অনেকেই ভেবে নিয়েছে ভদ্রেশ্বরের মাথা এ জীবনে আর ঠিক হবে না। কিন্তু ডাক্তার বলেন অন্যকথা--এংজাইটি। বউ বাসমতী বলে, এংজাইটি না ছাই! উন্মাদ! চরিত্র খারাপ! সে যে যাই বলুক, ভদ্রেশ্বরের এতে আর কিছু যায় আসে না। সকাল হতে না হতে সাজঘরের ঢাউস বাক্সটা টানতে টানতে উঠোনে নামায়। তারপর ভেতর থেকে একে একে বার করে পরচুলা, চুমকি বসানো সালোয়ার, পালোয়ানের পাগড়ি, সেপাইএর চাপকান, রাজার মুকুট, ঘাগরা, সেনাপতির ছোগাকোট আরও অনেককিছু। এগুলো রৌদ্রে বিছিয়ে ঝোপমেরে বসে থাকে ভদ্রেশ্বর। বেলা বাড়ার সাথে সাথে বউএর বকরবকরও সে পরিমাণ বাড়তে থাকে। ভদ্রেশ্বরদের উঠোন লাগোয়া রাস্তা। এখন রাস্তা দিয়ে নানান ধাঁচের মানুষ হেঁটে যায়। ভদ্রেশ্বর সবাইকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরখ করে। নাহ! কেউ তার পালার সঞ্জয় কুমারের মতো বীর্যবান নয়। কেউ তার নায়িকা সনকার মতো সুন্দরী নয়। ভদ্রেশ্বর দেখে আর ভ্রু কোঁচকায়। কেননা এ পথ দিয়ে যারা যায়, কারও হাতে হয়ত রেশনের মাল তোলবার থলে। চোখের জায়গায় চোখ নেই, নাকের জায়গায় নাক নেই! কেমন যেন! আর যাদের এসব আছে, তারা হেঁটে যাচ্ছে মোবাইলের আলো টিপটে টিপতে। জুড়ি নেই গাড়ি নেই হাতি ঘোড়া কিছুই নেই। কালেভদ্রে হয়ত একটা টোটো ঢুকল, ভ্যাকসিনের পোর্টাল কোথায় কবে আপলোড করা যাবে তার আগাম প্রচার নিয়ে। কেউ হয়ত আসে ‘দুয়ারে সরকার’-এর সুবিধা কারা কতখানি পেল তার সমীক্ষা করতে। তাহলে? এসব পোশাক কাকে পরাবে ভদ্রেশ্বর? কে বা এর প্রকৃত মূল্য বুঝবে? ভাবতে বসলে আকাশ-পাতাল একাকার হয়ে যায় ভদ্রেশ্বরের!
ভদ্রেশ্বরকে নিয়ে বাসমতীর সংসারে বিরক্তির একশেষ! কলপাড়ে এঁটো হাঁড়ি মাজতে মাজতে বলে ওঠে, “খানিক খানিক এমন ইচ্ছে হয়, এই হাঁড়ি দিয়ে নিজেই নিজের কপালটা ফাটিয়ে ফেলি! লকডাউন উঠেছে সে কোনকালে! মানুষ মাটি ফেঁড়ে নিজের পছন্দের রুজি-রোজগার বেছে নিচ্ছে! আর ইনি কিনা পড়ে আছেন একখান ছ্যাতাপড়া সাজের বাক্স নিয়ে! এইবার ওর ঢাকনা খুললে আগুন লাগিয়ে দেব বলে দিলাম!” বাসমতীর কথা শুনে থ’মেরে বসে থাকে ভদ্রেশ্বর, এককালের শ্রেষ্ঠ সাজঘরের মালিক তথা পাইকপাড়ার যাত্রা কমিটির অপ্রতিদ্বন্দ্বী মেকাপ মাস্টার ভদ্রেশ্বর মজুমদার! কী যেন এক অস্থিরতা গ্রাস করেছে ওকে! খেয়ে শান্তি নেই। বসে শান্তি নেই। হয়ত শুয়ে পড়েছে। কিছু একটা কল্পনা করে হুট করে ঠেলে উঠল। একখানা ইঁদুরে-কাটা বই হাতের তালুতে বাড়ি মেরে ধুলো ঝেড়ে গড়গড় করে কয়েকটা লাইন পড়ল। তারপর জরি বসানো একটা ছোগাকোট গায়ে চাপিয়ে ডাক দিল, “মানু, একটু ওঠ না সোনা মা! একটা ভিডিও বানিয়ে দিবি?”
বাপের কাতর অনুনয় ফেলতে পারে না দ্বাদশ বর্ষীয়া মেয়ে। ঘুমচোখ কচলে হয়ত বলল, “কীসের ভিডিও গো?”
ভদ্রেশ্বর চোখ বিস্ফারিত করে বলে, “রাতারাতি লাখোপতি হওয়া যায় যে ভিডিওয়! বানিয়ে দিবি মা? সকালে ইউটিউবে ছাড়বি। সন্ধ্যার মধ্যে আমাদের ব্যাঙ্কের বইতে টাকা ঢুকতে শুরু করবে!”
এভাবেই বাপ পাকা পরিচালকের মতো মেয়েকে বোঝাতে থাকে। অমনি বাসমতী হুঙ্কার দেয়, “ছ্যাবলামোর একটা লিমিট আছে! রাত কত হল সে খেয়াল আছে?”
মেয়ে ভয়ে ভয়ে মায়ের পাশে এসে শুয়ে পড়ে। তখনো বাসমতী গোখরোর মতো ফুঁসতে থাকে, “এই কী তুলেছিস দ্যাখা। আগে মোছ। মোছ বলছি! কতটা নির্লজ্জ হলে তবে এতখানি নিচে নামা যায়!”
মানু ভিডিও ক্লিপটা অন্যত্র লুকিয়ে রাখতে চেষ্টা করে।
বাসমতী তখনো শাসাতে থাকে, “এই মেয়ে, লক্ষ্মীর ভাঁড় ভেঙে এই মোবাইল আমি তোমাকে পড়াশুনার কাজে ব্যবহার করার জন্যে দিয়েছি। এইবার যেদিন দেখব কেড়ে নেব!”
আলো নিভে যায়। বাসমতীও অনেক অশৈলের পর ক্লান্ত শরীরে ঘুমের মধ্যে তলিয়ে যায়। কিন্তু ভদ্রেশ্বরের ঘুম আসে না। দাঁতে দাঁত চেপে কিড়মিড় করে বউকে শাপশাপান্ত করে। কখনো বা অস্ফুটে উচ্চারণ করে গুচ্ছ গুচ্ছ সংলাপ, “কোথায় যেন আছি? বাসমতীর সংসারে তো? না না একটা ছিন্নমস্তার সংসর্গে! ওরে ও সঞ্জয়, ও সনো, গেলি কনে? প্রতিদিন যারা শিয়ালদার কোলে মার্কেটে চিংড়িমাছ বাছে, তাদের আত্মীয়স্বজনকেও চোখ বেঁধে দিলে ঠিক গায়ের গন্ধে যে যার মানুষ চিনে নেয়! আমি তোদের এতদিন এত আলো এত মঞ্চ দিলাম! অথচ তোরাই আমার সাথে এইভাবে লুকোচুরি খেলিস?”
অনেক আগেই বাসমতীর সঙ্গ ত্যাগ করতে পারত ভদ্রেশ্বর। কিন্তু করেনি। সংসারে পুরুষ মাত্রেরই দায়িত্ব কর্তব্য বলে একটা অলিখিত ধর্ম আছে। হয়ত এটার জন্যই সে পারে না। কিম্বা সাজঘরের বাক্সটার জন্যে। আজ হোক বা কাল, ভদ্রেশ্বর কিন্তু এখনো বিশ্বাস করে, মঞ্চ থেকে মুখ ফিরিয়ে মানুষ কোথায় পালাবে! মোবাইলে তো? মোবাইল দিয়েই বাজিমাত করতে হবে! অতএব একদিন না একদিন তার কপাল খুলবেই! আর এই নেশাতেই একেকদিন একেকরকম পোশাক পরে বেরিয়ে পড়ে অচেনা অজানার টানে। চলতে চলতে যদি কখনো কুণ্ঠা এসে তাকে দুর্বল করতে থাকে, তখন সে নিজের বুকে জোর চাপড় মারতে মারতে বলে, “আমাদের রানিঘাটের রঞ্জনাদি মাত্র একখানা গানকে সম্বল করে সোজা বোম্বে গেল! সামান্য এক ফেরিওয়ালা সেও কিনা রাতারাতি ভুবনবিখ্যাতদের তালিকায় নাম লিখিয়ে ফেলল! আমিই বা কম কীসে? বরং আর্টের দিক থেকে এঁদের দুজনের চাইতে আমি অনেকটাই এগিয়ে! কিন্তু ভিডিওটা করবে কে?”
একদিন ভরদুপুরে ঝাঁপ দিয়ে চলন্ত বাসে উঠে পড়ল। উঠতে না উঠতেই লজেন্স বিক্রেতার সাথে তুমুল ঝামেলা বেঁধে গেল! কন্ডাক্টর দুপক্ষকেই থামাতে চেষ্টা করল। কিন্তু হকার বড় তেজি! সে ইউনিয়নে নালিশ ঠুকে দিল! অবশেষে চাপে পড়ে বাসমালিক ভদ্রেশ্বরকে বাস থেকে নামিয়ে দিতে বাধ্য হল। পরের দিন সন্ধ্যায় ট্রেনের কামরায় উঠে সিরাজদ্দৌলার পার্ট দিয়ে দিন শুরু করল। দুয়েকজন যাত্রী খিল্লির সাথে আবদার মাখিয়ে বলে উঠল, “মিদনাপুরের মীরজাফরের পাট করতে পারলে পাঁচটাকা!”
কেউ কেউ সত্যি সত্যি টাকাও গুঁজে দিল। কিন্তু ভিডিও করে না কেউ। এখন হঠাৎ হঠাৎ বাক্সটার কথা মনে পড়ে। আর সেদিন সকালটানে বাড়ি ফিরে আসে ভদ্রেশ্বর।
সেদিন একটা পার্কের পাশ দিয়ে হেঁটে ফিরছিল ভদ্রেশ্বর। হঠাৎ ওর নজরে পড়ল, একটি মধ্যবয়স্ক লোক মোবাইলে কিছুর একটা ভিডিও করছে। অমনি ভদ্রেশ্বর উল্লোখুল্লো চুলগুলো ঠিক করে শট দেবে বলে দাঁড়িয়ে পড়ল। ভিডিওকারী লোকটা খেঁকিয়ে উঠল, “এটা সোলো সিনের জন্যে না! সরে দাঁড়ান!”
ভদ্রেশ্বর সরে দাঁড়াল। একইসাথে ওর নজরে পড়ল, একজোড়া সঙ্গমরত সারমেয়কে সামনে রেখে ভিডিও করছে লোকটা! ঘেন্নায় অপমানে ভদ্রেশ্বরের মরে যেতে ইচ্ছে হল! গায়ের কোটটা ফেঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে হল। কিন্তু পারল না। কেননা উলঙ্গ হয়ে যাবে সে। ঘরে মেয়েটি বড় হচ্ছে। বাপের এহেন কুকীর্তির কথা চাউর হলে মেয়েটি লোকসমাজে মুখ দেখাতে পারবে না! এটা এখনো পরিষ্কার ভাবতে পারে ভদ্রেশ্বর। অতএব সংকল্প নিল, সে আর বাড়ি যাবে না।
২
বাধ্য হয়ে একশ দিনের কাজে নাম লিখিয়েছে বাসমতী। দুপুরে সবাই যখন ভাতঘুম দিতে টিভি খুলে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দেয়, তখন হয়ত বাসমতীকে অন্যের পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটতে হয় মিটিঙে। ইদানীং পঞ্চায়েতের হয়ে লোকও পটাতে হয় বাসমতীকে। তা নইলে ভদ্রেশ্বরের ভাতাটা স্যাংশান হবে না। মেয়ে মানুও বাপের হয়ে তদবির করে। ফর্ম ফিলাপ করে পঞ্চায়েতে বিডিও অফিসে জেলার সদর দপ্তরে জমা দেয়। কেননা সে জানে কত হেলি তেলি ‘গানওয়ালা’ ‘কীর্তনশিল্পী’ ‘লোকশিল্পী’ পরিচয় দিয়ে সরকারি ভাতা তুলে দিব্যি সংসার চালাচ্ছে। সে তুলনায় তার বাপের প্রতিভা কোনও অংশে কম কিসে?
বিডিও বলেন, “তোর বাবা যে শিল্পী ছিল, এমন কোনও প্রুফ আছে? থাকলে এই ফর্মের সাথে এটাচ করে দে।”
ছবি খুঁজতে গিয়ে মানুর মাথা এলোমেলো হয়ে যায়! নাহ তেমন একটা ছবিও নেই। বাসমতীর বকুনি খেয়ে সব ছবিই সে ডিলিট করে ফেলেছে কি? না করেনি। যতোই হোক বাপের স্মৃতি বলে কথা! কোনও মেয়েই সবটা মুছতে পারে না। সে গ্যালারি খুঁজে ছোট্ট একটা ভিডিও বার করল।
বিডিও বললেন, “আপাতত এটাই আমার হোয়াটসঅ্যাপে দে। তারপর দেখছি!”
মানু বাপের ভিডিওটা মাকে উপেক্ষা করে এই প্রথম শেয়ার করল।
এখন প্রত্যেক সপ্তাহে একবার করে মানু জেলার কলাভবনে যায়। বাপের ভাতাটা ওদের পেতেই হবে। ভিডিওটা এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে যায়। আর অমনি হাসির ফোয়ারা ওঠে, “এই রে! বলছে তো যাত্রাশিল্পী। এ তো দেখছি উঠোনে চাটাই পেতে বাইট দিচ্ছে! এসব কেন?”
কেউ কেউ আবার ঠোঁট চিতিয়ে একরাশ অবজ্ঞা মাখিয়ে বলে দেন, “সে তো ডিলিট হয়ে গেছে। তাছাড়া এই ছবিতে কিছুই প্রমাণ হচ্ছে না আদৌ উনি, নাকি অন্য কেউ!”
এমন কথায় মানুর চোখ রাঙা হয়ে ওঠে, “বাপের ছবি নিয়ে কেউ কি মিথ্যাচার করে? না করে না!”
অভাবের সংসারে অবাঞ্ছিত হাত-পা গজায়। আর তখনই সে নিজের গরজেই খুঁজে নেয় কোথায় কতটুকু গচ্ছিত আছে। ভদ্রেশ্বরকে অনেক খুঁজেছে বাসমতী। এখন আর ধৈর্যে কুলোয় না। বরং রাস্তা দিয়ে ভাঙ্গাড়ি গেলে ঘর থেকে ডাক দেয়, “ও ভাই, এদিকে এসো তো।”
ফেরিওয়ালা উঠোনে পাল্লা-পোড়েন নিয়ে বসে পড়ে। বাসমতী খাটের তলা থেকে বাক্সটা টেনে বার করে। ঢাকনা খুলে চেয়ে থাকে ওর খোলে। ফেরিওয়ালা ঘনঘন হাঁক ছাড়ে, “বউদি, কী কী আছে আনুন।”
বাসমতী টিনের বাক্সটা উঠোনে এনে ঘা দেয়। পোড়া পাঁপড়ের মতো ওর তলাটা ভেঙে যায়। এরপর একে একে ওর মধ্য থেকে জংধরা ঢাল তরোয়াল লাঠি ঘন্টা কাঁসর সব বার করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দ্যাখে আর দরদাম করে, “পেতল কত করে নেচ্চ? এটা কিন্তু মোটেও লোহা নয়!” এমন সময় মানু টিউশানি থেকে ফিরে এল।
“সব বেচে দিচ্ছ মা? বাবা যদি ফিরে আসে? দাঁড়াও কিছু জিনিসের ছবি তুলে রাখি।” মানু কিছু কিছুর ছবি তুলে নিল।
বাসমতী ধমক দিয়ে বলল, “এসবের দরকার নেই। পারলে একটা খাতা কলম নিয়ে আয়। হিসেব কর।”
মানু অনেকক্ষণ ধরে হিসেব করল। মোট, ২২২ টাকা বারো আনা। বাসমতী বলে, “ওটাকে তেইশ করে দিতে হবে।”
ফেরিওয়ালার মুখ ভার হয়ে এলে বাসমতী একগোছা পরচুলা গুঁজে দেয় ওর হাতে। ফেরিওয়ালার মুখ কাঁচুমাচু হয়ে আসে, “এসব কে মাথায় দেবে ম্যাডাম। তার চাইতে এক কাজ করেন, রেখে দেন। আমি আগামী হপ্তায় এক বাসনওয়ালা দিদিকে নিয়ে আসব।”
কথাটা কানে আসতেই বাসমতীর চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল! সে জিজ্ঞাসা করল, “তোমার কাছে দেশলাই আছে?”
“কী হবে ম্যাডাম?”
“আজ এগুলো পুড়িয়েই দেব!”
ফেরিওয়ালা লোকটি লজ্জায় জিভে কামড় দিয়ে উঠল! এবার সে নিজেই জরি দেওয়া ওড়না ঘাগরা পরচুলাগুলো গুছিয়ে একত্র দলা পাকিয়ে মানুর হাতে দিল। এবং বিশেষভাবে বাসনওয়ালা দিদির জন্যে রেখে দিতে পুনঃপুনঃ অনুরোধ করল।
৩
“কোথাও কি আর ম্যারাপ বাঁধা হবে না? কেউ কি আর যাত্রাকে ভালোবাসে না? বাসে তো! কিন্তু অভিনয়টা কে করবে শুনি? তার নায়ক, তার খলনায়িকা এরা গেল কোথায়?” আজকাল নিজের মনেই একা একা সংলাপ রচনা করে ভদ্রেশ্বর। আজ যখন বৈশাখের ঠা-ঠা রোদে ঘুরে ঘুরে একটা জলাশয়ের ধারে এসে দাঁড়াল, হঠাৎ নজরে এল জলের নিচে কে যেন ওর দিকে হাত নাড়ছে। ছায়াটাকে নিখুঁতভাবে নিরীক্ষণ করল ভদ্রেশ্বর। হ্যাঁ ওটা তালগাছই। গাছটার মাথা বরাবর কেউ দাঁড়িয়ে আছে। ভদ্রেশ্বর আরও খানিকটা সময় নিল। এবার সে নিজের কাছেই বহুবার জিজ্ঞাসা করল, “লোকটাকে চেনা চেনা লাগছে মনে হল?”
গলা শুকিয়ে ধুলো হয়ে এসেছে ভদ্রেশ্বরের। তবু হাইহুই করে হাঁকল, “হেই, তুমি সঞ্জয় না? গাছের মাথায় কেন?”
লোকটা কথা বলল না। সে আপনমনে তালের পুরুষ মঞ্জরীগুলোকে পরখ করতে লাগল। ভদ্রেশ্বর ছায়া পেয়ে বসল। কিন্তু আর কতক্ষণ? একগাদা মাটির ঠিলে লোকটার পেছনে ঝুলছে। আর ওগুলোই একটার সাথে একটা বাড়ি খেয়ে ঠনঠন করে আওয়াজ ছাড়ছে।
“আরে ও সঞ্জয়, আওয়াজ দিচ্ছ না যে মোটে! তাই বলি এদ্দিন আছ কোথায়? এসব ছেড়েছুড়ে দিয়ে দিব্যি রসেবশে আছ দেখছি!”
লোকটা খানিকটা নামল। ভদ্রেশ্বর হাঁকুপাঁকু করে উঠল, “এই তো চিনেছি চিনেছি। তুমিই আমার নায়ক! তোমার কাছে মোবাইল আছে? মোবাইল?”
ভদ্রেশ্বরের এহেন পাগলামিতে লোকটা থেমে গেল। সে আবার ওপরের দিকে উঠতে লাগল।
“তুমি সঞ্জয় তো? আরে ভাই, এইটুকু অন্তত স্বীকার করো!”
দখিনা হাওয়াই উত্তর এল, “হুম!”
“এ তল্লাটে আর কোনও মানুষ নেই?”
“মানে?”
“মানুষ মানে ওই অ্যানরয়েড মোবাইল ব্যবহার করে এমন মানুষ! আছে?”
“আছে!”
“কোথায় কদ্দুর?”
সঞ্জয় নামের লোকটি এবার একটা কাঁচা তালের বেগ্লো ওর সামনে ফেলে বলল, “সোজা এটা টানতে টানতে যাও। ডাক পাবে!”
ভদ্রেশ্বর পাতা হাতে ছুটতে শুরু করল। কেননা অভিনয়ের খিদেয় সে একেবারে হায়েনা হয়ে উঠেছে! কাঁচা তালের বেগ্লোটা টানতে টানতে সুর করে হাঁক পাড়ল, “পাতাআআআআআআআআ!”
খানিকটা যেতেই কে যেন ডাকল, “এই পাতা, এদিকে!”
কে ডাকল? ঝাঁ ঝাঁ রোদে বেশি দূরে দৃষ্টিও ঘোরানো যায় না। ভদ্রেশ্বর পাতাটা উঁচু করে রৌদ্র আটকানোর চেষ্টা করল। দেখল একটা ছাইয়ের ঢিবির পাশে ছোট্ট একটা মাচা। মাচাটা তালপাতা দিয়ে ছাওয়া। তাহলে কি ওখান থেকেই ডাকটা এল? কাছে এগিয়ে যেতেই ভদ্রেশ্বর ভ্যাঁক করে কেঁদে ফেলল, “সনকা, তুমি এখানে কী করছ?”
সনকা মাচার নিচে অনেকগুলো মাটির পাত্র দেখিয়ে দিয়ে বলল, “জলসত্র বসিয়েছি গো ভদে দা!”
“কাদের জন্যে?”
“বসো। দেখবে কত কত বাবু ভদ্দরলোকেরা আসবে!”
“ইস! কী যে বলিস!”
“বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি? এক গ্লাস খাও!” সনকা একগ্লাস দিল।
ভদ্রেশ্বর মুখে দিয়েই ওয়াক করে উঠল, “আরে! এ তো তাড়ি মনে হচ্ছে রে!”
সনকা হি-হি করে হেসে উঠল। অপূর্ব সেই হাসি! এখনো আগের মতো কী যেন আঠা মাখানো আছে ওর ওই হাসিতে! ভদ্রেশ্বর আর কথা বাড়াল না। সে পাত্রটা এক চুমুকে শেষ করে ফেলল। সনকা আরও এক গ্লাস দিল। ওটুকুও খেল। এবার খেলা শুরু! মাটিতে উবু হয়ে বসে ঝিম কাটছে দেখে সনকা বলল, “এক গ্লাস সাদা দিই?”
“কলসি কটা?”
এবার সনকা উপুড় হয়ে একখানা ভিজে চট সরিয়ে দিয়ে বলল, “একটা উলা। একটাতে ঘোলা। বিকেলে এটাতে করে জিরেন আনি। আর এটাতে স্রেফ সাদা জল!”
“সবই কি তালের রস?”
“তাল ছাড়া এ তল্লাটে কী আর আছে শুনি?”
“তাই বলি!”
“সাদা দেব এক গ্লাস?”
