নদীর সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক সভ্যতার আদিলগ্ন থেকে। নদীকে কেন্দ্র করে মানুষ বসতি গড়েছে, গড়ে উঠেছে সভ্যতা। নদীও নানাভাবে সমৃদ্ধ ও প্রভাবিত করেছে মানুষের সমাজজীবন। নদী তার জলরাশির সঙ্গে বয়ে নিয়ে চলে তীরবর্তী অসংখ্য লোকালয়ের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতিকে। আবার বিশেষ করে সে নদী যদি হয় গঙ্গা, যা মানুষের জীবনে, বিশ্বাসে, আচারে, ধর্মীয় চেতনায় জড়িয়ে আছে ওতপ্রোতভাবে। তার গরিমা অতুলনীয়। ভারতবাসীর জীবনে সে মাতৃস্বরূপা। দেবীর আসনে সে অধিষ্ঠিত। মানুষ দিয়েছে তাকে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা। ভগিনী নিবেদিতা, ‘দ্য ওয়েব অফ ইণ্ডিয়ান লাইফ’ (১৯০৪) গ্রন্থে লিখছেন, ধার্মিকের কাছে গঙ্গা শুদ্ধিদাত্রী, দার্শনিকের কাছে গঙ্গা এমন এক প্রবাহ যা ব্রহ্মের দিকে নিয়ে যায়, ইতিহাসের ছাত্রদের কাছে গঙ্গা আর্যসভ্যতার বহমানতার প্রতীক; এসবের ঊর্ধ্বে গঙ্গা তার গুণমুগ্ধদের কাছে একজন ব্যক্তি।
গঙ্গা গোমুখ থেকে গঙ্গাসাগর পর্যন্ত ২৫০০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি ধারাই শুধু নয়, বহু উপনদীর জলে পুষ্ট গঙ্গা অববাহিকা ১১টি রাজ্যে ৮,৬১,৪০৪ বর্গকিমি বিস্তৃত এবং সেখানে বাস করেন প্রায় ছাপ্পান্ন কোটি মানুষ। গঙ্গার উৎসমুখ থেকে গঙ্গোত্রী, উত্তরকাশী, দেবপ্রয়াগ, হৃষীকেশ, হরিদ্বার, বিঠুর, কানপুর, এলাহাবাদ, বেনারস, পাটনা, নবদ্বীপ, কলকাতা হয়ে গঙ্গাসাগর— এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমা করে গঙ্গার দুই তীরের জনজীবন, সভ্যতা, পুরাণ ও ইতিহাসকে দু মলাটে লিপিবদ্ধ করেছেন লেখক চঞ্চলকুমার ঘোষ তাঁর ‘গঙ্গা—ভারতাত্মার প্রাণ-প্রবাহ’ গ্রন্থে। এটি কিন্তু ঠিক ভ্রমণকাহিনি নয়, লেখক এই বইয়ে প্রবন্ধাকারে গ্রথিত করেছেন গাঙ্গেয় সভ্যতা, গঙ্গা তীরের মানুষের ইতিহাস, ধর্ম, সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্পকলা ও উৎসবকে। তার সঙ্গে উজাড় করে দিয়েছেন নিজের অনুভব আর অভিজ্ঞতা। লেখক নিজেই জানিয়েছেন চার বছর ধরে গঙ্গার তীর ধরে ঘুরতে ঘুরতে যে বর্ণময়, বিচিত্র আর বহুব্যাপ্ত অভিজ্ঞতা তিনি সঞ্চয় করেছেন তা কোনো উপন্যাসে প্রকাশ করা সম্ভব নয়, বরং প্রবন্ধের মধ্যেই তা বলা সম্ভব।
লেখক চঞ্চলকুমার ঘোষ প্রথমেই লিখেছেন গঙ্গার জন্মের চিরন্তন সেই কাহিনি— ভগীরথের তপস্যায় স্বর্গ থেকে মাটিতে নেমে এলেন গঙ্গা, তার পবিত্র ধারায় ধন্য হল পৃথিবী। সেই কাহিনি স্রোত কয়েক হাজার বছর ধরে ভারতবর্ষের মানুষের জীবনে এমনভাবে প্রবাহিত হয়েছে যে প্রত্যেক ভারতবাসী অন্তরের অন্তস্থল থেকে বিশ্বাস করে গঙ্গা কোনো সাধারণ নদী নয়। গঙ্গা স্বর্গ-মর্তের মিলনসেতু। স্বয়ং বিষ্ণুর পাদপদ্ম থেকে তাঁর জন্ম। শিবের মাথায় তাঁর অবস্থান। যুগযুগান্ত ধরে মানুষের বিশ্বাস গঙ্গার জলের স্পর্শে, এমনকি দর্শনেও জন্মজন্মান্তরের সব পাপ ক্ষয় হয়ে যায়। বহু শতাব্দী আগে থেকে নানা দেশের অভিযাত্রী সন্ধান শুরু করেছিলেন গঙ্গার উৎস মুখের। উৎসের রহস্য সন্ধানের ইতিহাস উন্মোচিত করেছিল একটা বাক্স। সেটি পাওয়া গিয়েছিল ১৯০৯ সালের কলকাতার সেন্ট পলস চার্চে। জনৈক পাদরি প্রাচীন পরিত্যক্ত সেই বাক্স খুলতেই বেরিয়ে এসেছিল আন্তোনিয়ো দ্য মন্সারেট-এর ভ্রমণপথের বিবরণ ও তাঁর আঁকা একটি মানচিত্র। খুলে গেল ইতিহাসের দরজা। মন্সারেট-এর বর্ণনা থেকে জানা যায়, তিনি মনে করতেন মানস সরোবর থকে গঙ্গার উৎপত্তি। রহস্য উন্মোচনের প্রথম ঝুঁকি নিয়েছিলেন এক পর্তুগিজ পাদরি। নাম আন্তোনিয়ো দ্য আদ্রেদ। সময়টা ১৯৬৪ সাল। এইভাবে বহু দেশের বহু অভিযাত্রী দুঃসাহসিক সফরে নিয়েছিলেন নানা ঝুঁকি। তাঁদের অভিজ্ঞতাকে একসূত্রে বেঁধেছেন লেখক চঞ্চলকুমার ঘোষ তাঁর ‘প্রথম অভিযাত্রী’ ও ‘বিদেশির চোখে’— এই দুই প্রবন্ধে।
সনাতন ভারতবর্ষের পরিপূর্ণ রূপটি সম্পৃক্ত হয়ে আছে গঙ্গার সঙ্গে। আর গঙ্গার প্রতিটা ঘাটের সঙ্গে জুড়ে আছে ইতিহাস। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ঘাটের কথা’য় লিখেছিলেন, ‘পাষাণে ঘটনা যদি অঙ্কিত হইত তবে কতদিনকার কত কথা আমার সোপানে সোপানে পাঠ করিতে পারতে। পুরাতন কথা যদি শুনিতে চাও, তবে আমার এই ধাপে বইস; মনোযোগ দিয়া জলকল্লোলে কান পাতিয়া থাকো, বহুদিনকার কত বিস্মৃত কথা শুনিতে পাইবে’। গঙ্গার ঘাটের সেই বিস্মৃত ইতিহাস, লোককথাকে লেখক লিপিবদ্ধ করেছেন তাঁর ‘ঘাটের ইতিকথা’ প্রবন্ধে। সঙ্গে মিলিয়েছেন তাঁর গঙ্গা দর্শনের নিজস্ব অভিজ্ঞতা। যেমন তিনি তুলে ধরেছেন বারানসীর ঘাটের একটি সুন্দর দৃশ্যপটের – ‘রাত্রি শেষ হওয়ার আগেই জেগে ওঠে বারাণসীর ঘাট। মন্দিরে মন্দিরে শুরু হয় আরতি, পুজোপাঠ। মঙ্গল শঙ্খ আর ঘণ্টাধ্বনিতে মুখর হয়ে ওঠে প্রকৃতি। ...শুরু হয় স্নান, মনস্কামনা পূরণে পাতার ভেলায় ভাসিয়ে দেওয়া হয় দীপের বাতি। ঘাটে ঘাটে নৌকার আনাগোনা। ... উপার্জনের আশায় চলে কথক ঠাকুরের পাঠ, ভিখারির প্রার্থনা, ধর্মচর্চা, একই সঙ্গে চলে শরীর চর্চা, পালোয়ান ঘাটের ধারে কুস্তি করে, জল তোলপাড় করে সাঁতার কাটে ছেলের দল। চলে ঘাটের উপর বিদেশিদের ম্যাসাজ। ভস্মমাখা সাধু ধ্যানস্থ হয়ে আছেন। ...সন্ধে হয়, জ্বলে ওঠে দীপ। ঘাট লাগোয়া মন্দির থেকে ভেসে আসে আরতির ঘণ্টাধ্বনি’। নবপরিণীতা বধূর গঙ্গা বন্দনা আর মুমূর্ষু বৃদ্ধের অন্তর্জলি যাত্রা— গঙ্গার একই ঘাটে একই সঙ্গে হয়ে চলেছে; একটি নব জীবনে আনিত আকাঙ্খা, অন্যটি জীবনের অন্তিমলগ্নের অপেক্ষা, দুটির অবলম্বনই সেই গঙ্গা। বারাণসীর বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনে এসে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘পশ্চিমে মহাদেশে আমরা দেখতে পাই যে ফ্রান্সের চিত্তের কেন্দ্রভুমি প্যারিস। ইতালির রোম, প্রাচীন গ্রিসের এথেন্স, হিন্দু ভারতবর্ষের ইতিহাসে তেমনি কাশী... এখানে যে কেবল ভক্তি ধারার সঙ্গমস্থান তা নয় এখানে ভারতীয় সমস্ত বিদ্যার মিলন হয়েছে’।
বিশিষ্ট নৃবিজ্ঞানী নির্মলকুমার বসু ‘পরিব্রাজকের ডায়েরি’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন তাঁর গঙ্গা দর্শনের অভিজ্ঞতা—‘দেখিলাম সকল মানুষই গঙ্গার ধারে মানুষের সঙ্গ ছাড়িয়া প্রকৃতির সহিত সঙ্গ করিতে আসিয়াছে। পুরানো বাড়ির ফাটলের মধ্যে আগাছা জন্মাইয়া যেমন আলোর দিকে, আকাশের অভিমুখে গ্রীবা বাড়াইয়া দেয়, ইহারাও সকলে তেমনই করিয়া বাঁচিবার চেষ্টা করিতেছে। কেহ প্রকৃতির শান্ত সুন্দর রূপে, তাহার বিস্তারে বিশালতায় অবগাহন করিতেছে। কেহ বা অন্তরে বেদনার আঘাতে মুদ্রিতনয়নে হৃদয়ের মধ্যে কল্পনার দেবতাকে প্রতিষ্ঠিত করাইবার প্রয়াসে ক্ষিপ্তের মত অঙ্গুলি সঞ্চালন করিতেছে’।
তবে গঙ্গার মাহাত্ম্য শুধু তার ধর্মীয় অনুভূতিতে নয়। ইতিহাস, সমাজজীবন, অর্থনীতি, কৃষি, বাণিজ্য, শিল্প, সঙ্গীত, সংস্কৃতি, লৌকিক জীবন— সব কিছুর সঙ্গেই গঙ্গা একাত্ম হয়ে রয়েছে। তাই কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, দার্শনিক প্রত্যেকেই গঙ্গার ধারায় খুঁজে পেয়েছেন তাঁদের জীবন দর্শন, তাঁদের কল্পনা, তাঁদের পূর্ণতা। তারই প্রকাশ কাব্যে, সাহিত্যে, পুরাণে, মহাকাব্যের নানা আঙিনায়। ভারত সাহিত্য তথা বাংলা সাহিত্যে গঙ্গা এসেছে নানা রূপে, তাকেই একসূত্রে লেখক উপস্থাপন করেছেন এই গ্রন্থে। গ্রন্থের শেষে রয়েছে গুপ্তযুগে নির্মিত এবং এলিফ্যাণ্টা গুহা, বারাণসী ও বেসনগরে প্রাপ্ত গঙ্গামূর্তির স্থিরচিত্র।
গঙ্গা নদীকে কেন্দ্র করে ইতিহাস, সাহিত্য, ভূগোল ও বিজ্ঞানের একটা অবিরল সম্মেলন দেখতে পাওয়া যায়। গঙ্গা তীরবর্তী মানুষদেরই গঙ্গা বাঁচানোর দায়িত্ব নিতে হবে, তবেই বাঁচবে এই নদী। লেখক রাজ্য তথা দেশ জুড়ে গঙ্গা তীরের যে খন্ড খন্ড ছবি তুলে ধরেছেন, সেখানে হয়তো আরো অনেক কিছু সমস্যার কথা বাদ থেকে গেল। তবে গঙ্গা নদী যে আমাদের জীবনযাপন ও জীবন ধারণের অন্যতম সোপান, সেকথা লেখক তুলে ধরেছেন সহজ ভাষায়, মুন্সিয়ানার সঙ্গে।
গঙ্গা— হাজারো মিথ, লোককথা, কাহিনি তাকে নিয়ে। তাকে কেন্দ্র করে বিবিধ লোকাচার, সংস্কৃতি, সভ্যতা। লেখক চঞ্চলকুমার ঘোষ গঙ্গাকে দেখেছেন নানা রূপে, নানা ভাবে— তীরবর্তী মন্দির, নগর, গ্রাম, শহর। বিচিত্র মানুষের জীবন। পাপ থেকে পুণ্য। অতীত থেকে বর্তমান। গঙ্গার এই দীর্ঘ পথ চলতে চলতে তাঁর মনে হয়েছে এ কোনও নদীকে দর্শন নয়, ভারতাত্মার প্রবহমান ধারাকে প্রত্যক্ষ করা। যা মানব জীবনের হাজার পরিবর্তনের মধ্যেও বয়ে চলেছে ধীর কিন্তু নিরবিচ্ছিন্ন। লেখকের অনুভূতি দিয়েই এই লেখা শেষ করব। তিনি লিখছেন, ‘এই বিশালত্বের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অনুভব করেছি পরিবর্তনের মধ্যেও এই নদী-প্রবাহের মধ্যে ক্ষুদ্রতা নেই, সংকীর্ণতা নেই। এই ধারার সামনে দাঁড়িয়ে বিনম্র হয়েছি। তার কলধ্বনির মধ্যে ভেসে উঠেছে ধনী, দরিদ্র, সাধু, তপস্বী, পাপী, পুণ্যবান, শোকার্ত মানুষ। ক্ষুদ্র থেকে বৃহত্তর প্রাণী, সকলের মিলিত ঐকতান— যা চিরন্তন শাশ্বত’।