‘হারে রে রে রে রেষাট দশকের অপরাহ্ন থেকে সারা সত্তর যুগের বিভ্রান্ত যুব সমাজ যখন রাজনৈতিক, সামাজিক ও অতি অবশ্যই, অস্তিত্বের সঙ্কটের মধ্যেও বনের পাখির মতো মনের আনন্দের মুক্তি-স্বাদের স্বপ্ন-উড়ানে আকাঙ্খিত যাত্রা শুরুর সন্ধানী, পরিচালক শঙ্কর ভট্টাচার্য তখন তাঁর চির-যুবক ছবি ‘দৌড়’ ছবিতে প্রোটাগনিস্ট মুখ হিসেবে মনোনীত করেছিলেন অভিনেতা প্রদীপ মুখোপাধ্যায়কে। সত্তর দশক কোনও লেবেল-সাঁটা মুক্তির দশক হয়তো নয়, কিন্তু সাংস্কৃতিক বিকাশের ক্ষেত্রে একটা উত্তরণের দশক তো বটেই। সব ধরনের সাহিত্য-শিল্পকলায় নতুনত্বের বিবর্তনের শুরুর সে কালে সিনেমাতেও আঙ্গিকগত ও কনসেপ্টগত একটা পরিবর্তন এসেছিল। সমান্তরাল সিনেমার যে প্রেক্ষিত রচনা হয়েছিল ষাট দশকের শেষে মৃণাল সেনের ‘ভুবন সোম’, মণি কাউলের ‘উসকি রোটি’ বা বাসু চ্যাটার্জীর ‘সারা আকাশ’- এর হাত ধরে, সিনেমার সেই নব-তরঙ্গ আছড়ে পড়েছিল কলকাতার স্টুডিও পাড়ার সিনেমা সৈকতেও। বাস্তবোচিত অভিনয়, নীরব অভিনয়, চরিত্রের বোধ অনুযায়ী গঠনমূলক অভিনয়ের নতুন রীতি রপ্ত করার মধ্যে দিয়ে দেশ জুড়ে যে নতুন ভাবের অভিনয়শৈলীর জন্ম হয়েছিল, আমাদের বাংলাতেও তেমনই উত্থান প্রদীপ মুখোপাধ্যায়ের। যাঁর অভিনয় প্রায়োগিক দিক থেকে সর্বজনগ্রাহ্য, সৃজনশীল, চরিত্র অনুযায়ী নিজেকে ভাঙার ক্ষমতা আর অবশ্যই, ভালোবেসে, ভালো ছবিতে ভালো লাগার বুদ্ধিদীপ্ত শুভ্রতায় মোড়া।
আমায় ছেড়ে দে রে দে রে
যেমন ছাড়া বনের পাখি
মনের আনন্দে রে’-
ষাট দশকের শেষ ভাগ থেকে আশির দশক জুড়ে সমান্তরাল সিনেমার উত্থান ও বিস্তার। ‘মেন স্ট্রীম’ সিনেমায় প্রচলিত নাটকীয় অভিঘাতধর্মী অভিনয়রীতি, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের গ্ল্যামার কনসেপ্ট, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, সংলাপ ডেলিভারির স্টাইলিস্টিক রীতি – এ সবের পাশাপাশি যখন সমান্তরাল সিনেমাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতাকে পটভুমি করে সিনেমার কনসেপ্ট, ফর্ম বা ট্রিটমেন্টগত নতুন ধারার ভারতীয় সিনেমাশৈলীর সৃষ্টি হলো, আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃতি পেতে শুরু করলো বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় নির্মিত ছবিগুলোর অভিনয়-শিল্পীরাও। পুনের ফিল্ম ইনস্টিটিউট অথবা দিল্লীর ন্যাশানাল স্কুল অফ ড্রামা ছাড়াও বাংলা, মারাঠা বা মালয়ালী স্টেজ থেকেও সুদক্ষ অভিনেতারা সমান্তরাল সিনেমায় নিজেদের মেলে ধরার সুযোগ পেয়েছিলেন এবং নিজেদের সমান্তরাল অভিনেতা-অভনেত্রী হিসেবে, সর্বভারতীয় তো বটেই, আন্তর্জাতিক স্তরেও স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। এই পটভূমিকাতেই যখন শ্যাম বেনেগাল, মৃণাল সেন, কেতন মেহেতা, অবতার কাউল, সাই পরাঞ্জপে, রবীন্দ্র ধরমরাজ, এম.এস.সথ্যু, অশোক আহুজা, গোবিন্দ নিহালনী প্রমুখদের ছবির সূত্র ধরে আমরা পেয়ে গিয়েছিলাম নাসিরুদ্দিন শাহ, ওম পুরি, শাবানা আজমী, স্মিতা পাতিল, ফারুক শেখ, দিপ্তী নাভাল, অমল পালেকার, মিঠুন চক্রবর্তী, শ্রীলা মজুমদার, মমতা শঙ্কর, ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়, অঞ্জন দত্তদের নবতরঙ্গ সিনেমার সমান্তরাল অভিনয় শিল্পীদের। বাংলা আঞ্চলিক সিনেমায় প্রদীপ মুখোপাধ্যায়র উত্থানের যোগসূত্রও এই পটভূমিকা থেকেই।
মজা করে প্রদীপ মুখোপাধ্যায় বলতেন –‘আমরা যাঁরা সত্যজিতের নায়কদল…আমরা হলাম যুদ্ধ শেষের বেঁচে থাকা কিছু বীর।‘ ("Us Ray heroes… we are the last of the Mohicans”)। এই গম্ভীর গর্বের জায়গাটা খুব উজ্জ্বলতার আভায় উদ্ভাসিত। চিরাচরিত নিও-রিয়্যালিস্ট ভাবনায় ছবি করার ক্ষেত্রে সত্যজিৎ রায় তাঁর কনসেপ্টগতভাবে কিছু পরিবর্তন এনেছিলেন কলকাতা-ত্রয়ী সিনেমাগুলোর মধ্যে দিয়ে। ‘প্রতিদ্বন্দী’ (১৯৭০), ‘সীমাবদ্ধ’ (১৯৭১) এবং ‘জন অরণ্য’ (১৯৭৫)। প্রোটাগনিস্ট হিসেবে তিনটি ছবিতে তিনি তিন নতুন মুখ নিয়েছিলেন- যথাক্রমে ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়, বরুণ চন্দ ও প্রদীপ মুখোপাধ্যায়। গ্ল্যামারহীন, ঠিক যেন সত্তর দশকের নবচেতনার যুবসম্প্রদায়ের বাস্তবোচিত অবয়ব।
সত্যজিৎ রায় তাঁর ছবির চরিত্র চিত্রণের ব্যাপারে খুব খুঁতখুঁতে ছিলেন, সেটা আমরা সবাই জানি। চরিত্রের সাথে মানানসই শরীরিক কাঠামোই শুধু নয়, বুদ্ধীদীপ্ত অভিনয় রীতি চাইতেন তিনি সব অভিনেতাদের কাছ থেকেই। সেদিক দিয়ে প্রদীপ মুখোপাধ্যায় তাঁর অভিনীত প্রথম ছবিতেই একটা আন্তর্জাতিক অবস্থান পেয়ে গিয়েছিলেন। লেখক শংকরের ‘জন অরণ্য’ উপন্যাসকে নিয়ে ১৯৭৫ সালে সত্যজিতবাবু যখন ছবি করার প্রয়াসী হলেন, তখন নিশ্চিন্তে, নির্ভাবনায় ‘সোমনাথ’ চরিত্রটির জন্য প্রদীপ মুখোপাধ্যায়ের ওপর ভরসা রেখেছিলেন তিনি। ‘সোমনাথ’-এর চরিত্রটি নিঃসন্দেহে, একটু জটিল ছিল। শিক্ষিত বেকার চাকরির সন্ধানে ক্লান্ত। তবু রণাঙ্গন ছাড়ে নি। তারপর, বেঁচে থাকার তাগিদে দালালি ও অবক্ষয়িত ব্যবসার মধ্যে অজান্তে ঢুকে যাওয়া, ইচ্ছের বিরুদ্ধ জীবনে compromised হয়ে যাওয়া এমন এক চরিত্র। ধুলিধূসর রাজনৈতিক অবস্থায় ও অবস্থানে নব-উদ্যমের ছবি আঁকার বৃথা চেষ্টায় পিছলে পিছিয়ে যাওয়া এই সোমনাথের চরিত্রের অলিন্দে অলিন্দে দ্বৈততার পরত নিজের বুদ্ধিবিচারে ও শিক্ষাবিচারে সৃজনশীলতায় ভরিয়ে তুলেছিলেন প্রদীপবাবু।
অনন্য লাগে তাঁর অভিনয়ের স্মরণকথায় স্নাত হতে। কত দিনরাত কত বাঙালি চর্চা করেছে ‘দৌড়’ ছবিতে তাঁর অভিনয়ের উচ্চতা নিয়ে! সমরেশ মজুমদারের অনেক গল্পের মতোই রাজনীতি-রঙা সত্তরের যুবসমাজের অসাধারণ দিনলিপি। শঙ্কর ভট্টাচার্যের পরিচালনায় ছবিটি এখনও স্বপ্নিল। জীবনের দৌড়ে বার বার প্রত্যাখ্যাত এক যুবক প্রতিবন্ধী প্রেমিকাকে (অভিনয়ে মহুয়া রায়চৌধুরী) নিয়ে যেন এক রিয়্যাল ফ্যানটাসি দেখে। হয়তো সাগরপাড়ের বালুকাবেলায় ক্রাচ দূরে সরিয়ে দিয়ে দুবাহু মেলে ভালোবাসার শরিক হয়।
‘ঘন শ্রাবণ ধারাএ ছবিতেও সাবলীল প্রদীপ মুখোপাধ্যায়। এ ছবিতেও তিনি অনবদ্য।
যেমন বাঁধনহারা
বাদল-বাতাস যেমন ডাকাত
আকাশ লুটে ফেরে’
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ১৯৮১ সালে তাঁর প্রথম ছবি করলেন –‘দূরত্ব’। মন্দারের চরিত্রটি প্রদীপবাবুর জন্য আজ মিথ হয়ে গেছে। এ ছবিও সত্তর দশকের রাজনৈতিক পটভূমির পরম্পরায় নিষিক্ত। ছবিটির দৃষ্টিভঙ্গী ছিল খুব আধুনিক। মুড খুব কাব্যিক, মেজাজ ছিল নতুনধারার। প্রদীপ মুখোপাধ্যায়ের এই ছবিতে অভিনয় করা আরেক আন্তর্জাতিক অতিক্রান্ত স্তর। পরবর্তীকালে, বিভিন্ন সময়ে নানান উচ্চমানের পরিচালকদের কাছে তিনি হয়ে উঠেছিলেন তাঁদের ছবিতে চরিত্রের রকমফেরের চাহিদাযুক্ত এক অপরিহার্য অভিনেতা। ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘হীরের আংটি’, ‘দহন’ আর ‘উৎসব’ ছবিগুলোতে প্রদীপবাবু তাঁর অসাধারণ অভিনয়ের স্বাক্ষর রেখেছিলেন। প্রদীপবাবুকে বিভিন্ন চরিত্র কাজ লাগিয়েছেন নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায় (‘চপার' -১৯৮৭), অপর্ণা সেন (‘সতী’-১৯৯০, ‘গয়নার বাক্স’- ২০১৩), সন্দীপ রায় (বাদশাহী আংটি – ২০১৪)-এর মতো পরিচালকেরা। সুজয় ঘোষ পরিচালিত হিন্দী ছবি ‘কাহানী-২’ তে ডাক্তার মাইতির চরিত্রে অভিনয় করে সকলের নজর কেড়েছিলেন।
এমন স্বতঃস্ফূর্ত, সহজভাবে অভিনয় ক্ষমতা নিয়ে খুব কম অভিনেতারাই জন্মান। সত্যজিতের ‘শেষ যোদ্ধা’-দের অন্যতম প্রদীপ মুখোপাধ্যায় তাই থেকে গেলেন আপামর বঙালির হৃদয়ের আর্কাইভে।