এখন মে মাসের মাঝামাঝি। রাজুর স্কুলের গরমের ছুটিটা এই সবে পড়েছে। এর মধ্যেই ওই খারাপ খবরটা নিয়ে ভাগলপুর থেকে চিঠিটা এল রাজুদের বাড়িতে। রাজুর মা মন্দিরাই খামটা খুললেন প্রথম। তিনি চিঠি পড়ে জানতে পারলেন, ওঁর নব্বই বছর ছুঁই-ছুঁই মাসিশাশুড়ি, চাঁপাবতীদেবী গত সপ্তাহে হঠাৎই ইহলোক ত্যাগ করেছেন। আগামী পরশু ওঁর শ্রাদ্ধশান্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে ভাগলপুরের বাড়িতে, যেখানে চাঁপাবতীদেবী তাঁর শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। ওঁর পারলৌকিক কাজে অংশগ্রহণের জন্য গায়েন পরিবারকে আমন্ত্রণ জানিয়ে এই চিঠি লিখেছেন চাঁপাবতীর ছেলেরা।
চিঠি পড়েই মন্দিরার কপালে বেশ কটি ভাঁজ পড়লো। এরকম একটা পারিবারিক দুঃসংবাদ--শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে যাওয়াটা এ বাড়ির সকলেরই একান্ত কর্তব্য। লোকলৌকিকতা বলেও তো একটা ব্যাপার আছে, না কি! কিন্তু বাড়িসুদ্ধু সকলে মিলে অত দূরে, এত তাড়াতাড়ি যাওয়ার অনেক অসুবিধা--যাবার টিকিট জোগাড় করা, নিতাইবাবু মানে রাজুর বাবার অফিস ম্যানেজ করা, সর্বোপরি গোটা বাড়ি ফাঁকা রেখে চলে যাওয়া-- আজকালকার দিনে--নাহ, ভাবাই যায় না।
সেদিন অফিসফেরত নিতাইবাবু ঘরে ফিরলে, মন্দিরা চিঠিটা কর্তার হাতে তুলে দিলেন। চিঠি পড়ে স্বভাবতঃই নিতাইবাবু খুবই কাতর হলেন--ছোটবেলার অনেক মধুর স্মৃতি মনের পাতায় ভিড় করে এল। দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে তিনি স্বীকার করলেন যে, এমত অবস্থায়, কর্তব্যকর্ম হিসাবে তাঁরই যাওয়াটা উচিত, কিন্তু অফিসের অত্যন্ত জরুরি কাজের দায়িত্ব তাঁর উপর বর্তানোয়, এ সময় ভাগলপুরে যাওয়ার কোনো উপায়ই নেই তাঁর।
মন্দিরা অবশ্য এরকমটাই আশা করছিলেন কর্তার কাছ থেকে। অফিস অফিস করে যে লোকটা তাঁর নাওয়াখাওয়াটাও ঠিকমতো করার সময় পায় না, সে যায় কি করে অদ্দূর? ঘরের সমস্ত কাজ, মায় বাজারহাটও মন্দিরাকেই প্র্রায়ই সামাল দিতে হয়। নিতাইবাবু যেন অতিথি--কোথায় কী আছে, কিছুই ঠাহর করতে পারেন না তিনি; হাতের কাছটিতে সব সাজিয়েগুছিয়ে দিলেই যেন উনি বাঁচেন।
আর রাজু--তোমাদের তো মনে পড়েই গেছে এতক্ষণে যে, কীরকম দস্যি ছেলে সে--এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে, দ্যাখ না দ্যাখ কিছু একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলছ, ঘরে বাইরে কোথায় নয়? মন্দিরা থেকে থেকেই রেগে কাঁই হয়ে যান--লেখাপড়া নেই-রাতদিন যত্তসব আগডুম বাগডুম –-না আছে তার কোনো মাথা না মুণ্ডু। গুচ্ছের জিনিস নষ্ট আর ঘরনোংরা। নিতাইবাবুর কাছে সময় সময় এই নিয়ে গজগজ করেন মন্দিরা। বেশিরভাগ সময়ই শান্তিপ্রিয় এবং স্বভাবভীতু নিতাইবাবু হুঁ-হাঁ করে দায়িত্ব সেরে দেন। কখনো বা বলেন--ওহ, এক্সপেরিমেন্ট করে, সে তো বেশ ভালোই--বুদ্ধি খুলবে ওতে, আর ও তো এখনো অনেক ছোট আছে, একটু-আধটু তো উল্টোপাল্টা করবেই, বড়ো হলে ওসব আপসে ঠিক হয়ে যাবে। মন্দিরা তাতে শান্ত হওয়ার পাত্রী নয় অবশ্য, নিতাইবাবুর মুখের কথা খসতে না খসতেই সে ঝংকার দিয়ে বলে উঠবে সে--হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুমি তো বলেই খালাস, ঘরে আর থাকো কতক্ষণ? এসব উৎপাত সামলাতে হয় তো আমাকেই। বাপ হয়েছো, ওকে নিয়ে মাঝেমধ্যে বসতেও তো পারো, পড়াশুনাটা কী করছে দেখো একবার অন্তত! সব দায় বুঝি আমার? বাপ্-ছেলে মিলে আমার হাড়মাস একেবারে ভাজা ভাজা করে ফেললে গো! যাবো চলে একদিন যেদিকে দু চোখ যায়। ঠ্যালা বুঝবে তখন তোমরা বাপব্যাটা!
বাধ্য হয়েই পরদিন তড়িঘড়ি করে, বেজার মুখে পড়াশুনার খোঁজখবর নিতে, বুড়িছোঁয়ার মতোই, ছেলের ঘরে ঢোকেন নিতাইবাবু; কিঞ্চিৎ উৎসাহও দেখান-- তা বাবাকে পেয়ে রাজুও মনের সুখে তার নতুন এক্সপেরিমেন্টের গল্পই সর্বপ্রথমে শোনায়, পড়াশুনার ব্যাপারটা আর বিশেষ এগোয় না। তা সেসব চাঞ্চল্যকর ক্রিয়াকলাপের কাহিনী শুনতে শুনতে, রাজুকে উৎসাহ দেবার জন্য নিতাইবাবু ঘন ঘন মাথা নাড়ান বটে, কিন্তু মনে মনে তিনি এটাও ভাবেন, নাহ, এই সব পরীক্ষানিরীক্ষা করতে গিয়ে ছেলেটা না আবার কোনো বিপদ ডেকে আনে!
তা এহেন উদ্ভুট্টি সংসারের হাল শক্ত করে ধরে আছেন মন্দিরাই। এবারও তার ব্যতিক্রম কিছু হলো না। অনেক চিন্তাভাবনা করে গায়েন দম্পতি ঠিক করলেন যে, মন্দিরা একাই ভাগলপুর থেকে দিন সাতেকের জন্য ঘুরে আসবেন। তাঁর অবর্তমানে রান্নার মাসিই ঘরকন্নার কাজে ঠেকা দেবে। সে এই বাড়িতে খাওয়াপরার কড়ারে রাত-দিনের জন্য বহাল আছে--তা অনেক দিনই হয়ে গেছে। যদিও মেয়ের বাড়ি যাবো বলে মাঝে মাঝেই সে বায়না ধরে।
যাই হোক, এই পরিকল্পনা অনুযায়ী রান্নার মাসিকে সংসারের খুঁটিনাটি, বিশেষত রান্নাখাবারের সব বিধিব্যবস্থা পইপই করে বুঝিয়ে দিয়ে তবে মন্দিরা রওয়ানা হলেন ভাগলপুরের ট্রেন ধরতে।
দু'দিন কেটেছে। মন্দিরা এ-বাড়ি থেকে গিয়েছেন--কড়া গৃহকর্ত্রীর ডাক-শাসন কিছু নেই। সুতরাং রাজু, রাজুর বাবা- দুজনেই মহা আনন্দে আছে। অপার স্বাধীনতা। যখন খুশি, যা খুশি খাচ্ছে, ফেলছে, ছড়াচ্ছে--রান্নার মাসির কথা তারা বিশেষ কানে তোলে না। তাদের ভাবগতিক দেখে রান্নার মাসিও ভাবে--আমিও একটু সুযোগ নিই না কেন এইবেলা? এরা তো দিব্বি আছে বাপু! বৌদিমনির সবেতেই বেশি বেশি চিন্তা।
আজ রাতের খাওয়াদাওয়া সাঙ্গ হতেই সে গুটিগুটি উপস্থিত হয়, নিপাট ভালো মানুষ, দয়ার শরীর, দাদাবাবু, মানে রাজুর বাবার কাছে। কাঁচুমাঁচু মুখে বলে--দাদাবাবু, আমার এক বছরের নাতনীটা বেজায় জ্বরে ভুগছে গো, আমার মেয়ে লোকমুখে খবর পাঠিয়েছে, ওই রোগাভোগা মেয়ে আমার, পারে কি একা একা এত বড় ঝঞ্ঝাট সামাল দিতে? আমি গেলে...বুঝলেন না ... ওর একটু হিল্লে হয়। তা আমি এই কাল কাকভোরে যাব, আর বেলাবেলিতেই ফেরত আসব। কাল তো রোববার, আপনার গায়ে আঁচড়টিও লাগবে না গো - যদি একটু অনুমতি করেন এখন...।
তা এ আর বেশি কি? দয়ার অবতার দাদাবাবু, থুড়ি আমাদের নিতাইবাবু সঙ্গে সঙ্গেই ঘাড় এক হাত হেলিয়ে, হ্যাঁ, জানিয়ে দিলেন। হাসি হাসি মুখে রান্নার মাসিও গেল তার টিনের তোরঙ্গখানি গুছাতে।
সেই যে সে গেছে আজ দু'দিন হল, তার আর কোনো পাত্তাই নেই। অগত্যা নিতাইবাবুকেই রাজুর দেখভাল আর ওদের বাপ-ছেলের দক্ষিণহস্তের ব্যাপারটির সামাল দিতে হচ্ছে--অবশ্য তাতে ওদের কারুরই কোনো আপত্তি নেই। রাজু সারাদিন থাকছে প্রতিবেশী নীনাদের বাড়ি। রাজুর তো তাতে আরও মজা। নীনার সঙ্গে ওর এমনিতেই দারুণ ভাব। নিতাইবাবুও খারাপ নেই, অফিস থেকে ফেরার সময় রাজুকে নীনাদের বাড়ি থেকে তুলছেন, বাড়ি ফিরেই সোজা ফোন তুলে পাড়ার মোড়ের ফাস্টফুডের দোকান থেকে বাপ-ছেলের পছন্দসই খাবারের অর্ডার করে দিচ্ছেন। কাগজের থালাবাটিতে খানদান, খাওয়া শেষে ওসব ট্র্যাশ-ক্যানে জমা করেন।
আজ কিন্তু বেজায় খিদে পেয়েছে নিতাই বাবুর। সারা দিনে কাজের চাপে কিছুই বিশেষ খাওয়া হয়নি। রাজুকে তুলে যখন ঘরে ঢুকলেন, তখন আর দাঁড়াতে পারছেন না। রান্নাঘরে ঢুকে গাবদা রেফ্রিজারেটরটা খুলে তিনি ঘাঁটতে লাগলেন। ডিপ ফ্রীজে হাজার জিনিস সব প্যাকেট করে করে রাখা, ওসব এখন গরমটরম করতে অনেক সময় চলে যাবে, ওঁর আর তর সইছে না।
ওই একদম নিচের শেলফের কোনার দিকে এটা কী? বেশ সুন্দর মতো দেখতে তো জিনিসটা--কাস্টার্ড না কি? নিশ্চয়ই মন্দিরা ভাগলপুর যাবার আগের রাতে বানিয়েছিল, রাজুর জ্বালায় কিছু থাকার তো জো নেই, তাই বোধ হয় লুকিয়ে ওই ঘুপচিতে রেখে দিয়েছে। হুঁ, হুঁ, বাবা, আমি হলাম গিয়ে রাজুর বাপ, ছেলের চেয়ে আমিও কম যাই না! লুকিয়ে রাখবে? খুঁজেপেতে ঠিক বের করে ফেলেছি!
আঙ্গুল ডুবিয়ে এই এত্তোটুকু নিয়ে চেখে দেখলেন, নাহ মিষ্টির পরিমাণটা যথারীতি এবারও কোনোই আন্দাজ করতে পারেনি মন্দিরা। পুরো না-মিষ্টি কাস্টার্ড একটা বানিয়ে রেখেছে--ফোঁস করে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন নিতাইবাবু। নাকের কাছে বাটিসমেত বস্তুটা নিয়ে এসে শুঁকবার চেষ্টা করলেন--যদি বাজে কোনো গন্ধ মালুম হয়। মানে ওই টকটক, ঝাঁঝালো, পিলে-চমকানো, যেমন হয় আর কি খাবার পচে গলে। নাহ, সেরকম কিছুর হদিশ পেলেন না তিনি। যাক বাবা, তাহলে ঠিকঠাকই আছে। রংটাও মোটেই খারাপ লাগছে না, বেশ হালকা সবজে-কমলাটে মতো, মন্দিরা তো আবার শখ করে কেক, প্যাস্ট্রি, পুডিং--এসবেতে খাবারের রং এটা-ওটা দেয়। ওই ছেলের মতোই এক্সপেরিমেন্ট করে আর কি! সেরকমই কিছু হবে হয়তো এটা। যাক, এটাকেই আগে মেরে তো দেই, তারপর পেটটা একটু শান্ত হলে, ধীরেসুস্থে খাবারটা অর্ডার করা যাবে না হয় তখন।
নিতাইবাবু প্ল্যান করে নিলেন।
এবার একটা চামচ পেলেই হয়। চা-চামচগুলো কোথায় আছে কে জানে! নিতাইবাবু দেখলেন, রান্নার ওভেনের উপর হাতার মতো একটা বোম্বেটে চামচ শায়িত রয়েছে। তা সেটা দিয়ে এক সারভিং-এ পুরো কাস্টার্ডটাই চেঁছেপুঁছে বাটি থেকে তুলে নিলেন তিনি আর মুহূর্তের মধ্যে ইয়া হাঁ করে মুখের মধ্যে পুরোটাই একবারে চালান করে দিলেন। তারপর কোঁৎ করে একটা আওয়াজ করে চটপট কাস্টার্ডটা গিলে ফেললেন। জিভ ছেড়ে গলা দিয়ে ওটা যখন নাবছে, তখন ওঁর খেয়াল হলো: আচ্ছা, এরকম অদ্ভুত খেতে লাগল কেন কাস্টার্ডটা? যদিও খিদের মুখে একটু বেশি তাড়াতাড়িই উনি ওটা গলাধঃকরণ করেছেন, তবু কাস্টার্ডের স্বাদ আগে তো কখনো এরকম লাগেনি, - না-মিষ্টি, না-দুধেল, কেমন যেন--পানসে-তুলো তুলো,... না, না, কেমন যেন...ভেজা, নরম, সোঁদা, মেটে, মেটে- , না কি শ্যাওলা, শ্যাওলা— না কি, ছাতা পড়া-- নাহ, কোনো চেনা তুলনাই ঠিক খাপে খাপ মিলছে না--কিরম যেন একটা পাঁচমিশেলি স্বাদ।
কিন্তু এখন তো আর কিচ্ছুটি করার নেই, অদ্ভুত সেই কাস্টার্ড নাগালের এক্কেবারে বাইরে, সোজা যাত্রা করেছে পাকস্থলীর দিকে, হু-হু বেগে।
কেমন যেন চিন্তা চিন্তা হচ্ছে নিতাইবাবুর। পায়ে পায়ে ছেলের পড়ার ঘরে এলেন তিনি। দেখলেন মেঝেতে দুই ঠ্যাং সটান ছড়িয়ে বসে আছে রাজু বাবাজি, সামনে তার ডাঁই করা হরেক সরঞ্জাম--গঁদের আঠা, সেলোটেপ, খড়িমাটি, রং পেন্সিল--কী নেই? তার ডান হাতে ধরা একটা কাঁচি। সেটা জম্পেশ করে বাগিয়ে ধরে বাম হাতে ঝুলন্ত পিচবোর্ডটাকে খেলিয়ে খেলিয়ে কীসব কাটাকুটি করছে সে। নির্ঘাত নতুন কোনো এক্সপেরিমেন্ট-–ভাবলেন নিতাইবাবু।
অ্যাই, ওই কাস্টার্ডটা এত অদ্ভুত লাগল কেন রে, জানিস কিছু তুই? গলা খাঁকারি দিয়ে প্রশ্নটা রাজুর দিকে ছুঁড়ে দেন নিতাইবাবু।
কাস্টার্ড? কোন কাস্টার্ড? পিচবোর্ডের কাটাকুটি না থামিয়েই পাল্টা প্রশ্ন মহাব্যস্ত রাজুর।
আরে, ওই যে আমাদের ফ্রিজে রাখা ছিল--একটু অপ্রস্তুত স্বরে বলেন নিতাইবাবু।
ওটা কোনো কাস্টার্ড নয়, আমার বায়োলজি এক্সপেরিমেন্ট--কাটা পিচবোর্ডের অংশগুলোকে মেঝেতে দ্রুত হাতে সাজিয়ে নিতে নিতে, চোখ না তুলেই বলে রাজু।
বায়োলজি এক্সপেরিমেন্ট? দারুণ একটা চমক খেলেন নিতাইবাবু। ওটা খেতে কেমন তুলো তুলো না, না, হড়হড়ে মতো লাগল, কতদিন ধরে ওটা ওখানে রাখা আছে? নিতাইবাবুর এবার বেশ ভয় করছে।
রাজু এখন ঘাড় হেঁট করে, ছোট ছোট করে কাটা সেলোটেপের টুকরোগুলোকে প্রতিটা আঙুলের মাথায় মাথায় পরম অভিনিবেশে, একটা একটা করে সাঁটিয়ে রাখছে। হাতের কাজ করতে করতেই নির্বিকারভাবে সে বলে, ওতো সেই জানুয়ারি মাস থেকেই আছে ওখানে।
সেকি! এটা তো মে মাস--কঁকিয়ে উঠলেন নিতাইবাবু।
বাবার এই বিলাপে রাজুর অবশ্য কোনো হেলদোলই হলো না। সে মাথা নিচু করে, একমনে সেলোটেপের টুকরোগুলো নিয়ে কায়দা-কসরত করছে। দশ আঙুলেই তো চিপকে আছে দশটা টুকরো। হতচ্ছাড়ারা সব একটা আরেকটার গায়ে জড়িয়েমড়িয়ে একাকার। কীভাবে ছাড়ানো যায় ওগুলোকে?
হার্মাদ ছেলে, তুই ওই জঞ্জাল ফেলে দিসনি কেন?
বা, রে, ফেলবো কেন? মিস গুহ বলে দিয়েছেন, যত্ন করে রেখে দিতে, এক্সপেরিমেন্ট-এর ডেটা চাই না বুঝি?
সেলোটেপের টুকরোগুলোকে বাগে আনা কি অত সহজ? রাজুকে এবার একটু হতাশ দেখায়--ধুস, এই এক্সপেরিমেন্টটা জমছেই না।
ওরে বাবারে, আমি মলুম গো--নিতাইবাবু এদিকে চেঁচাতে থাকেন।
এইবার মাথা তুলে বাবার দিকে গভীর মনোযোগ সহকারে তাকায় রাজু।
এখন তোমার কেমন লাগছে বাবা? রাজুর চোখেমুখে উৎসাহ ছুটে পড়ছে। সে পিচবোর্ডের টুকরো সেলোটেপ--সব ছেড়েছুড়ে বাবার কাছাকাছি এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে।
আমার পেটে ব্যথা করছে। কাতর গলায় বলেন নিতাইবাবু।
রাজু আসতে আসতে আরও কাছে এগিয়ে আসে, বাবার পেটের এধার-ওধার হাত দিয়ে টেপাটেপি করে-এখানে ব্যথা লাগছে? ওখানে?
ন... ন... না... প্রায় কোঁকাতে কোঁকাতেই বলেন নিতাইবাবু।
বাবার পেট ছেড়ে এবার শরীরের উপর দিকে এগোচ্ছে রাজু। সে নিতাইবাবুর কপালে চাপ দেয়।
অমনি নিতাইবাবু ওরে, বাবারে, গেলুম রে, বলে জব্বর একটা চিৎকার করে ওঠেন।
অবাক কাণ্ড! রাজু ভুরু কোঁচকায়।
আমার মাথাটা ঝিমঝিম করছে, আমাকে কি হাসপাতালে যেতে হবে তাহলে কাঁপাকাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করেন নিতাইবাবু।
হতেও পারে--বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলে রাজু।
আচ্ছা, তোমার আর কী কী হচ্ছে? বাবার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে প্রশ্ন করে রাজু। -- একটু ভেবে ভেবে বলোতো!
প্রায় কাঁদোকাঁদো ভাবে নিতাইবাবু বলেন, আমার মুখের ভিতরটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। ন... ন... না এই আবার ভেজা ভেজা হয়ে গেল, এই আবার খটখটে শুকনো হয়ে যাচ্ছে। ত্তহ! মাগো! রাজু রে, ভালো করে দেখ তো একবার – আমার চেহারাটা কি নীলচে পারা লাগছে? প্রায় ডাক ছেড়ে কাঁদার উপক্রম করেন নিতাইবাবু।
এধার-ওধার থেকে ঘুরে ঘুরে বাবাকে দেখে রাজু, তারপর উত্তেজনায় চিৎকার করে বলে, হ্যাঁ, হ্যাঁ, তোমাকে সেরকমটাই তো লাগছে বটে!
দারুণ তো! বলে সে শূন্যে এক লাফ দেয়, তারপর দুই পাক নেচে নেয়।
তাই দেখে ছলোছলো চোখে বলেন নিতাইবাবু, আমি মনে হয় মরেই যাবো, যাই গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ি। কণ্ঠে তাঁর তীব্র অভিমান।
বাবার পথ আগলে দাঁড়ায় রাজু--ও বাবা, দাঁড়াও একটু--আমি একছুটে আমার নোটবইটা নিয়ে আসি, এই সব কিছু ঠিক করে লিখে রাখতে হবে।
কেন রে? ডাক্তারবাবুকে দেখাবার জন্য লিখে রাখবি বুঝি? আশার আলোয় নিতাইবাবুর মুখ উদ্ভাসিত।
ধ্যাৎ, তা কেন হবে? জোরগলায় বলে রাজু। এ তো সব মিস গুহর জন্য--তুমিই তো এখন আমার নতুন বায়োলজি এক্সপেরিমেন্ট--হেসে হেসে বলে রাজু।