[মাণ্টোর (১৯১২-৫৬) এই অতি ক্ষুদ্র কলেবরের গল্পটি যখন প্রথম পড়ি, তখন ধাক্কা লেগেছিল। গা গুলিয়েও উঠেছিল কি? নোংরা পেচ্ছাপখানার দেওয়ালে মুক্তচিন্তার কী সুগভীর প্রকাশ! ১৯৪৫ সালে ‘সড়ক কে কিনারে’ গল্প সংগ্রহে প্রকাশিত এই গল্প পড়ে মনে হবে দেশভাগের নির্মম বাস্তবতা, তৎকালীন রাজনীতির অযৌক্তিকতা আর হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি রাজনৈতিক নেতাদের বিশ্বাসঘাতকতার এমন উলঙ্গ প্রদর্শনও সম্ভব? সমকালীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি লেখকের ঘৃণা এই গল্পে যতটা তীব্রভাবে প্রকাশিত হয়েছে, তা হয়ত অন্য কোনও গল্পে হয়নি।
অনুবাদের জন্য দিল্লির এডুকেশনাল পাবলিশিং হাউস প্রকাশিত মাণ্টোসমগ্র (কুল্লিয়াত-এ-মাণ্টো)-র তৃতীয় খণ্ডে মুদ্রিত গল্পটি ব্যবহার করেছি।
—অনুবাদক]
কংগ্রেস হাউস্ আর জিন্না হলের অদূরেই একটা প্রস্রাবখানা আছে। বম্বেতে এদের মুত্রি বলে। আশপাশের মহল্লার যত ময়লা আর জঞ্জাল সেই দুর্গন্ধময় কুঠুরির বাইরে স্তূপের আকারে জমা হয়। বদবু এমনই যে বাজার থেকে বেরোনোর সময় নাকে রুমাল চাপা দিয়ে বেরোতে হয়।
একদিন বাধ্য হয়েই তাকে সেই মূত্রাগারে যেতে হয়েছিল। পেচ্ছাপ পাওয়ায় নাকে রুমাল চাপা দিয়ে, শ্বাস বন্ধ করে সেই পূতিগন্ধময় ঘরে প্রবেশ করতে হল। মেঝেতে ময়লার আস্তরণের মধ্যে বুদ্বুদ ফাটছে। দেওয়ালে যৌনাঙ্গের ভয়ঙ্কর সব ছবি আঁকা আছে। সামনের দেওয়ালে কেউ কাঠকয়লা দিয়ে এই শব্দগুলো লিখে রেখেছে:
‘মুসলমান বোনেদের পাকিস্তান গুঁজে দিয়েছি’
সে শব্দগুলো যেন বদগন্ধের প্রাবল্য আরও বাড়িয়ে তুলল। সে তাড়াতাড়ি বাইরে বেরিয়ে এল। জিন্না হল আর কংগ্রেস হাউস্ উভয়ের ওপরেই সরকারি নিয়ন্ত্রণ জারি আছে। কিন্তু অল্প দূরত্বে যে মুত্রিটি আছে সেটি সব নিয়ম-কানুনের ঊর্ধ্বে – তার কাজই যেন জঞ্জাল জমা করা আর দুর্গন্ধ ছড়ানো। মনে হল যেন আশপাশের মহল্লার যত আবর্জনা তা একটু বেশিই সেখানে জড় হচ্ছে।
আরেকবারও এমনি বাধ্য হয়েই তাকে সেই প্রস্রাবখানায় ঢুকতে হল। বোঝাই গেল যে মূত্রত্যাগের জন্য নাকে রুমাল দিয়ে নিঃশ্বাস চেপে সে আবারও সেই ঘরে ঢুকল। মেঝেতে পাতলা পায়খানার আস্তরণ জমে আছে। দেওয়ালে মানুষের সন্তান জন্ম দেওয়ার অঙ্গটির ছবির সংখ্যা যেন আরও বেড়েছে। ‘মুসলমান বোনেদের পাকিস্তান গুঁজে দিয়েছি’র ঠিক নিচে কেউ মোটা পেন্সিলে বড় বড় অক্ষরে লিখে দিয়েছে:
‘হিন্দু মায়েদের অখণ্ড হিন্দুস্তান ঢুকিয়ে দিয়েছি’
লেখাটি যেন মুত্রির বদবুকে আরও তেজি করে তুলেছে। সে একছুটে বেরিয়ে এল।
মহাত্মা গান্ধীকে নিঃশর্তে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। জিন্না পাঞ্জাবে পরাজিত হয়েছেন। জিন্না হল আর কংগ্রেস হাউসের হার-জিত কিছুই হল না। তারা এখনও সরকারি আদেশে বন্ধ আছে। আর একটু দূরেই যে মূত্রাগারটি আছে, সেখানে দুর্গন্ধের রাজত্ব চলেছে। প্রতিবেশের এলাকার আবর্জনা উঁচু ঢিবি হয়ে জমে আছে।
তৃতীয়বারের জন্যও তাকে পেচ্ছাপখানায় ঢুকতে হল। প্রস্রাব করার জন্য নয়। নাকে রুমাল দিয়ে, শ্বাসবন্ধ করে আবারও আবর্জনায় ভর্তি সেই কুঠুরিতে সে ঢুকল। মেঝেতে পোকামাকড় কিলবিল করছে। দেওয়ালে মানুষের লজ্জার অঙ্গগুলোর নকশা আঁকার জন্য আর কোনও জায়গাই খালি নেই। ‘মুসলমানোঁ কি বহিন কা পাকিস্তান মারা’ আর ‘হিন্দুয়োঁ কি মা কা অখণ্ড হিন্দুস্তান মারা’ লেখাগুলো ফিকে হয়ে এসেছে। কিন্তু তার নিচে সাদা চকে লেখা শব্দগুলো যেন জ্বলজ্বল করছে:
‘হিন্দু-মুসলমান উভয়ের মাকে হিন্দুস্তান গুঁজে দিয়েছি’
কথাগুলো যেন এক মুহূর্তে সেই প্রস্রাবাগারের সব দুর্গন্ধ তাড়িয়ে দিল। আস্তে আস্তে বাইরে বেরোতেই তার মনে হল পূতিগন্ধময় সেই ঘরে এক অজানা সুগন্ধ ছড়িয়েছে। শুধু এক লহমার জন্য।