবে না! কিন্তু অর্ককে তো বাঁচাতেই হবে। কিকি তিন বন্ধুকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল।
একটু পথ গিয়েই সুমি বলল, “ওই দ্যাখ গাছটার তলায় কী সুন্দর ছায়া। দুপুরের ঘুমটা তো হল না একটু জিরিয়ে নিই!”
পায়েল আর অরাত্রিকা দুজনেই হাঁ হাঁ করে উঠল ওর কথা শুনে।
পায়েল বলল, “কিকির শর্ত মনে নেই? ঘুমোলেই পথ দ্বিগুণ হয়ে যাবে! সন্ধ্যে নামার আগে আমাদের ফিরে যেতে হবে অর্ককে সঙ্গে নিয়ে। তুই বরং জোরে জোরে গানটান গা তাহলে ঘুম চলে যাবে!”
সেটাতে কাজ হল। তারস্বরে গান গাইতে গাইতে চলল ওরা। পায়েল সঙ্গে করে ভেজানো ছোলা এনেছিল। কিকিকে সেটা একটু খেতে দিতে সে মহা খুশি। ওদের গানে যোগ দিল।
গান গাইতে গাইতে পাড়া ছাড়িয়ে মাঠ-ঘাট পেরিয়ে একটা ডোবার কাছে এসে পোঁছল ওরা। কিকি বলল, “মহাপ্রভু ড্র্যাগন বলেছেন এত দূর এসে পড়তে পারলে তোমাদের একটা রাইড দেওয়া যেতে পারে!”
ওরা তিন জন বলল, “রাইড? কী রাইড?”
কিকি বলল, “চোখ বন্ধ করো তিনজনে! আমি খুলতে না বললে খুলবে না কিন্তু!”
ওরা তিন জন চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল। মনে হচ্ছিল ওদেরকে ঘিরে যেন সোঁ সোঁ করে হাওয়া বয়ে যাচ্ছে জোরে। বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছিল। পায়লে বলল, “সুমি চোখ বন্ধ করেছিস ঠিকই কিন্তু ঘুমিয়ে পড়িস না যেন। তাহলে সব কেলো হয়ে যাবে!”
সুমি দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “না ঘুমোচ্ছি না!”
একটু পরেই কিকি বলল, “এবার চোখ খুলতে পারো!”
ওরা তিনজন চোখ খুলে তাকিয়ে দেখল সামনেই একটা রামধনু রঙের বিশাল প্রাসাদ। খুব সুন্দর দেখতে সেটাকে, সোনালি চুড়োটা রোদ পড়ে ঝলমল করছে। ওদের সামনে থেকেই সেই প্রাসাদে উঠে যাওয়ার শ্বেতপাথরের সাদা পাকানো সিঁড়ি!
কিকি ডানা ঝাপটে বলল, “এটাই ড্র্যাগনের প্রাসাদ। তোমরা ভাল মেয়ে হয়েছিলে বলে তোমাদের এখানে নিয়ে এসেছি সোজা। ড্র্যাগনকে বোলো না কিন্তু। সে মহা রাগী। আমাকে ছোলা দিয়েছ বলে আমি তোমাদের এখানে নিয়ে চলে এসেছি শুনলে খুব রাগ করবে!”
ঠিক আছে বলে ওরা তিনজন লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল। কিকিও এসে গেছি, এসে গেছি বলতে বলতে ওদের সঙ্গে উড়ে উড়ে চলল।
প্রাসাদের ভিতরটাও খুব সুন্দর। একটা বিশাল রামধনু রঙের সিংহাসনে বসে রয়েছে সবুজ রঙের গিরগিটির মতন দেখতে মহাপ্রভু ড্র্যাগন আর তার কোলে অর্ক ঘুমিয়ে রয়েছে।
অরাত্রিকা বলল, “যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। অর্ক উঠে পড়লেই খুব মুশকিল হবে। ড্র্যাগনকে দেখে ভয়ে চেঁচামেচি শুরু করবে।
ওরা তিনজন মিষ্টির বাক্সটা ড্র্যাগনের পায়ের কাছে এগিয়ে দিয়ে বলল, “আমাদের সাধ্যমত মিষ্টি এনেছি আমরা। এবার আপনি অর্ককে ছেড়ে দিন! ও তো খুব ছোটো তাই ভয় পেয়ে যাবে।”
ড্র্যাগন হিস হিস শব্দ করে সিংহাসন থেকে নেমে এসে বাক্সটা খুলে দেখল।
“বাহ, বাহ বেশ বেশ!” বলে বিশাল হাঁ করে এক নিমেষে সব মিষ্টি খেয়ে শেষ করে ফেলল সে!
অমনি পিছন থেকে কে একজন বলল, “এই ভ্যাবলা আবার তুই দুষ্টুমি শুরু করে দিয়েছিস! মিষ্টি খেয়ে খেয়ে যা চেহারা করেছিস তা তো বলবার নয়! মোটা থপথপে হয়ে গেছিস, দু পা হাঁটার ক্ষমতাও নেই! আবার পুঁচকে মানুষের বাচ্চাকে ধরে এনেছিস! এখুনি দিয়ে দে!” বলতে বলতে মহাপ্রভু ড্র্যাগনের মা এসে পড়লেন। কিকি বলে উঠল, “প্রণাম মহারানি মা!”
“কিকি তুইও খুব দুষ্টু হয়ে পড়েছিস! সব সময় ওকে সাহায্য করছিস!”
কিকি গুঁই গুঁই করে বলল, “আমি আবার কী করলাম?”
“তোকে আমি বলেছিলাম না মহাপ্রভু দুষ্টুমি করলে আমাকে এসে বলবি! মিছি মিছি মানুষের বাচ্চাদের কষ্ট দিল!”
কিকি বুকে মুখ গুঁজে চুপ করে বসে রইল বকুনি খেয়ে আর মহাপ্রভু ড্র্যাগন তড়িঘড়ি অর্ককে অরাত্রিকার কোলে দিয়ে দিল।
মহারানি ড্র্যাগন এবার বললেন, “আমার ছেলে তোমাদের কষ্ট দিয়েছে বলে আমি দুঃখিত কিন্তু এই প্রাসাদের কিছু নিয়ম আছে। এখানে যারা আসে তাদের তিনটে প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে হয় নাহলে তারা এখান থেকে ফিরে যেতে পারে না। আমি দুঃখিত কিন্তু তোমাদের জন্যে আমি সেই নিয়ম ভাঙতে পারব না। নিয়ম ভাঙার নিয়ম তো নেই-ই আর সামনের দরজা খুলবেও না তিনটে প্রশ্নের উত্তর সঠিক না দিলে।”
ওরা তিন জন মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। এ তো একেবারে তেলের কড়াই থেকে আগুনে গিয়ে পড়া! ধাঁধার সঠিক উত্তর না দিতে পারলে চার জনই আটকে থেকে যাবে এখানে!
পায়েল বলল, “ঠিক আছে উপায় যখন নেই তখন চেষ্টা করে দেখি!”
মহারানি ড্র্যাগন বললেন, “কিকি প্রথম ধাঁধাটা বল!”
কিকি নেচে নেচে বলল, “আমার দুটো হাত আছে কিন্তু আমি তালি বাজাতে পারি না, কে আমি?”
এই খেয়েছে! ওরা তিন জন আবার মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। তারপর পায়েল দুম করে বলল, “বুঝতে পেরেছি! ঘড়ি! দুটো হাত আছে কিন্তু তালি বাজাতে পারে না!”
মহারানি ড্র্যাগন বললেন, “ঠিক উত্তর! কিকি দ্বিতীয় ধাঁধা!”
“আমার পা আছে কিন্তু আমি হাঁটতে পারি না!” কিকি গেয়ে গেয়ে বলল।
এবার অরাত্রিকা বলল, “ওটা টেবিল বা চেয়ার যে কোন একটা হতে পারে। পা আছে কিন্তু হাঁটতে পারে না!”
মহারানি ড্র্যাগন বললেন, “বেশ! কিকি শেষ ধাঁধাটা বল! ওটাই সব চেয়ে শক্ত। সবাই ওটাতে এসেই আটকে যায়।”
কিকি সুর করে করে বলল,
অতি বড়োকেও দুর্বল করি আমি,সত্যিই শক্ত। ওরা তিন জন বেশ ঘাবড়ে গেল। এখানেই কি থাকতে হবে নাকি ওদের সারা জীবন?
দৃশ্য দেখাই বহু তারপর থামি।
আমাকে তোমার চাই রোজ রোজ,
না পেলে আমাকে পড়ে খোঁজ খোঁজ।
তারপরই সুমি বলে উঠল, “বুঝতে পেরেছি! আমার খুব প্রিয় জিনিস সেটা! ঘুম! ঘুমের কথা বলা হচ্ছে!”
যেই না বলা অমনি ফটাস করে একটা শব্দ হল আর ওরা ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। চোখ যখন খুলল তখন ওরা পাড়ার মাঠের কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে। অর্ক রয়েছে অরাত্রিকার কোলে, সে তখনও ঘুমে কাদা।
ওরা তিন জন ছুটতে ছুটতে বাড়ি ফিরে এল। সুমি চটপট নিজের বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। মা তখনও দরজা বন্ধ করে ভাইকে নিয়ে শুয়ে আছেন।
ওদের ওই অ্যাডভেঞ্চারের কথা সুমিই আমাকে বলেছে। আরও বলেছে, “জানো আমি আর এখন অত ঘুমোই না। কিকি ঠিকই বলেছিল, ঘুমিয়ে পড়লে যে কোন কাজ করতে দ্বিগুণ সময় লেগে যায়!”