• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৮ | অক্টোবর ২০২২ | গল্প
    Share
  • হিমযুগ আসছে : পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়



    ফাগা লোহারের সারাদিন কাজকর্ম কিছু নেই। কিন্তু মানুষ কি একেবারে নিষ্কর্মা হয়ে বসে থাকতে পারে? তা নয়। ফাগা লোহারের প্রতিদিন আসলে অনেকখানি কাজ। অনেকখানি – অর্থাৎ কাজ একটাই। কিন্তু সেটা বেশ লম্বা। তার সময়-অসময় বলেও কিছু নেই। কাজটির নাম ইতিউতি ঘুরে বেড়ানো।

    তার মানে এও নয় যে, দূর দেশ ভ্রমণে ফাগার খুব নেশা। আট-দশ বছর আগে সে পুরুলিয়া সদরে গেছে শেষবার। আর বারো-তেরো বছর আগে আমচাতর নামে গঞ্জ মতো একটা জায়গায়। এই দ্বিতীয় জায়গাটি ফাগার শ্বশুরবাড়ি। বউ নিয়ে এসে অব্দি সেখানে আর সে পা দেয়নি।

    সুতরাং বাড়ি-বসা অকর্মণ্য লোক হিসেবে গাঁয়ে ফাগার খুব দুর্নাম। গাঁয়ের চতুঃসীমায় ঘুরে বেড়ানোকে কেউই কর্ম হিসেবে মানতে চায় না। ফাগা এতে খুব দুঃখ পায়। এ কী অন্যায় গ্রামবাসীদের! কোনটা কাজ আর কোনটা নয় তা ঠিক করা কি একটা সহজ কথা? ঠিক করবেই বা কে? যার বিনিময়ে পয়সা আসে তাই কি শুধু কর্ম? তার চেয়ে বরং বলা ভালো যার যেটায় আনন্দ তার সেটাই কাজ। আনন্দ আসবে কোন দুয়ার দিয়ে সেটা বুঝে নিক প্রত্যেক লোক নিজে নিজে।

    ফাগা, মাটির সঙ্গে মিশে থাকা অত্যন্ত লাজুক প্রকৃতির একটা লোক। আর আগাপাশতলা নিরক্ষর। ওপরের কথাগুলি ভেবেও সে খুবই লজ্জা পায়। ওরে বাবারে, সে কি তবে কানে কলম গোঁজা দিগ্‌গজ হয়ে উঠলো নাকি রাতারাতি? শিক্ষিত লোক মাত্রেই তার কানে কলম শোভিত ছবি ফাগার মনে দেখা দেয়। তখন তার হাসতে হাসতে নাভিশ্বাস উঠতে থাকে।

    আগে তবু ফাগার একটা অনিচ্ছাকৃত কামারশালাও ছিল। বর্ষায় গোটা গাঁয়ের জল ছুটতে ছুটতে এসে যে রাস্তায় এসে নামে, ফাগার কামারশালাটি ছিল সেই রাস্তায়, একেবারে সেই জলধারার তীরেই অবস্থিত। এই জলে মাঝে মাঝে কৃত্রিম প্লাবন ঘটত। তাতেই ফাগার কামারশালাটি ডুবে যায় অন্তত বার পাঁচেক। তারপর হাপরের আগুন স্নেহে অন্ধ হয়ে তালবাগড়ার (অর্থাৎ বোঁটা সমেত তালপাতা) চাল ছুঁয়ে কামারশালার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় আরও কয়েকবার। এই দুই পরস্পর বিপরীতধর্মী বিপর্যয় প্রায়ই ঘটতে থাকে। আর, ফাগার এই সব ক্ষতিতে লোকের সন্দেহ বাড়ে খোদ ফাগারই ওপর।

    একদিন লক্ষ্মীকান্ত বোষ্টম ফাগাকে বলল, ওরে ফাগা, তোর এইটুকু কামারশালায় কত রকম কাণ্ড! জল, আগুন, ছুরি-কাঁচিতে ধার দেওয়া আবার খদ্দেরকেও অম্লান বদনে ধার দেওয়া; না রে ফাগা, তোর নিঃস্ব হওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা।

    আর কেউ না জানলেও গাঁয়ের লোক হিসেবে লক্ষ্মীকান্ত প্রথম থেকেই জানে যে ফাগা আসলে একজন অভিযাত্রী। অ্যাডভেঞ্চার ওর রক্তে।

    ফাগা তার গাঁ-টির আয়তন বাড়িয়ে চলে রোজ। কারণ সে একেবারে পুরোটা ঘোরে না কোনোদিনই। সেটা সম্ভবও নয়। পঁয়তাল্লিশ বছর বয়েসের মধ্যে, তা প্রায় তিরিশ বছর তো বটেই – সে এইভাবে গাঁয়ে ঘুরছে। গাঁয়ে গাঁয়ে নয়। শুধু নিজের গ্রামেই। কিন্তু তার ধারণা এখনো পুরোটা ঘোরা হয়নি। আরো আছে। সবটা ভ্রমণ করতে তা প্রায় আশি-নব্বই বছর বয়েসের একটা গোটা আয়ুষ্কাল লেগে যাবে। কলম্বাসের মতো অভিজ্ঞতাও ফাগার হয়েছে বেশ কয়েকবার (কলম্বাসের নাম ফাগা জানে না। এ কথা আমি বলছি – অর্থাৎ লেখক)। তার মধ্যে, পাহাড় হতে চেয়ে হতে না-পারা একটা মস্ত উঁচু অতৃপ্ত নীলাভ পাথর ও তার নিচে বিরাট পাথুরে উঠোনের মতো পুরো গোল একটা জায়গা সে আবিষ্কার করেছে। উঠোনের পাথরের রং যে ঠিক কী আজ অব্দি ফাগা স্থির করতে পারেনি। কিন্তু উঠোনের রঙের দিকে খানিক তাকিয়ে অন্ধকারের দিকে চোখ ফেরালে মনে হয় অন্ধকার যেন সাফসুতরো হয়ে যাচ্ছে। একবার তাকানোর প্রভাব যেন বেশ কিছুক্ষণ থাকে। রাতের পথঘাট দিব্যি ফর্সা লাগে। তারপর ধরো, উঠোনটিতে দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝেই ফাগার মনে হয়, তলা থেকে কিছু একটা সরে যাচ্ছে ও পাথরের সেই শৃঙ্গ সমেত উঠোনটি খুব ধীর গতিতে ঘুরতে লেগেছে। এসবই যে মনে হওয়া তাতে সন্দেহ কী! জায়গাটি ফাগার খুবই পছন্দের। পছন্দ হওয়ার কাল্পনিক কৈফিয়ত হতে পারে এগুলি। নিজের কাছে নিজেরই। তা গাঁয়ের লোক কস্মিনকালেও এদিকে আসেনি ও দেখেনি পাথরটার রূপ ও রঙের ঐশ্বর্য। ফাগা মনে মনে পাথরটার মান রেখেছে, ফাগু-পাথর! (তার আর অন্য ভালো নাম নেই, সে কী করবে! শুনতে মোটামুটি ঠিকঠাক লাগবে বলে ফাগাকে জোর করে ফাগু করা গেছে।) এসব কি কম কীর্তি? পরিশ্রম ধৈর্য অধ্যবসায় লাগে রে বাবা, তোরা কী বুঝবি! ফাগা অবশ্য ঠিক এই শব্দগুলি বলে না, তবে যা বলতে চায় তার ভাবার্থ এইগুলি। যার উদ্দেশে বলে সে কানে কলম-গোঁজা সেই কল্পিত শিক্ষিত লোক। ফাগার আবার হো-হো হাসি পায়। হাসতে হাসতে সে মাঝে মাঝে ফাগু-পাথর থেকে গড়িয়েও পড়ে।

    ফাগার গ্রাম ও তার চারপাশ একটি বিস্তীর্ণ জায়গা। বেশ খানিকটা ঘিঞ্জি। সাত-আটটি কুলি – মানে পাড়া। প্রত্যেক কুলির মাঝ বরাবর কুলি-পাটান – অর্থাৎ দু-পাশাড়ি ঘরবাড়ির মাঝে এ-মুড়ো ও-মুড়ো লম্বা ও চওড়া জায়গা। এক হাত জায়গার জন্যে সেখানে মারামারি হচ্ছে, দান-ধ্যানের আলোচনা চলছে, নিন্দে-মন্দ হচ্ছে, কুৎসা রটছে। তারপর একেবারে ফাঁকা। আকাশের প্রান্ত নেমে এসেছে মাটিতে। মেঘ-বাদলা না থাকলে এমন স্বচ্ছ লাগে আকাশ, দেখে ভয় লেগে যায়। একা একা চেয়ে থাকতে থাকতে, হতেও তো পারে, সেই স্বচ্ছতায় একজন কেউ বিলুপ্তই হয়ে গেল পুরোপুরি!

