• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৬ | এপ্রিল ২০২২ | গ্রন্থ-সমালোচনা
    Share
  • মেঘ পাহাড় আর কুয়াশা মানুষ : সৃজা মণ্ডল

    মেঘ পাহাড় আর কুয়াশা মানুষ — কল্পনা রায় ; প্রয়াগ প্রকাশনী, আসাম, প্রচ্ছদ – বরুন সাহা; প্রথম প্রকাশ—আশ্বিন, ১৪১৩

    বীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘গর্মি যখন টুটল না আর পাখার হাওয়া সরবতে ঠাণ্ডা হতে দৌড়ে এলুম শিলং নামক পর্বতে’। শিলং-এ এলেই মনে হবে কোনো এক মেঘের দেশে এসেছেন। হাত বাড়ালেই মেঘ। প্রতি মুহূর্তে মেঘ, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ও ঠান্ডা হওয়া আপনাকে ভিজিয়ে দেবে। যেন মেঘে ঘেরা এক জনপদ। প্রত্যেক পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজেও মেঘ। মেঘ-ঢাকা পাহাড় ঘেরা কুয়াশাচ্ছন্ন শিলং প্রকৃতির এক আশ্চর্য রূপচ্ছবি। পাহাড় ভেঙে বন কেটে বসত হল, জঙ্গল কেটে গড়ে উঠল অপূর্ব নৈসর্গিক শহর শিলং। উঁচু-নিচু পাহাড়ী খাঁজে ছোট ছোট ইতস্তত ঘরবাড়ি, সাহেব-ইউরোপিয়ান পল্লি, অফিস পাড়া, সেনানিবাস — প্রকৃতির দানে, মানুষের বাস্তব ভাবনায় গড়ে ওঠা শিলং এক সৌন্দর্য-নগরী।

    ২৮ এপ্রিল, ১৮৬৬। শিলং-এর জন্মদিন। ১৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দে অসম প্রদেশের রাজধানী হয় শিলং। উনিশ শতকের শেষে ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পর অদম্য প্রাণশক্তি নিয়ে আবার সপ্রতিভ হয়ে উঠেছিল এই নিসর্গ শহর। কল্পনা রায়ের ‘মেঘ পাহাড় আর কুয়াশা মানুষ’ শিলং-এর প্রকৃতি ও মানুষের জীবনাশ্রিত শুধুমাত্র একটি অভিনব উপন্যাস নয়, ১৯০১ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত শিলং-এর ইতিহাসের দলিল, ডকুমেন্টেশন।

    শিলং উত্তর-পূর্ব ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পূর্ব খাসি পাহাড় জেলার একটি শহর। খাসিরা এখানকার আদি জনগোষ্ঠী। মাতৃতান্ত্রিক এই জনগোষ্ঠী নিজেদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে চলেছিল। ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দে খাসি পাহাড়ে ইংরাজ আধিপত্য বিস্তার করে। আসামের চিফ কমিশনার হপকিন্সন সাহেব স্বপ্ন দেখেন জঙ্গল কেটে শহর তৈরি করার। অফিস উঠে এল শিলং-এ। এলেন বাঙালি সিলেটী আমলারা, এলেন শ্বেতাঙ্গ অফিসার, জায়গা নিলেন সাহেব পল্লিতে। চাকরি সূত্রে গৌহাটি থেকে এলেন ব্রাহ্মসমাজ ভুক্ত পুরুষ ও মহিলারা। পাহাড়ের ওপর জেগে থাকা ছোট ছোট জনবসতি মেলে ছড়িয়ে দিল নিজেকে, তৈরি হল শিলং শহর।

    কল্পনা রায়ের ‘মেঘ পাহাড় আর কুয়াশা মানুষ’ উপন্যাসে জায়গা করে নিয়েছে শিলং-এ বসবাসকারী নানা জনজাতির রোজনামচার জীবন। এই উপন্যাসে ব্যক্তি বিশেষের কথা বা কাহিনি মুখ্য হয়ে ওঠে নি, এই উপন্যাসে আছে একটি জাতি তথা সভ্যতার কাহিনি। অগণিত চরিত্র — বাঙালি, খাসি, নেপালি, মুসলমান, ইংরেজ — বিচিত্র তাঁদের জীবন কথা, তাঁদের ভাবনা — কখনও তাঁরা প্রধান ভূমিকা নিয়ে আসে আবার কখনও সামান্য চরিত্রও প্রাণবান হয়ে ওঠে সহজ সারল্যে। বিভিন্ন চরিত্রকে নিয়ে গড়ে উঠেছে অদ্ভুত বিচিত্র কাহিনী সব — কোনোটি প্রেমপ্রীতি-ভালোবাসায় উজ্জ্বল, কোনো গল্প ঈর্ষা-প্রলোভনে তিক্ত তীব্র, কোনোটি কাম-কামনা-কলুষতায় আবিল আবার কোনো জীবনকথা কৌতুক-আনন্দ-হাস্য-পরিহাসে স্বচ্ছতোয়া। প্রতিটি কাহিনিই একক গল্পকথা যা উপন্যাসের পরিধিতে মিশে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে মানুষের বহু বিবিধ প্রাণচর্যার।

    উপন্যাসের চরিত্র অনেকেই প্রত্যক্ষ বাস্তব পরিচিত, যেমন- বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ। কবির সঙ্গে এই শৈলশহরের অচ্ছেদ্য বন্ধন। ১৯১৯ সালের বিক্ষুব্ধ ভারতে প্রতিবাদের মুখ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। জালিয়ানওয়ালাবাগে নিরস্ত্র, নিরপরাধ ভারতবাসীর হত্যার প্রতিবাদে তিনি ঐ বছরের ১৩ই এপ্রিল ভাইসরয়কে চিঠি দিয়ে নাইটহুড ত্যাগ করেন। তারপর মানসিক শান্তির খোঁজে আশ্রয় নেন শিলং পর্বতে। মানুষের মুখ থেকে প্রতিবাদের ভাষা কেড়ে নেবার অপচেষ্টা তাঁকে অত্যন্ত ব্যথিত করেছিল। কবির ঠিকানা ছিল রিবংয়ের ব্রুকসাইড বাংলো। টানা দুমাস তিনি ছিলেন ওই বাড়িতে। শুধু রবীন্দ্রনাথ নন, নেতাজী এবং স্বামী বিবেকানন্দও শিলংয়ের আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু কবির মতো বারবার ফিরে আসেননি তাঁরা। যখনই রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত কারণে চিত্তবৈকল্য ঘটেছে, রবীন্দ্রনাথ ছুটে এসেছেন এই পাহাড়ে। রচনা করেছেন ‘যোগাযোগ’ উপন্যাস ও ‘রক্তকরবী’ নাটক। অবিস্মরণীয় মহিমায় বিরাজ করেন হাসন রাজা — জমিদার বংশের যে মানুষটি নৌকোয় বসে সবুজ রঙের মখমলের পাজামা, লাল রঙের কোট, মাথায় সবুজ পাগড়ি পরে কবিতা লিখতেন, গান গাইতেন যার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ আবিষ্কার করেছিলেন এক দার্শনিক তত্ত্ব — ব্যক্তি স্বরূপের মধ্যে বিশ্ব সত্যর উপলব্ধি। এর সাথে আমরা পাই ঋষি অরবিন্দ পত্নী মৃণালিনীর কথাও। ঋষি অরবিন্দ যখন পণ্ডিচেরিতে, তখন মৃণালিনী শিলং-এ। এই সৌন্দর্যময়ী বিষাদপ্রতিমা পাঠকের মনকে অশ্রু সজল করে। এছাড়াও আছেন উ বাবু জীবন রায়ের কথা — যিনি খাসি সমাজের নবজাগরণের এক প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব। বিদেশী ভাবধারার সর্বগ্রাসী প্রভাব থেকে খাসি জাতিকে জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিলেন তিনি। খাসি জাতির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষার পাশাপাশি ভারতের মূল সাংস্কৃতিক ধারার সাথে পরিচয় ঘটিয়েছিলেন তিনি। উপন্যাসে তাঁদের আগমন কোনো আতিশয্য বা কোনো ত্রস্ত সংকোচের কারণ ঘটায় নি, তাঁদের আবির্ভাব কোনো বিচ্যুতি ঘটায় নি, বরং তাঁরা উপন্যাসে সঞ্চার করেছেন আলোকদীপ্তি, শিলংকে করেছেন আলোকোজ্জ্বল।

    শিলং শহরে ব্রাহ্ম, হিন্দু, মুসলমান, খ্রিষ্টান, বাঙালি, অসমীয়া, নেপালি, খাসি সকলে রয়েছে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে। শিলং-এর প্রাচীন মুসলমান ব্যবসায়ীরা গড়ে তুলেছেন মসজিদ। পুলিশ বাজারের মোড়ে ব্রাহ্মসমাজ। হিন্দুরা গড়ে তুলেছেন সনাতন হিন্দু ধর্মসভা। নেপালিদের রয়েছে মন্দির আর অসমীয়াদের নামঘর। ধর্ম সবসময়েই মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যায় মনুষ্যত্বের চরম বিকাশের মধ্য দিয়ে। স্বপ্ন দেখায় সুন্দর সমাজ আর রাষ্ট্রের। শিলং-এর মানুষদের জীবনযাত্রাতেও খুঁজে পাওয়া যায় ঐক্য সংহতি পরিপূর্ণতা আর প্রত্যেকের মধ্যে একে অপরের জন্য ভালোবাসা। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের জীবনচিত্রণ পাঠকের মনকে গভীর আবেগে, অনুরাগে স্পর্শ করে।

    কল্পনা রায়ের ‘মেঘ পাহাড় আর কুয়াশা মানুষ’ বিরাট জীবনপ্রবাহের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার এক অতুলনীয় শিল্পরূপ। নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে উপন্যাসটি গবেষণাধর্মী রচনাও বটে। বিখ্যাত নৃবিজ্ঞানী ই. বি. টাইলর সংস্কৃতির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, culture is “that complex whole which includes knowledge, belief, art, law, morals, custom, and any other capabilities and habits acquired by man as a member of society.” এই উপন্যাসে লেখিকা খাসিদের নৃতাত্ত্বিক অধ্যয়ন, হিন্দু সংস্কৃতিতে অস্ট্রিক প্রভাব, খাসি রূপকথার প্রতিরূপ, অসমের রাজনৈতিক ইতিহাস, শ্রীহট্টের সাহিত্য সংস্কৃতি ও জীবন চর্যা ইত্যাদি — প্রায় সমগ্র পূর্বাঞ্চলের জীবন-ইতিহাস-শিল্প-সভ্যতা-সংস্কৃতি প্রভৃতি বিবিধ বিষয় অপরিসীম সৃজন দক্ষতায় অন্তর্গত করেছেন। বাংলা অসমীয়া খাসি নেপালি ইত্যাদি সাহিত্য-সংস্কৃতির পরিচয়বহ হয়েছে উপন্যাসটি। সমাজের ভাঙা-গড়া, উত্থান-পতন, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের উদ্বোধন, সামগ্রিক জীবন চেতনার প্রকাশ ইত্যাদি উপন্যাসের বিশিষ্টতা সমূহ এই উপন্যাসে শিল্প কুশলতায় ধরা পড়েছে। নতুন সভ্যতার পত্তন, শহরের অস্থিরতা প্রাণচাঞ্চল্য, অগণিত মানুষের আনাগোনা — তাদের স্বাতন্ত্র্য, তাদের বহুবিচিত্র প্রাণচর্যা, জীবন পরিক্রমা উপন্যাসকে করে তুলেছে দ্বন্দ্ব সংক্ষুব্ধ গতিশীল।

    উপন্যাস ইতিহাস নয়। ঐতিহাসিক ঘটনা আশ্রয়ী হলেও বহুলাংশে কাল্পনিক। কোথায় সত্যের শেষ আর ফিকশনের শুরু — নিজেরও ঠাহর হয় না। সেই অতীত কল্পনায় বর্তমানের ছায়া মিশে থাকে। লেখকের স্মৃতি-শ্রুতি-পঠনের অভিজ্ঞতার প্রতিফলন থাকে। তাই হয়তো উপন্যাসটি অতীত-আশ্রয়ী হলেও বর্তমানের স্বরে কথা কয়। আদতে এই উপন্যাসটি শিলং-এর অন্তরকথা।

  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments