কার্টুন বা ব্যঙ্গচিত্র, বা তার বিবর্তন সম্বন্ধে লিখতে গেলে অবশ্যই আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে বেশ কয়েক শতক আগে। বাঙলা ভাষায় ব্যঙ্গচিত্র দুই অর্থে বোঝানো হয়। ক্যারিকেচর ও কার্টুন এই দুই ইংরেজি শব্দেরই বাংলা প্রতিশব্দ হিসাবে কেবলমাত্র ব্যঙ্গচিত্র শব্দটি ব্যবহার করা হয়। কার্টুনের ইতিহাস নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন তাঁরা মনে করেন ক্যারিকেচরের বিবর্তিত রূপ হল কার্টুন। ক্যারিকেচর বস্তুটি কী সে সম্বন্ধে দু’এক কথা বলি। কোনও বিশেষ ব্যক্তির আচরণের নকল করাকে সাধারণভাবে ক্যারিকেচর বলে বোঝানো হলেও ক্যারিকেচর আসলে চিত্রকলার এক বিশেষ আঙ্গিক যেখানে কোনও ব্যক্তির পোর্ট্রেটকে অতিরঞ্জিত করে দেখানো হয়। সেই অর্থে দেখতে গেলে কার্টুন ও ক্যারিকেচরের মধ্যে একটা চুল চেরা পার্থক্য টানাই যায়। ক্যারিকেচরের ক্ষেত্রে বাস্তব চরিত্রের অতিরঞ্জিত রূপটি ফুটিয়ে তোলেন শিল্পী। কার্টুনে সচরাচর কাল্পনিক চরিত্র সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে ব্যঙ্গ করে থাকেন শিল্পীরা। তবে এই পার্থক্য এতটাই সূক্ষ্ম যে সেই কারণেই বোধ করি বাঙলা ভাষায় ক্যারিকেচর বা কার্টুন প্রায় সমার্থক হয়ে উঠেছে ও ভিন্ন প্রতিশব্দের প্রয়োজন উপলব্ধ হয় নি।
ক্যারিকেচরের জন্ম হয় আদতে ইউরোপে। ইউরোপের ইতিহাসে রেনেসাঁ নামে পরিচিত যে সময়কাল সে সময়ে সমাজ, জীবনযাত্রা, সাহিত্য, ভাস্কর্য, শিল্প ও মননের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। তিনশো বছরের রেনেসাঁ যুগের অন্তর্বর্তী একটা সময়ে মানুষই হয়ে উঠেছিল শিল্প রচনার অন্যতম বিষয়। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি আঁকলেন ‘মোনালিসা’, আঁকলেন ‘গ্রোটেস্ক হেড’ (Grotespue Head) সিরিজ। শিল্পের এক নতুন আঙ্গিকের জন্ম হল। যে ধারায় মানুষের মুখ হয়ে উঠল মুখ্য বিষয় বা সাবজেক্ট। ছবিগুলিতে সাবজেক্টের মুখাবয়বের বিকৃত উপস্থাপনার মাধ্যমে অন্তর্নিহিত মনস্তাত্ত্বিক রূপটাই ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল। তবে কি এই বিকৃত উপস্থাপনাতেই লুকিয়ে আছে ভবিষ্যতের ক্যারিকেচর? ‘গ্রোটেস্ক হেড’ সৃষ্টি হয়েছিল ষোড়শ শতকে। কার্টুন শব্দের উৎপত্তি ইতালিয়ান শব্দ “কার্তোন” থেকে। কার্তোন হল এক ধরনের কাগজ। আগেকার দিনে শিল্পীরা কোনও বড় মাপের কাজ করার আগে কাঠকয়লা, পেন্সিল বা চক দিয়ে তার একটা খসড়া বানিয়ে নিতেন এই কাগজে। মনে করা হয় এই খসড়াই পরবর্তীকালে কার্টুনে বিবর্তিত হয়েছে।
বাঙলায় ব্যঙ্গচিত্রের ওপর যাঁরা গবেষণা করেছেন তাঁদের মতে বাঙলা কার্টুনের প্রথম পথ চলা শুরু ১৮৭২ সালে। তদানীন্তন মিউনিসিপালটি আইনের পরিপ্রেক্ষিতে আঁকা হয় এই কার্টুন। বিট্রিশদের বাঙালি বুরোক্র্যাট তৈরির পদ্ধতি নিয়ে ব্যঙ্গ করা হয় এই কার্টুনে। ভারতে যথাক্রমে ১৮৫০ সালে দিল্লি স্কেচবুক ও ১৮৫৯ সালে ইন্ডিয়ান পাঞ্চ প্রকাশিত হয়েছে। এই পত্রিকাগুলো জন্মাবার পেছনে আসল কারণ ছিল ভারতীয়দের প্রতি ব্রিটিশদের অপমানজনক আচার-আচরণের যোগ্য জবাব দেওয়া। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের সময় বিট্রিশ পত্রিকা দ্য পাঞ্চ-এ ভারতীয়দের প্রতি অপমানজনক কিছু কার্টুন প্রকাশিত হয়। তার যোগ্য জবাব দিতে হাটখোলার দত্ত-ভ্রাতৃদ্বয়, প্রাণনাথ এবং গিরীন্দ্রনাথের উদ্যোগে বসন্তক নামের পত্রিকার পথ চলা শুরু। একই সময়ে হরবোলা ভাঁড় নামের আরও একটি কমিক পত্রিকা বের হয় এই সব অপমানের যোগ্য জবাব দেওয়ার উদ্দেশ্যে।
গিরীন্দ্রনাথ দত্ত সে সময়ে কলকাতা কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান হগ সাহেবকে বরাহ অবতারের সঙ্গে তুলনা করে ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করেন।
এই সমস্ত কার্টুন তৈরি করা হত কাঠখোদাই করে। বাঙলার নিজস্ব শৈলীর পটচিত্রের ধাঁচে আঁকা এই ব্যঙ্গচিত্র দিয়েই বাঙলার পথ চলা শুরু। সে সময় উন্নত প্রযুক্তির ছাপাখানার সুবিধা না থাকলেও বাঙালি অপমানের যোগ্য জবাব দিতে পিছপা হয় নি। ব্যঙ্গ ও হাস্যকৌতুককে হাতিয়ার করে ব্রিটিশ শাসনের সমালোচনা করেছেন শিল্পীরা। এই চিত্রশৈলীতে ব্যাপক পরিবর্তন আনলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাইপো গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। পেন্সিল স্কেচে আঁকতে শুরু করলেন দারুণ সব ব্যঙ্গচিত্র। ইউরোপীয় ধারার ছোঁয়া লাগল গগন ঠাকুরের ছবিতে। যদিও তিনি পেশাদার ব্যঙ্গচিত্র শিল্পী ছিলেন না তবু তাঁর ব্যঙ্গচিত্রগুলি সে সময়ের নাম করা পত্রিকা, যেমন প্রবাসী, মর্ডান রিভিউ, ভারতী ইত্যাদিতে প্রকাশিত হতে লাগল। এই সব ব্যঙ্গচিত্রের মাধ্যমে রাজনীতি, প্রচলিত সমাজ, হিন্দুধর্মের আচারসর্বস্বতা, ও স্ববিরোধকেই বার বার ব্যঙ্গ করেছেন তিনি। তা ছাড়া ইংরাজদের অনুকরণপ্রিয় যে নব্য-বাঙালিসমাজ বিংশ শতকের গোড়ার দিকে জন্ম নিল তাকেও ব্যঙ্গ করতে ছাড়েন নি গগনেন্দ্রনাথ। সেইসব ছবি বাঙলার ব্যঙ্গচিত্রের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য।
এই ছবিটিতে উনি দেখিয়েছেন কিভাবে স্বামী তার স্ত্রীর ওপর সব ভার সমর্পণ করে নিজে নিশ্চিন্তে চলেছেন। এমনকি সে সময়ের বিখ্যাত ব্যক্তিদের নিয়েও উনি চিত্রের মাধ্যমে কৌতুক করেছেন। বাদ যান নি তাঁদের রবিকাও।
ধীরে ধীরে সাতের দশকে সাদা কালো টিভি গৃহস্ত ঘরে দেখা দিল। এখন এসে গেছে রঙিন কেবল্ টিভি। রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে বিশ্বের যত্রতত্র যাওয়া যায়। আমাদের মাথার সব চিন্তা ঝেঁটিয়ে দূর করে এখন তো টিভিই সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করছে।এখন এক ভয়াবহ সময়ের মধ্যে দিয়ে চলছি। স্বাধিন চিন্তার ক্ষমতাই নেই। আমরা হয়ে গেছি রোবট।
কথায় কথায় বইতে তিনি লিখছেন “ট্র্যাডিশন ভাঙাই হচ্ছে ট্র্যাডিশন।“ একজন সফল ব্যঙ্গচিত্রকার হিসাবে তাঁর এই উপলব্ধি আজ আমাদের বহিরঙ্গের যে অবস্থান তার নিরিখে অত্যন্ত দামি।
১৯৮০ সাল থেকে সক্রিয়ভাবে রাজনৈতিক ব্যঙ্গের মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে উজ্জীবিত করে রেখেছেন শিশির বাবু।
নরেন রায় ওরফে সুফির জন্ম অবিভক্ত বাঙলাদেশে। দেশ ভাগের সময় জন্মস্থান কুমিল্লা ছেড়ে হাওড়ার শিবপুরে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করে তাঁর পরিবার। দারিদ্র আর বেঁচে থাকার সংগ্রাম তাকে জীবনে অনেক কিছু শিখিয়েছিল। হাওড়ার অন্যতম জনপ্রিয় কার্টুনিস্ট নারায়ণ দেবনাথের সাথে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেন তিনি। বহু শিশুপত্রিকার সঙ্গে যুক্ত থাকা এই মানুষটি সেভাবে কোনও দিন স্বীকৃতি পান নি তাঁর কাজের। তবু সাধারণ জীবন যাপন করে বাঙলাকে দিয়েছেন অনবদ্য সব ছবি।
আসলে বাঙালির অন্তরঙ্গের পরিচয়খানা বুঝি সবথেকে ভালভাবে পরিস্ফুট হয়ে ওঠে তার ঠাট্টা, ইয়ার্কি, পরনিন্দা, পরচর্চায়। বাঙালির মুল্যবোধ, আর রসবোধ কালের নিয়মে বদলেছে। বদলেছে তার প্রকাশভঙ্গি, তার পরিসর। বাঙলায় পরবর্তীকালে এসেছেন বহু ব্যঙ্গচিত্র শিল্পী। তাঁদের অবদানে সমৃদ্ধ হয়েছে বাঙলার রসবোধ। ব্যঙ্গের কষাঘাতে বিপন্ন হয়েছেন আমাদের রাজনৈতিক নেতানেত্রীরা। কিন্তু এই একবিংশ শতাব্দীর দু’দশক পেরিয়ে এসে আজ আমরা যে সামাজিক পরিসরে দাঁড়িয়ে আছি তাতে করে ছাপার অক্ষর ক্রমাগত মিলিয়ে যাচ্ছে ভার্চুয়াল জগতে। আন্তর্জালের ফাঁদে আটকে পড়েছে আমাদের মন ও মনন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে তাতে কি বাঙালির রসবোধ থমকে গেছে? হয়ত মাধ্যম বদলেছে, বদলেছে তা উপস্থাপনার ভঙ্গিমা, ব্যঙ্গচিত্র আজ মীম হয়ে ভাইরাল হচ্ছে বাঙালির প্রাত্যহিক জীবনে। প্রচণ্ড মানসিক চাপের মুখে, ব্যক্তিগত শোক দুঃখের মধ্যেও, দ্রুতগামী জীবনের দৌড়ের ফাঁকে যখন স্ক্রিনে ভেসে ওঠে মীম তখন অজান্তেই হেসে উঠি আমরা। এই মীম জিনিসটা কি? জিন যে আমাদের বংশগতির ধারাকে এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মে বয়ে নিয়ে যায় এতো বিজ্ঞান বই পড়ার সুবাদে আমাদের জানা। জিন আমাদের বৈশিষ্ট্যগুলিকে পরবর্তী প্রজন্মে চালিত করে। মীমকে জিনের মাসতুতো ভাই বলা চলে। প্রখ্যাত বায়োলজিস্ট রিচার্ড ডকিন্স ১৯৭৬ সালে তাঁর বই “দ্য সেলফিশ জিন”স-এ লিখলেন জিন যেমন বংশগতির ধারক ও বাহক, মীম তেমনই সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। কোনও আইডিয়া বা আচরণ বা স্টাইল এক ব্যক্তি থেকে আরেক ব্যক্তিতে চারিত হয় এবং ক্রমে বিরাট জনগোষ্ঠীর মধ্যে এক বিশেষ সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যরূপে দেখা দেয়। তখন সেই আইডিয়া বা আচরণকে মীম বলে অভিহিত করলেন ডকিন্স সাহেব। অর্থাৎ কিনা জিনের মতোই মীম মিউটেশনের মাধ্যমে ও প্রতিরূপ তৈরি করতে করতে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে সংস্কৃতির ধারাকে বহন করে চলে। সমাজের ভাঙা গড়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মীমও তার রূপ বদলাতে থাকে। এ কী কথা শোনালেন ডকিন্স সাহেব! আন্তর্জালের দৌলতে হাজারো মীম প্রতিদিন আমাদের ভার্চুয়াল সফরে সঙ্গী হচ্ছে তারা কী সব আমাদের পরবর্তী প্রজন্মে আমাদের সংস্কৃতিকে বাহিত করবে না কি? ডকিন্স সাহেব যে মীমের উল্লেখ করেছেন তা স্বতস্ফূর্তভাবে জন্ম নিয়ে আপন বেগে বয়ে চলে এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মে। কিন্তু ইন্টারনেট ছেয়ে আছে যেসব মীম তার প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে আজকের ইন্টারনেট মীম কিন্তু শুধু হাল্কা হাসি বা ব্যঙ্গরসে সীমিত নেই। চটকা জনপ্রিয়তা লাভের আশায় অনেক সময়ে শালীনতার সীমা ছাড়াচ্ছে এই ভাইরাল হওয়া মীম। বদলাচ্ছে সমাজ, বদলাচ্ছে মীমের প্রকৃতি আর স্বরূপ। হাল্কা হাসি-ঠাট্টা বা ব্যঙ্গ নয়, এখনকার মীম নির্মমতার তুঙ্গে পৌঁছে যাচ্ছে কখনও কখনও। সামাজিক মাধ্যমগুলোতে প্রতিদিন অসংখ্য মীম ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার মধ্যে রাজনৈতিক মীম আছে, সেলিব্রেটিদের নিয়ে মীম আছে, ধর্ম নিয়ে উস্কানিমূলক মীম আছে। আমরা প্রতিদিন সেগুলো দেখছি, শেয়ার করছি। হ্যাঁ, অনেক সময় দায়িত্বজ্ঞানহীন ভাবে শেয়ার করছি। আমাদের আচরণ হাঁটি হাঁটি পা পা করে ইন্টারনেটের জগতে নিম্নরুচির সংস্কৃতির পদচিহ্ন রেখে এগিয়ে চলেছে।
কার্টুন ছবিতে রাজনৈতিক বিষয়ে বা সামাজিক সমস্যা নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য আগেও প্রকাশ করতেন শিল্পীরা। কিন্তু আজকের মীম অনেক ক্ষেত্রেই শালীনতার সীমা ছাড়িয়ে হয়ে উঠেছে চরম প্রতিহিংসামূলক। ইন্টারনেটের দৌলতে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ার ফলে অনেক সময় যে ব্যক্তি বা সংগঠনের উদ্দেশ্যে এই মীম তৈরি হয়েছে তার অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। বহু ক্ষেত্রে এই সমস্ত মীমের বিশ্বস্ততা বা চিন্তার উর্বরতা প্রায় থাকে না বললেই চলে। দিন বদলের পালা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। সংস্কৃতি প্রকাশের মাধ্যম বদলেছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। আজকের মীম কি বাঙলার ব্যঙ্গচিত্রশিল্পীদের দায়িত্বশীল সৃষ্টিগুলোর যোগ্য উত্তরসূরি হয়ে উঠতে পারবে কি? এই প্রশ্ন দেশ কাল নির্বিশেষে আপামর বাঙালি জাতির কাছে একটা বড়ো চ্যলেঞ্জ।
তথ্য ও ছবি ঋণ
সমস্ত ছবির উৎসঃ ইন্টারনেট
ব্যঙ্গচিত্রের ব্যবচ্ছেদ- রেনেসাঁ থেকে বর্তমান, ইতিবৃত্ত।
বাঙলার ব্যঙ্গচিত্র, চন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, অপার বাঙলা
ব্যঙ্গচিত্র কি সত্যিই রাজনৈতিক মুক্তির হাতিয়ার, চন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, Banglaalive.com
কথায় কথায়, চন্ডী লাহিড়ী
ই-পত্র ‘কার্টুন আর পোস্টার