    তিন দিকে ফাঁকার পরে শুধু ফাঁকাই। ফাঁকারই হম্বিতম্বি কেবল। চার নম্বর দিক – অর্থাৎ উত্তর-ঈশাণ কোণে অনেক দূর অব্দি বনবাদাড়। পলাশ গাছ অগুনতি। দেড়শো বছর আগে এই গাঁয়ের ভটচাজ আর মুখোপাধ্যায়রা মিলে লাক্ষা চাষে মেতে ওঠে। লাক্ষা সবচেয়ে ভালো হয় পলাশ গাছে। তারাই বনের সূত্রপাত ঘটায়। শুধু সূত্রপাত। তারপর বন নিজের বাপের কথাও শোনেনি। নিজের মর্জিতে বেড়েছে। পাখিদের উদ্যোগে ক্রমে অন্য অন্য গাছেরও নাগরিকত্ব হয়েছে সেই বনে। বনটা এখন দেড়শো বছরের ঠাকুর্দা। তার মন মর্জি ভীমরতির কাছে কে যাবে! এক শতাব্দীতে কেউই তার নিকটবর্তী হয়নি। এই বনেরও একটা নাম দিতে ইচ্ছে হয়েছে ফাগার। পাঁচমিশালি বন। এই নামটাই দীর্ঘদিন ফাগার অন্তরে প্রচলিত ছিল। তারপর লক্ষ্মীকান্ত বোষ্টমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হওয়ার পরে তার মুখে শুনতে-ভালো অন্য একটা নামের সন্ধান পাওয়া যায়।

    লক্ষ্মীকান্ত বোষ্টম বলে, পঞ্চবটী কেমন হয় ফাগা?

    ফাগা বলে, আইজ্ঞা, দুটি নাম কি কাছাকাছি?

    লক্ষ্মীকান্ত বোষ্টম হেসে বলে, তুই কি নিজের দেওয়া নাম কিছুতেই বদলাতে চাস না? তা তোর ওই পাঁচ আর এই পঞ্চ শুধু কাছাকাছি। চলবে?

    ফাগা বিনয়ের সঙ্গে বলল, আইজ্ঞা তুমার দেওয়া নামে কানের সাড়া পাচ্ছি। আমারটায় পাচ্ছি কই! তুমার নামই থাক।

    লক্ষ্মীকান্ত বোষ্টম বলল, না রে ফাগা, এ নামও আমার দেওয়া নয়। পুরাণের নাম। পুরনো নামও বলা যায়। পুরনো নাম নতুন করে রাখলে তার মধ্যে নতুনের একটু উল্লেখ থাকা ভালো। নব পঞ্চবটী বরং রাখা যাক, কী বল!

    সেই নব পঞ্চবটীর দেড় কিমি আগে ফাগু-পাথর। তার পর একটা অতি বিপজ্জনক জায়গা। লাক্ষা চাষের বনে ঢুকতে বাধা সৃষ্টির জন্যে ভটচাজ আর মুখো-রা ফাগু-পাথরের উপত্যকা থেকেই বাঘনখী নামে এক কাঁটা গাছের চাষও করে। যে গাছ এমনিই অযত্নে দিগন্তব্যাপী বেড়ে ওঠে, সেই গাছ সযত্নে লালন করলে, দেড়শ বছর পরে কী ভয়ানক হয়ে ওঠে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। কাঁটাগুলির রক্ত-পিপাসা লকলক করছে। মানুষ তো মানুষ দৈত্য-দানবকেও ওরা বাগে পেলে ছাড়বে বলে মনে হয় না। প্রথম প্রথম এই কাঁটার নামের প্রতি যথেষ্ট ভয় না থাকার কারণে ফাগার একবার খুব জোর প্রাণসংশয় হয়। কাঁটা-ঘেরা অবস্থাতেই সেবার ফাগার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় কী কারণে আজ এক শতাব্দী হতে চলল গাঁয়ের কেউই এদিকে একবারও আসে না। ফাগা মরতে মরতে বেঁচে নিজের কান মুচড়ে ফিরে আসে। কিন্তু চুপ করে বসে থাকতে পারে না বা প্রতিজ্ঞায় অটলও থাকতে পারে না। আবার যায়। এই কারণেই ফাগাকে একজন অভিযাত্রী বলা যায়। তারপর অনেক খুঁজে কাঁটার রক্ত-তৃষ্ণার মধ্যেই একটু করুণা দেখতে পায় ফাগা। অর্থাৎ একটা সুঁড়িপথ। তাতেও রক্তাক্ত হবার ভয় আছে বটে, তবে মরার ভয় নেই। হ্যাঁ, অনেক ধৈর্য লাগবে। হয়ত পথটা অতিক্রম করতে একটা গোটা বেলাই লেগে গেল! ফাগু-পাথরের দু-কিমি প্রায় সম্মুখ ভাগ থেকে আখের খেতের শুরু। লাক্ষা চাষের ক্ষেত্রে যেমন ভটচাজ ও মুখো-রা গাঁটছড়া বাঁধে এককালে, আখ চাষের বেলায় তেমনি এখন জোট বেঁধেছে বাউরী ও কামাররা। আখের খেত খুবই ঘন। তার ভেতর দিয়ে ওপারের কিছু দেখা যায় না। এই পর্যন্ত গ্রামের লোক আসে। তার বেশি নয় – সেই কাঁটা বনের, জীবন নিয়ে টানাটানি করা উপদ্রবের জন্যে।

    গ্রামের চতুঃসীমার একটা দিক দুর্গম আর বিপজ্জনক হওয়ার জন্য এক শতাব্দীতে কেউই আর সে-পথ মাড়ালো না বা ওদিকটাকেই চূড়ান্ত শেষ বলে ধরে নিল একযোগে সবাই, এ কি হয়? ফাগা কিন্তু মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, হয়, হয়। কিন্তু বিশ্বাসই করে শুধু। তর্কে যায় না কখনো কারো সঙ্গে। ফাগা শুধু লাজুকই নয়, সে খুবই ভিতু প্রকৃতির মানুষ। সবাইকেই তার সাংঘাতিক ভয়। বাচ্চাকেও। একমাত্র লক্ষ্মীকান্ত বোষ্টমকে নয়।

    লক্ষ্মীকান্ত ফাগারই সমবয়সী একটি লোক। তবু আজকাল ফাগা তার নাম ধরে ডাকতে পারে না। আগে ডাকত দিব্যি। ইদানিং লজ্জা পায়। আজকাল বরং লক্ষ্মীকান্তকে ‘বাবু’ বলে সম্বোধন করতে পারলে সে বেঁচে যায়, এমনি হয়েছে ফাগার মন।

    লক্ষ্মীকান্ত যেমন মাঝে মাঝে সকাল বেলা ঘরে ঘরে ভিক্ষে করতে এসে ফাগার উঠোনে আসত ও গান ধরত, এখনো তেমনিই করে। আগে আগে ওকে দেখে ফাগার মনে হতো, লক্ষ্মীকান্ত যেন আগাপাশতলা সংসারী মানুষ, তার একঘর ছেলেপুলে, আশ্রিত ও অতিথির মেলা লেগে আছে ঘরে। লক্ষ্মীকান্ত মাথা খাটিয়ে সব দিক নিয়ন্ত্রণ না করলে সংসার উচ্ছন্নে যায় আরকী! সুতরাং লক্ষ্মীকান্তর খুব চাপ।

    সেই শুনে, পরে, একদিন লক্ষ্মীকান্ত ফাগাকে বলেছিল, চাপ থাকলে ত আমি চুপচাপ ধরণের লোক হতাম রে ফাগা। কিন্তু আমাকে তুই বাক্যবাগীশ বলেই ধরতে পারিস।

    ফাগা লজ্জিত হয়ে বলেছিল, আইজ্ঞা আপনাকে কি আমি বালিশ বলতে পারি!

    লক্ষ্মীকান্ত বলে, ওরে ফাগা, তুই মাঝে মাঝেই আমার কথা শুনতে ভুল করিস বটে, কিন্তু তোর ভুল শব্দের অভিমুখও বার বার ঠিক শব্দের দিকেই যেতে চায়। তা ‘বাগীশ’-কে ‘বালিশ’ শুনলেও ক্ষতি নেই। ‘বাক্যবালিশ’ নামেও একটা শব্দ ভাবা যায় বইকি। যারা ঘুমের মাঝে খুব ভুল বকে, তারা যেন প্রলাপের একটি পুঁটুলি মাথায় দিয়েই শোয়। নইলে তারা অচেতন অবস্থায় অতো কথার জোগান পায় কোথায় বল দেখি! তা সেই কল্প-পুঁটুলিটিকেই বাক্যবালিশ বলা যায়।

    সেই সময় অবশ্য ফাগার একটা উলটো কথাও মনে হতো। সেটি এই যেঃ আজকাল রেশনে এত এত যে চাল-গম মেলে, তা লক্ষ্মীকান্ত ও তার বউ-ছেলে-মেয়ের ‘রেশন কাঁড়’ নাই? রেশন ব্যাপারটি আজকাল এমনই উদার যে ভাতের বন্দোবস্ত একেবারে পাকা হয়ে গেছে। এটা ফাগা চোখে দেখেনি, শুনেছে। চোখে সে দেখেছে যে ভিখিরি দেখা যায় না আদৌ আর। তাহলে লক্ষ্মীকান্ত বোষ্টম আসে কেন? তাও ফাগার মতো এমন একটি সংসারে যার ঘরের চালে পুয়াল নাই। উঠোনে বেড়া নাই। অভাব আর নোংরার একত্র বাস।

    ফাগার চারটি ছেলে-মেয়ে। কারো ‘রেশন কাঁড়’ নেই। ফাগার নিজেরই নেই। একমাত্র আছে বউয়ের। ওই একখানিই সম্বল। খুব সামান্য, প্রায় আবছা মতো কিছু শস্য পাওয়া যায় ওই মারফত। তাতে হপ্তার চারদিনও চলে না। ফাগার বউ লেখাপড়া জানে না বটে, তবে বেশ খাণ্ডার। ভাত যখন অনেক দূরের বস্তু হয়ে যায় (প্রায়শই হয়), কিছুতেই তাকে সংস্থাপিত করা যায় না সংসারে, ফাগার বউয়ের তখন রণংদেহী মূর্তি ধারণ করে ছেলেমেয়েগুলির প্রত্যেকটির জন্য রেশন কার্ড ছিনিয়ে নিতে ইচ্ছে হয় ব্লক অফিসে গিয়ে। কিন্তু কয়েকবার অফিসে যাতায়াত করে অন্তর্গত ভাবে সে খুবই হতাশ হয়ে ফিরে এসেছে। কারণ এই নারী দ্বৈত সত্তায় বিরাজ করে। অফিসে পা রাখা মাত্রই তার এক গলা ঘোমটা দিতে ইচ্ছে করে। তা ফাগার বউয়ের এই দ্বৈত সত্তা সম্পর্কে লক্ষ্মীকান্ত বোষ্টমের বয়ান এ রকমঃ ওরে ফাগা, কণ্ঠ তখন তার উৎকণ্ঠিত হয়। মানে, আপিসের লোকজনের কাছে কথা বেরুতে চায় না আরকী! কন্ঠের আরেক নাম হচ্ছে, বাগযন্ত্র। তা তোর শোনার হিসেবে তোর বউয়ের গলাটিকে বাঘ-যন্ত্র বললেও ক্ষতি নেই। তুই দিবারাত্র ব্যাঘ্রগর্জনই শুনছিস বলেই ধরে নিতে পারিস, কারণ বাঘের ডাক ওর চেয়ে কিছু পৃথক নয়। কিন্তু ওই বাগযন্ত্রই আবার আপিসে গিয়ে, চারিদিকে চেয়ে, অবাক-যন্ত্র হয়ে অব্যাহতি চায়। ওরে ফাগা, তোর বউ খুবই লক্ষ্মীমন্ত। কিন্তু তুই লক্ষ্মীর মন্ত্র যথার্থ জানিস না বলেই প্রায়শ গণ্ডগোল ঘটে বলে আমার বিশ্বাস।

    ফাগা, লক্ষ্মীকান্তর কথায় নিষিদ্ধ মৌতাত অনুভব করে আর হি হি করে হাসে।

    ফাগার উঠোনে বেড়া নেই বলে আঙিনাটি প্রায় অনন্ত। নিকটবর্তী মাঠঘাট সবই যেন উঠোনটির অন্তর্গত। শুধু তার একটা কাল্পনিক সীমা আছে। কাল্পনিক সীমার মধ্যেই আছে এক বুড়ো সজনে গাছ। ফাগা তার নিচে শুয়ে থাকে – যেদিন সে দু-বেলার মধ্যে দু-বেলাই উধাও হয়ে থাকে না, সেদিন। উধাও হলে সে কোথায় যায় তাও কি বলে দিতে হবে? অ্যাডভেঞ্চারে যায়। আর উধাও না হয়ে যা করে তার নাম কিছুই না করা। শুয়ে থাকলেই শতচ্ছিন্ন ও দুর্গন্ধযুক্ত কম্বলটি তার গায়ে দেওয়া চাই-ই চাই। কেন যেন তার আজকাল শীত লাগে খুব। বারোমাস, দিবারাত্র।

    বউ যেদিন অস্ত্র ধারণ করে সেদিন ফাগার হয় খুব চিন্তা। বউয়ের অস্ত্র একটি আধপোড়া কাঠ।

    বউ বলে, উঠবি? যাবি কন্টোল দোকান (রেশন দোকান)?

    ফাগা জানে এটা তার অধঃপতন দশা। আপাতত তাকে বউয়ের কাছে ‘তুই’ হয়েই থাকতে হবে। উপায় নেই।

    ফাগা অসহায়ের মতো বলে, কন্টোল গিয়ে কী হবে? আমার কি কাঁড় আছে? আগে বলক (ব্লক অফিস) যেতে হবে ত।

    ফাগার বউ বলে, তবে তাই যা।

    ফাগা ঘোষণা করে, আজ শনি। কাল রোব। দু-দিনই বলক বনধ।

    ফাগার বউ ব্যাপারটি বুঝেশুনে বলে, সোমবারে যাবি? না, জুমড়োর বাড়ি খাবি?

    তা সেই শনি থেকেই ফাগার কেমন একটা ভয়-মেশানো চিন্তা শুরু হয়ে যায়। রাতে ঘুম হয় না। বার বার ওঠার জন্যে সকালে দেখা যায়, সজনে-তলায় প্লাবন ঘটে গেছে। বউয়ের হাতে পোড়া কাঠের আঘাত খাওয়ার ভয় নয়। আসল কথা, ব্লক আপিস গিয়ে তাকে পাথরে পরিণত হতে হবে। কারণ মুখ ফুটে সে সাহেববাবুকে কিছুই বলতে পারবে না। কাগজপত্র কী কী লাগবে কিছুই জানে না। তার আধার কার্ডই ত নেই। এবার কখন বাবু তাকে তার নীরব আবেদনের বিনিময়ে ডাকবে, আদৌ ডাকবে কি না তারই কি ঠিক আছে কিছু। বিকেল চারটেয় হয়ত দেখা গেল ফাগা না খেয়ে বসে আছে ত আছেই, আপিস বন্ধ হচ্ছে। একটি নিষ্ফল পাথর হবার ভয় ফাগার। লজ্জাকে জয় করতে না পারারও ভয় – ইত্যাদি।

    নিজের বিষয়ে এরকম হাজার চিন্তার কারণ থাকা সত্ত্বেও লক্ষ্মীকান্ত-রহস্যই ফাগাকে সাধারণত ভাবায় বেশি।

    একদিন ফাগা লক্ষ্মীকান্তর পিছু নেয় বিকেল বেলা। কারণ লক্ষ্মীকান্ত সেদিন বেলা-ডুবু সময়ে ভিক্ষে করতে এসেছে। লক্ষ্মীকান্তর সময়-অসময় জ্ঞান নেই।

    ফাগা লক্ষ্মীকান্তর সঙ্গে চিরদিন একই গাঁয়ে আছে কিন্তু লক্ষ্মীকান্তর ঘর কোন কুলিতে (পাড়ায়) জানে না। নাঃ, ফাগার একঘেয়ে আড়ষ্টতা ফাগাকে বড়োই একঘরে করে রেখেছে দেখা যাচ্ছে। সুতরাং গা ঝাড়া দিয়ে ফাগা তার পিছু নিল।

    দেখা গেল, ঘরে ফেরার নামে লক্ষ্মীকান্ত বোষ্টম সেই অকূল শূন্যের পাথার পাড়ি দিচ্ছে ও উত্তর-ঈশাণ কোণের দিকে এগোচ্ছে। ফাগা তার সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখেছে অন্তত পঞ্চাশ হাত। এত দূরে আবছায়াটাও আবছা। লক্ষ্মীকান্তকে দেখাচ্ছে পেন্সিলে টানা রেখার মতো। আর লক্ষ্মীকান্ত নিজে পিছন ফিরে তাকালে অস্থিসার ফাগাকে দেখতে পাবে মাত্র একটা জুরগুন্ডা (চোর কাঁটা) রূপে। ফাগাকে তার চিনতে পারার সম্ভাবনা খুব কম।

    আখের খেত পেরিয়ে লক্ষ্মীকান্ত প্রায় ফাগু-পাথরের কাছেই চলে এল। তারপর কোথায় যে ছু-মন্তর হয়ে গেল! ফাগা বিচলিত বোধ করতে লাগল। সে সাহস করে পঞ্চাশ হাত ব্যবধান মোটে দশ হাতে কমিয়ে আনল লক্ষ্মীকান্তর হারিয়ে যাওয়া দিকের উদ্দেশে।

    দেখা গেল, ফাগা যে হাতে রেখে রেখে ভ্রমণ করে, গাঁয়ের আয়তন ক্রমে ক্রমে বাড়তে দেয় তার দেখার হিসেবে – আজ সেটা তাকে প্যাঁচে ফেলেছে।

    ফাগু-পাথরের উপত্যকাই সে দেখে থাকে সাধারণত, কিন্তু চুড়ো দেখেনি কখনো। চুড়োতে যে একটা অধিত্যকাও আছে (অর্থাৎ চুড়োর ওপরের সমতল জায়গা) তা আজ জানল বিশেষ তাগিদে ও স্বচক্ষে তা দেখল।

    অধিত্যকায় চড়ে ফাগার বিস্ময় বোধের আর অন্ত রইল না।

    লক্ষ্মীকান্ত একটা ঘরের মধ্যে ঢুকছে।

    এই ঘর, দৈবাৎ আখের অংশীদারী খেত পেরিয়ে এসেও, দূর থেকে দেখা তো যাবেই না, ফাগু-পাথরের কাছে দাঁড়িয়েও তার খোঁজ পাওয়া দুষ্কর। চুড়োয় উঠেও সামনের দিকে কিছুটা ঝুঁকতে হবে। সেই ঝোঁকা ঝুঁকির চেয়ে কম নয়। এত দূর যদি সাহস থাকে তবে গিয়ে বাড়িটি পড়বে চোখে। কারণ সেটি বিপজ্জনক ভাবে হেলে আছে উলটো দিকের উপত্যকার দিকে। গড়িয়ে পড়লেই হলো আরকী! উলটো দিকের উপত্যকায় সেই মরণ-ফাঁদের মতো কাঁটাগাছগুলির আধিক্য, সহজে যাওয়া যায় না। তাছাড়া অধিত্যকায় তরুণ তুর্কির মতো এক বটগাছ বাড়িটির পাহারাদার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আগাপাশতলা নিরেট পাথরের মাথায় বটগাছটিকে মাটির জোগান দিল কে এই নিয়ে ফাগা দিনের পর দিন ভেবেছে; কিন্তু তারপরও যে আরো একটা গুরুতর ভাবনার বিষয় ফাগু-পাথর মাথায় তুলে রেখেছে সেটা ফাগা কল্পনাও করেনি কোনোদিন। অর্থাৎ এই বাড়ি ও তাতে মানুষের বসতি।

    লক্ষ্মীকান্ত ঘরের ভেতরে ঢুকে যাওয়ার পরে আরো নিকটবর্তী হয়ে ফাগা দেখতে পেল, বাড়ি-টাড়ি ওটি নয়। মিনিবাস বা ওই ধরনের কোনো একটা গাড়ির কঙ্কাল। এত উঁচুতে গাড়ি! কে আনল? দেখে মনেহয় গাড়িটি দুর্ঘটনা-কবলিত। দেখে আরো মনে হয়, কাঠামোটি মাঝে মাঝে আনাড়ি হাতে অদ্ভুত সব উপায়ে টিকিয়ে রাখা হলেও (যেমন ছাদে পুয়াল ও ত্রিপল দেওয়া ইত্যাদি), তা প্রায় পঁচিশ-তিরিশ বছরের কম প্রাচীন নয়।

    ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই ফাগার শরীরের সেই চিরস্থায়ী শীতের অনুভূতি গুপ্ত ঘাতকের মতো পা টিপে টিপে এগিয়ে আসতে লাগল। তার একবার মনে হলো, আসার সময় কম্বলখানি নিয়ে এলেই ভালো হতো। তারপরই মনে পড়ে গেল, সঙ্গে কম্বল আনা খুবই বিসদৃশ ব্যাপার হতো যদি লোকের চোখে পড়ত। কারণ এটি শরতের প্রথম সপ্তাহ মাত্র। তারিখ ৫ই ভাদ্র। পথেঘাটে লোকে বলাবলি করছে ভাদ্রের রোদ-গরম এবার সীমা ছাড়িয়ে গেছে।

    মিনিবাসটির পাল্লাহীন একটি জানলার কাছে ফাগা দাঁড়িয়ে রইল তো রইলই। গা টলমল করলেও ফাগা এই পর্যন্ত নেমে এসেছে নিরাপদেই, কারণ বাসটি অব্দি পাঁচ-ছয় ধাপ সিঁড়ি করা হয়েছে পাথর কেটে।

    লক্ষ্মীকান্ত ঢুকে গেছে বেশ কিছুক্ষণ হলো। ভেতরে কাজকর্ম করছে বোঝা যায়। কিন্তু আলো জ্বালেনি।

    কাক-জ্যোৎস্না উঠছে ধীরে ধীরে। অর্থাৎ ছায়া ছায়া, ছোপ ছোপ চাঁদের আলো। কিন্তু পাথরের মাথাটা যথেষ্ট উঁচু বলে এখানে তার প্রভাব বেশি। বাসের কাঠামোটির অন্দরমহলেও তার আভাস গিয়ে পৌঁচেছে। বাইরের অসংখ্য জোনকির কিছু কিছু ভেতরে গিয়ে নাচানাচি করছে। লক্ষ্মীকান্তকে ছায়া রূপে চলাচল করতে দেখা যাচ্ছে।

    দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফাগা ভাবল, লক্ষ্মীকান্ত, এই তোমার ভরা সংসার! লক্ষ্মীকান্তর বিপজ্জনক-বসবাস নিয়েও ফাগা দুশ্চিন্তায় পড়ল কম নয়। নাঃ, লক্ষ্মীকান্তর ইহকাল আর পরকাল বড়োই কাছাকাছি। একেবারে এ-গাঁ ও-গাঁয়ের মতো ব্যাপার।

    ফাগা ভেবেছিল আজ সে নীরবে ফিরে গিয়ে একদিন, হয়ত কালই, তার গোয়েন্দা কীর্তির ফলাফল হঠাৎ লক্ষ্মীকান্তর কাছে উজাড় করে তার দাঁতকপাটি লাগিয়ে দেবে।

    চুপচাপ ফিরে যাবার জন্যে ফাগা উদ্যতও হয়েছিল, এমন সময় ভেতর থেকে লক্ষ্মীকান্ত বলে উঠলো, ওহে কে বটো, লুকিয়েচুরিয়ে কাজ নাই, ভিতরে এসো। ভয় নাই, আমার ঘর বত্রিশ বছর এমনিই পড়ো-পড়ো হয়ে আছে, পড়ার ইচ্ছা তার আদৌ নাই।

    ধরা পড়ে ফাগার একেবারে তাক লেগে গেল। সে যথেষ্ট সাবধানতাপূর্বক লক্ষ্মীকান্তকে অনুসরণ করছে। ধরা পড়ার কথাই ছিল না। কিন্তু এখন তো আর উপায় নেই। ফাগাকে প্রকাশিত হতেই হলো।

    ফাগাকে দেখে লক্ষ্মীকান্ত যার পর নাই খুশি হলো। বলল, দাঁড়া ফাগা, চা করি। আলো জ্বালাব আরো একটু বাদে। যতক্ষণ কেরাসিন বাঁচে বাঁচুক। কন্টোলে কেরাসিন দেয়। তার দাম অবিশ্যি কম নয়। তার ওপর আমার রেশন কার্ড নাই। সুতরাং দ্বিগুণ দামের ধাক্কা ও লুকনো-চুরনোরও ব্যাপার।

    ফাগা বলল, অন্ধকারে চা করবে কী করে?

    লক্ষ্মীকান্ত বলল, আমার জুনপুকিরা (জোনাকিরা) সাহায্য করে আমাকে। সব ব্যাপারেই করে।

    ফাগা বলল, আমি এসেছি তুমি বুঝলে কী করে?

    –-তুই এসেছিস বলে ত বুঝিনি। শুধু বুঝেছি একটা মানুষ এসেছে।

    –-আহা, হঠাৎ করে তাই বা বোঝা কী করে সম্ভব?

    লক্ষ্মীকান্ত হালকা হেসে বলল, বললাম না জুনপুকিরা আমার সহায়। হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে আলো দিয়ে ওরা নানা রকম ছবি আঁকে। কত চিত্রবিচিত্র ব্যাপার। সবের মানে বোঝা যায় না। বা, যে বোঝে সে বোঝে। তা আজ দেখলাম একটা জানলার কাছে শুধু মানুষেরই অবয়ব আঁকছে। এক বার, দু-বার, তিন বার... অসংখ্য বার। তখন বুঝলাম কেউ এসেছে। তোর মুখের কাছে বুকের কাছে হাতের কাছে যেমন যেমন উড়তে লেগেছে ওরা তেমন তেমন তুই ফুটে উঠেছিস অন্ধকারে।

    লক্ষ্মীকান্তর ওপর একযোগে অনেকখানি শ্রদ্ধা বেড়ে গেল ফাগার। আরেকটা কারণে সে লক্ষ্মীকান্তর প্রতি আত্মীয়তাও অনুভব করল। একমাত্র লাজুক কিংবা অকর্মণ্য হলেই যে রেশন কার্ড করানো যায় না তা নয়, অন্য কারণও থাকে। তার নাম অনিচ্ছা। কিন্তু এই কারণটা বোঝার জন্যে যথেষ্ট এলেম চাই। ফাগা এ-ব্যাপারে একেবারে মনের মতো লোক বলতে পেল, এক লক্ষ্মীকান্তকেই।

    চা খাওয়া হলো। চিনি নেই। চা-পাতা পর্যন্ত নামমাত্র। ‘জলজিরা’ নামের একরকমের টক ও নুন স্বাদের হজমি পাউডারের চা। এক টাকায় প্যাকেট পাওয়া যায়। অনেকদিন চা জোটেনি ফাগার কপালে। তা চায়ের নামে যা-ই খেল বেশ লাগলো খেতে।

    লক্ষ্মীকান্ত বলল, দাঁড়া, এবার আলোটা জ্বালি।

    পাল্লা দেওয়া চতুষ্কোণ এক লণ্ঠন। ন্যাবা রোগির চোখের মতো ছায়াচ্ছন্ন হলুদ আলো।

    লক্ষ্মীকান্তর গৃহের ঐশ্বর্য দেখে ফাগা অবাক হয়ে গেল।

    ঘর-জোড়া বইয়ের সম্ভার। ফাঁকা জায়গা খুব কম। শুধু বই আর বই। একদিকে শুধু একটা তক্তাপোষ। তাতে চটের বস্তা বিছানো। একটা তেলচিটে বালিশ, তার নাড়িভুঁড়ি পর্যন্ত প্রকাশ্যে এসে গেছে। একটা বাঁধানো খোলা খাতা, কয়েকটি কলম। তক্তাপোষের তলায় কেরোসিন স্টোভ, ময়ূরপঙ্খী একটা বঁটি, একটা বাক্স, তার মন্দিরা (ছোটো করতাল) দুটি ও বহু পুরনো অন্ধকার।

    সমতলে থাকার হিসেবে লক্ষ্মীকান্তর এই তৈজসপত্রের মূল্য হয়ত তেমন কিছুই না। কিন্তু লক্ষ্মীকান্ত যেভাবে লোকালয় থেকে অনেক দূরে এই পাহাড়প্রমাণ পাথরের মাথায় একেকটি জিনিস একার চেষ্টায় বয়ে বয়ে এনে প্রায় শূন্যতাকেই একটা আস্ত সংসারের রূপ দিয়েছে সেই হিসেবে এখানকার প্রতিটি বস্তুই ঐশ্বর্যের মর্যাদা পাওয়ার দাবি রাখবে বইকি!

    ফাগা চুপ করে বসে রইল। লক্ষ্মীকান্ত খাতায় লিখতে লাগল খসখস করে। চারিদিকে অপার নীরবতা। বনের দিক থেকে পর্যন্ত এমন একটা আওয়াজ নেই যা, হতে পারে রোমহর্ষক কিন্তু চেনা শব্দ। এর আগেও ফাগা, ফাগু-পাথরের মাথায় না হলেও তার উপত্যকায় ভর সন্ধ্যেবেলা অব্দি বহুবার কাটিয়ে গেছে; তখনো দেখেছে বেশ কিছুদিন হয়ে গেল, বনটা যেন ভারী অপ্রসন্ন আর চিন্তাগ্রস্ত। বন তো রাতের বেলা জাগবেই, তা এর তেমন কোনো লক্ষণ অন্তত বছর দুয়েক ধরে দেখা যায় না। ফাগা এর বহু গভীরেও গিয়েছে, এতটাই দূর যে রাস্তা পর্যন্ত গুলিয়ে গিয়ে শেষে বেরিয়ে আসাই হয়েছে দুষ্কর। তা সত্ত্বেও বনে সে কোনো প্রকার জনপ্রাণী দেখেনি। আচ্ছা ‘জন’ না হয় বাদ গেল, কিন্তু ‘প্রাণী’? সব জীবজন্তু কি শলাপরামর্শ করে একযোগে বিলুপ্ত হয়ে গেল? কীটপতঙ্গ পর্যন্ত!

    লক্ষ্মীকান্তর লেখাপড়া শেষ হয়েছে। সে ভাত চড়িয়েছে স্টোভে। ইতিমধ্যে রাত বেড়েছে। ফাগা চিন্তাস্রোতে ডুবেই আছে তখন থেকে। চিন্তা যারা করে তারা হয় দু-রকমের। চিন্তাশীল ও চিন্তাগ্রস্ত। এই মুহূর্তে ফাগার শ্রেণীটি ঠিক করতে পারল না লক্ষ্মীকান্ত।

    লক্ষ্মীকান্ত বলল, চাট্টি ভাত খেয়ে যাবি ফাগা? তরকারি-ফরকারি নাই কিন্তু।

    আহা, ভাত হলে আর দরকারটাই বা কী! লক্ষ্মীকান্ত বোষ্টমের সঙ্গে তার হৃদ্যতাও যথেষ্ট, এমন অবস্থায় ভাতের নেমন্তন্ন ফেরানো ফাগার পক্ষে দুঃসাধ্য হতো যদি না সে আজকের অবস্থায় পড়ত। আজকের দশাটি ফাগার নিজেরই ভালো করে বোধগম্যও হচ্ছে না। একবার মন উতলা হচ্ছে আবার পরক্ষণেই বুক জুড়ানো আনন্দে পট পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে দ্রুত।

    ভাতের জিজ্ঞাসার উত্তর লক্ষ্মীকান্তকে না দিয়ে একপ্রকার ঘোরের মধ্যেই ফাগা বলে বসল, এই ঘর – না, না, এই বাসটি কি তোমারই ছিল বরাবর?

    লক্ষ্মীকান্ত হেসে বলল, আমি কি কস্মিনকালেও বাস কেনার লোক ছিলাম রে ফাগা? তুই আমায় আজ নতুন দেখছিস নাকি?

    ফাগা বলল, তবে?

    লক্ষ্মীকান্ত তেমনিই হালকা গলায় বলল, এ কি আর বাস আছে রে? একে এখন বসবাস বলাই তো ভালো নাকি?

    ফাগা লক্ষ্মীকান্তর রঙ্গ এড়িয়ে পুরনো প্রসঙ্গেই স্থির থেকে বলল, অ্যাক্সিডেন হয়েছিল নাকি?

    লক্ষ্মীকান্ত আগের চেয়ে চওড়া হেসে বলল, কী জানি! এমনও হতে পারে বাসটা নিজেই ঝাঁপ দিয়ে মরতে এসেছিল। আবার এমনও হওয়া বিচিত্র নয় যে – লক্ষ্মীকান্তর গলার স্বর গাঢ় হয়ে এল –

    ফাগা লক্ষ্মীকান্তর মুখ খুব কাছ থেকে দেখলো আজ। লক্ষ্মীকান্তর ফাগার সমবয়সী হওয়াই সম্ভব। দেখে কিন্তু মনে হয় না। লক্ষ্মীকান্তর মুখে একটা রেখা নেই, কপালে ভাঁজ নেই। তেইশ-চব্বিশ বছরের যুবার মতো চেহারা। স্বাস্থ্য-ব্যবস্থাটিও অটুট। অথচ কী এমন খায় আজই স্বচক্ষে দেখা গেল। আর কিছুদিন বাদেই ফাগা যখন তার প্রিয় কম্বলটি সম্বল করে স্থায়ী শয্যা নেবে তখনো লক্ষ্মীকান্ত এই পাহাড়-সমান পাথরে রোজ ওঠানামা করবে, ভারী ভারী জিনিস বয়ে আনবে। নাঃ, লক্ষ্মীকান্তকে আজ বড়োই অচেনা ঠেকছে ফাগার। অনেক, অনেক দূরের মানুষ বলে মনে হচ্ছে তাকে।

    লক্ষ্মীকান্ত গাঢ় স্বরে ফাগাকে যা বলল তার মর্মার্থ এইঃ এই পৃথিবীই একমাত্র পৃথিবী তো নাও হতে পারে। হয়ত আরো অনেক পৃথিবী আছে ব্রহ্মাণ্ডে ছড়িয়ে। অন্তত একটা দুটো এমন আছেই যেখানে মানুষের মহাজাগতিক আত্মীয় কেউ কেউ থাকে। তাদেরও যানবাহন আছে। দেখতে হয়ত আমাদের এখানকার মিনিবাসের মতোই। কিন্তু তার কাজকর্ম শক্তি টিকে থাকার ক্ষমতা হয়ত অনেক বেশি। হতে পারে তেমনিই একটা যান এসে পড়েছে ফাগু-পাথরের চুড়োয়। তারপর এক-দেড় শতাব্দী কেটে গেলেও আর যেতে পারেনি ফিরে। নিয়ে যাওয়াই সম্ভব হয়নি হয়ত বা। সেই অপার্থিব যানে এখন বসবাস করছে লক্ষ্মীকান্ত বোষ্টম নামের একজন সৌভাগ্যবান মানুষ।

    এই সব বলেই লক্ষ্মীকান্ত দুনিয়া কাঁপিয়ে হা হা করে হাসতে লাগল।

    আজ আর ফাগা ফিরে গেল না। খেতেও উঠল না। তক্তাপোষের নিচে শুয়ে রইল। এবং ঘুমের মধ্যেই লক্ষ্মীকান্তর প্রতি সে তার আগের সম্বোধন বদলে ফেলার সিদ্ধান্ত নিল। লক্ষ্মীকান্ত সব দিক দিয়েই ফাগার চেয়ে ওপরের মানুষ। ‘আপনি-আজ্ঞে’ হওয়ার মতো মানুষ। লক্ষ্মীকান্ত থাকেও তো তার চেয়ে অনেক ওপরে। পৃথিবীর মাটিতে পর্যন্ত নয়। তারও কিছুটা উর্ধ্বে।

    এরপর দিন যায়, দিন যায়।

    এরপর লক্ষ্মীকান্ত যেমন যায় ফাগার ঘরে ভিক্ষে করতে ফাগাও চলে আসে প্রায়শই ফাগু-পাথরের শীর্ষে লক্ষ্মীকান্তর আবাসে।

    লক্ষ্মীকান্ত সকাল বেলা ভিক্ষে করতে এসে ফাগাকে আগের মতোই দেখতে পায় সজনে তলায় কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকতে। ফাগার বউ লক্ষ্মীকান্তকে খালি হাতে ফেরায় না কখনো। কিন্তু চাল দিতে তার মুখ ভার হয়ে যায়। ওই দুটি চাল তাতেও ভিখিরির ভাগ! একমুষ্টি দিতে গিয়েও শেষের ক-টির বেলায় হাতের মুঠো যেন কিছুতেই আলগা হতে চায় না।

    ফাগা অপরাধবোধে ভুগতে ভুগতে মনে মনে বউকে বলে, ওরে খেপি, কাকে কী দিচ্ছিস তুই নিজেই জানিস না!

    লক্ষ্মীকান্ত একদিন তার বাসায় তেমনি সন্ধ্যাবেলা খানিক যেন আবেগের বশে ফাগাকে বলল, ওরে ফাগা, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন নামে একখানা কাব্য আছে, তাতে আম-কাঁঠালের মতো রস। কিন্তু সবাই তো কাব্যের রস চাখতে পারবে না, ওর ভাষাও কিছুটা প্রাচীন। আমি সেই কবিতার বই এখনকার মতো ভাষায়, গদ্যে রূপান্তরিত করেছি। এই ভাঙা বাসের ওপর এসে বসলেই আমার মাঝে মাঝে বাইরের জ্ঞান লোপ পেয়ে যায়। মনে হয় কাঠের দেওয়ালে দেওয়ালেই লেখা রয়েছে কবিতা-পঙ্‌ক্তিগুলির রূপান্তর। ঠিক আমি যেমনটা চাইছি তেমন।

    ফাগা এসব কথার মানে প্রায় কিছুই বুঝল না। সে বসেছে মিনিবাসের সম্মুখভাগে, ড্রাইভার বসার জায়গাটিতে, এবং চেয়ে আছে ধূমল ধূসর দূরের দিকে। এই দিকেই বাসটার গড়িয়ে পড়া মুদ্রাটা স্পষ্ট বোঝা যায় শুধু নয়, তার আসন্ন পরিণতি পর্যন্ত বুকের ভেতর নিশ্চিতভাবে টের পাওয়া যায়। খানিক পরেই ফাগার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল ও গা গুলোতে লাগল।

    লক্ষ্মীকান্তর দিকে ফিরে সে হঠাৎ বলল, আইজ্ঞা –

    লক্ষ্মীকান্ত চোখ বুজে বসে আছে তার চতুষ্কোণ আলোর সামনে। সে ফাগাকে বাধা দিয়ে বলল, ফাগা, তুই কি আমাকে আপনি-আজ্ঞে করতে ভালবাসিস? আমার অস্বস্তি হয়। তবু যাতে তোর ভালো লাগা তাকেই আমি গুরুত্ব দেব। আমি এটুকু জানি, আপনি-আজ্ঞে দিয়েও বন্ধুত্বকে আটকানো যাবে না।

    ফাগা এইসব কথা ভালো করে না শুনে আগের প্রসঙ্গেই অবিচল থেকে বলল, আইজ্ঞা, সেই অন্য পৃথিবীর মানুষের চেয়ে আলাদা মানুষগুলিই যেন তোমার বই লিখে দেয় দেওয়ালে এখন এইটে বিশ্বাস করতেই আমার যে বড্ড আরাম হচ্ছে!

    লক্ষ্মীকান্ত সস্নেহে বলল, আচ্ছা তাই কর। যেমন তোর ইচ্ছে হয় করিস। তোর বিশ্বাসকে তুই শুধু মনেপ্রাণে বিশ্বাসই করিস না রে ফাগা, তাকে তুই ভালোও বাসিস প্রচণ্ড। তুই অতি সরল লোক ফাগা।

    এরপর একসময় গাঁয়ের অন্য অন্য লোকেদের জীবনে এল আনন্দ আর ফাগার বেলায় ঘটল বিপর্যয়। তার কারণ হলো এই যেঃ রেশনের জিনিস এবার থেকে পাওয়া যাবে বায়োমেট্রিক – অর্থাৎ আঙুল ছাপের বিনিময়ে। কার্ড বদলে ফেলারও সুযোগ এল। আগে 'কম জিনিস পাওয়া' কার্ড থাকলে, উপার্জন নেই এমন লোক 'বেশি জিনিস পাওয়া' কার্ডের জন্যে আবেদন করতে পারবে। খুবই সহজেই ঘটে যাবে কার্ডের রূপান্তর। সময়ও লাগবে না মোটে।

    ফাগার রেশন কার্ডই নেই তার আবার পরিবর্তন। এই সুযোগে ফাগা যদি নিজের ও ছেলেমেয়েগুলির রেশন কার্ড না করে আর কোনোকালেও হবে না – ইত্যাদি কথাবার্তাও প্রায়শই আসতে লাগল ফাগার কানে। ফাগা বিমর্ষ হয়ে বসে রইল। তার মাথা গুলিয়ে গেছে। এমনকী ফাগার বউয়ের পর্যন্ত আঙুল ছাপ হলো না রেশন দোকানে। আপাতত যে কয়েক মুঠো আটা ও চাল সে পাচ্ছিল তাও বন্ধ হলো। তাকে যেতে হবে ব্লক অফিস। সেখানেও না হলে –

    ফাগা ভেবে দেখল রেশনের প্রতি তার বিশ্বাস সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়েছে। সজনে তলায় শুয়ে ভর দুপুরবেলা তার লক্ষ্মীকান্তর সেদিনের বলা কথাটি মনে পড়লো – ফাগার বিশ্বাসকে ফাগা যে শুধু জীবন দিয়ে বিশ্বাস করে তাই নয় – ইত্যাদি ইত্যাদি।

    একদিন দুপুরের পর থেকেই ফাগার প্রচণ্ড ঠান্ডা লাগতে শুরু হলো। তার আগে, ভোর বেলা, ব্রাহ্ম মুহূর্তে সে বনের ভেতর ঘুরে এসেছে।

    বিকেলের পরে ওই অবস্থাতেই গেল লক্ষ্মীকান্তর বাসায়। আজকাল লক্ষ্মীকান্তর টান উপেক্ষা করা ফাগার কাছে দুষ্কর হয়ে উঠেছে।

    ভাদ্র মাস শেষ হয়েছে বটে কিন্তু আশ্বিনের শুরুতেই তো আর ঠান্ডা পড়বে না। দিনের বেলা তাপমান এখনো কমেনি। সন্ধ্যার গুমোট আগের মতোই বজায় রয়েছে। তা সত্ত্বেও ফাগা লক্ষ্মীকান্তর বাসায় এসেছে আগাগোড়া কম্বল মুড়ি দিয়ে।

    লক্ষ্মীকান্ত উদ্বিগ্নভাবে বলল, জ্বর নিয়ে কেন এলি বাপ?

    লক্ষ্মীকান্ত ফাগার কপাল ছুঁলো। তারপর অবাক হয়ে বলল, না তো, জ্বর তো এক ফোঁটা নেই। কপাল বরং স্বাভাবিকের চেয়েও বেশি ঠান্ডা। হ্যাঁ রে ফাগা, কী হয়েছে তোর?

    ফাগার চোখেমুখে কেমন একটা বিপন্ন ভাব। অনেকখানি অস্থির লাগছে তাকে। এসেই শুয়ে পড়েছে কাঠের মেঝেটিতে।

    লক্ষ্মীকান্ত মায়ের মতো বলল, আচ্ছা শুয়ে থাক, উঠিস না যেন। আমার লেখা ও ভাত রাঁধা হোক তখন তোকে তুলব।

    লেখা ও ভাত রাঁধা তো দূর লক্ষ্মীকান্তর কথা ভালো করে শেষ হবার আগেই ফাগা উঠে বসল।

    লক্ষ্মীকান্ত ফাগার জন্যে একটা মোক্ষম হোমিওপ্যাথি ওষুধের কথা ভাবতে ভাবতে বলল, কী রে বিশ্রামেও আজ রুচি নেই, বল!

    ফাগা তার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, বোসো একটু, আসছি। ব’লেই দ্রুত বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। ফিরে আসতে মোটেও দেরি করল না অবশ্য। তরুণ তুর্কি গাছের কয়েকটা সদ্য ছেঁড়া বটপাতা লক্ষ্মীকান্তর মুখের সামনে মেলে ধরে উত্তেজিত ভাবে বলল, এই দেখো, দেখো–

    (‘তুমি-আপনি’ ইত্যাদি আজ সব তার ঘেঁটে গেছে।)

    বটপাতা ক-টি আঙুলের ডগা দিয়ে ছুঁয়ে লক্ষ্মীকান্ত থমথমে গলায় বলল, এ যে দেখি বরফ পড়েছে রে ফাগা! তার মানে – লক্ষ্মীকান্ত গভীর চিন্তার সঙ্গে বিড়বিড় করে বলতে লাগল – প্রকৃতি তুষারপাতকেই মেনে নিতে চাইছে! কিন্তু, এক তুই বাদে বাকি আমাদের সবার যে রোদ লাগে, গুমোট লাগে, এগুলো তবে কী? সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থায় বরফ পড়ছে কী করে?

    ফাগা বলল, একটা জায়গা যাবে আমার সঙ্গে?

    –-কোথায়?

    -–বনের দিকে?

    লক্ষ্মীকান্ত দ্বিধা জড়ানো গলায় বলল, এখন?

    কিন্তু ফাগার বিপুল উৎসাহ ও চরম উদ্বেগ মাখানো চোখের দিকে তাকিয়ে লক্ষ্মীকান্ত যেন সম্মোহিত হয়ে গেল। বলল, দাঁড়া, একটা টর্চ নিয়ে নিই।

    ফাগু-পাথরের মাথা থেকে নেমেই ফাগা প্রায় দৌড়তে লাগল।

    লক্ষ্মীকান্ত পিছিয়ে পড়ে ডাকতে লাগল, ওরে থাম থাম, টর্চ আগে আগে নিয়ে যেতে দিবি তো!

    জঙ্গলের আগে সেই দুর্ভেদ্য কাঁটাবন। তার গোপন পথের সন্ধান আগে থেকেই ফাগার যথেষ্ট জানা। লক্ষ্মীকান্ত পৌঁছানো পর্যন্ত ফাগা দাঁড়িয়ে রইল সেখানে। নইলে লক্ষ্মীকান্ত হারিয়ে যাবে তার কাছ থেকে। কিন্তু সেই সুঁড়িপথে ঢোকা মাত্র ফাগা আবার তার গতি বাড়িয়ে দিল। লক্ষ্মীকান্ত কোথায় পড়ে রইল! লক্ষ্মীকান্তর কাছে আলো থাকায় নিশ্চিন্তি। কিন্তু ফাগার জন্যে লক্ষ্মীকান্তর দারুণ চিন্তা হচ্ছে। এক জায়গায় দেখা গেল ফাগার গায়ের কম্বলখানি কাঁটায় আটকে গেছে। ফাগা সেটিকে পরিহার করে এগিয়ে গেছে।

    একসময় বন অনেকটা ফাঁকা হয়ে এল। অন্ধকারের কালিমা কিছুটা ফিকে। ঝিকিমিকি জ্যোৎস্না দেখা যাচ্ছে। গোটা জায়গাটাকে লাগছে মস্ত একটা ইস্পাতের পাতের মতো। শুধু ফটফটে চাঁদের আলোর জন্যেই নয়, এমন মনে হওয়ার আরেকটি কারণও আছে। তা হলো, চারিদিকের পাতলা বরফের আস্তরণ। সেখানে দাঁড়িয়ে, লক্ষ্মীকান্ত পৌঁছনো পর্যন্ত ফাগা হাঁপানোর বিরতি নিল। লক্ষ্মীকান্ত এসে গেলে আবার করল গতিবৃদ্ধি।

    ফাগার মধ্যে সন্ধ্যাবেলার অস্থিরতা ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে। তার বদলে তাকে ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। ফাগাকে দেখতে লাগছে, ফাঁসির সাজা পাওয়া বিপ্লবীর মতো। অকুতোভয়, তবু কেন যেন মন ভালো নেই। লক্ষ্মীকান্তকে ফাগা যা দেখাতে চেয়েছিল তা দেখিয়েও কিছুতেই যেন তার আশ মেটে না। আরো দেখুক লক্ষ্মীকান্ত। যতদিন না সর্বনাশ পুরোপুরি আসে ততদিন তা নিরাকার। কিন্তু একেবারে দুর্বোধ্য তো নয়। লক্ষ্মীকান্ত শিক্ষিত ও দূরদর্শী মানুষ, ভালো করে দেখেশুনে সে আসন্ন অমঙ্গলের একখানি রূপরেখা ঠিক করুক। তারপর ওর মুখেই সব শুনবে ফাগা। ওর মুখে শোনাটাই একটা বিরাট সান্ত্বনা।

    ক্রমশ পায়ের নিচে বরফ পুরু হতে শুরু হলো। এবং অনতিবিলম্বেই পায়ের পাতা প্রায় ডুবতে বসল বরফে।

    লক্ষ্মীকান্ত অগ্রগামী ফাগার উদ্দেশে চেঁচিয়ে বলল, ওরে ফাগা, পায়ে কিছু পরে এলি না কেন?

    কাঁটার ঘায়ে ইতিমধ্যে দু-জনই বিস্তর ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। একজন অনভ্যাসের জন্যে। আরেকজন দ্রুততার কারণে।

    খানিক পরে দেখা গেল খালি পায়ে বরফের ওপর দৌড়তে গিয়ে ফাগা আরেক রকম বিপদেও পড়েছে। তার পায়ে ফোস্কা পড়ে গেছে।

    লক্ষ্মীকান্তই এবার তাকে ছাড়িয়ে পাগলের মতো এগিয়ে গেল।

    সেই অব্দি কোনো রকমে পৌঁছে ফাগা দেখল, একটা মস্ত বরফাবৃত পাথর চাটানের ওপর উবু হয়ে বসে, খানিকটা বরফ সরিয়ে লক্ষ্মীকান্ত টর্চের আলোর সাহায্যে কী একটা ব্যাপার গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছে।

    ফাগার এই মাত্র একটি কথা মনে হলো। সেটি এই যেঃ তাদের এই যাত্রায় প্রায় এক প্রহর রাত পেরিয়ে গেছে। জীবনে কখনো গাঁ ছাড়িয়ে সে এতটা দূরে আসেনি। কিন্তু এখনো কোনো লোকালয়ের দেখা নেই?

    লক্ষ্মীকান্তও প্রায় এমনি কথাই ভাবছে বোঝা গেল। সে মুখ তুলে বলল, ওরে ফাগা, গাঁয়ের কেউ কখনো এদিকে এসে জেনে যায়নি কেন এদিকে কী ঘটছে?

    লক্ষ্মীকান্তর চোখে-মুখে প্রচুর বরফের গুঁড়ো লেগে আছে। ফাগার, লক্ষ্মীকান্তর বলা সেই অদেখা অপার্থিব মানুষদের কথা মনে পড়ে গেল।

    বরফ মেখে ফাগার দশাও লক্ষ্মীকান্তরই মতো। ফাগার মুখে আলো ফেলে লক্ষ্মীকান্তর মনে হলো, তার পুরনো বন্ধু, যে এতক্ষণ তাকে সঙ্গ দিয়েছে, সে আর নেই। তার বদলে সামনে যেন দাঁড়িয়ে আছে জলজ্যান্ত এক প্রাগৈতিহাসিক লোক।

    লক্ষ্মীকান্ত খানিক চুপ করে থেকে একসময় ফাগার হাত ধরে টেনে বলল, ফাগা, দ্যাখ, কী সাংঘাতিক ব্যাপার।

    ফাগা দেখল, পাথরের ওপর বরফ সরানো জায়গাটুকুতে একটা এলোমেলো আঁকিবুকি। তা থেকে বরফের বাষ্প উঠছে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম। ফাগা ফ্যালফ্যাল করে সেদিকে চেয়ে থাকায় লক্ষ্মীকান্ত বলল, ওরে ফাগা, এর নাম জীবাশ্ম। মানে একটা কোনো জীবের শরীরের ছাপ উঠে-যাওয়া পাথর। ‘অশ্ম’-র অর্থই তো পাথর। এই জীবাশ্ম খুব বেশিদিনের পুরনো নয় বলেই আমার মনে হচ্ছে। তা একে চেনাও যায় কিছুটা। এ হলো পাখি আর স্তন্যপায়ী, মানে যারা সরাসরি বাচ্চা দেয় ও মায়ের দুধ খেয়ে বড়ো হয় তেমন প্রাণী, এই দুয়ের মাঝখানের প্রাণী। ভালো করে চেয়ে দ্যাখ ফাগা, এর চোয়ালে দাঁত আছে স্তন্যপায়ীর মতো। আবার একে পাখিও বলতে পারিস অনায়াসে, কারণ শরীর জুড়ে পালক। এ হলো এক যুগ-সন্ধিক্ষণের জীব। সন্ধিক্ষণ মানে একটা যাচ্ছে আরেকটা আসছে এমন দুইয়ের মাঝামাঝি। আজ আমার ভারী কষ্ট হচ্ছে রে ফাগা। হিমযুগের কথা আমি জানি। কিন্তু হিমযুগে জোনাকি থাকে কি না তা ত আমি জানি না। হিমযুগের এতো ন্যূনতম একটা ব্যাপার কোথাও জানানো হয়েছে কি না তাও আমি বলতে পারি না। হয়ত সব কিছুই পুরোপুরি মুছে গিয়ে আবার নতুন করে শুরু হবে।

    তারপর একটু চুপ করে লক্ষ্মীকান্ত বলল, ওরে ফাগা, আমরা প্রায় আট-দশ কিমি হেঁটেছি-ছুটেছি মনে হচ্ছে বটে, কিন্তু এগোনোর দিকে এগোইনি। এবং আর কেউই বোধহয় সেরকমটা পারবেও না। জীবাশ্ম দেখে এইমাত্র বুঝতে পারলাম আমরা সরাসরি পিছন দিকে এগিয়েছি। হিমযুগের দিকে যাওয়া মানেই ত তাই।

    দু-জনেরই শীতবোধ এতক্ষণ উবে গিয়েছিল। ফাগা হঠাৎ হি-হি করে কাঁপতে লাগল। লক্ষ্মীকান্তরও হাত ও পায়ের আঙুলের ডগাগুলি যেন ফুলে উঠল ও অবশ হতে শুরু করল।

    ফাগা লক্ষ্মীকান্তর কথা কিছুই বুঝতে পারল না, কিন্তু কেন যেন তার হু হু করে কান্না এসে গেল।

    সে হঠাৎ বরফের ওপর বসে পড়ে চোখের জল ফেলতে ফেলতে বলল, আইজ্ঞা, ইবার কী হবে?

    লক্ষ্মীকান্ত বলল, তাই ত রে ফাগা! পৃথিবীতে বেশ কয়েকবার হিমযুগ এসেছে বটে, কিন্তু তারপর কয়েক কোটি বছর আর সেটি দেখা দেয়নি। সেই কোটি কোটি বছর এত তাড়াতাড়ি কেটে গেল! আর আমরাই বা কেমন অচেতন মানুষ! আমাদের গাঁয়ের এত কাছে হিমযুগ এসে গেছে আর আমরাই জানতে পারিনি? একমাত্র তুই একেবারে আলাদা লোক। তোর যে এতদিনের শীতবোধ, সেটাই তো সত্যি হয়ে উঠল রে ফাগা।

    ফাগা কাঁদতে কাঁদতে আবার বলল, আইজ্ঞা আমাদের গাঁয়ের কী হবে?

    লক্ষ্মীকান্ত বলল, এতদিন আমাদের গাঁয়ের লোকেদের উচিত ছিল এদিকে আর কোনো গ্রাম-ট্রাম আছে কিনা ভেবে দেখা, এবং এসে দেখা। হিমযুগ যখন ইতিমধ্যেই এতোদূর গড়িয়ে গেছে তখন আর সে সুযোগ নেই। এখন আমাদের উচিত এবার হিমযুগের দিকেই যতটা সম্ভব এগিয়ে থাকা। উপায় যখন আর নেই-ই। কিন্তু তাও কি সবার পক্ষে সম্ভব? একমাত্র তোর ও তোর পরিবারের কিছুই অসুবিধা হবে না বলেই আমার মনে হয়। কারণ তোরা এ যুগে বসবাস করেও এ যুগের বিধি-বন্দোবস্ত বা জটিলতার সঙ্গে কখনো তেমন জড়াসনি। খাবারের জোগান যার সাহায্যে পাবি সেই রেশন কার্ড পর্যন্ত করাতে তোর গড়িমসি। এই মনোভাবের জন্যে অনেক ভুগতে হয়েছে তোদের। কিন্তু হিমযুগের ভেতর অক্লেশে মিশে যাওয়ার বেলায় এবার তার সুবিধা তোরা পাবি বইকী!

    ফাগা বলল, আর আইজ্ঞা তুমি?

    প্রশ্ন শুনেও লক্ষ্মীকান্ত নীরব থেকে গেল অনেকক্ষণ। ফাগাও চুপ। সে বসে পড়েছে বরফের ওপর। কিসের যেন একটা স্বতঃপ্রণোদিত মীমাংসা হয়ে গেল এরই মধ্যে।

    লক্ষ্মীকান্ত একসময় ফিকে হেসে বলল, আমিও অন্যদের মতো যুগের সঙ্গে কিছুটা জড়িয়েছি তো বটেই। আমি তোদের মতো সুযোগ কী করে পাবো? আমার তাতে দুঃখ বেশি নেই। এই মাত্র দুঃখ যে, আমার প্রতিদিনের লেখাপড়া ও ভিক্ষে করে বেড়িয়ে বেড়াবার অভ্যেস ও আমার করা নতুন শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, সবই হিমযুগে মিশে যাচ্ছে। তা সে আর কী করা যাবে বল! সব কী রকম ঘোলাটে সাদা হয়ে যাচ্ছে দ্যাখ! যদি চোখ থাকে আর চোখের মাঝে কালো ক্ষেত্রটিই না থাকে সেরকমই লাগছে চারিদিক। তবু, ওরে ফাগা, এই আপৎকালেও আমি তোর সৌন্দর্য স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। মৌদ্গল্যায়ন বা সারিপুত্রের মতো শান্ত লাগছে তোকে।

    লক্ষ্মীকান্ত-র দু-চোখ ভরে গেল জলে।

    ফাগার মধ্যে সে যে শুধু গভীর প্রশান্তি দেখতে পেলো তাই নয়। সে দেখলো, হিমযুগের প্রধান নন্দনতত্ত্বটিকেও। অর্থাৎ তার প্রগতিশীল উদাসীনতাকে। ...



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments