"এবারে তাকাও ওই দূরের আকাশের দিকে - ওই ভেসে যাওয়া মেঘগুলোর দিকে - তাকিয়ে দ্যাখো - কার চেহারা? - কার মুখ? বুঝতে পারছো?" - ওই মায়াবী কন্ঠস্বরটি যেন ক্রমশ ঘিরে ধরছিল আমাকে আর সেই সাথে ঘন হয়ে আসছিল ওই সম্মোহনী সূর্যাস্ত।
আসলে সেটা ছিল এক আশ্চর্য বিকেল - ওই পাহাড়ের কোলে বিশাল ঘাসজমির শেষ সীমানায় পড়ন্ত সূর্যটা একটা নিটোল রক্তবিন্দুর মতো লেগে ছিল আকাশের গায়ে - আর পাশ দিয়ে ধীরে ধীরে ভেসে যাচ্ছিল একটার পর একটা নানান আকারের সোনালি মেঘ।
একমনে তাকিয়ে দেখছিলাম দিনশেষের এই আশ্চর্য আকাশটাকে - হঠাৎ মনে হলো কে যেন আমার পাশে এসে দাঁড়াল এই নির্জনে।
তাকিয়ে দেখলাম আমার পাশে নিশ্চুপে এসে দাঁড়িয়েছে এক কিশোর - জামাকাপড় অবিন্যস্ত - একমাথা এলোমেলো চুল - কেমন যেন রুগ্ন মুখ - কিন্তু চোখ দুটো আশ্চর্য রকমের উজ্জ্বল - আর দৃষ্টিটা কেমন অদ্ভুত ভাসাভাসা।
বলতে যাচ্ছিলাম - 'তুমি কে?' কিন্তু তার আগেই যেন এক আশ্চর্য মায়াবী কন্ঠে সে বলে উঠল - "মনে করো আমি এক রাখাল - আর ওই দূরে - ওই গাছগুলোর নীচে মনে করো দাঁড়িয়ে আছে একপাল ভেড়া - মনে করো আমিই চরাতে নিয়ে এসেছি ওদের এখানে -"
এইসব কথায় আমি হতভম্ব হয়ে তাকালাম ওর দিকে - কিন্তু আমার এই মনোভাবকে গ্রাহ্য না করেই আমার চোখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে অদ্ভুত ফিসফিসে কন্ঠস্বরে সে বলে যেতে লাগল - "আর মনে করো - ঠিক এই মুহূর্তে - ওই দূরে - নিঃশব্দে এসে দাঁড়িয়েছে - একটা প্রকাণ্ড চেহারার ঝলমলে সোনালি রঙের -"
আমি অবাক হয়ে ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম, আর ছেলেটি তার সেই অবাক করা কন্ঠস্বরে বলতে থাকলো - "তাকাও - ভালো করে তাকাও - আমার মুখের দিকে নয় - ওই দিকে - ওই দূরের আকাশের দিকে - ওই ভেসে যাওয়া মেঘগুলোর দিকে - একমনে তাকিয়ে দ্যাখো - কার চেহারা - কার মুখ - বুঝতে পারছো?"
আমি ওই দূরের আকাশের দিকে তাকালাম, খুব মন দিয়ে দেখার চেষ্টা করতে লাগলাম। দেখতে পাচ্ছিলাম একের পর এক মেঘ ভেসে চলেছে আকাশের কিনারায়। কতরকম তাদের আকার -পড়ন্ত আলোয় যেন কত রহস্যময়!
"ওই মেঘের রাজ্যে ভালোভাবে তাকিয়ে দ্যাখো - ভেসে বেড়াচ্ছে কারা - ওই চলছে যেন মেঘের তৈরি একটা বিরাট পালতোলা নৌকা - ওই দ্যাখো বদলে গিয়ে হয়ে গেল প্রকাণ্ড রাজমুকুট - এইবার দ্যাখো রাজমুকুট ভেঙে গিয়ে... এখন কার চেহারা? - কার মুখ? বুঝতে পারছো?"
"ঝলমলে সোনালি রঙের - প্রকাণ্ড চেহারার - " ও বলে যেতে থাকল সেই অদ্ভুত ফিসফিসে গলায় আমার কানের কাছটিতেই।
আমি যেন একটা ঘোরের মধ্যে থেকেই চমকে উঠে বললাম - "সিংহ! সিংহ!"
"ঠিক বলেছো! একদম ঠিক বলেছো! তাহলে তুমি সত্যিই দেখতে পাচ্ছো তো - ওই দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে - ওই ভেড়ার পালের পিছনেই," উত্তর এলো ফিসফিসিয়ে
"কিন্তু ওরা - ওরা কেউ দেখতে পায় না কেন? এই নিয়ে হাসাহাসি করে কেন? কেন বলে আমায় মিথ্যাবাদী? আমি তো জানি যে আমি যা দেখছি তা কত ভয়ঙ্কর - বাস্তবের থেকেও," খুব কাতর কন্ঠে বলে উঠল সে।
আর এই কথা শেষ হতে না হতেই শুনতে পেলাম এক হাড় হিম করা সিংহের ডাক - চমকে উঠে দেখলাম একটা প্রকাণ্ড সোনালি রঙের ঝলকানি বিদ্যুতের মতো দেখা দিয়েই চলে গেল আমার সামনে দিয়ে।
তাকিয়ে দেখলাম আমার পাশের সেই ছেলেটি আর নেই! দূরে - অনেক দূরে - মাঠের শেষ প্রান্তে - দেখা যাচ্ছে সেই ভয়ঙ্কর সোনালি দেহটাকে - খুব শান্তভাবে ধীরেসুস্থে চলেছে সে - শিকার মুখে নিয়ে।
আর সেই শিকারটিকে চিনতে পারলাম মুহূর্তেই! তখনই এক প্রচণ্ড ভয়ে আমার সমস্ত শরীরটা যেন জমে পাথর হয়ে গেল - কিন্তু সম্বিৎ ফিরে পেলাম পরক্ষণেই - আর তখনই প্রাণপণে দৌড়তে শুরু করলাম - কারণ ওই জায়গা ছেড়ে আমায় পালাতে হবে এক্ষুনি - নইলে হয়তো এবার আমাকেই -
কতক্ষণ এইভাবে দৌড়েছি কে জানে, এবার দম নেওয়ার জন্য একটু থামলাম। রোদ একেবারে পড়ে এসেছে। চারিদিকে একটা ঘোলাটে অন্ধকার।
হঠাৎ টের পেলাম পায়ের তলায় একটা আঠালো চটচটে ভাব। তাকিয়ে দেখি রক্তের দাগ, রক্তের ধারা বয়ে যাচ্ছে পিছনের জমিতে।
আমি চমকে উঠে পিছিয়ে এলাম - দেখলাম রক্তের ধারাটাও আমার পিছু পিছু এগিয়ে এল! তারপর আমার পা বেয়ে শরীরের উপর এঁকেবেঁকে উঠতে শুরু করল!
আমার আর এতটুকু নড়ার ক্ষমতা রইল না - তা সত্ত্বেও আমি আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলাম ওই রক্তের দাগগুলো মুছতে।
"যাক! তুমিও রক্তাক্ত হলে!"
শুনে চমকে উঠলাম! আবার সেই কন্ঠস্বর! সামনে তাকিয়ে আঁতকে উঠলাম ! আমার সামনে, প্রায় দুহাত দূরেই, আধো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে এক বীভৎস চেহারায় - সেই ছেলেটা!
রক্তে ভেসে যাওয়া শরীর! মুণ্ডহীন! স্কন্ধকাটা ছেলেটার দুহাতে ধরা তারই কাটা মাথাটা! ওই রক্তাক্ত মুখটাই যেন সেই ফিসফিসে গলায় বলে উঠলো - "এখনো অবিশ্বাস?"
না না - অবিশ্বাস করব কীভাবে! আমি তো নিজেও দেখেছি সেই সোনালি শরীর - মেঘের ভিতর দিয়ে - তারপর আমার চোখের সামনে সেই প্রকাণ্ড বিদ্যুৎ ঝলকের মতো চলে যাওয়া। তারপর এই রক্তের স্রোত, অস্বীকার করব, অবিশ্বাস করব কীভাবে?
তারপর যেন নিজেকে নাকি ওই ছেলেটিকেই আর্তস্বরে বললাম - "শেষটা কি এভাবেই হওয়ার দরকার ছিল?"
স্কন্ধকাটা ছেলেটি নিঃশব্দে আমার দিকে এগিয়ে দিল তার দুহাতে ধরে থাকা কাটা মুণ্ডুটা।
এবার আমি বুঝতে পারলাম, নিশ্চিতভাবেই বুঝতে পারলাম সমস্ত ব্যাপারটা। আর তখনই চিনতে পারলাম ওকে নির্ভুলভাবে। তাই সমস্ত ভীতিভ্রান্তি ছুঁড়ে ধীরে সুস্থে খুব স্পষ্টস্বরে বললাম -
"তুমি তো সেই অঘোরবাস্তবের কবি, তাই সবার কাছেই লাঞ্ছিত, ধিকৃত, এবং শেষপর্যন্ত নিহত - নিজের কৃতকর্মের জন্যই। তোমার এই সংস্পর্শ আমার অসহ্য মনে হচ্ছে, তোমার এই নিরন্তর মায়াবী খেলা থেকে মুক্তি চাই আমি, পরিত্রাণ পেতে চাই আমি। তোমার এই জাদু - "
আমার কথাটা মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে সে যেন পাথরকঠিন স্বরে বলে উঠল - "তাই বুঝি? তাহলে দ্যাখো। তোমার সামনে যে বাস্তব আছড়ে পড়েছে, যাও সেখানে - সেখানেই থাকো।"
তার ওই অদ্ভুত বায়বীয় কন্ঠস্বর শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কানে এল বিকট একটা শব্দ, যেন অনেক উঁচু থেকে কিছু একটা পড়ার আওয়াজ। ঘুরে দেখলাম, কিছুটা দূরে পড়ে আছে আষ্টেপৃষ্ঠে হাত-পা বাঁধা একটি মধ্যবয়সি লোক। রক্তে ভেসে যাচ্ছে তার থ্যাঁতলানো মাথাটা, আর তার রক্তে ভেজা পরনের জামাটায় লেখা - 'আমি চোর ঈশপ'।
আমার সামনে এখন চাপ চাপ রক্ত - ঘাসের ভিতর দিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। এই হত্যা বড়ো বাস্তবিক; আমি কিছুতেই চাই না এই ভয়ঙ্কর বাস্তবের সামনে এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে, তাই পালিয়ে যাই, এক্ষুনি, অন্যদিকে, ওই অঘোরবাস্তবের আশ্রয়েই।
(কথিত আছে গ্রীসদেশে জন্মসূত্রে ক্রীতদাস ঈশপ তার প্রখর বাস্তববুদ্ধি ও সহজাত প্রজ্ঞার গুণে দাসত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে রাজন্যবর্গের বিশ্বস্ত পার্ষদ হয়ে ওঠেন। সেই সূত্রেই লিডিয়ারাজ ক্রেসাসের তরফ থেকে ডেলফি নগরীতে যান এবং সেখানে তথাকথিত সাধুসন্তদের কৌশলবৃত্তির বিরোধিতা করেন। যার ফলে ঈশপকে মিথ্যা ষড়যন্ত্রে অ্যাপোলো দেবতার মন্দির থেকে স্বর্ণপাত্র চুরির অভিযোগে প্রাণদণ্ড দিয়ে একটি পাহাড়ের মাথা থেকে নীচে নিক্ষেপ করে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়।
বর্তমান কাহিনীটি ঈশপের The shepherd boy and the wolf কথিকা এবং ঈশপের মৃত্যুকাহিনীর দ্বারা প্রাণিত।)