• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৬ | এপ্রিল ২০২২ | গ্রন্থ-সমালোচনা
    Share
  • সভ্যতার অসুখ : রবিন পাল

    সভ্যতার অসুখ — অনুরাধা রায় ; থীমা, কলকাতা, প্রচ্ছদ – অজয় গুপ্ত; প্রথম প্রকাশ-- বইমেলা ২০২২; ISBN: 978-93-81703-94-6

    কিছু বই আছে যা চেখে দেখার, আর কিছু গপ্ গপ্ করে গিলে নেবার, কিন্তু অল্প কিছু বই আছে যা চিবোনোর আর শেষ পর্যন্ত হজম করার। বেকন্-এর এ কথাটি সত্যি বলে মনে হয়। এবং ভালো একটা বই এক master-spirit-এর মূল্যবান life blood, যা embalmed ও সংরক্ষিত এই উদ্দেশ্য থেকে যে সে বই জীবন থেকে জীবনান্তরে প্রবাহিত হতে পারে। মিল্টন-এর এ কথাটিও মানি। শ্রীযুক্তা অনুরাধা রায়ের ‘সভ্যতার অসুখ’ বইটি বারংবার চিবোনোর এবং হজম করবার। এ ধরনের বই প্রাণিত করতে পারে বিবেকী পাঠককে জীবন থেকে জীবনান্তরে। তিনি এ সময়ের অগ্রগণ্য বাঙালী ঐতিহাসিক, বাঙলা সংস্কৃতিকে তিনি নানা প্রেক্ষিত থেকে বিশ্লেষণ করে চলেছেন, যার আবেগ উচ্ছ্বাস সংযত উপস্থাপন যাতে আছে তুলনামূলক সাম্প্রতিকের কাজ ও তত্ত্বের পরিচয় ও প্রয়োগ। এবং সে আলোচনা (তাঁর অনেকগুলি বই স্মরণে রেখে বলছি) বুঝতে খুব একটা অসুবিধে হয় না। বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে সহজ উপস্থাপনার রেওয়াজ আজ বিরল, যাদের লেখা পড়ে বোঝা যায়, বোঝার পর তর্ক করা চলে, অনুরাধার বাংলা ও ইংরেজি লেখালিখি সে ক্ষেত্রে অন্যতম।

    বইটিতে আছে ৯টি প্রবন্ধ, লেখার কাল ২০০৫ থেকে ২০২১, তবে আলোচনাকালে বর্তমান পাঠক প্রয়োজন মতো আগে পরে আসতে পারে এবং তাঁর পূর্ব রচিত লেখালিখির কথাতেও যেতে পারে। বইটির ব্যাক কভারে বলা হয়েছে কথা-প্রতিকথার বিনিময়ে বর্তমান সময়কেই বিচার অনুধ্যানের মুক্ত তর্কক্ষেত্রে আনা গেছে বিপুল বৈচিত্র্য এবং এই সংলাপ নির্ভর উপস্থাপনার ভঙ্গিটি বাংলা প্রবন্ধের পরিচিত আদল নয় অবশ্যই। এই আদলটি অর্থাৎ সংলাপ আশ্রয় আমরা ইদানীংকালে পেয়েছি শঙ্খ ঘোষ বা রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের প্রবন্ধে, রবীন্দ্রনাথ যে ভঙ্গি ব্যবহার করেছিলেন ‘পঞ্চভূত’ বইটিতে।

    বইটির নাম রেখেছেন — ‘সভ্যতার অসুখ’। পাঠকের মনে পড়া স্বাভাবিক ‘সুচেতনা’ কবিতাটি, যাতে জীবনানন্দ দ্বিতীয় স্তবকের শেষে বলছেন — ‘পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন; / মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীরই কাছে।’ ‘সুচেতনা’, ‘বনলতা সেন’ (পৌষ ১৩৪২) কাব্যের সংযোজন অংশের অন্তর্ভুক্ত। দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘জীবনানন্দ দাশের কাব্য সংগ্রহ’ বইটিতে এ কবিতাটি পত্রিকায় প্রকাশের সাল তারিখ দেন নি। এই কাব্য গ্রন্থটির মধ্যে এবং অন্যত্র ‘অন্ধকার’ কথাটি বহু ব্যবহৃত। ‘অন্ধকার’ নামেও কবিতা আছে এ বইতে। অনুরাধা বলেছেন — ‘ইতিহাস আর সমাজবিদ্যা চর্চা, মানে মানব অস্তিত্বের সামাজিক স্তরটা নিয়ে পড়া, পড়ানো, লেখালিখিই তার পেশা।’ এবং সমাজ স্বদেশ সংস্কৃতি, তাদের সব অসংগতি, অসুখ নিয়ে যাপনের পটভূমিটি তিনি ধরতে চান। তাছাড়া ‘এই করোনাকালে গোটা মানব সভ্যতার অসুখের মোকাবিলা করতে হয়।’ এই দৃষ্টিভঙ্গি লেখার পিছনে কাজ করেছে বলে বইটির নাম সার্থক মনে হয়। প্রসঙ্গত বলে নিই সভ্যতার দেশজ ও আন্তর্জাতিক অসুখকে তিনি ধরতে চান, কিন্তু তাতে আচ্ছন্ন থাকতে চান না। পরিত্রাণের পথ সন্ধান করেন। অর্থাৎ অসুখ মোকাবিলা ও পরিত্রাণের পথ সন্ধান অভীপ্সিত লক্ষ্য। তিনি তিমির বিলাসী নন, বরং মৃত্যুশব্দ জয় করে মানবচেতনা নিরাময়ের পথসন্ধানী, যা জীবনানন্দের ভাষায় হবে ‘ইতিহাস ভুবনে রঙীন’ এর প্রাথমিক পাথেয় — ভালোবাসা, কাছাকাছি থাকা।

    বইটির শেষ প্রবন্ধ — ‘সভ্যতার অসুখ: করোনাকালে কথোপকথন’। এইটি ইতিপূর্বে প্রকাশিত হয় নি পত্রিকায় বা সংকলনে। মাসি, বোনঝির কথোপকথনের মধ্য দিয়ে করোনা সংকটের উৎপত্তি, বঙ্গে ও ভারতে সাধারণ মানুষের বিপন্নতা, উচ্চ ও মধ্যবিত্তের স্বার্থআনন্দ, শাসক শ্রেণীর অবিবেচনার কথা যেমন আছে, তেমনি এই সংকটে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটটিও তুলে ধরা হয়েছে। কিছু ব্যক্তিক প্রসঙ্গ (কথোপকথনরত ২ জনের), তাদের পরিচিত কয়েকজনের প্রসঙ্গ যেমন আছে, তেমনি অনলাইন পড়া ও পড়ানোর সংকট, জনসাহায্যে ব্যতিক্রমী হাত বাড়ানো আছে। ধরা পড়েছে ব্যবসায়ী ও দাপুটে নেতাদের হাতে মানুষের বন্দীত্ব। ‘বড়োলোক ছোটো লোকোমি, জীবনকে পণ্য করে তোলা, নেতাদের অতিনাটকীয় আচরণ ও নির্বুদ্ধিতা, বিরূপ পরিস্থিতি (চীনেও ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স বৃদ্ধি) সংকট বোঝাতে লেখিকা যেমন অলিভার টুইস্টের স্মিথফিস্ত মার্কেটের বা রবীন্দ্রজলসা বা মুক্তধারা প্রভৃতির উদাহরণ দিয়েছেন। অনেক স্ববিরোধিতাও দেখান। দুজনের মধ্যেই আদর্শবাদিতার অভাব সত্ত্বেও করোনা পরবর্তী নতুন পৃথিবী গড়ে তোলার ভাবনা এসেছে। বহু বিশিষ্ট চিন্তাবিদের বইপত্রের কথা আছে। তৎসহ গান্ধী প্রচারিত আত্মনির্ভরতা, লোভ পরিহার, মধ্যবিত্ত অসাড়তা ত্যাগের কথা এসেছে। গান্ধী কথিত কিছু নিদান থাকলেও গান্ধী ও গান্ধীপন্থার সমালোচনাও আছে। সেমিনার সক্রিয়তার অন্তঃসারশূন্যতা, টি. ভি. কালচারের তীক্ষ্ণ সমালোচনা, রাজনীতিবিদদের প্রতি শ্লেষ বিদ্রূপ আছে। স্বৈরাচারী শাসকদের সর্বগ্রাসী নজরদারি এবং উগ্র জাতীয়তাবাদের সাহসী সমালোচনাও আছে। নিদান স্বরূপ আছে কাছাকাছি প্র্যাকটিস, শারীরিক শ্রম, সোসাল ডিসট্যানসিং-এর সমালোচনা আছে। সভ্যতার উৎকট অসুখটা মোকাবিলার কিছু নিরীক্ষার কথাও আছে। সমাজবৈষম্য ও জাত বৈষম্য দূর করার কথা আছে। আর বলা হয় বহুকালীন কিছু সত্য (যেমন — প্রযুক্তি বরাবরই বৈষম্যের জন্ম দিয়েছে ইতিহাসে, পৃ. ২৫৮) আত্মনির্ভর ভারত, ছোট্ট ক্ষেত্রে জননৈকট্য স্থাপনের কথা প্রভৃতির মাধ্যমে গোটা পৃথিবীটার গভীর অসুখের কথা অনুভব, মানবপ্রকৃতিকে জৈবিকতাকে শারীর রসায়ন দিয়ে বোঝার গুরুত্বের কথা বলেছেন। হেমন্ত মুখার্জির একটা গান (এমন একটা ঝড় উঠুক) দিয়ে এ প্রবন্ধ শেষ হয়, এতে সাঙ্গীতিক প্রলেপ লাগে। নৈরাশ্য থেকে আশা পথে যাত্রার তথ্যসমৃদ্ধ সামাজিক ও বিশ্বায়িত পৃথিবীর দিকে বিচারী দৃষ্টিপাতে দীর্ঘ প্রবন্ধটি এ সময়ের একটি উল্লেখ্য লেখা বলেই মনে হয়েছে।

    অনেক দিন আগে শঙ্খ ঘোষ একটি কবিতায় লিখেছিলেন — আমাদের ডান পাশে ধ্বস / আমাদের বাঁয়ে গিরিখাদ / আমাদের মাথায় বোমারু / পায়ে পায়ে হিমানীর বাঁধ / আমাদের পথ নেই কোনো / আমাদের ঘর গেছে উড়ে / আমাদের শিশুদের শব / ছড়ানো রয়েছে কাছে দূরে / আমরাও তবে এইভাবে / এ-মুহূর্তে মরে যাব না কি? / আমাদের পথ নেই আর / আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি।’ (কোন বই মনে পড়ছে না) অনুরাধার কাছাকাছি তত্ত্ব আর বেঁধে বেঁধে থাকা বোধ হয় একই সুরে চলে। এই তত্ত্ব, লেখিকা বলছেন ১৯৯০ এর দশক থেকেই তার মাথায় ঘুরছে, ‘সে সময়’ সমাজবাদ বরবাদ আর বিশ্বায়নের সূচনা হল, কথাটা বললেন ২০০৫ এ ছাপা বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধের শতবর্ষে একটি লেখায় (পৃ. ২২২)। অতএব সে লেখাটা ধরা যাক। শেষোক্ত প্রবন্ধ দুই বোনের পারিবারিক কথায় শুরু, এবং গান্ধী কথিত স্বরাজ সাধনা, সংকীর্ণ দেশপ্রেমের কথা, কাজের জায়গা ভুলে দূরকে নিয়ে মাথা ঘামানোর সমর্থন, বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাস গবেষণায় দেশে থাকার জরুরীত্ব, পোস্ট কলোনিয়ালিজম যে এক ফ্যাশন-শব্দ, রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীর বিশ্বজনীনতা ও কাছাকাছি তত্ত্বের সহাবস্থান, স্বদেশি আন্দোলনের (১৯০৫) বিলাতি বয়কট সমালোচনা, গ্লোবালাইজেশন প্রভাবে ভোগবাদের ব্যাপকতা, কৃতি ছাত্রছাত্রীরা ‘বলি প্রদত্ত আমেরিকার জন্য’, জীবন কক্ষপথের আপেক্ষিক গতি ইত্যাদি ছোট্ট করে আলোচ্য। যার আড়ালে অবশ্য একগুচ্ছ সমালোচনা অপেক্ষায় থাকে পাঠকের জন্য।

    ‘এই উত্তর-স্বাধীনতা’ প্রবন্ধের বিষয় ‘স্বাধীনতা’ প্রসঙ্গের রকমফের। নারী স্বাধীনতা, কেনাবেচার স্বাধীনতা, ডিস্কোতে নাচের স্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা, অ্যাডাম স্মিথ ও রুশোর স্বাধীনতা চেতনার পার্থক্য, বিলেতি তত্ত্ব থেকে দেশীয় ঐতিহ্য, গান্ধীর গ্রাম-স্বরাজ, সার্ত্র ও ফুকোর তত্ত্ব, যথার্থ স্বাধীনতার জন্য সমাজ আনুকূল্য, মার্ক্সবাদে ব্যক্তিস্বাধীনতার জন্য লড়াই, এলিয়েনেশন তত্ত্ব, রবীন্দ্র ‘আত্মশক্তি’ কথা, রবীন্দ্র ও গান্ধীর সীমাবদ্ধতা, রামমোহন প্রমুখ উনিশ শতকীদের স্বাধীনতা ধারণার স্বরূপ, প্রভৃতি প্রসঙ্গ আলোচিত। লেখিকার উপলব্ধি জীবনে অ-স্বাধীনতাই বেশি, স্বাধীনতা তুলনায় কম। নারী স্বাধীনতার যাথার্থ্যবিচার, যা-ইচ্ছে পোশাকের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে মারাত্মক উপমা — নেকড়ে বাঘের পেটের মধ্যে বসে স্বাধীনতা সম্পর্কে তৃপ্তি, কাজান জাকিসের জোর্বার স্বাধীনতা, ইভান ভাজব-এর ধারণার তফাৎ বলা হয়। বাংলা সাহিত্যে জোর্বার মতো চরিত্র নেই, বুদ্ধের স্বাধীনতা বোধ, এরিক ফ্রমের স্বাধীনতার ভয় বইটির উল্লেখ, উনিশ শতকে বাঙালী স্বাধীনতা ভীতি, সে সময়ে মেয়েদের খাঁচায় বন্দীত্ব চেতনা, ভিকটিম ফেমিনিজম ও পাওয়ার ফেমিনিজম কথা। দেখা যায় স্বাধীনতা নিয়ে সেমিনারে, মিছিলে যাওয়া না যাওয়া, ভোট দেওয়া না দেওয়া প্রসঙ্গায়ন শেষ দেখা গেল — কেউ আমরা স্বাধীন নই, পাগল ছাড়া। বিভূতিভূষণ এর ‘মনটা খুব মুক্তির সন্ধানী ছিল’ (পৃ. ৩৯) পুনর্বিবেচনার দাবী রাখে। ব্যক্তিত্ব ও তাত্ত্বিক প্রসঙ্গের দ্রুতগামী উত্থাপন খুব চমৎকার। ৪৭-পরবর্তী ভারতীয় স্বাধীনতা ও পাশ্চাত্যে তার স্বরূপ — নামকরণে ধরার চেষ্টা আছে।

    ‘মিছিল ছাপিয়ে’ একটি অভিনব লেখা। নন্দীগ্রাম ঘটনার প্রতিবাদে মিছিল যাতে ভদ্রলোকদের প্রাধান্য, যাতে যোগ দিয়েছেন অতীতের বরেণ্যরা কেউ কেউ (যথা রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম) আবার নিখিলেশ, সন্দীপ, ব্রতী প্রভৃতি সৃষ্ট চরিত্র — এই ফ্যান্টাসির আবহ রচনা করে তিনি পক্ষে, সীমাবদ্ধতায়, সম্ভাবনায় দীর্ঘ মিছিল দৃষ্টান্তের উপস্থাপন করেছেন। প্রসঙ্গত সাম্যবাদী দেশজ ঐতিহ্যের সমালোচনা, আন্দোলন ইতিহাসে মৌলিক চিন্তার দাবিদার, বড়োমাপের তাত্ত্বিকের অনুপস্থিতি কিংবা বুদ্ধিজীবীর একালীন ভাবনা প্রভৃতি এসেছে। কিছু শ্লেষ, কিছু দুঃখ, কিছু উপলব্ধিতে বুদ্ধিদীপ্ত মনোগ্রাহী রচনা আমদের লিখন ঐতিহ্যে একেবারেই বিরল। যান্ত্রিক প্রবন্ধায়ন ছাপিয়ে এ রচনা হয়ে ওঠে ভিন্নস্বাদী দৃষ্টান্ত।

    টুনু ও দিদির কথাবার্তায় উঠে আসে — ‘তুই তো ছোটবেলায় গল্প লিখতিস।’ (পৃ. ৩) এই গুণ বা বৈশিষ্ট্য দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহৃত হয় এ বইটির আঙ্গিকে, ভাষারীতিতে, কথনে। বোধকরি এ ভাবেই প্রবন্ধ বলতে আমরা সচরাচর যা বুঝি অর্থাৎ তত্ত্ব ও তথ্যের উপস্থাপন, তার যান্ত্রিকতা-মুক্ত নতুন একটা ধাঁচ গড়ে উঠতে থাকে অনুরাধার লেখায়, অন্য কারো কারো প্রয়াসে। ‘বোকা বসন্তের গল্প’ বা ‘বইয়ের চেয়ে বড়ো’ এ দুটি রচনায় আছে স্মৃতি উন্মোচনের অবেগী চেহারা। প্রথমটি লেখিকার গড়ে ওঠার, নিজেকে সচেতন ভাবে গড়ে তোলার প্রসঙ্গ। তাঁর গবেষণার বিষয় নির্বাচন, গৌতম চট্টোপাধ্যায়, চিম্মোহন সেহানবীশ, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরী, হেমন্ত, শম্ভু মিত্র, সোমনাথ হোর, সুধীপ্রধান, গৌরী চট্টোপাধ্যায়, পূর্ণেন্দু পাত্রী, অরুণ সেন, খালেদ চৌধুরী — এদের সম্পর্কে গল্প ফাঁদেন নি, তাদের অবদানের দিক। সীমাবদ্ধতার কথা একটা নির্মোহ বিশ্লেষণ উঠে আসে। নিজেকে তিনি বারংবার ‘বোকা’ বলেছেন, ভূমিকা থেকে অন্যত্র ‘বোকা বসন্তের গল্প’ রচনায় তা বহুব্যবহৃত। কে বোকা কে চালাক এর একপেশে বিচার হতেই পারে, কিন্তু রচনা বা কর্ম সামর্থ্যে মূল্যায়ন হবার কথা — কে বোকা কে বোকা নয়। ‘বইয়ের চেয়ে বড়ো’ রচনায় এই ‘কথা বৃত্তান্ত’ রচনায় তিনি তাঁর ডাক্তার পিতা ও তার নানা কৃতিত্বের, স্বকীয়তার, দৃষ্টান্ত স্থাপনের বিবরণ দিয়েছেন, একান্ত কাছের মানুষকে ঐতিহাসিক মানুষ রূপে অঙ্কন করেছেন। অনুরাধার অর্জিত উত্তরাধিকার কোন্ পথে তা কোনো কোনো পাঠকের দৃষ্টি এড়িয়ে যাবে না। বই সম্পর্কে, বই-এর সঙ্গে জীবনকে পাওয়ার অভিজ্ঞতা (পৃ. ১৭৮-১৭৯) নিজের মেধা ও চেতনা দিয়ে বইয়ের সঙ্গে এক দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্ক তৈরি করা (পৃ. ১৮৯) আজকের বইবিরোধী পণ্যশাসিত আস্ফালিত জীবনে একটা বিপরীত দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।

    ‘আগামী পৃথিবী?’ রচনাটি আপাতভাবে ২০১৫ তে বার্লিনে হুমবোল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুকালের জন্য পড়াতে যাওয়ার কথা, যদিও সেমিনার কক্ষের বা শ্রোতা ও পণ্ডিতবর্গের কথা নেই। বরং আছে বহিঃপ্রকৃতি এবং স্মরণীয় কতকগুলি মিউজিয়াম দেখার কথা। এই কাঠামোর ভিতর প্রবেশ করে টুপাই যে ওখানে স্টুটগার্টে কাজ করে, উত্তরবঙ্গে আলাপ, টুপাইয়ের ছেলে বন্ধু, পারস্পরিকতা, টুপাই সংক্রান্ত বাল্যকথা। টুপাইয়ের চাকরিগত প্রেমগত ‘অস্থিরতা’, জার্মানীর গানবাজনা, টুপাইয়ের রান্না, ইউক্রেনীয় শিল্পপ্রতিভা, দূষণমুক্ত বেকার ভাতা ইত্যাদি। শেষের দিকে আছে আবহ-বৈষম্য কথা। অন্ধ দেশপ্রেমের বিপদ, উত্তর আধুনিক, উত্তর জাতীয়তাবাদী পড়াশুনার প্রসঙ্গের পাশে জার্মান চেতনার মুক্তিবোধ, জাতধর্ম দেশ জাতির সীমানা ভেঙে ফেলা (পৃ. ২১৫) তারুণ্যের সমালোচ্য দিক নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু ব্যক্তিমানুষের মর্যাদা, মানবিকতা, মর্যাদাবোধ, সততা, নাগরিক চেতনা এ সব স্বপ্ন দেখায় আগামী পৃথিবীর। এখানেও তর্ক থেকে যায়।

    ‘সল্টলেকে সাড়ে তিন দশক : এক পরবাসীর যাপনের বৃত্তান্ত’ রচনাটিতে একটা কালের ক্রমবিকাশমান সমাজ এবং লেখিকার নিজের ও পরিবারের আকাঙ্খা ও অবসাদের চিত্র আছে। ১৯৭৬ থেকে ২০০৯ এই কালসীমানা। ক্রম পরিণত মন ও মনন নিয়ে তিনি উপলব্ধি করেছেন — ক) সল্টলেকে মেলে নব্য মধ্যশ্রেণীর সমাজ ও সংস্কৃতি খ) তবে সুরুচিবান সংবেদনশীল সমাজনৈতিকতায় সমৃদ্ধ গ) বাসিন্দারা — মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তরা একধরনের সাংস্কৃতিক হেজিমনির শিকার ঘ) কিছু পরে প্রকট ধনের পাশাপাশি রাজনৈতিক ক্ষমতার এলিটত্ব ঙ) জনসংস্কৃতির দাপট ও আগ্রাসন চ) সংস্কৃতির লোকদেখানো দিকটা বড়ো হয়ে ওঠে ছ) মুসলমান প্রতিবেশীতে আপত্তি ছ) উন্নয়নের হুজুগের ঢেউ জ) প্রোমোটারের আধিপত্য। আমি যদিও সল্টলেকের বাসিন্দা নই তবু সত্তর দশক থেকে বন্ধু ও পরিজনবর্গের কাছে যাতায়াতে এসব দুর্বিপাক পথিক দৃষ্টিতেও চোখে পড়েছে। উপভোগ্য বিষাদক্ষিন্ন এই লেখাটি একটা কালের ছবি, কাহিনী ও টুকরো গল্প থাকলেও গল্প বা উপন্যাস নয়। ফলে কথাসাহিত্য পাঠে আগ্রহীদের কাছে আগ্রহ বাড়াবে না। মনে পড়ছে বেশ কিছুদিন আগে কিশলয় ঠাকুরের ‘লাবনি’ নামে একটি নভেলেট পড়েছিলাম যাতে সল্টলেক পত্তন ও বিকাশের কথা আছে। সেই ডকু নভেল এ পাঠে পরিপূরক হতে পারে।

    বাদবাকি রইল শিক্ষা ও সংস্কৃতি নিয়ে দুটি পৃথক প্রবন্ধ। শিক্ষা-বিষয়ক লেখাটি কথোপকথন রীতিতে নয়, তবে কাহিনীর টুকরো আছে। গবেষকদের বানান ভুল, স্কুল গভনিং বডির নির্বাচনের ঘটা, খাতা পড়ে নয়, ‘নম্বর দিতে হয় notionally’, বিদ্যাবিমুখ জীবন এবং জীবনবিমুখ বিদ্যা, উত্তর-আধুনিক যুগের ইতিহাস-সমাজ বিদ্যায় তত্ত্বের খুব প্রাধান্য, শিক্ষায় তঞ্চকতা ও চালাকি, শিক্ষার মূল্য অর্থ প্রতিপত্তিতে, সেমিনার-প্রহসন ও পারস্পরিক পৃষ্ঠ কন্ডূয়ন ইত্যাদি। উল্লিখিত প্রসঙ্গগুলি নৈরাশ্যজনক অথচ লেখিকার অর্জুন সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাবে। অন্যত্র তিনি সিলেবাস বদল বা সেমিনারে অনালোচিত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ নির্বাচনের (যেমন- বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ফ্রিডম’ বিষয়ক আলোচনা) কথা ভেবেছেন কিন্তু বার্তমানিকতার দূরবস্থা তাকে কতদূর সহায়ক করবে বলা শক্ত। সবশেষে ধরি সংস্কৃতি বিষয়ক প্রবন্ধটি। আমাদের যৌবনকালে দীপেন্দু চক্রবর্তীর ‘সংস্কৃতির ক্ষয়ক্ষতি’ বইটি বেশ নাড়া দিয়েছিল। অনুরাধার প্রবন্ধটিও নাড়া দেবার মতো। আলোচনার শুরুতে চ্যাপলিন, মাইকেল এঞ্জেলো, রবীন্দ্রনাথ, শেক্সপীয়র প্রভৃতি বরেণ্যদের কথা ও কাহিনী এসে গেল, যেখানে পৃষ্ঠপোষক বা পেট্রনদের ভূমিকা, উঠল। কিন্তু আজকে পৃষ্ঠপোষক সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রণ করে, তার অনুকূল প্রবাহে চললে অনেক সুবিধা, প্রতিকূলে জাগে নানা প্রতিবন্ধকতা। প্রসঙ্গত পোস্ট কলোনিয়াল স্টাডিতে টেম্পেস্ট বিচার, কডওয়েলের ইলিউসন অ্যান্ড রিয়ালিটির বক্তব্যে আগ্রহ সোভিয়েতে সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার চাপ, ইত্যাদির পর কালচার ইন্ডাস্ট্রির কথা উঠল। একসময় শুনতাম এডর্নো বলছেন আউশ উইৎস এর পর কবিতা লেখা বৃথা। কিন্ত এ আক্ষেপকে সরিয়ে রেখে ইউরোপে এবং আমাদের দেশে (নানা দুর্বিপাক ও অপমৃত্যু সত্ত্বেও) কবিতার প্লাবন বইছে। অ্যাডর্নো কালচার ইন্ডাস্ট্রির কথা বলতেন। হর্কহাইমার-ও। তাঁদের রচনা ‘The Culture Industry : Enlightenment as Mass Deception’ পঠিতব্য। তাঁরা মাস কালচারের পরিবর্তে কালচার ইন্ডাস্ট্রি কথাটির পক্ষপাতী। হলিউড সংস্কৃতির উদাহরণ দিয়ে বলছেন সংস্কৃতি-ব্যবসায় ও সংস্কৃতির বৈরী সম্পর্ক। অনুরাধা আমাদের দেশের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ী ও ব্যবসা মনোবৃত্তির দিকটি তুলে ধরেন, খেলার জগতেও পেট্রমেজের কথা ওঠে, খুঁটির জোরে মেড়া লড়ে’র কথা, জনতার হৈ চৈ, ট্যালেন্ট হান্ট মস্তি মার্কেটের আধিপত্য, গলবস্ত্র সংস্কৃতি, গলায় গামছা সংস্কৃতির কথা এনেছেন। তাঁর উপলব্ধি — পড়াশুনো তো উঠেই গেছে, লোকে সাহিত্যিক চেনে বিজ্ঞাপন দেখে, বিশ্বজয়ী ধনতন্ত্রের দাপট প্রভাবিত সংস্কৃতি অবশ্য দুনিয়াজোড়া বিরাজিত যা গুগল খুললে টের পাওয়া যায়। শিরদাঁড়া সোজা রেখে দাঁড়ানো শুনতে ভালো, কিন্তু বিপজ্জনক। এ গাড্ডা থেকে ওঠার কোনো উপায় এখনো নেই।

    বইটিতে লেখিকা সভ্যতার অসুখের লক্ষণগুলি দেখিয়েছেন যদিও প্রচ্ছন্নভাবে রোগ নিরাময়ের কিছু কথাও আছে। ওঁর লেখার বড়ো গুণ তিনি কঠিন বিষয়কে সহজ করে বলতে জানেন, কারণ লক্ষ্য মানুষকে বোঝানো। ‘In dark times an intellectual is very often looked to by members of his or her nationality to represent, speak out for, and testify to the sufferings of that nationality.’ (E. Said) আর অন্ধকারাচ্ছন্ন বিশ্বে প্রসঙ্গকে আকৃষ্ট করে তোলার জন্য তিনি গল্পের, রসিকতার, শ্লেষ বা রঙ্গের আশ্রয় নেন, মাঝে মাঝে অবশ্য ফুটে ওঠে তাঁর তীক্ষ্ণ স্বর। তিনি নিজেকে আড়াল করেন না। নোয়াম চমস্কি বলেছিলেন ‘Edward Said helps us to understand who we are and what we must do if we aspire to be moral agents, not servants of power.’ বাঙালি পাঠক ভাববেন আশা করি। ভগিনী অনুরাধার লেখার আড়ালে বইয়ের খসখস শব্দ শোনা যায় বলেছেন একজন। হ্যাঁ, তার দরকার আছে, লড়াইয়ে নামলে। ভগিনী তর্ক করতে ভালোবাসেন, তাই বলি, কোনো কোনো প্রসঙ্গে তাঁর কিছু মন্তব্য পুনর্বিবেচনার কথা মনে হয়। যেমন — বিভূতিভূষণ সম্পর্কে, টুগেনিভ প্রসঙ্গে। কিন্তু সেসব আবার একদিন হবে। আপাতত কতিপয় পাঠককে বইটি পড়ার ডাক দিই।

  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments