আসুন এই কবির একটা কবিতা পড়ে তাঁর সঙ্গে পরিচিত হই:
তোমার স্তনদুটো কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে
ক্ষতগুলো নিষ্প্রভ হয়ে আসে
কয়েক বছর পরে যেমন হয়
যে নারীদের সঙ্গে আমি মেয়েবেলা কাটিয়েছি
তারা সবাই অর্ধনগ্ন
সূর্যালোকিত টিলার ওপরে বসে
আমরা একে অন্যের পানে তাকাই
লজ্জাহীনা
আর তুমিও খুলে ফেললে ব্লাউজ
নিজের থেকে তুমিও চাওনি
তোমার কাটা-ছেঁড়া, অসম্পূর্ণ
মুছে দেওয়া শরীরকে মেলে ধরতে
আমি তাকাতেও পারি না
আমার দৃষ্টি পড়লে ঝলসাবে তোমার বুক
যদিও আমি চিরদিন ভালোবাসবো তোমায়
যেখানে তোমার স্তনদুটো বিরাজ করত একদিন
আঙুল বোলাতে খুব ইচ্ছে করে সেখানে
কিন্তু তা করে উঠতে পারিনি কোনওদিন
কবিতার নাম “চল্লিশ পেরিয়ে মৃত এক নারী”, বিষয়--স্তনের ক্যানসারে মৃত এক নারীর স্মৃতি এবং কবি--সর্বদা নিজের সঙ্গে যুদ্ধরত, নারীবাদী না হয়েও নারীবাদের প্রতীক এড্রিয়েন রিচ। গত দু দশক তিনি বাস করতেন ক্যালিফোর্নিয়ায়, আমার শহর থেকে মাইল পঞ্চাশ দূরে, গাছপালায় ঘেরা একটি পাহাড় পেরিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের কোলে সান্তা ক্রুজ শহরে; ৬৩ হাজার অধিবাসীর এই শহরে রয়েছে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এক বিশ্ববিদ্যালয় আর প্রচুর সংখ্যায় প্রতিবাদী বুদ্ধিজীবী। দেশটি ঘোর পুঁজিবাদী হলে কি হবে, এই শহরে এখনও মিছিল বেরোয় মে দিবসে আর নিয়মিতভাবে দেখানো হয় সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র।
এড্রিয়েন সেসিল রিচ এর জন্ম আমেরিকার মেরিল্যান্ড রাজ্যের বাল্টিমোর শহরে মে ১৬, ১৯২৯। বাবা আর্নল্ড রাইস রিচ সেই শহরের এক ডাকসাইটে চিকিৎসক এবং জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের বিকারতত্ত্ব অথবা প্যাথোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান। মা হেলেন এলিজাবেথ রিচ এক প্রতিভাময়ী কনসার্ট পিয়ানোবাদক এবং সুরকার। বাবা ইহুদি এবং মা খ্রিস্টান এড্রিয়েন এবং তাঁর ছোটো বোন বড়ো হন খ্রিস্ট ধর্মের প্রভাবে। তাঁর জন্মের বছরেই প্রকাশিত হয় ভার্জিনিয়া উল্ফ (১৮৮২-১৯৪১)-এর দীর্ঘ ও যুগান্তকারী প্রবন্ধ “তার নিজস্ব ঘর”--নারীর রচিত সাহিত্য নিয়ে প্রতিবেদন। তাঁর মতে, কথাসাহিত্য লেখায় হাত দেবার আগে নারীর প্রয়োজন জীবনধারণের জন্যে যথেষ্ট অর্থ এবং নিজস্ব একটি ঘর। নারীর সাহিত্য হ’ল এমন একটা ঘর যেখানে এর আগে কেউ কোনওদিন যেতে পারেনি; এবং সেই ঘরটা হল মেয়েদের মধ্যে সম্পর্কের এলাকায়। রিচ বিচরণ করেন সেই এলাকায় তাঁর লেখক জীবনে--কবিতা আর মননশীল প্রবন্ধের মাধ্যমে। বাবার বিশাল লাইব্রেরিটি ছিল তাঁর অনুপ্রেরণার ক্ষেত্র এবং তাঁকে দিয়েছিল বুনিয়াদী প্রয়োগকুশলতার শিক্ষা; ব্লেক, কিটস, রসেটি ও টেনিসন পড়ে তাঁর উৎসাহ জাগে কবিতায়; প্লুটার্ক, হ্যাভলক এলিস ও স্পিনোজা গড়ে দেন তাঁর দার্শনিক ভিত্তি। চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত বাড়িতেই লেখাপড়া করেছেন দুই বোন মায়ের কাছে--বাবা উৎসাহ দিতেন নিয়মিত কবিতা পড়তে ও লিখতে। বাবার ওই লাইব্রেরিতেই গড়ে ওঠে তাঁর সাহিত্যনিষ্ঠা এবং অদম্য আত্মবিশ্বাস--হতে পারে এক শিশুর সরল বিশ্বাস অথবা এক কবির গভীর বিশ্বাস--যে ওই ছাপানো, সুদৃশ্য পৃষ্ঠাগুলি তাঁকে শেখাতে পারে নারী হিসেবে কিভাবে বাঁচা যায় পুরুষের এই পৃথিবীতে, তাঁকে বলতে পারে কি কি ঘটা সম্ভব। কিন্তু শেখাতে পারে না নারীর সঙ্গে অন্য নারীর সম্পর্ক বিষয়ে; সেই বিষয়ে তারা নীরব, এমিলি ডিকিনসনের (১৮৩০-১৮৮৬) ভাষায়--‘পর্দার আড়ালে মুখ লুকোয় সব ধ্রুপদী সাহিত্য’।
পঞ্চম শ্রেণী থেকে স্থানীয় মেয়েদের স্কুল--সেখানে রোল মডেলের অভাব নেই--অনেক শিক্ষিকাই স্বাধীন, অবিবাহিত, ব্যক্তিত্বসম্পন্না এবং শিক্ষকতায় নিবেদিত--বালিকা এড্রিয়েনের অনুপ্রেরণা তাঁরা। ১৯৪৭ সালে স্কুলের পাঠ সমাপ্ত করে তিনি গেলেন ভুবনবিখ্যাত নারীশিক্ষার প্রতিষ্ঠান ম্যাসাচুসেটস রাজ্যের র্যাডক্লিফ কলেজে--পড়লেন সাহিত্যতত্ত্ব, কাব্য এবং সৃজনশীল সাহিত্য--কিন্তু সেখানে নারী অধ্যাপক প্রায় নেই বললেই চলে। রোল মডেলের অভাব সত্ত্বেও সংবেদনশীল কবিতার ঢল নামলো। ১৩০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে কানেটিকাট প্রদেশের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়; সেখানে বসে ডবলিউ.এইচ. অডেন (১৯০৭-১৯৭৩) সম্পাদনা করেন “ইয়েল তরুণ কবি সিরিজ”; প্রতি বছর একজন আনকোরা, অপ্রকাশিত কবিকে পুরস্কার দেওয়া হয় এবং প্রকাশ করা হয় তাঁর প্রথম বই--ভূমিকা লেখেন অডেন সাহেব নিজে। ১৯৫১ সালের নির্বাচিত কবি চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী এড্রিয়েন, তাঁর কবিতাগ্রন্থের নাম “পৃথিবী পালটে যায়” (A Change of World)।
কলেজ শেষ করার পরে তিনি গুগেনহাইম জলপানি নিয়ে এক বছরের জন্যে গেলেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে। কিন্তু বছরের মাঝখানে ফ্লোরেনস শহরে বেড়াতে গিয়ে এত ভালো লেগে গেল ইতালি--সেখানেই থেকে গেলেন বাকি সময়টা কবিতা লেখায় এবং ভ্রমণে। তাঁর সতীর্থ ও পরম বান্ধব অ্যালফ্রেড হাসকেল কনরাড (১৯২৪-১৯৭০) ততদিনে অর্থনীতির গবেষণা সমাপ্ত করে হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় যোগ দিয়েছেন।
১৯৫৩ সালে তাঁদের বিবাহ এবং পিঠোপিঠি তিনটি পুত্রসন্তান ১৯৫৫ সালে ডেভিড, ১৯৫৭ সালে পাবলো এবং ১৯৫৯ সালে জেকব। সেই তুমুল ব্যস্ততার ফাঁকেই দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ “হিরে কাটে যারা” (The Diamond Cutters and Other Poems, প্রকাশ ১৯৫৫)--পরবর্তীকালে তাঁর নিজের মতেই বইটি প্রকাশের অযোগ্য। বিবাহিত জীবন সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য--আমি চেয়েছিলাম পরিপূর্ণ নারীর জীবন--আমার প্রথম পরিবারে তা সম্ভব ছিল না--তাই সেখান থেকে বেরিয়ে নতুন সম্ভাবনার সন্ধানে যাওয়া।
১৯৬০-এর দশাব্দের সূচনায় বিপুল পরিবর্তন এল তাঁর জীবনে; ১৯৬০ সালে তিনি পেলেন জাতীয় শিল্প ও সাহিত্য সংস্থার বিশেষ পুরস্কার; ১৯৬১ সালে দ্বিতীয়বার গুগেনহাইম জলপানি নিয়ে এক বছরের জন্যে হল্যান্ডে গেলেন এবং ওলন্দাজ ভাষা থেকে কবিতার ইংরেজি অনুবাদের কাজে লাগলেন। ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হ’ল নারীবাদী ভাবনার কাব্যগ্রন্থ “বৌমার তোলা ছবিগুলি” (Snapshots of a Daughter-in-Law: Poems 1954-1962 )। সমালোচনার ঝড় উঠলো--বিরূপ এবং গভীর, ব্যক্তিগত প্রসঙ্গের অবতারণার কারণে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে “ব্যক্তিগত” মানে “পবিত্র” নয়, তা পরিত্যাজ্য; কবি নিজেও পিছিয়ে এলেন তাঁর অবস্থান থেকে। অবশ্য তার আগেই ঘটে গেছে তাঁর কবিজীবনের জলবিভাজিকা মুহূর্ত।
১৯৬০ সালের এক বৃষ্টিসিক্ত বসন্তের দিনে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এলেন সান ফ্রানসিসকোর কবি রবার্ট ডানকান (১৯১৯-১৯৮৮)। তিনি আলোচনা করতে চান কবিতা নিয়ে, কিন্তু এড্রিয়েনের শিশু সন্তানটি অসুস্থ--একবার তাকে কোলে নেন, আবার বসিয়ে দেন হাই চেয়ারে--তার ফাঁকে চা বানিয়ে খাওয়ালেন কবিকে। কিন্তু কবিতার কথা বলার ফুরসত কই? সেদিন তিনি উপলব্ধি করলেন যে কবিতায় নারীর যে রূপকল্প, তার সঙ্গে রক্তমাংসের নারীর কোনও সম্পর্ক নেই। দু দশক পেরিয়ে তিনি লিখবেন এই ঘটনাটির উল্লেখ করে, কিভাবে তিনি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন এক নতুন যুগের নারীকে কবিতায় উপস্থাপিত করার জন্যে।
ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে ১৯৬০ দশাব্দের বামপন্থী আন্দোলন ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরোধিতা, কৃষ্ণকায় মানুষের মানবাধিকার এবং নারীমুক্তির দাবিতে। কবি ঝাঁপিয়ে পড়লেন তিনটি আন্দোলনেই--মিছিল, বক্তৃতা, অবরোধ ও প্রচারে। তার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা এবং তিনটি কাব্যগ্রন্থ--“জীবনের যা আবশ্যকতা” (Necessities of Life, ১৯৬৬), “ইস্তেহার” (Leaflets: Poems 1965-1968, ১৯৬৯) এবং “পরিবর্তনের ইচ্ছে” (The Will to Change: Poems 1968-1970, ১৯৭১)। নানা কারণে স্বামীর সঙ্গে দূরত্ব বাড়লো--বিয়ে ভাঙলো ১৯৭০ সালের মাঝামাঝি এবং অক্টোবর মাসে কনরাড গাড়ি চালিয়ে গেলেন ভারমন্ট রাজ্যের নির্জন অরণ্যে এবং নিজেকে গুলি করে আত্মহত্যা করলেন। তাঁর মৃতদেহ খুঁজে পেয়ে শনাক্ত করেন সতীর্থ কবি ও পোয়েট্রি পত্রিকার এক সময়ের সম্পাদক হেডেন কারুথ (১৯২১-২০০৮)।
হার মানলেন না এড্রিয়েন--তিনটি সন্তানকে নিয়ে ছোটো একটি ফ্ল্যাটে রাজনৈতিক কাজকর্ম, চাকরি এবং কবিতা। স্বামীর সঙ্গে সমস্যায় তিরিশ বছর বয়েসে আত্মহত্যা করেছিলেন সিলভিয়া প্লাথ (১৯৩২-১৯৬৩); একাকিত্ব এবং মনোবিকলনের শিকার হয়েছিলেন অ্যান সেক্সটন (১৯২৮-১৯৭৪); কিন্তু নিজেকে ভেঙে পড়তে দিলেন না কবি--পারিবারিক ও মানসিক দ্বন্দ্ব সত্ত্বেও তিনি চালিয়ে গেলেন জীবনযাত্রা এবং কাজকর্ম। কনরাডের আত্মহত্যার জন্যে দায়ী করা হল তাঁকে--তিনি উত্তর দিলেন গভীর, সাবলীল, নারীবাদী কবিতায়। তাঁর ভাষা হয়ে উঠলো ষড়যন্ত্রমূলক অথচ বিধ্বংসী। ইংরেজি ভাষা অত্যাচারীর ভাষা, কিন্তু ভগিনীদের সঙ্গে কথোপকথনের জন্যে এই ভাষা ছাড়া আর উপায় কী? তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটল সমকামী নারী হিসেবে। ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত “গাড়ি চালিয়ে ধ্বংসের দিকে” (Diving into the Wreck: Poems 1971-1972) কাব্যগ্রন্থে পুরুষতন্ত্রের ধ্বংসস্তূপ থেকে নারীজীবনের মুক্তির বাসনা। ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত “এজমালী ভাষার স্বপ্ন” (The Dream of a Common Language: Poems 1974-1977) গ্রন্থে বিকশিত সমকামী নারীর কামনা, বাসনা ও যৌনতার জীবন্ত বহি:প্রকাশ:
এড্রিয়েন রিচ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, (১৯১৯-২০১২)
তোমার স্তনের ওপরে উড়ন্ত আমার মুখ
তোমার স্তনের ওপরে উড়ন্ত আমার মুখ
শীতের ছোট্ট ধূসর বিকেল
এই শয্যায় আমাদের একহারা তনু
স্পর্শে বিহ্বল উত্তেজনার আনন্দময় তাপে হতবাক
দৃঢ় অথচ কোমল একে অপরকে ঘিরে
বাহুবন্ধনে খেলি আমরা দিবসের মোমবাতি
অদ্ভুত আলো জ্বালে যদি বাইরে ধরায়
তুষার পড়তে শুরু করে গাছের ডালপালা ভরিয়ে
দিন ফুরিয়ে রাত আসে জানান না দিয়ে
চলবে আমাদের শীতের প্রমোদ
হহাৎ, উদ্দাম ও কোমল তোমার অঙ্গুলি
যেখানে থাকা উচিত আমার জিভের যা করা উচিত
এক মুহূর্ত থেমে তোমার রসিকতায় হাসি
হে প্রেম তোমার উষ্ণ সুগন্ধ শীতের কামনায়
১৯৬৭ সালে প্রকাশিত “এজমালী ভাষার স্বপ্ন” কাব্যগ্রন্থ থেকে।
********
এড্রিয়েন ভালবেসেছেন দুই নারীকে--একজন শ্বেতাঙ্গী আর অন্যজন কৃষ্ণাঙ্গী। তাঁদের কন্ঠে তিনি শুনেছেন প্রথম প্রেমের গান, প্রথম মাধুর্যের কাহিনীগুলি। তাঁদের হাতে অনুভব করেছেন কোমলতা আর আবেগের প্রাথমিক জ্ঞান। যে অনুভূতি তিনি প্রায় দু দশকের দাম্পত্য জীবনে অথবা তিনটি সন্তানের জন্ম দিয়ে পাননি। পিতার কাছে, স্বামীর কাছে পেয়েছেন সাদা চামড়ার আর পৌরুষের সংস্কৃতি। ১৯৭০-এর দশাব্দ থেকে তাঁর জীবনের লক্ষ্য হবে নারীর এবং বিশেষ করে সমকামী নারীর জীবনযাত্রা এবং তাঁদের প্রতি সমাজের অত্যাচারকে সাহিত্যের পুরোভাগে তুলে আনা। “বয়:সন্ধির বয়েস থেকে একজন লেসবিয়ান লুকিয়ে ছিল আমার অন্তরে--এতদিনে শুরু হ’ল তার সজোরে হাত পা নাড়া।” ১৯৭৬ সাল থেকে জ্যামাইকান-আমেরিকান কথা সাহিত্যিক মিশেল ক্লিফ (১৯৪৫-২০১৬) তাঁর জীবনসঙ্গী--দুজনের দাম্পত্য ৩৬ বছরের দীর্ঘ। মিশেলের মৃত্যু এড্রিয়েনের মৃত্যুর চার বছর পরে জুন ১২, ২০১৬।
১৯৭৪ সালে কবির “গাড়ি চালিয়ে ধ্বংসের দিকে” কাব্যগ্রন্থটি “জাতীয় পুস্তক পুরস্কারের” জন্যে মনোনয়নের তালিকায় স্থান পেল। তালিকায় অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন অ্যালেন গিনসবার্গ (১৯২৬-১৯৯৭) তাঁর “আমেরিকার পতন” গ্রন্থের জন্যে। ছিলেন আরও দুই নারীবাদী কবি--অ্যালিস ওয়াকার (১৯৪৪-) এবং অড্রি লোর্ড (১৯৩৪-১৯৯২)। শেষ পর্যন্ত পুরস্কারটি যৌথভাবে রিচ এবং গিনসবার্গকে দেওয়া হল; রিচ কিন্তু নিজের পুরস্কারের টাকাটি ভাগ করে নিলেন দুই ভগিনী কবির সঙ্গে এবং পুরস্কারটি গ্রহণ করলেন আমেরিকার সব নারীদের পক্ষ থেকে--“পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যাদের কন্ঠরুদ্ধ করে রাখা হ’ত এবং এখনও রাখা হয়”। অনেক সমালোচকের মতে এটিই তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতার বই--অত্যাচারিতের ভাষায় লেখা যে কথাগুলো বলে নেওয়া জরুরি। গ্রন্থের নাম-কবিতার কিছু অংশ--
এসেছি আমি এই ধ্বংসাবশেষের
পর্যবক্ষণে।
শব্দগুলোর আমার যাত্রাপথের মানচিত্র।
দেখতে এসেছি ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ
আর যা যা সম্পদ রক্ষা পেয়েছে।
উশকে দিই হাতের প্রদীপ
ধীরে ধীরে দেখতে পাই দুপাশে।
বেশ স্থায়ী একটা অস্তিত্ব গড়ে ওঠে
ধ্বংসভূমির বেড় ধরে ধরে।
আমি দেখতে এসেছি ধ্বংসের ভূমিকে
শুনতে চাই না তার করুণ কাহিনী।
ধ্বংসভূমি সরেজমিনে দেখে কবি ফিরে আসেন, কিন্তু তিনি তখন আর একা নন--সর্বনামের পরিবর্তনে এক নতুন মাত্রা যোগ হয় কবিতার গায়ে। একবচন ও বহুবচনে কবি পুরুষতন্ত্রকে ভেঙে ফেলেন, নারীতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আশায়--
আমরা, মানে আমি, মানে তুমি
ভীরুতা অথবা সাহস--যা নিয়েই হোক
আবার খুঁজে খুঁজে ফেরত আসবো
এই ধ্বংসভূমিতে
সঙ্গে থাকবে ছুরি, ক্যামেরা
আর প্রাচীন এক পুরাণগ্রন্থ, যাতে
আমাদের সকলের নামই অনুপস্থিত।
******
১৯৮৬ সালে শিকাগোর “পোয়েট্রি” পত্রিকা ১ লক্ষ ডলার অর্থমূল্যের “রুথ লিলি কবিতা পুরস্কার প্রদান শুরু করে। প্রথমবার পুরস্কারটি পান এড্রিয়েন রিচ। অনেক পাঠক সমালোচকের চোখ কপালে ওঠে--সারাজীবন তিনি কবিতায় নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে চলেছেন, ত্যাগ করেছেন সংসার, মাতৃত্ব এবং শ্বেতাঙ্গী মার্কিন মানুষ হিসেবে জন্মগত অধিকার। যুদ্ধ করেছিলেন নারীর অধিকারের জন্যে, পৃথিবীজোড়া যুদ্ধের বিরুদ্ধে, ভূমিজ মানুষের অধিকার রক্ষায়, কালো মানুষের মানবাধিকারের পক্ষে। আমেরিকার অন্যতম সেরা কবির সম্মান সেই যুদ্ধেরই অমোঘ পরিণতি।
১৯৯৭ সালে রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটন কবিকে মনোনীত করেন জাতীয় শিল্প পদকের জন্যে। কিন্তু তাঁর সরকার যেহেতু গত কয়েক বছরে ছাঁটাই করেছেন শিল্প ও সাহিত্যের জন্যে সরকারী অনুদান, কবি প্রত্যাখ্যান করলেন সেই সম্মানঃ “I could not accept such an award from President Bill Clinton or this White House, because the very meaning of art, as I understand it, is incompatible with the cynical politics of this administration. Art means nothing, if it simply decorates the dinner table of the power that holds it hostage.”
২০০০ দশাব্দের সূচনায় ইরাক যুদ্ধের প্রাক্কালে আবার নতুন করে যুদ্ধবিরোধীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন তিনি--কবিতায় এবং অন্যান্য কার্যকলাপে। এক নারী যখন সত্যি কথা বলেন, তখন তাঁকে ঘিরে নতুন নতুন সত্যের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। সেই কারণেই মনের কথাগুলো বলে নেওয়া প্রয়োজন অথবা কবিতায় তাদের তুলে ধরা প্রয়োজন। মিথ্যাচার কেবল শব্দের মাধ্যমেই হতে পারে এমন কোনো কারণ নেই, নীরবতার মাধ্যমেও প্রকাশ পেতে পারে মিথ্যে। তিনি লিখে চলেন--রাজনীতি, যুদ্ধের বিরোধিতা, নারীবাদ, অর্থনীতির বৈষম্য, জাতি বিদ্বেষ এবং আরও নানান বিষয়ে। ১৯৮৬ সালে “তোমার দেশ, তোমার জীবন” (Your Native Land, Your Life: Poems), ১৯৯১ সালে “কঠিন পৃথিবীর এক মানচিত্র” (An Atlas of the Difficult World: Poems 1988-1991)--গ্রন্থদুটিতে সমকামের পাশাপাশি উঠে আসে তাঁর ইহুদিত্ব, যে ধর্ম তাঁকে লুকিয়ে রাখতে হয়েছিল প্রথম জীবনে। নিজের কবিতা ছাড়াও তিনি লিখেছেন সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে তাঁর গদ্য, সমকাম ও নারীবাদ নিয়ে গভীর আলোচনা, ইংরেজি অনুবাদ করেছেন মির্জা গালিবের গজলের এবং গ্রিক নাটকের।
অন্তিম দুটি কাব্যগ্রন্থে উপস্থাপিত হয় ক্যালিফোর্নিয়া আর ভারমন্ট প্রদেশের অপরিসীম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য--নতুন পৃথিবীকে গড়ে তোলা, তাকে নতুন করে দেখা। ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয় “ধ্বংসস্তূপের মাঝে বিদ্যালয়” (The School Among the Ruins: Poems 2000-2004) এবং ২০০৭ সালে “গোলকধাঁধায় টেলিফোন বাজে” (Telephone Ringing in the Labyrinth: Poems 2004-2006)। শান্তি এবং নীরবতায় বাস করেন দুই সখী সান্তা ক্রুস শহরে--তাঁদের দেখা যায় সমুদ্রের ধারে বেড়াতে অথবা রাজনৈতিক মিছিলে--একজন বাতে পঙ্গু, অন্যজনের যকৃতের ব্যামো। কিন্তু তাঁরা সুখী। সমসাময়িক “চিরকাল, আবার” কবিতার প্রথম কয়েকটি পঙ্ক্তি:
তোতাপাখিটা চেঁচায়--পালাও! পালাও!
যদি সত্যি সত্যিই পালানো যেত
উড়তে উড়তে আমি গাড়ি নিয়ে এগোই
লম্বা পাহাড়ি পথ বেয়ে সেই বাড়িটা
দরজায় কুইন অ্যান লেসের পর্দা
তাতে ডেইজি ফুলের ছবি--
কাঁধ লাগিয়ে ঠেলতে হয় আটকানো কপাট
হেঁসেলে গয়ে ঝর্নাজলের কল খুলে
ভিজিয়ে নিই তাপিত জিভ
কন্ঠতালু এবং গলা
জানালার শার্সি খুলে পর্দা সরিয়ে দিই
বুক ভরে শ্বাস নিই সদ্য কাটা ঘাসের
পাইন গাছের উষ্ণতার
ছড়ানো সারের লাইলাক ফুলের
মুদির দোকানের বাদামি থলেগুলো খুলে
জিনিসপত্র গোছাই।
মার্চ ২৭, ২০১২ তাঁর মৃত্যু ৮২ বছর বয়েসে। জুন ২০১৬ তাঁর “কবিতা সমগ্র--১৯৫০-২০১২” গ্রন্থের প্রকাশ; সম্পাদনা ও ভূমিকা--ক্লডিয়া র্যাংকিন (১৯৬৩--)। ১২১৬ পৃষ্ঠার মহাগ্রন্থে তাঁর ছয় দশকের কাব্যকৃতি।