• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৮ | অক্টোবর ২০২২ | গল্প
    Share
  • পথের বাঁকে : সেমিমা হাকিম



    পথের বাঁকে ব্রজবিহারী চট্টরাজের অবয়ব মিলিয়ে যেতে গেট বন্ধ করে বাড়ির পথ ধরলেন নুরজাহান দিদিমনি। সুন্দর মরসুমি ফুলের বাগান দুপাশে, মাঝে ইটের দুরমুশ করা বাঁধানো পথ। ফুট পঞ্চাশ হবে। তারপর গ্ৰিল ঘেরা বারান্দা পেরিয়ে ভিতর বাড়ি। সবটুকু পথ পেরিয়ে এলেন অন্যমনস্ক অভ্যাসে। সামনের বসার ঘরের সেন্টার টেবিলে তখনও পড়ে রয়েছে ব্রজবিহারীকে দেওয়া চায়ের কাপ ডিশ, মিষ্টি, চানাচুর ইত্যাদির গুটিকয়েক প্লেট চামচ, জলের গ্লাস। কারুকার্য করা কাঠের ট্রেতে তুলে রেখে এলেন রান্নাঘরের অন্যান্য এঁটো থালাবাটির সঙ্গে। সাব্বিরের মা এসে ধুয়ে মুছে রাখবে।

    এ বাড়িতে সাব্বিরের মা না হোক পঁচিশ বছর কাজ করছে। প্রথম যেদিন নুরজাহান দিদিমনি এবং তাঁর স্বামী স্থানীয় আকাশনগর হাই স্কুলের হেড মাস্টারমশাই সেখ আখতারুজ্জামান হক এ বাড়িতে গৃহপ্রবেশের মিলাদ দিয়ে বসবাস করতে শুরু করলেন, সেদিন থেকে বেওয়া সাব্বিরের মাও এই বাড়িতে কাজে বহাল হন। সাব্বির তখন বছর ছয়ের শিশু। সকালে মায়ের আঁচল ধরে চলে আসত ছোট্ট সাব্বিরও। নিঃসন্তান নুরজাহান দিদিমনি সকালে আশপাশের ছোট বাচ্চাদের বিনা বেতনে পড়াতেন; তা যত না গরীব দুঃস্থদের মধ্যে শিক্ষার প্রসারের জন্য, তার থেকেও বেশি নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য। পড়োর দল নটা সাড়ে নটায় বাড়ি ফিরলে, তিনি স্নান খাওয়া সেরে বেরিয়ে পড়তেন বাড়ি থেকে কিলোমিটার পাঁচ দূরের ইতিপুর বালিকা বিদ্যালয়ের উদ্দেশে। বাসরাস্তার ওপরই স্কুল। বাস ছাড়াও ট্রেকার চলে, তাই যাতায়াতের অসুবিধা হয় না বা স্কুলে পৌঁছাতে একদিনও দেরি হয়নি তাঁর দীর্ঘ তিরিশ বছরের কর্মজীবনে।

    যাইহোক, সাব্বির প্রথম প্রথম এ বাড়িতে এসে বাইরের দাওয়া থেকে উঁকি দিয়ে দেখত নুর দিদিমনি সবাইকে পড়া বোঝাচ্ছেন, পড়া ধরছেন লেখাচ্ছেন। সে এমনিতেও খুব ছোট, তায় স্কুলে যায় না। ফলে কৌতূহল তো হতোই কিন্তু তার মায়ের ওসব কথা ভাবার সময় কোথায়? ইজ্জতের সঙ্গে নিজের আর ছেলের পেটের ভাত জুগিয়ে বেঁচে থাকাটাই মুখ্য তখন। এ বাড়ির কাজটা তাই সাব্বিরের মায়ের জন্য বড় নেয়ামত, খুব সৎভাবে, গায়েগতরে খেটেখুটে পারলে আরও দুটো কাজ করে দিত নিজে থেকে টেনে নিয়ে। কাজের মধ্যে থালাবাসন মাজা, ঘর মোছা, কাপড় কাচা সঙ্গে রান্নার বৌকে কুটনো বাটনা করে দেওয়া।

    সাব্বিরের মায়ের মানসিকতা বুঝতে আখতার মাস্টার বা নুর দিদিমনির কোন অসুবিধা হয়নি, তাই প্রথম প্রথম ভুলচুক হলেও তার দিকে নজর দেননি। মায়ের সঙ্গে এসে বাইরের দাওয়ার রোদে খেলত সাব্বির, মাকে এ বাড়িতে থেকে দেওয়া চা, টিফিন ভাগ করে খেত, কোন বায়নাক্কা ছিল না। দিদিমনির খুব ভালো লেগে গিয়েছিল ছেলেটিকে। নিজেই কাছে টেনে পড়াশোনা শেখাতে শুরু করলেন, প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। শুধু তাই না, কলেজ পর্যন্ত তার সমস্ত পড়াশোনার খরচ মিটিয়েছেন দিদিমনি।

    এখন সাব্বির স্পেয়ার পার্টসের ছোট্ট দোকান খুলেছে বাস রাস্তার ধারে। ভালো চালু দোকান। অভাব নেই কোন কিন্তু সাব্বিরের মা এ বাড়ির কাজটি ছাড়েনি। স্পষ্ট বোঝা যায় অর্থ না, কৃতজ্ঞতাই সাব্বিরের মাকে এখানে আটকে রেখেছে। তা ভালোই। আখতার মাস্টারমশাই হঠাৎ মারা যাবার পর বড্ড একা হয়ে পড়েছেন নুরজাহান ম্যাডাম।



    ***********************************



    'কে এসেছেলো দিদিমুনি? কাচের গেলাসখানা ধুয়ে গ্যাসের পাশে রেকেচি। তুলে দিও। ঘরের টিউব জ্বালাউনি ক্যানো গো। ওঠো। মগরিবের আজান হয়ে গ্যালো। অজু করি নাও।'

    সাব্বিরের মায়ের কথায় বর্তমানে ফিরলেন নুরজাহান। ওড়নাখানা মাথায় দিয়ে বললেন, 'ব্রজবিহারী স্যর এসেছিলেন।'



    -- ব্রজ মাস্টার! ক্যানো? এতদিন পরে কী মনে করে? এ বাড়ির কানাচ মাড়ায় কোন সাহসে? শরম হায়ার মাতা খেয়ে বসে আছে নে?



    -- সাব্বিরের মা! ওয়াক্ত বয়ে যায়। অজু করে নামাজ পড়ো, আমাকেও পড়তে দাও। তারপর আমাকে এককাপ লাল চা করে দিও। তোমার ইচ্ছে হলে দুধচা করে নিও। ওবেলার ভুনা গোস্ত রাখা আছে ফ্রিজে। তুমি নিয়ে চলে যেও। আজ রাতে কিছু খাব না আর হ্যাঁ, যাবার সময় বাইরের গেটে তালা দিয়ে যেও। আমি এখানের কোলাপসেবলের তালা দিয়ে দেব।

    এই বলে নুরজাহান বাথরুমে চলে গেলেন অজু করতে। সাব্বিরের মা জানে, এরপর ওঁর মুখ দিয়ে একটা কথাও আর কেউ বার করতে পারবে না। সে বেচারা এইসব শিক্ষিত মানুষজনের হালহকিকত বোঝে না। তারা জানে রাগ হোক বা ক্ষোভ, খানিক চিৎকার চেঁচামেচি করে, খানিকক্ষণ পাড়া জানিয়ে আহাজারি কান্না করলে, দুটো চারটে লোক ছুটে আসবে, আটটা দশটা কথা হবে, পাড়াপড়শি পাশে বসে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দুটো সান্ত্বনার কথা বললে তবে বুকের ভার কমে। কিন্তু দিদিমুনি মানুষটা বরাবরই অন্য ধাঁচের। শরীরের কষ্ট হোক বা মনের -- তা কোনদিন কাউকে বলতে শোনেনি সাব্বিরের মা। মাস্টারভাই, আখতার মাস্টারমশাইকে সে বরাবর মাস্টারভাই বলে এসেছে, যতদিন বেঁচেছিলেন ততদিন আগলে রেখেছিলেন দিদিমুনিকে। কিন্তু বছর পাঁচ আগে হঠাৎ 'ইস্টোক' হয়ে মারা যাবার পর দিদিমুনি যেন এক্কেবারে পাথর হয়ে গ‍্যাচেন। লোকের মুখে রটেছিল ইসকুলে মাস্টারদের মিটিংয়ে ব্রজ মাস্টার নাকি কীসব উল্টোপাল্টা কথা বলেছিল হেডমাস্টারমশাইকে। তখনই মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন মাস্টারভাই। সোজা বড় নার্সিংহোমে নিয়ে গিয়েও কিছু করা গেল না। দুদিন পরে জলজ্যান্ত মানুষটা মরা হয়ে বাড়ি ফিরেছিল। সাব্বিরের মা নামাজ পাটিতে বসে ব্রজ মাস্টারের নামে দুটো বদদোয়া পেশ করে, চোখের কোনা ভালো করে আঁচলে রগড়ে নামাজ শেষ করল। তারপর দিদিমুনির হুকুম মোতাবেক সব কাজ শেষ করে ভিতর বাড়ির দরজা টেনে দিয়ে গেটে তালা লাগিয়ে বাড়ি চলে গেল। দিদিমুনির নামাজ পড়তে সময় লাগে। কত ওজিফা আজগর, দোয়া দরুদ পড়ে, অনেক অনেক মোনাজাত করে। তারপর ওঠে। তখন কোলাপসেবলের তালা লাগিয়ে ঘরে দোর দিয়ে নেবে। এই চত্বরে চোর-ডাকাতের ভয় নেই এমনিতেও, তাছাড়া আখতারুজ্জামান মাস্টারকে আজও স্থানীয় মানুষ সম্মানের সঙ্গে স্মরণ করে। তাঁর বাড়ির নিরাপত্তা যেন অযাচিতভাবে আশপাশের সকলের দায়িত্ব। দরজা সারা রাত উদোম খোলা থাকলে দুটো সাপখোপ হয়ত ঢুকে পড়তে পারে বাড়িতে, উটকো মানুষজনের সাহস হবে না এ বাড়ির শান্তি নষ্ট করার। এ কথা যেমন সাব্বিরের মা জানে তেমনি জানে আশপাশের অঞ্চলের ভালো মন্দ সমস্ত মানুষ। তবু তার মনটা ভালো নেই। বাড়ি ফিরে নিজের ঘরটিতে ঢুকে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। সাব্বিরের বৌ এলে তাকে বললেন, 'শরিলটায় জুত নেই মা, খানিক শুয়ে থাকি।'

    ঘন্টাখানেকের মধ্যে সাব্বির ফিরে এসে মায়ের কাছে এলো শরীরের খোঁজ নিতে। তাড়াতাড়ি ফিরে আসার কারণ জিজ্ঞেস করতে বলল, 'আজ ব্রজ মাস্টারের বড় রাস্তায় এ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। মাথাটা পুরো থেঁতলে গেছে। সবাই দোকানপাট বন্ধ করে দিল। আমিও বাড়ি চলে এলাম।’



    **********************************



    মগরিবের নামাজ কখন শেষ নুরজাহানের। আজ তবু চুপ করে নামাজ পাটিতে বসেছিলেন তিনি। ব্রজর দেখা করতে আসা তাঁকে উজান বাইতে বাধ্য করছে। ব্রজ, ব্রজবিহারী চট্টরাজ বর্তমানে আকাশনগর হাই স্কুলের বাংলার মাস্টারমশাই, একসময় ছাত্রও ছিল এই স্কুলের। তবে বাড়ি ছিল কিছু দূরের দেবগ্ৰামে। সেখানের বনেদী পরিবারের ছেলে সে। বাড়িতে নন্দকিশোরের প্রতিষ্ঠিত মন্দির, নিত্যসেবা হয় তাঁর। রাসের মেলা বসে দেবোত্তর মাঠে ফিবছর। প্রত্যন্ত মফস্বল অঞ্চলটি তখন খোলামেলা চাদরের মতন। হিন্দু মুসলিম ভেদাভেদ বলতে পাড়ায়, উপাসনায় এবং জলচরিতে। নয়ত ব্যবসাবাণিজ্য, লেনদেন, চাকরিবাকরিতে সবাই মিলেমিশে থাকে। ছেলেপুলে স্কুলে পড়াশোনা করে পাশাপাশি বসে, একই মাঠে বল খেলে, বিপদে আপদে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। রাজনৈতিক অস্থিরতা কথাটাই অপরিচিত এইসব প্রত্যন্ত অঞ্চলে।



    তখন সবে স্কুলে জয়েন করেছেন আখতারুজ্জামান। অঙ্কের স্যার। ওদিকে মাধ্যমিকে মোটামুটি ভালো রেজাল্ট করেছিল ব্রজ। ব্রজ আর্টসের ছেলে। তাই সরাসরি গুরু শিষ্য সম্পর্ক ছিল না দুজনের কিন্তু আখতার ভালো ক্রিকেট খেলতেন এবং ব্রজ স্কুলের ক্রিকেট টিমের উইকেট কিপার। ফলে পরিচয়। স্নেহের সম্পর্ক। সেই সুবাদে মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে আসা যাওয়া সবই ঘটেছিল অবাধে। নুর দিদিমনিও খুব পছন্দ করতেন ছটফটে ব্রজকে। সদ্য যুবকটির চোখে তাঁর প্রতি ফুটে ওঠা মুগ্ধতাকে উপভোগ করতেন স্বাভাবিকভাবে। সে মুগ্ধতায় কলুষ ছিলো না, পূজারীর নিবেদনের মতন একাগ্ৰতা ছিল। কতই বা বয়স তখন নুরজাহানের, একত্রিশ বত্রিশ। পূর্ণ যুবতী। যদিও স্বামীর প্রতি একনিষ্ঠ ছিলেন তবু এই তুষ্টিকে অবহেলা ভরে ছুঁড়ে ফেলেননি, আবার প্রশ্রয়ও দেননি কোনদিন। শুধু নিরস্ত্র করেছিলেন সহজ আচরণে। বয়সের ওই স্তরে নিছক আবেগ ছুটিয়ে নিয়ে চলে তা অভিজ্ঞ নুর দিদিমনি খুব ভালো করে জানতেন। স্বামীকেও কিছু জানতে দিলেন না। শুধু বয়সে বছর চোদ্দর ছোট ব্রজকে দিনের পর দিন বোঝালেন, 'অসম্ভব! এ প্রেমের কোন পরিণতি নেই ব্রজ। জীবন বিদ্যাপতির চোখে দেখা বন্ধ করো। বাস্তবের মাটি ভীষণ শক্ত। তাতে হেঁটে চলে বেড়াতে হয় সবাইকে। অসম্ভব এই সম্পর্ক তোমাকে কষ্ট ছাড়া আর কিছু দেবে না। এ নিছক সাময়িক মোহ আর যেকোন মোহ একদিন না একদিন ভেঙে যায়। বাস্তবকে মেনে নেওয়াতেই সবার মঙ্গল।'

    ব্রজ বুঝেছিল কি না জানেন না তবে তাঁদের বাড়ি আসা কমে গিয়েছিল। যাইহোক, ব্রজ উচ্চমাধ্যমিকে হায়ার সেকেন্ড ডিভিশন পেয়ে বড় কলেজে পড়বে বলে শহরে চলে গেল। আকাশনগরের সঙ্গে কমে গেল যোগাযোগ। তবু পাঁচ বছর পরে বাংলায় এম এ করে যখন ব্রজ দেবগ্ৰামে ফিরল তখন আকাশনগর স্কুলে বাংলার একটি শিক্ষকপদ খালি। ততদিনে আখতারুজ্জামান আকাশনগর হাইস্কুলের হেডমাস্টারমশাই। তাঁর সুচারু ব্যবস্থাপনায় চাকরিটি সহজেই পেয়ে যায় অত্যন্ত সুযোগ্য ব্রজবিহারী। কিন্তু মাত্র কয়েক বছর পরই নুরজাহানের কাছে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, 'ব্রজ পাল্টে গেছে নুর। কানাঘুষো শুনছি বড্ড একপেশে রাজনৈতিক কথা বলে স্টাফরুমে। এখন সবাই সেটাকে হাল্কাভাবে উড়িয়ে দিলেও বলা যায় না কবে কীভাবে ফুলকি জ্বলে ওঠে। ভয় করছে কেমন করে সামলাব তখন। ব্রজর এমন রূপ ভাবতে পারছি না নুর।'



    -- তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে না তো?



    -- না নুর। আমার কোন ভুল হয়নি। তাছাড়া আসল কথাটাই তো তোমাকে বলা হয়নি। ব্রজ প্রতি পদে আমার বিরোধিতা করে। এক্সট্রা ক্লাস দিলে করে না। ম্যানেজিং কমেটিতে থাকলে আমার যেকোন প্রস্তাবের বিপক্ষে কথা বলে। সে স্কুলের জন্য যত ভালো প্রস্তাবই হোক না কেন! এমনকি ধর্মের উল্লেখ করেও কথা বলেছে পেছনে, জানো?



    -- না না, এ তোমার মনের ভুল। এমনটা হতেই পারে না। ও আমাদের কতটা শ্রদ্ধা করে সেটা তো আমরা জানি। কিচ্ছু ভেবো না। এখন দেশের হাওয়া একটু এলোমেলো, তাই হয়ত...



    -- না নুর, এই ব্রজকে না আমি, না তুমি, কেউই চিনি না।



    নুরজাহানের কপালে চিন্তার রেখা ফুটেছে, কিন্তু তার প্রকাশ রাখেননি কোথাও এতটুকু। ভেবেছিলেন বাড়াবাড়ি হলে না হয় ব্রজকে ডেকে বুঝিয়ে বলবেন। কিন্তু কী বোঝাবেন আর কেন বোঝাতে যাবেন তার কোন কূলকিনারা করে উঠতে পারেননি তিনি। সময় বয়ে গেছে নিজের পথে।



    তারপর বছর পেরিয়েছে, ব্রজবিহারী চট্টরাজ স্কুল ম্যানেজিং কমিটিতে স্পষ্টতই আখতারুজ্জামানের বিরুদ্ধপক্ষ; সে রাজনৈতিক মতবাদ হিসেবেই হোক বা অন্য কোন কারণে। এখন যেকোন মিটিংয়ে কথা কাটাকাটি নিয়ম হয়ে গেছে। তবু স্কুলের মাথায় বসে আছেন বলে আখতারুজ্জামানকে মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়। বয়স হচ্ছে। আর বছর চার আছে রিটায়ারমেন্টের। প্রেসার বেশ হাই। নিয়মিত ওষুধ খেয়েও রাশ টানা যাচ্ছে না। সামান্যতম উত্তেজনায় মাথা টলে যায় আজকাল। সেদিন সকাল থেকেই শরীরটা যুতে ছিল না আখতারের। নুর বলেছিলেন, 'এতটা প্রেশার নিয়ে স্কুলে নাই বা গেলে আজ। হাতে তো এখনও চারটে সিএল। দুটো নিয়ে নাও, শহরে গিয়ে চেকআপও করিয়ে নেওয়া যাবে।’



    কিন্তু আখতার বললেন, 'না নুর! মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিকের টেস্টের পাশফেল নিয়ে মিটিং। কমার্সের কটা ছেলেকে নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। যেতেই হবে। তাছাড়া আমি না গেলে ব্রজ মিটিংয়ে কিছু না কিছু গণ্ডগোল করবে। এতগুলো ছেলেপুলের ভবিষ্যৎ নিয়ে কোন উল্টোপাল্টা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। এতদিন শক্তহাতে স্কুলটাকে চালিয়ে নিয়ে এসেছি। আজ সামান্য প্রেশারের জন্য তার সুনামে হাত পড়তে দিই কেমন করে?’



    আখতারুজ্জামান স্কুলে যান। ছুটির পর মিটিং শুরু এবং যথারীতি ব্রজবিহারীর বিরোধিতা করতে হবে তাই বিরোধিতার ফল আখতারুজ্জামানের মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া এবং জ্ঞান হারিয়ে ফেলা। ওঁকে সঙ্গে সঙ্গে শহরের বড় নার্সিংহোমে ভর্তি করা হয়। কিন্তু সেরিব্রাল স্ট্রোক সব চেষ্টাকেই বিফল করে দেয়।



    নুরজাহান শুনেছিলেন সবকিছু। কিন্তু ভবিতব্যকে মেনে নিয়েছিলেন নিতান্ত বাধ্য হয়ে। কিন্তু এরপর পারিপার্শ্বিক সবকিছুর থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নেন। চাকরিটি ছাড়া বাইরের কারোর সঙ্গে কোন যোগাযোগ রাখেননি। ছোটদের পড়াশোনা শেখানোও বন্ধ করে দিয়েছেন দীর্ঘদিন। একাই থাকেন নিজেদের হাতে বানানো বাগানবাড়িটিতে। বাগান করেন, বই পড়েন, ধর্মকর্মের ছোট থেকে ছোট নিয়ম খুঁজে পেতে মেনে চলার চেষ্টা করেন। নিজের রান্না নিজেই করে নেন। সাব্বিরের মা নাছোড়বান্দার মতন জুড়ে আছে তাই, নয়ত ওকেও বলেছিলেন চলে যেতে। মাস খানেক হল নুরজাহান রিটায়ার করেছেন। একাকীত্ব বড্ড চেপে বসছে বুকের ওপর। পুরনো কথা ভীষণ মনে পড়ে আজকাল। বিশেষ করে আখতারুজ্জামানের হঠাৎ চলে যাওয়া।



    আজ পড়ন্ত দুপুরবেলায় কলিংবেল বেজে ওঠায় অবাক হয়েছিলেন নুরজাহান। দরজা খুলে দেখেন ব্রজ। আরও অবাক হয়েছিলেন তিনি। দরজা খুলে বসার ঘরে বসতে বলে নুরজাহান রান্নাঘরে গিয়েছিলেন চা, মিষ্টি ইত্যাদি অতিথি সৎকারের আয়োজন করতে। আখতারের স্মরণসভাতেও যে আসেনি, সে কেন আজ হঠাৎ এই অসময়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে বুঝতে পারছিলেন না তিনি। ব্রজর সামনের সেন্টার টেবিলে চা, মিষ্টি, চানাচুর ইত্যাদি সাজিয়ে বসলেন অন্য আর একটি চেয়ারে। ব্রজ জলটুকু ঢকঢক করে খেয়ে মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে থাকল একটু। নুরজাহান বললেন, 'তোমার পছন্দের ক্ষীরকদম আর দইচুর আছে, খেয়ে দেখো।'



    -- মনে আছে?



    -- কেন থাকবে না! তুমি তো ঘরের ছেলে ছিলে একসময়।



    -- কিন্তু এ আমি কী করেছি। ক্ষমা কি নেই?



    -- তুমি তো কিছু করোনি। মানুষের মৃত্যুর কারণ ও সময় পূর্বনির্ধারিত। তুমি শুধু অছিলা ছিলে, নিমিত্ত। আমার তো তোমার প্রতি কোন ক্ষোভ নেই, ব্রজ। তুমি এবার এসো।



    ব্রজবিহারী আর একটিও কথা না বলে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। পেছনে পেছনে নুরজাহানও চললেন এগিয়ে দিতে। গেটের বাইরে রাখা বাইকটা সোজা করে স্টার্ট দিলেন ব্রজবিহারী। নুরজাহান দেখলেন বাইকের সামনে নেমপ্লেটে লেখা 'রাই' -- ও নামে একটা সময় আড়ালে তাঁকে ডাকত ব্রজবিহারী।


    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments