• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৬ | এপ্রিল ২০২২ | গল্প
    Share
  • অন্য মা : গান্ধর্বিকা ভট্টাচার্য



    ক'দিন হল টিপু লক্ষ্য করেছে, যে তার মা একদম পাল্টে গেছে। মানে, সেভাবে পাল্টে গিয়ে একেবারে অন্য কেউ তার মা হয়ে চলে আসেনি। যে মা ছিল সেই আছে। কিন্তু মা-মা ব্যাপারটা যেন আর নেই।

    কথাটা খোলসা করে বলতে গেলে, টিপুর মা ছিল চূড়ান্ত বদরাগি। কথায় কথায় টিপুকে বকা লাগাত, মাঝেমধ্যেই এক আধটা চড় কষিয়ে দিত, আর হোমওয়ার্ক না করলে সে কী ধ্যাতানি...পাশের বাড়ির চিনি-কাকিমা পর্যন্ত একদিন শুনতে পেয়েছিল। বাবা অফিস থেকে ফিরলেই শুরু হয়ে যেত নালিশের বন্যা –

    “তোমার ছেলে অত্যন্ত বেয়াদব হয়েছে, আমার একটা কথাও শোনে না, আমি আর ওকে সামলাতে পারছি না,” ইত্যাদি ইত্যাদি। কথার কিছু বৈচিত্র্য থাকলেও ভাবটা মোটামুটি এরকমই থাকত। আর বাড়িতে আত্মীয়স্বজন এলে তো কথাই নেই। টিপুর মানসম্মানের কিমা বানানোই মায়ের একমাত্র কাজ ছিল।

    এহেন জাঁদরেল মা যদি হঠাৎ চুপসে গিয়ে মিনমিন করতে থাকে, টিপুকে বকা তো দূরের কথা শাসন পর্যন্ত না করে, তবে কেমন লাগে ব্যাপারটা? সারাদিন হাওয়া বেরিয়ে যাওয়া বেলুনের মতো মা ঘুরে বেড়ায়, মাঝে মাঝে একটু হাসে – যেন কতই না কষ্ট হচ্ছে। আর টিপুর সঙ্গে কী ভালো ব্যবহার! উফফ অসহ্য।

    হয়তো বাবা নেই বলেই মায়ের নালিশটা আজকাল তেমন জমছে না। টিপুর বাবার খুব অসুখ করেছিল। ডাক্তারকাকু বলল কোভিড হয়েছে, হসপিটালে ভর্তি হতে হবে। সেই যে বাবা গেল আজ অবধি ফিরল না। উলটে দাদু-দিদা এসে টিপুদের বাড়িতে থাকতে লাগল।

    কর্নফ্লেকসের বাটিতে চামচ ঘোরাতে ঘোরাতে টিপু এইসব কথাই ভাবছিল। মাও হয়তো কিছু ভাবছিল কারণ মায়ের হাতের পাঁউরুটি হাতেই রয়ে গেছিল।

    এর মধ্যে যে কিছু একটা ঘোরতর ব্যাপার ঘটে গেছে সেটা টিপু আন্দাজ করতে পারছিল। বাড়িতে লোকজনের যাতায়াত লেগেই আছে। একদিন টিপুকে ন্যাড়া করে কিসব পুজো করানো হল। বাবা আর ফিরবে না সেটাও বোঝানো হল। সেটা অবশ্য নতুন কিছু না। কিছুদিন আগে অবধিও বাবা রায়পুরে থাকত আর টিপু কোলকাতায় থাকত মায়ের সঙ্গে। টিপু ধরে নিয়েছে এখনো সেরকমই কিছু একটা হয়েছে।

    মাসিদিদা কিছুক্ষণ মাকে জড়িয়ে ধরে থেকে তারপর টিপুর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “এইটুকুনি বয়েসে বেচারার মাথার ওপর থেকে ছাদ সরে গেল!” টিপু পরিষ্কার জানত তার মাথার ওপর ছাদ, পাখা সবই আছে। তাহলে মাসিদিদা মিথ্যে কথা বলল কেন? আজও টিপুর কাছে এটা একটা রহস্য।

    টিপুর স্কুল ছাড়িয়ে অন্য স্কুলে দেওয়া হবে কি না, মা কী করে সংসার চালাবে এসব নিয়েও অনেক কথা হয়েছিল। অটিস্টিক কথাটা টিপু কয়েকবার শুনেছে, কিন্তু মানে বুঝতে পারেনি। টিপুকে ওরা এসব সময়ে ঘরে ঢুকতে দিত না, কিন্তু সে দরজার বাইরে থেকে সবকথাই শুনেছে। আর মাকে কাঁদতে দেখেছে। যত দেখেছে তত তার সন্দেহ বেড়েছে। ও আবার মা নাকি, মা তো সবাইকে বকা দেয়। টিপু তো বটেই, এমনকি বাবা, মানু-মাসি কেউ মায়ের বকার হাত থেকে রেহাই পায়নি। তবে আজকাল মা এরকম করে কেন?

    সব থেকে অদ্ভুত ঘটনাটা ঘটল দু'দিন আগে।

    মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেছিল টিপুর। চোখ খুলে দেখে পাশে মা নেই। টিপু ভয়ে ভয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েছিল। এত রাতে মা কোথায় গেল? বাথরুমের দরজাও তো খোলা।

    এঘর-ওঘর খুঁজতে খুঁজতে দেখে বাইরের ঘরের সোফায় মা বসে আছে। আলোও জ্বালায়নি। যে মা ভূতের এমন ভয় পেত, সিঁড়ির ল্যান্ডিংএর আলো না জ্বালিয়ে বাথরুমে পর্যন্ত যেতে পারত না, সেই মা নিজেই ভূতের মতো অন্ধকারে একা একা বসে আছে? নাঃ, ও কিছুতেই টিপুর মা নয়। কোথাও একটা গণ্ডগোল হয়েছে। টিপুর মা নির্ঘাত পালটে গেছে।

    কিন্তু পালটে গেলে কি দাদু-দিদা কিছু বলত না? না-ই বলতে পারে, যদি দাদু-দিদাও ষড়যন্ত্রের মধ্যে থাকে। কিন্তু মা যদি নকল হয়, সে কথা টিপু বলবে কাকে? বাবাও তো বাড়ি নেই।

    বাটির দুধ ঠান্ডা হয়ে গেছে কিন্তু টিপুর সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। সিলিংএর দিকে তাকিয়ে মুখটা একটু হাঁ করে সে দিন গুনছে। তিরিশ দিন। তি-রি-শ দি-ন হল বাবা বাড়ি আসেনি। টিপুর ন্যাড়া মাথায় আবার চুল গজিয়েছে। ক্লাসে আর কেউ তাকে ন্যাড়া বলে খ্যাপায় না, মাথায় চাঁটি মেরে পালিয়ে যায় না। সেটা অবশ্য ভালোই হয়েছে। কার আর রোজ রোজ মাথায় চাঁটি খেতে ভালো লাগে?

    সেদিন মাকে সোফায় বসে থাকতে দেখে টিপু একটা ফন্দি এঁটেছিল। সে পরীক্ষা করে দেখবে যে মা আসল না নকল। পরের দিন সকাল হতেই মায়ের একটা ভালো শাড়ি কাঁচি দিয়ে কাটতে শুরু করে দিয়েছিল। আগেও একবার ছবি বানানোর জন্য সে মায়ের একটা জামা কেটেছিল, এবং সাংঘাতিক মার খেয়েছিল। মা যদি সত্যি হয় তাহলে জামাকাপড় কাটা কিছুতেই সহ্য করবে না।

    পরীক্ষা খানিকটা সফল হয়েছিল। টিপুকে শাড়ি কাটতে দেখে মা দেখে হাঁ-হাঁ করে উঠেছিল।

    “আরে কী করছিস আমার দামি শাড়িটা নষ্ট করলি, দাঁড়া তোর হচ্ছে!”

    ছুটে এসে টিপুকে এক চড় কষিয়েই দিচ্ছিল এমন সময়ে দিদা এসে থামিয়ে দিল।

    “আহা বেচারাকে মারিস না। ওরও তো এতবড় একটা কষ্ট যাচ্ছে, ভালো করে বুঝিয়ে বল না, ও সব বুঝবে।”

    ব্যাস, দিদার কথা শুনে আবার মা ম্যাদা মেরে গেল। চোখ মুছে পাশের ঘরে চলে গেল। তারপর সন্ধে বেলা টিপুকে আদর করে কোলে বসিয়ে বলল একজন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। সেই ডাক্তার ইঞ্জেকশন দেবে না, শুধু টিপুকে কিছু কথা জিজ্ঞেস করবে। টিপুকে সব কথার ঠিকমতো উত্তর দিতে হবে।

    “কবে যাব ডাক্তারের কাছে?”

    “এই শুক্রবার।”

    টিপু আর মায়ের সঙ্গে কথা বাড়ায়নি। বাড়ালেও তার কথা গ্রাহ্য হবে এমন ভরসা তার ছিল না। তবে মনে মনে সে পুরো ব্যাপারটা এতদিনে আন্দাজ করতে পেরেছিল। নকল মা নিশ্চয়ই ঠিক করেছে টিপুকে ছেলেধরার কাছে বিক্রি করে দেবে। ইঞ্জেকশন দেয় না, শুধু কথা বলে, এরকম আবার ডাক্তার হয় নাকি? সকালে মায়ের শাড়িটা কেটে বোধহয় সে বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। আর তাকে বাড়িতে রাখা হবে না। সেটা ভাবলে টিপুর গলার কাছটা টনটন করে ওঠে।

    হঠাৎ চমকে উঠে টিপু দেখল টেবিলের ওপার থেকে মায়ের হাতটা তার দিকে এগিয়ে আসছে, তার মাথাকেই লক্ষ্য করে। তার মানে কি সে এবার কানমলা খাবে? মা কি আবার আগের মতো চেঁচাবে, বকাবকি করবে? আবার সব আগের মতো হয়ে যাবে? আশায় টিপুর মনটা নেচে উঠল – ওই তো, ওই তো হাতটা এগোচ্ছে...কিন্তু না, প্রত্যাশিত কানমলাটা এল না। মা হালকা করে টিপুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।

    “খাবারটা খেয়ে নাও বাবু, ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তো।”

    আবার সেই মোলায়েম, করুণ গলা! রাগে টিপুর গা রি রি করতে থাকে। মায়ের হয়েছে টা কী?

    “আমি এটা খাব না।”

    টিপু একটু সাহস করেই বলে ফেলল। একবার মনে হল মায়ের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠছে, কিন্তু না, আবার মুখটা কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল।

    “অন্য কিছু বানিয়ে দেব?”

    টিপু আর উত্তর দিল না। খাবার টেবিল থেকে উঠে গিয়ে বিছানায় বসে কাঁদতে থাকল। সব বাদে বাবার ওপর গিয়ে তার রাগটা পড়ল। হ্যাঁ, বাবাই তো নাটের গুরু। হসপিটালে গিয়ে আর ফিরল না তাই তো মা এমন হয়ে গেছে। তাই তো মা টিপুকে ছেলেধরার হাতে বিক্রি করে দিচ্ছে!

    দুমদুম করে গিয়ে নীচু টেবিলের ওপর থেকে টিপু আ্যলবামটা নিয়ে এল। ওতেই মা-বাবার বিয়ের ছবিগুলো আছে। টিপু জানে, কারণ মা কাল রাতেই ছবিগুলো দেখছিল। ব্যাস, তারপরেই তার হাতে উঠে এল বিশ্বস্ত সেই কাঁচি।

    মন দিয়ে ছবিগুলো কাটতে কাটতে হঠাৎ যেন টিপু চোখে সর্ষে ফুল দেখল। সঙ্গে সঙ্গে কাঁধের কাছটা জ্বালা করে উঠল। পেছনে তাকিয়ে দেখে মা যেন কখন এসে দাঁড়িয়েছে। চোখদুটো ভাঁটার মতো জ্বলছে, আর হাতটা পড়ছে টিপুর পিঠের ওপর।

    “বদমাইশ ছেলে, আমি যত ভাবছি কিছু বলব না তুই তত বেড়ে উঠছিস? দাঁড়া, আজ আমার একদিন কি তোর একদিন!”

    আওয়াজ শুনে দিদা পাশের ঘর থেকে ছুটে আসে।

    “আরে কী করছিস? মারছিস কেন ছেলেটাকে?”

    কিন্তু মা আজ কথা শোনার পাত্রী নয়।

    “তুমি আর ওকে সাপোর্ট করবে না মা! ওই বাঁদর ছেলেকে আমি শায়েস্তা করেই ছাড়ব। তোমার গুণধর নাতির কাণ্ড দেখবে? আমাদের বিয়ের ছবিগুলো কুচিকুচি করে কেটেছে! আমি এখন ওগুলোর কপি কোথায় পাব?”

    বলতে বলতেই টিপুর পিঠে আরো কয়েক ঘা এসে পড়ে।

    “আরে ছাড়, ছাড়, ওকে মারিস না! আমি দেখছি তোর বাবার ল্যাপটপে আরো কপি আছে কি না!”

    “কী হল এত চেঁচামেচি কেন করছ?”

    দাদু লুঙ্গির কশি বাঁধতে বাঁধতে ছুটে এসেছে। দিদা মায়ের হাত চেপে ধরেছে। মানু-মাসি অবধি ঘর মোছা স্থগিত রেখে দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু টিপুর কোন দিকে খেয়াল নেই। সে শুধু হাততালি দিচ্ছে আর হো হো করে হাসছে।

    খুব আনন্দ, ভীষণ আনন্দ তার। আজ কতদিন পরে সে তার মাকে, তার নিজের সত্যিকারের মাকে আবার খুঁজে পেয়েছে!



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments