"ঠিক ধরেছেন। আমি অনেক দূর থেকে আসছি।"
"ভালো। তা, আমাদের গ্রামটা আপনার কেমন লাগছে?"
"মন্দ নয়, বেশ বর্ধিষ্ণু গ্রাম। ইচ্ছে করছে চারপাশটা একটু ঘুরেফিরে দেখেশুনে নিই।"
"দেখুন না, প্রাণ ভরে দেখুন। আর যদি কিছু খোঁজখবর, জিজ্ঞাসাবাদ করতে হয় তো এই ইনফরমেশন সেন্টারের হেড বিক্রম সামন্তের চেয়ে ভালো এ তল্লাটে আর কাউক্কে পাবেন না। তা, মশায়ের নাম?"
"প্রোজ্জ্বল।"
"বেশ অভিধান ঘেঁটে নাম দিয়েছিল তো আপনার পূর্বপুরুষ। তা, অদ্দুর থেকে যখন এসেছেন নিশ্চয়ই শুধু আমাদের গ্রাম দেখতে আসেননি, ঐ দুটো অভয়ারণ্য মানে স্যাংচুয়ারিও দেখবেন?"
প্রোজ্জ্বল একটু আমতা-আমতা করে বললেন, "হ্যাঁ, তা তো বটেই।"
"অনেকেই আসে। এখান থেকেই টিকিট পাবেন। কিন্তু আপনার গাড়িটা কোথায় ছেড়ে এলেন? গ্রাম হলেও এখানে গাড়ি চলার রাস্তা অনেক ভেতর অব্দি গেছে। এলাকা অবশ্য নিরাপদ, তবু যেখানে সেখানে দামি গাড়ি ছেড়ে আসা –"
"না, সেটি নিরাপদেই আছে।"
"ও, তবে অতিথিশালায় রেখে হেঁটে এসেছেন।"
"ঐ আর কী। তা বিক্রম বাবু, ঐ যে কী স্যাংচুয়ারির কথা বলছিলেন – একটু বুঝিয়ে দেবেন?"
সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন বিক্রম, "আপনি তো স্যাংচুয়ারির কথা শুনেই এসেছেন?"
"তা তো বটেই। তবে একটু বিশদ জানতে চাইছিলাম। স্যাংচুয়ারিতে জানি বিপন্ন প্রজাতিদের রাখা হয়। তা, দুটো স্যাংচুয়ারি কেন? মাংসাশী আর তৃণভোজী পশুদের জন্য?"
প্রোজ্জ্বলের আপাদমস্তক একবার মেপে নিয়ে বিক্রম বললেন, "আপনি বোধহয় এদেশে থাকেন না?"
লাজুক হেসে প্রোজ্জ্বল বললেন, "ঠিক ধরেছেন। বললাম না, অনেক দূর থেকে আসছি।"
"কিন্তু তামাম সভ্য দুনিয়াতেই তো আজকাল মোটামুটি এই প্রথা চালু। তা, আপনি কি –"
ইতিমধ্যে প্রোজ্জ্বল পকেট থেকে একটা মাস্ক বের করে পরে নিয়েছেন। সেদিকে তাকিয়ে অবাক বিস্ময়ে বিক্রম বললেন, "সে কি মশাই, আপনি এখনও মুখোশ বয়ে বেড়াচ্ছেন? সেই গ্রেট ভাইরাল এপিডেমিক তো কয়েক দশক আগেই বিদায় নিয়েছে।"
"তা নয়। আসলে বাতাসটা একটু ভারী লাগছিল।"
"অ, অভ্যেস নেই। ঐ চাষীরা খেতে কিছু পোড়াচ্ছে আর কী। তা, কিছুদিনেই অভ্যেস হয়ে যাবে।"
তারপর প্রোজ্জ্বলকে আবার গভীরভাবে নিরীক্ষণ করে বিক্রম বললেন, "এখন আমার কী মনে হচ্ছে, জানেন? আপনি ভিনদেশ থেকে নয়, ভিন সময় থেকে এসে পড়েছেন। এক আমেরিকান সাহেবের গপ্পো শুনেছিলাম, সে পাহাড়ে গিয়ে কীসব লতাপাতার প্রভাবে ঘুমিয়ে পড়েছিল। তারপর বিশ বছর পর যখন জেগে উঠল, তদ্দিনে দেশে এক বিপ্লব ঘটে গেছে। আপনারও অনেকটা সেই দশা, যেন কয়েক দশক আগের পৃথিবী থেকে হঠাৎ চোখ মেলে দেখছেন সব পাল্টে গেছে।"
একটু লজ্জিতভাবে প্রোজ্জ্বল বললেন, "আসলে আমি –"
"দাঁড়ান, দাঁড়ান!" বিক্রম ভুরু কুঁচকে একটু ভেবে বললেন, "আপনি কি ঐ দক্ষিণ মেরুর গবেষকদের একজন নাকি? শুনেছিলাম, ভারতের ক'জনও তাতে ছিল।"
চট করে মুখে একটা হাসি টেনে বললেন প্রোজ্জ্বল, "ঠিক ধরেছেন তো, মশাই। আপনি দেখছি বেশ ওয়াকিবহাল।"
"হ্যাঁ, এখন তো মুঠোফোনেই বিশ্বের খবর পাওয়া যায়। তবে আমার আবার খবর রাখার একটু বাড়তি ঝোঁক। আপনারা তো দীর্ঘদিন তুহিন মেরুতে বিচ্ছিন্নভাবে থাকলে মানুষের শরীর-মনের ওপর কী প্রভাব পড়ে, তার পরীক্ষা চালাচ্ছিলেন?"
যেন লুফে নিয়ে বললেন প্রোজ্জ্বল, "হ্যাঁ হ্যাঁ, ভবিষ্যতে মানুষ যদি মঙ্গল বা ওরকম কোনও শীতল ভিনগ্রহে যায় তবে তাদের শরীর-মনের কী অবস্থা হতে পারে সেটার আঁচ পাবার জন্য। তবে সেই স্বেচ্ছানির্বাসনের সময়ে তো আমরা বাইরের কোনও খবরপত্রই রাখতে পারতাম না। তাই বেরিয়ে আসার পর এই প্রথম আপনার মতো একজন নির্ভরযোগ্য মানুষের দেখা পেয়ে দুনিয়ার হালহকিকতটা সংক্ষেপে জেনে নিচ্ছিলাম, যাতে পাঁচজনের কাছে বেকুব না বনতে হয়।"
"ভালোই করেছেন। ঠিক লোকের কাছে মুখ খুলেছেন।" বিক্রম খুশি হলেন। তারপর একটু সন্দিগ্ধ ভঙ্গীতে বললেন, "কিন্তু মশাইকে দেখে তো বেশ জোয়ান জোয়ান লাগছে। অদ্দিন ওখানে থেকে বুড়ো হয়ে যাননি?"
মুচকি হেসে প্রোজ্জ্বল বললেন, "ওটাই তো মজা! শোনেননি, কিছু প্রাণী শীতঘুমে কয়েক মাস না খেয়েদেয়েও একই রকম থাকে? আসলে অমন কড়া ঠাণ্ডায় কোষের বিভাজন কমে যায়। তাই মানুষের বয়সও ধীরে ধীরে বাড়ে। নইলে জন্মতারিখ ধরলে, আমি তো ষাট ছাড়িয়ে গেছি।"
"বাঃ!" সপ্রশংস দৃষ্টিতে প্রোজ্জ্বলের পেশল শরীরের দিকে তাকিয়ে বললেন বিক্রম, "তা, কী যেন শুধোচ্ছিলেন, ঐ দুই অভয়ারণ্যের কথা? ওগুলো হচ্ছে দুই বিরল প্রজাতি, অর্থাৎ খাঁটি জন্তু আর খাঁটি মানুষের জন্য।"
"কী সর্বনাশ, তাহলে পড়ে রইল কারা? জন্তু আর মানুষ কি অখাঁটিও হয় নাকি?"
"হয় কী বলছেন, তারাই তো আজ মেজরিটি। এই আমি, (আড়চোখে প্রোজ্জ্বলের দিকে তাকিয়ে) আপনি, আরও যারা এই পথ হাঁটছে সেই পাঁচজন সবাই তো ঐ ক্যাটিগরির – অর্থাৎ কিছুটা মানুষ, কিছুটা পশু। যাদের আগেকার আমলে 'নরপশু' বলে গালমন্দ করা হত কিন্তু এখন কর্মোদ্যোগী বলে মান্যি করা হয়।"
"আর খাঁটি মানুষ কারা? তাদের অভয়ারণ্যে রাখার দরকার হল কেন?"
"সে এক লম্বা গপ্পো। শুনতে গেলে আপনার দিন কাবার হয়ে যাবে, তাই শর্টেই বলছি। আচ্ছা, আপনি তো রসগোল্লা খেয়েছেন? মশায়ের ঘাড় নাড়ার ভঙ্গী দেখেই বুঝলাম অনেকদিন খাননি, প্রায় ভুলে গেছেন। তা, এই রসগোল্লা কী দিয়ে তৈরি হয় জানেন তো? স্রেফ ছানা আর চিনি দিয়ে। এতে ক্ষীরের মিশেল চলবে না। কিন্তু শুধু ছানা আর চিনি পাক দিয়ে দেখুন, সে রসগোল্লা জমবে না। কাগজ কাগজ স্বাদ, ছাগল ছাগল গন্ধ। তাই রসগোল্লায় সুজির মিশেল দিতে হয়। তারপর ধরুন, সোনা। প্রশংসা করতে মানুষ বলে, খাঁটি সোনার মতো। কিন্তু চব্বিশ ক্যারাটের সোনা কি কোনও কাজের? কিছু করতে যান, বেঁকে যাবে। তাই সোনাতেও পান না মেশালে চলে না।"
"ঠিক বলেছেন। এমনকি, বাতাসেও এক ভাগ অক্সিজেনের সঙ্গে চার ভাগ নাইট্রোজেনের মিশেল, নইলে শ্বাসযন্ত্র নিতে পারবে না। একচিলতে ফসফরাসের 'ডোপ' না দিলে বালি শুধু বালি, সভ্যতার প্রাণভোমরা সিলিকন চিপ নয়। মদে যদি একশো পার্সেন্ট অ্যালকোহল থাকত তবে একঢোঁক খেলেই গলাবুক জ্বলত।"
"এই তো মশাই সার ধরেছেন।" বলেই বিক্রম প্রোজ্জ্বলের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বললেন, "তবে আমি কিন্তু মাল, বলতে পারেন, ছুঁই না। ঐ ধরুন বন্ধুবান্ধবদের অনুরোধে কখনও-সখনও সন্ধেবেলায় –"
"ওটুকু না থাকলে তো আপনিও ঐ খাঁটি মানুষ হয়ে যাবেন। কিন্তু খাঁটি মানুষ আর খাঁটি জন্তু এত কমে গেল যে তাদের স্যাংচুয়ারিতে রাখতে হচ্ছে?"
"এটাই তো সভ্যতার ধর্ম।" বিক্রম বিজ্ঞের মতো ঘাড় নাড়লেন, "সভ্যতা মানেই বৃদ্ধি। আর তার জন্য অসভ্যতা অর্থাৎ জঙ্গল আর পশুদের ক্রমে নিকেশ না করলে চলবে কেন?"
"তাই আপনারা, মানে আমরা জঙ্গল কাটছি, পশু মারছি।"
"ঠিক। কিন্তু ঈশ্বরের মহাজগতে তো কিছুই হারায় না, কিছুই কমে-বাড়ে না। তাই ঐ হারানো জঙ্গল আর পশু আজ সভ্যতার অন্দরেই ঢুকে পড়ছে। যত পশু মরছে, মানুষের পশুত্ব তত বাড়ছে। যত জঙ্গল কমছে, সমাজ তত জঙ্গুলে হচ্ছে।"
"দারুণ বলেছেন। কিন্তু তার মধ্যে ঐ খাঁটি মানুষ কারা?"
"খুব ডেঞ্জারাস মিউট্যান্ট। তারা বলে, সভ্যতা আজ পশুচেতনায় চালিত হচ্ছে। সেটা ত্যাগ করে সমাজকে মনুষ্যধর্মে চলতে হবে।"
"তা, মনুষ্যধর্ম বলতে তারা বোঝেটা কী?"
"ওরা সবাই হুবহু একমত না হলেও মোটামুটি বলে মানুষ এককালে যখন পশুবৎ ছিল তখন তারা বন্যপ্রাণীদের সঙ্গে আর নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করেই টিঁকে থেকেছে। কিন্তু উন্নত আধুনিক মানুষের সমাজে এটা আর অপরিহার্য নয়। এখন মানুষ ঘৃণায় নয়, ভালোবাসায় চলবে। পরস্পরের সঙ্গে লড়াই না করে মৈত্রীতে থাকবে। সভ্যতাকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদেই তাদের পরিবেশকে রাখতে হবে দূষণমুক্ত।"
"কথাগুলো তো মন্দ শোনাচ্ছে না।"
"না। কিন্তু ঐ খাঁটি সোনার মতো, কোনও কাজে আসে না।"
"কিন্তু যদ্দুর জানি বিভিন্ন যুগে অনেক মহাপুরুষও এসব কথা বলে গেছেন।"
বিক্রম একটু কান চুলকে বললেন, "হ্যাঁ। কিন্তু সে আর ক'জন? মানুষ তাদের মোকাবিলার একটা উপায়ও বের করে ফেলেছিল – এইসব মহাপুরুষদের তারা দেবতা বানিয়ে পুজো করত। ব্যস, সেই ধামাকায় তাঁরা কী বলছেন সেটা চাপা পড়ে যেত। আর একবার যদি কাউকে দেবতা বানিয়ে দাও তো ল্যাঠা চুকে গেল, তাঁকে সবাই পুজো করবে কিন্তু কেউ অনুকরণের চেষ্টা করবে না। মানুষ কি কখনও দেবতা হতে পারে? তাই ঐসব ভালো ভালো কথা তাঁদের সঙ্গেই কালের গর্ভে হারিয়ে যেত। আর ঐসব মহাপুরুষদের অনেকেই ঐ বাণী-টানি প্রচারের নেশায় মেতে সংসারধর্ম পালনের তেমন সময় পেতেন না। ফলে তাদের বালবাচ্চা কম হত, তাই সেই ভালোমানুষির মিউট্যান্ট জিনও বিশেষ ছড়াতে পারত না।"
"যথার্থ ব্যাখ্যা করেছেন! এক্কেবারে ইতিহাসের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। কিন্তু ইদানীং অবস্থা পাল্টাল কেন?"
"পাল্টাল এইজন্যে যে ভালোমানুষি রোগটা কীভাবে যেন কিছু সাধারণ মানুষ আর বালবাচ্চাদের মধ্যেও ছড়াতে আরম্ভ করল। উপরন্তু তারা দল পাকিয়ে 'চলবে না, চলবে না' শুরু করল।
"যেমন? কী ইস্যুতে?"
"এই ধরুন যুদ্ধে কেউ জেতে না, সবাই হারে, তাই প্রতিবেশীর সঙ্গে যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে, এইসব উটকো দাবি তুলে।"
"যুদ্ধে তো সত্যিই অনেক মানুষ হতাহত হয়, অনেক কিছু ধ্বংস হয়।"
"আপনি একটা দিকই দেখলেন। কিন্তু যুদ্ধ যদি বন্ধ হয়ে যায়, পৃথিবী জুড়ে সব অস্ত্র তৈরির কারখানা উঠে গিয়ে কত লোক বেকার হবে, ভাবুন তো? আবার যুদ্ধে ধ্বংস হওয়া রাস্তাঘাট, ব্রিজ, বাড়িঘর পুনর্নিমানের জন্যও তো কত কর্মসংস্থান হয়। তাছাড়া যুগে যুগে মানুষ যখন খুব বেড়ে যায়, এই যুদ্ধই তাদের সংখ্যা সীমার মধ্যে নিয়ে আসে।"
"এসব তো আগে ভাবিনি। তা, ঐ খাঁটি মানুষেরা আর কী বলে?"
"বলে জঙ্গল কেটে, পাহাড় ভেঙে উন্নয়ন চলবে না। বাতাসে দূষিত ধোঁয়া ছেড়ে, নদীতে রাসায়নিক মিশিয়ে কারখানা চালানো চলবে না।"
"এটাও তো মন্দ শোনাচ্ছে না। সত্যিই, বাতাস, জল দূষিত হলে মানুষ বাঁচবে কী করে?"
"হাসালেন, মশাই। তাহলে আমরা কী করে বেঁচে আছি? মানুষ প্রাণীটার জান খুব কড়া। সবকিছুই তারা মানিয়ে নেয়। হ্যাঁ, কিছু ঠিকই মরবে। তবে বাকিরা তো থাকবে? এটাকেই তো বলে 'সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট'। কিন্তু জঙ্গল, পাহাড় ভাঙা থামালে, কারখানা বন্ধ হলে উন্নয়নটা হবে কোন পথে? তাহলে তো মানুষ প্রজাতি এমনিই অভাবে শুকিয়ে শেষ হয়ে যাবে।"
"কিন্তু বিজ্ঞানীরা যে বলেন বায়ুদূষণ বন্ধ না হলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে বিপর্যয় হবে?"
বিক্রম চোখ মটকে বললেন, "বিজ্ঞানীরা মানুষকে ভয় দেখাবার জন্য ওসব একটু বাড়িয়েই বলে। ওহ্, আপনিও তো একজন – না, আপনাদের কথা বলছি না। আমি বলছি সেইসব তথাকথিত পরিবেশ বিজ্ঞানীদের কথা যারা কার্বন দূষণ, বিশ্ব উষ্ণায়ন এইসব নিয়ে লম্বাচওড়া জ্ঞান ঝাড়ে, যার বেশির ভাগই মেলে না।"
"কিছুটা কি মেলে?"
"ইয়ে, অনেক বললে তার কিছু তো মিলবেই। ঝড়বৃষ্টি, জলোচ্ছ্বাস এসব কি আগেও হত না, নাকি তাতে লোক মরত না? আর চিকিৎসাবিদ্যা যেমন উন্নত হচ্ছে তাতে এভাবে লোক না মরলে পৃথিবীটাতে তো একদিন মানুষের দাঁড়াবার জায়গাও থাকবে না।"
"পরিষ্কার বুঝেছি। এবার বলুন তো, ঐ খাঁটি মানুষদের স্যাংচুয়ারিতে রাখার প্ল্যানটা এল কীভাবে?"
"তা কি আর একদিনে এসেছে? তাদের ছাড়া রাখলে নানা বিপদ হচ্ছিল। তারা উন্নয়নের আর যুদ্ধের প্রচেষ্টায় বাধা দিচ্ছিল, ফলে পাবলিক খচে গিয়ে তাদের ক্যালাতে যাচ্ছিল। এই অবস্থায় তাদের নিরাপদে রাখতে আমরা প্রথমে তাদের রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে আটক করতে শুরু করলাম।"
"রাষ্ট্রদ্রোহ? তারা বুঝি বোমা-বন্দুক ধরছিল?"
"আরে না না, অত জোশ থাকলে তো! কিন্তু তারা অন্যদেরও নির্বীর্য, হীনবল করে দেওয়ার চেষ্টা করছিল। দেশ তাহলে কাদের নিয়ে এগিয়ে যাবে আর রাষ্ট্রই বা কাদের নিয়ে অভাবের বিরুদ্ধে আর প্রতিবেশী রাষ্ট্র্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে?"
"বুঝলাম, তাই রাষ্ট্রদ্রোহের জন্য জেল।"
"ছি ছি, জেল তো কবে উঠে গেছে! এখন সংশোধনাগার, যেখানে চেষ্টা করা হয় অন্তরীণদের ভুলত্রুটি শুধরে খাঁটি করার।"
"মানে, অখাঁটি করার?"
"হ্যাঁ হ্যাঁ, মানে তাদের মধ্যে ঐ কিছু পার্সেন্ট পশুবৃত্তি ঢুকিয়ে দেওয়ার।"
"কীভাবে?"
"ধরুন দু'ঘা দিয়ে, যাতে তাদের মধ্যে প্রচণ্ড রাগ, খুন করার প্রবৃত্তি জেগে ওঠে।"
"তাতে কাজ হত?"
"কয়েকজনের ক্ষেত্রে হত, কিন্তু অনেকের ক্ষেত্রে এতেও কাজ হত না। যেমন ধরুন একজন উদোম ক্যালানি খাওয়ার পর প্রহরীকে বলেছিল, আপনার জন্য কষ্ট হয়। বড্ড পরিশ্রম হল, একটু জিরিয়ে জলটল খেয়ে নিন। তার ফলে বরং কিছু প্রহরীই পাল্টি খেয়ে যাচ্ছিল।"
"চিন্তার কথা। ভালোমানুষি রোগটা দেখছি ছোঁয়াচে হয়ে উঠছিল। অর্থাৎ বিপন্ন প্রজাতি সংখ্যায় বাড়তে বাড়তে –"
"বরং আমাদেরই বিপন্ন করে তুলতে চলেছিল। সেইজন্যেই তো চটজলদি স্যাংচুয়ারির ব্যবস্থা। যান, নিজের চোখেই দেখতে পাবেন।"
"তবু যদি আগে থাকতে ওখানকার ব্যাপারস্যাপারগুলো সংক্ষেপে একটু বলতেন।"
"জায়গাটা ঘেরা। তবে সেই বর্বর যুগের মতো কাঁটাতার বা বিদ্যুৎতারের ব্যবস্থা নয়, ইলেকট্রনিক ঘের – যা পেরোতে গেলেই অদৃশ্য শক্তির দাপটে মানুষ ছিটকে পড়ে যাবে। পশুদের অভয়ারণ্যে আমরা ভিজিটরদের সাঁজোয়া গাড়িতে ভেতরে নিয়ে যাই, খাবারও ভেতরেই রেখে আসি। কিন্তু মানুষের অভয়ারণ্যে আপনি তাদের দূরে টাওয়ারে উঠে অথবা একটু বাড়তি খরচ করলে হেলিকপ্টার থেকে দেখতে পারবেন। আর তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও ঐ হেলিড্রপ করা হয়। অবশ্য এই প্রকৃতিপ্রেমী ভালোমানুষেরা নাকি আদিম পদ্ধতিতে প্রকৃতির থেকেই তাদের প্রয়োজনের অনেকটা জোগাড় করে নেয়।"
"আর টেলি-যোগাযোগ?"
বিক্রম একটু দ্বিধা করে বললেন, "ইয়ে, বাইরের সঙ্গে তাদের টেলি-যোগাযোগের তেমন ব্যবস্থা নেই, শুধু একটা ইমার্জেন্সি চ্যানেল ছাড়া। কিন্তু ওদের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য আমরা ইনট্রানেট করে দিয়েছি। তাতেই ওরা খুব খুশি। নিজেদের ইকো-চেম্বারে আমাদের বাপান্ত করে খুব তৃপ্তিতেই আছে।"
"কী মশাই, আরও কিছু জানতে চান?"
"না, ব্যাপারটা মোটামুটি বুঝে গেছি।"
"তাহলে আর কী, টিকিট কেটে গিয়ে দেখে আসুন।"
"হ্যাঁ, এই যাচ্ছি।"
বিক্রম দেখলেন, প্রোজ্জ্বলের মুখে ফুটে উঠেছে এক বিচিত্র হাসি। তারপর তিনি ব্যাগের থেকে একটা অদ্ভুত গোলাকৃতির মুঠোফোন গোছের যন্ত্র বের করে বোতাম টিপে বিল্ডিংয়ের বাইরের বিরাট গাছটার পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলতে শুরু করলেন।
"স্যাম্পল ফিল্ড সার্ভে শেষ। রেজাল্ট আমাদের স্যাটেলাইট সার্ভের সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে। অর্থাৎ কেস হোপলেস, গ্রেড বড়জোর সি মাইনাস। সিস্টেম রিপেয়ারের বাইরে, রি-ফর্মাট করে রি-ইনস্টল করতে হবে। আপাতত ফিরছি।"
হঠাৎ গাছটার পেছন থেকে এক উজ্জ্বল জ্যোতি উল্কাবেগে আকাশে মিলিয়ে গেল। অবাক বিক্রম সেদিকে গিয়ে দেখলেন, প্রোজ্জ্বল নেই।