মনে অনেক দ্বিধা নিয়ে, বেশ কয়েকদিন ইতস্তত করার পরে আপনাকে এই চিঠি লিখতে বসেছি। হাতে লেখা চিঠি একান্তই ব্যক্তিগত আদান-প্রদানের মাধ্যম। নিবিড় প্রেম নিবেদন অথবা চরম সুখ-দুঃখের আবেগ এতে প্রকাশ করা চলে। চিঠির আরেকটি সুবিধে হল প্রেরক আর প্রাপক পরস্পরের পরিচিত না হলেই বা অসুবিধে কোথায়? চিঠির মাধ্যমেই প্রথম পরিচয় ঘটুক না।
ইত্যাকার চিন্তার শেষে আপনাকে চিঠি লেখার সাহস সঞ্চয় করলাম। চিঠি তো আপনাকেই লিখছি। অন্য কেউ নাই বা আপনাকে চিনলেন। আপনার সারা জীবনের সাধনার সঙ্গে আমি তো কিছুটা পরিচিত। আর এই চিঠি দৈবাৎ আপনার কাছে না পৌঁছোলে, অন্য কারও হাতে পড়লে, তিনিও তো আপনাকে চিনবেন। আর চিনে নিলে কী মজাটাই না হবে! সে অচেনা পাঠকও আপনার এই অন্ধ ভক্ত পত্রলেখকের মত শব্দের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকবেন, হয়ত আজীবন।
আপনি অভিধান প্রণয়ন শিল্পের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি-র মূল সংস্করণের চতুর্থ অর্থাৎ শেষ সম্পাদক জানতাম। আরও অভিভূত হয়েছি আপনার অবিনশ্বর কীর্তি ইংরেজি শব্দের ব্যুৎপত্তি নির্দেশক অসাধারণ কোষগ্রন্থ দি অক্সফোর্ড ডিকশনারি অব ইংলিশ এটিমোলজি (১৯৬৬) চেখে দেখে। প্রায় ৩৮,০০০ শব্দ সম্বলিত এই অভিধানে শব্দের উৎপত্তি আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার অভিযোজনের ফলে শব্দের গায়ে যে নতুনতর অর্থ সেঁটে বসে, তার কত অসংখ্য উদাহরণই না আপনার এই অসাধারণ প্রচেষ্টার ফলে আমরা জেনেছি। কিন্তু অভিধান পাঠের আনন্দ শুধু শব্দের ইতিহাস আবিষ্কারের মধ্যেই থেমে থাকেনি। সাহিত্য পাঠের সময় গল্প-কবিতায় কোনও বিশেষ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ প্রায়ই কী সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনার আভাস দেয়, তা আপনার এই অভিধানটি না ঘাঁটলে আমরা পেতাম কি? জানতাম কি যে ‘butler’ শব্দের আদি রূপের অর্থ করলে দাঁড়ায় ‘বোতল বাহক’? আর যদি না জানতাম, তাহলে এক ইংরেজ প্রভুর প্রাসাদের প্রধান ভৃত্যকে নিয়ে রচিত কাজুও ইশিগুরো-র অনবদ্য উপন্যাসে মনিবের মর্যাদা আর স্বীয় আত্মমর্যাদা রক্ষার্থে জীবনের সব সুখ বিসর্জন দেওয়ার ঘটনাটি অত নিদারুণভাবে মনের ভেতরে নাড়া দিত? হ্যাঁ, আমি The Remains of the Day উপন্যাসের নায়কের কথা বলছি। এক ‘বোতল বাহক’-এর মর্যাদা কতটুকুই বা?
অভিধানরচনা একটি বহু প্রাচীন বৃত্তি। আর অভিধান সংকলনের পক্ষে মনুষ্যজীবন বড়ই সংক্ষিপ্ত। তবু জীবনের শেষ দুটি দশক আপনি ইংরেজি শব্দের উৎস নির্দেশক উপরোক্ত গ্রন্থটি নির্মাণের কাজে নিয়োজিত থেকেছেন। আপনার মৃত্যুর আগেই পাণ্ডুলিপিটি মুদ্রণের জন্য চলে গিয়েছিল। সে অভিধানের সূচনায় প্রকাশকের পক্ষ থেকে আপনার অবদান সম্পর্কে যা লেখা হয়েছে, তা উদ্ধৃতিযোগ্য:
Dr. C. T. Onions, whose lifetime of learning this dictionary harvests, died while it was still going through the press. He was the last of the editors of the original Oxford English Dictionary and for many years the doyen unquestioned of English lexicography. The publishers would like to take this last opportunity of saluting the man to whom this etymological dictionary will be an enduring monument.বাস্তবিকই, এই অনবদ্য কোষগ্রন্থটি আপনার চিরস্থায়ী স্মৃতিফলক হিসেবে রয়ে গেল। অভিধান আমরা প্রধানত পড়ি না, দেখি। আপনার ওই অভিধানটি কিন্তু যে কোনও অনুসন্ধিৎসু ব্যক্তিকে অভিধানের পাঠক করে তুলবে।
শুনেছি গত শতাব্দের দ্বিতীয় দশকে অক্সফোর্ড এর মাগদালেন কলেজের গ্রন্থাগারে প্রচণ্ড ঠান্ডায় আপনাকে কম্বল মুড়ি দিয়ে অনেক কাগজ আর বইপত্র নিয়ে বসে থাকতে দেখা যেত। নিন্দুকেরা বলেন প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনোয় আপনি নাকি তেমন কৃতিত্ব দেখাননি। কিন্তু তাতে কীই বা আসে যায়। ১৮৯৫ থেকে অক্সফোর্ডের অভিধানকারদের দলে কাজ শুরু করে আপনি কুড়ি খণ্ডের সেই সুবিশাল অভিধানের চতুর্থ সম্পাদক হন। কিন্তু শব্দের খেলায় মেতে থেকে আরও কত কাজ যে করেছেন! ব্যাকরণের বই লিখেছেন, আবার অনবদ্য একটি শেক্সপিয়ার গ্লসারি তৈরি করেছেন। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে গ্রিসে গ্লস্সাই (glossai) রচিত হয়েছিল যাতে সেকালের লেখকদের রচনার উদ্ধৃতি থাকত। অর্থেরও বিবৃতি দেওয়া হত। এক্ষেত্রে আপনার উদ্দেশ্য ছিল উদাহরণ সহযোগে মহান নাট্যকারের রচনায় ব্যবহৃত শব্দের সেইসব অর্থ নির্দেশ করা যেগুলো এখন অচল অথবা অপ্রচলিত। একটা উদাহরণ দিই। দি উইনটার্স টেল নাটকের চতুর্থ অঙ্কের চতুর্থ দৃশ্যের ২৫৮ পঙ্ক্তিটি: ‘I love a ballad in print a-life’। এখানে ‘a-life’ শব্দবন্ধের অর্থ কী? আপনি জানিয়েছেন যে শেক্সপিয়ারের কতিপয় সম্পাদক এর অর্থ বুঝিয়েছেন ‘on my life’। কিন্তু আপনি দেখালেন এখানে ‘life’ আসলে ‘lief’ বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে যার প্রাচীন তাৎপর্য হল ‘dear, beloved’। অর্থাৎ বাক্যটির অর্থ হল ‘আমি লিখিত অথবা মুদ্রিত রূপে লোকগাথা পেতে খুব ভালোবাসি’। কী প্রাঞ্জল আপনার এই ব্যাখ্যা!
আরও জেনেছি যে প্রখ্যাত ব্রিটিশ লেখক ও ধর্মতত্ত্ববিদ সি. এস. ল্যুইস্ আপনার পাণ্ডিত্যের বড় অনুরাগী ছিলেন। অক্সফোর্ডের মাগদালেন কলেজে তিনি আপনার সহকর্মীও ছিলেন। ল্যুইস্ এর ডায়েরিতে আপনার বক্তৃতা শোনার সেই অভিজ্ঞতার কথা লেখা আছে। মধ্যযুগীয় ইংরেজি সাহিত্য সম্পর্কে সেই বক্তৃতা শুনে লেখক তাঁর ভাইকে চিঠিতে লিখছেন: ‘সকাল দশটায় স্কুলে গিয়েছিলাম মধ্যযুগীয় ইংরেজি বিষয়ে আনিয়ান্স সাহেবের বক্তৃতা শুনতে.....কী অসাধারণ বক্তৃতাই না তিনি দিলেন! সবচেয়ে সুন্দর তাঁর উদ্ধৃতিগুলি যা তিনি অননুকরণীয় ভঙ্গিমায় আবৃত্তি করেন। একবার প্রায় একটা গোটা কবিতার স্বাদগ্রহণ করতে করতে আবৃত্তি করলেন। তারপরে বললেন, “আমি কিন্তু ঠিক এটা বলতে চাইনি।” উনি আমার হৃদয়ের খুব কাছের মানুষ।’
আনিয়ন্স সাহেব, আপনার মত এক জীবনে বহু জীবনের কাজ করেছেন এমন অভিধানকার আমার নিজের ভাষায় ছিলেন। বস্তুত এই চিঠিটি আমি যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস, রাজশেখর বসু, কাজী আব্দুল ওদুদ, সুবলচন্দ্র মিত্রের মত বাঙালির নামেও পাঠাতে পারতাম। শব্দ সংকলন নীতি বিভিন্ন হলেও, এঁরা সকলেই বাংলা ভাষার শব্দবৈচিত্র্যকে কোষগ্রন্থে ধরে রাখার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। হরিচরণবাবু তো একেবারেই আপনার সমগোত্রীয়। ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’-এ তিনি যেভাবে শব্দের ব্যুৎপত্তি নির্দেশ করেছেন, তা অসাধারণ। বাংলা অভিধানে এমন বিশদ ব্যুৎপত্তি নির্দেশ বিরল। তিনিও আপনার মতই অনুভব করেছিলেন যে ব্যুৎপত্তির ব্যাখ্যা থেকেই শব্দের অর্থবোধ হতে পারবে।
আমি স্বপ্নে আপনাদের মত প্রগাঢ় পাণ্ডিত্যে সমুজ্জ্বল দুই মনীষীকে এক টেবিলে মুখোমুখি আলোচনায় বসাই। হরিচরণবাবু দেখাবেন ‘খাট পালঙ্গ’ এর ‘পালঙ্গ’ বা ‘পালঙ্ক’ শব্দটির মূল রূপ সংস্কৃত ‘পর্য্যঙ্ক”। চারপেয়ে খাটের দুটি দিক আর ছাদটা ঢেকে দিলেই হয় ‘পালকি’। কিন্তু ‘পালকি’ শব্দটি যে পর্তুগিজ ‘palanquim’ থেকে এসেছে। আপনিও দেখিয়েছেন ইংরেজি ‘palanquin’ শব্দটির আদিরূপ পর্তুগিজ ‘palanquim’ এবং ফরাসি ‘palanquin.’ শব্দের ইতিহাসের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকে না জানি কত অজানা গল্প!
আমরা যাঁরা আপনার মত শব্দশাস্ত্রবিশারদের গুণগ্রাহী, তাদের একটাই আশঙ্কা। শিক্ষিত বাঙালির প্রয়োজন মেটাতে, সুভাষ ভট্টাচার্য যাকে বলছেন একটি ‘সার্থক বাংলা অভিধান’, তা কি আমাদের ভাগ্যে জুটবে না? কেমন সেই অভিধান? সুভাষবাবু বলছেন: ‘বাঙালি যে ভাষায় কথা বলে তার মার্জিত শিষ্ট রূপ এবং বাঙালি যে-ভাষায় লেখে তার রূপটি বিবৃত থাকবে অভিধানে প্রত্যাশা এই পর্যন্তই।’ বাঙালি পাঠক কিন্তু তেমন একটি আধুনিক অভিধানের জন্য বহু বছর অপেক্ষা করে আছেন।
গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের ‘আমাদের বাংলা ভাষায় কোনও অভিধান নেই, তোমাকে একটা অভিধান লিখতে হবে’ এই নির্দেশ শিরোধার্য মেনে দিনরাত এক করে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রবল উৎসাহে শুরু করেছিলেন শব্দ আর তার অর্থের অনুসন্ধান। তাঁর মত কঠোর দারিদ্রের মধ্যে জীবনব্যাপী প্রচেষ্টায় অভিধান প্রণয়ন করে, শেষ বয়সে নিজের সামান্য সঞ্চয় ব্যয় করে সেই অভিধান ছাপানোর কথা ভাবতে পারেন, এমন আত্মনিবেদিত যোগীপুরুষের উদয় না হলে বাংলা অভিধানের ভবিষ্যৎ কি অন্ধকার? বঙ্গীয় শব্দকোষ-এর একটি পরিবর্ধিত, পরিমার্জিত রূপ কি আমরা দেখতে পাব না? বাংলায় শব্দের ব্যুৎপত্তি নির্দেশক একটি অনন্য অভিধান অথবা একটি পূর্ণাঙ্গ বাংলা অভিধান প্রণয়ন কি অসম্ভব? এই অসম্ভবকে সম্ভব করতে যাঁরা আগ্রহী, আপনি হয়ত তাঁদের দিকনির্দেশ করতে পারবেন। তখন হয়ত কেউবা এমন সেই অভিধান প্রণয়ন করবেন যা শব্দের প্রাণের গভীর গোপনে লুকিয়ে থাকা অর্থের নির্দেশ দিতে পারবেন:
‘For words, like Nature, half reveal
And half conceal, the Soul within.’(In Memoriam: Alfred Lord Tennyson)
আমার সশ্রদ্ধ নমস্কার জানবেন।
তথ্যসূত্র:
১)The Oxford Dictionary of English Etymology; Ed. C. T. Onions; OUP, 1996
২)All My Road Before Me: The Diary of C. S. Lewis 1922-27; Harvest Books, 2002
৩) অভিধান সংকলকের ভাবনাচিন্তা; সুভাষ ভট্টাচার্য; পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, জুন ১৯৯৯