আচিবি ১৯৩০ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক নাইজিরিয়াতে জন্মগ্রহণ করেন। নাইজিরিয়াতে বহু উপজাতির বাস, তাদের মধ্যে সবচাইতে বেশি সংখ্যক হল ইবোরা। পূর্ব নাইজিরিয়াতে আচিবির জন্মস্থান ওগিডি ছিল বেশ বড় একটি ইবো গ্রাম, এবং আফ্রিকায় প্রথম দিকের প্রতিষ্ঠিত অ্যাংলিকান চার্চগুলোর একটি এই গ্রামে ছিল। সেখানকার মিশনারি স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষার শেষে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ইবাদানের ইউনিভার্সিটি কলেজ থেকে স্নাতক হন। তাঁর শৈশব ছিল জন্মসূত্রে প্রাপ্ত ইবো (Igbo/Ibo) ঐতিহ্যের সঙ্গে ঔপনিবেশিক মিশনারিদের দ্বারা প্রচারিত খ্রিস্টধর্মের দ্বারা প্রভাবিত --- যে ধরনের মিশ্র সংস্কৃতিবাহী কিছু চরিত্র তাঁর উপন্যাসে দেখা যায়।
যদিও ইবোদের লিখিত ভাষা ছিল না, তাদের গল্প বলার একটা পরম্পরাগত সংস্কৃতি ছিল। পরিপার্শ্ব থেকে পাওয়া বহুযুগের সঞ্চিত অভিজ্ঞতা থেকে উঠে আসা সেসব গল্প, এবং তার সঙ্গে দৈনন্দিন কথা বা আলাপে জড়িয়ে থাকত অর্থবহ প্রবাদবাক্য। ‘থিংস ফল্স অ্যাপার্ট’-এ আচিবি বলেছেন, ‘ইবোদের মধ্যে কথাবলার শিল্পকে খুবই গুরুত্ব দেওয়া হয়, এবং কথা গলাধঃকরণ করবার জন্য প্রবাদবাক্যগুলো পাম তেলের কাজ করে।’
বেশিরভাগ মায়েরা রান্নাঘরে কাজ করতে করতে তাদের ছেলেমেয়েদের শোনাতেন সেইসব গল্প, এবং বারবার কথনের ফলে শিশুদের মনন জুড়ে তার প্রভাব বিস্তার করত। ইবোসমাজের পুরুষের বিশ্বাস ছিল পৌরুষে---যার মুখ্য প্রতীক দৈহিক বল যাতে প্রতিপক্ষকে হারানো যায়--- সেটা হোক কুস্তি বা সত্যিকারের অস্ত্র দিয়ে লড়াই; ইয়াম, যা পুরুষের ফসল বলে কথিত ছিল, জঙ্গল কেটে বড় বড় ক্ষেত্র প্রস্তুত করে তার চাষ; দোর্দণ্ডপ্রতাপে পরিবার শাসন, যথেষ্ট সম্পদের অধিকারী হবার লক্ষ্য, কারণ যথেষ্ট সম্পদের অধিকারী হলে কনেপক্ষের দাবিমত পণ দিয়ে স্ত্রী অর্জন করা যেত, এবং সম্পন্ন পুরুষের একাধিক স্ত্রী থাকা খুবই সাধারণ ব্যাপার ছিল। এই সবকিছু থাকলে পুরুষ শ্রেষ্ঠত্বের সূচক কিছু উপাধি নিতে পারত এবং সেই উপাধির অভিজ্ঞান ছিল পায়ে বিশেষ রকমের মল পরা। তাই পুরুষের গল্প মেয়েদের গল্প থেকে ভিন্ন ছিল, সেগুলো ছিল যুদ্ধজয়ের গল্প, এবং তাদের কথাবার্তায় থাকত দৈহিক দুর্বল এবং নরম মানসিকতার ব্যক্তির প্রতি তাচ্ছিল্য।
ইবো সমাজের সংস্কৃতির একটা বড় বৈশিষ্ট্য ছিল মুখোসপরা নাট্যপরম্পরা --- বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানের অঙ্গ হিসেবে গোপনীয় কিছু কৃত্য সম্পন্ন করার পর পূর্বপুরুষের আত্মার প্রতীক মুখোশ পরে কিছু বিশেষ মানুষ (অবশ্যই পুরুষ) অভিনয় করত, যা তাদের বিশ্বাসমত ছিল আত্মার ভর করা। তা ছাড়া তাদের ছিল অবশ্যমান্য দৈববাণী, বিশেষ কোনো দেবস্থানের বিশিষ্ট পুরোহিত (পুরুষ বা নারী) ভরগ্রস্ত হয়ে যা উচ্চারণ করত। গ্রামের এক-একজন দেবতা ছিল, সেই দেবতার পুরোহিত আকাশে চাঁদের অবস্থান দেখে উৎসবের দিনক্ষণ বলে দিত। কিছু বিশিষ্ট প্রাণী, যেমন বিশাল অজগর ছিল পবিত্র, জলদেবতার প্রতিভূ। লোককথায় এবং প্রবাদে বার বার গিরগিটি, পাখি, কচ্ছপ, চিতাবাঘ, ইরোকো নামে সুউচ্চ বৃক্ষ, তেল পামের গাছ ফিরে ফিরে এসেছে। আচিবির উপন্যাসের ইবো চরিত্রগুলোর কাজ, ব্যবসায় এবং কথোপকথনে এসব প্রতীক সচ্ছন্দে ব্যবহৃত হয়েছে।
ঔপনিবেশিক শাসনের প্রথম যুগে ইবোরা স্বাভাবিকভাবেই শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশ শাসকদের সন্দেহের চোখে দেখেছিল। প্রতিরোধ ও লড়াই করেছিল, তা করতে দু-একজন সাহেব ও শাসকপক্ষীয় দেশি কর্মচারীদের হত্যাও করেছিল। কিন্তু প্রতিশোধ নিতে গিয়ে ঔপনিবেশিক শাসকেরা কিছু কিছু গ্রামে গণহত্যা চালিয়ে বিদ্রোহ সমূলে উৎপাটিত করেছিল। উপজাতিদের নিজেদের ভেতরও মানুষের স্বভাবগত পারস্পরিক দ্বিমত, দ্বন্দ্ব, ইর্ষা, এমন কি জিঘাংসাও থাকত, নিজেদের গ্রাম বা গ্রামসমষ্টির বাইরে অন্যদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের অবনতি বা উন্নতি দুইই ঘটত, ঝগড়াবিবাদ কখনো কখনো মারামারি এমন কি অল্পস্বল্প ঘটনায় রক্তারক্তিতেও গড়াত। তবে সাধারণভাবে ইগবো সমাজ গণতান্ত্রিক, শান্তিপ্রিয়, তাদের কেন্দ্রীয় কোনো শাসক ছিল না। তারা কোনো দূরের রাজা বা রাষ্ট্রনায়কের শাসনে কখনো ছিল না। তাদের একটা সুন্দর ব্যবস্থা ছিল, গ্রামের মাঝখানে একটা মাঠে সমস্ত পুরুষ জড়ো হয়ে আলোচনা করে সাধারণ ইতিকর্তব্য স্থির করত, আলাপ আলোচনার মাধ্যমে নিজেদের সমস্যা মেটাত। যা সমাধান বেরোত, তা সবাইকে মেনে নিতে হত। কোনো বিশেষ কিছু ঘোষণা করতে গেলে ঢাক বাজিয়ে ঘোষণা হত।
ব্রিটিশ শাসনের কেন্দ্র ছিল দূরে। কিছু গ্রামে তৈরি হয়েছিল চার্চ, স্কুল, এবং কোর্ট, শাসকের প্রতিভূ হিসেবে। উপনিবেশকারী ব্রিটিশ এসেছিল সম্পদের খোঁজে, একইসঙ্গে খ্রিস্টান মিশনারিরা খ্রিস্টধর্ম প্রচার করতে এসে নিজেদের ধর্মকে আলোকের ধর্ম বলে প্রচার করতে থাকল, এবং গ্রামে স্কুল খুলল। মিশনারিরা নিজেদের ধর্মকে উপস্থাপন করতে উপজাতীয়দের স্থানীয় ধর্মবিশ্বাসকে কুসংস্কার বলে নিজেদের ধর্মে আকৃষ্ট করতে চাইল। কিন্তু ফল হল যে তারা উল্টে এদের পাগল আখ্যা দিল। তবে সব মিশনারি সমান ছিল না, কেউ কেউ নানাভাবে বুঝিয়ে মানুষকে আকৃষ্ট করতে চেষ্টা করছিল, আবার কেউ কেউ ছিল আপোসবিরোধী, প্রথম থেকেই জোর খাটিয়ে নিজস্ব মতপ্রতিষ্ঠা করার পক্ষে। উপজাতীয়দের মধ্যে কেউ কেউ নিজেরা দীক্ষিত না হলেও নিজেদের একজন সন্তানকে ‘সাদামানুষের বিদ্যা’ শেখাবার জন্য স্কুলে পাঠাচ্ছিল, যাতে সাদা মানুষদের ব্যাপার বোঝা যায়। অনেক উপজাতীয় মানুষ আবার সমাজে অবহেলিত হয়ে নতুন ধর্মের শরণ নিচ্ছিল। কিছু স্থানীয় মানুষকে ব্রিটিশ শাসকের প্রতিভূ অফিসারদের বাড়িতে রাঁধুনি, মালী, ঝাড়ুদার ইত্যাদি শ্রমসাধ্য কাজে ছাড়াও সড়ক গড়তে মাটি কাটার, জঙ্গল পরিষ্কার করার কাজে সামান্য বেতনে লাগানো হত, তাদের হাতে পেত নগদ কিছু টাকাকড়ি। তবে যারা গৃহভৃত্যের কাজ করত, তাদের সমাজে ঘৃণার চোখে দেখা হত।
ব্রিটিশ শাসনের মেশিনারি সুনিশ্চিত ব্যবস্থামূলক হওয়ার পর কিছু কিছু সদ্য ইংরেজি-জানা উপজাতীয় মানুষ নিম্নতম পদের কর্মচারী নিয়োগ হল স্থানীয়দের মধ্য থেকে। তারা গ্রামের মানুষের সঙ্গে সরকারের সংযোগ রাখার কাজ করত, গুপ্তচরের, পুলিশের কনস্টেব্ল বা দোভাষীর কাজ করত। সেই কর্মচারীরা স্থানীয় হলেও অন্য গ্রামীণ মানুষের সামনে নিজেদের ক্ষমতা দেখাত, এবং সুযোগ পেলে অত্যাচার করত; সরকারের সঙ্গে গ্রামের মানুষের সম্বন্ধীয় কোনো কাজ করতে হলে গ্রামবাসীদের থেকে ঘুষ নিত।
ধীরে ধীরে শিক্ষা প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে আরো স্কুল এবং কলেজ খুলল। ইংরাজি শিক্ষিত ইবোরা স্কুলের শিক্ষক, গ্রামের চার্চের পাদ্রি, কেরানি ইত্যাদি কাজও করতে লাগল, ধীরে ধীরে তারা খোদ ব্রিটিশদের দেশে গিয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করে দেশে ফিরে সরকারের উচ্চপদেও অধিষ্ঠিত হতে লাগল, কিন্তু সেই সঙ্গে কিন্তু তাদের সমাজের কুসংস্কারের সঙ্গে অনেক ভাল সংস্কারও ঝেড়ে ফেলল।
মোটামুটি এই পরিবর্তনের চালচিত্রকে প্রসঙ্গে রেখে আচিবি তাঁর ত্রয়ী লিখেছিলেন। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৫ সালের মধ্যে লেখা উপন্যাস তিনটির দৈর্ঘ্য খুব বেশি নয়।
এখন উপন্যাসগুলোর বিষয়বস্তুর দিকে তাকানো যাক।
আচিবির থিংস ফল অ্যাপার্ট-এর মুখ্য চরিত্র হল ওকোংক্বো, যে ইবো সমাজের একজন মান্যগণ্য মানুষ, পৌরুষে বিশ্বাসী। তার গায়ে প্রচণ্ড শক্তি, সে কুস্তি লড়ে এলাকার সবচেয়ে বড় কুস্তিগিরকে হারিয়েছে। তার চাষ-আবাদ অনেক, বাড়িতে বড় বড় গোলা ভর্তি ইয়াম আছে। তার তিন জন স্ত্রী, এবং আটটা ছেলেমেয়ে, তাদের সে কড়া শাসনে রাখে। তার বাবা উনোকা ছিল সম্পূর্ণ তার বিপরীত, নরম স্বভাবের, সে বাঁশি বাজাত এবং চাষবাসে বিশেষ পরিশ্রম করতে চাইত না, এবং পরিবার প্রতিপালনের জন্য প্রচুর ঋণ রেখে গিয়েছিল। ছেলে ওকোংক্বোর কাছে বাবার এই প্রকৃতি ছিল নিতান্তই মেয়েলি, ঘৃণ্য; তাই সে দারিদ্র ঠেলে উঠে নিজের বুদ্ধি ও পরিশ্রমে সমৃদ্ধি অর্জন করেছিল এবং তাদের গ্রাম উমুওফিয়ায় সফল পুরুষ বলে গণ্য হয়েছিল।
কিন্তু সেই নির্দয় পৌরুষে ওকোংক্বো তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে ফসল লাগানোর আগের সপ্তাহে যে সামাজিক শান্তির দিন উদযাপিত হত, সেই দিনেই সামান্য দোষে প্রচণ্ড মারে, ফলে গ্রামের পুরোহিত তার নিন্দা করে পৃথিবীমাতার শান্তি ভঙ্গ করার জন্য তার জরিমানা করে। অন্য এক ঘটনায় একবার উমুওফিয়ার এক মহিলাকে পাশের গ্রামের বাজারে কোনো এক ব্যক্তি হত্যা করে। এবং উপজাতীয় প্রতিশোধের নীতি অনুসারে ওকোংক্বোকে সেখানে পাঠানো হয়। ওকোংক্বোর প্রতাপের খ্যাতি ছিল, তাই তাকে দেখে বিবাদে না গিয়ে গ্রামবাসীরা তার হাতে নিজেদের দুজন মানুষ --- একটি মেয়ে নিহত স্ত্রীর স্বামীকে দেয় ক্ষতিপূরণ হিসেবে যাবে, এবং একটি ছেলেকে তুলে দিয়েছিল। সেই ছেলেটি, যার নাম ইকেমেফুনা, গ্রামসমাজের সাধারণ সম্মতিতে ওকোংক্বোর বাড়িতে থেকে গিয়েছিল, তার ছেলেদের সাথী হিসেবে সে বেশ মানিয়েও নিয়েছিল।
কিন্তু কয়েক বছর পর ‘পাহাড় এবং গুহার দৈববাণী’ হল যে ছেলেটিকে হত্যা করতে হবে, কারণ রক্তের বদলে রক্ত নেওয়া বাকি রয়ে গিয়েছিল। ওকোংক্বো এবং তার পরিবার ততদিনে ছেলেটির সঙ্গে মায়ায় জড়িয়ে গেছে, বিশেষ করে বড় ছেলে ন্বোয়ে এবং তার মা। কিন্তু মায়া দেখানো ওকোঙ্ক্বর স্বভাব বিরোধী--সে কিছুতেই নিজেকে নরম দেখাতে পারবে না। মনে প্রচণ্ড কষ্ট হলেও সে দৈববাণীর বিরোধিতা করল না। ইকেমেফুনাকে নিয়ে গ্রামের লোকে হত্যা করার জন্য বনের মধ্যে গেল, ওকোংক্বো ও তাদের সঙ্গে গেল, এবং শেষপর্যন্ত নিজের পৌরুষ দেখাতে হত্যায়ও অংশগ্রহণ করল। ন্বোয়ের কিশোর মনে এই ঘটনা অত্যন্ত আঘাত দিল, সে বাপের এই কাজ কোনোমতেই মানতে পারেনি। সে কিছুতেই তার বাপের মত পুরুষ হয়ে উঠল না।
এই ঘটনার পর গ্রামের একজন বৃদ্ধ মান্যগণ্য ব্যক্তির মৃত্যু হল। ইবো গ্রামে সেরকম মান্যগণ্যের মৃত্যুতে বন্দুকের আওয়াজ করা হত। ওকোংক্বোর বন্দুকের গুলি অনিচ্ছাকৃতভাবে মৃত বৃদ্ধের ছোট ছেলের বুকে লেগে তখনই মৃত্যু হল। এবার সমাজের মতে হত্যাকারীর শাস্তি হল সাত বছরের জন্য নির্বাসন, শুধু তাই নয়, বলা হল যে হত্যাকারীর ঘরবাড়ি সব কিছু ভেঙে জ্বালিয়ে দিলেই ভূমি এই পাপ থেকে মুক্তি পাবে। শাস্তি ঘোষণা হয়ে যেতেই ওকোংক্বোর বন্ধু ওবিয়েরিকা তাদের জিনিষপত্র যতটা বয়ে নিয়ে যাওয়া যায় ততটা গুছিয়ে দিল, যতটা সম্ভব ইয়াম বীজ নিজের সঙ্গে বাড়ি নিয়ে গেল। নির্বাসনদণ্ডে দণ্ডিত ওকোংক্বো পরিবার নিয়ে তার মায়ের গ্রাম ম্বান্তার দিকে রওয়ানা হল। তার একমাত্র জীবিত মামা এবং মামাতো ভাইদের সহায়তায় কিছু খেতের জমি এবং ঘর বানানোর মালপত্র পেয়ে সেখানেই ঘর বানিয়ে চাষবাস করে নির্বাসনের সাত বছর কাটাতে লাগল। ওবিয়েরিকা ওকোংক্বোর যে ইয়াম বীজ নিয়ে গিয়েছিল, সেগুলো থেকে পরের বছর ফসল তুলে বিক্রি করে যা পেয়েছিল সেই কড়ি ওকোঙ্কোকে দিয়েছিল।
ম্বান্তাতে ইতিমধ্যে মিশনারিরা চার্চ খুলেছে। তারা জমি চাইতে তাদের দেওয়া হয়েছিল অপবিত্র জমির একাংশ, যে জমিতে অপবিত্র অর্থাৎ আত্মহত্যা করে মারা যাওয়া ব্যক্তির শব, দুরারোগ্য কিছু রোগ যেমন উদরিতে ভোগা রোগী, যমজ বাচ্চা (যমজ বাচ্চাকে অভিশাপ ভাবা হত, তাই যমজ জন্মালে তাদের নেওয়া হত না)--এদের ফেলা হত। গ্রামের লোকে ভেবেছিল মিশনারিরা ওখানে ভুতপ্রেতের উৎপাতে থাকতে পারবে না। কিন্তু দেখা গেল তারা সেখানে জঙ্গল পরিষ্কার করে তাদের ঈশ্বরের ঘর বানিয়েছে। চার্চের পাদ্রি গ্রামে এসে নতুন ধর্মের কথা বলতে লাগল, লোকে কৌতূহলী হলেও তেমন উৎসাহ দেখাল না। কিন্তু খ্রিষ্টান ধর্মসঙ্গীত শুনে অনেকের মনেই দাগ কাটল, এবং ওকোংক্বোর বড় ছেলে ন্বোয়ে তার বন্ধু এবং ভ্রাতৃপ্রতিম নিহত ইকেমেফুনার জন্য অনেক বছর ধরে যে মানসিক দুঃখের চাপ সহ্য করছিল, এই সঙ্গীত শুনে তার থেকে মুক্তি খুঁজে পেল। সে লুকিয়ে চার্চে যাতায়াত শুরু করল। ওকোংক্বো জানতে পেরে তাকে প্রচণ্ড মারল, কিন্তু পরিণামে সে চিরতরে গৃহত্যাগ করে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করে চার্চে চলে গেল। খ্রিষ্টান হয়ে তার নাম হল আইসাক।
সাত বছর পর ওকোংক্বো যখন সপরিবারে নিজের গ্রামে ফিরে এল, তখন উমুওফিয়াতেও অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। এখানেও মিশনারিদের প্রভাব হয়েছে, চার্চ খুলেছে, স্কুল খুলেছে, তাদের চেষ্টায় অনেকে খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত হয়েছে। নব্য খ্রিস্টানেরা অনেকেই পুরোনো ধর্মকে উপহাস করে। তাদের পবিত্র জীব অজগর মারে। তাদের পবিত্র মুখোশকে অপবিত্র করে। ওকোংক্বো এসব দেখে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে যায়, কিন্তু আশ্চর্য হয়ে দেখে এইসব অপমানের বদলা নিতে বিশেষ কেউ জ্বলে উঠছে না। ম্বান্তাতেও সে প্রস্তাব দিয়েছিল ব্রিটিশ পাদ্রিসহ নতুন খ্রিস্টানদের চাবুক মেরে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিতে, কিন্তু সেখানেও কেউ রাজি হয়নি, কারণ তারা লোকমুখে ব্রিটিশদের প্রতাপ ও বন্দুকের জোরের কথা শুনেছিল, তাদের দ্রুতগামী ‘লোহার ঘোড়া’ (সাইকেল)-এর কথা শুনেছিল। তা ছাড়া নতুন খ্রিস্টানেরা সবাই গ্রামের মানুষেরই আত্মীয়। তাই যেহেতু তাদের মারা যাবে না, তাদের শাস্তি হল একঘরে করা, যাতে তারা গ্রামের ব্যবহার করা নদীতে, রাস্তায়, বাজারে যেতে না পারে।
উমুয়াফিয়াতে যেদিন কোনো এক নব্য খ্রিস্টান পবিত্র মুখোশ ছিঁড়ে অপবিত্র করে দিল, সেদিন মানুষ খেপে গেল। তারা একসঙ্গে মিলে চার্চ ভেঙে ফেলল। ফলে সরকারি সেপাই এসে গ্রামের ছজনকে তুলে নিয়ে গেল, ওকোংক্বো ছিল তাদের একজন। সেখানে দেশি নব্য খ্রিস্টান পাহারাদাররাই তাদের চুল কেটে দিয়ে অপমান করল। যখন তারা গ্রামে ফিরে এল, অপমানে জ্বলছিল। একদিন তারা মাঠে জড়ো হয়েছিল ইতিকর্তব্য স্থির করার জন্য। সেখানে কয়েকজন সরকারি বার্তাবাহী এল খবর জানতে। তারা ওকোংক্বোকে ম্যাজিস্ট্রেটের বার্তা দিল, সভা বন্ধ করতে। ভীষণ রেগে ওকোংক্বো সেই বার্তাবাহককে তার তরোয়াল দিয়ে কেটে ফেলল। কিন্তু কী আশ্চর্য! কেউ তাকে সমর্থন করল না, বরং সে কেন এই কাজ করল, সেই প্রশ্নই করছিল। ওকোংক্বো বুঝল, তাদের সমাজে কাপুরুষতার ঘুণ ধরেছে, এরা আর লড়াই করবার জন্য জাগবে না। তাই সে সেখান থেকে চলে গেল। পর দিন ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশ নিয়ে ঘটনার খোঁজ করতে এল, ওকোংক্বোর খোঁজ করতে গিয়ে দেখা গেল সে তার বাড়ির পেছনে গাছ থেকে ঝুলছে। যেহেতু সে আত্মহত্যা করেছিল, সমাজের কেউ তাকে ছোঁবে না, তাই ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশে বার্তাবাহকদের কয়েক জন মৃতদেহ নামাল। ওকোংক্বোর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ওবিয়েরিকা রাগে দুঃখে সাহেবকে শুনিয়ে দিল যে তারা গ্রামের সবচাইতে শ্রেষ্ঠ পুরুষকে হত্যা করেছে। ম্যাজিস্ট্রেটের লোকেরা ওবিয়েরিকা সহ গ্রামের কয়েকজনকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল। ম্যাজিস্ট্রেট ভাবল এইসব ঘটনা নিয়ে পরে বই লিখবে যে কীভাবে নাইজার নদীর নিম্ন অববাহিকার বিদ্রোহ দমন করা হয়েছিল!
অ্যারো অফ গড হল এজুউলুর গল্প। ‘এজুউলু’ হল সামাজিক ঐক্যের কারণে একত্রীকৃত ছয়টা গ্রামের মান্য দেবতা ‘উলু’র পুরোহিতের উপাধি, এবং শব্দার্থে উলু দেবতার পুরোহিতরাজা। সেই পুরোহিত বংশপরম্পরায় ‘এজুউলু’ উপাধি নেয়। সমাজে রাজার মত মান্য, লোকের বিশ্বাসে দৈব ক্ষমতার অধিকারী এজুউলু চাঁদ দেখে উমুয়ারো গ্রামসমষ্টির উৎসব পার্বণের দিন স্থির করে, বিশেষ উৎসবের দিনে সে বিচিত্র সাজে পরিশ্রমসাধ্য কিছু কৃত্য করে সমাজের মানুষের মঙ্গলবিধানের জন্য। এখন বয়স হয়েছে, সেই অবস্থায় সে নিজের ক্ষমতার পর্যালোচনা করে, সে কি উৎসবের দিন ঘোষণা না করবার সাহস করতে পারবে? আচিবি এখানে একটি উদাহরণ দিয়েছেন। তার ক্ষমতা হল একটি বাচ্চা ছেলের পোষা ছাগলের মত, যতক্ষণ সে পোষে ছাগলটি তার থাকে। যখন সেটা কাটা হয়, তখন ছাগলের মালিকানা অন্যের হয়ে যায়। একইভাবে এজুউলু ভাবে, সে বাচ্চা ছেলেটির মত তার ক্ষমতার চৌকিদারমাত্র, কিন্তু স্বীকার করতে এখনো মন চায় না। উৎসবগুলো তো আসলে ফসল লাগানোর বা কাটবার আগে পালন করতে হয়, বিশেষ অনুষ্ঠান করতে হয় যাতে পৃথিবীর দেবতা সন্তুষ্ট হন, কোনো অশুভ শক্তি অনিষ্ট না করে--- এই সব উৎসব পালন করার পরই ফসল লাগানো বা তোলা হয়, তাই এই উৎসব সবার জন্য, এমনকি এজুউলুর পরিবারের জন্যও।
তার তিন স্ত্রী, অনেকগুলো ছেলেমেয়ে, তবে প্রথম স্ত্রী মারা গেছে, পরের দুজন বর্তমান। তাদের গ্রামেও খ্রিস্টান মিশনারিরা স্কুল খুলেছে, এজুউলু সাদা মানুষের ক্ষমতা সম্পর্কে অবগত আছে। তাই সে তার এক ছেলেকে ‘সাদা মানুষের বিদ্যা’ শিখতে স্কুলে পাঠায়, কিন্তু গ্রামের মানুষ এমনকি তার পরিবারও তার এই কাজকে সমর্থন করে না। তাদের সন্দেহ--এজুউলু তার ছেলেকে খ্রিস্টান বানিয়ে সহজে রোজগার করবার জন্য স্কুলে পাঠিয়েছে। সে তার দৃষ্টিভঙ্গি লোকজনকে বোঝাতে সক্ষম হয় না। যদিও সে খ্রিস্টধর্মের পক্ষপাতী ছিল না, এবং নব্য খ্রিস্টান যারা পুরোনো রীতিনীতি ও ধর্মকে অবজ্ঞা করত তাদের ঘৃণা করত, তবুও অনেকেই তাকে দুমুখো ভাবত। তাই এজুউলুর অনুশাসনের প্রতি ধীরে ধীরে শুধু গ্রামের লোক নয়, তার নিজের পরিবারেও অসন্তোষ দানা বাঁধছিল। টাকার জন্য অনেকেই খ্রিস্টান হতে বা সরকারের কাজ করতে উৎসুক ছিল। উমুয়ারো গ্রামসমষ্টির বাইরে অনেক জায়গায় লোকে তা করছিলও। এজুউলু এবং তার কিছু বন্ধু ও সমর্থকের জন্য জন্য তা করা যাচ্ছিল না।
অতীতে একবার একটুকরো জমি নিয়ে এজুউলুর গ্রাম উমুয়ারো সঙ্গে অন্য গ্রামের সংঘাত বেঁধেছিল। জমিটুকু আসলে অন্য গ্রামেরই ছিল, কিন্তু উমুয়ারোর মানুষও বিনা বাধায় সেখান থেকে ঘর ছাইবার ঘাস সংগ্রহ করত। গ্রামের কিছু লোক এজুউলুর নিষেধ সত্ত্বেও জমিটা দখল করতে যায় ও মারামারিতে জড়িয়ে পড়ে। সেই লড়াইয়ের খোঁজ করতে ব্রিটিশ জেলা অফিসার এলে এজুউলু ন্যায়ের জন্য নিজের গ্রামের মানুষের বিপক্ষে সাক্ষী দিয়েছিল। সেই কারণে প্রশাসনের কাছে তার বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল। এরই মধ্যে কিছু অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটল, তার যে ছেলে স্কুলে পড়ত, সে একদিন নব্য খ্রিস্টানদের প্ররোচনায় তার বাক্সের ভেতর একটা অজগর বন্দি করে রেখেছিল। ভাগ্যক্রমে সেটা মরে যায়নি, মরলে সমাজে বিরাট অঘটন ঘটত; পবিত্র প্রাণীর হত্যা লোকে মানত না, এবং হত্যাকারীকে শাস্তি পেতে হত। কিন্তু এই ঘটনাতে গ্রামের লোক যারা এজুউলুর বিরুদ্ধে তার ছেলেকে স্কুলে পাঠানোর জন্য অসন্তুষ্ট ছিল, তাদের অসন্তোষ আরো বেড়ে গেল, এবং সর্বমান্য পুরোহিত এজুউলুকেও কথা শোনাতে ছাড়ল না। এই টালমাটাল অবস্থায় জেলা অফিসার তাকে গ্রামীণ শাসনের ক্ষেত্রে কিছু শলাপরামর্শের জন্য নিজের অফিসে ডেকেছিল। কিন্তু এজুউলুর নিয়ম হল সে যেহেতু গ্রামদেবতা উলুর পুরোহিত হিসেবে গ্রামের মুখ্য, তার অন্য কোথাও যাওয়া সাজে না। যার দরকার সে এজুউলুর কাছে আসে। তাই সে প্রশাসকের বার্তা অগ্রাহ্য করে। তবে সে জানে শাসকের আদেশ অমান্য করলে সংঘাত অনিবার্য, তাই সে যাবে কি যাবে না সেটার সিদ্ধান্ত করতে গ্রামের সভা ডাকে, কিন্তু সেই সভায় গ্রামের মান্যগণ্য ব্যক্তিরা তার সহায়তা করতে অস্বীকার করে। তখন সে নিজে সারাদিনের পথ হেঁটে গিয়ে সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করে। পরদিন জেলা অফিসার আবার বার্তাবাহক ও কনস্টেব্ল পাঠায় তাকে ধরে আনবার জন্য, কিন্তু সে আগেই চলে গেছে দেখে তারাও অফিসে চলে যায়, এবং সেখানে তার সঙ্গে মোটামুটি ভালই ব্যবহার করা হয়। কিন্তু কাকতালীয়ভাবে সেই সময় জেলা অফিসার নিজেও প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়, গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে যে এজুউলুর জাদুকরী শক্তিতেই অফিসার অসুস্থ হয়েছে। গ্রামে তার প্রতি সমীহ আবার খানিকটা ফিরে আসে। সহকারী জেলা অফিসার মি ক্লার্ক তেমন কোনো দোষ না পেয়ে এজুউলুকে ছেড়ে দেয়, কিন্তু জেলা অফিসারের অনুপস্থিতির জন্য এইটুকু সিদ্ধান্তে আসতে দুমাস লেগে যায়। দুমাস পর ছাড়া পেয়ে বাড়ি এসে কিছুদিন নিজের প্রতি লোকের সমীহ সে উপভোগ করে, কিন্তু যখন শোনা গেল অফিসার সুস্থ হচ্ছে তখন সেটা আবার টাল খেয়ে গেল, তারা আগের মত তাকে অভিবাদন জানাতে আসা কমিয়ে দিয়েছিল। এজুউলু গ্রামের প্রতি রাগ ভেতরে ভেতরে পুষতে থাকে।
গ্রামের নিয়ম অনুসারে নতুন ইয়াম উৎসব অর্থাৎ ইবোদের নবান্ন উৎসবে প্রত্যেক পরিবার থেকে একটা করে ইয়াম উলু দেবতার থানে দেওয়া হত। এর থেকে বারোটি ইয়াম এজুউলু নিজের জন্য রেখে অন্যগুলো বিলিয়ে দিত। এই ইয়ামগুলোর একটা সে প্রতি মাসের সন্ধ্যায় প্রথম চাঁদ দেখে খেত, এভাবে বারো মাসে বারোটি ইয়াম যেদিন খাওয়া হয়ে যেত, তার সপ্তাহ (ইবোদের সপ্তাহ হয় চার দিনে, এবং মাসে সাত সপ্তাহ থাকে) দুয়েকের মধ্যেই নতুন ইয়াম উৎসবের জন্য দিন ঠিক হয়ে যেত। এদিন পুরোনো ইয়াম খাওয়া নিষিদ্ধ, নতুন ইয়ামই খেতে হয়, এবং তার পরই খেতের ফসল ঘরে তুলতে হয় এবং তারপর নতুন ফসল বুনতে হয়। এবছর এজুউলু দুমাস জেলে থাকার ফলে দুটো ইয়াম খেতে পারেনি, এবং একটা করে মাসে খাওয়াই উলুর বিধি। নিয়মমত তার খাওয়া শেষ হলে তবেই নতুন ইয়ামের দিন শুরু হবে। সে তার ক্ষমতাবলে বছরের সময়মত উৎসব শুরু করবার কোনো উপায় করতে পারত। কিন্তু গ্রামের মানুষ যারা তাকে আগে সমর্থন করেনি, তাদের উপর রাগে উলু দেবতার কোপের অজুহাতে সে নিয়ম শিথিল করল না। আরো দুমাসের আগে ইয়াম উৎসব হবে না বলে সে জানিয়ে দিল। গ্রামের মানুষ কিংকর্তব্যবিমূঢ়, এজুউলু অনুমতি না দেওয়ায় তাদের নবান্ন উৎসব, নতুন চাষ সব পিছিয়ে গেল, ভয় হল এবছর তারা পর্যাপ্ত খাবার নাও পেতে পারে।
দুমাস পর সে উৎসবের ঘোষণা করল। তার মেজ ছেলে নববিবাহিত প্রাণবন্ত যুবক ওবাইকা নতুন ইয়াম উৎসবের জন্য তৈরি মুখোশ পরে নাচবার সময় শ্বাস আটকে মারা গেল। এজুউলু যে আগে থেকেই গ্রামের মানুষের আচরণে বিরক্ত ছিল, ছেলের মৃত্যুশোকে সে ভাবতে লাগল কেন এমন হল? সে তো দেবতার নিয়মের অন্যথা করেনি। ভাবতে ভাবতে সে পাগল হয়ে গেল, যেন দেবতাই তাকে তীরবিদ্ধ করেছেন। লেখক অবশ্য আগেই ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছিলেন যে আগে তার মাও উন্মাদরোগে ভুগেই মারা যায়।
দেবতারও শাস্তি হল। এজুউলু পাগল হয়ে যাবার পর দেবতার পুজো করবার লোক থাকল না, কারণ গ্রামের লোক ধীরে ধীরে নতুন ধর্মে দীক্ষা নিল, এবং বাৎসরিক ইয়াম উৎসবে উলুর থানে জমা দেবার ইয়াম এখন থেকে নতুন দেবতা ‘জিশু ক্রিস্টি’র থানে পড়তে লাগল! এভাবে উপন্যাসটি শেষ হল ব্যঙ্গাত্মক সুরে।
নো লঙ্গার অ্যাট ইজ উপন্যাসে আমরা দেখি পুরোনো উমুয়াফিয়া গ্রামের ওকোংক্বোর নাতি ওবি ওকোংক্বোকে, যাকে উচ্চশিক্ষার জন্য বিলাত পাঠানো হয়েছিল। দুই প্রজন্ম পরে এখন ইবোসমাজের বেশিরভাগই খ্রিস্টান। অনেকেই কিছু লেখাপড়া করে রোজগারের জন্য গ্রাম ছেড়ে দেশের বড় শহর লাগোস-এ বাস করে। ওকোংক্বোর ধর্মান্তরিত বড় ছেলে আইসাকের ছেলে ওবি উচ্চশিক্ষার শেষে বিলাত থেকে ফিরে ব্রিটিশ উচ্চপদস্থদের সমকক্ষতার দাবিদার হয়, এবং উচ্চপদেই বহাল হয়।
ওবির উপরওলা ব্রিটিশ অফিসার সব দেশি অফিসারকেই দুর্নীতিগ্রস্ত ভাবে। ওবি এপর্যন্ত নৈতিক দিক দিয়ে ঘুষ নেওয়া ইত্যাদি দুর্নীতি সমর্থন করত না। দেশে ফিরে সে সর্বত্র দেখে দুর্নীতির ছড়াছড়ি, ঘুষ না দিলে কোনো সরকারি সেবা পাওয়া যায় না। যথেষ্ট টাকা বেতন পেলেও তার উপর প্রচুর চাপ। তাকে তার উচ্চশিক্ষার অনুদান শোধ করতে হবে, তার মা-বাবা দরিদ্র, মা দুর্বল হয়ে প্রায় মরতে বসেছে, তাদের সাহায্য করতে হবে, তার ভাইয়ের উচ্চশিক্ষার খরচা যোগাতে হবে, তার নিজের প্রেমিকাকে নিয়ে ঘর বাঁধার সাধও মেটাতে হবে। এদিকে সে সরকারি নিয়মকানুনে অনভিজ্ঞ হবার ফলে পরিণামের কথা না জেনেই ঋণ নিয়ে গাড়ি কিনে ফেলে; সরকারি বাসস্থানে উচ্চ হারে বাঁধা বিদ্যুতের বিল, নিজস্ব খরচের বিল, ড্রাইভার, চাকর, ফোন, গাড়ি ঋণের কিস্তি, প্রেমিকা ক্লারাকে নিয়ে ডেট করার খরচ সব দেবার ফলে তার রোজগারের টাকা তো শেষ হয়েই যায়, তাকে বাড়তি ঋণ নিতে হয়। ক্লারার জাত নিয়ে তার মা-বাবা এবং সমাজের আপত্তির ফলে সে প্রেমিকাকে দেওয়া কথা রাখতে দ্বিধায় পড়ে। ওদিকে তার প্রেমিকা ক্লারা যে তাকে পঞ্চাশ পাউন্ড ধার দিয়েছিল, একসময় গর্ভবতী হয়ে পড়লেও ওবির দ্বিধাগ্রস্ততার জন্য তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে যায়। মায়ের চিকিৎসার জন্য ওবি বেশ টাকা খরচ করলেও কাজ হয় না, মা মারা যায়। ওবি প্রচণ্ড অর্থাভাবে পড়ে একসময় দুর্নীতির সঙ্গেই বোঝাপড়া করে, ঘুষ নেয়। ব্রিটিশ অফিসার তক্কে তক্কে ছিল, তার পেছনে চর লাগিয়েছিল। একসময় ধরা পড়ে ওবি বিচারের মুখোমুখি হয়।
এইটুকু সারসংক্ষেপে অবশ্য উপন্যাসগুলোর খুব কমই বলা হয়। বহুমুখী দৃষ্টিকোণে আচিবি তাঁর সমাজের সমস্যাগুলোকে দেখিয়েছেন। ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ তো ছিলই, যা নিস্তরঙ্গ ইবোসমাজে সংঘাত এনেছিল। কিন্তু আচিবি নিজের সমাজকেও সমালোচনা করতে ছাড়েননি। তিনি দেখিয়েছেন যে সর্বনাশের বীজ চরিত্রের মধ্যেই নিহিত থাকে। অতিরিক্ত পৌরুষাভিমান ওকোংক্বোর জীবনে ট্রাজেডি ডেকে আনে এটা যেমন একদিকে ঠিক, অন্যদিকে তাদের সমাজ যে অসংখ্য কুসংস্কারে নিমজ্জিত ছিল, সেসবও ছিল সমাজের ধ্বংসের কারণ। ছোট ছোট গোষ্ঠীতে বিভক্ত ইবো সমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিদেশি শত্রুর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারেনি, নিজস্ব স্বার্থই বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। ফলে ওকোংক্বো একা হয়ে গিয়েছিল, অন্যদিকে নিজেকে সমাজের উর্ধ্বে ভাবা এজুউলুকে তার নিজের মানুষ অগ্রাহ্য করছিল। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকেরা সেই বিভক্ত সমাজের বিবাদে ইন্ধন জুগিয়ে দখলদারির সুযোগ নিয়েছিল। তারা এসেছিল স্বার্থের খোঁজে, মিশনারিরা নিজেদের ধর্মকে আলোকের ধর্ম অভিহিত করে উপজাতীয় মানুষকে দীক্ষিত করিয়েছিল, পড়াশুনোর জন্য স্কুল খুলেছিল, কিন্তু তাতে না ছিল সহমর্মিতা না ছিল সমতা। ফলে শিক্ষা কেবল অর্থ উপার্জনের মাধ্যম ধরে নিয়ে নব্য শিক্ষিত যুবকেরা ভোগবাদে উদ্দাম হয়ে ওঠে, শেষপর্যন্ত দুর্নীতিপরায়ণতার ছাপ চিরতরে তাদের কপালে লেগে যায়। যে ওবি তার পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন ছিল, ভোগের চাহিদায় তার পদস্খলন ঘটে, এবং নাকউঁচু নীতিবাগীশ ইংরেজ অফিসার মি গ্রিন গোটা আফ্রিকার সমাজকেই দুর্নীতিপরায়ণ বলে আখ্যায়িত করে।
এইখানে এসে আমাদের দেশ সহ তৃতীয় বিশ্বের সব পূর্বতন উপনিবেশ যেন একসূত্রে বাঁধা পড়ে যায়।