“না থাক। নেশাটা লেগে এসেছে মনে হচ্ছে!”
আজ তীব্র দহন। মাঝে মাঝে ঘূর্ণি উঠছে। আর সেই ঘূর্ণির সাথে ছাই ধুলো উড়ে এসে মাচাটাকে আচ্ছা করে মচকে দিয়ে গেল।
“এত ছাই উড়ে আসছে কোত্থেকে?”
“সনকা দূরে ইশারা করল। এবার ভদ্রেশ্বর দেখল একটা ধু-ধু গ্রামের মাঝখানে এসে পড়েছে সে। যে গ্রামে একটা ঘরও আর অক্ষত নেই। সবকটা ভস্ম হয়ে আছে। ভদ্রেশ্বরের চোখ কপালে উঠল,“হায় রে এটা তো সেই সীতাপুর হাট!”
সনকা হিসহিস করে উঠল, “চুপ! কথা বাড়িও না!”
ভদ্রেশ্বরের কথা জড়িয়ে এল, “কে করল এই সর্বনাশ?”
“কে আর করবে! নিজেরা নিজেরা মারকুটাকুটি করে মরেছে!”
“কতজন মরেছে বলে মনে হচ্ছে?”
“খাতা আমার কাছে নেই। ইলেকশান আসলে আসল হিসেব পাওয়া যাবে!”
“কেউ জীবিত নেই না?”
“না!”
ভদ্রেশ্বর ঝপ করে ঝাঁপিয়ে মাচায় উঠল, “তাহলে কারা খায় তোমার এই রস?”
সনকা জবাব দিল না। ভদ্রেশ্বর পীড়াপীড়ি শুরু করল, “বলো না এতবড় একটা জতুগৃহে কার জন্যে জলসত্র বানিয়ে বসে থাকো?”
“উঁহু! এখানে এসব কোরো না! সিরিয়াস থাকো! পারলে পাতাটা ওই রাঙা দেওয়ালটার ওপরে তুলে দাও। কাল সকাল হোক, সব জানতে পারবে। এখন আমি যাব।” বাকি কথাগুলো ভদ্রেশ্বরের চেতনায় পৌঁছাল না; তার আগেই সে ওখানেই ঘুমে ঢুলে পড়ল।
৪
পরদিন সনকা অনেকটা বেলায় এসে দেখল, দেওয়ালগুলোর মধ্যে যে কয়লার রাশি ছিল সেগুলো সরিয়ে একপাশে শুয়ে আছে ভদ্রেশ্বর। আরও দুটো পাতা কোত্থেকে এনে দারুণ একটা ছাউনি করেছে সে। সনকা একটা গামছায় করে ভাত বেঁধে এনেছিল, ওটা খুলে ভদ্রেশ্বরকে দিল। বলল, “পাশের নালা থেকে স্নান করে এসো!”
বহুদিন পরে নারীর শাসনে ভেতরটা চঞ্চল হয়ে উঠল। ভদ্রেশ্বর উঠে দাঁড়াল।
সনকা বলল, “গা থেকে কোটটা খুলে দাও দিকিনি। কেচে দিই!”
সনকার আদেশমতো সে গামছা পরে হনহন করে হেঁটে গেল। সনকা ভদ্রেশ্বরের জরির পোশাকগুলো বাড়ি দিয়ে দিয়ে কাচল। এবং নিংড়ে একটা ঝলসানো নিমের ডালে নেড়ে দিল। যে দেওয়ালটাতে ভদ্রেশ্বর ছাউনি দিয়েছে, এবার কিছুক্ষণের জন্যে ওর ভেতরটায় গিয়ে দাঁড়াল। এখানে অনেকটা ছায়া। অনেকদিন পর আদি সেই শামিয়ানার সুখ অনুভব করল সনকা!
এমন সময় তিন চারটে গাড়ি ঢুকল। একটা উচ্চ আধিকারিকদের। বাকিগুলো সবই প্রেসের। সনকা ছাই উড়িয়ে ছুটে এল।
একজন নোট-প্যাড বের করে জিজ্ঞাসা করলেন, “মানুষ ফিরছে বলে মনে হয় ম্যাডাম?”
সনকাকে ম্যাডাম সম্বোধন না করলে সেও সবটা খুলে বলে না। কিন্তু আজ মনে হল নিজে থেকেই কথায় আঁচ সাজিয়ে বসে আছে সনকা।
এবার সে কলসিতে ঠুক ঠুক করে ঠোকা দিয়ে বলতে লাগল, “আজ একজন এসেছে। অল্প জেরা করবেন। বোঝেন তো মাথাটা এলোমেলো হয়ে আছে কি না!”
“কোথায় তিনি?”
ভদ্রেশ্বর ভিজে গায়ে পাতার নিচে ঢুকতেই সনকা চেঁচিয়ে উঠল, “ওই তো উনি!”
আধিকারিক সহ এক গাদা ক্যামেরা দৌড়ে এল, “এই বাড়িটাই কি আপনার?”
প্রথমত কী বলবে বুঝে উঠতে পারল না ভদ্রেশ্বর। সনকা চোখ টিপতেই সে বলল,“হুম!”
“আপনি যখন বেরিয়ে গেলেন, ভেতরে কে কে ছিল!”
হঠাৎ এই দহনবেলায় নিজেকে বড় অপরাধীর মতো মনে হল! মানুর মুখখানি মনে পড়তেই ভদ্রেশ্বর ভ্যাঁক করে কেঁদে ফেলল, “আমার একমাত্র মেয়ে! আর মেয়ের মা!” আর বলা হল না। তার আগেই ওর কাঁধে-পিঠে হাত বুলিয়ে অনেকেই সান্ত্বনা দিতে লাগলেন!
লোকগুলো আর ভদ্রেশ্বরকে কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। তাঁরা আরও দু-তিনটে বাড়ির নমুনা নিয়ে যখন গাড়িতে উঠবেন বলে মনস্থির করে ফেলেছেন, এমন সময় সনকার কাছে ছুটে গিয়ে আবদার করল, “কোই ভাত এনেছ বললে! দাও!”
“বউ মেয়ের হয়ে ভালোই তো কাঁদলে! আমি ভাত দেব কেন?”
“তাহলে আমাকে দিয়েই বা কথাগুলো বলালে কেন?”
“তোমরা বলবে না তো কে বলবে? তোমাদের মতো মানুষের এই কান্নাটুকুর মূল্য কত হয় জান? সবচেয়ে বড় কথা হল, এই যে দুঃখটাকে নিজের বলে ভাবতে পারলে! এটাই বা কজন পারে?”
“আমার নিজের দুঃখ মানে?”
এবার সনকা দপ্ করে জ্বলে উঠল, “ভেবেছ পাগল সেজেছ মানে সবকিছু থেকে পার পেয়ে যাবে! বেশি চালাকি কোরো না বুঝলে!” বলতে বলতে সনকা ওর কোটটা ভদ্রেশ্বরের মুখের ওপর ছুড়ে মারল।
গাড়িগুলো সবে ধোঁয়া ছাড়তে শুরু করেছে।
জরির কোটটাকে উড়াতে উড়াতে দানবের মতো ছুটে এল ভদ্রেশ্বর, “ও বাবু, ভিডিওটা মুছে দেন! এটা আমার ঘর না! আমি পাইকপাড়ার সাজঘরের মালিক! আমি ভদ্রেশ্বর মজুমদার! আমার পরিবারের সবাই জীবিত! আপনাদের পায়ে পড়ি বাবু! ভিডিওটা মুছে দেন!”
কিন্তু কে শোনে কার কথা! চলন্ত গাড়িতেই এডিটিং চলছে। সন্ধ্যায় চ্যানেলে চ্যানেলে চুলচেরা বিশ্লেষণ হবে। আর এটাকে ভাইরাল করতে যে যে মশলাপাতির দরকার হয়, প্রত্যেকটা মিডিয়া হাউসেই এসব মজুত করা আছে!