• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৬ | এপ্রিল ২০২২ | ছোটদের পরবাস | গল্প
    Share
  • আইসক্রিম ট্রাক : রূপসা দাশগুপ্ত



    ১)

    পাইন গাছের ঝরা পাতায় ঢেকে যাওয়া পিচরাস্তা দুপুরের নিঝুম ঘুম থেকে হঠাৎ জেগে ওঠে টুং টাং সুরেলা আওয়াজে। গর্ত থেকে কাঠবিড়ালির ছোট ছানারা কাণ্ডটা কি দেখতে উঁকি মেরেই, ভয়ে লুকিয়ে পড়ে তক্ষুনি। চার বছরের টুবলু ঝুলবারান্দায় অধীর আগ্রহে দাঁড়িয়েছিল এতক্ষণ এই শব্দের আশায়। “মা…মা… চলো চলো এসে গেছে,” আধো বাংলায় সে দুপুরের ঘুম থেকে মাকে জাগাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সপ্তাহে তিন-চার দিন বিকেলের দিকে এই আইসক্রিম ট্রাক আসে তাদের আশপাশের পাড়ায়।

    আমেরিকার দক্ষিণের প্রায় বৈচিত্রহীন একটা ছোট্ট শহর, এদেশে যাকে বলে ডীপ সাউথ। নিবিড় জঙ্গল কেটে তৈরি হয়েছে শহরটি, তাই এখানে আসতে পার হতে হয় মাইল মাইল গহিন জঙ্গলের মধ্যেকার রাস্তা।

    সোমা ও আদিত্যর ছোট পরিবার কিছু মাস হল এসেছে এখানে। ছোট ছোট কাঠের বাড়ি চারদিকে, তারই একটা ভাড়া নিয়েছে তারা। বাচ্চাদের খেলার মাঠ, সুইমিং পুল ও কমিউনিটির অফিস নিয়ে বেশ একটা পাড়ার মত, ফাঁকা জায়গা ও গাছপালার অভাব নেই। পুরো শহরটাতেই লোকসংখ্যা খুব কম। দু-একটা বড় কোম্পানি আছে যাদের উপর নির্ভর এখানের মানুষের জীবনযাত্রা, সেইরকমই একটায় আদিত্য প্রজেক্টে এসেছে। আর আছে মিলিটারি বেস। তাই আর্মির লোকজন আসে, থাকে, আবার চলেও যায় রাতারাতি। সোমা বুঝেছে এখানে সব কিছুই তাৎক্ষণিক, লোকজন জানে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার সময় পাওয়া যাবে না, তাই মেলামেশা করে না। একটু হাসি, দু-একটা মামুলি কথা, ব্যস।

    তারাও এখানে কদিন থাকবে ঠিক নেই, আগে তারা ছিল জনবহুল ক্যালিফোর্নিয়ার একটা শহরে, ফলে এ একরকম নির্বাসন তাদের জন্যে। ছোট্ট টুবলু সঙ্গী খুঁজে পায় না। পাশের বাড়িতেই একটা তিন বছরের বাচ্চা থাকে, কিন্তু পিটার বেজায় লাজুক। তার মা বিশেষ আগ্রহও দেখায় না মেলামেশার, তারা আর্মির লোক, নিজেদের ক্লাব ইত্যাদিতেই মেশে হয়ত। টুবলুকে পার্কে নিয়ে যায় সোমা, কেমন যেন আলগা-আলগা ভাব লোকজনের, অনেক চেষ্টা করেও বন্ধু পায় না তারা। কাছের নার্সারি স্কুলে টুবলুকে ভর্তির চেষ্টা চলছে, তারা জানিয়েছে কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হবে, ক্লাসরুমে জায়গা নেই। এই অবস্থায় বিকেলের আইসক্রিম ট্রাক যেন একঝলক খুশি নিয়ে আসে। অনেকগুলো ডলার দিয়ে ক্যাটক্যাটে রং আইসক্রিম পছন্দ করে টুবলু। বড্ড গায়ে লাগে সোমার, কিন্তু আইসক্রিমওয়ালার বন্ধুত্ব ফাউ জোটে ছেলের, অগত্যা…।

    ২)

    খুব লম্বা, পেটানো শরীর, হাশিখুশি মাঝবয়েসি লোক আইসক্রিমওয়ালা। তার একটা চোখ আকারে ছোট, তার চারপাশে সেলাইয়ের অসংখ্য দাগ। বাম হাত কবজি থেকে জোড়া দেওয়া, যেন পুরোটাই কেটে ফেলা হয়েছিল এমন গভীর ক্ষত। তার ট্রাকে বড় বড় করে লেখা থাকে “ইরাক ওয়ার ভেটেরান”। টুবলুকে রডনি ডাকে বাডি বলে। সে গল্প বলে বন্দুক- ট্যাংক- বোমা- যুদ্ধের, সোমার ভালো লাগে না, কিন্তু টুবলুর সে-সব মহা পছন্দ। পুরো কমিউনিটিতে আইসক্রিম বিক্রি শেষে রডনি আজকাল আসে মিনিট দশেক টুবলুর সাথে গল্প করতে। সোমা কিছুক্ষণের জন্য একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচে, অনেক ধন্যবাদ দেয় সে রডনিকে, করলই নাহয় খানিক যুদ্ধের গল্প, যার যে বিষয়ে অভিজ্ঞতা।

    রাত্রে আদিত্য অফিস থেকে ফিরলে, টুবলু বিকেলের শোনা যুদ্ধের গল্পের ডেমো দেখায় বাবাকে। ঢ্যা ঢ্যা ঢ্যা ঢ্যা ঢ্যা মেশিনগান চলছে, হুই শব্দে ওই উড়ে গেল বোমারু। টুবলুকে সঙ্গ দিতে আদিত্য গান ধরেছে--“হাল্লা চলেছে যুদ্ধে, হাল্লা হাল্লা হাল্লা...”

    “হাল্লা” কী তা না বুঝেই গানের দমকে মাথা নেড়ে খেলনা-বন্দুক হাতে ছেলে ছুটে বেড়াচ্ছে বাড়িময়।

    সোমার কান ঝালাপালা, সে চেঁচিয়ে ওঠে--তুমিও এইসব কুশিক্ষা দিচ্ছ ছেলেকে।

    আদিত্য হো-হো করে হেসে ওঠে--“ওরে হাল্লার রাজার সেনা তোরা যুদ্ধ করে করবি কি তা বল”--এটা গাইতে হবে তো? তা হাল্লার রাজার সেনার সাথে বন্ধুত্ব তো আমি পাতাইনি, হে বালিকে।

    সোমা রেগে ওঠে-- কেউ কথা বলে এখানে? ওই একজনই যা একটু সঙ্গ দেয় বাচ্চাটাকে, আমার কোনো উপায় রেখেছ তুমি? চারপাশে তাকিয়ে দেখো সবই হাল্লার রাজার সেনা আর তাদের ফ্যামিলি। আমার একটুও পছন্দ না এই যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা।

    ৩)

    টুবলু তার মায়ের তৈরি সন্দেশ চুপি-চুপি একটা ছোট্ট টিফিনবক্সে ভরেছে, ইচ্ছে মাকে লুকিয়ে রডনিকে খেতে দেবে। যথারীতি সোমা ধরে ফেলেছে, সে যত বোঝায় এখানে লোকে এভাবে খেতে দেয় না, ওর খারাপ লাগে যদি? টুবলু তত চেঁচিয়ে কেঁদেকেটে একশা করছে। শেষে সোমা খুব সঙ্কোচের সাথে রডনিকে জানায়,

    --এটা আমাদের ঘরে তৈরি মিষ্টি, টুবলু তোমাকে খাওয়াবে বলে খুব জেদ করে নিয়ে এল।

    রডনি টপাটপ খেয়ে ফেলে বলল--কাবাব আর বিরিয়ানি কই? টিক্কা মশালা? উঃ, কতদিন খাইনি, এই ছোট্ট শহরে তো পাকিস্তানি বা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট নেই।

    সোমা অবাক হয়ে বলে--তুমি এসব ভালোবাসো? আমি তো ভাবি এত মশলা তোমরা পছন্দ কর না।

    --আমি সর্বভুক, হাজারটা দেশে থেকেছি, সবরকম খাবার চেখে দেখা আছে। আমি তোমাদের স্পাইসি খাবার খুব খুব ভালোবাসি।

    --আচ্ছা তাহলে মা তোমার জন্যেও বানাবে, আমি নিয়ে আসব--টুবলুর কচি গলা রিনরিনিয়ে ওঠে।

    --উঃ তুমি একদম আমার মনের কথাটা বললে বাডি। তাহলে এই ডীল হোক আমি ফ্রী-তে আইসক্রিম দেব, আর তুমি আনবে ইনডিয়ান ফুড, রাজি মাম্মি?

    আর রাজি না হয়ে সোমার উপায় কি? সোমা মনে মনে ভাবে “টুবলুটা কী ঝামেলায় ফেলল।”

    রাত্রে আদিত্য বলে--আরে তোমার আর্মি ম্যান তো গুটিগুটি এগুচ্ছে সোম!! এখন বলে হাতের রান্না খাওয়াও। কী বিপদ! একে বীর, তায় সুপুরুষ, আমি তো ডুয়েলে টিঁকতেই পারব না।

    সোমা বালিশ দিয়ে দুমদাম পেটায় আদিত্যকে, ফর্সা মুখ লাল করে বলে-- শনিবারে তুমি নিয়ে যেয়ো ছেলেকে, কুম্ভকর্ণর মত দিবানিদ্রা না দিয়ে।

    --রক্ষে করো! দশ বছরের পুরনো বউয়ের জন্য দিবানিদ্রা ছাড়তে পারব না।

    --আচ্ছা পরকিয়ার কী ঠেলা জান না তো, তাই। সোমা শাসায়।

    ৪)

    রডনি বলে-–আমার ছেলে আর আমি চেটেপুটে খেয়েছি। এত ভালো কী করে যে বানাও তোমরা।

    সোমা বলে--শিখে নিও, রেসিপি লিখে দেব।

    --কত সব মশলা! আমি কোনমতে রান্না করতে পারি, ওসব পারব না। আইসক্রিমের বদলে মাঝে মাঝে ইন্ডিয়ান খাবার জুটলেই হবে।

    তার উজ্জ্বল নীল চোখে খুশি ঝলমল করে পড়ন্ত রোদ ঠিকরে। এই বিনিময় প্রথায় সোমা প্রবল আপত্তি করে, বলে-- আইসক্রিম ফ্রী দিতে হবে না তোমাকে, এটা ঠিক হচ্ছে না। আমার খুব ভুল হয়ে গিয়েছে; আগেই জানতে হত তোমার ফ্যামিলিতে কতজন আছে, আমি তো শুধু তোমার খাওয়ার মত দিয়েছিলাম।

    --আর কেউ নেই, আমার ছেলে আর আমি।

    টুবলু উৎসাহের সাথে জানতে চায়--তোমার ছেলে কত বড়?

    রডনি হেসে বলে--অনেক বড় বাডি, সিক্সটিন, হাই স্কুলে পড়ে।

    টুবলু হতাশ হয়। সোমা বলে-–তাতে কী, তবুও টুবলু খেলতে পারে তাই না? একদিন এনো ছেলেকে।

    সোমা ভাবে--স্ত্রীর কথা কি জানতে চাওয়া উচিত হবে? হতে পারে ডিভোর্সি অথবা হয়ত বিয়েই করেনি, কতরকম তো দেখল এই দেশে এসে, চুপ থাকাই ভালো।

    ৫)

    দেখতে দেখতে পাতাঝরার মরসুম আসে ঘটনাবিহীন এই গঞ্জে। আজকাল সোমা যা কিছু ভালো রান্না করে একটু রডনির জন্যে রেখে দেয়, টুবলু সেরা আইসক্রিম বেছে নেয় রডনির ট্রাক থেকে, রডনি দাম নিতে চায় না। এর মধ্যে আদিত্যও রডনির সাথে আলাপ পাতিয়েছে, মাঝেসাঝে আইসক্রিম কিনতে গিয়ে গল্প করে আসে।

