• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৬ | এপ্রিল ২০২২ | কবিতা
    Share
  • জিপসি ব্যালাড থেকে দুটি কবিতা : ফেডেরিকো গার্সিয়া লোরকা
    translated from English to Bengali by স্বপন ভট্টাচার্য



    জিপসি ব্যালাড (Primer romancero gitano) ১৯২১ থেকে ১৯২৮-এর মধ্যে লিখিত। লোরকা বলেছেন জিপসি ব্যালাড একান্তভাবেই আন্দালুসীয়। জিপসিদের তিনি বলেছেন দেশের সবচেয়ে বড় ‘অ্যারিস্টোক্র্যাট’ এবং আন্দালুসীয় সত্যের বর্ণমালা, রক্ত এবং অস্থিমজ্জা তারা। তথাকথিত আধুনিকতার সঙ্গে জিপসি জীবনের সংঘাত, তাদের জীবনচর্যায় ‘আদিমতার (primitivism) মধ্যে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা, প্রাণিত করেছে লোরকাকে। আঠারোটির মধ্যে জিপসি ব্যালাডের তেরোটি কবিতাই মৃত্যু বা বিয়োগে শেষ হয়েছে, কিন্তু তার মধ্যেও আন্দালুসীয় যৌনতার অকপট ভাষ্য রচনা করেছেন তিনি। যেমন,
    ¡Ay mis camisas de hilo!/ ¡Ay mis muslos de amapola- -লিনেনের বুনন আমার এ প্রিয় অন্তর্বাস/
    উরুতে প্রস্ফুটিত আমার গোপন পপিফুল (‘কৃষ্ণবর্ণ মৃত্যুর গান’)।

    স্বপ্নচারিতের সঙ্গীত আগস্ট ১৯২৪-এর রচনা। লোরকার নিজের মতেই ব্যালাডের সবচেয়ে রহস্যময় কবিতা। ‘যদি আমাকে জিগ্যেস কর কেন আমি লিখেছি Mil panderós de cristal/herian la madrugada ( স্ফটিকের একতারা হাজার হাজার / আঁধারে আহত হল ভোরের আকাশ), আমি বলব, এঞ্জেলদের হাতে আর গাছেদের হাতে আমি তা দেখেছি, কিন্তু এর বেশি আর কিছুই বলতে পারবো না আমি; অবশ্যই আমি এর অর্থ ব্যাখ্যায় বসবো না। এবং সেটাই তো হওয়া উচিত। কবিতা তাই, যা দিয়ে মানুষ দ্রুত সেই ক্ষুরধার অভিমুখে পৌঁছে যেতে পারে যেখান থেকে দার্শনিক আর গণিতজ্ঞ নীরবে পশ্চাদপসরণ করে যান।‘

    আন্দালুসীয় গীতিকবিতা সবুজ বন্দনার কবিতা। শুধু যৌবনের নয়, যৌনতার প্রতীকরূপেও তার সাবলীল সঞ্চরণ। লোরকার ব্যবহৃত পঙ্‌ক্তিযুগল Verde que te quiero verde/ Verde vineto.Verde ramas (হরিৎ তোমাকে ভালবাসি এতটাই / হরিৎ বাতাস। হরিৎ বৃক্ষশাখা।) সারা পৃথিবীর কবিতাপ্রেমী মানুষকে আন্দোলিত করে চলেছে এতদিন পরেও। ইংরাজি অনুবাদটি সম্ভবত অনেকেরই পরিচিত- Green oh how I love you green/ Green wind. Green boughs (অনুবাদ Will Kirkland)। লোরকার চাওয়া সবুজ, তিনি নিজেই বলেছেন, ‘কাঙ্ক্ষিত সবুজ, হয়ত যে সবুজের স্বপ্ন দেখি অথচ যে সবুজ হয়ে উঠতে পারে নি আজও।‘

    কৃষ্ণবর্ণ মৃত্যুর গান সম্ভবত লোরকার অনেকগুলো বিখ্যাত কাজের প্রারম্ভসংকেত। একাকিনী জিপসী রমণী সোলেদাদ মন্তোইয়া (আক্ষরিকভাবেই যার নামের অর্থ দাঁড়ায় ‘একাকিনী মন্তোইয়া’) লোরকার পরবর্তীকালের একাকিনী নারীচরিত্রগুলির পূর্বসূরী সব অর্থেই। মারিয়ানা পিনেদা’র নামচরিত্র, ব্লাড ওয়েডিং-এর ডনা রসিটা, ইয়েরমা হোক বা মার্তিরিও-- সবার শিকড় রয়ে গেছে এই সোলেদাদ মন্তোইয়াতে††

    † Modernism and Mourning ( 2007). Patricia Rae(ed) Lewisburg Bucknell University Press p.143
    ††তদেব





    স্বপ্নচারিতের সঙ্গীত
    গ্লোরিয়া জিনার এবং ফার্নান্দো ডি লস রিওসের প্রতি

    হরিৎ তোমাকে ভালোবাসি এতোটাই।
    হরিৎ বাতাস। হরিৎ বৃক্ষশাখা।
    সমুদ্রে ভাসমান হরিৎ জাহাজ,
    পাহাড় ডিঙিয়ে এক ঘোড়া ছুটে চলে।
    কটিদেশে ছায়া বোনা যার
    ছাদের আলসে ধরে স্বপ্নচারিত মেয়ে
    ত্বক হরিৎ, হরিৎ তাহার কেশদাম
    চোখে তার রূপোলি বিষাদ।
    হরিৎ তোমাকে ভালবাসি এতোটাই।
    জিপসি চাঁদের আলো
    তাকে দেখেছে সবাই
    কাউকে সে দেখে না কোথাও।

    *

    হরিৎ তোমাকে ভালবাসি এতোটাই।
    তুষারচাদরে মোড়া তারাদের দল
    ছায়ামাছেদের নিয়ে নেমে এল জলে
    ভোরের প্রথম আলো পাছে পথ ভুল করে ফেলে।
    বাতাসও হয়েছে ভারি, বেআবরু ডুমুরের ডাল
    পাহাড় শ্বাপদ বুনো,
    অ্যাগেভ পাতার মদ নষ্ট হয়ে যায়।
    কার আসবার কথা? কোথা থেকে আজ?
    ছাদের আলসে ধরে স্বপ্নচারিত মেয়ে
    হরিৎ হরিৎ ত্বক, হরিৎ কেশদাম
    সমুদ্রের স্বপ্ন তার চোখে, যদিও তা তিক্ত কষায়।

    *
    “কমরেড, এই তেজি ঘোড়াটা রাখুন
    বিনিময়ে আপনার ঘর,
    আয়নার বিনিময়ে এ ঘোড়ার সাজ
    লেপটার বিনিময়ে আমার ছুরিটা।
    কমরেড শুনুন, কাবরা গিরিখাত থেকে
    আমি আপনার দরজায়, রক্ত ঝরছে, তাও।”
    “হে যুবক শোনো, আমি যদি পারতাম
    তোমারই শর্ত মেনে তোমাকে এ ঘরে বসাতাম।
    কিন্তু যুবক, আমি সেই আমি নই আর, তদুপরি
    ভুলে গেছি কোনদিন এই গৃহ, এ ছিল আমার।”
    “কমরেড, তবে এখানেই মরে যেতে যাই
    মৃত্যু শোভন যদি হয় তবে হোক ইস্পাতশয্যায়
    পেতে দিন নরম লিনেন।
    গলা থেকে বুক ফালাফালা আলম্ব ক্ষত
    দেখুন কমরেড, আমি কে, এসেছি কোথায়?”
    “তোমার শাদা জামায়
    তিনশত পিঙ্গল গোলাপ ফুটেছে।
    রক্তে ভিজে উঠছে ক্ষতস্থান।
    কিন্তু আমি সেই আমি নই আর, তদুপরি
    ভুলে গেছি কোনদিন এই গৃহ, এ ছিল আমার।”
    “অনুমতি দিন তবে অন্দরে যাই,
    ছাদের আলসেটিতে আরো একবার।
    শুধু একবার কমরেড, শুধু একবার
    হরিৎ ছাদের বেড়ি আরো একবার!
    চাঁদের সীমানা জুড়ে বেড়ি অতুলন
    যেখানে নিয়ত ঢেউয়ের গর্জন শোনা যায়।”

    *
    দুই সহচর হাতে হাত
    অলিন্দে সিঁড়ি বেয়ে ওঠে
    পায়ে পায়ে লোহিত ক্ষরণ
    নোনা জল দু’চোখ প্লাবিত করে বয়।
    মামুলি টিনের লণ্ঠন থেকে
    ভয়ার্ত আলো থরথর, টালির ওপর।
    স্ফটিকের একতারা হাজার হাজার
    আঁধারে আহত হল ভোরের আকাশ।

    *
    হরিৎ তোমাকে ভালবাসি এতোটাই।
    হরিৎ বাতাস, হরিৎ গাছ।
    দুই কমরেড আগুয়ান।
    জিভে স্বাদ রেখে গেল হাওয়া
    বাসিল, পিত্ত আর পুদিনার।
    “কমরেড! সে কোথায়?
    তিক্ত কষায় মেয়ে, বলুন কোথায়?”
    “তোমার ফেরার পথ চেয়ে
    আশাপ্রোজ্জ্বল মুখ, কালো দীঘলচুল মেয়ে
    তাকে প্রতীক্ষায় রেখেছিল আলসের হরিৎ চাতাল।”

    *
    বৃষ্টির জল ভরা কূপকন্দরে
    জিপসি কন্যার দেহ দোল খায়, দোলে।
    ত্বক হরিৎ তার, হরিৎ কেশদাম
    চোখে তার রুপোলী বিষাদ।
    জ্যোৎস্না বুনেছে এক তুষারকণিকা
    ভাসিয়ে রেখেছে তাকে জলে।
    গুটিয়ে আসছে রাত,
    যেন বেলাশেষ গ্রামের চাতাল।
    নগররক্ষীর দল বেসামাল, মত্ত
    দরজার গায়ে ধাক্কা দিচ্ছে অবিরত।
    হরিৎ তোমাকে ভালবাসি এতোটাই।
    হরিৎ বাতাস, হরিৎ গাছ।
    সমুদ্রে ভেসে চলা জাহাজ,
    পাহাড় ডিঙিয়ে এক ঘোড়া ছুটে চলে।

    Romance sonámbulo Sleepwalking Ballad
    (A Gloria Giner y a Fernando de los Rios) (To Gloria Giner and Fernando de los Rios)



    কৃষ্ণবর্ণ মৃত্যুর গান

    হোসে নাভারো পার্দো কে

    মোরগের সরু ঠোঁট
    খুঁটে বার করে আনে ভোর,
    যখন কুমারী মেয়ে মন্তোইয়া সোলেদাদ
    ছায়া পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামে
    পীতাভ তামার ত্বক,
    শরীরের ঘ্রাণ অশ্ব বা নিছক ছায়ার
    স্তন দুটি তার লোহারের পাটাতন
    বিরহের গোল গোল সুর লাগে তাতে।

    “কি চাও কুমারী মেয়ে
    একা একা এই অবেলায়?”
    “আমি চাই তাই, যেটা আমি চাই
    তোমার কী আসে যায় তাতে?
    এসেছি যা পাবো বলে সেটুকুই চাই
    সে আমার সুখ, স্বয়ং আমার আমি প্রণয়ী এখন।”
    “হে কুমারী মেয়ে, তুমি জানো না কি
    আমার সমস্ত ব্যথা আকাশ ছিন্ন করে
    বজ্রঘোটক হয়ে সমুদ্রে নেমে এলে
    ঢেউগুলি গিলে নেয় তাকে?”
    “সাগরের কথা আর বোলো না আমাকে
    জলপাই বাগিচার মাটি ফুঁড়ে
    ঝরে পড়া পাতাদের নীচে
    কৃষ্ণবর্ণ ব্যথা বীজ থেকে মহীরুহ হবে।”
    “তোমার কী শোক বল মেয়ে
    কোন বেদনার হাহাকার?
    কেন তোমার চোখ পিপাসাকাতর
    যেন কষায় লেবুর রস ঠোঁটে নেমে আসে।”
    “নিদারুণ ব্যাথার দহন! আমাকে ছুটিয়ে মারে
    ঘরময় পাগলিনী প্রায়।
    টেনে টেনে ঘুরে মরি পোষাক ঝালর
    শয়নকক্ষ থেকে রসুইয়ের ঘরে।
    কোন ব্যথা জেনে নিতে চাও! কালো রং তার
    পোষাক বদলে যায় ত্বকে।
    আহ! আমার এ লিনেন অন্তর্বাস
    আহ! উরুতে প্রস্ফুটিত আমার গোপন পপিফুল।”
    সোলেদাদ, ঘরে যাও রাতচরা পাখিদের জলে
    স্নান কর, শরীর ভেজাও আর
    কিছুটা জিরিয়ে নিক হৃদয় তোমার
    ঘরে যাও তুমি, মন্তোইয়া সোলেদাদ।

    *
    নদী বহে যায়
    নদী গান গায় আকাশের, গাছের পাতার।
    স্কোয়াশের ফুলে বোনা মুকুটের সাজে
    নূতন আলোয় সাজে নূতন সকাল।
    ও জিপসি ব্যথা!
    ব্যথা অমলিন এবং সতত একা
    ব্যথা অন্তঃসলিলা
    ব্যথা দূরের আঁধার ছেঁড়া ভোর।

    Romance de la pena negra (Ballad of Black Pain)
    A José Navarro Pardo (To José Navarro Pardo)

  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments