এক একটা বই থাকে যারা যেন সময়কে অতিক্রম করে চিরকালীন হয়ে যায়। সমাজের বিশেষ বিশেষ সংকট মুহূর্তে সেই বইগুলো তখন যেন আর শুধুমাত্র ছাপা কাগজের বই থাকে না, এক একজন মেরুদণ্ড সোজা রাখা, প্রাণবান, তেজী মানুষ হয়ে ওঠে আর সমাজকে চলার নতুন পথ দেখায়। অস্থির পথ হাতড়ানো সময়ে রাস্তা খুঁজতে চাওয়া নতুন যুগের মানুষেরা সেইসব বইয়ের আলোয় নিজেদের বেঁচে থাকার দিশা খুঁজে নিতে প্রয়াস করে।
এইসব কথাগুলো মনে হল একশো বছরেরও আগে লেখা পুরনো একটি বইকে নতুন করে পড়তে গিয়ে। বইটির নাম হল 'মহান পুরুষদের সান্নিধ্যে'। লেখক শিবনাথ শাস্ত্রী।
শিবনাথ শাস্ত্রী ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর সারস্বত সমাজের এবং সামাজিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের একজন প্রধান ব্যক্তিত্ব। সংস্কৃত কলেজের এই প্রবল মেধাবী ছাত্রটি ব্যক্তিগত জীবনে প্রথমে হেয়ার স্কুলের হেড পণ্ডিত এবং পরে সাউথ সুবার্বান স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। শিবনাথ শাস্ত্রীর মূল পরিচয় ছিল যে তিনি ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের একজন নেতা। সে যুগে সামাজিক সংস্কারের ক্ষেত্রে ব্রাহ্মসমাজের একটি বিশিষ্ট ভূমিকা ছিল। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে মতাদর্শগত দ্বন্দ্বে যখন কেশব চন্দ্র সেন আদি ব্রাহ্মসমাজ ভেঙে বেরিয়ে এসে যখন নিজেদের নতুন সমাজ তৈরি করেন, শিবনাথ শাস্ত্রী ছিলেন তাঁর অন্যতম প্রধান সহযোগী। আবার পরবর্তীকালে যখন কেশব চন্দ্র সে্নের সঙ্গে মূলত তাঁর নাবালিকা কন্যার কোচবিহার রাজপরিবারে বিয়ে দেওয়া এবং পৌত্তলিকতার প্রতি আকর্ষণ, কীর্তন করা ইত্যাদি নিয়ে ব্রাহ্মসমাজের মধ্যে বিরোধ বাঁধে, তখন শিবনাথ আবার সেখান থেকেও বেরিয়ে এসে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ সৃষ্টি করেন।
এই ইতিহাসটুকু তুলে ধরলাম এই কারণে যে এই প্রেক্ষাপটটুকু মাথায় রাখলে এই বইটিকে বুঝতে সুবিধা হবে। শিবনাথ শাস্ত্রী সারা জীবন ধরে অজস্র লিখেছেন, তাঁর লেখা একটি বিখ্যাত বই 'রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন ব্রাহ্মসমাজ' এখনও কেউ কেউ খুঁজে নিয়ে পড়ে। এটি ইংরেজিতে লেখা তাঁর বই 'Men I have seen'-এর বাংলা অনুবাদ, পঞ্চাশের দশকের আরেকজন কবি নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় মূল ইংরেজি বইটি থেকে অনুবাদ করেছেন।
মূল বইটি একটি স্মৃতিচারণামূলক লেখার সংকলন। তাঁর সময়ের সাত জন বিখ্যাত মানুষ, যাঁদের তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন, যেমন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস, ডা. মহেন্দ্রলাল সরকার, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজনারায়ণ বসু, আনন্দমোহন বসু, দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ ইত্যাদি, তাঁদেরকে নিয়ে লেখা অন্তরঙ্গ স্মৃতিচারণের সংকলন হল এই বইটি। সে যুগের বিখ্যাত সম্পাদক রামানন্দ বন্দোপাধ্যায় তাঁর 'Modern Review' পত্রিকায় নিজের আগ্রহে এই লেখাগুলি একসময়ে প্রকাশ করেছিলেন।
আসলে এই নামগুলি এমন যে এঁদের কাউকেই শিক্ষিত মানুষের কাছে আর নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কোনো দরকার পড়ে না। কিন্তু শিবনাথ শাস্ত্রীর এই লেখাগুলির একটি বিশেষত্ব আছে, সেটা হল তাঁর দেখার চোখ। শিল্পীরা, বিশেষ করে যারা পোর্ট্রেট আঁকেন, যেমন পেন্সিলের আঁচড়ে বা তুলির রং-এ একটা মানুষের ভেতরের মানুষটাকে তাঁর ছবির মধ্যে ফুটিয়ে তোলেন, শিবনাথ শাস্ত্রীও সেই রকম তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে এই লোকগুলোর একেবারে ভেতরের মানুষটাকে পাঠকের চোখের সামনে তুলে এনেছেন। ফলে এই লেখাগুলো পড়তে পড়তে আমরা যেন এইসব মহান পুরুষদেরই চোখের সামনে কথা বলতে দেখতে পাই। তাঁরা তখন কিন্তু আর দেবতা হয়ে পুজো করার মনীষী থাকেন না, রক্তমাংসের মানুষ হয়ে ওঠেন। তাঁদের যেমন স্থির বিশ্বাস আছে, আবার তেমন দ্বন্দ্ব আছে, প্রশ্নও আছে। শিবনাথ তাঁদের কারও বন্ধু, কারও ছাত্র, কারও আবার শিষ্য। বাংলার নবজাগরণের এই সব বিখ্যাত পুরোধা পুরুষদের আমরা শিবনাথের সঙ্গে গল্প করতে, কথা বলতে, তর্ক করতে দেখতে পাই।
কিছু কিছু অদ্ভুত তথ্যও জানা যায় এই বইটি থেকে, যা সাধারণত জীবনীগ্রন্থে লেখা হয় না। যেমন বিদ্যাসাগর খুবই রসিক মানুষ ছিলেন, ছোটোদের পেছনে লাগতে খুব ভালোবাসতেন। এই হয়তো কারুর উপর প্রচণ্ড রেগে গেলেন, আবার পরে মাথা ঠান্ডা হয়ে গেলে তাকেই অকাতরে ক্ষমা করে দিতেন, কোনোদিন রাগ পুষে রাখতেন না। শিবনাথের ছোটোবেলায় তাঁদের বাড়িতে তাঁর মামার সঙ্গে গল্প করতে এসে দু-আঙুলে মোটাসোটা শিবনাথের ভুঁড়িতে আঙুল দিয়ে খোঁচা দিয়ে মজা করতে ভালোবাসতেন। ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার তখনকার দিনে অত ব্যস্ত ডাক্তার এবং প্রবল জ্ঞানী মানুষ হওয়া সত্ত্বেও শিবনাথের মতো অনামী, অজানা তরুণের কাছে নিজের ভুল স্বীকার করে যেতেন। রামকৃষ্ণদেবের ভাগ্নে হৃদয় বড়লোক শিষ্যদের কাছ থেকে মামার নাম ভাঙিয়ে টাকাকড়ি চাইতেন বলে শিবনাথের সামনেই রামকৃষ্ণদেব তাকে প্রবল তিরস্কার করতেন। হিমালয়ের উচ্চতার এমন ঝকঝকে মানুষদের এমন অজস্র ছোটোখাটো ঘটনা এই বইটিতে আছে, যা থেকে আমরা তাঁদের হীরেকাটা আলোর মতো হৃদয়কে দেখতে পাই, বুঝতে পারি।
এর বাইরেও আরেকটি বিষয় আছে যার জন্য এই বইটি আজও গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক। সেটা হল ব্যক্তিগত মতাদর্শগত বিরোধের ঊর্ধ্বে উঠে একজন মানুষের আরেকজন মানুষের প্রতি অকুন্ঠ শ্রদ্ধা ও সম্মান দেখানো, যা এই একবিংশ শতাব্দীর, বাইরে আলো ঠিকরানো অথচ ভিতরে দীর্ণ থেকে দীর্ণতর সভ্যতায় ক্রমশ বিরল থেকে বিরলতর হয়ে পড়ছে।
এই বিষয়ে দুজন মানুষের কথা আলাদা করে একটু বলা দরকার। প্রথমজন হলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ব্রাহ্মসমাজের মতাদর্শগত যে অভ্যন্তরীণ বিতর্কে প্রথম ভাঙ্গন ঘটেছিল, তার মূলে ছিল মহর্ষির সঙ্গে ব্রহ্মবান্ধব কেশবচন্দ্র সেনের বিরোধ, এবং সেই বিরোধে কেশবচন্দ্রের পক্ষে একজন প্রধান সহযোগী ছিলেন শিবনাথ শাস্ত্রী। অথচ মহর্ষি সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে শিবনাথের মধ্যে কিন্তু তাঁর প্রতি এতটুকু অসূয়া নেই। লেখার প্রতিটি ছত্রে তাঁর সম্বন্ধে প্রবল শ্রদ্ধাই যেন বর্ষিত হয়েছে। আবার এরকমও নয় যে তিনি তাঁদের সঙ্গে মহর্ষির বিরোধের বিষয়টিকে এড়িয়ে গেছেন। নিজেদের মতের কথা বলেছেন, তাঁদের সঙ্গে দেবেন্দ্রনাথের বিরোধের কথাও বলেছেন, আবার এটাও বলেছেন যে সেই বিরোধের উপরে উঠে শিবনাথ বা কেশবচন্দ্রের প্রতি ব্যক্তিগত স্তরে মহর্ষির গভীর স্নেহ ও ভালোবাসার কথা, পারস্পরিক সম্পর্কের মাধুর্যকে মতাদর্শগত বিরোধের কারণে ক্ষুন্ন হতে না দেওয়া। যেমন একটা ঘটনার কথা শিবনাথ বিস্তৃত করে লিখেছেন। শিবনাথ শাস্ত্রীরা তাঁদের নতুন সমাজভবনের প্রতিষ্ঠার জন্য মহর্ষির কাছে চাঁদা চাইতে গেছেন, আর মহর্ষি আগে তাঁদের পেট ভরে ভালো-মন্দ খাইয়ে তারপর আশাতীত অংকের অর্থসাহায্য করেছেন। অজস্র মতভেদের উপরে উঠে সেই কথা জানাতে শিবনাথ কিন্তু ভোলেননি।
আর একজন হলেন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস। মনে রাখতে হবে শিবনাথ শাস্ত্রী ছিলেন একেশ্বরবাদী ব্রাহ্ম, পৌত্তলিকতার বিরোধী আর শ্রীরামকৃষ্ণ কালী সাধক। শ্রীরামকৃষ্ণের যে ছবিটি শিবনাথ এঁকেছেন তা বড়ই হৃদয়গ্রাহী। রামকৃষ্ণ ছিলেন একজন শিশুর মতো সরল মনের মানুষ, যিনি তাঁর পছন্দের মানুষদের, বন্ধুদের প্রবলভাবে ভালবাসতে পারতেন, একেবারে আপন করে নিতেন। শিবনাথকে তিনি এত ভালবাসতেন যে কিছুদিন না এলেই ঠাকুর লোক পাঠিয়ে বার বার তাঁর খোঁজ নিতেন, ডেকে পাঠাতেন, আবার অনেকদিন বাদে এলে প্রবল অভিমানও করতেন। শিবনাথ রামকৃষ্ণের কাছে যাওয়া কমিয়ে দিয়েছিলেন থিয়েটারের জগতের লোকদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতার কারণে। আবার তাঁর অসুখের খবর পেয়ে সব বিরোধ ভুলে গিয়ে ছুটেও গিয়েছিলেন তাঁর কাছে।
আজকের এই সময়ে আমাদের সবায়েরই আসলে একটা যেন দলের প্রয়োজন। আমরা সবাই নিজেদেরকে কোনো না কোনো দলের মধ্যে দেখতে ভালোবাসি। আর এই দলের বাইরের সবাই আমার শত্রুপক্ষ। এই দলগুলোর নাম কখনো হিন্দু-মুসলমান, কখনও সি. পি. এম., কংগ্রেস, কখনো ভারত-পাকিস্তান, কখনো ব্রাহ্মণ-দলিত, আবার কখনও বা নিছক এ পাড়া, ও পাড়া। আমার দলের লোক হলে সবকিছুই ঠিক, আবার অন্য দলের লোক হলে, তা সে যত ভালোই হোক তার সবকিছুই খারাপ, পরিত্যাজ্য, বর্জনযোগ্য। আমার দলের লোক চুরি করলেও চোর নয়, খুন করলেও খুনি নয়, এমনকি ধর্ষণ করলেও তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয়। আবার অন্য দলের লোক হলে তার সবকিছুই ক্ষমাহীন অপরাধ, তাকে বিনা বিচারে হত্যা করা যায়, তার বোনকে ধর্ষণ করা যায়, তার মতবাদকে ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়া যায়। আমরা কেওই আমাদের স্মৃতিতাড়িত ব্যক্তিগত বিদ্বেষের ওপরে যেন উঠতে পারছি না। যখনই আপনি আমার মতের বাইরে বা মতের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলছেন, আপনি আমার শত্রুপক্ষ হয়ে যাচ্ছেন। আপনাকে আমি আর সহ্য করতে পারছি না। শিবনাথ শাস্ত্রী যেন এই প্রচলিত ধারণাগুলোর ওপরেই আঘাত করতে চেয়েছেন। অথচ তাঁর স্বর শান্ত ও সমাহিত। প্রতিবাদ উঁচু গলায় চেঁচিয়ে নয়, মৃদু স্বরে অথচ স্পষ্টভাবে। আজকের এই অসহিষ্ণু সময়ে সেই কারণেই এই বইটির কাছে আমাদের ফিরে আসা জরুরি।