• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৮ | অক্টোবর ২০২২ | গল্প
    Share
  • স্বরূপ : দিবাকর ভট্টাচার্য



    সে ছিলো এক গভীর কালো রাত। খানিক আগেই ভস্মীভূত হয়ে গেছে তাঁর পরমাত্মীয়ের মৃতদেহ। তিনি বসে আছেন তাঁর ঘরে। এক বিপুল বিশূন্যতায়। সামনের আকাশে অপার জ্যোৎস্নায় ভাসছে প্রকাণ্ড চাঁদ। কেউ যেন পিছন থেকে আলতো করে হাত রাখলো তাঁর কাঁধে। তিনি ঘুরে দেখলেন ঘরের আধো অন্ধকারে এক মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে তাঁর পাশটিতে। আলতো করে হাত রেখেছে সে তাঁর কাঁধটিতে। খুব আস্তে করে সে বলে উঠলো - "আমি আনন্দ। আমি আছি তোমার সঙ্গে।"

    এরপর থেকে সেই আনন্দ তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে অসংখ্য বার। কতোরকম সাজে। কতোরকম ভঙ্গিতে। তিনিও যেন আনন্দের এই সঙ্গটি ছাড়া থাকতেই পারতেন না।

    এইভাবে কেটে গিয়েছিলো বহুকাল। অনেক ঝড়ঝাপটা এসেছিলো তাঁর জীবনে। কঠিন কঠোর অন্ধকার সময়ে তিনি যখন একেবারে একা হয়ে গেছেন তখনও আনন্দ তাঁর পাশটিতে এসে বলেছে - "আমি আনন্দ। তোমার পাশেই আছি।"

    এইভাবে আনন্দ শুধুমাত্র তাঁর নিত্যসঙ্গী নয়, পরমাত্মীয় হয়ে উঠলো।

    এইসময় আনন্দের সংস্পর্শ যেন তাঁকে দিব্য অনুভূতি দিতো।

    কালের নিয়মে বার্ধক্য এলো তাঁর শরীরে। একদিন তিনি খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। রোগশয্যায় লিখতে চেষ্টা করলেন তাঁর শেষলেখা।

    এইসময় আনন্দকে তিনি যেন আর দেখতে পাচ্ছিলেন না। কিন্তু আনন্দ এসেছিলো। ওইঘরে। একান্তে। এসে সে বললো - "আমি এসেছি।" তিনি তাঁর অস্বচ্ছ দৃষ্টি দিয়ে চেষ্টা করলেন তাঁকে ভালো করে দেখতে। সে এবার তাঁর মুখের কাছে গিয়ে বললো- "আমি আনন্দ। আমার দিকে তাকিয়ে দ্যাখো। আমি তোমার পাশটিতেই আছি।"

    উনি এবার একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে বললেন - "তোমার সব পোষাক খোলো দেখি।"

    এইকথা শুনে আনন্দ তাঁর দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। তারপর একটি একটি করে খুলে ফেলতে লাগলো তার সমস্ত পরিধান। শেষে সম্পূর্ণ নিরাবরণ হয়ে সে এসে দাঁড়ালো তাঁর সামনে।

    আধো অন্ধকারে এবার তিনি অপলকে দেখতে থাকলেন তার সম্পূর্ণ নগ্ন দেহটিকে। তারপর খুব ক্ষীণ কন্ঠে বলে উঠলেন - "তুমি তো আনন্দ নও।"

    সে ওই অন্ধকারে সম্পূর্ণ অনাবৃত দেহে একইভাবে নিশ্চুপে দাঁড়িয়ে রইলো।

    তিনি আবার সেই ক্ষীণকন্ঠে বলে উঠলেন - "তুমি আনন্দ নও। তুমি ছলনা। আনন্দের বেশে আমার পাশে এসে দাঁড়াতে এতকাল।"

    তারপর ফের যেন কোনোক্রমে অতি কষ্টে বলে উঠলেন - "আমার সমস্ত জীবন কেটে গেল, তোমাকে জানতেই পারলাম না। ঠিকভাবে তোমাকে জানতে পারলে তবেই তো পাওয়া যায়"- বলে চুপ করে গেলেন তিনি।

    এইবার ছলনা তাঁর দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে তাঁর পাশটিতে এসে বসলো।

    তারপর জিজ্ঞাসা করলো - "কি পাওয়া যায়?"

    তিনি অতি অস্পষ্ট স্বরে বললেন - "ঈশ্বরের স্বরূপ।"

    তারপরেই চিরকালের মতো স্তব্ধ হয়ে গেলো সেই মহান কবির কন্ঠ।



    অলংকরণ (Artwork) : রঞ্জন ভট্টাচার্য
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments