• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৮ | অক্টোবর ২০২২ | ছোটদের পরবাস | গল্প
    Share
  • কিম্বারলাইট : অচিন্ত্য দাস



    এর আগে ‘মরুভূমির গুপ্তধন’ নাম দিয়ে একটা ঘটনা তোমাদের জন্য লিখেছিলাম। সেটা পড়ে অনেকে বলেছিল আমার দেখা আরও ঘটনা তারা শুনতে চায়। তাই ভাবলাম শশাঙ্কবাবুর সঙ্গে গিয়ে যা দেখেছিলাম আর শিখেছিলাম তা লিখে পাঠাই।

    তখন আমার বয়স চব্বিশ-পঁচিশ হবে। একটা কারখানায় কাজ করতাম। সেখানে নিয়ম ছিল – বছরের তিরিশ দিন পাওনা ছুটির অন্তত পনেরো দিন সে বছরে নিতেই হবে। না নিলে পরের বছর সে ছুটি আর থাকবে না। আর ধরো কেউ কুড়ি দিন ছুটি নিল, তাহলে ইচ্ছে করলে বাকি দশ দিন ছুটির মাইনে সে বাড়তি পেতে পারে।

    সেবার বছরের শেষদিকে মানে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে তাই করেছিলাম। নিয়মরক্ষা আর কিছু পয়সা পাওয়া ছাড়াও আর একটা কারণ ছিল। আমার বাবা-মা আত্মীয়স্বজন বলতে তেমন কেউ ছিল না তবু সেবার আমার এক দূর সম্পর্কের মামা আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। কারণটা হলো ওঁর মেয়ের বিয়ে। বিয়েবাড়িতে খাটাখাটনির জন্য লোকজন পাওয়া গেলে সুবিধে হয়, তাই আমাকে ডাকা। কুড়ি দিন ছুটি আর দশ দিনের মাইনে নিয়ে আমি কোলকাতায় মামার বাড়ি এলাম। তা বিয়েবাড়িতে খুব খাটলাম। মামা দেখলাম আমার ওপর খুব খুশি। দিন পাঁচ-ছয়ের ভেতর সব কাজ হয়ে গেলে আমি যখন ফেরার জন্য ব্যাগ গোছাচ্ছি তখন মামা ডাকলেন আমাকে।

    মামার ঘরে এসে দেখলাম মামার বন্ধুস্থানীয় এক বয়স্ক ভদ্রলোক বসে আছেন। কাঁচা-পাকা চুল এলোমেলো হয়ে কপালে ভিড় করেছে। চোখে মোটা কাচের চশমা। আমাকে আপাদমস্তক জরিপ করে নিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন – “কি হে আমার সঙ্গে কাজ করবে … দিন দশেকের একটা কাজ আছে … মাইনে পাবে দিন এক হাজার হিসেবে।”

    ভদ্রলোককে দেখে আমার একটু ভয়-ভয় করছিল। তবে টাকাটা আমার জন্য অনেক। তাই পট করে হ্যাঁ বলে দিলাম।

    “হ্যাঁ মানে? তুমি কি ভেবেছ তোমার যোগ্যতা বিচার না করে এমনি এমনি তোমায় কাজে নিয়ে নেব? তোমাকে ইন্টারভিউ মানে পরীক্ষা দিতে হবে।”

    ওঁর চোখের ইশারায় মামা অন্য ঘরে চলে গেলেন। পরীক্ষা ব্যাপারটায় আমার বড় ভয়। আমি বলির পাঁঠার মতো এককোণে দাঁড়িয়ে রইলাম।

    “প্রশ্ন মন দিয়ে শোনো, দুবার বলা হবে না।”

    ঢোক গিলে বললাম “ঠিক আছে স্যার। শুনছি…”

    “কিম্বারলাইট কাকে বলে?”

    আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। এই বিদঘুটে কথাটা কোনোদিন শুনিইনি, তো মানে জানব কী করে। মাথা নিচু করে বললাম –“না স্যার, আমি জানি না।”

    ওঁর চোখে বেশ একটা তৃপ্তির হাসি খেলে গেল বলে মনে হলো। কিন্তু আট-দশ হাজার টাকা রোজগারের সুযোগটা হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে যে। মরিয়া হয়ে বললাম –“ওই শব্দটার মানে জানি না, কিন্তু স্যার আমি ট্র্যাফিক লাইট, সার্চ লাইট, হেড লাইট – এসব জানি। টিউব লাইট লাগাতে এবং সারাতেও …”

    “থামো। ওসব কে জানতে চেয়েছে! নিজের বোকামো ফলাও করে না বললে চলছে না?”

    ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। হলো না তাহলে।

    এমন সময় মামা আবার ডাকলেন –“এই, এদিকে শুনে যা--”

    আবার গেলাম। এবার ওই ভদ্রলোক বললেন –“তুমি কাজটা পেয়েছ। আজকেই আমাদের যাত্রাশুরু।”

    আমি আরও ঘাবড়ে গেলাম। এ কী পাগলের পাল্লায় পড়লাম রে বাবা! এবার কী করি? ওঁর হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য বললাম –“স্যার, আমি তো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি, আমি তো আপনার সঙ্গে কাজ করার যোগ্য নই।”

    “যোগ্য-অযোগ্য কাজে নামলে বোঝা যাবে। তোমাকে কেন নিলাম জানো? ওই কথাটার মানে তোমার কেন, কোনো সাধারণ লোকেরই জানার কথা নয়। এর আগে যাদের ডেকেছিলাম তারা সকলেই পয়সার লোভে পড়ে বলেছিল … কোথায় যেন শুনেছি, আর একটু ভাবলে মনে পড়ে যেতে পারে… এইসব চালবাজি আমি দু চোখে দেখতে পারি না। তুমি দেখলাম খুব সততার সঙ্গে বললে যে তুমি জান না। এইটা আমার ভালো লাগলো। তারপরে অবশ্য তুমি বেশ পাগলামি শুরু করেছিলে… বেশিক্ষণ করলে তোমাকে নিতাম না।”

    উনি এবার অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ওঁর নামটা পরে জেনেছিলাম – শশাঙ্ক শেখর চৌধুরি। নামকরা বিজ্ঞানী। আমি অবশ্য ওঁকে স্যারই বলতাম।



    ব্যাগ অর্ধেক গোছানো ছিলো। বাকিটা গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হলো। হাওড়া থেকে ট্রেন ধরে গেলাম রায়পুর। তখন মধ্যপ্রদেশে ছিল, এখন অবশ্য নতুন প্রদেশ ছত্তিশগড়ের রাজধানী। রায়পুর থেকে গাড়ি নিয়ে দক্ষিণ দিকে অনেকটা রাস্তা পেরিয়ে গেলাম জগদলপুর নামে একটা ছোট শহরে। সেদিন হোটেলে বিশ্রাম। একটা জিনিস লক্ষ্য করতেই হয়েছিল – স্যারের ব্যাগ দুটো অসম্ভব রকমের ভারী। প্রথমবার হ্যাঁচকা তুলতে গিয়ে হাতে বেশ লেগে গেল।

    শুতে যাবার আগে স্যার আমাকে বললেন – “মন দিয়ে শোনো, এখানে আমি বা আমরা যা করব, দেখব এবং শুনব তা তুমি কোনদিন কারো কাছে বলবে না। কোটি কোটি টাকার ব্যাপার তো, তাই।”

    শুনে আমার নাড়ীর গতি অনেকখানি বেড়ে গেল। এ কার সঙ্গে কাজ করতে এলাম রে বাবা! কাজটাই বা কী? বিপদে পড়ে যাব না তো!

    হোটেলে একটা বড় ঘরে দুদিকে দুটো বিছানা। আমারা শুয়ে পড়লাম, আমার ভীষণ ঘুম পেয়ে গিয়েছিল। ঘুমে চোখ বুজে যাওয়ার আগে দেখলাম স্যার বালিশের ওপরের আলোটা জ্বালিয়ে বই পড়ছেন।

    অভ্যাসমতো ভোরে ঘুম থেকে উঠে লজ্জায় পড়ে গেলাম। স্যার আগেই উঠে পড়েছেন। বেরোবার জন্য তৈরিও হয়ে গেছেন। আমি কথা না বলে মিনিট পনেরোর ভেতর প্যান্ট-সার্ট পরে তৈরি হয়ে নিলাম। বললাম – “চলুন স্যার।”

    “মানে – তুমি কোথায় যেতে চাও?”

    আমি এবার সত্যি ঘাবড়ে গেলাম। আমতা-আমতা করে বললাম –“আপনি বেরোবার জন্য তৈরি তাই বলছিলাম আর কি। আপনি যেখানে যাচ্ছেন সেখানে যাব।”

    “সঙ্গে যাবে তো গামবুট আছে?”

    “গামবুট!”

    “হ্যাঁ, গামবুট।”

    “না স্যার, তা তো নেই আমার।”

    “তাহলে জুতোর দোকানে চলো।”

    গাড়ি অপেক্ষা করছিল। স্যার বললেন বাজারের দিকে যেতে। অত সকালে দোকানপাট খোলেনি, স্যার একটা খাবার দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে আমাকে নিয়ে ঢুকলেন। আমরা আলু পরোটা, দই আর ছাতুর সরবত খেলাম। স্যার বললেন –“ওই পাশটায়, মানে খালের পাড়ে, কতগুলো চালাঘর রয়েছে – ওইখানে তুমি যাও। বিহুরাম বলে একটা লোক থাকে ওখানে, খুঁজে নিয়ে এসো।”

    “কিন্তু স্যার, ঘর তো অনেকগুলো!”

    “আরে দশ-পনেরোটার বেশি নয়। ঘরে-ঘরে খোঁজ করো গিয়ে।”

    গেলাম। আমি উটকো লোক, তাও এসেছি সাতসকালে কাজের সময়। প্রথম আটটা দরজায় আট রকমের গালাগালি খেলাম। ন নম্বর ঘরে অবশ্য পাওয়া গেল বিহুরামকে। সে এসে স্যারের সামনে দাঁড়াল। বিহুরাম স্যারকে চেনে।

    “বিহুরাম, তোমার নৌকা ঠিক আছে তো? আজ থেকে দিন দশেক রোজ লাগবে।”

    বিহুরাম দেখলাম স্যারকে খুব ভক্তি করে। সে তক্ষুনি ছুটল তার নৌকা তৈরি রাখতে। আর আমরা গেলাম জুতোর দোকানে আমার গামবুট কিনতে।



    এতক্ষণ যা বললাম তা ছিল আমাদের ‘প্রস্তুতি পর্ব’। এবার আমাদের আসল অভিযান শুরু হলো।

    ***

    নৌকার দাঁড় বাইছে বিহুরাম। আমরা খালের ভেতর দিয়ে এসে পড়লাম একটা জলধারায়। বেশ স্রোত, কয়েক সেকেন্ডের জন্য নৌকা টলমল করে উঠল। বিহু অবশ্য সামলে নিল। স্যার বললেন, “এরকম বহু ছোট ছোট ধারা বা ঝরনা ইন্দ্রাবতী নদীতে পড়েছে। তা এবার ওটা কোলবালিসের মতো না রেখে পরে ফেলো দিকি।”

    গামবুট পায় গলিয়ে নিতে নিতে দেখলাম নৌকা ঢুকছে ঘন বনের মধ্যে। দুপাশে ছোটবড় গাছ আর লতাপাতার বুনোট। ঝুপ করে আলো কমে এল। কীরকম একটা স্যাঁতস্যাঁতে ঠান্ডা ভাব। এক জায়গায় দেখলাম আমাদের রাস্তা, মানে জলপথ, দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে। স্যার একটু ভেবে বললেন বাঁ দিকে যেতে। স্যার নদীর ধারটা খুব মন দিয়ে দেখছিলেন। মাঝে মাঝে ক্যামেরা দিয়ে ছবি নিচ্ছিলেন – পোলারয়েড ক্যামেরা, তক্ষুনি ছাপা ছবি বেরিয়ে আসছিল। তখন তো আর হাতে হাতে ফোন-ক্যামেরা ছিল না!

    এদিকটায় জঙ্গল আরো ঘন, আরো অন্ধকার লাগছিল। দু-একটা পাখির ডাক বা ডানার শব্দ ছাড়া সম্পূর্ণ শব্দহীন চারিদিক। আমি কী একটা বলতে যাচ্ছিলাম, বিহু আমাকে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করতে বলল। একটু পরে যখন আমরা জঙ্গল পার হয়ে এলাম তখন স্যার বুঝিয়ে দিলেন যে এরা বিশ্বাস করে এইসব বনে বনদেবী থাকেন। তিনি মানুষের আসাযাওয়া এমনকি কথা বলা একদম পছন্দ করেন না।

    স্যার বিহুরামকে বললেন, “না, এটা নয়, তুমি আবার ফিরে গিয়ে অন্য রাস্তাটা ধরো।” বিহু উজানে দাঁড় টানতে লাগল। অন্য ধারাটায় নৌকা ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে আবার অন্ধকার হয়ে এল। দুপাশে জঙ্গল। এদিকটায় জঙ্গল আরও গভীর মনে হচ্ছিল। কিছুদূর গিয়ে স্যার ইশারায় বিহুকে জানালেন যে ডানদিকের তীরে আমরা নামব।

    আমি ভয় পেয়ে গেলাম। এর মধ্যে নামতে হবে? স্যার বোধহয় আমার মনের কথা বুঝে নিয়ে বললেন “গামবুট তো আছে, ভয় কীসের…”

    শ্যাওলা আর কাদায় ভরা যাচ্ছেতাই জায়গা। গাছে নৌকো বেঁধে বিহুও আমাদের সঙ্গে যোগ দিল। নৌকোতে একটা হাঁসুলি ছিল, সেটা দিয়ে ও লতাপাতা আর বুনো ঘাস সাফ করতে লেগে পড়ল। স্যারের নজর মাটির ওপর। একটা জায়গায় তিনি একটা খুরপির মতো লোহার যন্ত্র দিয়ে মাটি সরাতে লাগলেন। আমাকেও একটা দিলেন হাত লাগাবার জন্য। গজ দশেক এভাবে মাটি সরানোর পর একটা কালো পাথর বেরিয়ে পড়ল। স্যার খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলেন, তারপর কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন – আমি সাপ, সাপ বলে চেঁচিয়ে উঠলাম। বেশ বড়, মেটে রঙের। সরসর করে লতাপাতার ভেতর চলে গেল। মনে হলো সাপটা খুব বিরক্ত হয়েছে, তার শান্তির জায়গায় আমরা মানে মানুষেরা হানা দিয়েছি। বিহু ফিসফিস করে বলল যে এ সাপের বিষ নেই। হেলে সাপ। আলো কমে আসছিল। স্যার হাত নেড়ে বিহুকে ফেরার জন্য ইশারা করলেন। বললেন কাল আবার এইখানটায় আসতে হবে।

    ***

    ফেরার পথে আমরা হাটে গেলাম। ভারি ভালো লাগছিল। এখানে গ্রামের মানুষদের পয়সাকড়ি বেশি নেই, গরীব বলা যায়। কিন্তু সব সময় হাসিমুখ। সবাই যেন খুশিতে রয়েছে। স্যার মজা করে বললেন, “দেখছ তো হাটে সব পাওয়া যাচ্ছে – ‘উচ্ছে বেগুন পটল মুলো/ বেতের বোনা ধামা কুলো/ সরষে ছোলা ময়দা আটা/ শীতের র‌্যাপার নকশা কাটা…’”

    এই একদিনেই আমার জায়গাটা খুব ভালো লেগে গেল। স্যারকে কথায় কথায় বললাম “বন-জঙ্গল, নদীনালা, গ্রামের হাট, হাসিখুশি মানুষজন – জায়গাটা খুব সুন্দর স্যার। কিন্তু স্যার যে কথাটাকে এত গুরুত্ব দেবেন, ভাবিনি। হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গিয়ে বললেন “হুঁ, আমিও তাই ভাবছি …”

    আমি কিছুই বুঝতে না পেরে মাথা নাড়লাম।

    স্যার বললেন, “মাথা নাড়ছ কী ভেবে, অ্যাঁ…কাজ নিয়ে কিছু বলার আছে?”

    সংক্ষেপে ‘না’ বললাম। কিছু বললে যদি আবার বকুনি খেতে হয়! এঁর সঙ্গে তাল রাখা অসম্ভব। কখন যে কী বলেন!



    সেদিন রাত্তিরে শোবার সময় জিগেস করেছিলাম, “স্যার, ওই কিম্বারলাইট না কী যেন, আপনি আমাকে যেটা জিগেস করেছিলেন – সেটা কী?”

    স্যার বললেন –“তাহলে শোনো। আজ থেকে কোটি কোটি বছর আগেকার কথা। পৃথিবী যখন এত বুড়ো হয়নি তখন প্রায়ই জোরালো ভূমিকম্প হতো।

    “রবীন্দ্রনাথের ‘আফ্রিকা’ কবিতাটা পড়েছ – ‘তাঁর সেই ঘনঘন মাথা নাড়ার দিনে..’”

    বললাম, “না স্যার। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা কবিতা আমার মুখস্থ আছে, ইস্কুলে আবৃত্তি করেছিলাম।”

    “বেশ। একদিন শুনিও তো। হ্যাঁ, যা বলছিলাম। অনেক সময় পাতাল থেকে মাটি ফুঁড়ে গরম লাভা বেরিয়ে আসত। কালক্রমে তা ধীরে ধীরে পাথরের আকার নিয়ে জমে যেত। এই রকমের পাথর দক্ষিণ আফ্রিকার কিম্বারলে নামে একটা জায়গায় প্রথম আবিস্কার হয়। তাই এ ধরনের পাথরকে কিম্বারলাইট বলা হয়।

    “আমাদের দেশে এই জায়গাটায় কিম্বারলাইট আছে। আমি অনেক বছর এখানে ঘুরে ঘুরে এর সন্ধান করেছি, পেয়েও ছিলাম। আজকে সেই জায়গাটাতেই গিয়েছিলাম।”

    “এই কালো পাথর কী কাজে লাগবে স্যার?”

    “পৃথিবীর এক নাম রত্নগর্ভা। কিম্বারলাইট যে গভীরতা থেকে আসে সেখানে প্রবল তাপ ও চাপে কার্বন হীরকে পরিণত হয়। কিম্বারলাইটের সঙ্গে সে সব হীরক খণ্ড অনেক সময় উঠে আসে…”

    পরের দিন বেরোবার সময় আমার দারুণ ভালো লাগছিল – আমরা হিরে খুঁজতে যাচ্ছি গভীর অরণ্যের ভেতর। যদিও সেখানে একটা হেলে সাপ ছাড়া আর কিছু দেখিনি এখন পর্যন্ত, তবু কত কী আছে কে জানে। স্যারকে মনে হচ্ছিল সেই ‘চাঁদের পাহাড়ের’ ডি অ্যালভারেজ। আর আমি হলাম শঙ্কর। ওই খুরপির মতো লোহার জিনিসটা চেয়ে নিজের কাছে রাখলাম। হাতে একটা অস্ত্র থাকলে নিজেকে বেশ অভিযাত্রী-অভিযাত্রী লাগে!

    পরের দিন আমরা সোজা গেলাম আমাদের জায়গায়। আজ আকাশ একটু মেঘলা তাই জায়গাটা আরও অন্ধকার লাগছিল। হ্যাঁ, স্যারের ব্যাগ কেন এত ভারী তার কারণ বোঝা গেছে। ব্যাগে ঠাসা একগাদা বই, তাড়া তাড়া কাগজ – বৈজ্ঞানিক রিপোর্ট ধরনের। আর আছে কিছু যন্ত্রপাতি। স্যার আজকে সেরকম কিছু যন্ত্র নিয়েছেন সঙ্গে।

    আজ স্যার নৌকার ওপর একটা টেবিলের মতো পাটাতন লাগিয়ে নিলেন। তার ওপরে ঠিক ল্যাবরেটরির মতো কিছু যন্ত্রপাতি বসালেন। একটা দেখলাম মাইক্রোস্কোপ ধরনের কিছু। স্যার বললেন “ঠিকই ধরেছ, এটা পাথর দেখার অণুবীক্ষণ যন্ত্র।”

    অনেকক্ষণ কাজ চলল। জায়গা জায়গা থেকে পাথর খুঁড়ে সেগুলো ছোটো ছোটো টুকরো করে ভাঙ্গা, তারপর সেগুলো ঘষে ঘষে চকচকে করে অণুবীক্ষণে দেখা – এই চলল দুপুর অবধি। স্যার এর মধ্যে থেকে কিছু নমুনা ব্যাগে ভরে নিচ্ছিলেন। তারপর একসময় সব গুটিয়ে নিয়ে উঠে পড়লেন। দেখে মনে হচ্ছিল বেশ খুশি হয়েছেন। বললাম –“স্যার কাজ হয়ে গেল?”

    “কাজ কি কখনো শেষ হয়? খিদে পেয়েছে তাই গুটিয়ে নিলাম। চলো, আগে খাওয়া, তার পর হোটেলে গিয়ে আবার বসব।”

    ***

    বিকেলের দিকে কাজ শুরু হলো। স্যার প্রথমে হোটেলের ঘরটাকে ওঁর ল্যাবরেটরি করে নিলেন। টেবিলে অন্য একটা বড় মাইক্রোস্কোপ। জুতো রাখার তাকে আটকে দিলেন পাথর ঘষার যন্ত্র। খাটের ওপর বই, কাগজপত্র। আমাকে বসিয়ে দিলেন মেঝেতে। আমার কাজ নমুনা পরীক্ষা হয়ে গেলে তা গুছিয়ে রাখা আর স্যার যা বলবেন তা খাতায় লিখে ফেলা।

    মাঝখানে দুবার চা এল। রাতের খাবার ঘরেই আনিয়ে নিলেন। একমনে তপস্যা করা আর বিজ্ঞানের কাজ আমার একই রকম মনে হচ্ছিল। স্যারের তপস্বী রূপ আমি সেই প্রথম দেখেছিলাম।

    রাত একটা নাগাদ স্যার আমার পিঠে একটা চাপড় মেরে বললেন, “একটা বিরাট আবিষ্কারের সঙ্গে তোমার নাম জুড়ে গেল, বুঝলে…”

    বললাম, “কী হয়েছে স্যার, হিরে পাওয়া যাবে!!”

    “পাওয়া যাবে নয়, পাওয়া গেছে। এই কিম্বারলাইটে হিরে থাকার সব লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। আর একটু খোঁড়াখুঁড়ি করলে হীরকখণ্ড পাওয়া যাবে। আমি নিশ্চিত।”

    “তাহলে এবার আমরা কী করবো, স্যার?”

    “একটা বড় কোম্পানি আমাকে বলেছে হিরে খুঁজে দিতে পারলে ওরা আমাকে অনেক টাকা দেবে। ওরা সরকার থেকে জায়াগাটা ইজারা নিয়ে হিরের খনি প্রতিষ্ঠা করবে, আমাকে তার অংশীদার করে নেবে। চাইলে তুমিও ভালো মাইনের কাজ পেতে পারো … তুমিও তো এই অভিযানের একজন।”

    সেদিন রাতে আমার ঘুম হলো না ভালো করে। খালি মনে হচ্ছিল চাকরিতে নিলেও কত আর দেবে। আমি আর স্যার যদি নিজেদের কোম্পানি খুলি? হিরের দাম তো অনেক হয়, হিরের খনির মালিক হলে তো বিরাট বড়লোক হয়ে যাব। বাড়ি হবে, গাড়ি হবে, যখন যা চাইব তা পাবার ক্ষমতা হবে... না না কাল সকালেই স্যারকে বোঝাতে হবে। হিরের খনির সন্ধান পেয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকার কোনো মানে হয়?

    ***

    সকালে দেখলাম স্যারের অন্যরকম মেজাজ। বললেন, “আজ ব্রেকফাস্টে কী খেতে চাও বলো। তারপর খানিক নৌকাবিহার করে আসা যাক। আজ আমাদের ছুটি রে ভাই, আজ আমাদের ছুটি…”

    আমি স্যারকে হিরের ব্যবসার কথাটা বলি বলি করছিলাম। এমন সময় স্যার হঠাৎ বলে বসলেন, “তোমার কাছে একটা কাপড়ের থলি ছিল না…নিয়ে এসো তো … কটা জিনিস ভরতে হবে..”

    দেখলাম স্যার থলিটায় কাল রাত্তিরে লেখা কিছু কাগজপত্র আর খামে রাখা পাথরের নমুনাগুলো ভরলেন।

    নৌকাতে উঠে আমি সাহস করে আমার প্ল্যানটা, মানে দুজনে মিলে হিরের ব্যবসা শুরু করার কথাটা বলেই ফেললাম।

    স্যার আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন তারপর আস্তে আস্তে বললেন, “তুমি ঠিকই বলছ। আমি কিংবা আমরা অনায়াসে এখানে ইজারা নিয়ে খনির কাজ শুরু করতে পারি। হিরে পাওয়া যাবেই, কোটি কোটি টাকা লাভ করতে পারব। সাতপুরুষের জন্য অফুরন্ত টাকাপয়সা আসবে হাতে।

    “কিন্তু ভেবে দেখেছ, এই জায়গাটার কী অবস্থা হবে। খনির জন্য জঙ্গল কেটে সাফ করতে হবে, তারপর হবে রাস্তা। তার ওপর দিয়ে ভারী ভারী ট্রাক, গাড়ি, বাস চলবে। শহরতলী গড়ে উঠবে। বাজার, পাকাবাড়ি, সিনেমা হল। সারাদিন হইচই, মানুষ দৌড়বে টাকা, আরও টাকা রোজগার করতে। সঙ্গে আসবে লোভ, হিংসা, ঝগড়া, খুনোখুনি।”

    বিহুরামের নৌকা চলছে। সেই জায়গাটার পাশ দিয়ে, যেখানে আমরা হিরের সন্ধান পেয়েছিলাম। এখানে কথা বলা বারণ, তাই স্যার আমার কানের কাছে মুখ এনে বললেন, “চারপাশটা কী সুন্দর লাগছে বলোতো! কোথাও নিবিড় বনজঙ্গল, কোথাও পাহাড়ের গা ছুঁয়ে নদী বয়ে গেছে। দূরে গ্রাম দু-চারটে, ক্ষেতে চাষ হচ্ছে।”

    আমার মনে তখন বিরাট বড়লোক হবার ইচ্ছে ঢুকেছে। চারপাশ সুন্দর লাগছিল ঠিকই, তবে হিরে কি তার থেকেও বেশি সুন্দর নয়…

    এমন সময় একটা ঝপ করে শব্দ হলো। চমকে উঠে দেখলাম স্যার ওই কাগজপত্র আর কিম্বারলাইটের নমুনা সমেত থলিটা জলে ফেলে দিয়েছেন! হিরের ঠিকানা, হিরের খবর সব চলে গেল জলের তলায়!

    এতই আশ্চর্য হয়েছিলাম যে আমার মুখে কথা সরল না। কেমন যেন হয়ে গিয়েছিলাম। চুপ করে স্থির হয়ে বসেছিলাম। অনেকক্ষণ পরে স্যার আমার পিঠে হাত দিয়ে বললেন, “হয়তো তোমার ভাল লাগল না, কিন্তু আমি অনেক ভেবেই সব কিছু ফেলে দিলাম, বুঝলে। এরকম একটা জায়গা নষ্ট করতে মন সায় দিল না। যাইহোক, তোমার মাইনে – আট হাজার আছে – এই খামটা রাখো।”

    আমি আস্তে আস্তে বললাম, “স্যার, একদিন আপনি আমার কাছে কবিতা শুনবেন বলেছিলেন। শুধু দুটো লাইন বলছি স্যার এখন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘স্পর্শমণি’ কবিতা থেকে - ‘যে ধনে হইয়া ধনী, মণিরে মান না মণি/ তাহারি খানিক/ মাগি আমি নতশিরে…’”

    এই বলে আমি স্যারের পা ছুঁয়ে প্রণাম করে খামটা ফিরিয়ে দিলাম।



    তারপর কত দিন কত বছর কেটে গেছে। যোগাযোগ ছিল না, তবু খবর পেয়েছিলাম যে স্যার আর নেই। তাই এতদিন পরে সব কিছু লিখেই ফেললাম। এখন সেখানে কী অবস্থা তা জানি না, তবে হিরের খনি যে হয়নি তা জানি। আমার কীরকম মনে হয় মা বসুন্ধরা যেন ইচ্ছে করেই হীরকবাহী কিম্বারলাইট ফেলে রেখেছেন সেখানে। বিজ্ঞানীরা লোভ জয় করতে পারেন কি না তার পরীক্ষা নিতে। আমার স্যার সে পরীক্ষায় সসম্মানে পাশ করেছিলেন।

    এখনো মনে পড়ে ঘন বনের ভেতর দিয়ে নৌকা বেয়ে চলা। সেই রোমাঞ্চ, সেই চিত্রবিচিত্র হেলে সাপ, সেই হাটে কেনাবেচা করতে আসা হাসিখুশি গ্রামের লোকেরা। আর মনে পড়ে বিহুরামের কল্পনার সেই বনদেবীকে। তিনি বনের ভেতর মানুষের যাতায়াত এমনকি কথা বলাও মোটে পছন্দ করেন না।
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments