দোলের দিন সকালে আমি আর অধীরদা সস্ত্রীক গোপালপুর এসে পৌঁছেছি। কাল রাতে ট্রেনের দুলুনিতে অন্তত আমার ঘুমটা ভালই হয়েছিল বলতে হবে, ব্রেকফাস্ট সেরে নিজেদের মধ্যে সামান্য আবির খেলা হল, আমাদের চারজনেরই দোল খেলায় বিশেষ একটা উৎসাহ নেই, বয়সের ধর্ম কি না জানি না। একসময় আমি তো বেশ চুটিয়ে দোল খেলেছি, এখন এই মধ্য চল্লিশে এসে অনেক ভাললাগার গতিপথই বদলে গেছে, পুরনো অনেক ভাললাগা নতুন ভাললাগাদের জায়গা ছেড়ে দিয়ে সরে গেছে, শুধু রহস্য কাহিনির নেশাটা চৌদ্দতে যা ছিল, চুয়াল্লিশেও তাই আছে। আর কাহিনিটি যদি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দা চূড়ামণি মাইক ব্রিয়ারলির তদন্ত কাহিনি হয় এবং সে অমৃত রস ভাগ করে নেওয়ার জন্য সঙ্গে থাকেন অধীর বাগচীর মতো রহস্য রোমাঞ্চ গল্পের এনসাইক্লোপিডিয়া, তবে তো কথাই নেই। তা অধীরদার সোদপুর স্টেশনরোডের বাড়ির বৈঠকখানা হোক অথবা গোপালপুরের হোটেলের ঘর।
সি বিচ থেকে সকলে এক চক্কর ঘুরে এলাম, এখানকার সাগরের জল সত্যিই নীল, বিচও বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, রাতেও একবার সমুদ্রতীরে আসার ইচ্ছে আছে, কালকে সাইট সিয়িং-এ যাব তারা-তারিণি মন্দির আর চিলিকা। রোপওয়ে চড়াটাই তারা-তারিণি মন্দিরে যাওয়ার প্রধান আকর্ষণ। পরশু সমুদ্রস্নান করে রাতের ট্রেনে ফের কলকাতা অভিমুখে যাত্রা। অধীরদা আগেই বলে রেখেছিলেন ডাবলিনের রহস্য রোমাঞ্চ পত্রিকা, ‘দি ইনভেস্টিগেটরের’ লেটেস্ট কপিটা গত পরশুই ডাকযোগে এসে পৌঁছেছে অধীরদার ঠিকানায়, আর সেই সংখ্যার মাইক ব্রিয়ারলি কাহিনি আমরা কৃপণের মতো বাঁচিয়ে রেখেছি এই গোপালপুর ভ্রমণের জন্য। তাই, আমাদের দু’জনের আর তর সইছিল না, তড়িঘড়ি হোটেলে ফিরে দু’জনে অধীরদার ঘরে বসেছি, ‘দি ইনভেস্টিগেটর’ খুলে, সামনে টেবিলে হোটেল কর্তৃপক্ষের সরবরাহ করা ধূমায়িত কফি, চিকেন পকোড়া। গিন্নিরা এইসব খুনোখুনি, চোর-ডাকাতের গল্প মোটেই পছন্দ করেন না, তবে তাঁরা বেড়াতে আসার আনন্দে মশগুল আছেন এবং দু’জনে অন্য ঘরে গুলতানি করছেন, সেটা ওঁদের স্বামীদের ধারাবাহিক অপদার্থতা নিয়ে হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। যাইহোক, এ দিকে অধীরদা পত্রিকা খুলে সূচীপত্র দেখে মাইক ব্রিয়ারলির সাম্প্রতিক তদন্ত কাহিনি খুলে ফেলেছেন, দেখা যাক মাইক এবং তার সহকারী অ্যান্ড্রিউ রবার্টসন এ বারে কী খেলা দেখান।
২)
প্রেস কনফারেন্স শেষ হয়েছে প্রায় আধ ঘণ্টা হয়ে গেল, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দা চূড়ামণি মাইক ব্রিয়ারলি তখনও নিজের ঘরে বসে সহকর্মীদের কাছে মন দিয়ে নিজের ঢাক নিজে পেটাচ্ছেন, তাতে বিস্তর জল মেশাচ্ছেন বটে তবে তা তিনি মেশাতেই পারেন, কেননা গত কালই তিনি ব্রিক্সটনের স্কুল শিক্ষিকা জুডি হাডসনের নৃশংস হত্যা রহস্যের সমাধান করে ফেলেছেন, আর সেইজন্যেই আজ বিকেলে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের বড়কর্তা টনি অ্যাডামস সাংবাদিক সম্মেলন ডেকেছিলেন, সেখানে যথারীতি স্বভাবসিদ্ধ নাটকীয় ভঙ্গিমায় নিজের এবং তাঁর সহকারী অ্যান্ড্রিউ রবার্টসনের কৃতিত্ব জাহির করলেও তদন্তের সাফল্যর পিছনে বড়কর্তা মি. অ্যাডামসের সুযোগ্য নেতৃত্বের কথাও বলতে ভোলেননি, বড়কর্তাকে সুযোগ পেলেই তৈলমর্দন করবার সুযোগ কখনই ছাড়েন না গোয়েন্দা প্রবর।
এখন নিজের চেম্বারে বসে তারই রেশ টেনে চলেছেন রংচং চড়িয়ে, ছিটেফোঁটা কৃতিত্বের ভাগ রবার্টসনকেও দিচ্ছেন বলে রবার্টসনও সেই রং মেশানো জলের ধারা উপেক্ষা করছিল। ব্রিয়ারলি সাহেব তখন যদি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারতেন যে সাংবাদিক সম্মেলন শেষ হওয়ার পরে তাঁর ফোনে সাত-সাতটি মিস কল জমে গেছে, আর তার সবকটিই তাঁর সুন্দরী মুখরা ধর্মপত্নী লিলিয়ান ব্রিয়ারলির করা, তবে মোবাইল ফোনটি সাইলেন্টে রেখে, আসর জমানোর নিজস্ব সিদ্ধান্তকে কিছুতেই স্বাগত জানাতে পারতেন না। টনক নড়ল, যখন রবার্টসনের কাছ থেকে জানতে পারলেন তাকে না পেয়ে লিলি, রবার্টসনের মোবাইলে কল করে তাঁর ফোন না ধরার কারণ জানতে চাইছে। ধুরন্ধর গোয়েন্দা অভিজ্ঞতা থেকেই জানেন, সহকর্মীদের সামনে এই মুহূর্তে লিলির সঙ্গে ফোনালাপ তাঁর পক্ষে খুব সম্মানজনক হবে না, তাই তিনি ঘর থেকে ছিটকে বেরোলেন। তবে যতটা ঝড় সামলাতে হবে ভেবেছিলেন, তার থেকে লিলির কণ্ঠে অনেক বেশি উৎকণ্ঠা টের পেলেন।
পার্কিং লটের দিকে এগোতে এগোতে রবার্টসনকে বললেন, “আপাতত একটা বেসরকারি তদন্ত, এমনকি তদন্তের কিছু আছে কি না তারও ঠিক নেই, যদি কিছু থাকে তবে সরকারিভাবে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড হয়তো কেসটা হাতে নেবে। লিলির এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবী আমার সাহায্য চেয়ে লিলির অফিসে এসেছিল, লিলি ওর বান্ধবীকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে এসেছে, আর তাই ফোন করে আমাকেও ফিরতে অনুরোধ করল আর কী। সরকারিভাবে তাই আমি তোমায় আমার সঙ্গে যেতে বলছি না, তবে উৎকৃষ্ট কফি আর রাতের খাবার খেতে তুমি আমার বাড়ি আসতেই পারো।”
রবার্টসন একটা হাড় জ্বালানো খিঁক খিঁক হাসি হেসে বলল, “বস, বলুন ম্যাডামের আদেশে আপনি পড়িমরি করে বাড়ি দৌড়োচ্ছেন, আর টেনশনের চোটে নিজেই ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসেছেন। আমি সঙ্গে থাকলে আপনি কবে আবার নিজে গাড়ি চালিয়েছেন? সরুন, আমাকে গাড়ি চালাতে দিন, টেনশন নিয়ে গাড়ি চালানো মোটেই উচিত হবে না।”
৩)
অধীরদা বললেন, “অতনুদা, গল্প শুনতে গিয়ে কফি তো ঠান্ডা করে ফেললেন, আর সমুদ্রের ধারে বেড়াতে এসে চিকেন পকোড়াটা একদম অসহ্য লাগছে।” অগত্যা আমাকে গা ঝাড়া দিতে হল, পমফ্রেট মাছ ভাজা আর একপ্রস্থ কফির অর্ডার দিয়ে এসে বললাম, “অধীরদা ব্যাপারটা কী বলুন তো? মিসেস ব্রিয়ারলি কী জন্য এমন তড়িঘড়ি মাইক ব্রিয়ারলিকে তলব করলেন? তাঁর এই বান্ধবীটাই বা কে?”
অধীরদা একটা বালিশ কোলের ওপর টেনে নিয়ে বললেন, “সেই কথাতেই আসছি। এই ঘটনার সূত্রপাত গত অগস্ট মাসে মানে ২০২১-এর অগস্টে, স্কটল্যান্ডের রাজধানী এডিনবরা শহরে।” আমি বললাম, “সেই সময় তো এডিনবরাতে বিখ্যাত, ‘ফ্রিঞ্জ’ ফেস্টিভ্যাল হয়। যেটা নাকি পৃথিবীর সবথেকে বিখ্যাত আর্ট ফেস্টিভ্যাল। কী হয় না সেই মেলায়! নাচ, গান, অভিনয়, পেন্টিং, সার্কাস। তিন সপ্তাহ ধরে সে এক মহাযজ্ঞ, পৃথিবীবিখ্যাত শিল্পী থেকে আনকোরা নতুন শিল্পী, সকলেরই সে এক মহাসমারোহ বলা যায় এই ফ্রিঞ্জ উৎসবকে। একবার নাকি এডিনবরা আর্ট ফেস্টিভ্যালে আটখানা থিয়েটার দল বিনা আমন্ত্রণে এসে উপস্থিত হয় এবং মূল অনুষ্ঠান অডিটোরিয়মের বাইরের প্রাঙ্গণে নিজেদের থিয়েটার শো করে, সেই থেকে এই উৎসবের নাম হয়ে যায়, ফ্রিঞ্জ উৎসব।”
অধীরদা বললেন, “হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন। মিসেস ব্রিয়ারলির স্কুলজীবনের বান্ধবী সোফিয়া ক্রসের ছেলে, জেরেমি ক্রস তাঁর স্ত্রী অলিভিয়া ক্রস এবং সোফিয়ার স্বামী ডানকান ক্রস এই তিনজনে মিলে গেছিলেন ফ্রিঞ্জ উৎসবে অংশ নিতে। ডানকান এবং জেরেমি বহু বছর ধরে ফ্রিঞ্জ উৎসবে যাচ্ছেন। সোফিয়াও সাধারণত তাদের সঙ্গে যান, এ বার কাজের চাপে যেতে পারেননি। জেরেমির সঙ্গে অলিভিয়ার বিয়ে হয়েছে প্রায় আট মাস আগে, সেও এইবার বাবা, ছেলের সঙ্গ নিয়েছিল। ডানকান একসময় শখের থিয়েটারে অভিনয় করতেন, পরে কর্মব্যস্ততায় সেই শখ বজায় রাখতে না পারলেও থিয়েটারের প্রতি ভালবাসায় ভাটা পড়েনি, প্রত্যেক বছর সেই টানেই জেরেমি এবং সোফিয়াকে সঙ্গে করে চলে যেতেন এডিনবরার আর্ট ফেস্টিভ্যালে। নিজের লেখা নাটকে অভিনয় করতেন স্বামী, স্ত্রী এবং পুত্র মিলে। জেরেমির আর কোনোদিন ফ্রিঞ্জ উৎসবে আসা হবে না, কেননা উৎসব শুরুর আগের দিন দুপুর বেলায় হোটেলে ঘুমের মধ্যেই বছর ছাব্বিশের এই যুবক মারা যায়, মৃত্যুর কারণ হার্ট অ্যাটাক। সোফিয়া ক্রস মনে করছেন তাঁর ছেলের মৃত্যু স্বাভাবিক নাও হতে পারে। সেই ভাবনায় কিছু সারবত্তা আছে, না তা কেবল একজন শোকাতুর মায়ের কষ্টকল্পনা, সেটাই মাইককে খতিয়ে দেখতে হবে।
মাইক ব্রিয়ারলি আর রবার্টসন এত ক্ষণে মাইকের নর্থ গ্রীনউইচের অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছে গেছে, সেখানে সোফিয়া ক্রস মাইকের জন্য অপেক্ষা করছেন, আমরা বরং মাইকের বসার ঘরে ঢুকে পড়ে সেই কথোপকথনে কান পাতি।”
৪)
সোফিয়া ক্রসের বয়স পঞ্চাশের আশপাশে হবে, তিনি এই বয়সেও অসম্ভব সুন্দরী, পুত্রশোকের যন্ত্রণাও সেই সৌন্দর্যকে ম্লান করতে পারেনি।
সোফিয়া স্কুলে মিসেস ব্রিয়ারলির থেকে কয়েক বছরের সিনিয়র ছিলেন, একবার স্কুল থেকে একটা এক্সপিডিশনে গিয়ে দু’জনের মধ্যে বন্ধুত্ব শুরু হয়। মাঝে যোগাযোগ নষ্ট হয়ে গেলেও বছর পাঁচেক আগে ফেসবুকের মাধ্যমে দু’জনের আবার যোগাযোগ হয়। এমনকি লিলি, জেরেমির বিয়ের রিসেপশনেও গেছিলেন, কাজের চাপে মি. ব্রিয়ারলির আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি।
সোফিয়া যে একটু আগেও কান্নাকাটি করছিলেন তা তাঁকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
মাইক সোফিয়াকে বললেন, “আপনার ছেলের মৃত্যু তো হয়েছে বলছেন অগস্টের পাঁচ তারিখে, আপনার হঠাৎ এগারো তারিখে এসে কেন মনে হচ্ছে এ মৃত্যু অস্বাভাবিক?”
সোফিয়া বললেন, “ডানকানের ফোনটা যখন আসে তখন আমি মাদ্রিদে, নিজের একমাত্র সন্তানের আকস্মিক মৃত্যুসংবাদ যে একজন মায়ের কাছে কী নিদারুণ হয়ে নেমে আসতে পারে তা হয়তো আপনি আন্দাজ করতে পারেন। আমার তখন চিন্তাশক্তি লোপ পাওয়ার অবস্থা। মাদ্রিদ গেছিলাম অফিসের একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে অংশ নিতে, তড়িঘড়ি অফিসে সব বুঝিয়ে বলে, ফ্লাইট ধরে লন্ডনে ফিরে আসি। জেরেমিকে তত ক্ষণে লন্ডনে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। আমি আসার পর, ফুলহ্যামে জেরেমির পূর্বপুরুষরা যে গোরস্থানে শুয়ে আছেন, সেখানেই ওকে কবরস্থ করা হয়েছে। ডানকান কিন্তু জেরেমির বায়োলজিকাল ফাদার নয়, জেরেমির বাবা লুকাস ব্রড যখন মারা যায় তখন জেরেমির সাত মাস বয়স। লুকাসেরও মৃত্যু হয়েছিল হার্ট অ্যাটাকে, তখন তার তিরিশ বছর বয়স। লুকাসের এক দাদাও হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছিল, ওদের বাবাও তাই। ওই বংশে কোনও পুরুষই বোধহয় চল্লিশের গণ্ডি পেরোয়নি। লুকাস ঠাট্টা করে বলত, আমরা বুড়ো হওয়া পছন্দ করি না, সেটা সত্যি হয়ে যাবে কে জানত!
তার বছর দেড়েক বাদে আমি ডানকান ক্রসকে বিয়ে করি। জেরেমি ডানকানের পদবিই ব্যবহার করত, বাবা হিসেবে ও ডানকানকেই চিনেছিল। ডানকানকে বিয়ে করার সময় আমি শর্ত দিয়েছিলাম যে আমাদের আর বাচ্চা হবে না। ডানকান তখন সেটা মেনে নিয়েছিল। জেরেমি নাটকের নেশা পেয়েছিল ডানকানের কাছ থেকে, জেরেমির ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার হওয়া ডানকানকে দেখে। জেরেমিদের বংশের হার্ট অ্যাটাকের ইতিহাস আমাকে শুরুতে অন্য কিছু চিন্তা করতে দেয়নি, প্রথম তিনটে দিন যে কীভাবে কেটে গেছে, জেরেমির সারাজীবনটা ছায়াছবির মতো, খালি মনের পর্দায় ভেসে উঠছিল। একটু ধাতস্থ হওয়ার পর থেকে কিন্তু একটা সামান্য ব্যাপার আমাকে এখন খুব ভাবাচ্ছে, আমার ছেলে সারাজীবনে কোনোদিন দুপুরে ঘুমোয়নি, সেই ছেলে তার প্রাণের উৎসবে গিয়ে দুপুর বেলায় ঘুমিয়ে পড়ল! জেরেমি নাকি সেদিন দুপুরের খাওয়ার পরে বেলা একটা নাগাদ বলে, সে একটু ঘুমিয়ে নিতে চায়, অলিভিয়া যেন একাই ডানকানের ঘরে গিয়ে রিহার্সাল সেরে নেয়। ঘণ্টা খানেক বাদে, অলিভিয়া রিহার্সাল শেষে ঘরে ফিরে এসে তখনও জেরেমিকে ঘুমোতে দেখে ডাকাডাকি করে, সেই ঘুম আর ভাঙেনি। জেরেমি ডানকানের মতই অভিনয় নিয়ে অসম্ভব খুঁতখুঁতে, যেখানে তার পরের দিন পারফর্ম করার কথা, সেখানে রিহার্সাল না করে সে ছেলে ভরদুপুরে শুয়ে পড়ল, আর উঠল না! হার্টের সমস্যা জেরেমিরও ছিল, তার জন্য ওষুধ খেত, কিন্তু সেদিন তার খুব শরীর খারাপ ছিল বলে কেউ বলেনি। লন্ডন থেকে আগের দিন সকালে ট্রেনে চার ঘণ্টা সফর করে এডিনবরার ওয়াভেরলি স্টেশনে পৌঁছে দিব্যি আমাকে ফোন করে বলল, আমাকে মিস করবে। শারীরিক সমস্যা কিছু হলে আমাকে নিশ্চয়ই বলত। জেরেমি-অলিভিয়ার ফ্ল্যাট, ফুলহ্যামে আমাদের বাড়ি থেকে গাড়িতে দশ মিনিটের রাস্তা, সপ্তাহে একদিন অবশ্যই আমাদের দেখা হত আর ফ্রিঞ্জ উৎসব যত এগিয়ে আসত, তখন তো প্রায় রোজই আমরা একসঙ্গে রিহার্সাল করতাম। এ বার তার অন্যথা হয়নি, আমি শেষ মুহূর্তে অফিসের কাজে আটকে গেলাম আর ছেলেটাকেই হারিয়ে ফেললাম। মনে হচ্ছে এই দুপুরে জেরেমির শুতে যাওয়াটা বেশ অস্বাভাবিক।
পুলিশকে আমার ধারণার কথা বললে হয়তো আমাকে পাগল ঠাওরাবে, তাই আপনার শরণাপন্ন হয়েছি। আপনার এত খ্যাতি, আপনি তদন্ত করে যদি কিছু না পান, তবে শান্তিই পাব হয়তো, নয়তো সারাটা জীবন বড় যন্ত্রণায় কাটবে।”
মাইক বললেন, “আপনি নির্দ্বিধায় সব কথা বলুন। তুচ্ছ মনে করে কোনও কথা বাদ দেবেন না, সঙ্কোচবশত কোনও সম্ভাবনা এড়িয়ে যাবেন না। ডাক্তারকে যেমন কিছু লুকোন না, আমাকেও লুকোবেন না। মনে করুন আমি একজন অপরাধ জগতের ডাক্তার, তারপর ভেবে দেখব, সত্যি আপনার ভাবনার যথার্থ কারণ আছে, না তা অমূলক।”
৫)
আমি বললাম, “হুম, মাইক ব্রিয়ারলিকে অপরাধ জগতের জাদুকর বললেই যথার্থ বর্ণনা করা হয়, দেখছি তো একটার পর একটা কেস। তবে অধীরদা, দুপুরে কেউ সাধারণত ঘুমোত না বলে কখনই ঘুমোবে না, এমন তো কেনো কথা নেই। হয়তো জেরেমির শরীর খারাপ লাগছিল বলেই ঘুমিয়ে পড়েছিল, সে ঘুম আর ভাঙেনি। হোটেল কর্তৃপক্ষ যে ডাক্তার ডেকেছিলেন, তিনি কিছু গণ্ডগোল দেখলে স্বাভাবিক মৃত্যু বলে ডেথ সার্টিফিকেট দিতেন না, বডি পোস্টমর্টেমে পাঠিয়ে দিতেন। সে ক্ষেত্রে পুলিশ কেস হত। ডানকান এবং অলিভিয়া, পুলিশে কোনো অভিযোগ জানাননি, সোফিয়া নিজেও কবর দেওয়ার আগে জেরেমির মৃতদেহ দেখেছেন, কোনো অসঙ্গতি দেখলে নিশ্চয়ই সে কথা কাউকে বলতেন।” অধীরদা বললেন, “আপনার প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে, আমাকে এখন কাহিনির শেষ অবধি পড়ে যেতে হবে। এখন সেটা খুবই অসঙ্গত হবে, দুপুর দু’টো বেজে গেছে, এ বার লাঞ্চের জন্যে গাত্রোত্থান না করলে আমাদের গিন্নিরা ব্যাপারটা সুনজরে দেখবেন বলে মনে হয় না।”
গুরুভোজই হল যাকে বলে, সে বর্ণনা করে আর গল্পের কলেবর বৃদ্ধি করতে চাই না, তবে ওড়িশার অধিবাসীদের রান্নার প্রশংসা না করলে আমার মতো ঔদরিকের পক্ষে সেটা অকৃতজ্ঞতা হয়ে যাবে। খাওয়া সারার পর থেকেই আমি আর অধীরদা, ব্রিয়ারলি কাহিনিতে পুনরায় মনোনিবেশ করতে উদগ্রীব হয়ে পড়ছিলাম। দুই গিন্নিই বললেন, তাদের রাতে ট্রেনে ভালো ঘুম হয়নি। আমি আর অধীরদা কেবল ভোঁসভোঁস করে ঘুমিয়েছি; সুতরাং, এখন দু’জনে একটু দিবানিদ্রা দিতে চান। তাঁরা অন্য ঘরে ঢুকে দোর দিতেই অধীরদা, দা ইনভেস্টিগেটরের পৃষ্ঠা খুলে জিজ্ঞাসা করলেন, “কতদূর পড়া হয়েছিল যেন?” “ওই তো, যেখানে ব্রিয়ারলি, মিসেস সোফিয়া ক্রসকে বলছেন কোনো তুচ্ছ ঘটনাও বাদ না দিয়ে তাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ যা মনে আসে তাই জানাতে।” আমি খেই ধরিয়ে দিই। “ওঃ, হ্যাঁ’ বলে অধীরদা আবার শুরু করলেন।
সোফিয়া একটু ইতস্তত করতে লাগলেন, যেন কোথা থেকে শুরু করবেন ঠাহর করতে পারছেন না। সেটা লক্ষ করে মাইক বললেন, “আপনি বরং আমার কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দিন। সেদিন মি. ডানকান আপনাকে ফোনে কী ঠিক বলেছিলেন?” সোফিয়া বললেন, “ডানকান ফোন করে সেদিন বলল, ‘জেরেমি আর নেই সোফিয়া। হৃদয়ের অসুখেই জেরেমিকে চলে যেতে হল, এ বার নাটকটা বাতিল করে দিলেই বোধহয় ভালো হত।’ তারপর কী বলেছিল, কিছু বলেছিল কি না আর খেয়াল নেই, তখন কিছু বোঝার মতো অবস্থা আমার আর ছিল না।” মাইক জিজ্ঞাসা করলেন, “নাটক বাতিল করে দেওয়ার কথা ডানকান বললেন কেন?” সোফিয়া বললেন, “ডানকানের এ বারের নাটকের নাম ছিল, ‘হৃদয়ের অসুখ’, আর অন্তত আপাতদৃষ্টিতে হৃদয়ের অসুখেই জেরেমির মৃত্যু হয়েছিল, সেই কারণেই হয়তো ডানকানের মনে হয়েছিল, নাটকটা না করলেই ভালো হত। আসলে যখন ডানকান দেখল যে শেষ মুহূর্তে আমাকে অফিসের কাজে মাদ্রিদ যেতেই হবে, তখন ও নাটকটা বন্ধ করে দিতে চেয়েছিল। বলেছিল এমনিই ফ্রিঞ্জ উৎসবে ঘুরে আসবে। নাটকে নায়ক নায়িকার কয়েকটা রোমান্টিক দৃশ্য ছিল, তার মধ্যে একটা অন্তরঙ্গ চুম্বন দৃশ্য। তখন আর নতুন কাউকে এনে রিহার্সাল দেওয়ার সময় ছিল না, আমাদের নাটকের বাজেটও সীমিত, পেশাদার অভিনেত্রীকে নিতে হলে তাকে টাকাও দিতে হবে। ডানকানের নাটক সে সব মাথায় রেখেই লেখা হত। আমরা তিনজনেই অভিনয় করতাম, পুরোটাই যাকে বলে হোম প্রোডাকশন। অলিভিয়া তখন বলে, রোজ রিহার্সাল দেখে দেখে তার পার্ট মুখস্থ হয়ে গেছে, সে আমার বদলে অভিনয় করতে চায়। ডানকান পত্রপাঠ সে প্রস্তাব বাতিল করে দেয়। বলে, ছেলের বউয়ের সঙ্গে নাটকের প্রয়োজনেও রোমান্স করতে পারবে না। ওই দৃশ্যগুলো বাদ দিলে নাটকের আর কিছু থাকে না। জেরেমির সঙ্গে ডানকানের পার্ট বদলাবদলি করার সুযোগ নেই। জেরেমির চরিত্রটি ছিল একটি স্কুল ছাত্রের, গোঁফ দাড়ি কামালে জেরেমি সেই চরিত্রে দিব্যি মানিয়ে যেত, ডানকানের মতো মাচো মধ্যবয়সী পুরুষের পক্ষে সেটা অসম্ভব। অলিভিয়াই তখন জেদ করে, এত পরিশ্রম করে নাটক তৈরি করে বাতিল করার মানে হয় না। মেকআপ নিয়ে নিজের বয়স বাড়িয়ে, আমার জন্য নির্ধারিত চরিত্রে সে ঠিক মানিয়ে নেবে।
ফ্রিঞ্জ উৎসবে অংশ নেওয়ার ক্রস পরিবারের যে রেওয়াজ তাকে নষ্ট করা যায় না। অভিনয়টা অভিনয় হিসেবে নিলে কোথাও কোনো সমস্যা থাকবে না। আমিও তাতে সায় দিই। বাধ্য হয়ে ডানকান নিমরাজি হয়, তবে চুম্বন দৃশ্যটা নাটক থেকে বাদ দিয়ে দেয়। সত্যি কথা বলতে, ফ্রিঞ্জ উৎসবে অভিনয় না করার চিন্তা আমাদের পক্ষে একরকম অসম্ভব ছিল। জেরেমির পাঁচ বছর বয়স থেকে আমাদের ফ্রিঞ্জ উৎসবে যাওয়া শুরু। আমরা দু’দিন আগেই লং ড্রাইভ করে এডিনবরা পৌঁছে যেতাম। বহুবার আমরা এডিনবরা যাওয়ার পথে, আমাদের গাড়িকেই ব্যাকড্রপ বানিয়ে রাস্তাতেই থিয়েটার করেছি। তারপর তো উৎসবের সময় তিন সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন থিয়েটার দেখা, নিজেদের অভিনয় করা ছিলই। ফ্রিঞ্জ উৎসবে আমরা বরাবর ঘাঁটি গাড়তাম হোটেল ওয়েভারলিতে, এ বারও জেরেমিরা সেই হোটেলেই উঠেছিল। পুরো উৎসব শেষ না হলে আমরা ফিরতাম না, বলতে পারেন অগস্ট মাসটাকেই আমরা উৎসর্গ করেছিলাম থিয়েটারের জন্য, সব শেষ হয়ে গেল, আর কোনোদিন আমাদের ফ্রিঞ্জ উৎসবে যাওয়ার প্রবৃত্তি হবে না।”
ব্রিয়ারলি জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি বলছেন বরাবর আপনারা লং ড্রাইভ করে এডিনবরা পৌঁছোতেন, তা হলে এ বার ডানকানরা ট্রেনে গেল কেন?”
“কারণ, অলিভিয়ার মোশন সিকনেস আছে। দশ ঘণ্টার ওপর ড্রাইভ করে ওর পক্ষে এডিনবরায় যাওয়া অসম্ভব। বিশেষ করে গাড়িতে দীর্ঘ সফর অলিভিয়ার জন্য কষ্টকর। তার থেকে ট্রেনে চার ঘণ্টার যাত্রা সুবিধাজনক, তাও অলিভিয়াকে সেই জন্য ওষুধ খেতে হয়।”
মাইক জিজ্ঞাসা করলেন, “ডানকানের সঙ্গে জেরেমি, অলিভিয়া আর আপনার সম্পর্কের রসায়নটা কীরকম ছিল?” সোফিয়া বললেন, “জেরেমি ছোটবেলা থেকেই ডানকানের ন্যাওটা। আগেই বলেছি ওর নাটকের নেশা বা ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সবই ডানকানকে দেখে। ডানকানও হাতে ধরে জেরেমিকে সব শিখিয়েছে। সৎ বাবা-ছেলের সম্পর্কের টেনশন ওদের মধ্যে ছিল না। অলিভিয়া, আমাদের পরিবারের নতুন সদস্য, যদিও সে জেরেমির বান্ধবী হিসেবে আগেও আমাদের বাড়িতে এসেছে। অলিভিয়াও অল্প দিনেই ডানকানের ভক্ত হয়ে গেছিল। ইয়ং জেনারেশনের প্রতিনিধিরা সব সময়ই ডানকানকে পছন্দ করে। তাদের সঙ্গে মেশার, ডানকানের একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে।
নিজের ব্যাপারে বলব, ডানকানের মতো স্বামী পাওয়া সৌভাগ্যর ব্যাপার। ডানকান সুদর্শন, সৃষ্টিশীল, প্রেমিক, সংসারী; এক কথায় একজন নারী যা যা তার পুরুষের কাছে চায়, তার সব ডানকানের আছে। তবে ডানকানের একটা বড় দোষ হল, সে ওভারপসেসিভ, মাঝে মাঝে সেটা মাত্রা ছাড়ায়। ডানকানের ধারণা, মোটামুটি সব পুরুষই আমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। এখন আমার একান্ন বছর বয়স হয়ে গেছে, সেটা ওর খেয়াল থাকে না। আমার অফিসের সহকর্মী জোনাথন ক্যাডিক বড়জোর বয়সে জেরেমির থেকে দু’-তিন বছর বেশি হবে। সেও আমার সঙ্গে মাদ্রিদ যাচ্ছে শুনে ডানকান একেবারে ক্ষেপে গেল, বলল আমি নাকি ডুবে ডুবে জল খাচ্ছি, এর ফল ভাল হবে না, আমাকে পস্তাতে হবে।”
অধীরদা সিগারেট ধরাতে থামলেন, মৌজ করে ক’টা সুখটান দিয়ে বললেন, “কী মনে হচ্ছে অতনুদা? সোফিয়ার আশঙ্কা কি সত্যি? সে কি ডানকানের দিকে কোনো ইঙ্গিত করছে? ডানকান একে জেরেমির সৎ পিতা, তার ওপর ঈর্ষান্বিত পুরুষ অতি ভয়ঙ্কর এক প্রাণী, সে এমন অনেক কাজ করে ফেলতে পারে যার বুদ্ধিতে ব্যাখ্যা চলে না।”
আমি বললাম, “অধীরদা, ভুললে চলবে না, সোফিয়া কিন্তু ডানকান আর জেরেমির অত্যন্ত সুসম্পর্কের কথাই তুলে ধরেছেন। ডানকানের প্রতি তার সন্দেহ থাকলে, সেটা তিনি করতেন কি? জেরেমির অকালমৃত্যুতে সোফিয়া একটা যাকে বলে, কনফিউসড স্টেট অফ মাইন্ডে আছেন। এখনও পর্যন্ত জেরেমির মৃত্যু যে অস্বাভাবিক, তার কোনো ইঙ্গিত নেই।” অধীরদা বললেন, “না, আছে। মৃত্যুটা স্বাভাবিক হলে, দা ইনভেস্টিগেটরের সম্পাদক এই গল্প ছাপতেন না। এমনিতেই তো জানেন, ওরা তিলকে তাল করে মাইক ব্রিয়ারলির গল্পগাথা ছেপে লোকটাকে এক অলৌকিক শক্তির অধিকারী বানিয়ে ফেলেছে। তাতে ওদের স্বার্থ আছে, পত্রিকার কাটতি বাড়ে। কিন্তু, আপনার কী স্বার্থ আছে সেটা বুঝি না, ‘মাইক ব্রিয়ারলি’ নামটা শুনলেই আপনার চোখেমুখে একটা ভক্তিভাব জেগে ওঠে।” আমি খোঁচাটা হজম করলাম, তর্ক জুড়ে গল্প শোনায় ব্যাঘাত ঘটাতে আমি মোটেই চাই না, নয়তো অধীরদার ব্রিয়ারলি ভক্তি আমার থেকে কিছু কম নয়, আর তা নিয়ে দু’-চার কথা আমিও শোনাতে পারতাম।
৬)
খোঁচাটা দিতে পেরে অধীরদা বেশ প্রফুল্ল চিত্তে বললেন, “বুঝলেন অতনুদা, আপনার ব্রিয়ারলি সাহেব এখন মিসেস সোফিয়া ক্রসের ফেসবুক প্রোফাইল খুলে বসেছেন আর তাকে টুকটাক প্রশ্ন করছেন। আমরা বরং গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো শুনে নিই।”
“সোফিয়া, ডানকানদের এডিনবরা যাত্রার যা ছবি দেখলাম তা যথেষ্ট। এ বার আপনি আমাকে জেরেমির মৃতদেহের কিছু ছবি দেখান। ফেসবুকে শেষযাত্রার একটা ছবি অলিভিয়া পোস্ট করেছেন, সেটা কফিনবন্দী জেরেমির। আমার চাই ক্লোজআপ মৃতদেহের ছবি। ডানকান এবং অলিভিয়া অবশ্যই জেরেমির শেষ স্মৃতি হিসেবে সেরকম ছবি তুলেছেন। আপনি নিজেও মাদ্রিদ থেকে ফিরে জেরেমির শেষ শয্যার ছবি তুলেছিলেন কি?”
লিলিয়ান ব্রিয়ারলি এ বার বিরক্ত হয়ে তাঁর গোয়েন্দা স্বামীটিকে তীব্র ভর্ৎসনা করে বললেন, “মাইক, এত ক্ষণ আমি একটাও কথা বলিনি, তোমাকে তোমার কাজ করতে দিয়েছি, কিন্তু তুমি মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছ। তুমি একজন সদ্য পুত্রহারা মায়ের মানসিকতা বুঝতে একেবারেই অক্ষম। তাঁর কাছে সন্তানের মৃতদেহের ছবি চাইতে তোমার মানবিকতায় লাগল না? কী হাতিঘোড়া তুমি ওই ছবি দিয়ে মারবে জানি না, তবে সোফিয়ার বেদনা খুঁড়ে বার করতে তোমার হৃদয়হীন প্রশ্ন খুব কাজে এসেছে, সেটা বুঝতে পারছি।”
মাইক হতাশার ভঙ্গিতে বললেন, “বুঝলে রবার্টসন, আমাদের হল গিয়ে থ্যাঙ্কলেস জব। লোকে চোর-ডাকাতের সঙ্গে গোয়েন্দাকে খুব একটা তফাত করে না। আড়ালে ডাকে টিকটিকি বলে। এমনকি গোয়েন্দার অর্ধাঙ্গিনীও গোয়েন্দার কর্মপদ্ধতি সুনজরে দেখে না। একটু তোমার লিলি ম্যাডামকে বলো, ওঁর অনুরোধেই আমি মিসেস সোফিয়া ক্রসের সঙ্গে কথা বলছি, আর কেসটার মেরিট আছে কি না বোঝার জন্য জেরেমির মৃতদেহের ছবিও খুব প্রয়োজন। পুলিশের ফটোগ্রাফার ছবি তুললে আমি সোফিয়ার কাছে তা চাইতে যেতাম না; এ ক্ষেত্রে সেই সম্ভাবনা নেই। তাই আমি নিরুপায়।”
লিলি ফুঁসে উঠলেন, “থাক, আর রবার্টসনকে সালিশি মানতে হবে না। শুঁড়ির সাক্ষী মাতাল।” রবার্টসন বিড়বিড় করে বলল, “শালা, বুড়ো ছুঁচোর জন্য মাতাল বদনামও শুনতে হল। এসে থেকে এক কাপ কফি আর এক টুকরো কেক ছাড়া কিছু জোটেনি, এমনি ম্যাডামের মুড ঠিক নেই, তারপর বুড়ো ছুঁচো তাতে ধুনো দিল, রাতের খাওয়া জুটলে হয়।”
মাইক ব্রিয়ারলি, রবার্টসনের বিড়বিড়ানি লক্ষ করেই বোধহয় বললেন, “ঠিক আছে সোফিয়া, আপনি যদি জেরেমির শেষ স্মৃতি হিসেবে তাঁর মৃতদেহের কোনো ছবি তুলে থাকেন সেটা আমাকে হোয়াটসঅ্যাপ করে দিলেই হবে, সঙ্গে ডানকানরা এডিনবরায় গিয়ে ওদের যেসব ছবি পোস্ট করেছে; আর আপনাকে আঘাত দিয়ে থাকলে আমি দু:খিত।”
সোফিয়া বললেন, “আমি জেরেমির মৃতদেহের কোনো ছবি তুলিনি, ইচ্ছে করেনি। তবে ডানকান কয়েকটা তুলেছিল এডিনবরার হোটেলে, আমার মনে হয়েছিল ওই ছবি আপনার লাগবে, আমি আজ ডানকানের থেকে চেয়ে নিয়েছি। আপনার হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার দিন, আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি। আর, মি. ব্রিয়ারলি, আপনি আপনার কাজ করছেন, আমি আঘাত পাইনি, আমি চাই আপনি সত্য উদঘাটন করুন। জেরেমির মৃত্যু স্বাভাবিক হলে তো কথাই নেই, কিন্তু মৃত্যু অস্বাভাবিক হলে তার কারণ আমি জানতে চাই। লিলি, আমার বন্ধু হিসেবে এবং একজন মা হিসেবে আশঙ্কা করছে আমার মানসিক অবস্থা স্থিতিশীল নয়। কিন্তু আমি ঠিক আছি, আপনার আরও প্রশ্ন থাকলে আপনি করতে পারেন। দাঁড়ান, আগে ছবিগুলো পাঠিয়ে দিই, আপনি দেখে নিন।”
সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে ছবিগুলো দেখতে দেখতে মাইক জিজ্ঞাসা করলেন, “জেরেমির কি অ্যালার্জির ধাত আছে?” সোফিয়া বললেন, “একসময় ছিল,
ইদানীং ডিম আর চিংড়ি খাওয়া ছেড়ে দেওয়ার পর অ্যালার্জি বেরনো বন্ধ হয়ে যায়। কেন বলুন তো?”
“তেমন কিছু ব্যাপার নয়, হয়তো পাঁচ তারিখ জেরেমির দুপুরের খাবারের প্রিপারেশনে ডিম বা চিংড়ির কোনো মিশ্রণ ছিল। এইসব তারকাখচিত হোটেলের
খাবারের মেনু দেখে সবসময় বোঝা যায় না, ভেতরে কী বস্তু আছে।
ডানকান জেরেমির যে ছবি তুলেছেন তাতে জেরেমির হাতে অ্যালার্জির দাগ আছে।
চার তারিখ রাতে জেরেমির ফেসবুক পোস্টের ছবিতে অ্যালার্জির লক্ষণ নেই। আচ্ছা, অলিভিয়া মোশন সিকনেসের জন্য কী ওষুধ খায়? ওর কি ঠান্ডা লাগারও সমস্যা আছে?”
“অলিভিয়ার ঠান্ডা লাগার ধাত নেই। জেরেমির সঙ্গে বিয়ের পর তো দেখিনি।
মোশন সিকনেসের জন্য অলিভিয়া কী ওষুধ খায় নাম তো জানি না। না, দাঁড়ান বলতে পারব। আমাকে একবার কয়েকমাস আগে প্রেসক্রিপশন হোয়াটসঅ্যাপ করেছিল, ওষুধ আনার জন্য। আমার ফোনে হবে, পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
“অলিভিয়ার সঙ্গে জেরেমির কতদিনের পরিচয়?”
“জেরেমি আর অলিভিয়া দু’জনেই অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ছাত্র। জেরেমির ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং আর অলিভিয়ার বিভাগ ছিল সাহিত্য। ফাইনাল ইয়ারের সময় অক্সফোর্ডের গ্রন্থাগারে ওদের আলাপ হয়, সব মিলিয়ে বছর তিনেক হবে।”
“অক্সফোর্ডে ওদের কোনো কমন ফ্রেন্ডের ঠিকানা, ফোন নম্বর দিতে পারবেন?”
“অক্সফোর্ডে জেরেমিদের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের একটা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ আছে, অলিভিয়াদের লিটারেচার বিভাগেরও আলাদা গ্রুপ আছে, তবে জেরেমি আর অলিভিয়া কেউই খুব একটা সেখানে সক্রিয় ছিল না। ওদের মুখেই শুনেছি, এইসব গ্রুপে প্রথমদিকে খুব উৎসাহ থাকে, পরে সেসব থিতিয়ে যায়। তা ছাড়া জেরেমির সঙ্গে অলিভিয়ার আলাপ হয় ওদের ইউনিভার্সিটি পর্বের একেবারে শেষদিকে, সুতরাং আলাদা বিভাগের এই দুই ছাত্র-ছাত্রীর কমন ফ্রেন্ডের তালিকা খুব দীর্ঘ হওয়ার কথা নয়। আমি, ‘মিলি ব্রাইট’ নামের একটি মেয়েকেই জানি, যে ফুলহ্যামের বাসিন্দা হওয়ার জন্য জেরেমির পরিচিত, আবার অক্সফোর্ডে সে অলিভিয়ার বিভাগের ছাত্রী ছিল, সেই সুবাদে তাকে ওদের ইউনিভার্সিটির কমন ফ্রেন্ড বলা যায়। মিলি ব্রাইট, জেরেমির শেষকৃত্যে উপস্থিত ছিল। আমার কাছে ওর ফোন নম্বর আছে, দিয়ে দিচ্ছি।”
“ডানকান যে শখের নাটকে অভিনয় করতেন, সেইসময়ের নাটকের জগতের কোনো বন্ধুবান্ধব বা ওর সহঅভিনেতার খোঁজ দিতে পারেন?”
সোফিয়া বললেন, “ডানকানদের নাটকের দলের নাম ছিল, ‘ড্রামাটিক ড্রিম’। সেই দলের নাট্য পরিচালক, ‘জন টাফনেল’ ছিল ডানকানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, টাফনেলের সঙ্গে আমাদের এখনও যথেষ্ট যোগাযোগ আছে, জেরেমির শেষকৃত্যে টাফনেলও এসেছিল। আমি ওর ফোন নম্বর লিখে দিচ্ছি, টাফনেল থাকেও আপনার বাড়ির খুব কাছাকাছি। হেঁটে যেতে পারবেন।”
“আপাতত, আমার আর কোনো প্রশ্ন নেই। পরশু সন্ধ্যা অবধি আপনি যে আমার সাহায্য চেয়েছেন সেটা গোপন রাখুন, এর মধ্যে জন টাফনেল এবং মিলি ব্রাইটের সঙ্গে কোনোরকম যোগাযোগ করবেন না, এদের ফোন এলেও ধরবেন না, পরে যোগাযোগ করছি বলে মেসেজ করে দেবেন। পরশু সন্ধ্যায় আমরা আপনার বাড়িতে আসব, তখন তো সবাই জানতে পারবেই। যদি কেউ জেরেমির মৃত্যুর জন্য দায়ী হয়ে থাকে, তবে তাকে আগাম সতর্ক হওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার মানে হয় না। ডানকান এবং অলিভিয়াকেও সেদিন সন্ধ্যায় উপস্থিত থাকতে বলবেন, আশা করি সেদিনই আমি পরিষ্কার করে আপনাকে জেরেমির মৃত্যুর কারণ জানাতে পারব।”
অধীরদা একটা সিগারেট আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে, নিজেও একটা ধরিয়ে বললেন, “এখনও অবধি কী বুঝছেন অতনুদা?” আমি একটা সুখটান দিয়ে বললাম, “মাইক ব্রিয়ারলির চিন্তাভাবনার হদিশ কখনই পাওয়া যায় না, তবে তিনি যে ডানকান, অলিভিয়া এবং জেরেমির সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ করার জন্য তাদের বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন, সেটা পরিষ্কার। যদি ধরে নিই ডানকান এবং অলিভিয়াকে ব্রিয়ারলি সাহেব সন্দেহের চোখে দেখছেন, তাদের মোটিভ একেবারেই স্পষ্ট নয়। বস্তুত তাদের কোনো মোটিভ থাকার সম্ভাবনা অতিশয় ক্ষীণ। আপাতদৃষ্টিতে ক্রস পরিবারকে একটি সুখী, নিটোল পরিবার বলেই মনে হচ্ছে। ওদিকে ব্রিয়ারলি বলে দিলেন পরশুদিন সন্ধ্যায় মানে সোফিয়ার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎকারের পরের পরের দিন তিনি এই কেসের মেরিট আছে কি না বলে দেবেন, থাকলে অপরাধীর স্বরূপও তখন আমরা জানতে পারব। অভিজ্ঞতা থেকে জানি, মাইক ব্রিয়ারলির তদন্ত বিদ্যুৎগতিতে এগোয়। মাসের পর মাস একটা কেস নিয়ে পড়ে থাকার বান্দা তিনি নন। প্রেস্টন সিটির কেসটা আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে অধীরদা, একদিনের মধ্যে ওই ভয়ঙ্কর জোড়া রহস্য, ব্রিয়ারলি মীমাংসা করে দিয়েছিলেন। এই কেসে যদিও উলুবনে মুক্তো ছড়াচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে।” অধীরদা বললেন, “আমিও বিশেষ কিছু ধরতে পারছি না। চলুন দেখি আগে কী হয়।”
৭)
“রবার্টসন, আমরা কাল সকালে ট্রেনে এডিনবরা যাচ্ছি, লক্ষ্য হোটেল ‘ওয়েভারলি’। ওই হোটেলেই জেরেমিরা উঠেছিল। তুমি চট করে, টনি অ্যাডামস স্যারকে ফোনে ধরো, ওঁকে সব জানিয়ে রাখি। তারপর তুমি, জন টাফনেল আর মিলি ব্রাইটকে ফোন করে বলো, আমরা ওদের সঙ্গে দেখা করতে আসছি।”
রবার্টসন বলল, “বস, আপনার কী মনে হয় আগামী কাল অগস্টের বারো তারিখে, ফ্রিঞ্জ উৎসবের মাঝখানে সে ঘর এখনও খালি আছে? জেরেমিরা চার তারিখে হোটেলে চেক-ইন করেছে, পাঁচ তারিখে জেরেমির মৃত্যু হয়েছে, ছ’-তারিখ থেকে ফ্রিঞ্জ উৎসব চালু হয়ে গেছে। আমরা নিশ্চয়ই ঘরটা চেক করতে পারি, কিন্তু তাতে কোনো ক্লু পাওয়ার সম্ভাবনা নেই সেটা একটা বাচ্চা ছেলেও জানে।”
“রবার্টসন, তোমাকে কে বলল যে আমরা জেরেমি ক্রস যে ঘরে মারা গেছিল, সেটা পরীক্ষা করতে যাচ্ছি? আমরা যাচ্ছি হোটেল কর্তৃপক্ষ এবং হোটেলের রুম সার্ভিসের যেসব কর্মী জেরেমিদের ঘরে সার্ভিস দিয়েছে, তাদের সঙ্গে কথা বলতে। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড প্রধান, টনি অ্যাডামসের অনুরোধ এডিনবরা পুলিশ ফেলতে পারবে না, তারাই হোটেল কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে দেবে।”
জন টাফনেল, রবার্টসনকে জানালেন তিনি বাড়িতেই আছেন। দেখা গেল আলাপ না থাকলেও তিনি মাইক ব্রিয়ারলির চেনা মুখ। তাঁর প্রতিবেশী স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের দুঁদে গোয়েন্দাটির খ্যাতি সম্বন্ধে টাফনেল সাহেব সম্যক অবহিত, মিডিয়ার দৌলতে আজকাল কোনো খবরই চাপা থাকে না। ডানকান সম্বন্ধে মাইক ব্রিয়ারলি আর রবার্টসন তাঁর কাছে খোঁজ খবর নিচ্ছে জেনে সে অতিশয় অবাক হয়ে বলল, “অফিসার্স, কী ব্যাপার বলুন তো, ডানকান কি কোনো গণ্ডগোলে জড়িয়ে পড়ল? সে যে অতি সজ্জন ব্যক্তি।” মাইক বললেন, “আশঙ্কার কোনো কারণ নেই। মিসেস সোফিয়া ক্রস হচ্ছেন আমার স্ত্রী’র ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। তিনি মনে করছেন, ডানকান কর্মক্ষেত্রে একটা ষড়যন্ত্রের শিকার হতে চলেছেন। একটা উড়ো ফোনে কোনো একজন মহিলা তাকে আজকেই এই খবরটা জানিয়েছেন। আমার মনে হয় কেউ বদমাইশি করে এটা করেছে, তবু একবার খতিয়ে দেখে নিতে চাই ডানকানের তেমন কোনো শত্রু আছে কি না, তাই ওঁর অতীত জীবন সম্বন্ধে জানতেই আপনার কাছে আসা।”
টাফনেল বললেন, “ডানকান ক্রস একজন সুপুরুষ, দক্ষ নাট্যকার এবং অভিনেতা। অভিনয়কে পেশা করলে ডানকান নাম করতে পারত। কিন্তু নাটক ওর শখের জায়গা, ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে সাফল্য হয়তো পেশা নিয়ে অন্য কিছু ভাবার অবকাশ দেয়নি। তরুণ বয়সে শন কনারির সঙ্গে ডানকানের অসম্ভব চেহারার মিল ছিল, এখনও আছে।
যদিও ডানকান কখনও শন কনারির অভিনয় নকল করেনি। এমন সুদর্শন যুবকের প্রেমে সেই সময় অনেক যুবতী হাবুডুবু খেয়েছে। তাতে অনেক যুবক অখুশি হয়েছে। দু’-চারটে ছোটখাটো গণ্ডগোল হয়নি তাও নয়। একবার এক বিবাহিত মহিলা মঞ্চে উঠে ডানকানকে চুমু খেলে, সেই মহিলার স্বামীর সঙ্গে ডানকান হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়ে। ভদ্রলোক ডানকানকে খুন করে দেওয়ার হুমকি দেন, যদিও চুমু-কাণ্ডে ডানকানের কোনো দোষ ছিল না। কিন্তু সে তো বহু বছর আগের ঘটনা, স্বামী ভদ্রলোকের চেহারাও ভুলে গেছি। এতদিন বাদে সে বা অন্য কোনো ঈর্ষান্বিত পুরুষ কি ডানকানের ক্ষতি করতে চাইছে?”
মাইক বললেন, “কিছুই বলা যায় না। সোফিয়া কীকরে ডানকানের জীবনে এলেন?”
“ডানকানের অভিনয় দেখতে এসে অনেক মহিলা তাঁর প্রেমে পড়ে যেত। সোফিয়া যেদিন আমাদের শো দেখতে এল, সেদিন হিসেবটা উলটে গেল। আমার মনে আছে, দর্শকাসনের সামনের সারিতে বসে থাকা সোফিয়ার সঙ্গে শো শেষে আলাপ করার জন্য মেকআপ না তুলেই ডানকান দৌড়েছিল। ক্যাসানোভা ডানকানের সেটাই শেষ দিন, আর প্রেমিক ডানকানের শুরু। সোফিয়া কিন্তু ডানকানের থেকে বয়সে পাঁচ-ছয় বছরের বড়। ডানকান, আমার মতনই মধ্য চল্লিশের, আর সোফিয়া পঞ্চাশ পেরিয়েছে। ডানকান-সোফিয়ার বিয়েতে অনেক যুবতী হতাশ হয়েছিল মনে আছে। তবে কি তাদের কেউ শত্রুতা করতে পারে? এ ছাড়া তো আর কিছু খেয়াল করতে পারছি না।”
মাইক বললেন, “অনেক ধন্যবাদ। আপাতত আপনি ডানকানকে আমাদের সাক্ষাতের ব্যাপারটা জানাবেন না, তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে জানলে ডানকান অযথা মানসিক চাপে পড়ে যাবেন।”
ফুলহ্যামে মিলির অ্যাপার্টমেন্টে ব্রিয়ারলিরা যখন বেল বাজালেন, তখন ঘড়িতে রাত্রি সওয়া ন’টা বেজে গেছে। রবার্টসন আগেই ফোনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে রেখেছিল।
সুবেশা বছর সাতাশ-আঠাশের একজন যুবতী দরজা খুলে জানালেন, তিনিই মিলি ব্রাইট। মাইক প্রথমেই এত রাতে একজন মহিলাকে বিরক্ত করবার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন।
মিলি অবাক হয়ে ব্রিয়ারলিকে জিজ্ঞাসা করলেন, “স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড হঠাৎ আমার খোঁজ করছে কেন? আমি তো জেনেশুনে কোনো অপরাধ করিনি।”
মাইক ব্রিয়ারলি মিলিকে আশ্বস্ত করে বললেন, “ব্যাপারটা সেরকম কিছু নয়। আপনার বান্ধবী অলিভিয়ার মাদার ইন ল সোফিয়া ক্রস হচ্ছেন আমার স্ত্রী’র বান্ধবী। সোফিয়াকে আজকে একজন পুরুষ ফোন করে বলে, সে অক্সফোর্ডে অলিভিয়ার সহপাঠী ছিল। সে সোফিয়াকে সাবধান করে বলে, অক্সফোর্ডে তাদের সহপাঠীদের কেউ অলিভিয়ার ক্ষতি করতে চাইছে। স্বভাবতই এই ধরনের ফোন টেলিফোন বুথ থেকে করা হয়, নম্বর ট্রেস করে লাভ নেই। যে ফোন করেছিল, সে নিজের পরিচয় দিতে অস্বীকার করে, তাতে নাকি তার ক্ষতি হতে পারে।
সোফিয়ার নম্বর কোথা থেকে পেয়েছে তাও জানাতে চায়নি। অলিভিয়াকে সে ফোন করবে না, কারণ অলিভিয়া তার গলা চিনে ফেলতে পারে। বুঝতেই পারছেন, সোফিয়া সদ্য ছেলেকে হারিয়েছেন, তার ওপর এমন ফোন পাওয়ায় আতঙ্কিত হয়ে তিনি আমার সাহায্য চেয়েছেন। এখন আপনি যদি জেরেমি আর অলিভিয়ার অক্সফোর্ডের দিনগুলোর ওপর কিছু আলোকপাত করতে পারেন, তবে হয়তো কোনো সূত্র পাওয়া যেতে পারে। অলিভিয়ার সঙ্গে জেরেমির কীভাবে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, আর ওদের সঙ্গে কারও শত্রুতা ছিল কি না বললেই যথেষ্ট।”
“জেরেমি ছিল ফুলহ্যামে আমার প্রতিবেশী আর অলিভিয়া ছিল অক্সফোর্ডে আমার সহপাঠিনী। জেরেমি অক্সফোর্ডের ছাত্র হলেও ওর আর আমার বিভাগ ছিল স্বতন্ত্র। তবে আমার সঙ্গে জেরেমির যোগাযোগ ছিল, আমরা দু’জনেই ফুলহ্যামের আর পাঁচজন বাসিন্দার মতন ফুলহ্যাম ফুটবল ক্লাবের সমর্থক, আমরা একসঙ্গে অনেক খেলাও দেখেছি। অলিভিয়ার সঙ্গে জেরেমির আলাপ হয় অক্সফোর্ডের লাইব্রেরিতে, সেটা আমার মাধ্যমেই, একদিন আমি আর অলিভিয়া লাইব্রেরিতে বই নিতে গিয়ে দেখি জেরেমি বসে পড়াশোনা করছে, তখন আমি দু’জনের আলাপ করিয়ে দিই। সেটা ছিল আমাদের ফাইনাল ইয়ার, সকলেই পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত, ওদের মধ্যে সেই সময় কোনো বিশেষ সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করার পর, জেরেমি কয়েকবার অলিভিয়ার ম্যাঞ্চেসটারের বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়, তখন অলিভিয়া ওকে বিশেষ পাত্তা দিত না। অলিভিয়ার চেহারা খুব আবেদনময়ী, ইউনিভার্সিটিতে ওর অনেক বয়ফ্রেন্ড ছিল। অলিভিয়া অনায়াসে একসঙ্গে অনেককে ল্যাজে খেলিয়ে যেত।
প্রথমে আমি এ সব কিছুই জানতাম না। দু’বছর আগে জেরেমি বলে ওর বার্থডে পার্টিতে অলিভিয়াকে ইনভাইট করেছে, অলিভিয়া কোনো কথা দেয়নি। সুতরাং, আমিও যেন একবার ওর হয়ে অলিভিয়াকে আসতে অনুরোধ করি। তখনই জেরেমির অলিভিয়া প্রীতির কথা জানতে পারি। জেরেমির বার্থডে পার্টিতে আসার পর অলিভিয়ার মধ্যে একটা পরিবর্তন হয়, ওর সঙ্গে জেরেমির সম্পর্ক দানা বাধে। তারপর আট মাস আগে তো ওদের বিয়ে হল, সেই বিয়ের গন্ধ গা থেকে যাওয়ার আগেই জেরেমি চলে গেল! আর ইউনিভার্সিটিতে ওরকম সবারই দু’-চারটে বয়ফ্রেন্ড বা গার্লফ্রেন্ড থাকে। ওই নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। অলিভিয়ার বয়ফ্রেন্ডদের সংখ্যা হয়তো একটু বেশি ছিল, কিন্তু তাদের মধ্যে কেউ এখন অলিভিয়ার ক্ষতি করতে পারে বলে তো মনে হচ্ছে না। তেমন প্রেমিক হলে, সে অলিভিয়ার বিয়ের সময়ই বাগড়া দিত।”
ব্রিয়ারলি বললেন, “আমিও আপনার সঙ্গে একমত। কেউ একটা বদমাইশি করে সোফিয়াকে ভয় দেখাতে ফোনটা করেছে, অলিভিয়া নয় সোফিয়াই লক্ষ্য। আচ্ছা এই যে অলিভিয়ার জেরেমির বার্থ ডে পার্টিতে আসার পর একটা পরিবর্তন হল এবং জেরেমির প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া দিল, তার কী কারণ বলে আপনার মনে হয়? প্রেমে পড়ে যাওয়ার যদিও কোনো সময় বা কারণ লাগে না, তবুও—।”
মিলি বললেন, “হতে পারে জেরেমির মা-বাবাকে দেখে অলিভিয়ার পুরো পরিবারটাকেই ভালো লেগে গেছিল। ডানকান আর সোফিয়া খুবই সজ্জন মানুষ, ওরা সহজেই মানুষের মন জয় করতে জানেন।”
“আর জেরেমি মানুষের মন জয় করতে পারত না? আপনি নিজে কখনও জেরেমির প্রেমে পড়ে যাননি?” মিলি ব্রাইট হেসে ফেললেন, “জেরেমি পড়াশোনায় দুর্দান্ত ছিল, সেই সুবাদে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেই বড় চাকরি পেয়েছিল, ভালো অভিনয় করত, নেশা-ভাঙ করত না, ওর হার্টের সমস্যা ছিল বলে একটা সিগারেটও কোনোদিন খায়নি। কিন্তু ওর মধ্যে ব্যক্তিত্বর অভাব ছিল, যেটা একজন নারী তার পুরুষের কাছে চায়, তাতে ওর ঘাটতি ছিল বলে আমার মনে হয়। জেরেমির আর একটা দোষের কথা উল্লেখ করতে হয়, সে ছিল রগচটা, ফুটবল মাঠে তাকে কয়েকবার মারমুখী হয়ে উঠতে দেখেছি। ফুলহ্যাম এফসি কর্তৃপক্ষ একবার জেরেমিকে সেইজন্য সতর্ক করে দিয়েছিল। আসলে আমার স্টেডি বয়ফ্রেন্ড আছে, শিগগিরই তাকে বিয়েও করব, তাই জেরেমিকে প্রেমিক হিসেবে কখনও কল্পনা করিনি। আমাদের দু’জনের মধ্যে ফুলহ্যাম এফসি ফ্যান হিসেবেই বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। নয়তো আমি জেরেমির যেসব ত্রুটির কথা বললাম, সেসব হয়তো অনেক মেয়ের কাছে ত্রুটি মনে হবে না। অলিভিয়ার নিশ্চয়ই মনে হয়নি। সত্যি বলতে অফিসার্স, সদ্য অকালপ্রয়াত বন্ধুর ত্রুটির কথা বলতে ভালো লাগছে না। অলিভিয়া এ সব কথা জানতে পারলে আমার ওপর অসন্তুষ্ট হবে। আশা করি আপনাদের সব কৌতূহল মেটাতে পেরেছি।”
ব্রিয়ারলি বললেন, “আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, আমাদের আজকের সাক্ষাতের কথা অলিভিয়াকে বলবার দরকার নেই, সে অহেতুক ভয় পেতে পারে।”
অধীরদা বললেন, “অতনুদা, ব্রিয়ারলি সাহেব, জন টাফনেল আর মিলি ব্রাইটের কাছে ডানকান আর অলিভিয়ার অতীত সম্বন্ধে সরাসরি প্রশ্ন না করে একটা করে গল্প ফেঁদে বসলেন কেন? আপনার কী ধারণা? লোকটা আসলে সাংঘাতিক সন্দেহবাতিক। বিকারগ্রস্ত বলা যায়, কাউকে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করেন না। দেখলেন না সোফিয়াকে বলে দিল দু’দিন টাফনেল এবং মিলির ফোন না ধরতে, যাতে ক্রস চেক করলে নিজের আজগুবি গল্প ধরা না পড়ে। ওদিকে টাফনেল আর মিলিকে বলে এসেছেন ডানকান আর অলিভিয়াকে কিছু না জানাতে। সাধে কী আর রবার্টসন আড়ালে মাইক ব্রিয়ারলিকে বুড়ো ছুঁচো বলে ডাকে।”
আমি বললাম, “গোয়েন্দাগিরির প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে সন্দেহ করা। সেটা আপনার মতন পোড়খাওয়া গোয়েন্দা গল্পের পোকা ভালই জানেন। আসলে টাফনেল এবং মিলি যাতে খোলা মনে নিজের বন্ধুদের সম্বন্ধে কথা বলতে পারে, সেহেতু ব্রিয়ারলি তাদের কাল্পনিক বিপদের গল্প ফেঁদে বসেছিলেন। ডানকান আর অলিভিয়ার চারিত্রিক গঠন, বৈশিষ্ট্য জানার জন্যই এই কৌশল। জেরেমির মৃত্যু অস্বাভাবিক হতে পারে ভেবে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দারা খোঁজ খবর করছে জানলে, টাফনেল এবং মিলি কিছুতেই মন খুলে কথা বলতেন না।”
৮)
ওদিকে মাইক ব্রিয়ারলির রহস্য কাহিনি পড়তে পড়তে গোপালপুরে তত ক্ষণে সন্ধ্যা নেমে গেছে। আমি তড়িঘড়ি উঠে গিন্নিদের দিকটা সামলাতে গেলাম। দেখি দু’জনেই সি বিচে যাওয়ার জন্য একদম তৈরি হয়ে গেছেন। আমি বললাম, “তোমরা বিচে গিয়ে বসে চা-টা খাও, আমি আর অধীরদা পিছনেই আসছি।” ভাগ্য বেশ সুপ্রসন্ন দেখলাম, বেড়াতে আসার আনন্দেই বোধহয়, বিনা তির্যক মন্তব্যেই তাঁরা সম্মতি দিলেন।
গিন্নিদের রওনা করিয়ে দিয়ে ফিরে এসে দেখলাম অধীরদা দা ইনভেস্টিগ্টরের পাতায় মশগুল হয়ে আছেন। আমি বললাম, “নিন আবার শুরু করুন।”
অধীরদা বললেন, “ব্রিয়ারলি সাহেব এবং রবার্টসন এডিনবরায় গিয়ে ওয়েভারলি হোটেল কর্তৃপক্ষ এবং কর্মচারীদের সঙ্গে যে কথাবার্তা বললেন সেটা এখন উহ্য থাকুক। হোটেল থেকে বেরিয়ে ব্রিয়ারলি সাহেব সোফিয়াকে ফোন করে ডানকানের ‘হৃদয়ের অসুখ’ নাটকটির স্ক্রিপ্ট চেয়ে নিয়েছেন। লন্ডনের ট্রেনে উঠে বসে, সেটা পড়তে পড়তেই ফিরছেন।
বিরক্ত রবার্টসন বিড়বিড় করে বলল, “শুরু হল, বুড়ো ছুঁচোর নতুন নাটক।” তারপর জিজ্ঞাসা করল, “বস, নাটকের স্ক্রিপ্টে কি জেরেমির মৃত্যুর খবর লেখা আছে? কী হচ্ছে তার কিছুই বুঝতে পারছি না। হোটেলের লোকজনের কাছ থেকে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো সূত্র পেয়েছেন বলেও মনে হচ্ছে না। এ দিকে কাল সন্ধ্যায় সোফিয়া ক্রসের বাড়িতে যাওয়ার কথা, সেখানে গিয়ে হবেটা কী? তার থেকে ফোনেই বলে দেবেন, জেরেমির মৃত্যু দুর্ভাগ্যজনক হলেও স্বাভাবিক মৃত্যু, কোনো রহস্য নেই।”
“রবার্টসন, তুমি তো জানো চোর ডাকাত ধরে বেড়াই ঠিকই, কিন্তু এ আমার আসল জায়গা নয়। কবিতা, উপন্যাস, নাটক হল আমার ভালো লাগার জায়গা, সাহিত্যের আঙিনায় বিচরণ করতেই আমি স্বচ্ছন্দ, তাই ভাবলাম নাটকটা পড়তে পড়তেই ট্রেনে ফেরা যাক। তুমি একেবারে মার্কামারা স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের অফিসার, অপরাধ জগৎ ছাড়া কিছু জানো না। সোফিয়ার বাড়ি কাল সন্ধ্যায় যাব বলেছি, সে ঢের দেরি আছে। তার আগে কাল সকালে আমি একবার ম্যাঞ্চেস্টার যাব, একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।”
ফুলহ্যামে সোফিয়া ক্রসের বাড়ির ছাদে চেয়ার পেতে বসবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বৈঠকখানায় এতজন মানুষের বসার জায়গা করা সম্ভব হয়নি। উপস্তিত আছেন ডানকান, সোফিয়া, অলিভিয়া, লিলিয়ান ব্রিয়ারলি, জন টাফনেল, মিলি ব্রাইট, অ্যান্ড্রিউ রবার্টসন, মাইক ব্রিয়ারলি, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড প্রধান টনি অ্যাডামস, ভিডিয়ো রেকর্ডিংয়ের জন্য দু’জন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড অফিসার এবং আরও দু’জন রক্ষী।
টনি অ্যাডামস বললেন, “শুরু করো ব্রিয়ারলি, জেরেমি ক্রসের মৃত্যু নিয়ে তোমার বক্তব্য শোনা যাক।”
ব্রিয়ারলি বললেন, “আমি আগে মি. ডানকান ক্রস এবং মিসেস অলিভিয়া ক্রসকে কয়েকটা প্রশ্ন করব। মি. ডানকান, ওয়েভারলি হোটেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে আপনি তাদের বহুদিনের কাস্টমার, আপনি কখনও সন্ধ্যা ছ’টার পর জল ছাড়া কিছু খান না, সোফিয়াও সেটা সমর্থন করেছেন। তবে চার তারিখ রাত আটটা নাগাদ আপনি রিসেপশনে ফোন করে দু’কাপ কফি এবং বিস্কিট অর্ডার করেছিলেন কেন?”
ডানকান বললেন, “আমার ঘরে রিহার্সাল চলছিল। তাই জেরেমি আর অলিভিয়ার জন্য আমি কফির অর্ডার করেছিলাম।”
মাইক ব্রিয়ারলি টনি অ্যাডামসকে সম্বোধন করে বললেন, “স্যার, সেদিন মি. ডানকানের ঘরে কফি নিয়ে গিয়েছিলেন প্রবীণ রুম সার্ভিসম্যান মি. রবার্ট কিন। মি. কিন নিজেও একজন নাট্যপ্রেমী। দীর্ঘ দিন ধরে মি. ডানকান এই হোটেলের কাস্টমার, সেই সুবাদে মি. কিনের সঙ্গে তাঁর একটা সখ্যতা গড়ে ওঠে, তাই হোটেল কর্তৃপক্ষও যতটা সম্ভব মি. ডানকানের রুম সার্ভিসের জন্য মি. কিনকে পাঠাতে চেষ্টা করেন।
মি. ডানকান, মি. রবার্ট কিন কিন্তু জানিয়েছেন, সেই সময় আপনার ঘরে জেরেমি ছিল না। আপনি আর অলিভিয়াই কেবল রিহার্সাল করছিলেন। আমি সোফিয়ার ফেসবুক প্রোফাইলে দেখেছি, জেরেমি ওই সময়টা ফ্রিঞ্জ উৎসবের ঐতিহ্য নিয়ে একটা ফেসবুক লাইভ করছিল।”
ডানকান বললেন, “ঠিক কথা। সেইজন্যই জেরেমি রিহার্সালে আসতে দেরি করে ফেলেছিল। মি. কিন যখন কফি নিয়ে আসে, তখন আমি আর অলিভিয়া রিহার্সাল করছিলাম।”
“মি. ডানকান, আপনার নাটকের স্ক্রিপ্ট আমি পড়েছি, আপনার ঘরে সেদিন যে দৃশ্যের রিহার্সাল চলছিল, সেটা কিন্তু স্ক্রিপ্টে নেই।”
ডানকান বললেন, “মূল নাটকে একটি ঘনিষ্ঠ চুম্বনের দৃশ্য ছিল, সোফিয়ার বদলে যখন অলিভিয়া অভিনয় করবে বলে ঠিক হয়, আমি সেটা বাদ দিয়ে দিই। পুত্রবধূকে অভিনয় করতে গিয়েও চুম্বন করা আমার পক্ষে অসম্ভব। কিন্তু তাতে নাটকের অভিঘাত অনেকটাই ম্লান হয়ে যায় তাতে সন্দেহ নেই। অলিভিয়া সেটাই সেদিন রিহার্সাল করতে বলছিল, ও চেয়েছিল দৃশ্যটা বাদ না দিতে। ফ্রিঞ্জ উৎসবের বোদ্ধা দর্শকদের, তুলনায় দুর্বল একটা উপস্থাপনা দেখানোর ইচ্ছে অলিভিয়ার ছিল না। অলিভিয়া ওই দৃশ্যে আমাকে সোফিয়ার সঙ্গে বহুবার অভিনয় করতে দেখেছে। সে ওই দৃশ্যের অভিঘাত জানে। অলিভিয়া রিহার্সাল দেখতে দেখতেই নাটকটির প্রতি একাত্ম হয়ে পড়েছিল, নিজে অভিনয় করতে এসে সেটা আরও গাঢ় হয়েছে।
শিল্পের প্রতি ওর দায়বদ্ধতা আসলে আমার মতন শখের নাট্যকার, অভিনেতার থেকে অনেক বেশি। সোফিয়াও জানে ওই দৃশ্য নাটকে ছিল এবং পরে ওর অনুপস্থিতির কারণে আমি দৃশ্যটা বাদ দিয়েছিলাম।”
ব্রিয়ারলি বললেন, “অলিভিয়া, মি. কিন কফি নিয়ে যাওয়ার একটু পরেই আপনি ডানকানকে বলেন, ‘আমি এখন যাচ্ছি, কাল সবরকম বন্দোবস্ত করেই রিহার্সালে আসব।’ আপনি, ‘সব রকম বন্দোবস্ত করে রিহার্সাল দিতে আসবেন’ বলতে ঠিক কী বুঝিয়েছিলেন?”
অলিভিয়া বললেন, “সব বন্দোবস্ত বলতে আমি পুরোপুরি তৈরি হয়ে রিহার্সালে আসার কথা বুঝিয়েছিলাম। ছ’-তারিখেই তো ফ্রিঞ্জ উৎসবে আমাদের শো ছিল।”
“এডিনবরায় অগস্ট মাসে তো গরম আবহাওয়া, ফুলহ্যামেও তাই। ডানকান, জেরেমির মৃত্যুশয্যার যে ছবি তুলেছেন, সেখানে আপনি জেরেমির শিয়রের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন, আপনার গলায় স্কার্ফ জড়ানো। এখনও সেই স্কার্ফ জড়ানো আছে, আপনার ঠান্ডা লেগে গেছে বলে তো মনে হচ্ছে না?”
অলিভিয়া একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “দ্যাট ওয়াজ দা লাস্ট লাভ বাইট অফ মাই জেরেমি, হি ওয়েন্ট ওয়াইল্ড ইন দা লাস্ট নাইট অফ হিজ লাইফ। ডিড হি নো দ্যাট হিজ আওয়ার্স আর নামবারড? মে বি। আই ডোন্ট নো রিয়েলি।” অলিভিয়া দু’হাতে মুখ ঢাকলেন। সোফিয়া নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে অলিভিয়ার পিঠে হাত রাখলেন, তারপর ব্রিয়ারলি সাহেবকে বললেন, “মি. ব্রিয়ারলি, ব্যক্তিগত প্রশ্ন না করে কাজের কথায় চলে আসলেই ভালো হয়।”
টনি অ্যাডামস বললেন, “কাম অন ব্রিয়ারলি, পুট দা কার্ডস অন দা টেবিল নাউ। আমি জানি, তুমি তদন্ত করে বুঝতে পেরেছ যে জেরেমির মৃত্যুতে একটা অস্বাভাবিকত্ব আছে। প্রমাণ আর মোটিভ হাতে না থাকলে এতগুলো লোককে তুমি এখানে জড়ো করতে না।”
মাইক ব্রিয়ারলি স্বভাবসিদ্ধ নাটকীয় ভঙ্গিমায় টনি অ্যাডামসকে অভিবাদন করে বললেন, “হ্যাঁ স্যার, এ বার সেই প্রসঙ্গেই আসছি।
জেরেমির যখন মৃত্যু হয় তখন তার পরনে ছিল হাফ হাতা টি শার্ট আর ফুল প্যান্ট। ডানকান মৃত্যুশয্যায় শায়িত জেরেমির কয়েকটা ছবি তুলেছিলেন, সেই ছবি খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে আমি জেরেমির দু’হাতে অ্যালার্জির চিহ্ন লক্ষ করি। মৃত্যুর আগের দিন রাতে জেরেমি একটি ফেসবুক লাইভ অনুষ্ঠান করেছিল এবং বেশ কিছু ছবি পোস্ট করেছিল। শেষ ছবি পোস্ট, একটি সেলফি রাত বারোটায় হোটেল রুম থেকে করা। সেখানে কোথাও অ্যালার্জির কোনো লক্ষণ ছিল না।
সোফিয়া আমাকে জানান ডিম আর চিংড়ি খেলে জেরেমির অ্যালার্জি হত বলে সে ওই দু’টি খাবার খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল। আমি ওয়েভারলি হোটেল কর্তৃপক্ষর কাছ থেকে জানতে পারি পাঁচ তারিখ দুপুরে জেরেমির অর্ডার করা খাবারে ডিম বা চিংড়ির অস্তিত্ব ছিল না। তা হলে অ্যালার্জি হল কেন?
স্যার, অলিভিয়া ক্রস মোশন সিকনেসের শিকার একজন পেশেন্ট, ভ্রমণ করতে গেলেই যাকে সেই জন্য ওষুধ খেতে হয়। মোশন সিকনেসের ওষুধ খেলে কিন্তু কারও কারও হাতে-পায়ে অ্যালার্জি বের হতে পারে, আমি নিশ্চিত জেরেমির পায়েও অ্যালার্জি বেরিয়েছিল। ফুল প্যান্ট পরে থাকায় সেটা ছবিতে দেখা যায়নি। সোফিয়া জানিয়েছেন জেরেমি কখনও দুপুরে ঘুমোত না, সেই ছেলে তার প্রিয় উৎসবে এসে দুপুরে ঘুমিয়ে পড়বে কেন? একবার একটা বইতে পড়েছিলাম স্কোপোলামাইন হাইড্রোব্রোমাইড যদি একটু বেশি পরিমাণে খাওয়া যায়, তা হলে একটা দ্রুত স্বপ্নবিহীন ঘুমে মানুষ আচ্ছন্ন হয়ে পড়বে, সেই ঘুম আর ভাঙবে না। অলিভিয়া ক্রস ঘটনাচক্রে মোশন সিকনেসের জন্য স্কোপোলামাইন হাইড্রোব্রোমাইড ওষুধ সেবন করেন।
তা একটা ফিকশনের বইয়ের ওপর তো পুরোপুরি নির্ভর করা যায় না। তাই আমি আজ সকালে ম্যাঞ্চেস্টারে একজন ডাক্তারবাবুর কাছে গেছিলাম মোশন সিকনেসের বিষয়ে পরামর্শ নিতে, এই ডাক্তারবাবুই মিসেস অলিভিয়াকে দীর্ঘদিন মোশন সিকনেসের চিকিৎসা করছেন।
স্কোপোলামাইন হাইড্রোব্রোমাইড তিন রকম ভাবে ব্যবহার করা যায়। ইনট্রাভেনাস ইঞ্জেকশন নেওয়া যায়, কানের পেছনে ট্রান্সডার্মাল প্যাচ হিসেবে ব্যবহার করা যায় বা ট্যাবলেট হিসেবে খাওয়া যায়। অলিভিয়া ট্যাবলেট খেতেন। এখন ডাক্তারবাবুর মতে অতিরিক্ত এই ওষুধের ব্যবহার একজন হার্ট পেশেন্টের পক্ষে প্রাণঘাতী হতে পারে। কলম্বিয়ায় স্কোপোলামাইন মারাত্মক অপরাধমূলক ড্রাগ হিসেবে গণ্য করা হয়, শয়তানের নিশ্বাস নামে পরিচিত এই ড্রাগ, খাবার বা তরল পানীয়ে গুঁড়ো করে মিশিয়ে, পার্টিতে ধনীদের অচৈতন্য করে সর্বস্ব লুঠ করা একটা পরিচিত অপরাধ, এতে প্রাণ সংশয় হওয়াও বিচিত্র নয়। এটা নেশার ওষুধ হিসেবেও অনেকে ব্যবহার করেন, শুধু কলম্বিয়ার মানুষই এর খবর রাখেন ভাবার কোনো কারণ নেই। স্কোপোলামাইন হাইড্রোব্রোমাইড ট্যাবলেটে একটু ওভারডোজ হলে মুখের ভেতরটা শুকিয়ে যায়, দৃষ্টি আবছা হয়ে যায়, একটা ঘোর চলে আসে, যেটা অনেকে নেশা হিসেবে পছন্দ করে। জেরেমির ড্রাগস নেওয়ার কোনো ইতিহাস নেই, জেনেটিক হার্ট পেশেন্ট জেরেমি সবরকম নেশা থেকে দূরে থাকতেন। জেরেমি হঠাৎ করে নেশা করবার জন্য স্বেচ্ছায় ড্রাগস নিয়েছেন সে সম্ভাবনা বাতিল করা যেতে পারে।
৫ই অগস্ট, যেদিন দুপুরে শোওয়ার পর জেরেমি আর ওঠেননি, সেদিন অলিভিয়া এবং জেরেমি দুপুরের খাবার ঘরে আনিয়ে খেয়েছিলেন। ডানকান, হোটেলের রেস্তোরাঁয় খেতে গেছিলেন। হোটেল কর্তৃপক্ষের মতে এটা অভূতপূর্ব ঘটনা। ক্রস পরিবার ওয়েভারলিতে চিরকাল একসঙ্গে খাবার খেতেন। কিন্তু পরিবারের নতুন সদস্য অলিভিয়ার অভিরুচি ভিন্ন হতেই পারে, ভুললে চলবে না যে জেরেমি এবং অলিভিয়া নবদম্পতি, তাদের এ ধরনের ইচ্ছা হতেই পারে। যদিও চার তারিখ সন্ধ্যায় তাঁরা দু’জনে রেস্তোরাঁয় খেতে নেমেছিলেন। জেরেমি তারপর ফেসবুক লাইভে মেতে ওঠে, অলিভিয়া চলে যায় ডানকানের ঘরে রিহার্সাল দিতে। পাঁচ তারিখ দুপুরে কিন্তু জেরেমির খাবারে ওষুধ মিশিয়ে দেওয়ার সম্পূর্ণ সুযোগ অলিভিয়ার কাছে ছিল এবং অলিভিয়া সে সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছিল।
এ বার আসি খুনের মোটিভে। জেরেমির মৃত্যুতে ডানকান আর অলিভিয়া দু’জনেই জড়িত থাকতে পারেন। এটা তাদের মিলিত ষড়যন্ত্র হতে পারে অথবা যেকোনো একজন জেরেমিকে হত্যা করতে পারেন। কিন্তু মোটিভ কী? ডানকান ক্রস জেরেমির সৎ বাবা, জেরেমির জন্য তার নিজের পিতৃত্বের সাধ বিসর্জন দিতে হয়েছে। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে জেরেমি আর ডানকান অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ, এত বছর বাদে সে জেরেমিকে মারতে যাবে কেন? একটা সম্ভাবনা হল ওভারপসেসিভ ডানকান, সোফিয়ার মাদ্রিদ সফরের তরুণ সঙ্গীকে মেনে নিতে না পেরে সোফিয়াকে দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়েছিল। প্রতিশোধ নিতে সে জেরেমিকে হত্যা করতে পারে, ওভারপসেসিভ ডানকান এ রকম হুমকি বহুবার আগেও দিয়েছেন, সোফিয়ার সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি তিনি এইসব হুমকিকে বিন্দুমাত্র গুরুত্ব দেন না।
আর ডানকান অলিভিয়ার মোশন সিকনেসের ওষুধ পাবে কোথায়, কীকরেই বা সেটা জেরেমির খাবারে মিশিয়ে দেবে? যদি না অলিভিয়া তার সঙ্গে ষড়যন্ত্রে সামিল হয়। অলিভিয়া কেন ডানকানের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিজের সদ্য বিবাহিত স্বামীকে হত্যা করবে? এক যদি সুদর্শন ডানকান আর আবেদনময়ী অলিভিয়ার মধ্যে কোনো রসায়ন না গড়ে ওঠে।
না, ডানকানের দিক থেকে কোনো রসায়ন গড়ে ওঠেনি। মিলি ব্রাইট আমাদের বলেছিলেন, অলিভিয়া প্রথম দিকে জেরেমি সম্বন্ধে আগ্রহী ছিলেন না। জেরেমির জন্মদিনের পার্টিতে ডানকান আর সোফিয়ার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর তার মত বদলায়। সোফিয়া নয় ডানকানই ছিল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। হতে পারে সেটা অলিভিয়ার অবচেতনেই ঘটেছিল। বিপত্তি বাধল ফ্রিঞ্জ উৎসবের আগে সোফিয়াকে মাদ্রিদ যেতে হল, আর সোফিয়ার ভূমিকায় ডানকানের সঙ্গে অভিনয় করতে এসে অলিভিয়ার শরীর আর মনে আগুন জ্বলে উঠল। অলিভিয়া মুখে বলল, অভিনয়কে অভিনয় হিসেবে নিতে, কার্যক্ষেত্রে নিজে অভিনয় আর বাস্তবের ফারাক করতে পারল না।
সোফিয়া জুলাইয়ের একত্রিশ তারিখ জানতে পারেন, তাঁকে অগস্টের তিন তারিখে মাদ্রিদ যেতে হবে। অগস্টের এক তারিখ থেকেই অলিভিয়া, ডানকানের সঙ্গে রোমান্টিক দৃশ্যে রিহার্সাল করতে আরম্ভ করেন। ডানকান শুরুতেই এই নাটক বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন। সোফিয়া আর অলিভিয়ার চাপাচাপিতেই তাকে রিহার্সাল চালিয়ে যেতে হয়। অভিজ্ঞ অভিনেতা ডানকানের প্রথম থেকেই অলিভিয়ার রকমসকম ভালো লাগেনি। তিন তারিখ সোফিয়া মাদ্রিদ রওয়ানা হওয়ার আগেও ডানকান সোফিয়াকে নাটক বন্ধ করে দেওয়ার ইচ্ছে জানিয়েছিলেন। সোফিয়া সেটা তাঁর ওপর ডানকানের রাগ এবং অভিমানের ফসল হিসেবে ধরে নিয়েই নাটক বন্ধ না করার পক্ষে সওয়াল করেন। জেরেমির এ বিষয়ে কী মত ছিল সেটা বোধহয় কেউ জিজ্ঞাসা করেননি। মিলির মুখে শুনেছি জেরেমির ব্যক্তিত্বের অভাব ছিল, তবে তার আপত্তি ছিল বলে মনে হয় না। সোফিয়ার মাদ্রিদ চলে যাওয়া অলিভিয়াকে আরও সাহসী করে তোলে। ওয়েভারলি হোটেলে ডানকানের ঘরে রিহার্সালের সময়, সে বাদ হয়ে যাওয়া চুম্বন দৃশ্য নাটকে যোগ করার জন্য ডানকানকে চাপ দেয়।
মি. ডানকান, আর একবার চার তারিখ রাতে আপনার হোটেল রুমের রিহার্সাল দৃশ্যে ফিরে যাওয়া যাক। মি. কিন কফি নিয়ে গিয়ে দেখেন, আপনার ঘরের দরজা খোলা। অলিভিয়া উত্তেজিতভাবে ডায়ালগ বলছেন, ‘আমাকে কতবার ফিরিয়ে দেবে? ও কি তোমার ছেলে? নিজেকে ঠকাচ্ছ, আমাকেও। কিস মি।’ মি. কিন তখন দরজায় দাঁড়িয়ে। আপনার চোখ পড়ে রবার্ট কিনের ওপর, আপনি হেসে বলেন, ‘ভিতরে এস কিন, রিহার্সাল কেমন দেখলে? বসে রিহার্সাল দেখে যাও।’ বলে বারংবার তাকে রিহার্সাল দেখার অনুরোধ করতে থাকেন। সেই সময় অলিভিয়া বলে সে তাঁর ঘরে ফিরে যাচ্ছে, কাল সব রকম বন্দোবস্ত করেই আবার রিহার্সাল দিতে আসবে। আপনিও কিনের সঙ্গে সঙ্গেই ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন, বলেন জেরেমিকে খুঁজতে যাচ্ছেন।
আসলে আপনি একা থাকতে ভয় পাচ্ছিলেন। আপনি চাইছিলেন জেরেমি হয় আপনার সঙ্গে, নয় অলিভিয়ার সঙ্গে থাকুক। অলিভিয়া কোনো অজুহাতে আপনার ঘরে একা আসুক, সেটা আপনি চাইছিলেন না। আপনার নাটকের স্ক্রিপ্ট আমি পড়েছি, সেখানে অলিভিয়ার বলা ডায়ালগগুলো নেই। আপনার ঘরে সেই সময় কোনো রিহার্সাল চলছিল না। জেরেমিকে ছাড়া অলিভিয়াকে দেখে আগেই আপনি কিছু আশঙ্কা করেছিলেন, সঙ্গে সঙ্গে আপনি কফির অর্ডার দেন এবং রুমের দরজা খুলে রাখেন। অলিভিয়া আপনার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে সেটা আপনি আগেই টের পেয়েছিলেন। রুম সার্ভিসম্যানকে রিহার্সাল দেখার অনুরোধ করে আপনি ঘরে তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি নিশ্চিন্ত করতে চাইছিলেন। মি. কিন নিজে নাটকের ব্যাপারে উৎসাহী বলে ডায়ালগগুলো ভালভাবে অনুধাবন করেছিলেন। যদিও ওগুলো আসল নাটকের ডায়ালগ ছিল না।
চুম্বনের দৃশ্যটা যে নাটকে ছিল সেটা সোফিয়া আমাকে আগেই বলেছেন, কিন্তু অলিভিয়ার বলা ওই ডায়ালগগুলো নাটকে কোথাও ছিল না। অলিভিয়া, আপনি সব রকম বন্দোবস্ত বলতে কী বুঝিয়েছিলেন? জেরেমিকে ঘুম পাড়িয়ে আসবেন, যাতে সে হঠাৎ করে এসে আপনার অভিসারে বাধা দিতে না পারে। আপনি কোনো মনগড়া ডায়ালগ রিহার্সালের মাঝে বলেননি। আসলে ডানকানকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, জেরেমি তাঁর ঔরসজাত সন্তান নয়, আপনার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে তাঁর দ্বিধা থাকার কারণ নেই।”
পাঁচ তারিখ দুপুরে জেরেমিদের ঘরে খাবার নিয়ে গিয়েছিলেন রুম সার্ভিসের মি. ক্রিস ল্যুইস, তিনি অলিভিয়ার গলায় স্কার্ফ থাকার কথা মনে করতে পারেননি। চার তারিখ রাতে জেরেমির লাভ বাইট নয়, অলিভিয়ার গলায় পাঁচ তারিখ দুপুরে ডানকানের নখ লেগে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়, সেটা ঢাকতেই অলিভিয়াকে স্কার্ফ দিয়ে গলা ঢাকতে হচ্ছে। আমার ধারণা, জেরেমিকে হত্যা করার কোনো পরিকল্পনা অলিভিয়ার ছিল না। স্কোপোলামাইন দিয়ে জেরেমিকে আচ্ছন্ন করে দিয়ে ডানকানের ঘরে নিশ্চিন্তে রিহার্সালের নামে তাকে প্ররোচিত করাই অলিভিয়ার উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু সে তো ডাক্তার নয়, একজন জেনেটিক হার্ট পেশেন্টের ওপর কত পরিমাণে স্কোপোলামাইন প্রয়োগ করা যায়, তার মাত্রা সে জানবে কীভাবে? জেরেমির ঘুম নিশ্চিত করতেই সে বেশি পরিমাণ ওষুধ খাবারে মিশিয়ে দেয়।
তারপর অলিভিয়া ডানকানের ঘরে গিয়ে আবার রিহার্সালের অছিলায় তাকে চুমু খাওয়ার চেষ্টা করলে, ডানকানের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে, তিনি অলিভিয়াকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে বলেন ওই দৃশ্য নাটকে না রাখার সিদ্ধান্ত তিনি বদলাবেন না। ধাক্কা মারার সময় ডানকানের হাতের নখ লেগে অলিভিয়ার গলায় ক্ষতের সৃষ্টি হয়। এই পর্যন্ত আমি কল্পনার সাহায্য নিলাম, এরপর প্রমাণে আসছি। জেরেমিদের হোটেলের রুম নাম্বার পাঁচশো এক, করিডরের শেষ প্রান্তে তারপরে স্টেয়ারকেস এবং লিফ্ট। ডানকানের রুম নাম্বার পাঁচশো ছাব্বিশ। ওই করিডরে পাঁচশো তিরিশ নাম্বার অবধি রুম আছে। পাঁচশো তিরিশ নাম্বার ঘরের পর আবার স্টেয়ার কেস এবং লিফ্ট। অর্থাৎ করিডরের দু’প্রান্তেই সিঁড়ি এবং লিফ্ট আছে। করিডরে কোনো সিসিটিভি ক্যামেরা নেই, কিন্তু সিঁড়ি এবং লিফ্টের সামনে আছে। অলিভিয়া সেদিন পাঁচশো তিরিশ নাম্বার ঘরের দিকের লিফ্ট ব্যবহার করে নিচে নামেন, হোটেল ডক্টরের কাছে টিটেনাস নেন এবং ক্ষতে মলম লাগান। ডাক্তারবাবুকে স্পষ্টই বলেন নখ লেগে কেটে গেছে, অবশ্যই কার নখ তা বলেননি। আঘাত পাঁচশো এক নম্বর ঘরে লাগলে, অলিভিয়া পুরো করিডর উজিয়ে বিপরীত প্রান্তের লিফ্ট ব্যবহার করতেন না।
ক্রস পরিবার টানা বাইশ বছর ধরে ওয়েভারলি হোটেলে উঠছেন, হোটেলের প্রতিটি কর্মচারী তাদের চেনেন। হোটেলের ডাক্তারবাবু চার্লস ইভান্স পনেরো বছর ধরে এই হোটেলের সঙ্গে যুক্ত, তিনি জেরেমির হৃদযন্ত্রের সমস্যা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল, সোফিয়া প্রতি বছর ফ্রিঞ্জ উৎসবে গিয়েই ডা. ইভান্সকে দিয়ে জেরেমির চেকআপ করাতেন। এ বার সোফিয়া ছিলেন না, ডানকান কিন্তু ইভান্সকে বলেছিলেন জেরেমির চেকআপ করে নিতে। ইভান্স জেরেমিকে বলে রেখেছিলেন পাঁচ তারিখ সন্ধ্যায় চেকআপ করবেন, তার আগেই সব শেষ, হার্ট অ্যাটাকেই। ডা. ইভান্স জেরেমির জেনেটিক হার্ট পেশেন্ট হওয়ার ইতিহাসে প্রভাবিত হয়ে যান, হার্ট অ্যাটাককে কোনো ড্রাগ ত্বরান্বিত করেছে বলে ধরতে পারেননি, জেরেমির হাতে অ্যালার্জির অস্তিত্বকে গুরুত্ব দেননি। সহজেই ডেথ সার্টিফিকেট দিয়ে দেন। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, ফরেন্সিক পরীক্ষা করলে জেরেমির শরীরে স্কোপোলামাইন হাইড্রোব্রোমাইডের অস্তিত্ব ধরা পড়বে।
মি. ডানকান জেরেমির মৃত্যুকে অস্বাভাবিক বলে ভাবেননি। তিনি গোয়েন্দা বা চিকিৎসক নন। অলিভিয়ার আচরণকে তিনি সাময়িক মোহ হিসেবে ধরে নিয়ে, বিশেষ করে এই শোকের আবহে আর জল ঘোলা করতে চাননি, বরং পারিবারিক কেচ্ছা ধামাচাপা দিতে অলিভিয়ার আচরণকে আড়াল করেছেন। ডানকানের কাছে অলিভিয়া শুধুই পুত্রবধূ, স্নেহের পাত্রী।”
অধীরদা বই বন্ধ করে বললেন, “অতনুদা, এরপর ব্রিয়ারলি সাহেব ঘটনার উপসংহার টানবেন, ডানকান-সোফিয়াদের পারিবারিক নাটকও কিছু হবে, জেরেমির টক্সিকোলজি রিপোর্ট হাতে এলে অলিভিয়া আইনের হাত থেকে নিস্তার পাবেন বলে মনে হয় না, সেসব জেনে আর লাভ নেই। তার থেকে আপনি অলিভিয়ার আচরণের কী মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেন, সেটাই শুনি।”
আমি বললাম, “জেরেমির ব্যক্তিত্বের অভাব ছিল, তার চেহারাও বালকসুলভ, দাড়ি-গোঁফ কামালে তাকে দিব্যি স্কুল ছাত্রের চরিত্রে মানিয়ে যায়। পাশাপাশি ডানকান মধ্যবয়সী সুদর্শন, আকর্ষক ব্যক্তিত্বের অধিকারী। মেয়েরা অনেক সময়ই বেশি বয়সের পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হয়। অলিভিয়ার অবচেতনে হয়তো ডানকানের প্রতি একটা দুর্বলতা ছিলই, রিহার্সালের সময় রোমান্টিক দৃশ্যে অভিনয় করতে গিয়ে এবং এডিনবরায় সোফিয়ার অনুপস্থিতি আগুনে ঘৃতাহুতির কাজ করেছে। এমনও হতে পারে, ডানকান যদি অলিভিয়ার কথা মেনে নিয়ে নাটকে চুম্বন দৃশ্য রেখে দিতেন, তবে জল এতদূর গড়াত না। অক্সফোর্ডে অলিভিয়ার অনেক অনুরাগী ছিল বলে মিলি ব্রাইট উল্লেখ করেছিল; যারা অন্যদের মনোযোগ পেতে অভ্যস্ত, তাঁরা অনেকসময় সাধারণ প্রত্যাখ্যানও মেনে নিতে পারেন না, প্রত্যাখ্যান তাদের জেদ বাড়িয়ে দেয়।
আমি মাইক ব্রিয়ারলির সঙ্গে একমত যে অলিভিয়া জেরেমিকে হত্যা করতে চায়নি, ঘুম পাড়িয়ে দেওয়াই তার উদ্দেশ্য ছিল, জেরেমি, চিরকালের মতন ঘুমে ঢলে পড়বে কল্পনা করতে পারেনি।”
অধীরদা বললেন, “আপনার বক্তব্যের সঙ্গে আমি সহমত, আর আপনার মাইক ব্রিয়ারলি প্রীতির যথার্থ কারণ আছে। লোকটা সত্যিই ক্রিমিনোলজির জাদুকর।
স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, আমারও একটু একটু ভক্তিভাব জেগে উঠছে। এখন চলুন, সাগর তীরে গিয়ে গিন্নিদের সঙ্গ দিই, দোল পূর্ণিমার জ্যোৎস্নালোকে সমুদ্রের অপরূপ সৌন্দর্য আর ঢেউয়ের শব্দের ভিতর মিশে থাকা সঙ্গীতের মূর্ছনা; মাইক ব্রিয়ারলির রহস্য কাহিনির থেকে কম রোমাঞ্চকর হবে বলে মনে হয় না।”