কবিতা টবিতা লিখতে না পারলে কী হবে বেঘোরে মারা যাওয়ার চেষ্টা এজীবনে কম করিনি, কিন্তু অন্য সব কাজের মতো এটাতেও ব্যর্থ হয়েছি। আর এগুলো করতে গিয়ে মালুম হয়েছে অনেকগুলো ঝুঁকি আসলে তেমন কোনো ঝুঁকি নয়, আমরা একটু বাড়িয়ে ভাবি। আমাদের যেমন ভয় দেখানো হয়েছিল বেলুন যাত্রা বিপদসঙ্কুল আলগা স্কার্ফ বা ক্যামেরা স্ট্র্যাপ দমকা হাওয়ায় গলায় ফাঁস হয়ে যেতে পারে, উদগ্রীব হয়ে নীচে কী আছে দেখতে গিয়ে যে-বাক্সের মধ্যে চড়ে যাত্রা তার দেওয়াল টপকে পপাত চ মমার চ হয়ে যেতে পারে, বা নামার সময়ে হাওয়া অনুকূল না থাকলে বাক্স কাত হয়ে দাঁত ছিরকুটে পড়তে পারে। তবে এসব কিছুই হয়নি, হয়েছে দেদার মজা। কিন্তু তার আগে আছে বিস্তর প্রস্তুতি। প্রথম থেকে পরম্পরাযুক্তভাবে বলা যাক।
লোকে পোপকে দেখতে ভ্যাটিকান যায়, আইফেল টাওয়ার দেখতে পারি যায়, টিউলিপ দেখতে হল্যান্ড যায়, মাচ্চুপিচ্চু দেখতে পেরু যায় তেমনি মাইগ্রেশন দেখতে কেনিয়া বা তানজানিয়া যায়। জুলাই-অগস্ট এমনকী সেপ্টেম্বর জুড়ে সবুজ ঘাস খুঁজে পেতে দলে দলে জেব্রা আর ওয়াইল্ডবিস্ট প্রাণ হাতে করে মারা নদী এপার ওপার করে সেই কতকাল ধরে, তার নামই নাকি মাইগ্রেশন। তো আমি নেহাত বাঙাল বলে কেনিয়া তানজানিয়া ধাওয়া করেছি দু-চারবার, কিন্তু এহেন দুর্লভ যাত্রা দেখে উঠতে পারিনি। পাড়ার সবাই বলল ওটা না কি মস্ত ভুল হয়ে গেছে।
পরশুরামের কেদার চাটুজ্জে ভূতে ভয় পেত না কিন্তু ‘কলচর’কে ডরাত। কেন সে আলী সাহেব লিখে গেছেন আপনারা পড়েছেন। আমি তেমনি ভগবানে বিশ্বাস না করি পাড়ার ঠেকে করি। ঠেক সব জানে, দীপিকা পাড়ুকোনের দর্জির নাম, কর্কটরোগের নতুনতম চিকিৎসা কী, কোন শেয়ারের দাম লাফিয়ে বাড়বে, বিশুদ্ধসিদ্ধান্ত পঞ্জিকার এবারের তিথি গণনা কেন শুদ্ধ নয় সব। তাই মনে হল ভুলটা শুধরে নেওয়া দরকার।
এবার আমরা যাচ্ছি একটু নতুন পথে, আদ্দিস আবাবা হয়ে। মাঝরাতে বিমান ছাড়ার পরে পরেই আপ্যায়ন করে খেতে দেওয়া হল আমাদের। মুম্বাই বিমানবন্দরে ভয়ংকর ভিড় ঠেলতে হয়েছিল। ভালো করে খাওয়া হয়নি। তাই খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লাম। ভোরবেলা আদ্দিস আবাবা। ঘন্টা চারেক অপেক্ষার পর তানজানিয়ার উড়ান ধরতে হবে আমাদের। যথারীতি শেষ মুহূর্তে ঘোষণা হল গেট বদলে গেছে। একটা আন্তর্জাতিক ভিড় পড়িমড়ি করে দৌড় দিল নতুন গেট লক্ষ্য করে। আমরা সেই বিশাল সর্পিল লাইনের পিছন দিকে। অবশেষে যখন প্রবেশমুখে এলাম বিমানের ভারপ্রাপ্ত কর্মী মিষ্টি হেসে বললেন আপনাদের সিট নেই।
মানে?!!
জানা গেল যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে নির্দিষ্ট বিমানটি বাতিল হয়েছে। পরিবর্ত বিমানটি আকারে একটু ছোটো। ফলে পিছন দিকে যাদের আসন ছিল সেগুলো কাটা পড়েছে। আমাদের উদ্বাস্তু কলোনিতে লোকেরা হামেশা নানা জায়গা থেকে বাদ পড়ে যেত, এনিয়ে দাঙ্গাহাঙ্গামার বেশি কিছু হত না। ভুরুর নীচে কাটা দাগ না থাকলে আবার বাঙাল কি?
ওদিকে কিলিমাঞ্জারো বিমানবন্দরের বাইরে যে আমাদের সারথি কাম গাইড অপেক্ষা করে থাকবেন, ওদিকে যে আমাদের গোরংগোরো তে হোটেল বুক করা আছে, আমাদের যে আবার খিদে পেয়ে গেছে, আমার পিসিমা যে কলকাতায় বসে খুব দুশ্চিন্তা করবেন, সবচেয়ে বড়ো কথা বেড়াতে বেড়িয়ে আবার বিপাকে পড়েছি শুনলে ইয়ারবক্সিরা যেসব বাক্যবাণ বর্ষণ করবেন সেগুলো সামলাবে কে? তড়বড় তড়বড় করে এসব যতই বলি ভদ্রলোক খালি বলেন আমার ওপর ভরসা রাখুন। আগে অন্যদের উঠতে দিন। শেষমেষ কি তাহলে আনরিজার্ভড কামরায় বাথরুমের পাশে মেঝেতে চাদর পেতে যাওয়ার মতো করে যেতে হবে না কি? একটাই সুবিধে, মিনিট চল্লিশেকের উড়ান, আর চেনা কেউও নেই। আর হ্যাঁ, ছোটো বিমান হোক আর যাই হোক আমাদের চেক ইন লাগেজ খোলের মধ্যে ঠুসে দিয়েছে তো? অবশেষে শেষ লোকটিকে নিয়ে যখন এয়ারলাইনসের বাস চলে গেল আমরা বাক্শক্তিরহিত হয়ে শুধু তাকিয়ে রইলাম। তারপর ভদ্রলোক প্রবেশদ্বারের মুখের যন্ত্র থেকে ফরফর করে চারটে বোর্ডিং পাস বের করে আমাদের হাতে দিয়ে বললে এই আপনাদের প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত করে দেওয়া হল। আসুন। আনন্দের চোটে দু-গেলাশ লাল ওয়াইন খেয়ে ফেললাম ওই চল্লিশ মিনিটের যাত্রায়।
কিলিমাঞ্জারো খুব ছোটো বিমানবন্দর। মূলত পর্যটকরা ব্যাবহার করেন। তাই ছোটো হলেও ইমিগ্রেশনের অনেকগুলো জানালা। ফলে বেশ তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়া গেল। আমাদের সারথির নাম ইনোসেন্ট সত্যিই এক বড়োসড়ো চেহারার দেবশিশু। সে জানাল আরুশাতে আমরা একবার খেতে থামব। তারপর সোজা গোরোঙ্গোরো। চমৎকার খাওয়া। বিশেষত একটা তেলাপিয়া গোছের মাছ তো অপূর্ব। সন্ধের অন্ধকারও নামল আমরাও এসে পৌঁছোলাম এক ভারি সুন্দর হোটেলে। দুঃখের বিষয় কাল ভোরেই আমাদের বেরোতে হবে এ-সুখাশ্রম ছেড়ে।
রাত থাকতে থাকতেই বড়ো ভোজনকক্ষে ইলাহি নাস্তার আয়োজন হয়েছে। তার মানে হোটেলকর্মীরা তো প্রায় মাঝরাত থেকে বন্দোবস্ত করতে লেগেছেন। তানজানিয়া এবং কেনিয়ার এই হোটেলগুলো বা জঙ্গলের ক্যাম্পগুলোয় এঁরা এইভাবে কাজ করতে অভ্যস্ত। যেহেতু ভোরের দিকে বনের প্রাণিদের নড়াচড়া বেশি তাই বাবুবিবিরাও ভোর ভোর বেরিয়ে পড়তে চান। সুতরাং অন্ধকার থাকতেই ছোটো হাজরি এবং প্যাকড লাঞ্চ তৈরি করে ফেলাই রীতি।
আমি বাদে দলের বাকিরা গোরোঙ্গোরোর গহ্বরে নামছে এই প্রথম। চারপাশের পাহাড়ের দেওয়ালের মাথায় হালকা কুয়াশা জড়ানো। তার মধ্যে দিয়ে সাফারির বাহন আপনাকে নিয়ে নামতে শুরু করলে ‘দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড’ এর কথা, মাইরি বলছি, আপনার মনে পড়ে যেতে বাধ্য। সেই বিস্ময় আর উত্তেজনা ঘন্টা পাঁচেক উপভোগ করার পর স্বাভাবিকভাবেই আমাদের আবার খিদে পেল। আর তারপর আমরা রওনা হলাম সেরেঙ্গিটির দিকে। বেলা বেড়ে ভালোই গরম, তার মধ্যে প্রান্তরের চওড়া কিন্তু কাঁচা, খানাখন্দ ভরা রাস্তা দিয়ে সেই পড়িমড়ি ছুটের কথা যত কম বলা যায় ততই ভালো।
মহুয়াদি একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন গতদিনের হাড় ভাঙো-ভাঙো যাত্রায়। আমরা তাই ঠিক করলাম প্রথা ভেঙে আমরা সকালে বেরিয়ে লাঞ্চ-এ একবার ফিরে আসব। বিকেলবেলার যাত্রায় থাকব আমরা অদম্য তিনজন।
বিকেলবেলা তো যা হোক দুনিয়ার পশুপাখি আমাদের দেখে যা আমোদ পাওয়ার পেল কিন্তু আসল মজা হল সেদিন রাত্তিরে। সবাই খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ার পর সারাদিন চষে যে-সিংহ মহারাজের আমরা দেখা পাইনি তিনি স্বয়ং ক্যাম্পে এলেন দেখা করতে। কলিং বেল ছিল না বলে খাওয়ার তাঁবু আর এক নম্বর তাঁবুর মাঝখানে বসে ঘণ্টা দুই ডাকাডাকি করে তিনি ক্ষান্ত হলেন। আলো যখন ফুটি-কি-না-ফুটি হয়েছে বড়ো টর্চ হাতে তাঁবুর বারান্দায় আসতেই মাসাই প্রহরী তাঁর হাতের টর্চ জ্বালিয়ে ইশারা করে সামনের দিকে ফেলতেই দেখতে পেলাম একটি বাদামি পিঠ আর পিঙ্গল কেশরের আভাস অপস্রিয়মান। বুঝলাম রাজদর্শন দিয়ে দিন শুরু হয়েছে যখন আজ আর কোন চিন্তা নেই।
ওলগাটুনি থেকে বিস্তর হাসি আলিঙ্গন বিনিময় করে আমরা রওনা দিলাম মাসাই মারা-র উদ্দেশ্যে। ইনোসেণ্ট সীমান্ত অবধি আমাদের দেখভাল করবে। তারপর নতুন চালক, নতুন গাইড। সীমান্তের নাম ইসাবেনিয়া। বন ছাড়িয়ে হাইওয়েতে পড়ার পর সাদামাটা গাঁ-গঞ্জের মধ্যে দিয়ে আমরা চলেছি সীমান্তের দিকে। রবিবারের অলস সকাল। আমাদের সচকিত করে এক গলি থেকে বেরিয়ে এল এক শ্বেতাম্বর, সহাস্য, সুদৃশ্য মিছিল, ক্রুশ হাতে গান গেয়ে নাচতে নাচতে মিছিল চলেছে গঞ্জের গির্জার দিকে। আমাদের দেখে সবাই হাসিমুখে হাত নেড়ে বিদায় জানাল। ধর্মের অনুগামীরা এত স্বতঃস্ফূর্ত অহিংস সজীবতা দেখাতে পারে দেখে ভারি ভালো লাগল।
সীমান্তে কড়াকড়ি তেমন নেই। একটা বড়ো কম্পাউন্ডের এধারে একটা বড়ো বাড়ি। তার পাশে বড়ো পার্কিং-এর জায়গা। সেখানে আমাদের গাড়ি এসে দাঁড়াবার পর ইনোসেন্ট আমাদের কেনিয়ান সারথিকে ফোন করে ডাকতেই তিনি তাঁর গাড়িটা নিয়ে এসে আমাদের একদম পাশে লাগিয়ে দিলেন। ওঁরা দুজনে যতক্ষণে এ-গাড়ি থেকে ও-গাড়িতে সব মাল চালান করছেন আমরা বাড়িটার মধ্যে ঢুকে পাসপোর্টে বেরোবার ছাপ্পা লাগিয়ে আনলাম। আরেকটু এগিয়ে গিয়ে নতুন গাড়ি আমাদের কেনিয়ান সীমান্ত চৌকি, অর্থাৎ আরেকটা একতলা বাড়ির সামনে নিয়ে এল। খুব সামান্য দেখেশুনে তাঁরা আবার প্রয়োজনীয় ছাপটাপ মেরে আমাদের কেনিয়া প্রবেশের অনুমতি দিয়ে দিলেন।
আমাদের নতুন গাইডের নাম ডেভিড। খুব পোড় খাওয়া লোক। সীমান্ত চৌকি লাগোয়া একটা কাফেটেরিয়া দেখিয়ে বললেন রাস্তায় আর তেমন ভালো খাওয়ার জায়গা নেই, ওখানেই বসে খেয়ে নিতে। উনি যে-ক্যাম্পে আমাদের নিয়ে যাবেন তারা আমাদের লাঞ্চ প্যাক করেই দিয়েছিল। কাফেটেরিয়ার কফি ইত্যাদি সহযোগে সেটা আমরা সাবড়ে দিলাম। আমরা স্থানীয় সিম কার্ড নিতে চাই শুনে ডেভিড বললেন ঠিক বাইরেই একটা জায়গায় সেটা পাওয়া যাবে, তবে জায়গাটা ঘিঞ্জি এবং সব সীমান্তের মতো এখানেও উটকো লোকেদের একটা ভিড় আছে। একটু সাবধানে আর তাড়াতাড়ি করে ব্যাপারটা সমাধা করে নিতে হবে। সত্যিই নানা কিসিমের লোক আমাদের ছেঁকে ধরেছিল, তবে ডেভিডের অভিভাবকত্বে আমরা কোনো বিপর্যয় ছাড়াই কাজটা সেরে ফেললাম।
এখানেও ক্যাম্পে পৌঁছতে সন্ধে নামল। মাসাই মারা-র এই প্রান্তে আমরা কখনো থাকিনি। এখানেও প্রথমে ঢুকেই একসাথে খাওয়ার জায়গা আর রিসেপশন। নানা পথরেখা ধরে এগিয়ে গিয়ে বিভিন্ন নম্বরের তাঁবু। জঙ্গল বেশ ঘন বলে তাদের অবস্থান এখান থেকে দেখা যাচ্ছে না। প্রথমিক আপ্যায়নের পরে আমাদের তাঁবু নির্দিষ্ট হল। এবার আমাদের দুটো তাঁবু সামান্য তফাতে। সৌভাগ্যবশত সদ্য কেনা সিমকার্ড ভালোই কাজ করছে। সমন্বয়ের অসুবিধা হবে না।
পরের দিন ভোরে ডেভিডের সঙ্গে দেখা হতে বললাম তিনটে সাধারণ জিনিস শুধু দেখতে চাই চিতার শিকার, প্রাণিকুলের নদী পেরোনো আর দলবল পরিবার সহকারে সিংহ মশাই। ডেভিড ঝুনো লোক। মৃদু হেসে খালি বলল দেখা যাক।
আমরা নামলাম নিরাপদেই। সেখানে থেকে একটু দূরে সারি টেবিল পেতে খানাপিনার আয়োজন, বেলুন চড়ার মাশুলে এর মূল্য ধরা আছে। সেখানে বাড়তির মধ্যে রয়েছে শ্যাম্পেন। বাপের জন্মে আর কোনো বাঙাল ওই সাতসকালে শ্যাম্পেন দিয়ে আচমন করেনি এ আমি বাজি রেখে বলতে পারি। আর যে করেছে সে বেলুনে চড়েছিল।