    সেদিন বিকেলে রডনি খুব অন্যমনস্ক ছিল, চোখমুখ একটু অস্বাভাবিক। টুবলুর হাত ধরে একটু পায়চারি করতে করতে বলল--তোমাকে অনেক যুদ্ধের গল্প বলেছি বাডি, কিন্তু আজ বলছি যুদ্ধের থেকে বাজে জিনিস আর কিছ হয় না, জানবে যে জিতে যায় সেও আসলে জেতে না, যুদ্ধে সবাই হারায় কিছু না কিছু প্রিয় জিনিস, সে উইনার হোক বা লুজার।

    টুবলুর কচি গলায় অবিশ্বাসের সুর--তা কেমন করে হবে?

    রডনি বলে--একটু বড় হও, তখন এ কথার মানে বুঝবে।

    একটু পরে সে সোমার কাছে এসে বলে-- আমি যখন যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলাম আমার স্ত্রী মার্থা ক্যান্সারে মারা যায়। ধরা পড়েছিল লাস্ট স্টেজে, কেউ তো ছিল না তার যত্ন নেবার, আমার ছেলে তখন খুব ছোট, এই বাডির মত। আজ মার্থার জন্মদিন।

    কী বলবে ভেবে পায় না সোমা। জানতে চায়--তোমার সাথে শেষ দেখা হয়নি?

    --না, আমি খবর পেয়ে ফিরছিলাম কিন্তু...।

    রাস্তার পাশের হলুদ ফুলে ভরা গাছটা টুপটাপ ফুল ঝরায়, লালরঙা কার্ডিনাল আর ব্লু জে পাখিরা উড়ে এসে বসে। তাদের ঘরফেরত ডাকে মুখর হয় চারপাশ। তার সাথে যোগ হয় এক প্রাক্তন সৈনিকের আইসক্রিম ট্রাকের সম্মোহনী সুর, আজ যেন একটু করুণই শোনায় তা।

    ৬)

    হঠাৎই এক সপ্তাহে রডনি আসে না। তার জন্যে সন্দেশ, মাছের কারি, পড়ে থাকে ফ্রিজে। টুবলু কান্নাকাটি শুরু করে থেকে থেকে। এর মাঝে ওদের হঠাৎ বদলির সময় এসে যায়, শর্ট নোটিশে জায়গা বদলানো ওদের কাছে নতুন না। কিন্তু টুবলুর আইসক্রিমওয়ালার দেখা নেই সেটাই চিন্তার। আদিত্য বলে--ফোন নাম্বারটা নাওনি কেন?

    --ওমা তুমি চাইতে পারতে, ফোন নাম্বার তাই আমি চাইতে পারি? বাজে দেখায় না? তাছাড়া মনেও পড়েনি কোনোদিন। সোমা রেগে যায়।

    কম্যুনিটির অফিসে বলে রাখা ছিল, কিন্তু তারাও কিছু জানায় না, হয়ত পাত্তাই দেয় না।

    টুবলু একটা চিঠি লেখে, বড় বড় অক্ষরে সেখানে দেয়া থাকে বাবার ফোন নাম্বার। “আমাদের নতুন শহরে বাড়ি ঠিক হলে তোমাকে ঠিকানা দেব, তুমি চলে এসো। অবশ্যই ফোন করো।” একটা চিঠি ঘরের সামনের পাইন গাছে সাঁটিয়ে দেয় টুবলু। আর একটা কপি দেয়া হয় ছোট্ট পিটারের মাকে, যারা পাশের বাড়িতে থাকে। যদি দয়া করে তারা চিঠিটা দেয় আইসক্রিমওয়ালাকে। এসব ব্যবস্থা করে টুবলু বেশ নিশ্চিন্ত হয়ে বলে--ও ঠিক ফোন করবে, তাই না মা? সঙ্গীহীন প্রবাসে ছোট বাচ্চাদের বন্ধু হারানো বড় কষ্ট দেয়, মনটা বিষন্ন হয়ে যায় সোমার, মুখে বলে--নিশ্চয়ই করবে। অনেক ঠাঁই বদলের অভিজ্ঞতায় সে জানে ক্ষণিকের এই সব বন্ধুরা হারিয়েই যায়।



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments