ন্যাড়া ডালে সদ্য ফুল আসতে শুরু করেছে। ছোট্ট ছোট্ট কুঁড়িতে ভরে আছে গাছ। এ গাছটা গোলাপি চেরির। খুব প্রিয় রং। গোলাপিরঙা একটা ড্রেস ছিল তার, মলে গিয়ে নিজে পছন্দ করে কিনেছিল। বেশিদিন পরতে পেল না, সব ছেড়ে আসতে হল! কী যে এক বিতিকিচ্ছিরি রোগ এল, অতিমারিতে উজাড় হয়ে যাচ্ছে দেশ। সে ছিল হাসপাতালের নার্স, নাওয়া-খাওয়ার সময় ছিল না তাদের। হাসপাতালে রুগির ভিড়, জায়গা দেওয়া যাচ্ছে না, ওষুধ নেই, অক্সিজেনের অভাব! দিনরাত এক করে মানুষকে সারিয়ে তোলার চেষ্টা চালিয়েছে সেসময়। অতিরিক্ত পরিশ্রমে শরীর দুর্বল, ছোয়াঁচে রোগ সহজেই ধরে নিল তাকে। কয়েকদিনের মধ্যেই পৃথিবীর মেয়াদ শেষ! সেও তো প্রায় বছর দেড়েক হল।
তবে মায়া কি আর অত সহজে কাটে? তাই আশপাশেই থাকত। নিউ ইয়র্কের এই হাসপাতালে একেই স্টাফ কম, রুগির ভিড় বেশি, নজর রাখত সমানে! কার অক্সিজেন লেভেল কমে যাচ্ছে, নিঃশ্বাসের কষ্ট বাড়ছে, নার্স জুলিয়া হয়ত ঠিক সেই সময় বসে বসেই ঢুলে পড়েছে একটু। মানুষের শরীর তো? কত আর পারবে? মায়া হত তার। আস্তে করে জুলিয়ার চুলে একটু টান দিত। ধড়ফড়িয়ে উঠে জুলিয়া এদিক সেদিক তাকাত। রুগির দিকে চোখ পড়ত, দৌড়ে যেত সেদিকে। সেও তার ছায়াশরীরে হাঁফ ছাড়ত! কম লড়েছে অতিমারির কালে? অভ্যেসগুলো যাবে কোথায়? এখন তো তাও অনেকখানিই সামলানো গেছে। রোগের ভ্যাকসিন বেরিয়ে গেছে, অতিমারিও তাই শেষের দিকে। এখন আর অতটা নজরদারি করতে হয় না। মনটা ভালো আছে, তাই এদিক-সেদিক একটু ঘুরে বেড়াতে সাধ যায়।
এই তো, গত নভেম্বরের হ্যালোউইনে পাড়াবেড়ানি ছেলেমেয়েগুলো বেরিয়ে পড়েছিল। তাদের দলে মিশে সেও বাড়ি-বাড়ি গিয়ে ক্যান্ডি নিয়েছিল। বাড়ির লোকেরা চোখ কপালে তুলেছিলেন, "কী দুর্দান্ত মেকআপ! ঠিক যেন সত্যিকারের পেত্নি!"
হ্যালোউইন পেরিয়ে ক্রিসমাস এল, ঠান্ডা পড়ল জাঁকিয়ে। বরফের ওপর পিছলে পিছলে ভেসে বেড়াল সে। দারুণ মজা। স্কেটিং জানত, সেই বিদ্যেটাই কাজে লাগল। সেখানেই দেখা মামদোর সঙ্গে। গরমের দেশের ছেলে, জন্মেও বরফ দেখেনি। উইলো গাছে বসে বসে দেখছিল আকাশ থেকে দুলতে দুলতে নামছে তুষারকণা, সাদা চাদর বিছিয়ে দিচ্ছে জমিতে, ঘাসে।
সে তখন বায়বীয় স্কেটিংএ ব্যস্ত। অতটা খেয়াল করেনি। খেয়াল করল যখন সামনেই ধপাস-ধাঁই! মামদো উল্টে পড়েছে। তাকে দেখে বোধহয় সাধ জেগেছিল, বরফে খেলবে! পড়েছে একেবারে মুখ থুবড়ে, কোঁকাচ্ছে।
এক লহমায় ব্যাপারটা বুঝে নিল সে, কোমরে দুহাত রেখে দাঁড়াল, "বলি, আসা হচ্ছে কোত্থেকে?"
মামদোর অবস্থা খারাপ, কোনোমতে বলে, "অনেকদূর, সেই বেঙ্গল।"
ইংরেজিতে বলার কী দরকার ছিল কে জানে! বেশিদিন আসেনি বোধহয় এপারে। জানে না, এখানে সবাই সব ভাষা বুঝতে পারে।
"ব্যাংলাডেশ?" সেও একটু মজা করে। বেঁচে থাকতে বাংলাদেশের নামটা ঐরকমই উচ্চারণ করত। হাজার চেষ্টাতেও জিভে ঠিকঠাক শব্দটা আসত না। অনেক রুগি আসত তার হাসপাতালে, যারা বাংলাদেশে জন্মেছে, বাংলা ভাষায় কথা বলত। শুনে শুনে খানিক বুঝতেও শিখেছিল। কিন্তু বলতে পারত না। এখন আর সেসব সমস্যা নেই।
"না না, তার ঠিক পাশেই। কলকাতা। কিন্তু তুমি বাংলাদেশ জানো?" মামদো খুব অবাক হয়েছে।
"জানব না?" মিটিমিটি হাসে, "হাসপাতালে কত্ত রুগি ছিল আমার!"
"হাসপাতাল? তুমি হাসপাতালে কাজ করতে?"
"হ্যাঁ। কেন, আপত্তি আছে তোমার?"
"রাম বলো, আমার আর আপত্তি কী! তবে গলাটা চেনা চেনা লাগছিল। এবার ব্যাপারটা পোষ্কার হল।"
"মানে? ঝেড়ে কাশো দিকি?"
"আরে আমিও তো হাসপাতালেই অক্কা পেলাম। মামার কাছে বেড়াতে এসে রোগে ধরল। ব্যাস, সঙ্গে সঙ্গে লাল-নীল আলো জ্বালানো গাড়ি এসে সোজা হাসপাতালে জমা করে দিল।"
আহা রে! মনটা ভিজে আসে।
"মামার সঙ্গে আর দেখা হয়নি, না?"
"নাঃ!" মামদো দুদিকে ঘাড় নাড়ে। "আই সি ইউতে ছিলাম, কাউকে আসতেই দিত না কাছে।"
"সে তো দেবেই না, ভারি ছোয়াঁচে অসুখ কিনা! আই সি ইউর রুগিদের নিয়ে কম টানাপোড়েন গেছে আমাদের?"
"তোমায় দেখেছি আমি, খুব মনে আছে, প্লাস্টিকের গারবেজ ব্যাগ পরে কাজ করছ, দৌড়ে বেড়াচ্ছ এই বেড থেকে ওই বেডে।"
"ছোঁয়াচ আটকানোর মত পোশাক তো জুটত না, অত পি পি ই কোথায়? তাই গারবেজ ব্যাগই ভরসা। ওই পরেই যতটুকু যা হয়। তবে সাধ্যের অতিরিক্ত করেছি মানুষকে বাঁচাতে।" তার গলাটা একটু উদাস। "ওখান থেকেই রোগে ধরল, তারপর সোজা এপারে।"
বলতে বলতে হঠাৎ খেয়াল হয়েছে, মামদো সেই যে ভূমিশয্যা নিয়েছে, আর ওঠেনি তো! খ্যাঁক করে ওঠে, "তখন থেকে অমন কেতরে শুয়ে আছ কেন? উঠে দাঁড়াও দিকি?"
"বড্ড লেগেছে যে, পা পিছলে আলুরদম একেবারে!"
এবার আর সে হাসি চাপতে পারে না। নাঃ, সদ্য এসেছে এপারে, গেঁয়ো ভূত একটা!
খিলখিলিয়ে হেসে বলে, "সব তোমার মনের ভুল!"
"ভুল? হাড়গোড়গুলো ভেঙে গেল বোধহয়, আর তুমি কিনা..."
"ধুস, বোকার বেহদ্দ কোথাকার! ও হাড় কি মানুষের, যে ভাঙবে? হ্যাঁ, খুলেটুলে যেতে পারে অবশ্য, সে আবার ঠিক জায়গামত বসিয়ে নিলেই তো হল!"
"আঁ?" বেকুবের মত চোখ পিটপিট করে মামদো।
ভালো করে তাকায় সে। মামদোর নিচের পায়ের হাড়টা আলগা হয়ে ঝুলছে। ফের সেটাকে ঠিকঠাক করে চেপে বসিয়ে দিতে দিতে বলে, "এই নাও, জুড়ে দিলাম। এসব কাজ সবাই নিজেই করে। খেলাচ্ছলেই করে। এই যেমন ধরো নিজের খুলিটা হাতে নিয়ে একটু লোফালুফি করে আবার ঘাড়ে বসিয়ে নিল। কংকাল শরীরে তো আর ব্যথাবেদনা নেই, কম মজা?"
"তাহলে যে আমার..." কেমন অন্যমনস্ক শোনায় মামদোর স্বর।
মায়া হয় তার। আহা রে, পৃথিবীর খোলসটা ছেড়ে এসেছে বটে, স্মৃতিগুলো এখনো পুরোপুরি ভুলতে পারেনি। সময় লাগবে একটু। তার নিজেরও তো... যাকগে। কথা ঘোরায় সে।
"বরফে স্কেট করতে চাও?"
সঙ্গে সঙ্গে মামদোর মুখে হাসি ফুটেছে, "ওই যে তুমি যেরকম পিছলে পিছলে যাচ্ছিলে, দেখে কী ভালো লাগছিল, আমিও ঐরকম করব।"
"শিখতে হবে, ব্যালান্স আসতে একটু সময় লাগবে। স্কেটিং করোনি তো কোনোদিন?"
"নাঃ, গরমের দেশের লোক, বরফ পাব কোথায়?"
"কোনো চিন্তা নেই, শিখিয়ে দেব।" সাদা হাড়ের আঙ্গুল তুলে সে বরাভয় দেয়।
মামদোর এলেম আছে। জীবনে স্কেটিং না করলেও বায়বীয় স্কেটিং বেশ তাড়াতাড়িই রপ্ত করে নিল। দুজনে পাশাপাশি পিছলে পিছলে কাঁহা কাঁহা মুল্লুকে ঘুরল সারা শীতকাল। রকি মাউন্টেনের উপত্যকায় নেচে বেড়াল, পোকোনোর ঢালে সাঁই সাঁই নেমে এসে হি-হি করে হেসে গড়াগড়ি খেল, মাউন্ট ওয়াশিংটনে বরফের গোলা পাকিয়ে একে অন্যের দিকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারল।
এবং এই করেই বেশ জম্পেশ প্রেম হয়ে গেল দুজনের।
শুভস্য শীঘ্রম নীতিতে মামদো ঠিক করল বিয়ের প্রস্তাব দেবে। মেমপেত্নি বলে কথা, খুব শখ হাঁটু গেড়ে বসে প্রপোজ করবে। মধ্যযুগের নাইটদের মত, ঠিক সিনেমায় যেমনটি দেখেছে। সেইমত নিত্যি রাতের বেলায় চাঁদের আলোয় বাঁ-হাঁটুর ওপর বসে প্র্যাক্টিস করে।
একদিন জিজ্ঞেস করল, "আচ্ছা, প্রপোজ করতে কি আংটি লাগে?"
পেত্নির মনমেজাজ তখন একদমই ভালো নেই। ভাইরাস আবার চেগে উঠেছে। নতুন রূপ নিয়ে নতুন করে ইনফেকশন ছড়াচ্ছে। এই না কত কষ্ট করে ভ্যাকসিন-ট্যাকসিন দিয়ে অতিমারিকে বাগে আনা গেল! আবার সে এসেছে ফিরিয়া? কী সর্বনাশ!
সংক্ষেপে উত্তর দিল, "হুঁ।"
"ওয়েডিং রিং, তাই না?" মামদো উৎসাহিত।
ততক্ষণে সে হাওয়া। হাসপাতালের দিকে চলেছে সাঁই সাঁই করে। জেনারেল বেডের এক রুগির অবস্থা ভালো ঠেকছে না। আই সি ইউতে নিতে হবে বোধহয়। ডাক্তারকে জানাতে হবে। পাশ দিয়ে ভেসে চলে গেলেই শিরশিরে ঠান্ডা হাওয়ায় কেঁপে উঠবে ডাক্তার। হিটিং চলছে কিনা দেখার জন্যে মুখ বাড়াবে, আর তখনি দেখতে পাবে পেশেন্টকে।
মামদোর উৎসাহ চুপসে গেছে। ঠ্যাং ঝুলিয়ে একা একাই গাছের ডালে বসে আছে আর আকাশ পাতাল ভাবছে। শীত শেষ হতে চলল, বসন্ত আসি আসি করছে। ন্যাড়া গাছের ডাল ছোট্ট ছোট্ট ফুলের কুঁড়িতে সেজে ওঠার জন্যে রেডি হচ্ছে। কার্ডিনাল পাখি যুগলের কত্তাটি ডেকে ডেকে মাথা খারাপ করে দিচ্ছে। কার্ডিনাল গিন্নি ঝোপের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে আছে! সহজে ধরা দেবে না।
আহা রে! মামদো এখন কার্ডিনাল কত্তার দুঃখ বোঝে।
শেষমেশ অনেক ভেবেচিন্তে খানিক সাহস সঞ্চয় করেছে। নিচে ম্যানহাটানের থিকথিকে ভিড় দেখতে দেখতে বাতাসে ভেসে ভেসে চলল হাসপাতালের দিকে।
পেত্নি তো অবাক! মামদো এখানেও এসে হাজির! গম্ভীর গলায় বলল, "কী হল? এখানে যে?"
"না, মানে ওয়েডিং রিংটা... যদি একবারটি আমার সঙ্গে আসতে, তাহলে..."
"নাঃ," সে থামিয়ে দেয়, "ওরম সাধারণ পাঁচপেঁচি বিয়ের আংটি আমার দরকার নেই।"
মামদো অবাক, "আংটি নয়? তাহলে?"
"তাহলে কী, সেইটে তুমি ভাববে, আমি নয়। আমার ঢের কাজ। চারদিকে নজর রাখতে হচ্ছে। তাও তো সদাপ্রভুর অসীম করুণা, লোকে তাড়াতাড়ি সেরে উঠছে, হাসপাতাল পর্যন্ত আর আসতে হচ্ছে না। তুমি এবার যাও দেখি? বকিও না আর।"
মামদোকে বিদায় করল। উঁহু, অত সহজে তাকে পাওয়া যাবে না। কার্ডিনাল গিন্নির হাওয়া লেগেছে গায়ে। ফ্যালনা নাকি সে?
তাড়া খেয়ে মামদো মুখ চুন করে চলে এসেছে। উইলো গাছে পা ঝুলিয়ে বসে বসে ভাবছে, ভেবেই যাচ্ছে। আংটি ছাড়া আর কী দিয়েই বা প্রপোজ করা যায়? এ তো আচ্ছা ঝামেলায় পড়া গেল!
কার্ডিনাল কত্তার ডাকাডাকি আরো বেড়েছে। গিন্নি হাওয়া। আগে তবু ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে বসে ছিল। এখন আর তাকে দেখাও যাচ্ছে না। কোথায় আছে, কে জানে!
ইঁদুরের খচমচ শোনা যাচ্ছে নিচে। শীতের কামড় একটু কমতে না কমতেই সব বেরিয়ে পড়েছে গর্ত থেকে।
অন্যমনস্ক মামদোর মনে পড়ল সেই ছেলেবেলার কথা। সেবছর শীতকালে যাত্রাপালা এল তাদের গ্রামে, পালার নাম 'সিঁথির সিঁদুর, চাটল ইঁদুর'। যাত্রা দেখবে কী, নাম শুনে তারা বন্ধুরা মিলে হেসেই অস্থির।
হঠাৎ মাথায় ঝিলিক দিয়ে গেল বুদ্ধি। ইউরেকা! আংটি নয়, আংটি নয়, সিঁদুরকৌটো!
ঠাকুমার একটা ছোট্ট রুপোর সিঁদুরকৌটো আছে, মাকে দিয়ে গিয়েছিল। সূক্ষ্ম তারের কাজ করা কৌটোটা মা খুব যত্ন করে আলমারিতে তুলে রাখত। আছে নিশ্চয়ই সেখানে। এমন একখানি অ্যান্টিক জিনিস দেখলে মেম-পেত্নির নির্ঘাত খুব পছন্দ হবে! ওই সিঁদুরকৌটো নিয়ে সে হাঁটুর ওপর বসে হাত বাড়িয়ে দেবে, "Will you marry me?" দেখা যাক, কেমন তাকে ফেরাতে পারে।
যা ভাবা, সেই কাজ। সঙ্গে সঙ্গে রওনা দিল মোমিনপুরের দিকে। পৃথিবীর এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত - কম রাস্তা? আটলান্টিক সমুদ্দুর ডিঙিয়ে, গোটা ইউরোপ পেরিয়ে তবে তো এশিয়ায় ঢোকা যাবে! বায়বীয় শরীরে ভাসতে ভাসতে যাওয়া, সময় তো লাগবেই।
পেত্নির ওদিকে মনকেমন। আহা রে, অমন কড়া কড়া কথাগুলো সেদিন না শোনালেও হত। কী করবে, বড্ড ভয় পেয়েছিল যে। অতিমারির সঙ্গে আসল লড়াইটা তো তারা স্বাস্থ্যকর্মীরাই লড়েছে! দেখেছে তার ভয়ঙ্কর রূপ। সেই আতঙ্ক মাথায় নিয়ে ওয়েডিং রিঙের কথা শুনতে কারই বা ভালো লাগে!
কিন্তু মামদো সেই যে গেল, আর তার পাত্তা নেই! বলে গেল, কী নাকি এক সাত রাজার ধন আনতে যাচ্ছে দেশের বাড়ি থেকে। সেও খুব বেশি কান করে শোনেনি। কিন্তু একটা খবর তো দেবে? কোথায় আছে, কী করছে, জানতে পারলেও মনটা একটু শান্ত হয়। ভুলেই গেল না কি? দেখো গে, দেশে হয়তো কোনো শাঁকচুন্নির প্রেমে পড়েছে। গালে হাত দিয়ে সে আকাশপাতাল ভেবেই চলে।
এখন রোগের ভয় আর ততটা নেই। আপিস-কাছারি, ইস্কুল-কলেজ সব খোলা। সব যেন ঠিক আগের মত। শুধু তারই মনটা বদলে গেছে। কেন সে মামদোকে অমন দুচ্ছাই করল? কতদিন ধরে বেচারি আশা করে আছে, তাকে প্রপোজ করবে! ধুস, কিচ্ছু ভালো লাগে না।
চারদিক শুনশান। কার্ডিনাল কত্তার দেখা নেই। গলাও শোনা যাচ্ছে না। গিন্নি বেরিয়েছে ঝোপের আড়াল থেকে। গলা বাড়িয়ে দেখছে এদিক-সেদিক, ফালুক-ফুলুক। খুঁজছে বোধহয় তাকেই, যার চেঁচামেচিতে বিরক্ত হয়ে পাতার আড়ালে চুপটি করে বসে থাকত।
এক দিন যায়, দু দিন যায়। আকাশে চাঁদটা রোজ বাড়ছে। উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর। মেপল গাছে বসে বসে সময় আর কাটে না। একা একা ঘুরে বেড়াতেও ইচ্ছে করে না। মামদোর কথা ভাবে। তার দেশের কত গল্প শোনাত, বিশেষ করে বিয়েবাড়ির গল্প। মামদোর দেশে নাকি বিয়ে হয় দিনক্ষণ মেনে। শীতকালে মাঘ মাসটা বিয়ের মাস। মাঘ মাস পড়লেই একের পর এক বিয়ে লাগে। সানাইয়ের সুর আর রজনীগন্ধার গন্ধে মাতাল হয় চারপাশ। তার সঙ্গে ভালোমন্দ খাবার। ভেবেই মামদোর মন চঞ্চল। বেশিদিন তো ধরাধাম ছেড়ে আসেনি! বিয়েবাড়ির নেমন্তন্ন মামদো নাকি পারতপক্ষে বাদ দিত না।
ফিক করে হেসে সে জিজ্ঞেস করেছিল, "তা তুমি নিজে বিয়ে করলে না?"
লজ্জায় মামদোর গালের সাদা হাড়ে লালের ছোপ লেগেছিল, "নাঃ, কে দেবে বিয়ে? মা নেই, বাবা ছোটবেলায় মরেছে। থাকার মধ্যে এই এক মামা। তার কাছেই তো এসেছিলাম। শখ ছিল, এদেশটা একটু ঘুরেটুরে দেখেশুনে নিই, তারপর ফিরে গিয়ে নাহয়..."
মায়া হয়েছিল তার। মানুষের কত ছোট ছোট সাধ, আশা অপূর্ণ থেকে যায়। মামদোর কপালটাই খারাপ। এপারে এসে যাও বা একটা মনের মানুষ পেল, সেও শুধু মুখঝামটা দেয়! নাহলে কি মামদো এই গোটা পৃথিবীটা ডিঙিয়ে দেশে যাবার কথা ভাবত?
চোখের কোটর থেকে টুপ টুপ করে দুফোঁটা জল আপনিই ঝরে পড়ে। আজ এপ্রিল মাসের পিঙ্ক মুন। বসন্তের প্রথম পূর্ণিমা। বিরাট চাঁদ উঠেছে আকাশ জুড়ে। প্রথম বসন্তের এই সময় অনেক গোলাপি রঙের ফুল ফোটে। গোলাপি চেরি ফুটছে, গোলাপি পিচ আর প্লামফুলে ভরে গেছে গাছ, গোলাপি ফ্লক্স মাথা দোলাচ্ছে। ফুলের ওপর চাঁদের আলো পড়ে গোলাপি আভা ছড়ায়, তাই পিঙ্ক মুন।
হঠাৎ কানের কাছে চেনা গলার ফিসফিস, "এনেছি।"
বিষম চমকে ওঠে সে। আর একটু হলেই ডাল থেকে পড়ে যাচ্ছিল প্রায়। আকাশপাতাল ভাবছিল, খেয়ালই করেনি কখন মামদো এসে নিঃশব্দে পাশে বসেছে। ওঃ, অ্যাদ্দিনে ফেরার সময় হল বাবুর! বুকে অভিমান উথলে ওঠে, লুকিয়ে ফেলে সে ঝামরে ওঠে, "হোয়াট ননসেন্স! ইউ স্কেয়ারড মি!"
"আবার ইঞ্জিরি বলে! মেম-পেত্নির সঙ্গে প্রেম করার এই ঝামেলা!"
"কে বলেছিল সাতসমুদ্র উজিয়ে আমার পেছনে পড়তে? দেশ থেকে ফেরারই বা দরকার কী ছিল? একটা খবর নেই, সাড়াশব্দ নেই..." তার গলা ধরে আসে।
"আহা, রাগো কেন? এই দ্যাখো, হাতে কী।"
মামদোর হাতে ছোট্ট একটা কৌটো। রুপোর ওপর সূক্ষ্ম কারুকাজ করা। অনেকটা গ্র্যান্ডমার ওয়েডিং রিঙের বক্সটার মতো দেখতে। বহু পুরোনো জিনিস, দেখতেও বড় সুন্দর। বাড়ি থেকেই এনেছে নিশ্চয়ই।
কৌতূহলে চেয়ে দেখে, "কী এটা?"
"সিঁদুরকৌটো।"
পুট করে চাপ দিতেই ডালাটা খুলে যায়। কৌটোর মধ্যে লাল রঙের গুঁড়ো! এ আবার কী? ড্রাগ-ট্রাগ নাকি? মামদো শেষে এমন অধঃপাতে গেল? কড়া চোখে মামদোর দিকে তাকায়।
মামদো ঘাবড়ে গেছে, “আরে কী মুশকিল, বিয়েবাড়ির গল্প শোনালাম এত, মনে নেই? সেই যে কনের সিঁথির ওপর দিয়ে লম্বালম্বি লাল সিঁদুর পরিয়ে একসঙ্গে থাকার শপথ নেওয়া - তুমিই তো শুনে বললে, 'হাউ রোম্যান্টিক'!"
ঝট করে মনে পড়ে গেছে, ওহো, তাই তো? সিঁদুর-পরা কনেকে ভারি মিষ্টি লেগেছিল। সেই সিঁদুরের এত সুন্দর কৌটোটা তার জন্যে এনেছে মামদো? সাত সাগরের পার থেকে? সন্দেহ নেই, মামদো তার প্রেমের দাম দিয়েছে। নিমেষে মন খুশি, আহ্লাদে ছলছলিয়ে উঠেছে। তাকেও কনে বৌ সাজলে নিশ্চয়ই মন্দ লাগবে না।
"পরিয়ে দিই তাহলে?" লজ্জা লজ্জা গলায় মামদো শুধোয়।
আরো লজ্জা পেয়ে সে মাথা নিচু করে। ঠিক কনে বৌটিরই মত। ফুটফুটে চাঁদ হাসছে আকাশে। অস্থির সময় কেটে গেছে, পৃথিবী শান্ত, নির্ভয়। আজ আর সে ‘না’ বলবে না।
কাঁপা কাঁপা হাতে মামদো কৌটো থেকে সিঁদুর নিয়ে তার কপালে লেপে দেয়।
সঙ্গে সঙ্গে মসৃণ সাদা খুলির কপাল থেকে সিঁদুর পিছলে পড়ে যায় নিচে।
এ কী? এ তো হিসেবের মধ্যে ছিল না? দুজনেই চমকে উঠেছে।
যতবারই চেষ্টা চালায়, একই ফল। মামদোর মুখ শুকিয়ে আমসি। তারও মুখ আঁধার। এত শখের জিনিস, পরা যাবে না? এই প্রথম তার এপারে আসার জন্যে কষ্ট হচ্ছে। মানুষের চেহারাখানা থাকলে সেও কনের সাজে সাজত। দেখতে তো তাকে মন্দ ছিল না! চোখের গর্ত উপচে উপচে জল আসছে, এমন সময় পাশের মেপলগাছ থেকে কে যেন হইহই করে উঠল, "আরে দাঁড়াও, দাঁড়াও! সবুর করো একটুখানি।"
থমকে গেলেও সে চেঁচায়, "হোয়াট ননসেন্স, হু আর ইউ?" মেজাজ সত্যিই খারাপ।
সড়াৎ করে সামনে আসে মেকআপভূত। কলকাতারই ছেলে, টালিগঞ্জের নায়িকার মেকআপ করত। মরার পর হলিউড ঘুরতে এসেছিল, আজীবনের সাধ। হলিউড দেখেটেখে এবার নিউ ইয়র্কে ব্রডওয়ে থিয়েটার দেখতে এসেছে। তাছাড়াও রেডিও সিটি রকেট শো, আরও নানা এটা-সেটা। সাধ মিটিয়ে নেবে। আপাতত আশপাশেই ছিল, বিয়ের আসর বসেছে দেখে লোভ সামলাতে পারেনি, দেখতে এসেছে। তারপর দেখে এই কাণ্ড! বরকনে দুজনেই চুপসে গেছে।
সব দেখেশুনে এবার হাল ধরে, "লিকুইড সিঁদুরের কথা শুনেছ? আছে আমার কাছে। ওই দিয়েই তো মেকআপ কত্তুম। কত্ত হিট সিনেমা সব, 'সিঁদুর নিও না মুছে', 'সিঁদুরের দিব্যি', সিঁদুর নিয়ে খেলা'! কী দিন ছিল সে সব!"
"লিকুইড সিঁদুর?" পেত্নি অবাক হয়ে শুনছে, "সে আবার কী?"
"সিনেমার সিঁদুর গো, খুব পয়মন্ত। কত সিনেমা যে হিট করেছে এই সিঁদুরের গুণে!" বলতে বলতে ভোজবাজির মত মেকআপভূত বার করে আনে ছোট্ট লম্বামত একটা শিশি।
"কোত্থেকে পেলে?" সে আরও অবাক! এই না মামদো কত দৌড়োদৌড়ি করে তবে সিঁদুরকৌটো জোগাড় করল?
"মেকআপের বাক্সটা সঙ্গে করে নিয়ে এসিছি। এপারে যদি কারোর কাজে লাগে।" মেকআপভূতের গলাটা কেমন লজ্জা লজ্জা।
"কাজে লাগবে না মানে? একশো বার লাগবে! ঠিক করেছ নিয়ে এসে। কী বুদ্ধি গো তোমার? কই, দাও দেখি..." মামদো হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে।
মেকআপভূতের থেকে লিকুইড সিঁদুরের শিশি নিয়ে মেম-পেত্নির খুলির ওপর লম্বা তুলির টান দেয়।
"এই তো, বাহ, দিব্যি দেখাচ্ছে।" মেকআপভূত বলে, "খুলির সিঁদুর অক্ষয় হোক।"
নববধূর লজ্জায় মেম-পেত্নি খুলি নামায়।
চারদিক শুনশান। কার্ডিনাল কত্তাও আজ চুপচাপ। ও হরি, বৌ কাছে এসেছে। বসেছে পাশটিতে। তাই ডাকাডাকি সব বন্ধ।
আকাশে চাঁদ গোলাপি আলো ছড়িয়ে চলে।